পটমঞ্জরী – ১৬

অভীক সরকার

উদভ্রান্তের মতো সামনের দিকে হাঁটছিল সর্বাঙ্গধূলিধূসরিত চণ্ডকীর্তি৷ কেশরাশি অবিন্যস্ত। দেহের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত। চর্মপাদুকাটি ছিন্নপ্রায়।

চণ্ডকীর্তির পাশে হাঁটছিল আরেকজন। দর্শনমাত্রে বোঝা যায় সে একজন অন্ত্যজ বনচর। কটিদেশে একটি ক্ষুদ্র ছাগচর্ম ব্যতীত দেহটি প্রায় উলঙ্গ। কুঞ্চিত কেশদামের শুভ্রতা দেখে বোঝা যায় যে মানুষটি মধ্যবয়সি। যদিও তার বলিষ্ঠ শরীর যে-কোনও যুবককে লজ্জা দেবে।

 আর এই দুজনের পিছনে যারা হাঁটছিল তাদের দিকে চাইতে ভয় করছিল চণ্ডকীর্তির। ভয় করছিল এই দ্বিপ্রহরেও। ভীষণ ভয়। জীবনে এত ভয় কখনও পায়নি সে।

বনচর মানুষটি প্রশ্ন করল, ‘কী রে, আর কতদূর?’

চণ্ডকীর্তি ভীতস্বরে বলল, ‘আর দুইদিনের পথ।’

‘বেশ বেশ।’ প্রসন্ন দেখায় মানুষটিকে, ‘দ্রুত চল। আর পথ ভুল হলে বা প্রভু প্রকাশচন্দ্রের কাছে পৌঁছতে দেরি হলে কী হবে জানিস তো?’

সে আর জানে না চণ্ডকীর্তি? খুব জানে। শুধু এইটি বোধগম্য হচ্ছিল না তার, এই কুৎসিত এবং ভয়ঙ্কর ডাকিনী বাহিনীর প্রয়োজন পড়ল কেন মহারাজসচিবের। বিদ্রোহীরা কী এতই শক্তিশালী?

আজ থেকে ঠিক তিনদিন পূর্বে এই প্রশ্নই মাথায় এসেছিল তার।

শান্তঘোষ যখন তাকে এই কাজের জন্য মনোনীত করেন, তখনই তাকে গুপ্তচরবৃত্তির প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। সতর্কতা ও মন্ত্রগুপ্তি তার প্রধান। তার প্রশিক্ষণ, তার শিক্ষা, তার ষষ্ঠেন্দ্রিয় তাকে বলছিল তার চারিপাশের জাল ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। কাদের যেন সর্বক্ষণের অদৃশ্য প্রহরা চলে তাকে ঘিরে। যে কোনওদিন, যে কোনওদিন অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে সে। দেহ হয় তো খুঁজে পাওয়া যাবে কোন বারাঙ্গণার দ্বারে..

সেই রাতে শয্যাগ্রহণের আগে আবার সেই করাঘাত। গুনে গুনে ঠিক তিনটি। নির্দিষ্ট ব্যবধানে।

তবুও দরজা খোলেনি সে। দরজার এপার থেকেই প্রশ্ন করেছিল, ‘কে?’

ওপাশ থেকে পরিচিত স্বরে প্রশ্ন এসেছিল, ‘দ্বিতীয় পাণ্ডব।’

দরজা খুলে দিতেই ঢুকে পড়েছিল ভীম। আর যা সংবাদ দিয়েছিল, তাতে হাত পা অবশ হয়ে এসেছিল চণ্ডকীর্তির।

‘রাজগুরু দর্ভপাণি বন্দি হয়েছেন,’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলছিল ভীম, ‘তিনি প্রকাশ করে ফেলেছেন আপনার কথা।’

‘সে কী? কী করে?’

‘সেঁউতি ওদের পক্ষে যোগ দিয়েছে। কাল সারারাত্রি সে সেবা করেছে রাজগুরুর। রাজগুরুও মাধ্বীর আবেশে সব কথা বলে ফেলেছেন৷ আজ ভোররাত্রে সে বেরিয়ে গিয়ে প্রতিহারকে সব কিছু জানিয়ে দেয়। সেই থেকে রাজগুরু বন্দি। শুনেছি বন্দিশালায় নাকি অকথ্য অত্যাচার চলেছে তাঁর ওপর। চারজন প্রহরী দুই প্রহর ধরে কণ্টকাকীর্ণ কশা দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করেছে তাঁর সর্বাঙ্গে, তারপর সেই ক্ষতে লবনের পট্টি লেপন করে রাখা হয়েছে। এখন নাকি লৌহদণ্ড উত্তপ্ত করা হচ্ছে…’

শুনে দৃশ্যতই শিহরিত হয়েছিল চণ্ডকীর্তি।

‘সেই অত্যাচারের যন্ত্রণায় স্থির থাকতে পারেননি রাজগুরু। আপনার নাম প্রকাশ করে দিয়েছেন তিনি। আপনি পালান চণ্ডকীর্তি! পালান!’

‘কী করে পালাব? কোথায় পালাব?’

‘আমি ঠিক ব্রাহ্মমুহূর্তে ফিরে আসছি। সেঁউতিকে ছেড়ে তো কোথাও যেতে পারব না, ওকে নিয়েই আসছি। একটি গোপন পথ আছে, আমার চেনা। আমরা তিনজনে সেই পথে পালিয়ে যাব পুণ্ড্রের দিকে। কেউ আমাদের ধরতে পারবে না।’

সেই রাতেই পালিয়েছিল চণ্ডকীর্তি। না, ব্রাহ্মমুহূর্তর জন্য অপেক্ষা করেনি সে। পালিয়েছিল তার অনেক আগেই, মধ্যরাত্রেই।

কারণ ধর্মসেনের অনুগত ভৈরবদল ভীমকে স্ববশে আনলে কী হবে, সব কিছু ঠিক করে শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠাতে পারেনি। দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তাদের কাছে ছিল না।

এক, রাজগুরু দর্ভপাণি জানতেনই না যে চণ্ডকীর্তি কর্মান্তবাসকের একজন গুপ্তচর। সে সংবাদ তাঁর কাছে গোপন রাখা হয়েছিল শান্তঘোষের নির্দেশে।

দুই, সেঁউতি গত তিন রাত্রি ধরে তাঁর গৃহে গোপনে আশ্রয় নিয়েছে। এই রাষ্ট্রবিপ্লবের আবহাওয়ায় নিজেকে সুরক্ষিত মনে করেনি সে। তাই তার প্রিয়তম এবং সবচাইতে নির্ভরযোগ্য দয়িতের কাছে ছুটে এসেছে। তার পক্ষে পূর্বরাত্রে রাজগুরুর সেবা করা অসম্ভব, কারণ সেই সময় সে চণ্ডকীর্তির শয্যায় শায়িতা।

সেইদিনই পালাতে পালাতে ভেবেছিল চণ্ডকীর্তি, বিদ্রোহীরা এতই শক্তিশালী?

তার ভাবনাসূত্র ছিন্ন হল পাশের বনচর মানুষটির কণ্ঠস্বরে, ‘দুদিন বাদে পূর্ণিমা, না?’

‘হ্যাঁ, অগ্রহায়ণ পূর্ণিমা।’ সংক্ষেপে উত্তর দিল চণ্ডকীর্তি। এই অসভ্য, উগ্র এবং ভয়ঙ্কর বন্যবাহিনীর সঙ্গে বেশি বার্তালাপ করতে চায় না সে।

‘বাহ বাহ,’ অমার্জিত দাঁতগুলো বার করে হাসল বন্য মানুষ, ‘পূর্ণিমার আলোয় শ্মশানে বসে চিতার আগুনে নরমাংস ভোজ বেশ ভালোই হবে, কী বলিস ভাই?’

.

নিজের কক্ষে বসে দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রার আয়োজন করছিলেন আচার্য বিশুদ্ধকীর্তি। কয়েকদিনের পরিশ্রমে বড়ই শ্রান্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। গত দুদিন বুদ্ধগুপ্ত’র দেখা নেই। সে থাকলে পরিশ্রমের ভার কিছুটা কমে। আজ বিশুদ্ধকীর্তির বিশ্রামের প্রয়োজন। আজ রাত্রে প্রকাশচন্দ্র বিশেষ পূজার আয়োজন করেছেন। আজ কার্তিকী চতুর্দশী, তন্ত্রমতে কায়াপূজার প্রকৃষ্ট দিন। প্রকাশচন্দ্র বলেছেন, আজকের পূজা তিনিই করবেন।

বড় কৌতূহলে আছেন বিশুদ্ধকীর্তি। প্রকাশচন্দ্রের বহু বিচিত্র কৃৎকৌশলের সাক্ষী তিনি, অনেক অলৌকিক কর্মও অনায়াসে সম্পাদন করতে দেখেছেন। কিন্তু কখনও কোনও পূজাপাঠ সম্পাদন করতে দেখেননি। তবে বিশুদ্ধকীর্তি মনে মনে জানেন এবং স্বীকার করেন যে, আধিদৈবিক এবং আধিভৌতিক, দু’প্রকার সিদ্ধিতেই প্রকাশচন্দ্র অতি উচ্চমার্গের সাধক। বজ্রযানতন্ত্রে বিশুদ্ধকীর্তিরও কিছু কিছু সিদ্ধি আছে বটে, তবে প্রকাশচন্দ্রের কাছে নিতান্ত তুচ্ছ।

একটু আগেই মালিনী তাঁর দ্বিপ্রাহরিক সেবা করে গেছে। প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হয়েও যথেষ্ট পরিমাণে সেবা নিতে পারেন বিশুদ্ধকীর্তি। মালিনীও সেবাকলায় যথেষ্ট পটিয়সী। তাঁদের মধ্যে সেবার নামে যেটা হয় তাকে খণ্ডযুদ্ধই বলা চলে।

সদ্যলব্ধ সেবার মৌতাতে নিদ্রাটি বেশ গভীর হয়ে এসেছিল বিশুদ্ধকীর্তির। আবেশ ভাঙল মালিনীর চাপা কণ্ঠস্বরে, ‘প্রভু, জেগে আছেন?’

‘আবার কী হল মালিনী?’ মৃদু হাসলেন বিশুদ্ধকীর্তি, ‘জানো তো, এখন আর আমার দুবার সেবা নেওয়ার ক্ষমতা নেই। বরং বেশি রাত্রের দিকে একবার…’

কথা শেষ করতে দেয় না মালিনী, ‘প্রভু, মহাসান্ধিবিগ্রহিক অগ্নিমিত্র এসেছেন।’

বিস্মিত হলেন বিশুদ্ধকীর্তি, ‘সে কী! অগ্নিমিত্র এখন? এই অসময়ে?’

মালিনী বলে, ‘দেখা করবেন কি?’

আশ্চর্য হন বিশুদ্ধকীর্তি, ‘সে কী? রাজ্যের মহাসান্ধিবিগ্রহিক আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, দেখা করব না মানে? নিশ্চয়ই গুরুতর কিছু ঘটেছে।’

মালিনী কিছু বলে না, চুপ করে থাকে। সন্দিগ্ধ হলেন আচার্য, প্রশ্ন করলেন, ‘কী ব্যাপার, কিছু বলবে মনে হচ্ছে।’

মালিনী একটু ইতস্তত করে বলে, ‘না, মানে আজ ওঁকে কেমন যেন মনে হল।’

‘বটে? কীরকম?’

‘অতিথিকক্ষে বসে অপেক্ষা করতে বললাম, বসলেন না। বললেন এখনই দেখা করতে হবে, এখানেই, আপনার শয়নকক্ষেই। তাঁর আচরণে কেমন যেন একটা উন্মত্ত অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছিল। তার ওপর…’

‘তার ওপর কী?’

‘আমার দিকে কেমন বুভুক্ষু চোখে তাকাচ্ছিলেন।’

উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলেন বিশুদ্ধকীর্তি। মালিনীর প্রতি অনেকেই যে আকৃষ্ট, তা তিনি বেশ বোঝেন এবং উপভোগ করেন। মালিনী তাঁর অহঙ্কার।

তিনি সহাস্যে বললেন, ‘যাও, ওঁকে নিয়ে এসো। নিশ্চয়ই কোনও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে।’

অগ্নিমিত্র কক্ষে প্রবেশ করে আচার্যর সামনের আসনে উপবিষ্ট হলেন। সেই মুহূর্তেই আচার্য বিশুদ্ধকীর্তি অনুভব করলেন যে কোথাও একটি গুরুতর গণ্ডগোল আছে। মহাসান্ধিবিগ্রহিক অগ্নিমিত্র তাঁর শিষ্যস্থানীয়, দেখা হলেই প্রণত অভিবাদন করেন। এখন সেসব কিছুই করলেন না তিনি। সরাসরি আসনে উপবেশন করলেন, আচার্যর অনুমতির অপেক্ষা করলেন না। শুধু তাই নয়, আচার্য বুঝলেন যে, অগ্নিমিত্র আকণ্ঠ মদিরাপান করে এসেছেন, তার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আচার্য বিশুদ্ধকীর্তির সামনে সে মদ্যপ অবস্থায় এসেছে, এও এক অবিশ্বাস্য ঘটনা।

আশ্চর্য হলেন আচার্য বিশুদ্ধকীর্তি। প্রগলভস্বরে অগ্নিমিত্র বললেন, ‘অসময়ে এসে আপনার দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটালাম নাকি আচার্য?’

এবার সতর্ক হলেন আচার্য বিশুদ্ধকীর্তি, ‘না না অগ্নিমিত্র, আমি কিছুমাত্র বিব্রত হইনি। এই অসময়ে আপনি নিশ্চয়ই কোনও প্রয়োজনীয় সংবাদ নিয়ে এসেছেন। রাষ্ট্রের প্রয়োজন আমার দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রামের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

‘রাষ্ট্রের প্রয়োজন? বেশ বেশ!’ হাসলেন অগ্নিমিত্র, ‘বঙ্গদেশের রাজগুরু তথা রাজপুরোহিত রাষ্ট্রের কল্যাণের কথা ভাববেন না তো কে ভাববে।’

‘সে তো বটেই। তাছাড়া আমি একা কেন, আপনি আছেন, জিতসেন আছেন, প্রধানমন্ত্রী অমিতাভভট্ট আছেন, মহারাজসচিব প্রকাশচন্দ্র আছেন, সর্বোপরি বঙ্গেশ্বরী স্বয়ং আমাদের মাথার ওপর আছেন, রাষ্ট্রের কল্যাণের কথা ভাবার মানুষ কি কম?’

‘তা তো বটেই, তা তো বটেই।’ মাথা নাড়লেন অগ্নিমিত্র, ‘তবে কিনা রাষ্ট্রকল্যাণের ক্ষেত্রে আমরা হলাম গিয়ে গুল্মলতা, মহীরুহ বলতে তো আপনি ছাড়া আর কাউকে দেখি না।’

বিশুদ্ধকীর্তি শান্তস্বরে বললেন, ‘অগ্নিমিত্র!’ দয়া করে বলবেন, ঠিক কী উদ্দেশে এই বৃদ্ধের কাছে এসেছেন আপনি?’

‘বৃদ্ধ?’ কপট বিস্ময়ে বললেন অগ্নিমিত্র, ‘প্রৌঢ় বলুন। অবশ্য মালিনীর শয্যায় আপনাকে যুবকের থেকে কিছুমাত্র কম মনে হয় না বলেই শালিবন বিহারের গোপন সংবাদ।’

‘বাচালতা বন্ধ করুন অগ্নিমিত্র!’ শীলিতস্বরে বললেন আচার্য বিশুদ্ধকীর্তি, ‘কী প্রয়োজনের এসেছেন, বলুন। এই অর্থহীন বন্ধ্যালাপে আপনার আমার, কারোরই কোনও লাভ হবে না।’ বলতে বলতেই বিশুদ্ধকীর্তি লক্ষ করলেন যে দ্বারপ্রান্তে যবনিকার অন্তরালে দুখানি পায়ের পাতা দৃশ্যমান। মালিনী সব শুনছে।

মুহূর্তের মধ্যে অন্তর্হিত হল সম্মানের আবরণ। স্থির নেত্রে অগ্নিমিত্র বিশুদ্ধকীর্তির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কোন বার্তালাপ বন্ধ্যা, আর কোন বার্তালাপ শ্রেয় সে বিষয়ে তো আপনি ভালোই জানেন আচার্য। মাসাধিককাল পূর্বে জাহোরের এক পরিত্যক্ত প্রাসাদে মৎস্যেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে বপ্যট, গৌড়েশ্বর জয়ন্ত, ধর্মসেনসহ অন্যান্য সামন্তদের এক আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আশা করি সেখানকার আলোচনা যথেষ্ট অর্থবহ এবং ফলপ্রদই ছিল।’

ঘরের মধ্যে বজ্রপাত হল! সেই সভার সংবাদ এঁর কাছে পৌঁছল কী করে?

বিশুদ্ধকীর্তি অনুভব করলেন তাঁর মেরুদণ্ড দিয়ে হিমেল স্রোত যাচ্ছে। অকম্পিত স্বরে বললেন, ‘আপনি কোন সভার কথা বলছেন অগ্নিমিত্র? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলেন অগ্নিমিত্র। বললেন, ‘সে কী? কিছুই মনে পড়ছে না আচার্যদেব? মনে করাবার অনেক উপায় অবশ্য আমাদের রাজসেবকদের জানা আছে। তবে কি না আপনি বুদ্ধিমান মানুষ, বিষয়টি অতদূর যেতে দেবেন বলে মনে হয় না।’

বিশুদ্ধকীর্তি গর্জে উঠলেন, ‘আপনার এই বাতুল প্রলাপ শোনার সময় আমার নেই অগ্নিমিত্র। এই অবান্তর প্রলাপ বন্ধ হলে আপনি যেতে পারেন।’

‘অনেক সময় আছে আচার্য।’ অগ্নিমিত্রর মুখে ক্রূর হাসি ফুটে উঠল, ‘এত তাড়া কীসের? আপনাদের এতদিনের পরিকল্পনা এত সহজে কয়েক দণ্ডের মধ্যে জেনে যাব—সে কি সম্ভব? তারপর বলুন, কবে থেকে চলছে আপনাদের এই রাষ্ট্রবিদ্রোহের পরিকল্পনা? আর আপনিই বা এর মধ্যে ঢুকলেন কীসের লোভে?’

বিশুদ্ধকীর্তি কণ্ঠস্বরে ক্রুদ্ধভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলেন, ‘এখনও বলছি, সতর্ক হোন! আর একটিও বাতুল প্রলাপ যদি উচ্চারণ করেন…’

‘তাহলে কী করবেন? আমার নামে প্রকাশচন্দ্রের কাছে অভিযোগ করবেন? সে অবশ্য করতে পারেন। রাজগুরুর কথা প্রকাশচন্দ্র মন দিয়ে শুনবেন বলেই বিশ্বাস। তবে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পর তিনি কী পদক্ষেপ নেবেন সে কথা মহামান্য রাজগুরু ভেবে রেখেছেন তো?’

বিশুদ্ধকীর্তি কিছু বললেন না। স্থিরচোখে চেয়ে রইলেন অগ্নিমিত্রর দিকে।

অগ্নিমিত্র তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন, ‘আমি যে মিথ্যা অভিযোগ করছি না সে আপনি ভালো করেই জানেন আচার্য বিশুদ্ধকীর্তি। প্রমাণ চাই? এই দেখুন।’

এই বলে অগ্নিমিত্র কটিদেশের বস্ত্রপাক থেকে একটি অঙ্গুলিপরিমাণ বস্তু বার করে বিশুদ্ধকীর্তির সামনে মেলে ধরলেন।

বিশুদ্ধকীর্তির কিছু সময় লাগল বস্তুটি কী সেটি অনুধাবন করতে। তারপরে শিউরে উঠলেন।

বস্তুটি শুধু অঙ্গুলিপরিমাণ নয়, একটি আঙুল। একটি কাটা মধ্যমা। ওই মৃত, শুষ্ক অঙ্গুলি একজনেরই।

‘কী হয়েছে বুদ্ধগুপ্তর?’ প্রশ্ন করলেন বিশুদ্ধকীর্তি। আতঙ্কে থরথর কাঁপছিলেন।

‘আহা, কী আর হবে। আপাতত জীবিত আছেন বলেই সংবাদ পেয়েছি৷ তবে কতদিন জীবিত থাকবেন বলতে পারছি না। তার কারণ আপাতত ডানহাতের আঙ্গুলগুলোই দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এর পর বামহাত আছে। পায়ের আঙুল আছে৷ আমার তো ইচ্ছে কাটা আঙুল দিয়ে একটি মালা প্রস্তুত করে মহামান্য বুদ্ধগুপ্তের গলায় পরিয়ে বজ্রযোগিনীর মন্দিরের সামনে একটি বুদ্ধনাটিকার আয়োজন করাব। নাম দেব ‘এ যুগের অঙ্গুলিমাল।’

বিশুদ্ধকীর্তির চপেটাঘাত অগ্নিমিত্রর গণ্ডে আছড়ে পড়ার আগেই হাত ধরে ফেললেন অগ্নিমিত্র। হিসহিস স্বরে বললেন, ‘এই স্পর্ধা করবেন না আচার্য। এখনও যে আপনাকে আর আপনার সাধের মালিনীকে উলঙ্গ করে, বেত্রাঘাত করতে করতে প্রকাশ্য রাজপথ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছি না, সে আপনার পূর্বপুরুষদের কষ্টার্জিত সুকৃতির ফল। জেনে রাখুন—আপনি যে এখনও জীবিত আছেন, আপনার নশ্বর দেহটি যে মহামান্য রাজসচিবের পোষা কুমীরদের খাদ্য হয়নি, সে কেবলমাত্র আমার দয়ায়। অতএব শান্ত হয়ে বসুন। আমার সঙ্গে সহযোগিতা করুন, তাতে শেষাবধি আপনার কল্যাণ হবে। অন্যথায় আপনার আর আপনার বেশ্যার নিরাপত্তার দায় আমি নেব না।’

উঠে দাঁড়ালেন অগ্নিমিত্র। কক্ষটির এদিক থেকে ওদিক হাঁটা শুরু করলেন। তার সঙ্গে বলতে লাগলেন, ‘বেশ কয়েকদিন পূর্বে একটি ঘটনা ঘটে। অনেক রাত্রি পর্যন্ত সমস্ত ঘটনাবলী নিজের মনশ্চক্ষে পর্যবেক্ষণ করছিলাম, বুঝলেন৷ তখনই বিশেষ পরিস্থিতিতে আপনার উচ্চারিত একটি বাক্য আমার মনে কিছু প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল।

‘বেশ কয়েকদিন পূর্বে কমলাঙ্ক গ্রামের অরণ্যে জনৈক গোপালদেব রাজসেবকদের একটি ক্ষুদ্র বাহিনীকে একাই নিশ্চিহ্ন করেন, আশা করি তার কথা মনে আছে আপনার। তার পরদিন সেই সেবকবাহিনীর প্রধান তথা গ্রামরক্ষকটিকে রাজসভায় ডাকা হয়। উদ্দেশ্য ছিল ঘটনাটির ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে অবগত হওয়া। সেই সভায় স্বয়ং মহারানি আর আমাদের সাতজনের বিশিষ্ট গোষ্ঠী ছাড়া আর কেউ উপস্থিত ছিল না। তার আগে সেই দুর্ঘটনার সংবাদ জানতেন একমাত্র শান্তঘোষ আর জানতাম আমি। আর কেউ জানত না।

আপনি সভায় এসেই একটি উক্তি করেছিলেন মহামান্য আচার্যদেব। মনে আছে?’

জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে রইলেন বিশুদ্ধকীর্তি।

‘আপনি অসতর্কভাবে বলে ফেলেছিলেন, ‘‘এই কাপুরুষ গ্রামরক্ষকটিকে এখানে আনা হয়েছে কী করতে?’’ তাই তো?

‘এবার বলুন তো, আপনি কী করে জানলেন যে ওই গ্রামরক্ষক একজন কাপুরুষ? যদি না যেই ঘটনাটির সংবাদ আপনার কাছে আগে থেকেই অবগত থাকে?

‘সেই প্রথম আমার মনে সন্দেহের বীজ উপ্ত হয়।

‘আমরা অবগত ছিলাম, শালিবন বিহারের উপাধিবারিক বুদ্ধগুপ্ত আপনার বিশেষ ঘনিষ্ঠ। আপনার অনুপস্থিতিতে তিনিই শালিবন বিহারের যাবতীয় দায়িত্ব নির্বাহ করেন।

‘তারপর আমি বিশেষভাবে বুদ্ধগুপ্তর জন্য একজন অভিজ্ঞ গুপ্তচরকে নিয়োগ করি।

আমাদের সেই গুপ্তচর জানায় যে, ইনি যে শুধু আপনার ঘনিষ্ঠতম সহচর তাই নয়, আপনার দক্ষিণহস্ত, এমনকী আপনার ওই মালিনী সময়ে অসময়ে বুদ্ধগুপ্তকেও সন্তুষ্ট করে থাকেন।

‘অতএব মহামান্য বুদ্ধগুপ্তর জন্য আমরা গুপ্তজাল বিছিয়েছিলাম। অর্থ, ভয়, আদর্শ, আর আকাঙ্ক্ষা, এই চারটি হচ্ছে প্রধান কারণ—যার জন্য মানুষ পক্ষ পরিবর্তন করে। আমরা জানতে চেয়েছিলাম, বুদ্ধগুপ্তকে কী দিয়ে ক্রয় করা সম্ভব।

অবশেষে বুঝতে পারলাম যে বুদ্ধগুপ্ত অর্থের কাঙাল। তিনি অল্পবয়সে ভিক্ষু হয়েছেন। তাঁর মাতা এবং পিতা, দুজনেই ছিলেন শালিবন বিহারের বৌদ্ধসন্ন্যাসী। তাঁরা পড়ার সময়ে পরস্পরের অত্যন্ত কাছাকাছি আসেন এবং প্রণয়াসক্ত হয়ে পড়েন। বুদ্ধগুপ্ত সেই অবৈধ আসঙ্গলিপ্সার ফসল। তাঁর মাতা এবং পিতা দুজনেই শালিবন বিহার থেকে বিতাড়িত হন। তারপর থেকে কষ্টে, কায়ক্লেশে দিন কেটেছে তাঁদের।

বুদ্ধগুপ্ত তাঁর অসামান্য মেধার অধিকারে শালিবন বিহারে প্রবেশাধিকার পেলে কী হবে, দারিদ্র্যেহর কারণে শৈশব বা যৌবনের রূপরসগন্ধ কিছুই আস্বাদন করতে পারেননি। চিরকাল অর্থাভাবে বিব্রত হয়েছেন।

তাই যখন আমার প্রেরিত গুপ্তপুরুষ তাঁকে এক কলসপূর্ণ রৌপ্যদ্রহ্মের লোভ দেখায়, তিনি আর স্থির থাকতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত গতকাল রাত্রে আমাদের পক্ষে যোগ দিয়েছেন।’

এই বলে বিশুদ্ধকীর্তির ওপর ঝুঁকে এলেন অগ্নিমিত্র, ‘এই মুহূর্তে আমি সব জানি আচার্যদেব। আমি জানি কারা কারা আপনাদের সঙ্গে আছেন। তাঁরা কোথায় লুকিয়ে আছেন। কী আপনাদের পরিকল্পনা। আপনাদের এতদিনের সযত্নলালিত সাধের অভ্যুত্থান পরিকল্পনার প্রতিটি অংশ এখন আমার সামনে উন্মুক্ত। বলুন আচার্য, আমার কী করা উচিত।’

‘কী চান অগ্নিমিত্র?’ শুষ্কস্বরে প্রশ্ন করলেন বিশুদ্ধকীর্তি।

আরও ঝুঁকে এলেন অগ্নিমিত্র। কদর্য মদ্যপ গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল বিশুদ্ধকীর্তির নাসারন্ধ্রে।

‘আমার অর্থ চাই আচার্য। অপরিমিত অর্থ। আজ অবধি বঙ্গদেশের শাসকবর্গ, শ্রেষ্ঠী এবং বণিকশ্রেণী অপরিমিত অর্থ দান করে গেছেন ওই বজ্রযোগিনীর মন্দিরে আর শালিবন বিহারে৷ সেই অপরিসীম সম্পদের কুঞ্জি গচ্ছিত আছে কেবল আপনার কাছে।

জেনে রাখুন আচার্য, এতক্ষণ যা বললাম সেই তথ্য শুধুমাত্র আমার কাছে, কেবলমাত্র আমার কাছেই অধিগত। প্রকাশচন্দ্র বা রাজ্ঞী এই ব্যাপারে কিছুই জানেন না। এই মুহূর্তে আপনাকে, আপনার এই সাধের শালিবন বিহার এবং আপনার মিত্রবর্গকে রক্ষা করতে পারি আমি। একমাত্র আমি।’

এতক্ষণে কথা ফুটল বিশুদ্ধকীর্তির মুখে, ‘সে সম্পদে একমাত্র সদ্ধর্মের অধিকার, অগ্নিমিত্র!’

‘বটে! জেনে রাখুন, নিজের প্রাণ বাঁচানোর থেকে বড় ধর্ম আর নেই। এই মুহূর্তে যাবতীয় স্বর্ণ এখানে একত্রিত করতে আদেশ দিন আচার্য।’

‘কিন্তু তার জন্য সময় চাই অগ্নিমিত্র,’ বোঝানোর চেষ্টা করেন বিশুদ্ধকীর্তি, ‘এত দ্রুত অত বৃহৎ সম্ভার একত্র করব কী করে?’

‘সে আপনার সমস্যা বিশুদ্ধকীর্তি।’ উচ্চস্বরে বলে ওঠেন অগ্নিমিত্র, ‘আমার কাছে সময় নেই। আমি আজ রাত্রের মধ্যেই এই সম্পদ চাই। তারপর আমি আর এখানে নেই। আমি জানি এই দেশ নষ্টদের অধিকারে যাবে, তার আগেই আমি পালাতে চাই৷’

বিশুদ্ধকীর্তি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘আপনি এখানেই অপেক্ষা করুন। আমি দেখছি।’

অগ্নিমিত্র সহাস্যে বললেন, ‘বেশ, বেশ। তবে একলা অপেক্ষা করার অভ্যাস আমার নেই। মালিনীকে বলুন কিছু উত্তম সুরা সহ আমাকে সঙ্গ দিতে।’

.

অমিতাভভট্ট যখন হরিকেলে পৌঁছলেন তখন সন্ধ্যা নামছে। কর্মান্তবাসক থেকে হরিকেল কম দূর নয়। একটি অশ্ববাহী রথে দুদিনে এই পথ অতিক্রম করেছেন অমিতাভভট্ট। তিনি, তাঁর সারথি এবং অশ্বদুটি অত্যন্ত শ্রান্ত। অথচ সময় নেই।

কুটিরের সামনে রথ থামতেই প্রায় লাফিয়ে নামলেন অমিতাভভট্ট। উপস্থিত প্রহরীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিশ্রাম করছিল। তারা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে দেখে স্তম্ভিত।

রক্ষীদের ওইভাবে বসে থাকতে দেখে বিরক্ত হলেন অমিতাভভট্ট। কঠিনস্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘বাহিনীর অধিনায়ক কে?’

প্রহরীরা সন্ত্রস্ত হয়ে সরে দাঁড়াল। প্রধান প্রহরী এগিয়ে এসে বিনীতস্বরে বলল, ‘আমি প্রভু। অধীনের নাম বিদ্যাধর। আশা করিনি যে আপনি এত দ্রুত এসে উপস্থিত হবেন।’

আশ্চর্য হলেন অমিতাভভট্ট। তাঁর এখানে আসার সংবাদ তো এদের জানার কথা নয়।

তাহলে? গম্ভীরস্বরে বললেন, ‘বিদ্যাধর, আর্য চারুদত্তকে আমি কর্মান্তবাসকে নিয়ে যাব। তাঁকে যাত্রার জন্য প্রস্তুত করে দাও।’

বিদ্যাধর অন্যদের সঙ্গে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। অমিতাভভট্ট বললেন, ‘কী হল, কথা কানে যাচ্ছে না?’

বিদ্যাধর বলল, ‘প্রভু, গতকাল রাত্রেই আর্য চারুদত্ত’র দেহাবসান হয়েছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে কর্মান্তবাসকের উদ্দেশে দূত প্রেরণ করেছি এই মৃতদেহের দাহসংস্কারের বিষয়ে জানার জন্য। ভাবলাম আপনি হয়তো কোনোভাবে সেই সংবাদ পেয়েই উপস্থিত হয়েছেন। যদিও…’

বিদ্যাধরের কোনও কথাই কর্ণগোচর হচ্ছিল না অমিতাভভট্ট’র। বজ্রাহতর মতো তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। একটিমাত্র কাজের ভারই তাঁর ওপর ন্যস্ত করেছিলেন প্রকাশচন্দ্র। তাতেও সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলেন তিনি! এখন কোন মুখে গিয়ে প্রকাশচন্দ্রের সামনে দাঁড়াবেন? কী ভাববেন বাকি সতীর্থরা?

কিছুক্ষণ পর বিদ্যাধর ইতস্তত করে ডাকল, ‘প্রভু…!’

শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন অমিতাভভট্ট৷

‘বলছিলাম যে আর্য চারুদত্ত’র সৎকার বিষয়ে মহামান্য রাজসচিব কি কোনও নির্দেশ দিয়েছেন?’

একটি চপেটাঘাত সশব্দে আছড়ে পড়ল বিদ্যাধরের গালে। চিৎকার করে উঠলেন অমিতাভভট্ট, ‘রাজসচিব, রাজসচিব আর রাজসচিব। কেন, সব কিছুতে রাজসচিবের নির্দেশ প্রয়োজন হবে কেন? তোরা জানিস না আমি এই দেশের প্রধানমন্ত্রী? আমি কি এতই অপদার্থ, যে একটা মৃতদেহের সৎকার বিষয়েও তোরা রাজসচিবের আদেশের অপেক্ষা করবি? কী ভেবেছিস, আমি রাজসচিবের বার্তাবহ দূত? কেন?’

প্রহরীরা হতভম্ব। অমিতাভভট্ট মৃদুভাষী এবং সজ্জন বলে পরিচিত। রূঢ়বাক্য প্রয়োগ করতে শোনেনি তারা। বিদ্যাধর বাম হাত গালে চেপে বসে পড়েছে।

রক্তচক্ষু অমিতাভভট্ট গর্জে উঠলেন, ‘হাঁ করে তাকিয়ে দেখছিস কী? আমাকে মৃতদেহের কাছে নিয়ে চল। আমি যা বলব, ঠিক সেরকম করবি, বুঝেছিস?’

এর থেকে অধিক যত্ন করে বিদ্যাধরকে আজ অবধি কেউই কিছু বোঝায়নি। সে ‘আসুন প্রভু, আসুন,’ বলতে বলতে দ্রুতপদে অন্তর্হিত হল কুটিরের অভ্যন্তরে।

ভিতরে ঢুকতেই উৎকট গন্ধ নাকে এল অমিতাভভট্টর। মৃতদেহে পচন শুরু হয়েছে।

উত্তরীয়ের প্রান্তটি নাকে চেপে একবার ঘরটি দেখে নিলেন অমিতাভভট্ট। অতি সাধারণ ঘর। যেটুকু না হলে জীবনধারণ অসম্ভব, কেবলমাত্র সেটুকুই আছে। শত্রুর শেষ রাখেন না প্রকাশচন্দ্র। তবে এঁর ক্ষেত্রে প্রাণদণ্ড না দিয়ে যা শাস্তিবিধান করেছিলেন সে প্রাণদণ্ডের থেকেও সাঙ্ঘাতিক!

ঘরের মধ্যে এক জায়গায় এসেই দৃষ্টি স্থির হল অমিতাভভট্ট’র। মৃতদেহের পাশে ওটা কী? ভূর্জপত্র নাকি?

প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি অনুসরণ করে বিদ্যাধর। তারপর সন্ত্রস্তস্বরে বলে, ‘আর্য চারুদত্ত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পর আমরা কক্ষ একবার পরীক্ষা করে দেখি। চারুদত্ত’র একটি প্রিয় উপাধান ছিল, সেটি কাউকে স্পর্শ করতে দিতেন না। সেই উপাধান থেকে এই ভূর্জপত্র উদ্ধার হয়েছে।’

চকিতে বিদ্যাধরের দিকে ফিরলেন অমিতাভভট্ট, ‘কী আছে ওতে?’

সেই দৃষ্টির সামনে যেন আরও সঙ্কুচিত হয়ে গেল বিদ্যাধর, ‘জানি না প্রভু। প্রথম দর্শনেই বুঝেছিলাম যে ওটি একটি দীর্ঘ পত্র। মহামান্য, মানে ইয়ে, প্রকাশচন্দ্রের উদ্দেশে লিখিত। পত্রটি বহুদিন পূর্বে লেখা।’

‘পড়েছিস?’

‘আজ্ঞে?’

‘পত্রটিতে কী লেখা আছে পড়েছিস?’

‘আজ্ঞে না মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।’ যেন শিউরে উঠল বিদ্যাধর, ‘আমি ভেবেছিলাম মহামান্য, মানে ইয়ে, রাজসচিবের উদ্দেশেই যখন পত্রটি লিখিত, সেটি খুলে দেখা ঠিক হবে না।’

স্থিরনেত্রে বিদ্যাধরের দিকে তাকিয়ে থাকেন অমিতাভভট্ট। কর্মান্তবাসক থেকে বহুদূরে প্রকাশচন্দ্রের একজন ঘোষিত শত্রুর মৃত্যু হয়েছে। তারপর তাঁর কাছ থেকে প্রকাশচন্দ্রের নামে লিখিত একটি দীর্ঘ পত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে যে কোনও ধুরন্ধর ব্যক্তি পত্রটি হস্তগত করত, পাঠ করত, এবং তার বিপুল কূটনৈতিক মূল্যের সদ্ব্যবহার করত!

‘নিয়ে আয়।’

বিদ্যাধর একবার পত্রটির দিকে, আরেকবার অমিতাভভট্টর দিকে করুণচোখে তাকাল৷

‘কী রে, কথা কানে যাচ্ছে না?’ ধমকে ওঠেন অমিতাভভট্ট। ওই পত্রটি তাঁর চাই। জীবনে অনেক তুচ্ছতাচ্ছিল্য সহ্য করেছেন তিনি। আর নয়। এইবার প্রকাশচন্দ্রকে তিনি দেখে নেবেন।

কিছু দোলাচলের পর বিদ্যাধর ভূর্জপত্রটি এনে অমিতাভভট্ট’র হাতে দেয়। অমিতাভভট্ট বহু যত্নে সেটি কুক্ষিগত করেন। তারপর বেরিয়ে আসেন পূতিগন্ধপূর্ণ কক্ষটি থেকে।

বিদ্যাধর পিছনে পিছনে বেরিয়ে আসে গড়ুরহস্ত হয়ে, ‘অধীনের প্রতি কী আদেশ প্রভু?’

রথে উঠে নির্বিকার চিত্তে আদেশ দেন অমিতাভভট্ট, ‘কুটিরটিতে অতি উত্তমরূপে অগ্নিসংযোগ কর। সব কিছু যেন ভস্মীভূত হয়ে যায়। আর হ্যাঁ, এই মুহূর্ত থেকে তোদের কর্ম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হল। তোরা নিজেদের গ্রামে ফিরে যা। গিয়ে বল যে বঙ্গদেশের সর্বনাশ হয়ে গেছে, আমাদের আর বাঁচবার আশা নেই।’

.

.

বিশুদ্ধকীর্তি যখন ফিরে এলেন তখন তাঁর সমস্ত শরীর স্বেদস্রাবে প্লাবিত। এ এক এমনই কাজ যে কাউকে সঙ্গে নেওয়ার উপায় নেই। বজ্রযোগিনী মন্দিরের সঙ্গে তুলনীয় না হলেও শালিবন বিহারে যে পরিমাণ স্বর্ণ গচ্ছিত আছে, তার পরিমাণ কম নয়। তার একটি বৃহৎ অংশ বয়ে এনেছেন তিনি।

বন্ধ দ্বারের সামনে এসে কিঞ্চিৎ ইতস্তত করতে লাগলেন। কী একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে না?

এদিক ওদিক ক্ষণেক দেখে নিলেন। তাঁর বাসস্থান বিহারের এক প্রান্তে। বিশেষ কারণ ছাড়া এদিকে কেউ আসে না।

দ্বারদেশে কান পাতলেন বিশুদ্ধকীর্তি। পরক্ষণে নির্ভুলভাবে চিনতে পারলেন ভেসে আসা শব্দকে। নারীর শীৎকারের শব্দ।

সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল বিশুদ্ধকীর্তির। থরথর করে হাত পা কাঁপতে লাগল তাঁর। মনে হল এক পদাঘাতে বন্ধ দ্বার খুলে অগ্নিমিত্র’র ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। তারপর যা হওয়ার তাই হবে।

অনেক কষ্টে উদগত ক্রোধ সংবরণ করলেন বিশুদ্ধকীর্তি। নিজেকে প্রবোধ দিলেন। হয়তো সম্মতি ছিল না মালিনীর। পাষণ্ডটা নিশ্চয়ই বলপ্রয়োগে তাকে বাধ্য করেছে।

ভাবতে ভাবতেই মালিনীর শীৎকারমিশ্রিত হাসির শব্দ ভেসে এল। সঙ্গে কিছু অর্ধসমাপ্ত বাক্য। বলছে এমন চরম সুখ বহুকাল পায়নি সে। অগ্নিমিত্র যে কাজকৌশলে বিশুদ্ধকীর্তির তুলনায় কত পটু তাঁর বিবরণ দিচ্ছে।

আর অনুরোধ করছে, অগ্নিমিত্র যেন তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যান!

বিশুদ্ধকীর্তি কাঠের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। যে নারীকে এত প্রেম উপহার দিয়েছেন তিনি, সযত্নে মাথার মণি করে রেখেছেন, এত দ্রুত আনুগত্য পরিবর্তন করে ফেলল? এত কুহকিনী, এত কুলটা, এত ছলনাময়ী হতে পারে নারী?’

একটু পর কঙ্কণের শব্দ ভেসে এল। পোশাক পরছে মালিনী। শোনা গেল অগ্নিমিত্রর কিছু তরল হাস্যপরিহাস।

মালিনীর অনুরোধও শুনতে পেলেন বিশুদ্ধকীর্তি। অতি উৎকৃষ্ট মৈরেয় এনেছিল সে। অগ্নিমিত্র তো সেসব মুখেই দিলেন না। মালিনীকে দেখেই বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অত যত্নে আনা পানীয় সেবন করবেন না অগ্নিমিত্র? মালিনীর সেবা কি বৃথা যাবে?

অগ্নিমিত্র’র উচ্চ হাসি ভেসে এল। তিনি বলেছেন, এমন সুন্দরীকে ভোগ করার জন্য এতই ব্যগ্র ছিলেন যে মদিরাপানের জন্য অপেক্ষা করতে পারেননি। তবে মালিনীর স্বহস্তে প্রস্তুত মদিরা তিনি সানন্দচিত্তে গ্রহণ করবেন বইকি!

তার সামান্য কিছু পরে পানীয়তে চুমুকের শব্দ। উচ্চস্বরে মালিনীকে সাধুবাদ দিচ্ছেন অগ্নিমিত্র। দাঁড়িয়ে আছেন বিশুদ্ধকীর্তি। প্রতিটি শব্দ, শূলের মতো বিদ্ধ হচ্ছে তাঁর কর্ণকুহরে।

একটু পর খক খক করে কেশে উঠলেন অগ্নিমিত্র। তারপর একটি ধাতব শব্দ। পানীয়ের পাত্র পড়ে গেল?

আর থাকতে পারলেন না বিশুদ্ধকীর্তি। এক ধাক্কায় দ্বার উন্মুক্ত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সামনের দৃশ্য তাঁর চোখে পড়ল। ঝাঁকুনি খেয়ে তিনি থেমে গেলেন।

শয্যার ওপর শুয়ে ছটফট করছেন অগ্নিমিত্র। চোখের মণি বেরিয়ে আসতে চাইছে। মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে শ্বেতস্রাব।

অবিশ্বাসী চোখে মালিনীর দিকে তাকালেন বিশুদ্ধকীর্তি। মালিনীর মুখ রক্তশূন্য। ফিসফিস করে বলল, ‘বিষ। ভিক্ষুণী মন্দর্ভা দিয়েছিলেন।’

মালিনীর সংজ্ঞাহীন দেহটি মাটিতে পড়েই যেত, যদি বিশুদ্ধকীর্তি ধরে না ফেলতেন।

অনুচ্চ পাথুরে টিলা দাঁড়িয়ে আছে সাগরের গা ঘেঁষে। তার পায়ের কাছে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের ঢেউ। টিলার চূড়ায় উঠলে অনেক দূরের দিগন্ত অবধি দৃষ্টিসীমা প্রসারিত হয়৷ এই সন্ধ্যাবেলায় জনহীন টিলার সারা দেহে সূর্যাস্তের আলো।

টিলার চূড়ার দিকে চেয়েছিল অমিতাভভট্টর সারথি সুদাস। একটু দূরে তার অশ্ববাহিত রথটি দাঁড়িয়ে। সুদাস দেখছিল একটি পরিচিত অবয়ব বসে আছে টিলার চূড়ায়। দেখে মনে হয় যেন প্রস্তরমূর্তি। একটু পর নড়ে উঠল সেই প্রস্তরমূর্তি। হাতে ধরা ভূর্জপত্র একটু একটু করে ছিঁড়ে উড়িয়ে দিতে লাগল বাতাসে।

.

প্রথম থেকেই লক্ষণ ভালো লাগছিল না সিংহোদরের। তাকে বারবার বলা হয়েছিল—যেন গুপ্তগৃহ থেকে এক পক্ষকাল না বেরোয় সে। স্বয়ং পদ্মসম্ভব তাঁকে বিশেষভাবে নিষেধ করেছিলেন। সিংহোদরের এখন মনে হচ্ছে, সেই নিষেধাজ্ঞা তার শোনা উচিত ছিল।

গুপ্তগৃহটি এক অন্ত্যজ কিরাতপল্লীতে। দিনরাত, সেখানে পশুহত্যা, মাংসবিক্রয় লেগেই আছে। সিংহোদর সদ্ধর্মপন্থী, নিরামিষভোজী। পশুহত্যার দৃশ্য, রক্ত, মাংস, এসব দর্শনে তার বমনোদ্রেক হয়। সে পদ্মসম্ভবকে বলেছিল, ‘প্রভু, দয়া করে এই নরকে আমাকে ফেলে যাবেন না।’

পদ্মসম্ভব সেই আর্তিতে কান দেননি। সুপক্ব অজমাংসের সঙ্গে কিরাতদের প্রিয় উগ্রগন্ধী ভাতপচা আরক পান করতে করতে বলেছিলেন, ‘এখানেই পক্ষকাল থাকো। অন্ততপক্ষে যতদিন না চূড়ান্ত লড়াইটা হয়ে যায়।’ সিংহোদর করুণস্বরে জানতে চেয়েছিল যে তার জন্য এই নরকটি পছন্দ করার কারণ কী। পদ্মসম্ভব জানিয়েছিলেন, তার দুইটি কারণ। প্রথমত, এই সংকীর্ণ এবং ঘনবদ্ধ কিরাতপল্লীতে প্রবেশের আগে চন্দ্রবংশের সৈন্যরা দুবার ভাববে। দ্বিতীয়ত, কেউ ভাবতেই পারবে না যে মল্ল সিংহোদরের মতো অহিংস সদ্ধর্মী এই মাংসবিক্রেতা কিরাতদের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে।

সেই থেকে রয়ে গেছিল সিংহোদর। অত্যন্ত মুখরা এক কিরাত রমণী তাকে দুবেলা ভাত এবং সিদ্ধ নিরামিষ ব্যঞ্জন পরিবেশন করে যায়। তার কটুবাক্যের ভয়ে সেসব নিঃসাড়ে গলাধঃকরণ করে সিংহোদর।

তবে শান্তিতে ছিল না সিংহোদর। সে জানত যে, চন্দ্রবংশের গুপ্তচর বা রাজসেবকরা তাকে খুঁজছে। তার মুখ নিশ্চয়ই মনে রেখেছে কারারক্ষীরা৷ অন্তত সেতুরক্ষী তো বটেই। তারা নিশ্চয়ই তন্নতন্ন করে খুঁজছে কর্মান্তবাসক। হয়তো বা তার বাইরেও। প্রত্যহ সে ভয়ে ভয়ে থাকত, এই বুঝি তার কুটিরের দ্বার এক আঘাতে ভেঙে ফেলল কেউ। এই বুঝি তার হাত পা বেঁধে পশুর মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছে কেউ। এই বুঝি তার দেহে ভারী পাথর বেঁধে তাকে ছুড়ে দেওয়া হল এক মস্ত জলাশয়ে। ছটফট করছে সে, তার দিকে বিকট হাঁ করে এগিয়ে আসছে কুমির…

কতবার যে ঘুম ভেঙে ঘর্মাক্ত কলেবরে উঠে বসেছে সিংহোদর, নিজেও জানে না।

মাঝেমধ্যে পদ্মসম্ভব এসে দেখা করে যান। বিচিত্র সব ছদ্মবেশে আসেন তিনি। আর প্রতিবারই সেই নিখুঁত ছদ্মবেশ আর অসামান্য অভিনয় ক্ষমতা দেখে বিস্মিত হয়েছে সিংহোদর।

কয়েকদিন ধরেই বড় বিষণ্ণ হয়েছিল সে৷ এক নিঃসঙ্গতা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল এই নির্বাসনে। শেষে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়েছিল সে।

কিরাতপল্লীর সংকীর্ণ এবং জটিল সরু পথ মুখস্থ হয়ে গেছিল সিংহোদরের। অসুবিধা হল পল্লী থেকে নির্গমনের পথটি খুঁজে পেতে। অবশেষে সেই পথ খুঁজে পল্লীর বাইরে বেরোতেই মন প্রসন্ন হয়ে গেল তার।

হেমন্ত শেষ হওয়ার মুখে। পথের পাশে ফুটে আছে বিচিত্র বর্ণের সব বনজ ফুল। একটু দূরে একটি অনুচ্চ টিলা। তার পাশে মেঘান্দ’র একটি ক্ষুদ্র শাখানদী। জনবহুল পথ। হেঁটে যাচ্ছে কৃষক, গৃহবধূ, জালিক, বৃদ্ধ সন্ন্যাসী এবং পণ্যবাহী শ্রমিকদের দল। দুদণ্ড দাঁড়িয়ে বুক ভ’রে নিঃশ্বাস নিল সিংহোদর। তারপর একটু এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করল। আস্তে আস্তে এতদিনের জড়তা কেটে যাচ্ছিল তার।

 সিংহোদর দেখল, পল্লীপথের ঠিক সামনেই একটি অশ্বত্থবৃক্ষের নীচে জড়ো হয়েছে কয়েকজন। মিষ্ট অথচ তীব্র মদিরাগন্ধে চারিদিক ভরপুর। উঁকি দিয়ে দেখল, একটি খর্বকায় মানুষ হাঁড়িতে করে কোনও পুষ্পজাত মদিরা বিক্রয় করছে। তারই গন্ধে ম’ ম’ করছে চারিদিক। একটু পরেই সে বুঝতে পারল, এখানে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটছে। আজ অবধি সে কোনও মূক এবং বধির মদিরাবিক্রেতা দেখেনি। অথচ এখানে এই খর্বকায় মূক ও বধির মানুষটি সাবলীল ও সহজভাবে তার ক্রেতাদের সন্তুষ্ট করে চলেছে। সমস্ত ক্রয়বিক্রয় হচ্ছে অঙ্গুলি সঙ্কেতে, ওষ্ঠ সঞ্চালনে। আরও একটি আশ্চর্য জিনিস আবিষ্কার করল সিংহোদর। মূক এবং বধির মানুষটি অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী। সে ক্রেতার ওষ্ঠ সঞ্চালন দেখেই তার উচ্চারিত বাক্যটি বুঝতে পারে।

বেশ কিছুক্ষণ ধরে এই নিরুচ্চার ক্রয়বিক্রয় দেখল সিংহোদর৷ ততক্ষণে মত্ত ক্রেতাদের অনেকেই বিহ্বল। সেই অবসরে সিংহোদর গিয়ে ইশারায় এক পাত্র মদিরা দিতে বলল তাকে।

মূক ও বধির বিক্রেতা তার দিকে কয়েকমুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর নিষ্পাপ এবং অনাবিল হাসিতে ভরে উঠল তার মুখ।

টিলার ওপর বহুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন অমিতাভভট্ট। সূর্য নেমে এসেছে দিগন্তের অনেক কাছাকাছি। সমুদ্রের বুক জুড়ে রক্তিম সন্ধ্যা ছেয়ে আসছে। প্রবল বাতাসে উড়ে যাচ্ছে অমিতাভভট্ট’র পোশাক। তাঁর কেশরাশি অবিন্যস্ত। মুখখানি গম্ভীর এবং থমথমে।

চারুদত্ত’র মৃতদেহের পাশ থেকে উদ্ধার করা পত্রটির ছিন্ন অংশগুলি অনেক আগেই মিলিয়ে গেছে বাতাসে। কিন্তু তার অভিঘাত যেন এখনও ক্রুদ্ধ, অসহায় সর্পিণীর মতো পাক খাচ্ছিল তাঁর স্মৃতির মধ্যে।

সেই পত্রের প্রতিটি ছত্রে চারুদত্ত লিখে গেছেন প্রকাশচন্দ্র আর তাং সাম্রাজ্ঞী য়ু জেতিয়ানের যৌথ ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। লিখে গেছেন প্রকাশচন্দ্র আর এই নাগিনীর বঙ্গদেশ অধিকারের শিহরন জাগানো কাহিনি। চারুদত্ত স্বীকার করেছেন কীভাবে কোন প্রলোভনে তিনি সহায়তা করেছিলেন এই পাপ কর্মে। হত্যা করেছিলেন তাঁর সম্রাট রাজভটকে। মাদকদ্রব্য ব্যবহারে বশীভূত করেছিলেন ভাগিনেয়কে। তারপর প্রকাশচন্দ্রের হাতে তুলে দিয়েছেন এই দেশ শাসন করার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা।

পত্রের শেষের দিকে ঝরে পড়েছে তীব্র আক্ষেপ। অনুশোচনার গ্লানিতে দীর্ণ চারুদত্ত লিখেছেন, ‘সম্ভব হলে আমি সারমেয়’র মতো বঙ্গদেশের প্রতিটি গৃহদ্বারে গিয়ে চিৎকার করে বলতাম, এই পাপবুদ্ধিদের উৎখাত করুন। এদের ধ্বংস করুন। সবংশে নির্মূল করুন। কিন্তু হায়, আমি আজ অসহায়, নির্জীব। ঈশ্বর নিজহস্তে আমাকে পাপের শাস্তি দিয়েছেন। তবে আপনি পার পাবেন না প্রকাশচন্দ্র, আপনার জীবদ্দশাতেই, সজ্ঞানে, সুস্থ অবস্থায় আপনাকে আপনার পারিষদসহ অনন্ত নরকে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। এই অভিশাপ দিয়ে গেলাম।’

আকাশের অসীম শূন্যতার দিকে তাকিয়েছিলেন অমিতাভভট্ট। সেই শূন্যতা গ্রাস করেছিল তাঁর মস্তিষ্ক, স্নায়ু, চৈতন্য, সব কিছু।

এদের জন্যই সমস্ত জীবন ব্যয় করেছেন তিনি? নিজের মন, বুদ্ধি, আত্মা, চেতনা—সব কিছু সমর্পণ করেছেন এদের কাছে? নিজের জীবন, যৌবন, আদর্শ, চরিত্র সব বিসর্জন দিয়েছেন এই কুৎসিতবাদের যূপকাষ্ঠে? সর্বনাশের পথে টেনে নিয়ে গেছেন নিজের জন্মভূমিকে?

অসহ্য গ্লানি আর অপরাধবোধের আগুনে অন্তরাত্মা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল অমিতাভভট্টর। এই ঘৃণ্য পাপাত্মাদের জন্যই বিরুদ্ধমতের প্রত্যেককে সবংশে নিশ্চিহ্ন করেছেন তিনি, তাঁরা যতই শুভ চিন্তার, উন্নত চরিত্রের মানুষ হন না কেন। এই পাপ কর্মের জন্যই স্বমতাবলম্বীদের সমস্ত পাপ কাজ নির্বিকার চিত্তে সমর্থন করেছেন, তারা যতই নিকৃষ্ট চরিত্রের প্রাণী হোক না কেন। শিক্ষক থেকে ছাত্র, শ্রমিক থেকে কৃষক, বণিক থেকে ক্রেতা, রাজন্য থেকে অন্ত্যজ, সমাজের প্রতিটি স্তরে নিজেদের একচ্ছত্র অধিকার বিস্তার করেছেন তিনি। উগ্র আকাঙ্ক্ষায় নষ্ট করেছেন সহনশীল সমাজস্থিতি। এক অসহিষ্ণু, ধর্ষকামী অন্ধকারের রাজত্ব বিস্তার করেছেন নিজের জন্মভূমির ওপর।

কেন? কীসের জন্য? কোন স্বার্থে?

তাঁকে এবং তাঁদের বোঝানো হয়েছিল, প্রকাশচন্দ্রের প্রতি অন্ধ আনুগত্যই বঙ্গজাতির মুক্তির একমাত্র দিশা। আর সেই মুক্তির পথে সাধারণ নৈতিকতা কেবলমাত্র চারিত্রিক বিচ্যুতি ব্যতীত আর কিছু নয়। বিনা প্রশ্নে, বিনা বিচারে, প্রকাশচন্দ্রের মতাদর্শের প্রতি নিঃসপত্ন আনুগত্য, এতেই বঙ্গজাতির মুক্তি। প্রকাশচন্দ্র যা বলেন তাই নীতি। প্রকাশচন্দ্র যা অনুমোদন দেন তাই নিয়ম। প্রকাশচন্দ্র যা আদেশ দেন তাই বিচার। প্রকাশচন্দ্রের উচ্চারিত প্রতিটি অক্ষর পবিত্র, প্রকাশচন্দ্রের প্রতিটি আচরণ আচরণীয়, প্রকাশচন্দ্রের প্রতিটি আদেশ অবশ্যপালনীয়। সারাজীবন এই সত্যকেই ধ্রুব জেনে এসেছেন তিনি।

ঘনায়মান অন্ধকারে নিজের দু’হাতের দিকে অনেকক্ষণ স্থির চোখে চেয়ে আছেন অমিতাভভট্ট। বড় ভুল হয়ে গেছে সারা জীবন জুড়ে। মস্ত বড় ভুল। এই ভ্রান্ত, অন্ধ পথের পথিক হয়ে এতদিন দু’হাতে অজস্র কালি মেখেছেন তিনি। অপরিমেয় পাপের ভাগী হয়েছেন। আর কত মাখবেন? কেনই বা মাখবেন? কীভাবে হবে এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত?

সারথি সুদাস দেখল তার প্রভু স্খলিত পায়ে এসে দাঁড়িয়েছেন টিলার একেবারে উপান্তে। দু’হাত ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে উপরে তুলে কী যেন বলছেন তিনি, মনে হয় যেন সর্বশক্তিমানের প্রতি কোনও গভীর অনুযোগ জানাচ্ছেন।

দু’চোখে ধাঁধা লেগে যায় সুদাসের। কী করবে সে এখন?

তবে বেশিক্ষণ দোলাচলের মধ্যে থাকতে হয় না তাকে। সুদাসের স্তম্ভিত এবং আতঙ্কিত চোখের সামনে তার প্রভু ঝাঁপ দিলেন টিলার মাথা থেকে।

নীচে পড়তে পড়তে হাত দু’খানি দুদিকে বাড়িয়ে দেন অমিতাভভট্ট। যেন উদাস উন্মুক্ত বাতাসকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরতে চাইছেন তিনি।

একটু পরেই তাঁর দেহটি একটি গ্লানিভারগ্রস্ত পাথরের মতো ডুবে গেল পূর্বসমুদ্রের জলে। সেই সঙ্গেই অন্তরের সমস্ত দ্বন্দ্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল বঙ্গদেশের প্রধানমন্ত্রী অমিতাভভট্ট’র।

.

মূক ও বধির মদিরা বিক্রেতার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে একটা সন্দেহ পাকিয়ে উঠছিল সিংহোদরের মনে। তাকে এ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

অবশ্য তখন তার স্থির হাঁটার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে। পা টলায়মান। চোখদুখানি রক্তিম। মন বড় প্রসন্ন সিংহোদরের। শৌণ্ডিকটি বড় ভালো। একটিমাত্র কপর্দকের বিনিময়ে অন্তত অর্ধকলস মদিরা পান করতে দিয়েছে সিংহোদরকে। আকারে ইঙ্গিতে এও জানিয়েছে যে তার সঙ্গে গেলে আরও উৎকৃষ্ট সুরা এনে দিতে পারে সে। তার সঙ্গে সুন্দরী নারীও। না না, তার জন্য কিছুই দিতে হবে না সিংহোদরকে।

নারীসঙ্গ বহুকাল হয়নি সিংহোদরের। তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা, আপাতত পিত্রালয়ে অবস্থান করছেন। অনেক দিনের রমণীবর্জিত শুষ্ক জীবন বড়ই পীড়া দিচ্ছিল সিংহদোরকে। তার ওপর এই মন উদাস করা মদিরাবেশ। আর এ তো মানুষের শরীর।

পথ ক্রমেই প্রশস্ত হয়ে উঠছিল। প্রদোষকাল আসন্ন। পথে সুবেশ নাগরিকদের দল।

পথটি শেষে একটি সুসজ্জিত গৃহদ্বারে এসে শেষ হল। তার সামনে মধুপায়ী ভ্রমরগুঞ্জের মতো মদ্যপদের ভিড়। ততক্ষণে সিংহোদর কিঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ হয়েছে। সে ইতিউতি চাইতে লাগল। এই স্থান তার চেনা। ভাঁড়ুদত্ত’র প্রসিদ্ধ শৌণ্ডিকালয়। তাকে এখানে আনা হল কেন?

ততক্ষণে মূক ও বধির মানুষটি ভিতরে চলে গেছে। একটু পরেই দেখা দিলেন স্বয়ং ভাঁড়ুদত্ত। উদার হেসে বললেন, ‘কী সৌভাগ্য, কী সৌভাগ্য, স্বয়ং মল্ল সিংহোদর উপস্থিত যে! আসতে আজ্ঞা হোক। বসতে আজ্ঞা হোক। মায়া, দেখো কে এসেছেন। অতিথিকে ভেতরে নিয়ে যাও।’

সিংহোদরের মাথার মধ্যে একটা আশঙ্কা নড়ে উঠল। এক্ষুনি কিছু একটা ঘটে গেল যা হওয়া উচিত নয়। সঙ্গত নয়।

কিন্তু তার আশঙ্কা চাপা পড়ে গেল মায়াকে দেখে। মানুষ এত সুন্দরও হয়?

সেই মুহূর্তে মূক ও বধির মানুষটি বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে৷ সে চোখের ইশারায় মায়ার দিকে ইঙ্গিত করে অশ্লীল হাসিতে ভরিয়ে তুলল তার মুখখানি। মায়াও একটি কামাতুর বিলোল কটাক্ষ উপহার দিয়ে বলল, ‘আসুন স্বামী, উৎকৃষ্ট শিধু আছে। আর ক্লান্তি অপনোদনের জন্য শয্যাও প্রস্তুত।’

সিংহোদরের তৃষ্ণার্ত চোখে যেন সহস্র প্রদীপ জ্বলে উঠল। এ কি মানবী, নাকি যক্ষিণী?

অন্ধের মতো সে অনুসরণ করল মায়াকে। আহা, নিতম্ব দুটি কী মায়াময়, কী অনুপম।

.

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন