অভীক সরকার
৭৪৯ খ্রিস্টাব্দ৷ নালন্দা মহাবিহার, পাটলিপুত্র, মগধ৷
.
‘এই ভাবে চলতে পারে না৷ আর কতদিন, আর কতদিন আমাদের এই অত্যাচার সহ্য করে যেতে হবে লোকেশ্বর মৎস্যেন্দ্র?’ ক্রুদ্ধস্বরে প্রশ্ন করলেন মহাযোগী কাহ্ন৷
কয়েকদিন আগে নিজের চোখে যে ধ্বংসলীলাটি দেখে এসেছেন, এইমাত্র সবার সামনে সে কাহিনি বলেছেন মৎস্যেন্দ্রনাথ৷ সভার পরিবেশ এখন অগ্নিগর্ভ৷ ক্ষোভে ও ক্রোধে ফুঁসছেন প্রতিটি সভ্য৷ স্থির বসে আছেন আচার্য শান্তরক্ষিত৷ সচরাচর যিনি সামান্য লঘু মেজাজে থাকেন সেই পদ্মসম্ভবও চুপচাপ৷ প্রৌঢ় ক্ষত্রিয় মেরুদণ্ড সোজা করে বসে আছেন, যেন আদেশমাত্রে যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত৷
উঠে দাঁড়ালেন ভিক্ষুণী মন্দর্ভা! উত্তেজনায় সর্বাঙ্গ কাঁপছে তাঁর, ‘আচার্য, আপনি এখনও শান্ত হয়ে বসে আছেন? আপনি এখনও বলবেন অপেক্ষা করতে? এখনও বলবেন উপযুক্ত সময় আসেনি? এখনও বলবেন যে, হঠকারিতার ফল ভালো হয় না? অনুমতি দিন আচার্য, দীর্ঘদিন ধরে প্রান্তিক মানুষজনের মধ্যে, দেশের প্রাকৃতজনের মধ্যে আমরা গোপনে যে সংগঠন গড়ে তুলেছি তাদের বলি অস্ত্রধারণ করতে৷ ভেসে যাক, পুড়ে যাক, জ্বলে ছাই হয়ে যাক এই মৃত্যুভূমি৷’ জোরে জোরে শ্বাস ফেলছিলেন৷
উঠে দাঁড়ালেন অনেকেই, প্রত্যেকেই উত্তেজিত ও ক্রুদ্ধ৷ কোলাহলে কারও কথাই স্পষ্ট করে শোনা যাচ্ছিল না৷ এবার উঠে দাঁড়ালেন আচার্য শান্তরক্ষিত। দুহাত তুলে প্রত্যেককে শান্ত হতে বললেন৷
‘না, ভিক্ষুণী মন্দর্ভা!’ সহোদরাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘অপেক্ষার কাল শেষ হয়েছে, সেই জন্যেই এই সভা আহ্বান৷ যে উদ্দেশে আমি আমার প্রিয়শিষ্য কমলশীলকে সুদূর তিব্বতে পাঠিয়েছিলাম, তা সফল হয়েছে৷ চূড়ান্ত আঘাত হানবার এবার সময় এসেছে৷ আমাদের প্রস্তুত হতে হবে৷’
‘আচার্য, কোন উদ্দেশে কমলশীলকে তিব্বতে পাঠিয়েছিলেন—জানতে পারি?’ এই প্রথম কথা বললেন সেই ক্ষত্রিয়পুরুষ৷
কিছুক্ষণ মৌন থাকলেন আচার্য শান্তরক্ষিত৷ তারপর মুখ তুলে বললেন, ‘খুলেই বলি তাহলে৷
‘আপনারা জানেন যে, এই মুহূর্তে বঙ্গদেশের সিংহাসনে আসীন এক উন্মাদ ও কামলোলুপা রানি৷ যদিও প্রকৃতপক্ষে আসল ক্ষমতা প্রকাশচন্দ্র নামের সেই ঐন্দ্রজালিকটির হাতে৷ নির্বোধ রানিকে হাতের পুতুল সাজিয়ে এই রাজত্ব তিনিই ভোগ করছেন৷
এই প্রকাশচন্দ্র প্রেতসিদ্ধ পুরুষ৷ তিব্বতী পোন ধর্মের পুরোহিতদের কাছ থেকে জটিল সব পিশাচসাধনা শিখে এসেছেন তিনি৷
শোনা যায় মহাচীনের কোনও এক মন্ত্রসিদ্ধা রাজ্ঞীর কাছে বহুবিধ অলৌকিক শক্তি প্রাপ্ত হয়েছেন তিনি। এছাড়াও তাঁর কিছু নিজস্ব জন্মলব্ধ অতিপ্রাকৃত ক্ষমতাও আছে।
তিব্বতের রাজদরবারের সামন্তদের যে অংশটি তীব্রভাবে ভারত তথা বৌদ্ধ বিরোধী, তাদের সঙ্গে প্রকাশচন্দ্রের গোপন ষড় আছে৷ আজ থেকে নয়, প্রায় পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে৷’
‘পঞ্চাশ ষাট বছর ধরে?’ অত্যন্ত বিস্মিত হলেন সিদ্ধাচার্য ঢেণ্ঢন, ‘তাহলে তাঁর বয়স কত? তাঁকে দেখলে তো বৃদ্ধ বলে মনে হয় না!’
‘সেটাই তো আশ্চর্যের কথা মিত্র ঢেণ্ঢন! গণনা করে দেখলে আজ প্রকাশচন্দ্রের বয়স হওয়া উচিত একশোর কাছাকাছি৷ অথচ তাঁকে দেখলে তাঁর বয়স চল্লিশ বা পঞ্চাশ মনে হয়৷’
‘তোমরা যত সাধারণ ভাবছ, ইনি তত সাধারণ মানুষ নন৷’ গম্ভীরমুখে বললেন মৎস্যেন্দ্রনাথ৷ ‘শুধুমাত্র প্রেতসাধনায় এই ক্ষমতা জন্মায় না৷ অষ্ট-মহাসিদ্ধি ভিন্ন এই শক্তি অর্জনের ক্ষমতা কারও নেই৷ তার উপর ইনি দশ উপসিদ্ধিতে মহারথী৷ কোনো এক অজানা পৈশাচী প্রকরণে ইনি নিজের আয়ুবন্ধন করে রেখেছেন৷ জৈবিক নিয়মে এঁর বয়সও বাড়বে না আর অপঘাত মৃত্যু ব্যতীত এঁর মৃত্যুও হবে না৷’
সবাই চুপ করে রইলেন৷ পুনরায় বলতে শুরু করলেন মহাযোগী মৎস্যেন্দ্রনাথ, ‘যে রানিকে প্রকাশচন্দ্র রাজাসনে বসিয়েছেন, ইনিও কোনও সামান্য নারী নন৷ বেতালসিদ্ধ প্রকাশচন্দ্রের ভৈরবী ইনি, তাঁর পিশাচসাধনার সঙ্গিনী৷ এঁরও সাধনলব্ধ ক্ষমতা কম নয়৷
এই রানি যে শুধু অত্যন্ত কামলোলুপা তাই নয়৷ প্রতি পূর্ণিমা এবং অমাবস্যায় এই পিশাচীর একটি করে নতুন যুবক চাই, চাই তার রাতের কামতৃষ্ণা মেটাতে৷ আর তারপর যা হওয়ার তাই হয়৷’
‘কী হয়?’ প্রশ্ন করলেন পদ্মসম্ভব৷ ভ্রুকুটি করে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন মন্দর্ভা৷
ম্লান হাসলেন আচার্য, ‘পরের দিন সকালে সেই হতভাগ্যের মৃতদেহ পাওয়া যায় রাজপ্রাসাদের প্রাচীরের বাইরে৷’
কিন্তু—, প্রশ্ন করলেন পদ্মসম্ভব, ‘কিন্তু সব জেনেশুনেও যুবকরা বারবার কেন যায়?’
‘যায় রাজা হওয়ার লোভে৷’ তিক্তস্বরে বললেন ক্ষত্রিয় পুরুষটি, ‘রাজ্যে ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে, যে যুবক একটি পূর্ণ রাত্রি এই নারীকে রতিরমণে তৃপ্ত করে পরদিন প্রভাত অবধি জীবিত থাকবে, সেই হবে বঙ্গদেশের পরবর্তী সম্রাট। রানি আর রাজত্ব একসঙ্গে পাওয়ার লোভে কত শত যুবকের যে প্রাণ গেছে—তার কোনও ইয়ত্তা নেই৷
‘এই প্রকাশচন্দ্র দুটি ভয়াবহ সর্বনাশ করেছেন দেশের৷ প্রথমটি তো আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন৷ দেশের এই অরাজক অবস্থাই তার প্রমাণ৷ ন্যায়ের শাসন বলে কোথাও আর কিছুই অবশিষ্ট নেই৷ বিশেষত দরিদ্র কৃষক এবং অন্ত্যজদের তো কথাই নেই৷ প্রায় না-খেয়ে বেঁচে আছে তারা৷ অপেক্ষাকৃত ধনী যারা, তাদের অবস্থাও সুবিধার নয়৷ গায়ের জোরই এখন ক্ষমতার উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ যে যখন পারছে অন্যের সম্পত্তি গ্রাস করে নিচ্ছে৷’ বলতে থাকেন শান্তরক্ষিত, ‘আর দ্বিতীয়টি আরও সাঙ্ঘাতিক৷
‘পোন ধর্মের যাবতীয় ঘৃণ্য উপচার আর সাধনপদ্ধতি তিনি সদ্ধর্মের নামে, বিজ্ঞানবাদের নামে বৌদ্ধতন্ত্র বলে চালাচ্ছেন৷ এমন অদ্ভুত সব শাস্ত্র লিখেছেন যার বহিরঙ্গে মহাযানপন্থার কথা, অথচ আদতে সেগুলি পোন ধর্মের অশ্লীল সাধনপদ্ধতির আচারসংহিতা৷ এখন এমন হয়েছে যে, বঙ্গভূমির বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে তন্ত্রসাধনার নামে অসভ্য আর ইতর কাজকর্মের বাড়বাড়ন্ত৷ আশ্চর্য ধূর্ততার সঙ্গে পোন ধর্মের মূল সূত্রগুলিকে এদেশের তান্ত্রিক আচার বলে চালিয়ে দিয়েছে প্রকাশচন্দ্র ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা৷’
‘কিন্তু তাতে লাভ কী?’ বিস্মিত স্বরে প্রশ্ন করেন ভন্তে প্রজ্ঞারশ্মি৷
‘সদ্ধর্মকে দুর্বল করা, আবার কী!’ উত্তর দেন শান্তরক্ষিত৷
‘কিন্তু তাতেই বা প্রকাশচন্দ্রের সুবিধা কীসের?’ সংশয় যায় না প্রজ্ঞারশ্মির৷
‘ভুলে যেও না প্রজ্ঞারশ্মি, প্রকাশচন্দ্রকে এই দেশের রাজত্ব পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারে কিন্তু তিব্বতের সামন্তচক্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল৷ তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন গার বংশের তিরিলিং৷ গত পঞ্চাশ ষাট বছর ধরেই তিব্বতে সম্রাট আর সামন্তদের মধ্যে ক্ষমতাদখলের বিবাদ চলছে৷ যেহেতু সামন্তচক্রের বেশিরভাগই পোন ধর্মাবলম্বী, তাই তিব্বতের সম্রাটরা আঁকড়ে ধরেছেন বৌদ্ধধর্ম৷ আরও ভালো করে বলতে গেলে— ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম৷ এই সংগ্রাম যতটা ধর্মীয়, ততটাই রাজনৈতিকও বটে৷ এদেশের বৌদ্ধরা, বৌদ্ধপণ্ডিতরা চিরকালই তিব্বতের সম্রাটদের নৈতিক শক্তি যুগিয়ে এসেছেন৷ তাই বঙ্গভূমিতে সদ্ধর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করা না-গেলে তিব্বতে সম্রাটদের দুর্বল করা যাচ্ছিল না৷’ একটানে এত কথা বলে চুপ করলেন শান্তরক্ষিত৷
‘তবে এই অরাজক অবস্থা আর বেশিদিন নেই৷ আমাদের অভ্যুত্থান এবার শেষ পর্যায়ের জন্য প্রস্তুত, বন্ধুরা৷ শুধুমাত্র দুটি জিনিসের অভাবে আমরা চূড়ান্ত সংগ্রামে নামতে পারছিলাম না, আদিনাথের অসীম অনুগ্রহে আজ সেই দুটিই আমাদের হাতে৷’ প্রসন্নস্বরে বললেন মৎস্যেন্দ্রনাথ৷
‘সে দুটি কোন বস্তু, লোকনাথ?’ প্রশ্ন করলেন মন্দর্ভা৷
‘তিব্বত থেকে যে দুটি বস্তু এত যত্ন করে নিয়ে এলাম তাদের কথাই বলছেন নিশ্চয়ই?’ বলতে বলতে পরনের অঙ্গবস্ত্রটির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটি বড় চামড়ার বটুয়া বের করে এনে আচার্য শান্তরক্ষিতের হাতে দিলেন পদ্মসম্ভব৷ তারপর বললেন, ‘ভ্রাতা কমলশীল একটি পত্রও পাঠিয়েছেন আপনার উদ্দেশে। পত্রটি চৈনিক ভাষায় লিখিত। তবে তার তিব্বতীয় অনুবাদও আছে। রাজপুত্র ঠ্রিসং দেচেন স্বয়ং নিজের হাতে অনুবাদ করেছেন।’
ভ্রুকুঞ্চন করলেন শান্তরক্ষিত। এমন কী গোপনীয় পত্র যা কী না স্বয়ং রাজকুমারকে অনুবাদ করতে হয়, অন্য কাউকে দিয়ে করানো যায় না?
তিব্বতী লিপি স্বচ্ছন্দে পড়তে পারেন শান্তরক্ষিত। তিনি পত্রটি নিয়ে পোশাকের মধ্যে রাখলেন। তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ, রাজকুমার৷ এই দুটি দৈবী অস্ত্র ছাড়া প্রাসাদের মধ্যে ঢুকে সেই রানিকে হত্যা করা অসম্ভব৷ তাঁকে ঘিরে থাকে বেতালসিদ্ধ প্রকাশচন্দ্র আর তার ঘনিষ্ট বৃত্ত৷ রানি নিজেও বিষশাস্ত্রে মহাকুশল৷’
‘বিষশাস্ত্রে মহাকুশল মানে? ইনি কি বিষ খাইয়ে মারেন নাকি?’ প্রশ্ন করেন পদ্মসম্ভব৷
কিছুক্ষণ চুপ থাকেন মৎস্যেন্দ্রনাথ৷ তারপর ধীরে ধীরে বলেন, ‘হ্যাঁ রাজপুত্র, চুম্বনবিষ৷ সে বিষের কোনও প্রতিষেধক আমাদের জানা নেই৷ আর সেই বিষকন্যার হাতছানি এড়ায় এমন পুরুষ এ জগৎসংসারে নেই৷’
সবাই চুপ করে গেল৷ ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করলেন পদ্মসম্ভব, ‘কেন প্রভু?’
‘কারণ তিনি মানুষ নন, আর্য৷ তিনি বেতালসিদ্ধ প্রকাশচন্দ্রের নিজের হাতে গড়া এক প্রেতিনীবিশেষ৷ অতি দুর্লভ বিষপিশাচ সাধনায় এই নাগিনীকে তিলে তিলে প্রস্তুত করেছেন প্রকাশচন্দ্র৷ চৌষট্টি কামকলায় মহাসিদ্ধা তিনি৷ অজগর যেমন অনায়াসে নির্বোধ ছাগশিশু উদরসাৎ করে, তেমন ভাবেই হতভাগ্য লোভী যুবকদের গ্রাস করেন এই রানি৷ রাত্রিভর নিরবচ্ছিন্ন কামকেলির পর হতভাগ্য যুবক যখন ভাবে—এই তো, আর তো কয়েকটি মুহূর্তমাত্র, তারপরেই সে বঙ্গদেশের একচ্ছত্রাধিপতি সম্রাট৷ আর ঠিক তখনই সেই রানি আবার কণ্ঠলগ্না হন তাঁর, দয়িতকে নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরেন…আর তারপর…’
‘তারপর কী, লোকেশ্বর?’ শ্বাস বন্ধ করে প্রশ্ন করেন পদ্মসম্ভব৷
‘তারপর সেই নাগিনী চুম্বনের ছলে শরীরে জমে থাকা সমস্ত পাপ, সমস্ত হিংসা, সমস্ত ক্রোধ সেই হতভাগ্যের শরীরে ঢেলে দেন৷’
নিস্তব্ধ সভা, সূঁচ পড়া নৈঃশব্দ্য৷
‘কিন্তু এই প্রকাশচন্দ্র যখন রাজত্ব দখলে চেষ্টা করছিলেন, তখন তাঁকে আটকাবার চেষ্টা করেনি কেউ?’ প্রশ্ন করলেন একজন গৌরবর্ণ তরুণ৷
‘হ্যাঁ মিত্র গোরক্ষ, করেছিলেন অনেকেই৷’ গম্ভীরমুখে বললেন আচার্য শান্তরক্ষিত,’ তবে তাঁদের মধ্যে একজনই সোচ্চার প্রতিবাদের মুখ হয়ে উঠেছিলেন৷ তিনি ছিলেন সেই সভার রাজপণ্ডিত এবং তৎকালীন বঙ্গসম্রাট রাজভটের ঘনিষ্ট বয়স্য৷ প্রখর জ্ঞানের অধিকারী সেই মানুষটি প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন এই সর্বনাশ আটকানোর৷ তিনি অবশ্য শেষ পর্যন্ত সফল হননি।
তবে আমি মনে করি, যিনি এই বিষয়ে সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন তাঁকেই অনুরোধ করছি বিস্তারিতভাবে বলবার জন্য।’ এই পর্যন্ত বলে ক্ষত্রিয় পুরুষটির দিকে ফিরলেন আচার্য শান্তরক্ষিত, ‘আর্য বপ্যট, আপনিই এ ব্যাপারে যা বলার বলুন৷’
নামটি শোনামাত্র সভায় উপস্থিত সভ্যদের মধ্যে কৌতূহলের ঢেউ খেলে গেল৷ প্রতিটি মানুষ উদগ্রীব হয়ে চেয়ে রইলেন এই প্রৌঢ়ের দিকে৷
উঠে দাঁড়ালেন সেই মহাবলশালী প্রৌঢ় ক্ষত্রিয়৷ নম্রসুরে বললেন, ‘আচার্য আমার থেকে বয়সে ছোট হলে কী হবে, জ্ঞানে বয়োবৃদ্ধ বটে৷ ফলে তাঁর আদেশ শিরোধার্য৷ তবে যে কাহিনির কথা তিনি বলতে চেয়েছেন সে অনেকাল আগের কথা৷ আমি নিজে তখন দশ বছর বয়সি এক বালক মাত্র৷ তবে সেইদিন থেকে যে অপমানের বোঝা আমাকে সারা জীবন বয়ে চলতে হয়েছে তার তুলনা নেই৷’
‘আপনি কে?’ সটান প্রশ্ন করলেন পদ্মসম্ভব৷
এইবার ভিক্ষুণী মন্দর্ভার রাগত চক্ষু দেখে মনে হল যেন এই প্রগলভ রাজপুত্রকে এখনই চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে সুরধুনী গঙ্গায় বেশ ভালো করে চুবিয়ে আনতেন৷
‘আমি কে?’ কৌতুকস্বরে প্রতিপ্রশ্ন করলেন সেই ক্ষত্রিয়টি, ‘তাহলে শুনুন রাজকুমার, আমার নাম বপ্যট৷ আমি একজন যুদ্ধব্যবসায়ী৷ আমার পিতার নাম আচার্য দয়িতবিষ্ণু৷’
সভাস্থল স্তব্ধ৷ যোগী ঢেণ্ঢন বিস্মিতস্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘দয়িতবিষ্ণু? মানে পণ্ডিতপ্রবর দয়িতবিষ্ণু? সর্ববিদ্যাবিশুদ্ধ দয়িতবিষ্ণু? খড়্গসম্রাট রাজভটের সেই কূটবুদ্ধি ব্রাহ্মণপুরুষ?’
‘হ্যাঁ মিত্র, তিনিই৷’ স্মিতহাস্যে উত্তর করলেন বপ্যট৷
‘কিন্তু তিনি…তিনি তো শাস্ত্রাধ্যায়ী ব্রাহ্মণ ছিলেন, আচার্য ছিলেন!’ উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ান গোরক্ষ নামের গৌরবর্ণ তরুণটি, ‘তাঁর সন্তান কী করে ক্ষত্রিয় যুদ্ধব্যবসায়ী হয়?’
‘সেই কাহিনিটি খুলে বলার জন্যেই তো আমাকে এখানে ডাকা হয়েছে, মিত্র গোরক্ষ।’ বপ্যটের কণ্ঠ বড়ই শান্ত, ‘আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে সম্রাট বলভটের রাজসভায় যে রহস্যসূত্র আমার পিতৃদেব বিছিয়ে দিয়ে এসেছিলেন, আজ আমি সেই সুতোগুলি যথাযথভাবে গুটিয়ে রাখতে এসেছি৷’
মহর্ষি মৎস্যেন্দ্রনাথের প্রিয়তম শিষ্য গোরক্ষনাথ বিভ্রান্তমুখে নিজের আসনে বসে পড়লেন৷ উৎসুক হয়ে রইলেন বাকি সভ্যরা৷
‘সম্রাট বলভটের সেই সভায় কী হয়েছিল, তার প্রতিটি খুঁটিনাটি আপনারা প্রত্যেকে জানেন৷ সভার সেই কাহিনি পল্লবিত হতে হতে এখন প্রায় রূপকথা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আপনারাও জানেন—কোন অপবাদের বোঝা মাথায় দিয়ে আমার পিতৃদেবকে সেই রাজসভা থেকে বিতাড়িত করা হয়৷’
‘শুধু পণ্ডিত দয়িতবিষ্ণু কেন? সেই সভার পরপরই বিতাড়িত হন মহামাত্য বুদ্ধকীর্তি, তাঁকে নির্বাসিত করা হয় বঙ্গদেশের একদম দক্ষিণে, এক অস্বাস্থ্যকর পল্লীতে৷ পণ্ডিত দয়িতবিষ্ণুকে নিরাপদে বঙ্গদেশের সীমান্ত পার করে দিয়ে ফেরত আসার পথে গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হন সৈন্যাধ্যক্ষ আনন্দদত্ত৷ দণ্ডনায়ক বিশালকীর্তির প্রকাশ্যে মুণ্ডচ্ছেদ করা করা হয় দেশদ্রোহিতার অপরাধে৷’ বলতে বলতে কণ্ঠরোধ হয়ে গেল মহর্ষি মৎসেন্দ্রনাথের৷
সমগ্র সভাস্থল প্রস্তরস্তব্ধ৷
‘আপনারা এ-ও জানেন যে সেই সভায় আমার মা, পুণ্যশ্লোকা ভদ্রকল্যাণীদেবীর নামে খুবই অশ্লীল অভিযোগ তোলা হয়৷ বলা হয় যে, তিনি নাকি আমার পিতৃদেবের প্ররোচনায় সম্রাট রাজভটের অঙ্কশায়িনী হন৷ আমি সেই অবৈধ মিলনের ফল৷’
এ কথা বলার সময়েও কোনও অস্থিরতা প্রৌঢ় যোদ্ধাটির কণ্ঠে ফুটে ওঠে না। বোধহয় সারা জীবন ধরে প্রকাশ্যে বা ইঙ্গিতে এইসব কথা শুনতে তাঁকে আজ আর গ্লানি স্পর্শ করে না।
‘সে কাহিনিও তো আমাদের জানা, ক্ষত্রশ্রেষ্ঠ বপ্যট৷ আমরা এও জানি, যে আর্যা ভদ্রকল্যাণী আপনার গর্ভধারিণী নন৷ ফলে অসতীত্বের পাপ তাঁর ওপর অর্শায় না৷ তবে কে আপনার মাতা, ক্ষত্রশ্রেষ্ঠ বপ্যট? দয়া করে সে বিষয়ে কিছু আলোকপাত করুন।’ অনুরোধ আসে এক অত্যন্ত শান্ত ও ধীরস্বভাব সভ্যের কাছ হতে৷ হরিদ্রাভবর্ণ পুরুষটির নাম জালন্ধর৷
‘বলছি, মিত্র জালন্ধর৷ আজই এই রহস্যের উন্মোচনের হবে৷ অনেক লম্বা কাহিনি, আমি সংক্ষেপে বলছি৷’
‘আমার মা যখন গর্ভবতী হন, তার কিছুকাল আগে সম্রাট রাজভট বরেন্দ্রীতে আসেন৷ আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যে রাজমাতা প্রভাবতীদেবী কৈবর্ত-প্রধানের মেয়ে ছিলেন৷ যদিও বরেন্দ্রী সম্রাটের রাজ্যের মধ্যে পড়ত না, তবুও তিনি কোনও এক বিশেষ রাজনৈতিক কারণে এসেছিলেন৷ সেই কারণ এতদিন পর জানবার আর কোনও উপায়ই নেই৷
‘সেখানে এক কৈবর্তকন্যার সঙ্গে সম্রাটের প্রণয় হয়৷ প্রায় মাসখানেক ধরে সেই ঘোর প্রণয়পর্ব পার করে সম্রাট রাজভট তাঁর রাজ্যে ফিরে যান, প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান—শীঘ্রই তিনি ফিরে এসে সেই মেয়েটিকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে নিয়ে যাবেন রাজ-অন্তঃপুরে৷
‘সম্রাট রাজভট তখনই বিবাহিত, অসামান্য সুন্দরী তিব্বতরাজকান্তা তাঁর ঘরণী৷ বিবাহের পর শ্যালক চারুদত্তকে তিনি রাজসচিব পদে নিয়োগ করেছেন৷ স্ত্রী ও শ্যালকের প্রবল চাপে সম্রাট রাজভট পিছিয়ে এলেন তাঁর প্রতিশ্রুতি থেকে৷ দূত পাঠিয়ে তিনি সেই অভাগা কৈবর্তকন্যাকে জানিয়ে দিলেন যে, তিনি তাঁকে বিবাহ করতে পারছেন না৷’
সভার সবার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন বপ্যট, তারপর বলতে লাগলেন, ‘সম্রাটের দূত যখন বরেন্দ্রী পৌঁছয়, তখন সেই কৈবর্তকন্যা গর্ভবতী৷ কৈবর্তসমাজে এ নিয়ে বিপুল ক্ষোভ ও বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে৷ সে সংবাদ সম্রাটের কাছে পৌঁছতে দেরি হয়নি৷ তখন ত্রাতা হয়ে দাঁড়ান আমার পিতৃদেব৷ তাঁরই বুদ্ধিতে তখনকার মতো পরিস্থিতি সামলানো সম্ভব হয়৷’
‘কীভাবে?’ উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করেন ভন্তে সিংহহনু৷
‘আমার মা ভদ্রকল্যাণীদেবীর পিতৃগৃহ ছিল বঙ্গভূমি আর বরেন্দ্রীর সীমান্তে, কুমারহট্ট বলে একটি বর্ধিষ্ণু গ্রামে৷ প্রসবের সময় আমার মা সেখানেই ছিলেন৷ অতি গোপনে সেই কৈবর্তকন্যাকে বরেন্দ্রী থেকে আমার মামার বাড়িতে আনা হয় এবং সেখানেই তাঁর সেবাযত্ন হয়৷
‘দৈবী অনুগ্রহে আমার মা এবং সেই অনামা কৈবর্ত রমণী একই দিনে সন্তান প্রসব করেন৷ ভাগ্যদোষে আমার মায়ের একটি মৃতসন্তান জন্মায়৷ আর কৈবর্ত রমণীটি একটি অতি সুস্থ ও সবল পুত্রসন্তানের জন্ম দেন৷’
‘কে সেই পুত্রসন্তান?’ রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করলেন ভিক্ষুণী মন্দর্ভা৷
‘সে আজ আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, আর্যা৷’ ম্লান হেসে জানালেন বপ্যট, ‘আমিই সেদিনের সেই বেঁচে থাকা শিশু৷ সম্রাট রাজভটের সন্তান আমি৷ তাঁরই ঔরসে, এই দেশের এক সাধারণ রমণীর গর্ভে আমার জন্ম৷’
সমস্ত সভাগৃহে অস্বাভাবিক নীরবতা৷ একমাত্র মৎস্যেন্দ্রনাথ ছাড়া বাকিরা প্রত্যেকে প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে কাহিনিটি পরিপাক করার চেষ্টা করছেন৷
‘আর্য বপ্যট, আপনার কাহিনিটি শুনলাম,’ অত্যন্ত গম্ভীরমুখে প্রশ্ন করেন পদ্মসম্ভব, যা একেবারেই তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ, ‘শুধু একটি মাত্র প্রশ্নের উত্তর দিন আমাকে। আপনি তো সম্রাট রাজভটের সন্তান৷ তবুও বার বার আপনি আচার্য দয়িতবিষ্ণু এবং আর্যা ভদ্রকল্যাণীকেই নিজের পিতামাতা বলে উল্লেখ করছেন কেন?’
‘কারণ আমি মনে করি আমার আসল পিতা আচার্য দয়িতবিষ্ণু এবং মাতা আর্যা ভদ্রকল্যাণী, যাঁরা আমাকে অপার স্নেহ এবং ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করেছেন৷ সম্রাট রাজভট কোনওদিন আমাকে তাঁর সন্তান হিসাবে স্বীকৃতি দেননি, আর আমার গর্ভধারিণীকে তো কোনওদিন চোখেই দেখলাম না৷ দয়িতবিষ্ণু বা ভদ্রকল্যাণী, কেউই কোনওদিন আমাকে অন্যের সন্তান বলে ভেদবিচার করেননি, নিজের সন্তানের মতো মানুষ করেছেন৷ তাঁদের আমার পিতামাতার সম্মান না দিলে যে মহাপাতকী হব!’
‘আপনি ধন্য, আর্য বপ্যট,’ সহর্ষে বলে উঠলেন পদ্মসম্ভব, ‘সেই গর্ভ ধন্য—যা আপনাকে নয়টি দীর্ঘ মাস ধারণ করেছিল; সেই স্তন্যসুধা ধন্য—যা আপনাকে জীবনদান করেছে৷ একজন নয়, দুই-দুইজন বঙ্গমায়ের কোল আলো করেছেন আপনি৷ আপনার মতো সৌভাগ্যবান আর কে আছেন, আর্য বপ্যট?’
‘সেই কৈবর্তকন্যার কী হল? কোথায় গেলেন তিনি?’ স্তব্ধতা ভঙ্গ করে প্রশ্ন করেন মন্দর্ভা৷
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বপ্যট, ‘জানি নে ভদ্রে৷ তাঁকে আমি কোনওদিনও দেখিনি৷ আমার জন্ম দিয়ে তিনি নিঃশব্দে মিশে গেছিলেন তাঁর সমাজে, লোকলজ্জার থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যই নিশ্চয়ই৷ পিতা দয়িতবিষ্ণু যখন খড়্গ রাজসভা থেকে বিতাড়িত হয়ে বরেন্দ্রীতে ফিরে আসেন, তখন গোপনে অনেক বার তাঁর খোঁজ করেছিলেন৷ কিন্তু তখন তিনি মিলিয়ে গেছেন বিস্মৃতির অতলে৷ কেউই তাঁর সংবাদ দিতে পারেনি৷ শুধু এইটুকু জেনেছি যে, তাঁর নাম ছিল যশোধরা৷’
‘মিত্র বপ্যট, আপনার কি এখনও কৌতূহল আছে জানার জন্যে যে তিনি কোথায় আছেন? কী করছেন?’ প্রশ্ন করলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ৷
‘নেই বললে মিথ্যা বলা হবে প্রভু৷ এককালে ছিল না৷ কিন্তু এখন এই প্রৌঢ়ত্বের দরজায় এসে মনে হচ্ছে—একবার যদি আমার গর্ভধারিণীর দেখা পেতাম, তাহলে বড় ভালো হতো৷ কৈশোরে বা যৌবনে ভারি অভিমান ছিল তাঁর ওপর৷ এখন আমার বয়স হয়েছে, আজ বুঝি, কোন পরিস্থিতিতে আমাকে ত্যাগ করতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন৷’
‘আজ আমি যদি আপনার গর্ভধারিণীর সঙ্গে আপনার দেখা করিয়ে দিই ক্ষত্রশ্রেষ্ঠ বপ্যট, তাহলে বিনিময়ে কী পুরস্কার আশা করতে পারি?’ সহাস্যে ও সকৌতুকে প্রশ্ন করলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ৷
মুহূর্তে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো কেঁপে উঠলেন বপ্যট৷ তাঁর কঠোর চোখ দুটিতে আশ্চর্য ব্যাকুলতা৷ রুদ্ধ স্বরে তিনি বলে উঠলেন, ‘কী বললেন লোকেশ্বর? অনুগ্রহ করে আবার বলুন! আপনি চেনেন আমার গর্ভধারিণীকে? তিনি বেঁচে আছেন? আপনি জানেন—তিনি কোথায় আছেন? কীভাবে আছেন?’
‘জানি আর্য বপ্যট৷ আমার থেকে ভালোভাবে আর কেউ জানে না৷’ স্থিরোদাত্ত স্বরে উত্তর করলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ৷
‘আপনারা তো জানেন আমার জন্মবৃত্তান্ত৷’ শান্তস্বরে বলতে শুরু করেন মৎস্যেন্দ্রনাথ, ‘জন্মমুহূর্তেই পিতামাতা ত্যাগ করেন আমাকে৷ আমার কৈবর্ত ধাইমা’টি আমাকে লুকিয়ে নিয়ে পালিয়ে আসেন তাঁর নিজের গ্রামে৷ সেখানেই তিনি আমাকে সস্নেহে লালপালন করেন৷ আমার কাহিনিইও আপনার মতোই, মিত্র বপ্যট৷ আজ আমি যে শরীর নিয়ে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, সে শরীরের জন্ম দিয়েছেন একজন, কিন্তু মাতৃস্নেহধারায় পুষ্ট করেছেন অন্য কেউ৷ তাঁকে আমি আমার ঈশ্বরী জ্ঞান করি৷ শুনুন আর্য, আপনি যে হতভাগিনীর স্নেহচ্ছায়া থেকে জন্মাবধি বঞ্চিত, আদিনাথের অসীম অনুগ্রহে তিনিই আমার মাতা৷ আপনাকে হারিয়ে যে আক্ষেপ ছিল তাঁর, সেই দুঃখ ভুলতে আজীবন তাঁর বুভুক্ষু হৃদয়ের সমস্ত স্নেহ ও ভালোবাসা আমার ওপর ঢেলে দিয়েছেন তিনি৷ যে স্নেহসুধাধারা ন্যায্যত আপনার প্রাপ্য ছিল, আজীবন আমিই সেই ঝরনাধারায় স্নান করে এসেছি—হে ক্ষত্রপতি! আমরা একই মায়ের সন্তান!’ ধীর স্বরে বলছিলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ, আবেগে তাঁর চোখ সজল হয়ে উঠেছিল৷
সভায় যেন একটা বিস্ময়, আনন্দ আর উল্লাসের বিস্ফোরণ ঘটে গেল৷ স্তম্ভিত ও বিহ্বলিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন অনেকেই৷ দুহাতে মুখখানি চাপা দিলেন ভিক্ষুণী মন্দর্ভা, মুক্তাবিন্দুর মতো দুফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ল তাঁর অনিন্দ্যসুন্দর আঁখিদুটি থেকে৷ দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের মাথায় আঘাত করলেন পদ্মসম্ভব, আনন্দে, বিস্ময়ে জালন্ধরনাথের হাত চেপে ধরলেন ভন্তে সিংহরশ্মি৷ প্রায় উচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠলেন কাহ্ন, ‘কী আশ্চর্য, কী আশ্চর্য! এ আমি কী শুনলাম! হা ঈশ্বর! এ কী লীলা তোমার৷’ সিদ্ধাচার্য ঢেণ্ঢন দু’হাত মাথার ওপর তুলে আনন্দে নাচতে লাগলেন৷ বিস্ময়বিমূঢ় শাক্যভদ্র বললেন, ‘ধন্য হল এই সঙ্ঘারাম, ধন্য হল এই মহাবিহারের পুণ্যমৃত্তিকা৷ ধন্য হলাম আমরা৷ এবার বুঝলাম যে তথাগত আমাদের সহায়, এই সংগ্রামে আমাদের জয় নিশ্চিত৷’
কোলাহল সামান্য কমে এলে আবার বলতে শুরু করলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ, ‘এখন অনেক বয়স হয়েছে আমার মায়ের৷ প্রবল অসুস্থ তিনি, মৃত্যুশয্যায় শায়িত৷ আর খুব বেশিদিন তিনি বেঁচে থাকবেন না৷’ এই পর্যন্ত বলে থামলেন তিনি, তারপর আবার বলতে লাগলেন, ‘কয়েকদিন আগেই আমার মা তাঁর কাছে ডাকেন আমাকে৷ তিনি জানান যে ডাক এসেছে তাঁর, আর হয়তো কয়েকটা মাত্র দিনের অপেক্ষা৷ জীবনে যা পেয়েছেন আর যা পাননি—তা নিয়ে তাঁর মনে কোনও ক্ষোভ বা বেদনা নেই আর৷ নশ্বর জীবনের যাবতীয় চাওয়া-পাওয়ার ওপারে চলে গেছেন তিনি৷
‘শুধু একটি মাত্র অপূর্ণ ইচ্ছা রয়ে গেছে তাঁর জীবনে৷ সেটি পূর্ণ হলেই শান্তিতে চোখ বুজতে পারেন তিনি৷’
‘কী সেই ইচ্ছা, প্রভু?’ প্রশ্ন করলেন আচার্য শান্তরক্ষিত৷
‘সেই দিনই তিনি আমাকে জানান তাঁর প্রথম যৌবনের কাহিনি; জানান সম্রাট রাজভটের সঙ্গে তাঁর প্রণয়ের গল্প৷ আর্য বপ্যট, তিনি এখনও ভোলেননি তাঁর নাড়ীছেঁড়া রক্তপুত্তলিটিকে, তাঁর প্রথম সন্তানকে৷ তিনি এখনও মনে রেখেছেন আপনাকে৷ তিনি চান মৃত্যুর পূর্বে একবার তাঁর প্রথম সন্তানের মুখদর্শন করতে৷ এবার আপনি বলুন আর্য, আপনি কি সত্যই চান আপনার গর্ভধারিনীর সঙ্গে দেখা করতে?’
কোনও উত্তর করলেন না বপ্যট৷ তাঁর চক্ষু বেয়ে বন্যার মতো নেমে আসছিল চোখের জল৷ ভিজে যাচ্ছিল তাঁর কপাটবক্ষ।
‘তাহলে কথা দিন আর্য, যে মহা-অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা আমরা করেছি আপনি তার নেতৃত্বের দায়িত্ব নেবেন? আপনার শরীরে রয়েছে এই দেশের মাটি ও জলের ঘ্রাণ, রয়েছে এক মহান দেশপ্রেমিক রাজার জন্মবীজ৷ আপনার দেহ, মন, চৈতন্য পুষ্ট হয়েছে সর্ববিদ্যাবিশুদ্ধ পণ্ডিত দয়িতবিষ্ণুর ঘরে৷ আপনি নিজে স্বয়ং এই দেশের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা, খণ্ডিতারাতি বপ্যট৷ হে বপ্যট, রাজভটবংশাদিপতিত সিংহবিক্রম বপ্যট, আমার অনুরোধ—এই অভিযানের নেতৃত্ব স্বীকার করুন৷ আপনিই বঙ্গভূমির যোগ্যতম সম্রাট৷’ বললেন মৎস্যেন্দ্রনাথ৷
সমগ্র সভা উৎকর্ণ হয়ে রইল৷ স্পষ্ট হয়ে গেল, লোকেশ্বর মৎস্যেন্দ্রনাথ কূটনীতির যে চালটি চেলেছেন—তার মার নেই৷ সেইজন্যেই বপ্যটকে এই সভায় ডেকে এনেছেন তিনি৷ অনেক যুদ্ধে সৈন্যদলের নেতৃত্ব করেছেন বপ্যট, এই দেশের সবচেয়ে কুশলী যুদ্ধব্যবসায়ী তিনি৷ তার ওপর তাঁর রক্তে সম্রাটের উত্তরাধিকার বইছে৷ এমন একজনকে প্রজারা পরবর্তী সম্রাট বলে যত সহজে মেনে নেবে, অন্য কাউকে তত সহজে মেনে নেবে না৷ বর্তমান শাসককে উৎখাত করা যত সহজ, ততটাই কঠিন এমন একজন পরবর্তী শাসককে নির্বাচিত করা, যিনি যোগ্য এবং যাঁর রাজসিংহাসনের ওপর নৈতিক অধিকার আছে৷
চারিদিকে একবার তাকিয়ে নিলেন বপ্যট৷ অভিজ্ঞ যুদ্ধব্যবসায়ী তিনি, তিনিও বুঝলেন যে এই আহ্বান এড়াবার উপায় তাঁর নেই৷ তাঁর জননী আর জন্মভূমি, দুজনেই আজ একই সঙ্গে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে আছেন৷ কী করবেন বপ্যট?
চোখ বুজলেন তিনি৷ পিতা দয়িতবিষ্ণু বলে গিয়েছিলেন এই দিনটির কথা; সেই ক্রান্তদর্শী মানুষটি জানতেন যে, এইদিন আসবে, আসবেই৷
‘সেদিন তুমি কী সিদ্ধান্ত নেবে পুত্র?’ শেষশয্যায় শুয়ে যুবক পুত্রকে এই প্রশ্ন করেছিলেন তিনি, ‘দেশের সেবায় সবকিছু উৎসর্গ করবে, নাকি সমস্ত বিপদ থেকে গা বাঁচিয়ে নিরাপদে কাটিয়ে দেবে তোমার জীবন?’
কীই বা আর নিরাপদ আছে এ দেশে? আর অন্য কোন বিকল্প পথই বা থেকে গেছে তাঁর সামনে?
চোখ খুললেন বপ্যট, ধীরস্বরে বললেন, ‘লোকেশ্বর মৎস্যেন্দ্রনাথের অনুরোধ উপেক্ষা করব—এমন সাহস আমার নেই৷ আমার এই সামান্য জীবন যদি দেশের মানুষের সেবায় লাগে, তবে তার থেকে আনন্দের আর কীই বা হতে পারে৷ আমি এই অভ্যুত্থানের সমস্ত পরিকল্পনা ও চূড়ান্ত আঘাতের প্রস্তুতি নিজের হাতে সাজিয়ে দেব৷ রণাঙ্গনে সবার প্রথমে আমিই অধিষ্ঠিত থাকব৷ কিন্তু প্রত্যক্ষ সংগ্রামে ওই বেতালসিদ্ধ প্রকাশচন্দ্র আর কামুক রানিটিকে পরাস্ত করার মতো শারীরিক সামর্থ্য আমার শরীরে আর অবশিষ্ট নেই, হে নাথ৷ তবে তার জন্যে একজন উপযুক্ত অধিকারী প্রস্তুত আছে৷ বঙ্গদেশের সিংহাসনের ওপর তাঁর দাবি আমার থেকে কম কিছু নয়৷ আপনিও তাকে ভালোই চেনেন লোকেশ্বর৷’
মাথা নীচু করে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ৷ তারপর বললেন, ‘বুঝতে পেরেছি বপ্যট, আপনি কার কথা বলছেন৷ তবে তাই হোক৷’
‘তিনি কে আর্য বপ্যট?’ বিস্মিতস্বরে প্রশ্ন করলেন পদ্মসম্ভব৷
‘তিনি কে?’ মৃদু হাসলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ, ‘আসুন রাজকুমার, আমার সঙ্গে আসুন৷ তাঁর সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিই৷’ এই বলে বাকিদের উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘তাহলে আপনারা এখানেই থাকুন৷ চূড়ান্ত সংগ্রামের রূপরেখা তৈরী হোক ভ্রাতঃ বপ্যটের নেতৃত্বে৷ রাজপুত্র, আপনি আমাকে অনুসরণ করুন৷’ এই বলে সভা থেকে অন্য পথে বেরিয়ে গেলেন দুজনে৷
.
৭৪৯ খ্রিস্টাব্দ| পাটলিপুত্রের নিকটবর্তী অরণ্য, মগধ|
.
রাত্রি শেষ হয়ে এসেছে প্রায়৷ গভীর অরণ্যের মধ্যে একটি সংকীর্ণ বনপথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন দুজনে৷
দক্ষিণ-পশ্চিম আকাশে পাণ্ডুর হয়ে এসেছে নবমীর চাঁদ৷ চারিদিকে ঝিঁঝি পোকার শব্দে কান পাতা দায়৷ থেকে থেকে রাতচরা পাখিদের তীক্ষ্ণ ডাক ভেসে আসছে৷ বাতাসের অনর্গল স্রোত গাছের গুঁড়িতে আর লতাপাতায় আটকে ঝিরিঝিরি আওয়াজ তুলছে৷ গাছের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে—এক আশ্চর্য মায়াবী নীলাভ আলো ঘিরে ধরেছে সারা আকাশ৷ আর আকাশ থেকে সেই আদিম নীলাভ অন্ধকার বুড়ো বুড়ো গাছেদের শরীর বেয়ে, পাতার ডগা থেকে টুপটুপ করে অবিরাম ঝরে পড়ছে ভিজে মাটিতে৷
সামনের মানুষটির স্বচ্ছন্দ হাঁটাচলা দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে, এই অরণ্যপথে যাতায়াতের অভ্যাস আছে তাঁর৷ চুপচাপ প্রায় নিঃশব্দে হাঁটছিলেন তিনি৷ পেছনের যুবকটির আবার বেশিক্ষণ চুপ করে থাকার অভ্যেস নেই৷ তিনি ক্রমাগত উসখুস করছিলেন৷ শেষমেশ আর থাকতে না পেরে প্রশ্ন করলেন, ‘প্রভু, ভন্তে কমলশীলের কাছ থেকে যে দুটি জিনিস আপনাদের এনে দিলাম—ওগুলো কী?’
‘বিষ আছে হে, বিষ!’ সকৌতুকে উত্তর দিলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ৷
‘বিষ? আমি কি ঠিক শুনলাম? বিষ? বিষ আনতে এত কষ্ট করলাম আমরা? দেশে বিষাক্ত উদ্ভিদ-লতা কি কম পড়েছে? নাকি বিষাক্ত সাপেরা সব দেশ ছেড়ে পালিয়েছে?’ বিস্মিতস্বরে প্রশ্ন করলেন পদ্মসম্ভব৷
একটু ভাবলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ৷ তারপর যখন কথা বলতে শুরু করলেন, তখন পরিহাসের তরল চিহ্ন তাঁর কণ্ঠস্বর থেকে উধাও।
‘আজ আপনাকে একটি গূঢ় সংবাদ জানাই রাজকুমার। যে বিশাল পরিকল্পনা আমরা করেছি, আপনি তার অপরিহার্য অঙ্গ। তাই এই তথ্য জানা আপনার সবিশেষ প্রয়োজন।
‘এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই প্রকাশচন্দ্র এবং পিশাচী রানি—দুজনেই অমিত ক্ষমতার অধিকারী। শুধু এদেশের নয়, তিব্বত থেকে শুরু করে এদিকে যবদ্বীপ আর ওদিকে সুদূর মরুপ্রতীচ্য অবধি প্রচলিত যাবতীয় মারণতন্ত্রে এই দুজন মহাসিদ্ধিলাভ করেছেন। তা নাহলে এক বিশাল জনজাতিকে এভাবে এতদিন ধরে একইসঙ্গে ভীত, সন্ত্রস্ত আর মোহগ্রস্ত করে রাখা সম্ভব নয়। অতি প্রাচীন, অতি তীব্র, আমাদের অজানা কোনও এক মারীকৌশল এই দুজনের আয়ত্তাধীন। সে কৌশল এতই বিচিত্র আর এতই অদ্ভুত যে, তার স্বরূপ আমারও বিশেষভাবে জানা নেই। শুধু এই দুজনই নয়, এদের ঘিরে থাকে যে বিশেষ ছয় জন মন্ত্রী, তারা প্রত্যেকেই কূটবুদ্ধিতে, যুদ্ধশাস্ত্রে আর পৈশাচীতন্ত্রে বিশেষ পারঙ্গম। এই ছয় জনকে সম্মুখসমরে পরাস্ত করা তাও সম্ভব রাজকুমার। কিন্তু প্রকাশচন্দ্র আর রানির জন্য প্রয়োজন এক বিশেষ দৈবী অস্ত্রের।’
‘এতে কি তাই-ই আছে লোকেশ্বর?’ ফিসফিস করে প্রশ্ন করলেন পদ্মসম্ভব।
‘হ্যাঁ আর্য। এতে দুটি বস্তু আছে। প্রথমটি এমন এক অব্যর্থ মারণাস্ত্র, যার কোনও রোধক বা বর্ম সমগ্র ভারতভূমিতে নেই। এর উৎস সেই সুদূর মহাচীনে। চীনদেশীয় বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা এই অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন তিব্বতের পোন পুরোহিতদের হাতে। এর তুল্য মহাস্ত্র মানুষের ইতিহাসে আজ অবধি নির্মিত হয়নি।’
চুপ করে রইলেন পদ্মসম্ভব।
আবার বলতে থাকলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ, ‘কিন্তু শুধু আক্রমণ নয়, প্রতি আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়ও একইরকম প্রয়োজনীয়। এই নারীর বিশেষত্ব বিষপ্রয়োগে। এই বিষয়ে স্বয়ং প্রকাশচন্দ্রও এঁর কাছে শিশু। ভারতের ইতিহাসে এমন বিষকন্যা আর কখনও আসেনি, আর কখনও আসবেও না। এঁর প্রতি নিঃশ্বাসে বিষ, এঁর প্রতিটি রক্তবিন্দু কালকূটতুল্য মহাগরল। এমনকি এর স্পর্শমাত্রেই ক্ষুদ্র ইতর প্রাণীরা ইহলীলা সংবরণ করে, এত বিষ এই রানির শরীরে। একটি সবল পূর্ণবয়স্ক পুরুষকে হত্যা করতে এঁর একটিমাত্র প্রেমপূর্ণ চুম্বনই যথেষ্ট।’
‘সেই বিষের প্রতিষেধক কী আচার্য?’
‘আছে আর্য, আছে।’ ধীরে ধীরে বললেন মৎস্যেন্দ্রনাথ। আশ্চর্য মায়াবী আলো তাঁর দুচোখে৷ ‘এই তীব্র বিষের একটিমাত্র প্রতিষেধকই আছে এই মরজগতে।’
‘সেটি কী, লোকেশ্বর?’
‘নগাধিরাজ হিমালয়ের যে সর্বোচ্চ চূড়া, যাকে তিব্বতীয়রা সসাগরা ধরিত্রীর পর্বতমাতা বলে পূজা করে, তার কাছাকাছি এক অতি গোপন গুহা আছে। সাধারণের অতি অগম্য সেই স্থান, কেবলমাত্র একটি তিব্বতী পরিবারই বংশপরম্পরায় সেখানে পৌঁছবার পথ জানে। সেই গুহার মধ্যে আর কিছু নেই, শুধুমাত্র একটি অতিক্ষুদ্র তুষারস্তূপ আছে। প্রতি দশ বৎসর অন্তর বৈশাখী পূর্ণিমার মধ্যরাত্রে সেই স্তূপ থেকে একটিমাত্র লোহিতবর্ণ পুষ্পশোভিত লতা জন্মায়। এই লতার আশ্চর্য গুণ এই যে, পৃথিবীর যাবতীয় দৈবী বা ভৌতিক বিষ প্রতিরোধ করার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে তার।’ এই বলে চুপ করেন মৎস্যেন্দ্রনাথ। তারপর ধীরস্বরে বলেন, ‘তবে সেই লতা আহরণ করার অসুবিধা একটিই।’
চুপ করে চেয়ে আছেন পদ্মসম্ভব।
‘যদি সেই অবস্থাতেই, মানে লতাটি সেই স্তূপে জায়মান থাকতে থাকতেই রাত্রি প্রভাত হয়, তবে লতাটির বিষনাশক ক্ষমতার লয় ঘটে। তবে যদি রাত্রের মধ্যেই লতাটিকে উৎপাটিত করে যথাবিহিত ভাবে সংরক্ষণ করা যায় তবে তার তুল্য বিষহর ক্ষমতা আর কোনও পার্থিব বস্তুর নেই।’
‘আমার আনা দ্বিতীয় বস্তুটি কি সেই বিষহর লতা?’ প্রশ্ন করলেন পদ্মসম্ভব।
উত্তর দিলেন না মৎস্যেন্দ্রনাথ, শুধু মৃদু হাসলেন। চুপ করে গেলেন পদ্মসম্ভব৷
সময় বহে যায়…। তারপর আবার প্রশ্ন করলেন পদ্মসম্ভব, ‘আরও একটি কথা ছিল প্রভু৷’
‘বলুন রাজকুমার৷’
‘আপনি তো শৈব, আদিনাথ মহাদেবের শিষ্য, কুলাগম শাস্ত্রের উদগাতা৷ আপনার শিষ্য এবং অনুগামীরাও হঠযোগসিদ্ধ, আগমপন্থী৷ এই বৌদ্ধ বজ্রযানী আচার্যদের সঙ্গে আপনাদের মতবিরোধ নেই?’
হেসে ফেললেন মৎস্যেন্দ্রনাথ, তারপর বললেন, ‘গীতায় শ্রীকৃষ্ণ কী বলেছেন রাজকুমার? “যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম৷” যে ব্যক্তি ঈশ্বরের যেভাবে উপাসনা করে, সে তাঁকে সেইভাবেই পায়৷ আমি কৌলমার্গ অনুসরণ করি, ওঁরা শূন্যতা ও উপায়ের উপাসক৷ মার্গ বহুতর হতে পারে, উপাস্য তো একই, রাজকুমার? তাছাড়া দেশের এই দুঃসময়ে এখন কী উপাসনাপদ্ধতি, ধর্মকৃত্য—এসব নিয়ে বাদানুবাদ করার সময়?’
‘তাই যদি হয়,’ প্রশ্ন শেষ হয় না পদ্মসম্ভবের, ‘আপনারা তো সাধক, যাবতীয় সাংসারিক মোহমায়ার ওপরে কেবলমাত্র ঈশ্বরচিন্তায় দিন কাটানোর কথা আপনাদের৷ তবে এই অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা, সংগঠন, নেতৃত্ব—এইসব কাজে নামার কী প্রয়োজন নাথ?’
দপ করে জ্বলে ওঠে মৎস্যেন্দ্রনাথের চোখদুটি, ‘কী বলছেন কী রাজকুমার! দেশ ছাড়া, দেশের মানুষের কল্যাণ ছাড়া ধর্ম বলে কিছু হয় নাকি? মানুষের চেয়ে বড় ঈশ্বর কে? দেশের থেকে বড় মন্দির কী? মানুষের চোখের জল মুছিয়ে দেওয়ার থেকে বড় পুণ্য আর কীসে হয়?’
চুপ করে রইলেন পদ্মসম্ভব। তাঁর চৈতন্যের ওপর থেকে ধীরে ধীরে একটি পর্দা উঠে যাচ্ছিল৷ উপলব্ধির এক নতুন স্তরে উপনীত হচ্ছিলেন তিনি৷
বলতেই থাকলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ, ‘ধর্ম কী, রাজকুমার? যা ধারণ করে, স্থিতি আনে—তাই ধর্ম৷ এই দেশে যখনই সাধারণ মানুষ অত্যাচারিত হয়েছে, তখনই ধর্ম স্বয়ং আবির্ভূত হয়েছেন তাদের উদ্ধার করতে৷ আমার চারপাশের মানুষ অভুক্ত, অত্যাচারিত, নিপীড়িত, আর আমি পর্বতের গুহায় বসে খেচরীমুদ্রায় দিনাতিপাত করব? উষ্ণীষকমল প্রাপ্তির সাধনা করব? যে পারমার্থিক মোক্ষ একটি ক্ষুধার্ত শিশুরও পেট ভরাতে অক্ষম, সেই মোক্ষ নিয়ে আমি কী করব রাজকুমার? শুনুন রাজকুমার, আজ আপনাকে ধর্মের সারসত্য বলে দিই৷ জেনে রাখুন, দেশ ব্যতীত ধর্ম নেই, দেশের মাটি ব্যতীত মন্দির নেই, দেশের মানুষ ব্যতীত ঈশ্বর নেই৷’
অভিভূত হয়ে পড়ছিলেন পদ্মসম্ভব, ধর্ম আর স্বদেশ নিয়ে এভাবে কোনওদিনও ভাবেননি তিনি৷ শুধু জানেন যে, এই মানুষটি একজন শিবকল্প মহাযোগী, ত্রিকাণ্ড কুলাগমের প্রণেতা৷ ঈশ্বরকোটির এই মানুষটি দেশে বিদেশে অখণ্ড শ্রদ্ধার অধিকারী৷ তিনিও দেশের নিপীড়িত, দলিত মানুষদের নিয়ে এত ভাবেন? বুকের ভেতরটা তাঁর আর্দ্র হয়ে আসছিল৷
‘আপনি কখনও ঈশ্বরকে দেখেছেন, লোকেশ্বর?’ আচ্ছন্নস্বরে বললেন পদ্মসম্ভব৷
অকস্মাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন মৎস্যেন্দ্রনাথ৷ স্থির চোখে চেয়ে রইলেন পদ্মসম্ভবের দিকে৷ থমকে গেলেন পদ্মসম্ভবও!
সেই গাঢ় আরণ্যক অন্ধকারে, সেই নীলজোছনার আলোয়, আকাশ থেকে গাছের পাতা বেয়ে নেমে আসা নক্ষত্রআলোকে, ঐশীস্বরে বলে উঠলেন মহাযোগী মৎস্যেন্দ্রনাথ, ‘হ্যাঁ রাজপুত্র, আমি ঈশ্বরকে দেখেছি৷ যেমন এই মুহূর্তে আপনাকে দেখছি, তেমনই৷ আপনি দেখতে চান?’
সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল পদ্মসম্ভবের, মুখে কথা জোগাল না তাঁর৷
কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সহসা ঘুরে দাঁড়িয়ে পথ চলতে লাগলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ। আবার তাঁকে অনুসরণ করতে থাকলেন পদ্মসম্ভব৷ কিছুক্ষণ পর প্রশ্ন করলেন তিনি, ‘আর কতদূর, প্রভু?’
‘এই তো এসে গেছি।’ বনপথের শেষে একটুকরো পরিষ্কার জায়গায় এসে বললেন মৎস্যেন্দ্রনাথ৷
চারিদিকে তাকালেন পদ্মসম্ভব। বোঝাই যাচ্ছিল যে, অনেক চেষ্টায় অরণ্যের মধ্যে এই অংশটির সংস্কার করা হয়েছে৷ চতুর্দিকে গহীন বনাঞ্চল, আকাশে নবমীর চাঁদ। নির্মল আকাশ জুড়ে নেমে আসছে নীল জোছনা৷ সেই জায়গাটির একদম শেষে একটি মাটি ও পাথরের মন্দির৷ দূর হতেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, সেই মন্দিরে প্রদীপের আলোয় আর গুগ্গলের ধোঁয়ায় আরতি চলছে৷ বেশ কয়েকজনের ছায়ার নড়াচড়াও লক্ষ করলেন পদ্মসম্ভব৷ লম্বা লম্বা পা ফেলে সেদিকেই যেতে থাকলেন মৎস্যেন্দ্র৷ দেখাদেখি তাঁকে অনুসরণ করলেন পদ্মসম্ভবও৷
কাছে গিয়ে পদ্মসম্ভব দেখলেন, মন্দিরের বাইরে গেরুয়া কাপড় পরিহিত এক সৌম্যমূর্তি বৌদ্ধ সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে, আর তাঁর পাশে একজন অতি বিশাল শরীরের পুরুষ৷ দেখামাত্র দুজনকে চিনলেন তিনি, একজন ভন্তে কমলশীল, আরেকজন পদ্মসম্ভবের অনেকদিনের পুরোনো বন্ধু, কজঙ্গলের শবরজাতির অধিনায়ক—সিদ্ধ শবরবজ্র৷
লোকেশ্বর মৎস্যেন্দ্রনাথকে দেখামাত্র শবরবজ্র এবং কমলশীল দুজনেই হাত জোড় করে প্রণাম করলেন৷ মৎস্যেন্দ্রনাথ আশীর্বাদ করার পর শবরবজ্র এগিয়ে এসে সজোরে আলিঙ্গন করলেন পদ্মসম্ভবকে, ‘সেই যে গেলে, তারপর থেকে তো তোমার দেখাই নেই হে! বলি আছ কেমন ভায়া?’
এই মানুষটিকে অত্যন্ত ভালোবাসেন পদ্মসম্ভব৷ সহজ মানুষ এবং সহজপথ তাঁর কাছে চিরকালই অতি প্রিয়৷ তিনিও গভীর শ্বাস নিয়ে কিছু বলতে যাবেন, এমন সময় সেই মন্দিরটির ভেতরের দিকে চোখ গেল পদ্মসম্ভবের৷ আবিষ্টের মতো সেদিকে এগিয়ে গেলেন তিনি৷
মন্দিরের ভেতরে কয়েকটি বিশাল আকারের মাটির প্রদীপ জ্বলছে, তাতেই সমস্ত মন্দির আলোকিত৷ অগুরু, গুগ্গল ও চন্দনের গন্ধে ভরে আছে পুরো মন্দির৷ সামনে দাউ দাউ করে জ্বলছে এক বিশাল যজ্ঞকুণ্ডের আগুন৷
মন্দিরের ভেতরে এক দেবীমূর্তি৷ তার সামনে কুশাসনে বসে রয়েছেন কয়েকজন ব্রাহ্মণ পুরোহিত৷ তাঁরা যজ্ঞকুণ্ডে আহুতি দিচ্ছেন, আর সেই যজ্ঞকুণ্ডের সামনে, দেবীমূর্তির দিকে মুখ করে, তাঁদের দিকে পিছন ফিরে বসে আছেন এক তরুণ৷
পদ্মসম্ভবের চোখ গেল সেই তরুণটির দিকে৷ তাঁর সরু কোমর, চওড়া কাঁধ এবং সুগঠিত পেশীর অহঙ্কারে স্পষ্ট যে, ইনি এক সিংহবিক্রম যোদ্ধৃপুরুষ৷ তাঁর ঘন ও কোঁকড়ানো চুলের ভার নেমে এসেছে কাঁধ অবধি৷ প্রদীপ ও যজ্ঞের আগুনের আলো ঠিকরে যাচ্ছিল তাঁর সুগঠিত দেহখানি থেকে৷ সুললিত এবং সুগম্ভীর স্বরে স্তব আবৃত্তি করছিলেন তিনি৷
পদ্মসম্ভবের দৃষ্টি গেল দেবীমূর্তির প্রতি৷ মুহূর্তে বিস্মিত হলেন। ‘প্রভু, ইনি কোন দেবী?’ তিনি প্রশ্ন করলেন মৎস্যেন্দ্রনাথকে, ‘এই দেবীর মূর্তি তো এই অঞ্চলে কখনও দেখিনি৷’
‘রাজপুত্র, ইনি দেবী চুন্দা৷ আমি ডাকি চণ্ডী নামে, দেবী গৌড়চণ্ডী৷ ইনি আদিশক্তি, সকল জগতের বীজধাত্রী, সকল লোকের ঈশ্বরী৷’
পদ্মসম্ভব কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই সেই মহাবল তরুণটির গম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারিত স্তবগান ভেসে আসে, ‘মধুকৈটভবিধ্বংসি বিধাতৃ-বরদে নমঃ…’
তারই মধ্যে আবিষ্টস্বরে বলতে থাকলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ, ‘হে রাজকুমার, উত্তর গান্ধারের পার্বত্য অঞ্চলে পূজিতা এই দেবীকে আমি এই দেশে নিয়ে এসেছি৷ ইনি অতি রণদুর্মদ, ভীষণদর্শনা৷ কুমার, দেশের এই ক্রান্তিকালে এই দেবীর আশীর্বাদ আমাদের প্রয়োজন, ভীষণ প্রয়োজন৷’
আবার ভেসে এল সেই উদাত্ত প্রার্থনা,
.
‘ধুম্রনেত্রবধে দেবী সর্বকামার্থদায়িনী…’
.
সেই স্বরে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না মৎস্যেন্দ্রনাথ৷ তদগত চিত্তে তিনি বলে যেতে থাকলেন, ‘ইনি একাদশ রুদ্রকে ধারণ করেছেন, ধারণ করেছেন অষ্টবসু ও দ্বাদশ আদিত্যকে৷ ইনি স্বয়ং রুদ্রের ধনুতে জ্যা আরোপিত করেন…’
.
‘নিশুম্ভশুম্ভনির্ণাশি ত্রৈলোক্যশুভদে নমঃ…’
.
‘ইনি দেবতাদের শত্রুনাশ করেন৷ যজ্ঞের সকল হবি এঁর উদ্দেশেই অর্পিত হয়৷ ইনি সকল লোকের ঈশ্বরী, ধনদা, সুখদা, বরাভয়প্রদায়িনী৷’
.
‘স্তবদ্ভ্যো ভক্তিপূর্বং ত্বং চণ্ডিকে ব্যাধিনাশিনী…’
.
‘এই দেবীর শক্তিতেই জগৎসংসারের সকল প্রাণী দর্শন, শ্রবণ ও জীবনধারণ করে থাকে৷ অনুগত ভক্তকে ইনি ব্রহ্মজ্ঞান অর্পণ করেন৷’
.
‘চণ্ডিকে সততং যুদ্ধে, জয়ন্তি পাপনাশিনী…’
.
‘হে রাজপুত্র, আশ্রিতদের রক্ষা করার জন্যে ইনি সদাসর্বদা সংগ্রাম করেন৷ স্বর্গে ও মর্ত্যে ইনিই অন্তর্যামিনীরূপে পরিব্যাপ্তা…’
.
‘দেবী প্রচণ্ডদোর্দণ্ড দৈত্যদর্পনিসূদিনী…’
.
‘কিন্তু লোকনাথ, দেবীর বাহন এই পশু কেন? এই ভীষণ প্রাণীটিকে তো এই অঞ্চলে দেখা যায় না!’ বিস্মিতস্বরে প্রশ্ন করলেন পদ্মসম্ভব৷’
.
‘কৃষ্ণেন সংস্তুতে দেবী শশদ্ভক্ত্যা সদাম্বিকে…’
.
‘কারণ ইনি পার্বত্য দেবী, পর্বতদুহিতা৷ উত্তর হিমালয়ের সিংহবিক্রম পার্বত্য জনজাতির অধিষ্ঠাত্রী দেবী ইনি৷ তাই দেবীর বাহন এই পশুরাজ৷’
এক অদ্ভুত ভক্তিভাবে অন্তর পরিপূর্ণ হয়ে উঠছিল পদ্মসম্ভবের৷ আশ্চর্য ঐশ্বরিক শক্তিতে বলীয়ান তিনি৷ তবু তাঁর মাথা নত হয়ে আসছে এই বহুভুজা দেবীটির সামনে৷ দেবীর বিশাল দুই আয়তনয়ান দেখে তাঁর হৃদয়ে ভক্তি ও শ্রদ্ধা মিশিয়ে এক আশ্চর্য ভাবের উদয় হল৷ রুদ্ধস্বরে প্রশ্ন করলেন তিনি, ‘কে প্রভু, কে এই দেবী?’
দুই হাত জড়ো করে দেবীর উদ্দেশে তখন প্রণাম করছিলেন সেই বলশালী যুবকটি৷ পুজা শেষ হয়ে আসছিল তাঁর, ‘তারিণি দুর্গসংসার সাগরস্যাচলোদ্ভবে/ রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি…’
‘আর্য পদ্মসম্ভব,’ উচ্চকিত আবেগে কণ্ঠস্বর কেঁপে কেঁপে যাচ্ছিল লোকেশ্বরের, ‘আমি মৎস্যেন্দ্রনাথ, আদিনাথ মহাদেবের পদাম্বুজ নিজবক্ষে ধারণ করে ঘোষণা করছি যে, আজ হতে ইনি গৌড়বঙ্গের অধিষ্ঠাত্রী দেবী৷ এই দেবী একদিন বঙ্গভূমির ঘরে ঘরে পূজিতা হবেন, এই দেশের সমস্ত দুঃখ, সমস্ত বেদনা, সমস্ত দুর্গতি নাশ করবেন ইনি৷ আজ আমি এই সিংহবাহিনী দেবীর নাম দিলাম…’
.
‘ইদং স্তোত্রং পঠিত্বা তু মহাস্তোত্রং পঠেন্নরঃ,
সপ্তশতীং সমারাধ্য বরমাপ্নোতি দুর্লভং৷৷’
.
‘দেবী দুর্গা!’
পূজা শেষ করে সেই যুবকটি তাঁদের দিকে ফিরলেন৷ তারপর মৎস্যেন্দ্রনাথকে দেখে দ্রুত নেমে এলেন তাঁদের কাছে, প্রণত হয়ে বিনীতভাবে বললেন ‘প্রণাম লোকনাথ৷’
.
‘আসুন রাজকুমার পদ্মসম্ভব’ উদাত্তস্বরে বললেন মৎস্যেন্দ্রনাথ, ‘আপনাকে বঙ্গভূমির ভাবী সম্রাটের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই, ‘এই বলে থামলেন তিনি। তারপর গভীর শ্বাস নিয়ে বললেন, ‘ইনিই সর্ববিদ্যাবিশুদ্ধ দয়িতবিষ্ণুর পৌত্র, খণ্ডিতারাতি বপ্যটের পুত্র, রাজভটবংশাদিপতিত মহাবীর গোপালদেব৷’
পূর্বদিগন্তে লালের ফোঁটা স্পষ্ট হচ্ছিল। কিছুপরেই সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়ল মন্দিরের চৌকাঠে। হুঙ্কার দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন পুরোহিতের দল! পূজা সমাপ্ত হয়েছে তাঁদের। প্রধান পুরোহিত নেমে এলেন, যজ্ঞভস্ম আর রক্তচন্দনের টীকা পরিয়ে দিলেন প্রত্যেককে।
যুক্তকরে প্রশ্ন করলেন গোপালদেব, ‘অধীনের প্রতি এখন কী আদেশ, প্রভু?’
নবোদিত সূর্যের দিকে তাকিয়ে ছিলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ। সূর্যের আলো তাঁর কপালের মধ্যভাগে জ্বলজ্বল করছিল রাজটীকার মতো। সেইদিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলেন তিনি, অস্ফুটে কিছু শুভ মন্ত্রোচ্চারণ করলেন। তারপর ধীরে ফিরলেন গোপালদেবের দিকে।
‘বৎস, চূড়ান্ত সংগ্রামের ক্ষেত্র প্রস্তুত। আজ, এই মুহূর্ত থেকে আমাদের যুদ্ধ শুরু হল। তুমি পূর্বদিকে যাত্রা করো। আজ হতে একপক্ষকাল পর তুমি কর্মান্তবাসকের উপকণ্ঠে পৌঁছবে। সেখানে কান্তিপ্রভ নামক এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে আতিথ্য নিও। তিনি আমাদের গুপ্ত সহযোগী, এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। পরবর্তী আদেশ সেখানেই পাবে। ইতোমধ্যে আমরাও পৌঁছে যাব সেখানে। পরবর্তী কর্মপন্থা সেখানেই জানানো হবে তোমাকে।’
আভূমি প্রণত হতে যাচ্ছিলেন গোপালদেব, তাঁকে আটকালেন লোকেশ্বর মৎস্যেন্দ্রনাথ। জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘সাবধানে যাবে গোপালদেব৷ আর আমরা সবাই তাকিয়ে আছি তোমার দিকে। সদা সতর্ক থাকবে, নিজের ওপর বিশ্বাস রেখো। যে কঠিন কর্মভার তোমার ওপর ন্যস্ত হয়েছে, তার তুল্য গুরুদায়িত্ব খুব কম লোকই বহন করতে পারে। এককালে এই কঠিন কর্তব্য পালন করেছিলেন মহাবল শশাঙ্ক। তাঁর শাসনদণ্ডের নীচে বঙ্গভূমি প্রথমবারের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। আজ এই ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন লাঞ্ছিত নিপীড়িত অহল্যাভূমি আবার একজন শশাঙ্কতুল্য মহাপরাক্রমশালী রাজার জন্য প্রতীক্ষা করছে। আজ বঙ্গদেশের রাজলক্ষ্মী সেই শাসনদণ্ড তোমার হাতে তুলে দিতে চান। দেশের আপামর জনসাধারণ তোমার সঙ্গে আছে গোপালদেব। মনে রেখো—তুমিই আমাদের শেষ এবং একমাত্র ভরসা।’
কৃতাঞ্জলিপুটে প্রণাম জানিয়ে মন্দিরের অন্যপ্রান্তে রাখা গোরুর গাড়িটির দিকে এগিয়ে গেলেন গোপালদেব। এখান থেকে কর্মান্তবাসক দীর্ঘ দুই সপ্তাহের যাত্রা। ধীরে ধীরে মৃদুমন্দ চালে বনের মধ্যে মিলিয়ে গেল গাড়িটি। সেদিকে তাকিয়ে রইলেন বাকিরা। তাঁদের শক্ত হয়ে আসা চোয়ালে, মুষ্টিবদ্ধ হাতে আর দু’চোখের তারায় ঝলসে উঠছিল মুক্তির আশা আর স্বাধীনতার সংকল্প।
এবার সময় শুরু প্রত্যক্ষ সংগ্রাম।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন