কম্পিউটার, মোবাইল স্মৃতিহত্যা করছে

ইমানুল হক

এক

‘ডব্ল্যু ডব্ল্যু ডব্ল্যু’ শব্দবন্ধটি সত্যজিৎ রায় ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দ নায়ক ছবিতে ব্যবহার করেন বৃদ্ধ ব্যবসায়ীর মুখে৷ তখন তিনি কি জানতেন দুনিয়া একদিন ডব্ল্যু ডব্ল্যু ডব্ল্যু ময় হয়ে যাবে? এবং মনে করানো হবে কম্পিউটার যেন সর্বরোগহর ওষুধ! যদিও এই কথকেরা মনে রাখেননি বা রাখতে চাননি, কম্পিউটার কতকগুলো মূল সমস্যার সমাধান করতে পারবে না৷ মানুষের খাদ্যের জন্য মানুষকে কৃষি কাজ করতেই হবে—এর বিকল্প নেই৷ আসলে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর গোটা দুনিয়া যাতে আমেরিকাময় হয়ে ওঠে তাই ঢক্কানিনাদ শুরু হয়৷ আমেরিকা যা পারে তাই দুনিয়াকে করতে হবে৷ খেতে হবে মার্কিনি, পরতে হবে মার্কিনি, শুনতে হবে মার্কিনি, দেখতে হবে মার্কিনি৷ সিনেমায় চলবে যৌনতা মারপিট, সাহিত্য হবে সাময়িকতাময়৷ জীবন তাৎক্ষণিক প্রবচনময়—মুহূর্তে বাঁচো, নিজের কথা ভাবো, অন্যের জন্য কেবল বোকারা ভাবে৷ তার ফল হয় বিষময়৷ কেউ কখনো ভেবেছিল—ছাত্ররা খুন করবে সহপাঠীকে—ক্যাম্পাস লাইফ শুনবে ক্যাম্পাস ছাত্র মানে এককালে ছিল সাতখুন মাপ৷ আজ সে কথা লোকে মানবে?

দুই

সুপার কম্পিউটার বাড়ছে, বাড়ছে সুপার ডুপার দারিদ্র্যও৷ ভারত মোবাইল ব্যবহারে সারা পৃথিবীতে প্রথম স্থানে৷ কম্পিউটার ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত হারে৷ শপিংমল, বার, রেস্তোরা বাড়ছে ব্যাঙের ছাতার মতো, বাড়ছে অলিতে গলিতে শিক্ষাব্যবসায়ীদের বাংরেজি বিদ্যালয়৷ আর বাবা মা অভিধান ঘেঁটে খুব কঠিন কঠিন নাম বাংলা বের করেছেন, আর পড়ানোর সময় বাংলা মাধ্যম ব্রাত্য৷ দেশে ১১ হাজার কোটিপতি—এটা বিশ্ব রেকর্ড৷ এত অনাহারে মৃত্যুও কোনও দেশে বেশি নয়৷ অভাবে আত্মহত্যার মিছিল ক্রমবর্ধমান৷ আর অদ্ভুতভাবে বাড়ছে অসংখ্য উৎসব৷ পুরনো মেলাগুলি মরছে—সাজানো উৎসব, সরকারি মণ্ডপ সেখানে চোখে পড়ার মতো৷

তিন

খেলা যেমন শুধু আজকাল ক্রিকেটময়, তেমনি শিক্ষা ও সমাজব্যবস্থা আজ কম্পিউটারময়৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সিরিয়াস গবেষণা গুরুত্ব পাচ্ছে না৷ মৌল বিষয়গুলি অবহেলিত হচ্ছে৷ অর্থনীতি ছাত্র পাচ্ছে না, পরিসংখ্যানবিদ্যার সংখ্যাপূরণ হচ্ছে না৷ প্রেসিডেন্সির পদার্থবিদ্যা, রসায়নের আসন অর্থহীনতায় অবসায়িত৷

আইনস্টাইনদের জায়গা নিচ্ছেন বিল গেটস৷ ডালটন-রা তো ডাল (dull) নন, আজও৷ সমস্যা গভীরতর৷ ইন্টারনেট বা আন্তর্জালের নামে হালকা চটুল অগভীর জ্ঞান প্রশ্রয় পাচ্ছে। সফটওয়্যার শিল্পের প্রতি সরকার যতটা নরম, ততটাই কুলিশ-কঠোর কৃষি, চিকিৎসা, গ্রামীণ উন্নয়ন, দারিদ্র দূরীকরণ, বন্যা প্রতিরোধের মতো বিষয়ে৷ আগে দুনিয়া ছিল গো-বাচক, গোধূলি, গোষ্পদ, গবাক্ষ, গবেষণা৷ এমনকী অতিথি শব্দের সংস্কৃত প্রতিশব্দ ছিল গোঘ্ন৷ গোঘ্ন শব্দের অর্থ—গো হনন করা যায় যার জন্য৷ আগে বাড়িতে অতিথি এলে গো বৎস্য খাওয়ানোর রেওয়াজ ছিল৷ এখন দুনিয়া সি-বাচক৷ কম্পিউটার, সাইবার, ক্রিকেট, কর্পোরেট, করাপসন, কনজিউমারিজম৷ কিন্তু কমিউনিজমের কথা সেভাবে কেউ বলছে না৷

চার

তথ্য প্রযুক্তিতে লাভও অনেক৷ অনেক গবেষণা হচ্ছে৷

আবহাওয়া, পদার্থবিদ্যা, গণিত, সমাজতত্ত্ব ইত্যাদি নানা বিষয়ে তথ্য আদান প্রদান করা যাচ্ছে সহজেই৷ কিন্তু স্মৃতিক্ষয় ও ঘটছে বিপুল ভাবে৷ আগে যতগুলি নাম বা টেলিফোন নম্বর মনে রাখতে পারতেন, আজ তা পারেন? যন্ত্র ব্যবহার যান্ত্রিক করে দিচ্ছে৷ চিঠি লেখার পাঠ আগে উঠেছিল এখন চ্যাটাং চ্যাটাং করে চ্যাট করার যুগ৷ মোবাইল বার্তা আজকাল বাড়ছে৷ অতি সংক্ষেপে সম্পর্ক গড়া ও শেষ দুই-ই হচ্ছে৷ ফলে ক্যাম্পাস হত্যালীলা বাড়ছে৷ বাড়ছে অসহিষ্ণুতা৷ কথা বললে অনেক সমস্যার সমাধান হয়, কিন্তু সেদিকে ঝোঁক কমছে৷ আসলে মনোভাব—ব্যবহার করো ছুড়ে ফেলো৷

পাঁচ

বইমেলা আজ হচ্ছে—বিশ বছর পর হয়তো এই আকারে আন্তর্জাল মেলা হবে? ভুল ভাবছেন? দেখা যাক? বই সবচেয়ে বড় বন্ধু—এই শ্লোগান পাল্টালো বলে৷ ভাববেন না, যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা৷ আর দেশের গভীর গভীরতর অসুখ এখন৷

সকল অধ্যায়

১. মিথ ও মিথ্যা নির্মাণ— ইতিহাসের সচেতন ভাষা ও ভাষ্য
২. মিথ ও মিথ্যা : মুসলিম সমাজ ও ইতিহাস
৩. সোভিয়েত বিপ্লব কী দিয়েছিল দুনিয়াকে?
৪. নির্বাচিত যুদ্ধ : বাংলা ও আসাম
৫. ওরা তো জব্দ হবে!
৬. রেপাবলিক
৭. অদৃশ্য জেলখানার উল্লাস
৮. ক্ষুধাতুর চাঁদের গল্প
৯. গো-রক্ষা না গো-সন্ত্রাস?
১০. কত শত সুগান্তি, রূপান্তি মরলে তবে?
১১. নামের ফেরে
১২. ছি
১৩. আদালত ও বিচারহত্যা : সঞ্জীব ভাট
১৪. ক্ষমতার বিচিত্র মহিমা
১৫. সুপ্রিম ও সুপ্রিমো
১৬. কমিশন নয় অমিশন ক্লিন চিট (Cheat) কোম্পানি
১৭. খারাপ চালের দোকান ও আমাদের চালবাজি
১৮. প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় : কিছু জরুরি প্রশ্ন
১৯. ‘সব খেলার সেরা…’
২০. কম্পিউটার, মোবাইল স্মৃতিহত্যা করছে
২১. বাঙালির জাতীয় উৎসব পয়লা বৈশাখ
২২. গুজরাত মডেল ২০১৪

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন