অভীক সরকার
রাজ্ঞী আসন গ্রহণ করলে বাকিরা নিজ নিজ আসনে উপবেশন করলেন। মহারাজসচিব প্রকাশচন্দ্র অত্যন্ত শীতলকণ্ঠে বললেন, ‘কাহিনির মূল অংশটি না হয় এই রক্ষীপ্রধানটির থেকেই শোনা যাক, কী বলেন মাননীয় অমিতাভভট্ট?’
প্রধানমন্ত্রী অমিতাভভট্ট সম্মত হতেই সবার দৃষ্টি ন্যস্ত হল অভাগা মানুষটির ওপর।
রক্ষীপ্রধান তার শুষ্ক ওষ্ঠ দুটি লেহন করে নিল প্রথমে। তারপর কম্পিত ও স্তিমিতস্বরে বলা শুরু করল।
‘মহাপ্রতীহার আর্য শান্তঘোষের আদেশক্রমে আমরা সসৈন্যে উপস্থিত হয়েছিলাম কমলাঙ্ক গ্রামে। গ্রামটির সন্নিহিত অরণ্যের পাশে বর্বর কিরাতজাতির বাস। তারা যে শুধু বর্বর তা নয়, অত্যন্ত দুর্বিনীত এবং অবাধ্যও বটে। সেই জংলী ইতর প্রাণীগুলি যদি বিনা বাধায় আমাদের কাজ করতে দিত, তাহলে এই দুর্ঘটনা ঘটতই না।’
বাকিরা নড়েচড়ে বসলেন।
‘প্রথমে অনেক ধৈর্যের সঙ্গে তাদের বোঝাবার চেষ্টা করলাম আমাদের আগমনের উদ্দেশ্য কী, আমরা কেন এসেছি। দেশের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলের জন্যই যে এই ভৈরবীচক্রের আয়োজন, আর সেই চক্রানুষ্ঠানের জন্যই তাদের কন্যা, মাতা ও ভগিনীদের আশু প্রয়োজন—সে কথাটাও বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে বলা হয়। এমনকী ভৈরবীচক্রের পর যে সমস্ত নারীরত্নদের বিপুল কপর্দকরাশি এবং অন্যান্য উপহারসম্ভারের সঙ্গে সসম্মানে প্রত্যর্পণ করা হবে, সে কথাটাও বেশ স্পষ্টভাবেই ব্যক্ত করা হয়েছিল।
‘কিন্তু বিধি বাম, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। তারা অত্যন্ত উগ্র এবং অসভ্যভাবে আমাদের অপমান করতে থাকে। তার মধ্যে বিবিধ অশ্রাব্য গালি তো ছিলই, তার সঙ্গে ছিল অত্যন্ত অশ্লীল অঙ্গভঙ্গী, আমাদের পরিবারের নারীদের চরিত্র নিয়ে উচ্চারিত কুবাক্য, এমনকী কেউ কেউ বড় বড় পাথরের টুকরো এবং গাছের ডাল হাতে আমাদের হুমকি দিতে থাকে। শুধু কি তাই? দু-একজন অতি অবাধ্য কিরাত আমাদের সঙ্গীদের ওপর থুতু ছিটোতে থাকে, এমনকী কয়েকজন তো আমাদের সঙ্গীদের দাড়ি গোঁফ ছিঁড়ে নেবে বলে তর্জন করতে থাকে।
‘অতএব নিতান্ত বাধ্য হয়েই আমাদের মৃদু বলপ্রয়োগ করতে হয়। মৃদু বলতে খুবই মৃদু। ওই অতি সামান্য বলপ্রয়োগে মনুষ্যশরীরে সাধারণ ক্ষতসৃষ্টি ছাড়া আর অন্য কোনও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই নেই।’
এই পর্যন্ত বলে অপরাধী দৃষ্টিতে চারিদিক একবার দেখে নিল গ্রামরক্ষী। প্রধানমন্ত্রী অমিতাভভট্ট সামান্য অস্বস্তির সঙ্গে প্রশ্ন করলেন, ‘তারপর?’
‘কিন্তু ওই দুর্বিনীত কিরাতদের কথা কী বলব প্রভু, তাদের বিবেচনাবোধ বলতে কিছুই নেই? আমরা যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে সামান্য ভল্ল এবং তরবারি চালনা শুরু করেছি কী করিনি, ওদের ওই গোষ্ঠীপ্রধান বৃদ্ধ অলম্বুষটিকে নিতান্ত অবিবেচকের মতো এর মধ্যে পড়ে নিহত হতেই হল? নিহত হওয়ার একটা পূর্বাপর বোধ নেই? সময় অসময় জ্ঞান নেই? এমনকী তার সঙ্গে তার শিশু পৌত্রটিও যে নিহত হবে…’
‘কীরকম? বৃদ্ধটি যে দেহত্যাগ করল—সে না হয় বোধগম্য হল। কিন্তু শিশুটি কী করে…’ জিতসেনের প্রশ্নটি অর্ধোক্তই রয়ে গেল।
‘দৈব প্রভু, দৈবই প্রবল সর্বত্র।’ গভীর আক্ষেপের সঙ্গে মাথা নাড়ল গ্রামরক্ষকটি, ‘এক্ষেত্রেও শিশুটির দৈবই তাকে আকর্ষণ করে এনেছিল তার মৃত্যুর দিকে। যখন আমাদের রক্ষীদলের কুমার যোগেন্দ্র ক্রোধবশত তার ভল্লটি গ্রামপ্রধান বৃদ্ধের বক্ষের দিকে চালনা করে, তখন সেই বৃদ্ধ নিতান্ত মূর্খের মতো তার শিশুপৌত্রকে নিজবক্ষে ধারণ করে ছিল। ফলে ভল্লটি প্রথমে সেই শিশু…এবং তারপর বৃদ্ধটির…’
ভ্রূকুঞ্চন করলেন অগ্নিমিত্র, ‘বৃদ্ধটি তার শিশুপৌত্রকে বক্ষে ধারণ করে এই দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়েছিল? আমাদের তাই বিশ্বাস করতে হবে?’
সামান্য ইতস্তত করল রক্ষীপ্রধান৷ তারপর বলল, ‘না, ঠিক তা ঘটেনি। বৃদ্ধ যে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়নি, সে কথা সত্য। এমনকি সে যে অসুস্থ অবস্থায় কুটিরের অভ্যন্তরে নিজের পৌত্র ও পৌত্রীদের রক্ষণাবেক্ষণ করছিল— সেও সত্য। মহাবীর, মহাবলশালী কুমার যোগেন্দ্র নিতান্তই যৌবনমদমত্ত হয়ে সেই কুটিরে প্রবেশ করে…’
‘শিশুপরিবেষ্টিত বৃদ্ধটিকে হত্যা করে, তাই তো?’
রক্ষীপ্রধানের অস্বস্তি চতুর্গুণ বেড়ে যায়। সে ধীরে ধীরে বলে, ‘বলপ্রয়োগের সময় সর্বদা লক্ষ থাকে না যে…’
‘বল কোথায় প্রয়োগ করা হচ্ছে, মহামান্য রক্ষীপ্রধান?’ সামান্য ব্যঙ্গাত্মক সুরে প্রশ্ন করেন আনন্দগুপ্ত।
মরিয়া হয়ে ওঠে রক্ষীপ্রধান, ‘কিরাতদল এমনই অসভ্যতা করছিল প্রভু—যে কী বলব! আর গালিবর্ষণের তো ইয়ত্তা ছিল না, সেসব অশ্লীল কুবাক্য আমি আপনাদের সামনে উচ্চারণও করতে পারব না। নেহাত বাধ্য হয়েই…অর্থাৎ কি না সামান্য উত্তেজিত হয়েই মহাবীর যোগেন্দ্র…’
‘এই কর্মটি ঘটিয়ে ফেলেছে, তাই তো?’
দ্রুত সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে রক্ষীপ্রধান।
‘তারপর? তারপর কী হল?’ সামান্য ঝুঁকে শীতলস্বরে প্রশ্ন করলেন প্রকাশচন্দ্র। সেই স্বর শুনে রক্ষীপ্রধানের অস্বস্তি বহুগুণ বর্ধিত হয়। সে জানে না এই স্বরের মধ্যে কী আছে, কিন্তু শুনলেই এক অপার্থিব ভয়ের অনুভূতি আচ্ছন্ন করে শ্রোতাকে।
‘তারপর প্রভু আমরা যখন আপনার আদেশানুসারে কয়েকজন যুবতী ও কিশোরীকে কেশাকর্ষণ করে নিয়ে আসছি, ঠিক তখনই…
.
গোপালদেব অকুস্থলে পৌঁছতেই এক অভূতপূর্ব নারকীয় দৃশ্যের সম্মুখীন হলেন।
কিরাতদের বসতির সামনে রীতিমতো খণ্ডযুদ্ধ চলছে। যুদ্ধ বলা ভুল, অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত সৈন্যদল ভীম আক্রোশে ছারখার করে দিচ্ছে কিরাতদের ক্ষুদ্র বসতিটি। কিরাতপুরুষেরা বলশালী বটে, কিন্তু তাদের অন্ধ ক্রোধের উদ্গিরণ এবং সুশিক্ষিত সৈন্যবাহিনীর আক্রমণের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। তাই তারা ছত্রভঙ্গ, প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টায় ব্যর্থ। ওদিকে একটি অপেক্ষাকৃত বড় পর্ণকুটিরের সামনে থেকে হাহাকার এবং কান্নার আর্তনাদ ভেসে আসছে৷ কুটিরের সামনে দুটি মৃতদেহ শায়িত, একটি এক বৃদ্ধের, অন্যটি এক শিশুর।
গোপালদেব শান্তচোখে একবার বামদিকে আর একবার ডানদিকে তাকালেন। তারপরেই তাঁর চোখে পড়ল যে সৈন্যদের একটি ছোট অংশ কয়েকজন কিরাতরমণীকে বলপূর্বক আকর্ষণ করে নিয়ে যাচ্ছে।
গোপালদেব চিরকালই লক্ষ করে এসেছেন যে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে দেহে মনে এক আশ্চর্য প্রশান্তি অনুভব করেন তিনি। তাঁর স্নায়ু শান্ত ও ধীর হয়ে আসে, হাত এবং পায়ের পেশি লঘু অথচ শক্ত হয়ে ওঠে। আর আর হাতের খড়্গটিকে দেহের অংশ বলেই মনে হয়। মনে হয় যেন তারও প্রাণ আছে, আর সেই প্রাণবন্ত খড়্গ তার প্রভুর জন্য স্বয়ং ঈশ্বরের রক্তপানেও পশ্চাৎপদ হবে না।
গোপালদেব তাঁর মহাখড়্গ কোষমুক্ত করলেন।
তাঁর একটু সামনে এক সৈন্য একটি কিশোরীকে চুল ধরে টেনে নিয়ে আসছিল। কিশোরীটির আর্তনাদ আর বুকফাটা কান্নায় কর্ণপাত করার কেউ নেই। তার ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, নিম্নাঙ্গের বল্কলটিও প্রায় যায় যায়। কিশোরীটি একহাতে তার লজ্জাস্থান রক্ষার চেষ্টায় রত, আরেক হাত দিয়ে সেই সৈনিকের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সৈনিকটি ঈষৎ মদমত্ত তো ছিলই। দুর্বলের ওপর অত্যাচারের মধ্যেও উত্তেজক আনন্দও আছে। সে পৌরুষকণ্ঠে কিশোরীর অবশ্যম্ভাবী ভবিতব্য নিয়ে ক্রমাগত অশ্লীল কুবাক্য উচ্চারণ করে যাচ্ছিল। বোধকরি সেই আক্রোশই তাকে অন্ধ করে দিয়েছিল। তাই সে যখন দেখল তার পথরোধ করে দাঁড়িয়ে এক বলশালী যুবক, আর তার হাতে এক ভীমদর্শন খড়্গ, তখনও সে নিজের আশু সর্বনাশকে চিনে নিতে পারেনি। হুঙ্কার দিয়ে সে বলল, ‘কে রে তুই? কোন সাহসে চন্দ্রসৈন্যের পথরোধ করিস?’
যুবক শান্তস্বরে বললেন, ‘মেয়েটাকে ছেড়ে দে।’
সৈন্যটি উচ্চৈঃস্বরে হেসে বলল, ‘বাহবা, বাঃ! বড়ই মজার কথা। আর যদি ছেড়ে না দিই?’
যুবকটি শান্তস্বরে বলল, ‘তোর পক্ষে ভালো না-ও হতে পারে।’
দাঁতে দাঁত ঘষল উন্মত্ত সৈনিক। ‘যদি এই মেয়েটিকে ছেড়ে দিই, তাহলে ভৈরবীচক্রের অগ্নিকুণ্ডটা জ্বালানো হবে কোথায়? তোর মাতৃদেবীর যোনিদেশে?’
যুবকটির চক্ষুদুটি সামান্য জ্বলে উঠেই শান্ত হল। তারপর বলল, ‘কথাটা ভেবে বলিস। আমার মাতৃদেবী কিন্তু বয়সে তোরও মাতৃদেবীর মতোই হবেন।’
রাক্ষসের মতো হেসে সৈন্যটি বলল, ‘হা হা হা। আমার মায়ের মতন? শোন রে রণ্ডাপুত্র, তোদের মা আর আমাদের মা আর এক নয়। তোদের ধর্ম আর আমাদের ধর্ম এক নয়। তোদের রক্ত আর আমাদের রক্ত এক নয়। নিজেদের অপবিত্র রক্তকে আমাদের রক্তের সঙ্গে তুলনা করিস না, ফল ভালো হবে না।’
যুবকটি শান্তস্বরে প্রশ্ন করল, ‘কী রকম?’
‘আমরা, প্রকাশচন্দ্রের অনুগামী রাজসেবকরা প্রভুর চরণকমলে নিজেদের উৎসর্গ করে দীক্ষিত হয়েছি, নিজেদের পাপজন্ম শুদ্ধ করেছি। আমরাই এই পৃথিবীর একমাত্র শুদ্ধতম জাতি, ঈশ্বরের অনুপ্রেরিত বিশেষ গোষ্ঠী। আমাদের পাঠানো হয়েছে বঙ্গদেশ শাসনের জন্য। আমাদের রক্ত পুণ্য, আমাদের উদ্দেশ্য পুণ্য, আমাদের তরবারি পুণ্য। সর্বোপরি—আমাদের সঙ্গে আছেন সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর শ্রীপ্রকাশচন্দ্র। তিনি ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য বিশেষ পুরুষ।’
‘আর যারা তোদের বিরুদ্ধে?’ খড়্গখানি দৃঢ়ভাবে ধরে প্রশ্ন করলেন গোপালদেব।
‘আমরা তাদের মানুষ বলে মনে করি নাকি?’ ঘৃণায় নাসিকাকুঞ্চন করল সেই রক্ষী, ‘যারা আমাদের পক্ষে থাকে, একমাত্র তাদেরই আমরা মানুষ বলে মানি। আর যারা আমাদের বিরুদ্ধপক্ষ—তাদের প্রত্যেকে আমাদের শত্রু। তাদের আমরা কীটপতঙ্গের বেশি মনে করি না। তাদের পুরুষেরা অবশ্যবধ্য, তাদের নারীরা আমাদের যৌনদাসী হওয়ার জন্যেই জন্মেছে। তাদের শিশুরা জন্ম হতেই আমাদের দাস হওয়ার জন্য বলিপ্রদত্ত। তুইও তাদের মধ্যে একজন রে মূর্খ। তোদের নারীরা জন্মমাত্রেই আমাদের ভোগ্য। তাই তোর অপবিত্র বংশজাত বেশ্যাটিকে মা বলে মানতে…’
মুহূর্তের ভগ্নাংশে গোপালদেবের হাতে উত্তোলিত হল তাঁর মহাভৈরব খড়্গ।
রক্ষীপ্রধানটি বসতির মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে ধ্বংসযজ্ঞটি উপভোগ করছিল। আহা, আজকের অভিযানটি সম্পূর্ণভাবে সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে। আশা করা যায়, প্রভু পরমেশ্বর প্রকাশচন্দ্র নিশ্চয়ই প্রীত হবেন। আর লুণ্ঠিত নারীদের কিছু অংশ কি সে নিজেও পাবে না? লুণ্ঠনের অংশ গ্রহণ করা তো প্রভু প্রকাশচন্দ্রের অনুমত্যাদেশের মধ্যেই রয়েছে।
রক্ষীপ্রধান সহসা লক্ষ করল একটি যুবতী নারী প্রাণভয়ে তার পর্ণকুটিরের মায়া ত্যাগ করে অরণ্যের দিকে ধাবমান। হাতের ভল্লটি তুলে সে অনুগত একজন রক্ষীকে সেদিকে নির্দেশ করতেই কী যেন একটি গোলাকার বস্তু আকাশপথে উড়ে এসে তাঁর পায়ের কাছে পড়ল।
মাথা নীচু করল রক্ষীপ্রধান। তার পায়ের কাছে একটি বাদ্যছিন্ন নরমুণ্ড! আর সেই মুণ্ড আর কারও নয়, তারই বাহিনীর এক রক্ষীর।
প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেল রক্ষীপ্রধান। তারপরেই সে দুরন্ত ক্রোধে চিৎকার করে উঠল, ‘কার এই দুঃসাহস? কে হাত তুলেছে চন্দ্রসৈন্যের ওপর? কার ঘাড়ে একটার বেশি মাথা?’
সামান্য দূর থেকে ভেসে এল, ‘যুদ্ধ তো সমানে সমানে হয় শুনেছিলাম রে নপুংসক। নাকি চন্দ্রবংশের সৈন্যদল এতই ক্লীব যে, বৃদ্ধ আর নারী ছাড়া আর কারও সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়ার মতো যোগ্যতা নেই তাদের?’
রক্ষীপ্রধান সবিস্ময়ে তাকিয়ে দেখল অনতিদূরে এক মহাবল পুরুষ দাঁড়িয়ে। তাঁর হাতে ধরা মহাখড়্গটি থেকে তখনও চুঁইয়ে পড়ছে রক্ত, আর পায়ের কাছে একটি মুণ্ডহীন দেহ।
উন্মত্ত ক্রোধে রক্ষীপ্রধানের দেহে বিদ্যুৎপ্রবাহ বয়ে গেল। তারপরেই সে সরোষে চিৎকার করে উঠল, ‘ওরে! কে কোথায় আছিস? এই রণ্ডাপুত্রটার ঘাড় ধরে আমার সামনে নিয়ে আয়! এর বীর হওয়ার ইচ্ছেটা জন্মের মতো ঘুচিয়ে দিই। শয়তানটার এত স্পর্ধা যে, চন্দ্রসৈন্যদের দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করে?’
গোপালদেবের সবচেয়ে কাছে থাকা রক্ষীসৈন্যটি ভল্লহাতে ধাবিত হল তাঁর দিকে। গোপালদেব স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, খড়্গটি তুলে অবধি ধরলেন না। তারপর যে মুহূর্তে সৈন্যটি তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তিনি তড়িৎগতিতে সরে গিয়ে সৈন্যটির ভল্ল বাঁহাতে ধরে আশ্চর্য কৌশলে সেই ভল্লটিরই অগ্রভাগ সম্পূর্ণরূপে গেঁথে দিলেন সৈন্যটির কণ্ঠদেশে।
বাকি রক্ষীসৈন্যরা অবিশ্বাসের চোখে সম্পূর্ণ ঘটনাটি দেখল। তারপর হিংস্র জংলি কুকুরের দল যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্রুদ্ধ সিংহের উপর, সেইভাবেই উন্মুক্ত তরবারি এবং ভল্ল হাতে তারা ধেয়ে গেল গোপালদেবের দিকে।
গোপালদেব খড়্গটি তুলে রণহুংকার দিলেন, ‘জয় গৌড়, জয় বঙ্গ, জয় শশাঙ্ক।’
তারপর যেভাবে সর্বগ্রাসী হুতাশন শুষ্ক তৃণভূমি দগ্ধ করে, সেভাবেই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন সৈন্যদলের উপর।
.
‘একাই তিনি সমগ্র রক্ষীদলকে ধ্বংস করলেন?’ আচার্য বিশুদ্ধকীর্তি বললেন, ‘এ যে অবিশ্বাস্য!’
‘সেই অবিশ্বাস্য কাণ্ডটিই তো নিজের চোখের সামনে হতে দেখলাম ভন্তে। সে কোনও সাধারণ যুবক নয়। যেমন অদ্ভুত তার অস্ত্রচালনা, তেমনই আশ্চর্য তার যুদ্ধকৌশল। শুধু তাই নয় প্রভু, তার দুই বাহুতে যেন অযুত মত্তহস্তীর বল, আর ক্ষিপ্রতায় সে মহানাগ, মহাকালসর্প। দেখে মনে হচ্ছিল—যেন স্বয়ং পরশুরাম অবতীর্ণ হলেন।’
‘কে এই যুবক?’ প্রশ্ন করলেন জিতসেন।
‘জানি না প্রভু৷’
‘কিন্তু সে তোমাকেই বা ছেড়ে দিল কেন রক্ষী?’ এই প্রথম কথা বলে উঠলেন রাজ্ঞী। তাঁর কণ্ঠ সুমিষ্ট, অথচ কঠিন৷ চক্ষুদুটি সুন্দর, কিন্তু পলকহীন৷ তাঁর দিকে অধিক সময় চেয়ে থাকা যায় না। রক্ষীটি একবার রানির দিকে তাকিয়েই মাথা নত করে ফেলল।
‘আর তুমিই বা কোন মুখে লগুড়াহত সারমেয়র মতো ফিরে এলে? তোমার শাস্তির ভয় নেই?’ হিসহিস করে উঠলেন রানি।
‘আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধ করেছিলাম দেবী।’—রক্ষীর স্বর কম্পিত হচ্ছিল, ‘কিন্তু, সেই যুবকের অতিলৌকিক যুদ্ধপ্রতিভার কাছে পরাস্ত হতে বাধ্য হই। বিশ্বাস করুন দেবী, আমাদের সব কৌশল, সমস্ত পরাক্রম, সেই মহাবলীর কাছে ব্যর্থ হয়ে গেছে।’
‘সত্য বলো রক্ষী, তোমার সঙ্গে তার কোনও ষড় নেই তো? রাজদ্রোহের শাস্তি জানো তো?’ বিষাক্ত মসৃণ স্বরে প্রশ্ন করলেন রানি।
বঙ্গদেশে রাজদ্রোহিতার শাস্তি অতি ভয়ঙ্কর। কর্মান্তবাসকের পশ্চিমপ্রান্তে একটি মস্ত বড় অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ আছে। তার সঙ্গে দুটি ছোট খাঁড়ি বরাবর মেঘান্দর যোগ রয়েছে। সেখানে প্রকাশচন্দ্র তাঁর অত্যন্ত পছন্দের একটি জলচর প্রাণী পোষেন, কুমির। বঙ্গদেশে রাজদ্রোহিতার একটাই শাস্তি, অপরাধীকে সেই হ্রদে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ফেলে দেওয়া। প্রকাশচন্দ্র চান—মানুষ মনে রাখুক, রাজদণ্ড কতটা নির্মম হতে পারে।
‘সত্যি কথা বলো রক্ষী। তুমি জানো না—কে এই যুবক?’
‘জানি না দেবী। আমার প্রয়াত মাতার নামে শপথ করে বলছি। অবশ্য…অবশ্য…আমি সংজ্ঞাহীন হওয়ার পূর্বে একটি কথা শুনেছিলাম।’
‘কী? কী শুনেছিলে?’
‘সেই যুবক যোগেন্দ্রর মুণ্ডু একটি ভল্লের আগায় গেঁথে আমার সামনে এনে বলেছিল, ‘শোন রে মূর্খ, তোকে জীবন দিলাম একটিই কারণে। যাতে তুই ফিরে গিয়ে তোর প্রভুকে বলতে পারিস—বপ্যটপুত্র গোপালদেব এসেছেন!’
.
ঘর্ঘরধ্বনিতে চতুর্দিক মুখরিত করে সুসজ্জিত রথখানি কর্মান্তবাসকের উত্তরদ্বারে এসে পৌঁছতেই বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হল। নগরীতে প্রবেশের জন্য অপেক্ষমান জনতার অনেকেই ফিরে দেখতে থাকলেন।
বহুমূল্য রথখানি বিচিত্র সজ্জায় সজ্জিত। দুখানি স্বাস্থ্যবান কৃষ্ণবর্ণ অশ্ব তার বাহন। এই প্রাণীটি বঙ্গদেশে একেবারে অদৃষ্টপূর্ব না হলেও অনেকের কাছেই কৌতূহলের বিষয়।
তবে সমবেত জনতা অধিক মনোযোগী ছিল রথারূঢ় যুগলের প্রতি। সুঠামদেহী তাম্রবর্ণ পুরুষটি পরেছেন অতি দুর্মূল্য চীনাংশুক। নাসিকা সামান্য খর্ব, আয়ত নয়ন ভারি মনোহর৷ আজানুলম্বিত বাহু। ঈষৎ কুঞ্চিত কেশদাম।
নারীও অপরূপ সুন্দরী। তাঁর গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল গৌর। নাসা সুউন্নত। আঁখি গভীর ও শান্ত। সর্বাঙ্গে কমনীয়তা স্নিগ্ধ জ্যোতির মতো জড়িয়ে রয়েছে। সমবেত জনতা তাঁকে দেখেই যুক্তকরে প্রণাম জানাচ্ছে, মৃদু গুঞ্জন উঠে আসছে, ‘ইনি নিশ্চয়ই কোনও উচ্চবংশের মহিয়সী। আহা, কী অসামান্য রূপমাধুরী, কী স্নিগ্ধ লাবণ্য! এমন দেবীদর্শনেও অশেষ পুণ্য।’
পুরুষটি মহিলার কানে কানে কৌতুকস্বরে বললেন, ‘আর্যা মন্দার্ভা, শিশুকালে শুনেছিলাম সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। আজ তার চাক্ষুষ প্রমাণ পেলাম। আপনার একবার শুধু যোদ্ধৃবেশ ধারণ করে উন্মুক্ত খড়্গহস্তে রণভূমিতে আবির্ভূত হওয়ার অপেক্ষা৷ জনগণ ‘জয় দেবী চামুণ্ডা’ বলে আপনার পদতলে লুটিয়ে পড়বেই।’
নারী স্মিতহাস্য ওষ্ঠে ধরে রেখে বললেন, ‘বাচালতা করবেন না, আর্য পদ্মসম্ভব। লোকেশ্বর যা আদেশ দিয়েছেন, যথাযথ পালনের ব্যবস্থা করুন। আর হ্যাঁ, অভিনয়ের প্রয়োজনে যতটা কাছে আসা প্রয়োজন ঠিক ততটাই আসবেন, তার বেশি নয়।’
পুরুষটি কপট হতাশার ভঙ্গি করলেন। ততক্ষণে রথ দ্বারপালের সামনে এসে পৌঁছেছে৷
স্থূলোদর দ্বারপাল অতি মনোযোগ সহকারে চন্দ্রবংশের চিহ্নলাঞ্ছিত চতুষ্কী প্রস্তুত করছিল। শকট সামনে এসে দাঁড়াতে সে অলসভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘মহাশয়ের পরিচয়?’
পদ্মসম্ভব গম্ভীরভাবে বললেন, ‘উড্ডীয়ানের শ্রেষ্ঠী আর্য কমলরক্ষিত এবং তাঁর সহধর্মিণী শ্রীমতী পদ্মাবতী।’
‘এখানে আগমনের উদ্দেশ্য?’
‘বাণিজ্য। এই অপরূপ বঙ্গদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপরি প্রাপ্তি৷ আসলে…’ বলতে বলতে মন্দর্ভাকে কিছু কাছে টেনে নিলেন পদ্মসম্ভব, ‘আর্যা সদ্য গর্ভবতী হয়েছেন। তাই তাঁকেও নিয়ে এসেছি।’
মন্দর্ভা দ্বারপালের দিকে একটি সলজ্জ হাস্য উপহার দিলেন। তারপর অপাঙ্গে যে দৃষ্টিতে পদ্মসম্ভবের দিকে তাকালেন, তাতে সত্যযুগ হলে সেই মুহূর্তেই পদ্মসম্ভবের দেহভস্ম বাতাসে বিলীন হয়ে যাওয়ার কথা।
দ্বারপাল বলল, ‘কামরূপে আজকাল এরকম তেজিয়ান অশ্ব পাওয়া যাচ্ছে নাকি?’
পদ্মসম্ভবের হাসি বিস্তৃত হল। বললেন, ‘কামরূপের অনেককিছুই তো বঙ্গদেশের আপাত অজানা।’
দ্বারপাল এতক্ষণ মাথা নীচু করে ছিল। মুখ তুলেই চমকিত হয়ে লাফিয়ে উঠল ‘আপনি? এখানে? আর্যা মন্দর্ভা? আপনিও?’
মন্দর্ভা হতচকিত। মুহূর্তমাত্র দৃষ্টিপাত করেই পদ্মসম্ভব রথ থেকে লাফিয়ে নামলেন। দ্বারপালের গলা জড়িয়ে বললেন, ‘মিত্র মল্ল সিংহোদর! তুমি এখানেও!’
তারপর মন্দর্ভার উদ্দেশে উচ্চস্বরে বললেন, ‘কী সৌভাগ্য প্রিয়ে, প্রাক্তন মিত্র সিংহোদরকে যে ফিরে পাব স্বপ্নেও ভাবিনি। নালন্দায় পঠনপাঠনের দিনগুলিতে ওর সঙ্গে কতই না সুমধুর দিন কাটিয়েছি। মনে পড়লেই চোখদুটি ভিজে উঠছে। তাই না ভাই সিংহোদর?’
সিংহোদর বলল, ‘সে আর বলতে?’ তারপর বলল, ‘আপনি এখানে কী মনে করে প্রভু?’
‘ধরে নাও যা বললাম তাই৷ এই দেশের সৌন্দর্য অবলোকন।’
একবার চারিপাশ দেখল সিংহোদর৷ তারপর চাপাস্বরে বলল, ‘আপনারা একাই? না কি আচার্য শান্তরক্ষিতও এসেছেন?’
‘গুরু বিনা কি শিষ্যের ভ্রমণ সফল হয়?’
‘কোথায় তিনি?’
পদ্মসম্ভব স্মিত হাসলেন৷
মল্ল সিংহোদর কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল, ‘দিনকাল ভালো নয় আর্য। এইসময়ে আর্যাকে নিয়ে বঙ্গদেশ ভ্রমণে এসে ভালো করেননি।’
‘ভালো নয়? কীরকম?’
সিংহোদর অস্ফুটে বলে, ‘এ দেশের অবস্থার ব্যাপারে কি কিছুই শোনেননি?’
‘শুনেছি বইকি। সেই জন্যই তো আসা।’
সিংহোদর কয়েক মুহূর্ত চুপ৷ তারপরেই তার চোখেমুখে অস্থির উত্তেজনা ফুটে উঠল। ‘আশা কি আছে প্রভু? এই পাপিষ্ঠার কবল থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব?’
পদ্মসম্ভব গভীর চোখে মল্ল সিংহোদরের দিকে চাইলেন৷ ডান হাতটি তার কাঁধের ওপর রেখে বললেন, ‘আমার ওপর বিশ্বাস আছে ভাই সিংহোদর?’
‘আছে প্রভু।’
‘তাহলে শোনো। পৃথিবীতে আজ অবধি এমন কোনও শৃঙ্খল নির্মিত হয়নি—মানুষ যা ছিঁড়তে পারে না। এমন কোনও কারাগার প্রস্তুত হয়নি—মানুষ যা ভাঙতে পারে না। এমন কোনও অত্যাচারী জন্ম নেয়নি—মানুষ যাকে নিশ্চিহ্ন করতে পারে না।’
মল্ল সিংহোদর জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে থাকে পদ্মসম্ভবের দিকে।
‘সঙ্গে আছ, মল্ল সিংহোদর?’
‘আছি প্রভু৷’
পদ্মসম্ভব তাঁর কানে কানে কিছু একটা বললেন। শুনতে শুনতে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মল্ল সিংহোদরের।
.
.
রাত্রির তৃতীয় যাম। রাজপ্রাসাদ অন্ধকার। আকাশে মেঘ৷ তমসাবৃত চরাচর। শুধু মৃদুমন্দ হাওয়ায় অলিন্দের শূন্য পিঞ্জর থেকে টুংটাং ধ্বনি ভেসে আসছে।
চন্দনপালঙ্কে রতিক্লান্ত দুই নরনারী৷ পুরুষের বুকে মাথা রেখে নারীটি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন৷ একসময় অস্ফুটস্বরে বললেন, ‘আপনাকে এত বিক্ষিপ্ত লাগছে কেন প্রভু?’
প্রকাশচন্দ্র রানির চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘আমি অত্যন্ত চিন্তিত৷’
‘কারণ জানতে পারি প্রভু?’
অন্ধকারেই ম্লান হাসলেন প্রকাশচন্দ্র। এই নারী তাঁর আত্মার অংশ৷ যেদিন এই কন্যাকে তিনি নিজের জীবনে গ্রহণ করেছিলেন, সে বড় পুণ্যের দিন ছিল। সেইদিন থেকে তাঁর জীবনে একের পর এক সাফল্য করায়ত্ত হয়েছে অনায়াসে। তন্ত্র ও মন্ত্রের জগতে এমন কোনও বিদ্যা নেই—যা তাঁর অধিগম্য নয়। এই নারীকে তিনি নিজের সৌভাগ্যের চিহ্ন বলে সঙ্গে সঙ্গে রেখেছেন। মুহূর্তমাত্র নিজের থেকে আলাদা হতে দেননি।
ডান বাহু ললাটে রাখলেন প্রকাশচন্দ্র, আজকাল প্রায়শই কারণে অকারণে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছেন তিনি৷ এ কি বার্ধক্যের লক্ষণ?
তাং সম্রাট গাওজং এর প্রিয়তমা রক্ষিতা, চীন সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠতম তন্ত্রবেত্তা য়ু জেতিয়ান ছিলেন তাঁর গুরুমাতা। তাঁর আশীর্বাদে আজ তিনি প্রলম্বিত যৌবনের অধিকারী। একমাত্র অপঘাত বা দুর্ঘটনা ব্যতীত তাঁর মৃত্যু নেই, গুরু য়ু জেতিয়ান এই বরও দিয়েছেন তাঁকে। তবুও এক অচেনা দুর্লক্ষণ ক্রমেই শঙ্কিত করে তুলছে মহাতান্ত্রিক প্রকাশচন্দ্রকে।
তাঁর জন্ম বঙ্গদেশের এক কায়স্থ পরিবারে। পিতা দিবানাথ ছিলেন চন্দ্রবংশের অধীনস্থ এক ক্ষুদ্র ভূম্যধিকারী। চন্দ্রবংশ তখন খড়্গরাজের অধীনস্থ এক সামন্তবংশ। দিবানাথ এক গ্রাম্য শৈবসাধক ছিলেন। বিবিধ শৈব সাধনায় তাঁর সিদ্ধাই ছিল। কিছুটা তার জোরে, এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ভর করে তিনি চন্দ্রবংশের সিংহাসন দখল করেন। তবে শাসক হিসেবে অযোগ্য ছিলেন না৷ লোকে বলে দিবানাথ ন্যায়পরায়ণ এবং সুশাসক ছিলেন।
কিন্তু বহুদিন অপুত্রক ছিলেন দিবানাথ। উত্তরাধিকারীর অভাবে তাঁর রাজত্ব কে দেখবে—সেই নিয়ে সর্বদাই চিন্তিত থাকতেন তিনি। তারপর একদিন এক অঘোরী সিদ্ধপুরুষ তাঁর রাজ্যে আসেন৷ তাঁকে সেবায় তুষ্ট করলে তাঁর যোগমন্ত্রে দিবানাথের মহিষী গর্ভবতী হন। দিবানাথ আনন্দের বশে রাজ্যে তিন দিনের উৎসব ঘোষণা করেন।
এত কিছুর পরেও দিবানাথের আনন্দ স্থায়ী হয়নি।
নবজাতক যখন জন্মায় তখন পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ চলছিল। প্রকাশচন্দ্র ভূমিষ্ঠ হওয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে রাজপ্রাসাদের মাথার ওপর উড়তে দেখা যায় শ্যেন ও গৃধ্র, শোনা যায় রাসভ ও শৃগালের সমবেত উল্লাসধ্বনি।
এতগুলি অমঙ্গল চিহ্ন দেখে রাজ্যের মানুষ শঙ্কিত হয়ে ওঠে। রাজজ্যোতিষী ঘোষণা করেন যে এই শিশু অত্যন্ত অশুভ, চন্দ্রবংশ ও দেশের অশেষ দুঃখের কারণ হবে। সভাসদ এবং অন্যান্য ভূম্যধিকারীরা দিবানাথের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন শিশুটিকে ত্যাগ করার জন্য।
অবশেষে দিবানাথ নবজাতক শিশুপুত্রকে ত্যাগ করেন। তাঁর এক আত্মীয় অনন্তচন্দ্র ছিলেন হরিকেলের সম্পন্ন ব্যবসায়ী। অনন্তচন্দ্র ও তাঁর স্ত্রীর কোনও সন্তান ছিল না। দিবানাথ তাঁর সদ্যোজাত পুত্রসন্তানটিকে তুলে দেন তাঁদের হাতে৷ জীবনে তিনি তাঁর পুত্রের মুখদর্শন করেননি।
অল্প বয়স থেকেই প্রকাশচন্দ্র আশ্চর্য এবং অদ্ভুত সব ক্ষমতার পরিচয় দিতে থাকেন। বোঝা যায় যে, তিনি কোনও সাধারণ শিশু নন।
প্রকাশচন্দ্রের পালক মাতা কামিনীদেবী ছিলেন একজন ডাকসিদ্ধা যোগিনী। তিনি শিশুবয়সেই প্রকাশচন্দ্রকে তন্ত্রবিদ্যায় দীক্ষিত করেন। তিনি জানতেন, এই শিশুর শরীরে রাজলক্ষ্মণ আছে৷
প্রকাশচন্দ্র যখন পঞ্চদশবর্ষীয় কিশোর, তখন অনন্তচন্দ্র যবদ্বীপে বাণিজ্য করতে যাবেন বলে সপ্তডিঙা নৌবহর সাজান। প্রকাশচন্দ্র পালকপিতাকে অনুরোধ করলেন তাঁকেও সঙ্গে নেওয়ার জন্য। অনন্তচন্দ্র সম্মত হলেন৷
নৌযাত্রা যখন প্রায় শেষের পথে, সহসা দেখা দিল প্রবল ঘূর্ণিঝড়। শান্ত ধীর সমুদ্র ফুঁসে উঠল সহস্রশীর্ষ অজগরের মতো। সেই প্রবল বিপর্যয়ে অনন্ত সওদাগরের নৌকাগুলি যে কোথায় কোনদিকে ছিটকে পড়ল, কে জানে। জ্ঞান ফিরতে প্রকাশচন্দ্র দেখলেন তিনি সমুদ্রতীরে শুয়ে আছেন। একা। আশেপাশে আর কেউ নেই।
মনে নেই সেই কবে, কত হাত আর কত দেশ ঘুরে তিনি পৌঁছে যান এক আশ্চর্য দেশে। সুপ্রাচীন সভ্যতার চিন দেশ৷ ততদিনে হয়তো নিজের অধীত ভৌমবিদ্যার বলে নিজেকে মুক্ত করে দেশে ফিরে আসতে পারতেন প্রকাশচন্দ্র। কিন্তু অজানাকে জানার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল।
চীনে পৌঁছে বিস্মিত হতবাক প্রকাশচন্দ্র৷ বঙ্গদেশের থেকেও বহুগুণে বিচিত্র এবং সমৃদ্ধ এদের সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্ম। তখন তিনি ক্রীতদাস৷
ক্রীতদাস প্রকাশচন্দ্র রাজ পরিবারের পরিচারক হিসেবে নিযুক্ত হন। তারপর নিজগুণে তাং বংশের সম্রাট গাওজং-এর প্রিয়তম উপপত্নী য়ু জেতিয়ানের নজরে পড়েন তিনি। বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তাঁর বঙ্গজ সৌকুমার্যও যথেষ্ট সহায় হয়েছিল। মহান সম্রাজ্ঞী য়ু জেতিয়ান, চীন দেশের প্রথম নারী শাসক য়ু জেতিয়ান, সমগ্র চীনদেশের শ্রেষ্ঠ তন্ত্রবিদ য়ু জেতিয়ান তাঁর সবটুকু ছিলেন। তাঁর মাতা, তাঁর প্রভু, তাঁর আত্মার আত্মীয়, এমনকী তাঁর প্রেমিকাও। য়ু জেতিয়ান তাঁকে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছিলেন৷
‘কী ভাবছেন প্রভু?’ প্রশ্ন করলেন রানি।
‘কিছু একটা ঘটতে চলেছে প্রিয়ে। খুব বড় একটা কিছু!’
‘কেন প্রভু? এরকম মনে হচ্ছে কেন?’
‘আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় প্রিয়ে৷ সে কখনও মিথ্যা বলে না।
‘যেমন?’
‘কাল মধ্যরাত্রে পঞ্চমুণ্ডির আসনে দেবী বজ্রচর্চিকার ধ্যানে রত ছিলাম। তুমি তো জানো, দেবী বড়ই জাগ্রত, সাধকের ধ্যানে বিন্দুমাত্র বিঘ্ন সহ্য করেন না তিনি।’
‘জানি নাথ।’
‘কাল অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মনকে একাগ্র ও তন্ময় করে তুলতে পারছিলাম না। কী যেন একটা বাধা বার বার চিত্তকে বিক্ষিপ্ত করে তুলছিল। শেষে আসন প্রত্যাহার করে উঠে আসব, এমন সময় একটি দৃশ্য দেখে বিহ্বল হয়ে গেলাম।’
রানি সপ্রশ্নচোখে চেয়ে রইলেন৷
‘দেখলাম পঞ্চমুণ্ডির নরমুণ্ডটির মুখগহ্বর থেকে একটি বৃহৎ কালকেউটে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে।’
পালঙ্কের ওপর দ্রুত উঠে বসলেন রানি। ‘এর অর্থ কী নাথ?’
‘জানি না প্রিয়ে। কিন্ত মনে হচ্ছে ঝড় বোধহয় আসন্ন।’
‘আজ প্রভাতে রাজসভায় যে কাহিনিটি বলল প্রহরী, তার সঙ্গে কি এর কোনও সম্পর্ক আছে প্রভু?’
‘আছে প্রিয়ে৷’ উঠে বসলেন প্রকাশচন্দ্র, ‘পরিস্থিতি খুবই সঙ্গীন। যে কূট পরিকল্পনার বীজ বহুদিন আগেই আমরা উপ্ত করেছি এই দেশের ভূমিতে, তাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি পরিণতির দিকে, তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে একদল প্রতিস্পর্ধী মানুষ। তারা সাধারণ মানুষ নয়।
‘আমার চরেরা সংবাদ আনছে যে, বঙ্গদেশের চারিদিকে যে বিক্ষোভের আগুন জ্বলছে, তাতে ইন্ধন যোগাচ্ছে এই মানুষেরা। এই দেশের সঙ্গে তাদের নাড়ির টান অনেক গভীর। আমাদের পরিকল্পনা তারা বুঝে ফেলেছে৷ তারা ঐক্যবদ্ধ করছে আপামর জনতাকে।’
‘এরা কারা?’
‘একদল শৈব আর সহজিয়া সন্ন্যাসী। মানুষ তাদের শ্রদ্ধার চোখে দেখে। সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদের প্রভাব বিপুল। তারাই আজ সাধনার আসন ছেড়ে অস্ত্র ধরেছে আমাদের বিরুদ্ধে।’
‘কিন্তু কেন? ধর্মের সাধক রাজনীতির অঙ্গনে কেন?’
‘ধর্ম রানি, ধর্ম। ধর্মের ক্ষয়ই তাদের এই পথে টেনে এনেছে।’
‘কিন্তু এরা কী করে রোধ করবে আমাদের পরিকল্পনার গতি?’
‘এরা একদল প্রতিস্পর্ধী মানুষ, আমাদের উৎখাত করতে চায় রানি। বিদ্রোহের পথে, গণ-অভ্যুত্থানের পথে। এরা চায় চীন সম্রাট গাওজং আর গুরু য়ু জেতিয়ান-এর বঙ্গদেশ ধ্বংস করার স্বপ্নকে আবর্জনার স্তূপে নিক্ষেপ করতে।’
রানির চোখ দুটো অন্ধকারে ধ্বক করে জ্বলে উঠল, ‘অসম্ভব! আমাদের পরিকল্পনা পূর্ণ হবে, আরব্ধ কর্ম অবশ্যই সম্পন্ন হবে। এই দেশ একদিন ধর্ম আর নীতিবোধ জলাঞ্জলি দেবে, ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করে মরবে, ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে উৎসন্নে যাবে, বেশ্যা আর ভিক্ষুকের দেশ হবে। হবে, হবে, হবেই।’
.
ভোর। হেমন্তের হিমেল ভোর।
ব্রাহ্মমুহূর্তের প্রথম সূর্যকিরণ মেঘান্দ নদীর জল স্পর্শ করতেই শত সহস্র উলঙ্গ সন্ন্যাসীর দল ‘জয় বজ্রযোগিনীর জয়’ বলে নদীর জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়লেন। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভাববিহ্বল ভক্তের দলও পুণ্য-অবগাহনের উদ্দেশে নদীতে নেমে পড়লেন। মেঘান্দ’র বুকে আলোড়ন উঠল।
মাস দুই বর্ষা শেষ হয়েছে। মেঘান্দ এখন যুবতী নারীর মতো উচ্ছ্বল। এখান থেকে নদীপথে পূর্বসাগরের মোহনা একদিনের যাত্রা। সমুদ্রগামী নৌকাগুলি যতই সাগরের নিকটবর্তী হয়, মেঘান্দ ততই উদ্দাম ও চঞ্চল হয়ে ওঠে।
মেঘান্দ’র অন্য পাড়ে একটি বিস্তীর্ণ প্রান্তর, সেই প্রান্তর শেষ হলে লালিম্ববন পাহাড়শ্রেণী৷ তার পাদদেশে সুবিশাল শালিবন বৌদ্ধবিহার। এই বিহার সমতটের দেববংশের অর্থানুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তবে আপাতত তার ভরণপোষণের দায়িত্ব চন্দ্রবংশের। প্রকাশচন্দ্রের আদেশই এখানে শেষ কথা।
অবগাহনের পর পুণ্যার্থীরা উঠে এসে সূর্যপ্রণাম করতে লাগলেন। ভক্তিমতী পুরুষ ও রমণীরা সিদ্ধাচার্যদের প্রণাম করে আশীর্বাদ নিতে লাগলেন। থেকে থেকে দেবী বজ্রযোগিনীর নামে গর্জন উঠতে লাগল।
জনারণ্য থেকে কিছু দূরে দুই নবীন যুবক সমগ্র কর্মকাণ্ড অবলোকন করছিলেন। তাঁরাও একটু আগে স্নান সেরে উঠেছেন৷ ঊর্ধ্বাঙ্গে উত্তরীয়, অধোমাঙ্গে খাটো অধোবাস। চুলগুলি অবিন্যস্ত। সরস ও প্রসন্ন মুখমণ্ডল, সর্বদাই কৌতুকে ঝলোমলো।
প্রথমজন বললেন, ‘নাটকের কুশীলবরা তো সবাই প্রস্তুত। কিন্তু প্রধান সূত্রধর মহাশয়ের কী সংবাদ?’
দ্বিতীয়জন বললেন, ‘আজই তো তাঁর রঙ্গস্থলে উপস্থিত হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি আবার বড়ই লাজুক। কোথা থেকে কীভাবে তাঁর আবির্ভাব ঘটবে—সে বলা ভারি মুশকিল।’
‘রঙ্গমঞ্চের পর্দা উঠবে কখন?’
‘আগে তথাগতর নামে, ধর্মের নামে, সঙ্ঘের নামে কিছু পূজাপাঠ হোক, তারপর নাহয় নাটক শুরু হবে। বুদ্ধনাটক কি অতই সহজ বস্তু ভায়া?’
‘আমাদের এখন কাজ কী?’
‘কিছুই না। শুধু দেখে যাও। শোনো ভায়া, শাস্ত্রে বলেছে—দেশকে যদি ভালোভাবে জানতে চাও, তাহলে দু’খানি স্থান অতীব প্রশস্ত। এক তীর্থস্থান, দুই শৌণ্ডিকালয়।
প্রথমজন কৌতুক অনুভব করলেন, স্মিতহাস্যে প্রশ্ন করলেন, ‘কীরকম?’
‘তাহলে শোনো। ওই যে বিপুলোদর সন্ন্যাসীটিকে দেখছ, ওঁর নাম যোগী উড়ুম্বর। ইনি অতি বিখ্যাত মন্ত্রযানী বৌদ্ধ আচার্য। নর্মদাতীরে এঁর ধর্মস্থান বড়ই প্রসিদ্ধ, শিষ্য সংখ্যা কম করে হলেও দ্বিসহস্রাধিক। অর্থগৌরবে ইনি বড় বড় শ্রেষ্ঠীকে লজ্জা দিতে পারেন।
‘ওই যে চর্মটিকাসদৃশ প্রৌঢ়কে দেখছ ধ্যানমুদ্রায় বসে থাকতে, উনি কর্মান্তবাসকের বিশিষ্টতম শ্রেষ্ঠী দিবোদাস। আর যে কন্যাটিকে দেখছ তাঁর গাত্রমার্জনা করে দিতে, উনি দিবোদাসের বিধবা পুত্রবধূ। প্রৌঢ়া দিবোদাস তাঁর সুন্দরী বিধবা পুত্রবধূটিকে বড়ই স্নেহ করেন, এমনকী বিদেশে গেলেও তাঁকে সঙ্গী করেন। এক্ষেত্রে স্নেহের গতি কিঞ্চিৎ কুটিল।
‘ওদিকে যে সৌম্যদর্শন তরুণ স্নান সেরে উঠে আসছেন, তাঁর উজ্জ্বল ও মেধাবী মুখখানি ভালো করে লক্ষ করো। উনি শালিবন বিহারের অত্যুজ্বলতম রত্ন, কুমার সিদ্ধার্থশর্মা। বিশুদ্ধসিদ্ধান্তকারিকা এবং শব্দার্থমঞ্জরী নামের দু’খানি অত্যুত্তম গ্রন্থের রচয়িতা। আচার্য বিশুদ্ধকীর্তির পর ভন্তে বুদ্ধগুপ্ত, তারপরে ইনি।
‘ওই যে লোলচর্ম বৃদ্ধাকে দেখছ পূর্বাস্য হয়ে সূর্যপ্রণাম করতে, উনি কর্মান্তবাসকের বৃহত্তম গণিকালয়টির অধিষ্ঠাত্রী দেবী, নাম মঞ্জরী। ইনি চৌষট্টিকলায় মহা পারঙ্গম। কর্মান্তবাসকের যাবতীয় রাজন্য এবং বণিককন্যাদের নৃত্যগীত পটিয়সী করে তোলা, কলাবিদ্যা থেকে শুরু করে সীবনশিক্ষা, রন্ধনশিল্প থেকে শুরু করে উদ্যানবিদ্যায় পারদর্শী করে তোলার গুরুদায়িত্ব আপাতত এঁর বৃষস্কন্ধেই ন্যস্ত।
‘ওই যে উলঙ্গ সন্ন্যাসীদের দেখছ তাদের দীর্ঘ লিঙ্গগুলি পুণ্যলোভাতুর শিষ্যশিষ্যাদের মস্তকে স্পর্শ করে আশীর্বাদ দিতে, ওঁরা এক বিশেষ সহজিয়া সন্ন্যাসী সম্প্রদায়, নাম সহজলিঙ্গ। এঁরা উলঙ্গ থাকেন, ভিক্ষা করে খান, খাদ্যাখাদ্যের বাছবিচার নেই। তবে স্বভাবে বড়ই উগ্র। সামান্য অশ্রদ্ধাজ্ঞানে খর্পর ও ত্রিশূল হস্তে রুদ্ররূপ ধারণ করেন।
‘ওই যে দেখছ সুন্দরী পৃথুলা রমণীর দল উঠে আসছেন স্নান করে, ওঁরা কর্মান্তবাসকের বিভিন্ন বণিক, ব্রাহ্মণ, এবং রাজপদাধিকারীদের স্ত্রী ও বধূদের দল। ব্যস্ত গৃহস্বামীদের থেকে এঁরা না-পেয়েছেন প্রেম, না সময়। স্বামীদের অগোচরে এঁরা গৃহভৃত্য বা দেবরদের বিশেষ অনুগ্রহ করে থাকেন। অনেকে আবার গৃহদেবতার সেবায় নিজেদের তনুমন সমর্পণ করেছেন।
‘ওই দেখো, চটুল চপল কিশোরের দল একপ্রান্তে সমবেত হয়ে সিক্তবসনা রমণী দেখতে ব্যস্ত। তাদের চোখে দুরন্ত কৌতূহল৷ নারীশরীরের অপার রহস্য তাদের কাছে এখনও অধরা৷
‘ওই দেখ, বঙ্গদেশের বিশিষ্ট রাজন্যকদল স্নান সেরে উঠে আসছেন। সর্বাগ্রে আছেন রাজগুরু বিশুদ্ধকীর্তি। মহাপণ্ডিত হলে কী হবে, এই বয়সেও বৃদ্ধের নারীলিপ্সার অন্ত নেই।
‘বিশুদ্ধকীর্তির দক্ষিণপার্শ্বে আছেন প্রধানমন্ত্রী অমিতাভভট্ট। স্বভাবে বাতুল এবং কিঞ্চিৎ কোমল। কাব্য ও নাট্যপ্রেমী বলে বিখ্যাত। সরল ও কূটগরলবিহীন বলে জনমানসে শ্রদ্ধা পেয়ে থাকেন।
‘বিশুদ্ধকীর্তির বামপার্শ্বে আছেন মহাদণ্ডনায়ক জিতসেন। ঈষৎ স্থূল বুদ্ধি হলে কী হবে, ইনি সেই ত্রুটিটুকু পূরণ করেছেন সিংহাসনের প্রতি তাঁর প্রশ্নহীন আনুগত্য এবং সীমাহীন নৃশংসতা দিয়ে। তরবারি ছাড়া অন্য কিছুর ভাষা বোঝেন না।
সামান্য পশ্চাতে রয়েছেন মহাসান্ধিবিগ্রহিক অগ্নিমিত্র। মহাধূরন্ধর। এঁর মুদ্রার লোভ অপরিমেয়। সামান্য কয়েকটি স্বর্ণদিনারের লোভে ইনি নরকের পথেও যাত্রা করতে পারেন।
‘পেছনে রয়েছেন রাজবৈদ্য কুল্লুকভট্ট। প্রবীণ রাজবৈদ্য চিকিৎসাশাস্ত্রে সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি। বৃদ্ধের পুরুষাকারও বড়ই প্রবল, প্রয়োজন হলে রানি বা প্রকাশচন্দ্র, কাউকেই উচিত কথা বলতে ছাড়েন না। ভয়ে হোক বা ভক্তিতে, এঁকে কেউ বিশেষ ঘাঁটান না।
‘কুল্লুকভট্টের ঠিক পাশে আছেন রাজসেবকবাহিনী প্রধান গিরিকিশোর। লাম্পট্য, ক্রূরতা, নৃশংসতায় তুলনাহীন৷ এর মুখখানি যেমন শুকরতুল্য, স্বভাবটিও তেমন। জন্ম বারবণিতা গৃহে। পিতৃদেব ছিলেন জনৈক শৌণ্ডিক। এঁর নারীলিপ্সার কাহিনি বঙ্গদেশে প্রবাদপ্রায়। মাতৃ-মাতৃষ্বসা জ্ঞান নেই, কন্যা-কন্যাসমা জ্ঞান নেই, রজস্বলা নারী হলেই হল৷ অনেকেই অপেক্ষা করে আছেন যে, অভ্যুত্থান সফল হলে এই লম্পটপ্রবরের পুরুষাঙ্গ কর্তন করে শিবাভোগ দেওয়া হবে।
‘সবার শেষে যিনি ধীর পদক্ষেপে উঠে আসছেন, ওঁকে বিশেষ করে লক্ষ করুন। উনি মহাপ্রতীহার শান্তঘোষ। কূটবুদ্ধি, ধূর্ততা এবং নিঃশব্দ নির্মমতায় বঙ্গদেশে এঁর তুল্য আর একজনই আছেন, স্বয়ং প্রকাশচন্দ্র। সর্বদিকে এঁর দৃষ্টি শকুনির মতো। মনে রেখো ভায়া, বঙ্গদেশের গূঢ়পুরুষবাহিনীর নেতৃত্বে আনন্দগুপ্তর মতো একজন মানুষ রয়েছেন। সেই ধুরন্ধর ব্যক্তি শান্তঘোষের মতামত ছাড়া চলেন না।’
‘আনন্দগুপ্ত! তিনি কোথায়?’
‘তিনি আপাতত দেবী বজ্রযোগিনীর মন্দিরে নিরাপত্তার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছেন। প্রতি বছরেই থাকেন৷ আজ অবধি তাঁকে কেউ এই পুণ্যস্নানে অংশগ্রহণ করতে দেখেনি।’
‘প্রকাশচন্দ্র এবং রানি?’
‘তাঁদের স্নান ব্রাহ্মমুহূর্তের পূর্বেই সম্পন্ন হয়েছে। তবে এখানে নয়, রাজপ্রাসাদে। মেঘান্দের জল কলসি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে স্নানের জন্য। তাঁরা তাঁদের পুণ্যস্নান সেখানেই সম্পন্ন করেছেন।’
‘সে কী? আমি যে শুনেছিলাম রানি আর প্রকাশচন্দ্রের স্নানের পর এই মহাস্নান শুরু হয়?’
‘গত বৎসর অবধি তাই-ই হতো ভায়া। কিন্তু অজ্ঞাত কারণবশত এইবার তার পরিবর্তন হয়েছে।’
‘কারণ?’
‘কারণ? বলা ভারি সমস্যা। তবে তুমি যদি খুব অনুরোধ করো, সূত্র দিতে পারি।’
‘কী?’
অস্ফূটে দ্বিতীয় বক্তা বললেন, ‘ওঁরা জানেন! ওঁরা জানেন যে আমরা জানি।’
‘একটি কথা মানতেই হবে, মিত্র পদ্মসম্ভব,’ বিস্মিত কণ্ঠে বললেন প্রথম যুবক, ‘আমি আর তুমি বোধহয় একই সময়ে এই অঞ্চলে একত্র হয়েছি। কিন্তু বঙ্গদেশের যাবতীয় সংবাদ যে দ্রুততার সঙ্গে তুমি সংগ্রহ করেছ—যেমন আশ্চর্যজনক, তেমনই বিচিত্র।’
পদ্মসম্ভব চাপাস্বরে হাসতে হাসতে বললেন, ‘ওহে শ্রীমান জয়াপীড়, তুমি ভাগ্যদোষে কাশ্মীর প্রদেশ ছেড়ে এখানে এসেছ। আর আমি পূর্বদেশের ভূমিজ সন্তান। কামরূপ থেকে শুরু করে তাম্রলিপ্ত, বজ্জি থেকে শুরু করে হরিকেলের তটভূমি, কান্যকুব্জ থেকে শুরু করে তিব্বত, অর্ধেক ভারতবর্ষ আমি নিজের হাতের মতো চিনি। এতক্ষণ ধরে যে সংবাদ তোমাকে জানলাম, সে আমার অনেকদিনের পরিশ্রমের ফসল।’
জয়াপীড় বললেন, ‘ও, সেইজন্যই লোকেশ্বর তোমাকেই বেশি বিশ্বাস করেন, তাই না?’
অট্টহাস্য করতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন পদ্মসম্ভব, ‘নেহাত চারিদিকে লোকসমাগম, নইলে এই দণ্ডেই তোমার গালে স্নেহচুম্বন উপহার করতাম। বলো তো, এই শিশুসুলভ অভিমান কি মহা তেজস্বী জয়াপীড়কে মানায়?’
জয়াপীড় তবুও মুখ নিশ্চুপ কালো করে রইলেন। পদ্মসম্ভব একটু অপ্রতিভ হলেন। কৌতুক তাঁর চরিত্রের স্বাভাবিক অলঙ্কার। তাতে কেউ আহত হলে তিনি অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন।
ইতিমধ্যে শরৎসূর্যের স্বর্ণাভ আলোয় চতুর্দিক উদ্ভাসিত। পুণ্যার্থীরা গৃহাভিমুখী। নদীতীর শূন্যপ্রায়। মেঘান্দের জলে এখন ভাঁটার টান। সেই স্রোতে অগণিত ফুলমালারাশি ভেসে যাচ্ছে৷
এইসময় দুজনের পশ্চাতে একজন এসে দাঁড়ালেন। বলে উঠলেন, ‘দু’খানি কপর্দক দান করে এই ভিক্ষুককে কিঞ্চিৎ সাহায্য করবেন ভদ্রজনেরা, জগন্ময়ী বজ্রযোগিনী আপনাদের সহায় হবেন।’
জয়াপীড় পিছন না ফিরেই বললেন, ‘আপনি অন্য কোথাও ভিক্ষা অন্বেষণ করুন প্রভু। আমরা দরিদ্র কৃষক। আমাদের কাছে এই উত্তরীয় ভিন্ন আর কিছুই নেই।’
পদ্মসম্ভব কিছু বললেন না।
ভিক্ষার্থী পুনরায় বললেন, ‘উত্তরীয় দুটিই দান করুন ভদ্র। ভারতবর্ষের দুই মহাবীরের উত্তরীয় বিক্রয় করে দুই কপর্দক তো পাবই।’
সঙ্গে সঙ্গে দুজনে পিছন ফিরলেন। জয়াপীড়ের ডান হাত তাঁর কটিদেশে, সেখানে একটি তীক্ষ্ণ ছুরিকা লুকোনো৷ পদ্মসম্ভব সচরাচর অস্ত্র বহন করেন না৷ তিনি কয়েকমুহূর্ত নির্নিমেষে ভিক্ষুকের দিকে তাকিয়েই উঠে দাঁড়ালেন। করজোড়ে বললেন, ‘আদিদেব শঙ্করের মূর্ত অবতার লোকেশ্বর মৎস্যেন্দ্রনাথকে প্রণাম।’
জয়াপীড় বিহ্বলচক্ষে ভিক্ষুককে দেখতে লাগলেন। ইনিই তাহলে সেই আসমুদ্রহিমাচল ভারতভূমির শ্রেষ্ঠতম যোগী মহেশ্বর মৎস্যেন্দ্রনাথ?
জয়াপীড় আভূমি প্রণাম করলেন, ‘যোগীশ্রেষ্ঠ মৎস্যেন্দ্রনাথের চরণ বন্দনা করি। অধমের নাম বিনয়াদিত্য জয়াপীড়, একদা ভারতবিজয়ী ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়ের পৌত্র, বর্তমান গৌড়েশ্বরের জামাতা। আপনাকে যে এই বেশে দেখতে পাব—ভাবিনি আচার্য। ঔদ্ধত্যের অপরাধ ক্ষমা করবেন।’
মৎস্যেন্দ্রনাথ জয়াপীড়কে সবলে আলিঙ্গন করলেন। জয়াপীড় যথেষ্ট বলশালী পুরুষ, তবুও এই সবল সস্নেহ আলিঙ্গনে প্রায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। মুক্ত হয়ে বললেন, ‘মৎস্যেন্দ্রনাথের প্রথম স্নেহ আলিঙ্গন আমার স্মৃতিতে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।’
পদ্মসম্ভব নিরীহ স্বরে বললেন, ‘বুকের পাঁজরগুলি ভাঙেনি তো ভাই?’
জয়াপীড় বলে ওঠার আগেই মৎস্যেন্দ্রনাথ সহাস্যে বললেন, ‘ভ্রাতৃপ্রতিম পদ্মসম্ভবের কথায় কিছু মনে করবেন না রাজন। কৌতুক ওঁর চরিত্রের স্বাভাবিক ধারা। কিন্তু সেই কৌতুকরসের মাপকাঠিতে এই অদ্ভুতকর্মা মানুষটির দৃঢ়তা, বীরত্ব এবং দুঃসাহসের পরিমাপ করা অসম্ভব। রাজপুত্র পদ্মসম্ভব ভগবান বিষ্ণুর অবতার।’
পদ্মসম্ভব সখেদে বললেন, ‘আপত্তি নেই। কিন্তু আচার্য যদি একবার ষোল হাজার গোপিনীর বিষয়টা নিশ্চিত করে দিতেন, আমার দাবিটা তবে বেশ পাকাপোক্ত হতো।’
মৎস্যেন্দ্রনাথ এবং জয়াপীড় দুজনেই উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলেন। শূন্য মেঘান্দ তীরের দ্বিপ্রহর সেই হাসির কলরোলে মুখর হয়ে উঠল।
মৎস্যেন্দ্রনাথ ক্লান্তস্বরে বললেন, ‘আমি অত্যন্ত শ্রান্ত৷ এই বিশাল মেঘান্দ নদীর ওপার হতে সাঁতার কেটে এপারে আসতে আসতে শক্তি নিঃশেষিত। আপাতত আমাদের গুপ্তগৃহে যাওয়া যাক না কি?’
জয়াপীড় এবং পদ্মসম্ভব দুজনেই শশব্যস্ত হলেন। পদ্মসম্ভব অপরাধী সুরে বললেন, ‘আচার্য শান্তরক্ষিত আমাদের বলেছিলেন আজ মেঘান্দতীরে আপনার জন্য প্রতীক্ষা করতে। তাঁর কাছে গুপ্তসংবাদ ছিল। কিন্তু আপনি যে এই বিশাল নদী সাঁতরে আসবেন—সেটি কারোরই ধারণার মধ্যে ছিল না প্রভু। চলুন, আচার্য আপনার বিশ্রামের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।’
তিনজনে ধীর পদক্ষেপে চলে যাওয়া মাত্র কাছের বিশাল অশ্বত্থ গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একজন মানুষ। তার দেহ ধূলিধূসরিত, কটিতে কৌপীন, মাথায় মস্ত জটা, উন্নত কপাল চন্দন ও সিন্দূরে চর্চিত। মানুষটি মূক ও বধির। সকাল হতে সে ভিক্ষাপাত্র হাতে বসেছিল গাছতলায়। স্নানার্থীদের দল তাকে ভিক্ষুক ভেবে সিন্দুরচর্চিত ফলমূল এবং কপর্দকরাশি উদারহস্তে বিলিয়ে গেছে।
কিন্তু ঈশ্বর তাকে মূক ও বধির করে পাঠালে কী হবে, সেই অক্ষমতা পূরণ করে দিয়েছেন অবিশ্বাস্য দুটি ক্ষমতা দিয়ে। এক, নির্মল আবহাওয়ায় সে অন্তত অর্ধক্রোশ দূরের দৃশ্য দেখতে পায়। দুই, মূক ও বধির হলেও সে মানুষের ওষ্ঠের চলন দেখে বক্তব্য অনুধাবন করতে পারে!
চারিদিক নিস্তব্ধ হলে সে কপর্দকগুলি কটিদেশে বেঁধে, ভিক্ষালব্ধ ফলগুলির কিছু গলাধঃকরণ করে দ্রুতপদে ধাবিত হল গন্তব্যের দিকে।
প্রভু ভাঁড়ুদত্ত তার অপেক্ষায় আছেন।
.
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন