ইমানুল হক
ক
হেঁটে দেখতে শেখার কবিবাণী বৃথা৷ হাঁটা সহজ৷ দেখাও৷ কিন্তু আরেকরকম ভাবে? বলা সহজ, করা কঠিন৷ পা তো আসলে হাঁটে না৷ হাঁটায় মন৷ মনন৷ মানসিকতা, দর্শন, জীবনভাবনা৷
যাঁর যেমন জীবনভাবনা তাঁর তেমন চলা৷
আমাদের চলার পথের দর্শন, ‘আহা পিঁপড়ে ছোট পিঁপড়ে ঘুরুক দেখুক থাকুক/কেমন যেন চেনা লাগে’, গোছের অনুকম্পায় ভরা৷
তাই সংখ্যালঘু জীবন ব্রাত্য৷ প্রায় সব প্রান্তেই৷ কাছে এলে চোখে পড়ে৷ বাকি সময় না৷ নেতাদের গালি দেওয়া দস্তুর, তবু তাঁরা ভোট পরবে সংখ্যালঘুদের খেয়াল করেন, শহিদ হতে ডাকেন৷ বাকি জনতা—তাও না৷ বড় সংবাদমাধ্যম দূরে থাকুক, ছোট পত্র-পত্রিকা, সাময়িক পত্রিকা—সবাই খুব বেশি হলে ‘রিলিফে’ আগ্রহী৷ ঘটনা-দুর্ঘটনায় তাঁরা নাড়া খান৷ দাঙ্গা-গণহত্যার ত্রাণে এঁরা অনেকেরই থাকেন৷ কিন্তু বাকি সময়?
ওরা কোথায় আর আমরা?
ওরা থাকে ওধারে!
খ
দীপঙ্কর চক্রবর্তী, ‘অনীক’ ২০১৩-তে জানুয়ারি মাসে। সম্পাদক, অকুতোভয়, দলহীন কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবী দীপঙ্করদা প্রয়াত৷ পরদিন ১০টা নাগাদ যাওয়া হয়েছে ‘পিস হেভেনে’৷ দীপঙ্কর চক্রবর্তীকে লালসেলাম দেওয়ার মানুষ প্রায় জুটলো না৷ ছ’জন মানুষ সাড়া দিলেন শ্লোগানে৷ লাল পতাকাও বিছিয়ে দেওয়া যায়নি শরীরে৷ ওখান থেকে খানিকটা মন খারাপ নিয়ে ফিরছি৷ সঙ্গে ছিলেন শিল্পোদ্যোগী সমর নাগ৷ থমকে দাঁড়ালেন তিনি৷
দ্যাখো কী বিক্রি হচ্ছে দোকানে?
তাকাই৷ গাছের তলায় ছ’টি বস্তা৷
তাতে রাখা ছ’রকম চাল৷
১. পোড়া চাল
২. আধপোড়া চাল
৩. ছাতা পড়া চাল
৪. মাটি কাঁকর মেশানো চাল
৫. আসবেস্টস/পাথরের টুকরো মেশানো চাল
৬. ধুলোবালি মেশানো চাল
—এগুলো রাখা কেন?
—বিক্রি হয়? বোকা বোকা ঠেকবে জিজ্ঞাসাটা বুঝতে পারি উত্তরে৷
—বিক্রি না হলে কি সাজিয়ে রেখেছি? ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া৷
৪১ রফি আহমেদ কিদওয়াই রোডে, ‘শিব গঙ্গা’ দোকানের নাম৷ সেসব জেনে আসি এর ক’দিন পরে৷ রমজানের উপোসের আনুষ্ঠানিক দিনের সূচনা সন্ধ্যায়৷
আগের দিন জানা হয়নি সে সব৷
বিক্রির পরিমাণ? অনেক৷ পড়ে থাকে না কিছুই৷ যেমন সেদিন বিক্রির জন্য পড়েছিল না কিছুই৷
কোনো গুদাম ফোন করে জানালে কিনে আনা হয় বেচার জন্য৷
কেনার দাম জানা যায়নি৷
বেচার দাম? ১৫-২০ টাকা৷
অর্ধাহারে-অনাহারে থাকা মানুষরা কিনে নিয়ে যান সেসব চাল৷
বেছে নিয়ে খায়, ভালো, বুঝলেন, বলেন মালিকের আসনে থাকা বান্টি আগরওয়াল৷
বাজারে মিনিকিট চাল ৩২ টাকা কেজি৷
আর ভদ্রলোকেরা খান ৪৪-৪৮ টাকা দামের চাল৷ বাঁশকাটি ইত্যাদি৷
গ
জগদীশচন্দ্র বসু রোড, লোকে যাকে এ জে সি রোড ডাকে, সেই এ জে সি রোড এলাকায় নোনাপুকুর ট্রাম ডিপোর কাছে, অধুনালুপ্ত ‘যুগান্তর’—‘অমৃতবাজার’কে ডানহাতে রেখে ইলিয়ট রোড ধরে ট্রাম লাইন বেয়ে গেলে দেখা মিলবে রফি আহমেদ কিদওয়াই রোডের৷ উত্তরদিকের হাতছানিতে এগোলে ত্রিকোণ পার্ক পেরনোর মুখে রাস্তার বাঁ পাশে শিব গঙ্গা স্টোর্স৷
শিব গঙ্গা স্টোর্স পেরোলে পাবেন ফলের দোকান, উল্টোদিকে সামান্য দূরে মদের বিপণি৷ শিব গঙ্গার পাশে কয়েকটি দোকান ছাড়িয়ে দুধের বড় কড়াইয়ে দুধ ফুটতে দেখবেন৷ এক গ্লাস ১২ টাকা৷ সেখানে মেলে রাবরি, দুধ লাচ্ছা, মেওয়া, খোওয়া ক্ষীর, সুস্বাদু পনির৷
আর খারাপ চালের দোকান থেকে সামান্য দূরেই কলকাতার নামী তিনটি খাবারের দোকান৷
এক৷ আলোয়ার সহযোগী রেস্তোরাঁ আরাফত৷ যাদের নরম তুলতুলে দই ধনে পাতার যুগলবন্দী মাখন নরম কাবাব কলকাতা সেরা৷ (তাকে ডান পাশে রেখে এগোলেই কংগ্রেসের একদা সদর দপ্তর ছাড়িয়ে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট, যেখানে ভোটে সি পি এম জেতে না)৷
দুই৷ কস্তুরী (এর কাছ থেকে বাংলাদেশে যাওয়ার টিকিট মেলে)
তিন৷ রাঁধুনি৷ (কিছুটা এগোলেই ফ্রি স্কুল স্টিটে দমকল দপ্তর, খাদ্য দপ্তর এবং কলকাতা পুরসভা)৷
ঘ
ফতিমা, সালেহা বা তাঁদের বরেরা আধপোড়া-পোড়া ছাতা পড়া চাল ধুয়ে রান্না করবেন, সঙ্গে থাকবে মুরগির ফেলে দেওয়া ঠ্যাংয়ের হলুদ মাখা ঝোল৷
সালেহা কাগজ কুড়ানি৷ প্লাস্টিকও কুড়ান৷ ভ্যাট বা রাস্তার ধারে পড়ে থাকা কাগজ-প্লাস্টিক কুড়ানো তাঁর কাজ৷ সারাদিন ৩০-৪০ টাকা আয়৷ সব দিন জোটে না তাও৷ ছেলেকে কাজ করতে দিয়েছেন চায়ের দোকানে৷ সুন্দরবন ছেড়ে এসেছিলেন সুখের আশায়৷ সুখ মেলেনি৷ জুটেছে আধপোড়া চাল৷
অকাল জরা তাঁর শরীরে৷ তাঁদের পেরিয়ে রেস্তোরাঁয় যাব৷ এবং মাঝে মাঝে পিস হাভেনে৷ এবং আমরা এ সব দেখেও দেখব না কেন না, খিদে কোনও সামাজিক সমস্যা নয়৷
পুনশ্চঃ দু-টাকা কেজি চাল অথবা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার কেন প্রয়োজন— বোঝা যায় কিছু?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন