পটমঞ্জরী – ১১

অভীক সরকার

একই দিনের দ্বিতীয় প্রহরের প্রথম দণ্ড। নির্মল আকাশ, সূর্য মধ্যগগনে। বজ্রযোগিনীর মন্দিরের সামনে লোকে লোকারণ্য। শতাধিক পুণ্যার্থী একত্রিত হয়েছেন পূজার্চনার উদ্দেশে। ফুলের মালায় সজ্জিত। মন্দিরচত্ত্বর চন্দনজলে ধৌত, চন্দনগন্ধে চারিদিক আমোদিত।

মূল গর্ভগৃহ থেকে মন্দিরের দুয়ার অবধি দুদিকের প্রাচীর বরাবর বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি৷ এঁরা বঙ্গদেশের বিভিন্ন ধনীগৃহে নিয়মিত পূজা পেয়ে থাকেন। এই দিনটিতে তাঁদের বজ্রযোগিনী মন্দিরে এনে রাখা হয় সাধারণের পূজা পাওয়ার জন্য। সবকটি মূর্তি তাম্রনির্মিত, পাতলা সোনার পাতের আবরণ। সূর্যের আলোয় তাদের ঔজ্জ্বল্য বহুগুণ বর্ধিত। অধিকাংশই তারাদেবীর মূর্তি। কিছু মঞ্জুশ্রী, জম্ভল, অমিতাভ ও অন্য বোধিসত্ত্ব মূর্তিও আছে৷ প্রতিটি দেবদেবীর মাথার ওপর প্রকাণ্ড ছত্র। তার স্বর্ণনির্মিত দণ্ড, দুর্মূল্য পশম বা রেশমের বস্ত্র৷ ছত্রে সোনার সূতার কাজ করা ঝালর, তার প্রতিটি প্রান্ত থেকে একটি করে মুক্তা ঝুলছে।

 উত্তর পূর্ব কোণে কয়েকটি ভয়ালদর্শন মূর্তি রাখা। যেমন হেরুক, চণ্ডরোষণ, একজটা, বজ্রচর্চিকা ইত্যাদি। এসব মূর্তির পূজারীরা বজ্রযানী তন্ত্রমতে পূর্ণাভিষিক্ত সাধক এবং উচ্চপদস্থ শাসকবর্গ। নইলে এইসব ক্রোধী দেবদেবীদের গৃহস্থপূজা যে-সে মানুষের কর্ম নয়।

মন্দিরের গর্ভগৃহের সামনে সাতজন শ্রমণ তারাদেবীর স্রগ্ধরা স্তোত্র পাঠ করছে। ভন্তে বুদ্ধগুপ্ত আজ অত্যন্ত ব্যস্ত। পূজাপর্বের সুষ্ঠু পরিচালনার দায়িত্ব তাঁর। মন্দিরের প্রধান দ্বারের সামনে অতিবৃহৎ যূপকাষ্ঠ। কয়েকজন ভীমদর্শন ডোম তাদের খড়্গের ধার পরীক্ষায় ব্যস্ত। পূজা শেষে একশত আটখানি মহিষ বলি হবে। তাদের এক এক করে মন্দিরের পিছনদিকে এনে বেঁধে রাখা হচ্ছে৷

উপস্থিত পুণ্যার্থীদের উচ্চ স্বরে সমগ্র অঞ্চল কোলাহলপূর্ণ। সকলে অপেক্ষা করছেন কখন প্রকাশচন্দ্র এবং রাজ্ঞী এসে পূজাপাঠ সমাপন করবেন। পুণ্যার্থীদের দলের একেবারে সামনে আছেন বজ্রযানী সন্ন্যাসীরা। তাঁদের উলঙ্গ ভস্মাবৃত দেহ, দীর্ঘ জটা আর খর্পর-খট্বাঙ্গ দেখে অন্যান্যরা একটু দূরে রয়েছেন।

আছেন কিছু সহজযানী সাধক। এঁদের অবস্থান সংসার এবং সন্ন্যাসাবস্থার মধ্যের বিন্দুতে। অনেকেরই বিবাহিতা স্ত্রী আছেন, বাকিদের সম্বল সাধনসঙ্গিনী। অধিকাংশই অন্ত্যজ এবং নিম্নবর্গীয় জাতিভুক্ত, স্থায়ী উপার্জন বলতে তেমন কিছু নেই। এঁরা নিষ্কাম ও নিঃস্বার্থ হলে কী হবে, স্বভাবে উদাস ও যাযাবর প্রবৃত্তির। সহজিয়া সাধকদের স্ত্রী বা সঙ্গিনীরা জন্মসূত্রে ডোম, রজক, মালি বা অন্যান্য অন্ত্যজ ঘরের কন্যা হয়ে থাকেন।

সাধকদের প্রায় সকলের মস্তক মুণ্ডিত। মুখমণ্ডল গুম্ফশ্মশ্রুতে আবৃত। আজানুলম্বিত বেশ, সেটি বিভিন্ন আকারের এবং বিভিন্ন রঙের ক্ষৌম, দুকূল, কৌষেয় এবং পট্টবস্ত্রের পট্টি বুনে প্রস্তুত।

দূর হতে ঢাক ঢোল ও মৃদঙ্গরব ভেসে এল। উপস্থিত জনতা সরে গিয়ে মন্দিরের প্রধানদ্বারের সম্মুখের স্থান উন্মুক্ত করে দিল। এইবার দেবীগর্জন শুরু হবে। প্রাকৃত সাধারণের ভাষায়, গাজন।

ভীষণদর্শন চণ্ডালের দল ঢাক ঢোল কাড়া নাকাড়া মৃদঙ্গ বাজাতে বাজাতে, ভয়ঙ্কর রণহুংকার দিতে দিতে এগিয়ে আসতে থাকল। বাদ্যকারদের পেছনে পেছনে আরেক সারিবদ্ধ দল, বঙ্গদেশের সেনাবাহিনীর পদাতিক যোদ্ধা। তাদের একহাতে লাঠি এবং অন্যহাতে হ্রস্বদৈর্ঘ্যের তরবারি। প্রস্তরকঠিন দেহগুলি তৈলাক্ত, শরীর বেয়ে নেমে আসছে স্বেদবিন্দু। ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, নিম্নাঙ্গে ক্ষুদ্র অধোবাস মালকোচা করে পরা।

গর্জনদলের প্রথমে একটি ক্ষুদ্র রথ। ফল ফুল মালা দীপ ধূপে পূর্ণ। রথের চারিদিকে চারটি অতিদীর্ঘ বল্লম। বল্লমগুলি রৌপ্যনির্মিত, ফলা স্বর্ণের। রথটির মধ্যস্থানে একটি বংশদণ্ড প্রোথিত, তার মাথায় উড়ছে চন্দ্রবংশের পতাকা৷ তার সামনে স্বর্ণনির্মিত থালার ওপর একটি অদ্ভুতদর্শন তরবারি রাখা। প্রকাশচন্দ্রের অজেয়, অব্যর্থ তরবারি।

এই দলের ঠিক পেছনেই ভয়ালদর্শন ডোমের দল। তাদের সারা শরীরে বিচিত্র সব উল্কি, মুখে নানা রঙ, হাতে অতিদীর্ঘ ভল্ল। ভল্লগুলির শাণিত ফলার ওপর সূর্যের কিরণ পড়ে ঝলসাচ্ছে। এরা একটি বর্গাকার ব্যূহে শ্রেণীবদ্ধ হয়ে আসছে৷ মাঝখানে চারজনের সারি করে ষোলজন অশ্বারোহী, তাদের ঘিরে চৌষট্টিজন পদাতিক। তাদের গম্ভীর রণহুঙ্কারে চারদিকের বাতাস কেঁপে উঠতে লাগল। শিশুরা কেঁদে উঠল। মায়েরা তাদের মুখে আঁচল চাপা দিলেন।

এই ডোমসৈন্য বঙ্গদেশের রণবাহিনীর প্রধান অংশ। এঁদের বীরত্বের কথা আসমুদ্রহিমাচল বিদিত। যতবার বঙ্গভূমি বৈদেশিক শক্তির কাছে পরাভূত হয়েছে, ততবার দেখা গেছে যে পরাজয়ের কারণ সৈনাপত্য ও রণনীতি। বঙ্গসেনার বীরত্ব নিয়ে কারও মনে কোনওদিনই কোনও সন্দেহ ছিল না। বঙ্গদেশের দেবী পূজার্চনায় চণ্ডাল, ডোম, শবর, এঁদের অধিকার সর্বাগ্রে।

ভন্তে বুদ্ধগুপ্ত স্মিত গাম্ভীর্যের সঙ্গে প্রধান দ্বারে এসে দাঁড়ালেন। সৈন্যদলের যিনি প্রধান, এগিয়ে এসে একটি ফল এবং একটি স্বর্ণখণ্ড ভন্তের হাতে দিলেন। বুদ্ধগুপ্ত দুহাত তুলে স্বস্তিবাচন উচ্চারণ করলেন। চারজন সৈন্য অগ্রবর্তী রথখানি তুলে ধর্মস্তূপের সামনে রাখতেই উপস্থিত শ্রমণেরা শঙ্খধ্বনি করলেন। পুণ্যার্থীর দল সহর্ষে ‘জয় দেবী বজ্রযোগিনীর জয়’ বলে চিৎকার করে উঠল।

এবার ডোমসৈন্যের দল দুপাশে সরে গিয়ে পথ করে দিতেই বজ্রযানী সন্ন্যাসীরা খট্বাঙ্গগুলি দুহাতে উপরে তুলে ধরে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন। আরেকদল সন্ন্যাসী ভীষণ গালবাদ্যে চারিদিক সন্ত্রস্ত করে তুললেন। ভন্তে বুদ্ধগুপ্ত মন্দিরের প্রধান ঘণ্টা বাজিয়ে দিতেই সন্ন্যাসীর দল একে একে মন্দিরে প্রবেশ করে গর্ভগৃহের সামনে বিচিত্র ভঙ্গিতে নাচতে লাগলেন৷ সঙ্গে উচ্চকণ্ঠে গাইতে লাগলেন, ‘এক সো পদ্ম চৌষঠী পাখুড়ী/ তঁহি চড়ি নাচঅ ডোম্বী বাপুড়ী।’

প্রধান দ্বারের বাইরে তখন এসে দাঁড়িয়েছে পুলিন্দ, ব্যাধ ও শবরের দল। পুরুষ ও মহিলা উভয়েই আছে এই দলে। পুরুষদের অনেকের হাতে লাউয়ের খোলা আর আধহাত লম্বা বাঁশের টুকরো আর শুকরের অন্ত্রের তার দিয়ে বানান বাদ্যযন্ত্র। দু-এক জনের ঠোঁটে বাঁশি। এক বৃষস্কন্ধ প্রৌঢ়ের হাতে একটি বহুব্যবহৃত বীণা। তারা একটি বুদ্ধনাটিকার আয়োজন করেছে। নাটকের মূল নায়ক এক সহজযানী সাধক। তাঁকে ঘিরে তাঁর সঙ্গিনী নাচতে নাচতে গাইছেন,

‘তেন ন চ্ছুপই হরিণা পিবই না পাণী।
হরিণা হরিণীর নিলয় না জাণী।।
হরিণী বোলও সুন হরিণা তো।
এ বন চ্ছাড়ী হোহু ভান্তো।।’

প্রণয়ী সাধক উত্তর দিচ্ছেন,

‘কইসনি হালো ডোম্বী তোহেরি ভাভরী আলী।
অন্তে কুলিণজন মাঝে কাবালী।
কেহো কেহো তোহেরে বিরুআ বোলই।
বিদুজন লোঅ তোরেঁ কণ্ঠ না মেলই।।
কাহ্নে গায় তু কামচণ্ডালী
ডোম্বীত আগলি নাহি চ্ছিনালী।।’

.

অভিনেতা এবং অভিনেত্রী দুজনেই সাবলীল। তাদের লীলা, লাস্য, গান, অভিনয় সবই অতি অপূর্ব। তার সঙ্গে বাকি বাদ্যকর এবং সহশিল্পীরাও যথাযথ সঙ্গত করছেন। বাকি অভিনেতারাও যথেষ্ট সুঠাম দেহী৷

এরপর নাটক আরও বেশ সরস এবং আকর্ষণীয় হয়ে উঠল। নায়িকা চটুল চপল লাস্যের সঙ্গে নায়কের গলা জড়িয়ে বলছেন,

‘যোইণি তঁই বিণু খনহিঁ ন জীবমি।
তো মুহ চুম্বী কমলরস পীবমি।’

নায়ক তার উত্তরে সোল্লাসে গেয়ে উঠলেন,

‘ভব নির্ব্বাণে পড়হমাদলা।
মনপবণ বেণি করণ্ড কসালা।
জঅ জঅ দুংদুহি সাদ উছলিআঁ।
কাহ্ন ডোম্বি বিবাহে চলিআ।’

এই রসসিক্ত আলাপে উপস্থিত জনগণের অনেকে উল্লসিত হয়ে বাহবা দিলেন, অনেকে আদিরসাত্মক টিপ্পনি কাটলেন। যুবতীরা সামান্য লজ্জা পেলেন, যুবকেরা আমোদ। হো হো হাসির শব্দে সমগ্র স্থানটি পরিপূর্ণ হল।

ততক্ষণে পূজাস্থল সাধারণ পুণ্যার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। বজ্রযানী সন্ন্যাসীরা পূজাপাঠ সমাপান্তে নিজ নিজ শিবিরে প্রত্যাগমন করেছেন। সাধারণ পুণ্যার্থীরা মন্দিরে পূজা দিয়ে ফের প্রধান দ্বারের কাছে ফিরে আসছেন। এখনও নাটক শেষ হয়নি। তাছাড়া পূজার যে মূল আকর্ষণ, রাজ্ঞী ও প্রকাশচন্দ্রের পূজার্পণ এবং একশো আটখানি মহিষ বলি, সেটি তখনও অনুষ্ঠিত হওয়া বাকি।

নাটক প্রায় তুঙ্গমুহূর্তে, এমন সময় দূর হতে বজ্রনির্ঘোষ শোনা গেল। বঙ্গভূমির রানি এবং মহারাজসচিব প্রকাশচন্দ্র আসছেন।

চারিদিকে সাজো সাজো রব পড়ে গেল। মন্দিরচত্বর শূন্য করে দেওয়া হল দ্রুত। নাট্যদল তাঁদের রঙ্গ বন্ধ করে মিশে গেল প্রধানদ্বারের দুইপাশে জনতার মধ্যে। কেবলমাত্র শ্রমণেরা এবং বুদ্ধগুপ্ত ছোটাছুটি করছেন। যদিও বুদ্ধগুপ্তর বিশেষ ভূমিকা নেই। প্রকাশচন্দ্র এবং রানির সঙ্গে আচার্য বিশুদ্ধকীর্তিও আসছেন। বিশিষ্ট অতিথিদের পূজা এবং যজনের ভার তাঁরই ওপরে।

একজন শ্রমণ মন্দিরের প্রধান দ্বারের সামনে রাখা যূপকাষ্ঠটি মেঘান্দের জলে ধুইয়ে দিয়ে গেলেন। আরেকজন অতি দ্রুত সিন্দূর, রক্তচন্দন, দূর্বাঘাস এবং ফুলদল দিয়ে যূপকাষ্ঠ সজ্জিত করে দিলেন। বলশালী শৌনিকদল এক এক করে মহিষগুলিকে সামনে এনে রাখতে শুরু করল।

কাড়া, নাকাড়া এবং মৃদঙ্গের অতি উচ্চ নিনাদের সঙ্গে ধীরে ধীরে অত্যুজ্জ্বল সুসজ্জিত রথশ্রেণী এগিয়ে আসতে থাকে। সামনে বাদ্যকরের দল। তার পিছনে প্রথম রথ। তাতে অধিষ্ঠিত আছেন রাজগুরু বিশুদ্ধকীর্তি এবং প্রধানমন্ত্রী অমিতাভভট্ট স্বয়ং। দুজনেই যথেষ্ট সম্মানীয় মানুষ। উপস্থিত জনতা তাঁদের সশ্রদ্ধ প্রণতি জানাল।

 দ্বিতীয় রথে রয়েছেন মহাদণ্ডনায়ক জিতসেন এবং রাজসেবক বাহিনীপ্রধান গিরিকিশোর। জিতসেন বঙ্গজনের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। রুক্ষ, দৃঢ় এবং কঠোর শাসনদণ্ডে বিশ্বাস রাখেন। কিন্তু গিরিকিশোর চিরলম্পট৷ তিনি নারীদের দিকে অসভ্য ইঙ্গিত করতে লাগলেন।

তৃতীয় রথে রয়েছেন মহাসান্ধিবিগ্রহিক অগ্নিমিত্র এবং মহাপ্রতীহার শান্তঘোষ। তাঁদের আপাত-উদাস মুখভার দেখে তাঁদের মনের মধ্যে কী চলছে বলা দুষ্কর। কিন্তু দুজনেই অতি উচ্চপদস্থ রাজন্য, জনতা সম্ভ্রমের সঙ্গে মাথা নত করে অভিবাদন জানাচ্ছিল।

চতুর্থ এবং সর্বশেষ রথটিই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। অন্যান্য রথগুলি অশ্ববাহিত, এই রথের বাহন চারটি অতি ভীষণদর্শন বৃষ। রথখানিও অতীব সুসজ্জিত। স্বর্ণনির্মিত ছত্রের রক্তবর্ণ ধ্বজে একটি অর্ধচন্দ্র, এবং একটি তরবারি অঙ্কিত। এই লাঞ্ছন চন্দ্রবংশের বহু প্রাচীন ধ্বজচিহ্ন।

রথ ঘিরে ভীষণদর্শন খড়্গ এবং সুতীক্ষ্ণ ভল্ল হাতে কৃষ্ণবস্ত্রে সজ্জিত ষোলোজন যোদ্ধৃপুরুষ। সবাই জানে তারা কারা।

রথের ওপর রয়েছেন প্রকাশচন্দ্র এবং রানি। রানি প্রকাশচন্দ্রের বামদিকে অবস্থান করছেন, সদা সর্বদা তাই থাকেন। প্রকাশচন্দ্রের ঊর্ধ্বাঙ্গে একটি দশাযুক্ত ক্ষৌমবস্ত্র। অধোবাসে ত্রিকচ্ছ কৌষেয় পট্ট। কাঁধ অবধি নেমে আসা কেশরাশি একখানি সরু বস্ত্রখণ্ড দিয়ে মাথার পেছনদিকে বাঁধা। বাহুদুটি আজানুলম্বিত, বৃষস্কন্ধ সবল এবং কটিদেশে সিংহসদৃশ। ললাট সুপ্রশস্ত, হনুদেশ কঠিন এবং চোখদুটি অন্ধকার৷

রানির পরনে একটি অতিসূক্ষ্ম নীলাম্বরী চীনাংশুক। তসরের পট্টবস্ত্রে বক্ষ আবৃত। ভুজবন্ধে সুবর্ণনির্মিত অঙ্গদ। দেবদুর্লভ কুঞ্চিত কেশরাশি কবরীবন্ধনে মাথার উপর শিখণ্ডের মতো করে বাঁধা৷ তাতে মল্লিকাফুলের মালা জড়ানো। দুই কর্ণে বজ্রহীরকের কর্ণাভরণ। অনাবৃত বাহুদুটিতে চন্দনপঙ্ক এবং মৃগনাভির প্রলেপ, তার স্নিগ্ধ অথচ তীব্র সুগন্ধে চারিদিক আমোদিত। পদ্মপত্রতুল্য চক্ষু কাজলে সজ্জিত, সস্মিত ওষ্ঠে অলক্তরাগ, কণ্ঠে একটি বহুমূল্য স্বর্ণহার। তাঁকে দেখে উপস্থিত পুণ্যার্থীদের মধ্যে প্রণামের হুড়োহুড়ি পড়ে গেল।

চারটি রথ ধীরে ধীরে মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়াল। প্রধান দরজার সামনে প্রকাশচন্দ্র এবং রানির রথ। বাকি তিনটি রথ কিছু দূরে। প্রকাশচন্দ্র রথ থেকে নামলেন। তাঁর হাত ধরে সম্রাজ্ঞীও। বাকি তিনটি রথ থেকে অন্যান্য রাজপদাধিকারীরা নেমে এলেন। আচার্য বিশুদ্ধকীর্তি রানিকে অভিবাদন করে বললেন, ‘হে বঙ্গমাতৃকা, প্রতি বৎসরের মতো এই বৎসরেও দেবী বজ্রযোগিনীর মহাপূজার জন্য আমি, ভন্তে বিশুদ্ধকীর্তি, আপনাকে সশ্রদ্ধ আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। বঙ্গদেশের কল্যাণ হোক, শান্তি ও কল্যাণ বারিধারার মতো ঝরে পড়ুক এই দেশের সর্বত্র। পরমেশ্বর প্রকাশচন্দ্র এবং আপনার স্নেহশাসনে এই দেশের জনসাধারণ ঘৃতমিশ্রিত অন্ন, মৎস্য এবং মাংসে পরমসুখে প্রতিপালিত হতে থাকুক। আসুন দেবী, পরমমাতৃকা ব্রজযোগিনীর কাছে আমরা সমবেতভাবে সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধি প্রার্থনা করি। যেন আমাদের এই পরমপূজ্য মাতৃকাভূমির অক্ষয় সৌভাগ্যচিহ্ন…’

‘ঘৃতে, অন্নে, মৎস্যে, মাংসে তো দেহখানি দিব্যি বানিয়েছেন মশাই। দশটা বাঘে খেয়েও শেষ করতে পারবে না। সাধারণ মানুষ কী খেয়ে বেঁচে আছে জানেন?’

উপস্থিত জনতার মধ্যে কে যেন উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠল কথা ক’টি। সঙ্গে সঙ্গে হাসির রোল উঠে থেমে গেল৷

রাজগুরু থমকে গেলেন। বাকি ছয় জন স্তম্ভিত। রানি এবং প্রকাশচন্দ্র স্থির।

এবার অন্যদিক থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘রাজগুরু, আপনি না ধর্মপুরুষ? এই কুলটা, বহুভোগ্যা নারীর পাদবন্দনা করতে আপনার লজ্জা হচ্ছে না?’

উপস্থিত জনতা নিঃশব্দ। ক্রুদ্ধা মহাসর্পিণীর মতো ঘুরে দাঁড়ালেন রানি। তাঁর কবরী খুলে গিয়ে কেশরাশি নেমে এল কটিদেশ অবধি। চক্ষু জ্বলছে৷

বাকি ছয় জন এগিয়ে এসে রানির রথের সামনে দাঁড়ালেন। গিরিকিশোর কর্কশকণ্ঠে চিৎকার করে বললেন, ‘কার এতদূর স্পর্ধা আমাদের সম্রাজ্ঞীর চরিত্র নিয়ে কুকথা উচ্চারণ করে? সাহস থাকলে সামনে আয়। তোর জিহ্বা ছিঁড়ে কুকুরকে খাওয়াব।’

এবার উত্তর এল সম্পূর্ণ অন্য দিক থেকে, ‘ওরে লম্পট, তোর না হয় লঘুগুরু জ্ঞান নেই। রাজপদ লেহন করে তোর আর তোর উপগৃহিণীদের সংসারযাত্রা নির্বাহ হয়। কিন্তু আমাদের মতো বঙ্গবাসী এই স্বৈরিণী নারী আর প্রকাশচন্দ্র নামের ওই কূট কাপালিকের শাসনে কীভাবে জীবনধারণ করছে—তার কোনও সংবাদ রাখিস?’

রাজন্যবর্গ বিভ্রান্ত। কারা উচ্চারণ করছে এই কুবাক্য? এই সাহস, এই স্পর্ধা সাধারণ জনতার হল কীভাবে?

তবে দ্রুত তাঁরা সুস্থিত হলেন। জিতসেন দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘রাজসেবকদল, তোমাদের আদেশ দিচ্ছি, এই দণ্ডেই এই দুর্মুখ প্রজাদের আমাদের কাছে উপস্থিত করো।’

রাজসেবকসৈন্য প্রশ্ন করে না। শুধু আদেশ পালন করে। তারা রথশ্রেণীর সামনে এসে দাঁড়াল। তাদের একহাতে খড়্গ, অন্যহাতে ভল্ল। তাদের যদি বলা হয়, সমবেত জনতার প্রত্যেককে হত্যা করতে হবে, তারা তাই করবে। আদেশ পালন অথবা মৃত্যু, এই হচ্ছে তাদের ধর্ম।

কিন্তু তারা আগুয়ান হওয়ার আগেই আদেশ ভেসে এল, ‘আপনার আদেশ প্রত্যাহার করুন মহাদণ্ডনায়ক। পূজাপ্রাঙ্গণে রক্তপাত শ্রেয় নয়।’

প্রকাশচন্দ্রের কণ্ঠ শুনে থেমে গেল সৈন্যদল। শান্তঘোষ প্রকাশচন্দ্রের কাছে এসে বললেন, ‘আপনার আশঙ্কাই তাহলে সত্য হল প্রভু। বিদ্রোহ তাহলে কর্মান্তবাসকের রাজদ্বারে পৌঁছে গেল!’

প্রকাশচন্দ্র শান্তস্বরে বললেন, ‘তাই তো মনে হচ্ছে আর্য শান্তঘোষ।’

অপমানে রাজ্ঞীর হাত দুটি কাঁপছিল। চাপা ক্রুদ্ধস্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘এরা কারা, নাথ? এদের এত স্পর্ধা হয় কী করে যে, সর্বসমক্ষে আমার নামে এই দুর্বাক্য উচ্চারণ করে?’

প্রকাশচন্দ্র নির্বিকার মুখে বললেন, ‘এরা তাঁরাই, যাঁদের কথা বলেছি রানি।’

‘কিন্তু এই জনারণ্যে এমন অসভ্যতা?’ প্রশ্ন করলেন বিস্মিত অমিতাভভট্ট।

‘জনসমাগমই অপরাধীর জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ যবনিকা, প্রধানমন্ত্রী মহোদয়। জনতার মুখ নেই, অবয়ব নেই, চরিত্র নেই। তার নিশ্চল অন্তরালে থেকে মহত্তম অপরাধ সংঘটিত করা সম্ভব।’

‘অর্থাৎ?’

‘অর্থাৎ আমাদের প্রতিস্পর্ধীরা আমাদের থেকে কম চতুর নয় মন্ত্রীমশাই!’

প্রকাশচন্দ্র বলতে বলতেই জনতার মধ্যে থেকে কারা যেন সমস্বরে বলে উঠল, ‘এই উন্মাদ রানির শাসনের অবসান চাই। চৈনিক ঘটদাস প্রকাশচন্দ্রের হাত থেকে মুক্তি চাই।’

রাজপদাধিকারীরা, বুদ্ধগুপ্ত এবং উপস্থিত শ্রমণেরা হতভম্ব। কর্মান্তবাসকের মাটিতে যে কোনওদিন এই ধ্বনি উঠতে পারে—এ তাঁদের স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। কিন্তু তাঁদের বিস্ময় বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়ে এবার আরও অধিক মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হল, ‘চন্দ্রবংশ ধ্বংস হোক। সপ্তরাজন্যর কুশাসন উৎসন্ন হোক। জয় গৌড়, জয় বঙ্গ, জয় শশাঙ্ক।’

বিস্মিত হলেন অগ্নিমিত্র, ‘এত কণ্ঠ? এত মানুষ আমাদের বিরুদ্ধে?’

প্রকাশচন্দ্র বললেন, ‘অনেক নয় অগ্নিমিত্র, মাত্র কয়েকজনের কণ্ঠস্বর।’

রানি বললেন, ‘কিন্তু অনেকের স্বর শোনা যাচ্ছে যে নাথ।’

‘অনেকের স্বর শোনা যাচ্ছে, কারণ অনেকের স্বর শোনানো হচ্ছে।’

‘কিন্তু…কিন্তু এ কী করে সম্ভব মাননীয়?’ আচার্য বিশুদ্ধকীর্তি বিস্মিতস্বরে প্রশ্ন করলেন।

‘খুবই সম্ভব মাননীয় রাজগুরু। এ অতি বিচিত্র বিদ্যা, এর নাম অভিস্বরক্ষেপণ। এর দ্বারা আপনি ওষ্ঠ বিন্দুমাত্র কম্পিত না করে স্বরপ্রয়োগ করতে পারেন। স্বরকে উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দূরাগত ধ্বনিতে পরিবর্তন করতে পারবেন। একই কণ্ঠ থেকে বহুজনের স্বর উৎপন্ন করতে পারবেন।’

‘এ কেমন বিদ্যা প্রভু?’

‘আশ্চর্য বিদ্যা, আচার্য। এর উদ্ভব অতিদূর পাশ্চাত্য দেশে। মহান সম্রাট গাওজং-এর রাজসভায় এই বিদ্যায় পারদর্শী এক পাশ্চাত্যদেশী যুবক এসেছিল। তার কাছেই আমি গোপনে এই আশ্চর্য শব্দবিদ্যা শিখেছি। আমাদের শত্রুরা এখন সেই বিদ্যারই প্রয়োগ করছে।’

বিশুদ্ধকীর্তি বিহ্বলভাবে বললেন, ‘কিন্তু সেই বিদ্যা এদের কাছে পৌঁছল কী করে মহোদয়?’

‘প্রশ্ন সেটি নয় রাজগুরু’, সামান্য অধৈর্য হলেন প্রকাশচন্দ্র, ‘প্রশ্ন হচ্ছে এই মুহূর্তে ওদের ঠিক কতজন উপস্থিত আছে এখানে।’

ছ’জন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী, রানি, প্রকাশচন্দ্র এবং ভন্তে বুদ্ধগুপ্ত তাকালেন উপস্থিত জনতার দিকে। এই প্রথম তাঁরা অনুভব করলেন যে তাঁরা কতটা একা। এবং কতটা অসহায়।

প্রকাশচন্দ্র নিম্নস্বরে বললেন, ‘রাজগুরু, দ্রুত পূজা সম্পন্ন করুন।’

বিশুদ্ধকীর্তি দ্রুতপদে মন্দিরের ভিতরে অন্তর্হিত হলেন। প্রতিবার রানি ও প্রকাশচন্দ্র মন্দিরে আগত অন্যান্য মূর্তিগুলিকে প্রথমে অর্চনা করেন, তারপর বজ্রযোগিনীর আরাধনা সম্পন্ন করেন। কিন্তু আজ কেউ সেসবের মধ্যে গেলেন না। সরাসরি গর্ভগৃহের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। বুদ্ধগুপ্তর সঙ্গে বাকি শ্রমণেরা উচ্চৈঃস্বরে সমবেতভাবে যোগিনীমন্ত্র পাঠ করতে লাগলেন। একজন সেবক সজোরে ঘণ্টা বাজাতে লাগল।

তখন মন্দিরের ঠিক বাইরে বলিপ্রদত্ত মহিষগুলিকে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করানো হয়েছে। শৌনিকদল তাদের বৃহৎ খড়্গগুলির ধার পরীক্ষা করে নিচ্ছে শেষবারের মতো। প্রথম বলি প্রকাশচন্দ্র নিজের হাতে দেবেন। একটি অতি উৎকৃষ্ট কৃষ্ণবর্ণ মহিষ তার জন্য প্রস্তুত৷

কিছু পরেই প্রকাশচন্দ্র ও বাকিরা বেরিয়ে এলেন। প্রকাশচন্দ্রের প্রশস্ত ললাট জুড়ে আশীর্বাদী সিন্দুর। উন্মুক্ত সুঠাম নির্লোম বক্ষে অজস্র মুক্তার মতো স্বেদবিন্দু। প্রকাশচন্দ্রের ডানহাতে তাঁর অজেয় খড়্গ। উচ্চতায় সেটি তাঁর কোমর অবধি।

এই তরবারি সম্রাট গাওজং-এর ব্যক্তিগত তরবারিসহায়ক, শাও ফেং-এর নিজের হাতে প্রস্তুত। দীক্ষাদাত্রী য়ু জেতিয়ান এই ‘তাংদাও’-টি স্বয়ং শোধন করে প্রকাশচন্দ্রের হস্তে অর্পণ করেন। যতদিন এই তরবারি প্রকাশচন্দ্রের অধিগত থাকবে, ততদিন নাকি কোনও যুদ্ধে তাঁর পরাজয় হবে না।

প্রধান শৌনিক কৃষ্ণবর্ণ মহিষটিকে যূপকাষ্ঠে বদ্ধ করলেন। প্রকাশচন্দ্র তাঁর অজেয় তাংদাও নিয়ে মহিষটির দক্ষিণদিকে এসে দাঁড়ালেন। ‘জয় দেবী বজ্রযোগিনীর জয়’ ধ্বনিতে চারিদিক কম্পিত হল। সেই বিপুল কোলাহলে মহিষদল চঞ্চল হতে অপরাপর শৌনিকেরা তাদের গলার রশিগুলি শক্ত করে ধরল।

বিশুদ্ধকীর্তি দুই হাত তুলে অধীর জনতাকে শান্ত হতে বললেন। চারিদিকে উৎসুক নৈঃশব্দ্য নেমে এল। সবাই অপেক্ষা করে আছে প্রথম বলির জন্য। একটু আগেকার সাময়িক কটুবাক্যর কথা যেন কারও মনেই নেই।

প্রকাশচন্দ্র তাঁর তরবারি মাথার ওপর তুললেন।

চারিদিকে সগর্ভ নৈঃশব্দ্য। নিশ্চুপ উল্লাস।

বিশুদ্ধকীর্তি মুখ খুললেন বধমন্ত্র উচ্চারণ করার জন্য।

কিন্তু তাঁর মুখ হতে প্রথম শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার আগেই মাথার ওপর একটি তীব্র সাঁই সাঁই শব্দ শোনা গেল। উপস্থিতজন মাথা তুলে দেখলেন একটি তীরবিদ্ধ গোলাকার কৃষ্ণবর্ণ বস্তু উড়ে আসছে মন্দিরের প্রধান দ্বারের দিকে। তীরবিদ্ধ বস্তুটি যূপকাষ্ঠের ঠিক সামনে এসে পড়ল। অতি সাধারণ দর্শন একটি গোলাকার কন্দুক, তার মুখে একটি জ্বলন্ত পলিতা।

অন্যান্য রাজপুরুষরা হেসে উঠলেন। জিতসেন বললেন, ‘বিদ্রোহীরা কি তাহলে আমাদের কন্দুকক্রীড়ায় আহ্বান করছে প্রভু প্রকাশচন্দ্র?’

প্রকাশচন্দ্র কিন্তু হাসছিলেন না। তিনি বিস্ফারিত চোখে মুহূর্তকাল চেয়ে রইলেন জ্বলন্ত কন্দুকটির দিকে, তারপর চিৎকার করে উঠলেন, ‘সাবধান, সাবধান রাজন্যবর্গ! এই মুহূর্তেই ভূমিশয্যা নিন।’

এই বলে একহাতে রানিকে ধারণ করে ভূতলে শায়িত হলেন।

পরক্ষণেই অত্যুজ্জ্বল আগুনের সঙ্গে কর্ণবিদারী শব্দ। মনে হল যেন শতসহস্র বজ্রপ্রভা বিস্ফোরিত হল। প্রথমেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন হল যূপকাষ্ঠটি। যূপকাষ্ঠবদ্ধ মহিষটির ছিন্নমুণ্ড তীব্রবেগে আকাশে উত্থিত হয়ে গর্ভগৃহের সামনে গিয়ে পড়ল।

কয়েক ক্ষণের বিমূঢ় স্তব্ধতা। তারপরেই সহস্রককণ্ঠের অসহায় আর্তচিৎকার, আর আতঙ্কিত কলরোলে মুখরিত হয়ে উঠল মন্দিরপ্রাঙ্গণ। ভীত জনতার আর্তনাদ, শিশু ও নারীদের ক্রন্দন, আর উপায়হীন মানুষের অসহায় হাহাকার।

রাজন্যরা প্রকাশচন্দ্রের আদেশমাত্র ভূমিশয্যা নিয়েছিলেন, রাজসেবকদের প্রতিটি সেনাও তাই। একটু পর তাঁরা উঠে দাঁড়ালেন। পরক্ষণে তাঁদের চোখের সামনে সমগ্র দৃশ্যটির স্বপ্নাতীত পরাবাস্তবতা প্রকট হল।

এই বিস্ফোরণ এবং উপস্থিত জনতার আর্তনাদ বিচলিত করে তুলেছে মহিষদলকে। সবলে মুক্ত হয়ে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য ভাবে ছুটে আসছে মন্দিরের প্রধানদ্বারের দিকে। ফলে এই অশান্ত মহিষদল এবং আতঙ্কতাড়িত জনরাশি, এখন এরা তাঁদের দিকেই সর্বগ্রাসী মৃত্যুর মতো ধাবমান!

আর সেই উন্মত্ত মহিষদলের মধ্যমণি যে পর্বতপ্রমাণ মহিষটি, তার পিঠের ওপর শৃঙ্গদুখানি ধারণ করে আছে কে? ও কার অবয়ব?

রাজসেবকসেনা ততক্ষণে তাদের অভ্যস্ত দায়িত্ববোধে ফিরে এসেছে। তারা তৎক্ষণাৎ রাজ্ঞী, প্রকাশন্দ্র এবং অন্যান্য রাজন্য, বুদ্ধগুপ্ত এবং শ্রমণদের ঘিরে দাঁড়াল।

তারপরেই যেন পাতালের গহীন অন্ধকার থেকে পূর্বসমুদ্রের ভয়াবহতম ঝঞ্ঝা ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁদের ওপর।

কেউ জানে না কত দণ্ড পর, এই ঝঞ্ঝাবিক্ষোভ থামল। সবাই উঠে দাঁড়ালেন৷ মন্দিরপ্রাঙ্গণ শূন্য, কেবল ইতিউতি কয়েকটি আহত দেহ পড়ে আছে। আর পড়ে আছে ধ্বংসলীলার হৃদয়বিদারক চিহ্ন। সৌভাগ্যক্রমে মন্দিরের মধ্যে কেউ প্রবেশ করেনি। কিন্তু তাতেও ক্ষতি যা হয়েছে তাও কম নয়। আচার্য বিশুদ্ধকীর্তি ভূমিশয্যা থেকে ওঠার চেষ্টা করে ফের শুয়ে পড়েছেন। ভন্তে বুদ্ধগুপ্ত এবং বাকি শ্রমণেরা নিজেরাও অল্পবিস্তর আহত। তবুও তাঁরা চেষ্টা করছেন আচার্য বিশুদ্ধকীর্তিকে তুলে ধরার। জিতসেন এবং শান্তঘোষ শক্তধাতের মানুষ, তাঁদের সৈন্যাভ্যাস আছে। তাঁরাও যথেষ্ট আহত, তবুও এইসব আঘাত সামলে নিয়ে তাঁরা উঠে দাঁড়িয়েছেন। মহাসান্ধিবিগ্রহিক অগ্নিমিত্র তাঁর বিধ্বস্ত রথের চক্রটি অবলম্বন করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। তিনি দৃশ্যতই বিস্রস্ত, বিচলিত এবং বিধ্বস্ত। প্রধানমন্ত্রী অমিতাভভট্ট নরম মনের এবং নরম শরীরের মানুষ। কিন্তু তাঁর মানসিক বল অসাধারণ। সর্বাঙ্গ রক্তাক্ত, তবুও ইতিমধ্যেই তিনি উঠে বসেছেন। চক্ষু দু’খানি মুদিত করে কী যেন বিড়বিড় করছেন।

শুধুমাত্র প্রকাশচন্দ্র অবিচলিত!

তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে যেন যুদ্ধক্ষেত্রে উঠে দাঁড়িয়েছেন আহত এবং ক্রুদ্ধ পশুরাজ। তাঁর দুই বাহুর পেশিগুলি ফুলে উঠেছে বিস্ফোরণোন্মুখ আগ্নেয়গিরির মতো। প্রশস্ত বক্ষ থেকে চুঁইয়ে পড়ছে রক্তবর্ণ মুক্তাবিন্দু। চোখে ঝলসে উঠছে প্রতিশোধের অগ্নি। তাঁর পায়ের কাছে অবশ লতার মতো লুটিয়ে আছেন বঙ্গদেশের অবিসংবাদী কর্ত্রী, বঙ্গসম্রাজ্ঞী। তাঁর দেহে প্রাণ আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। প্রকাশচন্দ্র ক্ষণিকের জন্য নীচু হয়ে রানির নাকের কাছে নিজের করতল প্রসারিত করলেন। তারপর চিৎকার করে উঠলেন, ‘ওরে কে কোথায় আছিস? রানিকে প্রাসাদে নিয়ে চল, রাজবৈদ্যকে সংবাদ দে।’

বলেই তিনি চকিতে চারিদিকে ক্ষিপ্ত শার্দূলের মতো তাকালেন৷ কই, তাঁর মহাখড়্গ কই? যা দিয়ে তিনি এতদিন শাসন করে এসেছেন এই অভিশপ্ত ভূমি, য়ু জেতিয়ান-এর আশীর্বাদধন্য সেই অজেয় তাংদাও কোথায়?

ক্রোধবহ্নি কিঞ্চিৎ প্রশমিত হলে কঠোর সত্যটি হৃদয়ঙ্গম করলেন প্রকাশচন্দ্র। আরও অনেককিছুর মতো এই বিপর্যয় নিয়ে গেছে তাঁর অবলম্বনটিকেও।

তাঁর অজেয় খড়্গ উধাও!

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন