অভীক সরকার
অন্ধকার কারাগারের পাথুরে মেঝে থেকে উঠে আসছিল শব্দগুলো। একদল রক্ষীর হেঁটে আসার শব্দ। তবে তার সঙ্গে আরও একটি চেনা শব্দ ছিল। চেনা অথচ অচেনা। স্মৃতি আজকাল বড় বিশ্বাসঘাতকতা করে। অনেক চিরপরিচিত শব্দ, অর্থ, বা চিত্র বুঝতে পারেন না।
তারা হেঁটে আসছিল দীর্ঘ অন্ধকার অলিন্দ ধরে৷ শব্দগুলি প্রথমে স্তিমিত, তারপর ক্রমেই উচ্চকিত হয়ে উঠছে।
অলিন্দের শেষে বাঁক নিয়েই কয়েকটি অন্ধকার কারাকক্ষ। একজন নারী ভূমিশয্যায় শায়িত। তিনি প্রকাশচন্দ্রের এই গুপ্তকারাগারের একমাত্র বন্দি। তাঁর কান উদগ্রীব হয়—আসছে, খাদ্য আসছে!
এককালে এই দেশের সম্রাটের পট্টমহিষী ছিলেন তিনি। কী ছিল না তাঁর? আদেশ পালনের জন্য নিযুক্ত ছিল শতাধিক দাসদাসী। স্নান করতেন চন্দনজলে, প্রসাধন করতেন দুর্মূল্য কুঙ্কুম আর মহার্ঘ ফুলরেণুতে। তাঁর দেবনিন্দিত দেহকাণ্ডটি বেষ্টন করে থাকত মধুরার মহার্ঘ নীলাম্বরী। তাঁর ইঙ্গিতমাত্র স্বাদুতম খাদ্য ও মহার্ঘতম পানীয়ের ভাণ্ডার সাজিয়ে দেওয়া হতো তাঁর সামনে। আমোদে, আহ্লাদে, গরিমায় এবং ঐশ্বর্যে তিনি সত্যই রাজেন্দ্রাণী ছিলেন।
আর আজ?
বৃদ্ধা সামান্য মাথা তুললেন। এই অন্ধ কারার অন্তরালে কেটে গেছে কতগুলি বছর। কত বছর, তার আর গণনা করেন না। এই নরকের অন্ধকার ছিনিয়ে নিয়েছে তাঁর সবটুকু। তাঁর চোখের জ্যোতি ম্লান হয়েছে, শিথিল হয়েছে চর্মগ্রন্থি। ঘন মেঘতুল্য কৃষ্ণকেশরাশি এখন শণতন্তুর মতো। একদা রাজেন্দ্রাণীর এখন একটি মাত্র ছিন্নকন্থা সম্বল। কারাকক্ষের এককোণে একটি মৃৎপাত্রে দুর্গন্ধযুক্ত জল রেখে যায় ওরা, তৃষ্ণায় তাই পান করেন তিনি।
এককালে তিনি সম্রাজ্ঞী ছিলেন। আজ তিনি সাক্ষাৎ প্রেতিনী।
পায়ের শব্দরা আরও এগিয়ে আসছে। এইবার তিনি অন্য শব্দটি চিনে নিলেন। লৌহশৃঙ্খলের শব্দ। তার মানে নতুন কোনও বন্দিকে নিয়ে আসা হচ্ছে এই নরকে।
তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বন্দি মানে মানুষ। একটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক মানুষ, তাঁকে হোক না রাখা পাশের কারাকক্ষে। তবুও, কথা বলার মতো একটি মানুষ তো পাবেন তিনি।
শেষবার এসেছিল একজন। কোন এক বিদেশি গুপ্তচর। সাধারণ গুপ্তচর নয়, খুব উচ্চপদস্থ কেউ। নইলে প্রকাশচন্দ্রের এই বিশেষ অন্ধকূপে আনা হতো না তাকে। রোজই রক্ষীরা তাকে নিপীড়ন কক্ষে নিয়ে গিয়ে চূড়ান্ত অত্যাচার করত গুপ্তসংবাদের খোঁজে। দূর হতে ভেসে আসা সেই অত্যাচারের শব্দে, মানুষটির আর্তনাদের শব্দে সিঁটিয়ে থাকতেন তিনি।
রক্ষীরা তার রক্তাক্ত এবং ক্ষতবিক্ষত দেহটি পার্শ্ববর্তী কারাকক্ষে ফেলে চলে যাওয়ার পর সেই হতভাগ্যটির সঙ্গে ধীরে ধীরে, থেমে থেমে কিছু কথা বলতেন তিনি। তাঁর কাছ থেকেই জেনেছিলেন ওই পিশাচী নারীর সঙ্গে তাঁর প্রাণাধিক সন্তানের বিবাহের সংবাদ। জেনেছিলেন যে তাঁর স্নেহের পুত্তলিটিকে সেইভাবেই হত্যা করেছে ওই পাপিষ্ঠা নাগিনী, যেভাবে নিহত হয়েছিলেন তাঁর স্বামী।
সেই বন্দি অবশ্য বেশিদিন সঙ্গ দেয়নি তাকে। প্রকাশচন্দ্র নিজে এসে তাঁর কারাকক্ষের সামনেই সেই হতভাগ্যর মুণ্ডচ্ছেদ করেন। ওঃ, সে কী রক্ত!
সেইদিন আরও একটি কথা উচ্চারণ করেছিলেন প্রকাশচন্দ্র, সম্পর্কে তাঁর ভ্রাতৃশ্বশুর প্রকাশচন্দ্র, যাঁর অনুগ্রহে তাঁর স্বামী এই বঙ্গদেশের সম্রাট হয়েছিলেন—সেই প্রকাশচন্দ্র। সেই বিদেশি গুপ্তচরের ছিন্ন দেহ দেখে তিনি যখন বমন করছেন, তখন প্রকাশচন্দ্র বলেছিলেন, ‘রক্ত দেখে ঘৃণার উদ্রেক হচ্ছে রে রণ্ডা? উচিত ছিল তোর ওই অবাধ্য মূর্খ সন্তানটিকে তোর সামনে এভাবেই বধ করে তার রক্তমিশ্রিত অন্ন তোকে খাওয়ানো। তবে যদি সম্রাজ্ঞী য়ু জেতিয়ান-এর ঋণের কিছুমাত্র শোধ করতে পারি।’
মুহূর্তের জন্য একবার চোখ বন্ধ করেই খুললেন তিনি। ইশ্বরের নিশ্চয়ই কোনও উদ্দেশ্য আছে। নইলে এখনও তিনি কেন বেঁচে আছেন?
রক্ষীদলের পায়ের শব্দ এসে তাঁর কারাকক্ষের সামনে থামল। ভূমিশয্যা থেকে শ্লথভঙ্গিতে উঠে বসলেন তিনি। দুজন রক্ষী মৃৎপাত্রে করে সামান্য অন্ন ঠেলে দিল কক্ষের মধ্যে। অন্য রক্ষীদের মধ্যে অগ্রগামী রক্ষীটি তাঁর পাশের কক্ষটির লৌহদ্বার উন্মুক্ত করল। বন্দি সেই কক্ষে প্রবেশ করা মাত্র দ্রুত বন্ধ করা হল দ্বার।
তারপর বাকিরা প্রস্থান করলে দুজন রক্ষী ভল্ল হাতে কারাকক্ষের সামনে প্রহরায় রয়ে গেল।
সামান্য আশ্চর্য হলেন তিনি। নিরাপত্তা এতই সুদৃঢ় যে এখান থেকে পলায়নের কথা কেউ ভাবতেও পারে না।
এ হচ্ছে প্রকাশচন্দ্রের নিজস্ব কারা৷ এখানে একমাত্র প্রকাশচন্দ্র ছাড়া আর কারও শাসন চলে না, বঙ্গদেশের সম্রাটেরও নয়। লালিম্ববন পাহাড়ের বিস্তীর্ণ গুহার মধ্যে এর অবস্থান। গুহার সামনে রাজসেবকরক্ষীর এক বিশিষ্ট গোষ্ঠীর কঠিন প্রহরা৷ এদের নিযুক্ত করার পূর্বে প্রকাশচন্দ্র স্বয়ং এদের পরীক্ষা নেন। রক্ষীদের সহায়তার জন্য আছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হিংস্র কুকুরের দল।
মেঘান্দর একটি শাখা এই গুহার পিছনদিক বেষ্টন করে আবার মূল ধারার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। তার গভীরতা অধিক না হলেও স্রোত প্রবল। সেই শাখানদী থেকে একটি নাতিবৃহৎ খাল কেটে কারাগারের সামনে সৃষ্টি করা হয়েছে জলপূর্ণ পরিখা। তাতে প্রকাশচন্দ্রের কয়েকটি প্রিয় পোষ্য বসবাস করে। কুমীর!
পরিখাটি লাফিয়ে পার হওয়া অসম্ভব। কারাগারের মূল দ্বার থেকে পরিখার অন্যদিকে যাতায়াতের জন্য একটি সেতু আছে। আর প্রকাশচন্দ্রের বিশেষ অভিজ্ঞানচিহ্ন ব্যতীত সেই সেতু কখনই নামানো হয় না।
এ কারাগার নয়, সাক্ষাৎ নরক। এখানে একবার যারা আসে, পৃথিবীর বুক থেকে তাদের অস্তিত্ব মুছে যায়।
পরিখার এদিকে থেকে উচ্চৈঃস্বরে ডাক ভেসে এল, ‘পাটাতন নামাও হে সেতুরক্ষী, বন্দির জন্য অন্ন এনেছি।’
পরিখার এপারে সেতুরক্ষীর আদেশে তার সহকারী ধীরে ধীরে একটি কপিকলের রজ্জু আকর্ষিত করতে লাগল। দু’পারের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হওয়ামাত্র ওপার থেকে সেতুর ওপর উঠে এল এক বিশাল অবয়ব। তার ডান হাতে একটি দণ্ডদীপিকা, বাম হাতে বৃহৎ পাত্র।
এপারে এসে দণ্ডদীপিকাটি একটি আকর্ষীতে গুঁজল আগন্তুক। সেতুরক্ষীর সহকারী যুবা অন্নপাত্রটি নামিয়ে সেটি উত্তমরূপে পরীক্ষা করতে লাগল। সেতুরক্ষী আগন্তুকের পরিধেয় বস্ত্র পরীক্ষা করতে লাগলেন।
আগন্তুকের পরিধেয় কৃষ্ণবর্ণ অধোবাস, ঊর্ধ্বাংশ উন্মুক্ত। মুখের অর্ধেক সেই একই বস্ত্রে আচ্ছাদিত। সেতুরক্ষী আগন্তুকের মুখের বস্ত্রখানি উন্মোচিত করে মুখ দেখে নিলেন। তারপর আগন্তুকের কচ্ছটিকা পরীক্ষা করলেন, পাদুকা পরীক্ষা করলেন, মস্তকাবরণ পরীক্ষা করলেন। শুধু আগন্তুকের দক্ষিণ মণিবন্ধের দিকে নির্দেশ করে বললেন, ‘এটি কী?’
মণিবন্ধে একটি চওড়া এবং পুরু চর্মনির্মিত বাহুভূষণ, পট্টির মতো করে জড়ান। আগন্তুক উত্তর দিল, ‘আজ গৃহে দেবী অট্টহাসের পূজা, এ তারই চিহ্ন। তুমি মনে হচ্ছে এই অঞ্চলে নতুন। অট্টহাসের পূজাবিধি কিছুই জানো না!’
পাটাতনরক্ষী এদিকের লোক নন। তার ওপর তিনি বৌদ্ধ নন। তিনি আর কথা বাড়ালেন না। একবার দেবী অট্টহাসের মূর্তি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর। সেই ক্ষুৎকামা, শীর্ণকায়া, ভয়ঙ্করী মূর্তি দর্শনের স্মৃতি খুব একটা সুখকর নয়। তিনি আর কিছু বললেন না।
আগত রক্ষী কটিদেশ থেকে একটি নামাঙ্কিত চতুষ্কী বার করে প্রহরীকে দেখিয়ে নিলেন। ততক্ষণে তাঁর আনা অন্নপাত্রটির পরীক্ষা শেষ হয়ে গিয়েছিল। তিনি পুনরায় দণ্ডদীপিকা এবং পাত্রটি হাতে তুলে এগিয়ে গেলেন একটু দূরের একটি মস্ত বড় গুহামুখের দিকে। ওটিই এই নরকের প্রবেশদ্বার।
.
গোগ্রাসে অন্ন গ্রহণ শেষ করে মৃৎপাত্রটি কারাকক্ষের বাইরে ঠেলে দিলেন বন্দিনী। সামান্য জল পান করলেন। তারপর নিদ্রার ভান করে কিছুক্ষণ শুয়ে রইলেন।
ধীরে ধীরে রক্ষীদের কিছু কথা কানে আসতে লাগল তাঁর।
‘ইনি কি সেই তিনি?’
‘হ্যাঁ ভাই। ইনিই তিনি।’
‘বিশ্বাস হয় না। ইনি তো শুনেছি ইন্দ্রজালে বিশেষ সিদ্ধিপ্রাপ্ত। ধরা পড়লেন কী করে?’
‘হুঁ-হুঁ বাবা, রাজসেবকসেনা কী যেমন তেমন সৈন্য হে। তাদের প্রশিক্ষণই আলাদা। আর ঐন্দ্রজালিক হন বা সিদ্ধপুরুষ, শেষ অবধি মানুষ তো বটে।’
‘ধরা পড়লেন কী ভাবে?’
‘কাল রাত্রে নাকি এঁদের সন্ধানে কমলাঙ্ক গ্রামের অরণ্যে বিশেষ অভিযান চালানো হয়েছিল। স্বয়ং আনন্দগুপ্ত আর শান্তঘোষ তার দায়িত্বে ছিলেন। সেখানে দুইপক্ষের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ হয়। দুইপক্ষেরই অনেক অনেক সৈন্য হতাহত হয়েছে। তারপর ওরা যখন জঙ্গলের আরও গভীরে পালিয়ে যাচ্ছিল, ইনি নাকি কোন এক গুপ্তকুটিরের মধ্যে লুকিয়ে বসেছিলেন। জনৈক রাজসেবকসেনা এঁর সন্ধান পেয়ে বাকিদের ডেকে আনে।’
‘কিন্তু অভিযানটি চালানো হল কেন?’
‘কয়েকদিন আগে বজ্রযোগিনী উৎসবের সময়ে যে মহা অনর্থ ঘটেছিল, তার পেছনে নাকি ইনি আর এঁর কয়েকজন সঙ্গীসাথীই প্রধান।’
‘বল কী হে?’
‘শুধু কী তাই? আরও কারা কারা আছেন শুনলে মাথা ঘুরে যাবে।’
‘যেমন?’
‘মহাযোগী মৎস্যেন্দ্রনাথ। ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ বপ্যট। বিনয়াদিত্য জয়াপীড়। আরও অনেকে।’
‘বাপ রে! সবাই তো স্বনামধন্য পুরুষ।’
‘সে আর বলতে? আরও চিন্তার বিষয় কী জান? ওদের হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিল কিরাত আর শবরের দল।’
‘কিরাত আর শবর? ওরাও এঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে?’
‘সেটাই তো! আর তারা নাকি যুদ্ধও করেছে একেবারে প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর মতো। আমাদের সেনার অনেকেই নিহত হয়েছে। আহত আরও বেশি। শুধু তাই নয়, সেই যুদ্ধের পর থেকে শান্তঘোষ আর আনন্দগুপ্ত’র সংবাদ নেই। রাজপ্রাসাদ থেকে বলা হচ্ছে, ওঁরা যুদ্ধে মারাত্মক আহত। কুল্লুকভট্টর অধীনে রাজপ্রাসাদের মধ্যে তাঁদের চিকিৎসা চলছে। এদিকে শোনা যাচ্ছে তাঁরা আর বেঁচে নেই, নিহত হয়েছেন সেই যুদ্ধে।’
‘বলো কী হে?’
‘ঠিকই বলছি ভায়া। আরও যা সব শুনছি—সে সব যেমন ভয়ঙ্কর তেমনই উদ্বেগজনক।’
‘কীরকম?’
‘সে বড় গুহ্যসংবাদ হে, নিজের কাছেই রেখো। আমার শ্যালক অধিরথকে তো চেনো। সদ্য সদ্য সে বিশাখসেনের আপ্তসহায়ক নিযুক্ত হয়েছে। সে আমাকে বলেছে, গত কয়েকদিন ধরেই নাকি করসংগ্রাহকের কাছ থেকে সংবাদ আসছে যে কৃষকেরা সংঘবদ্ধ হচ্ছে৷ কর দিতে অস্বীকার করছে। বলছে—যে রানি দরিদ্রের বস্ত্রের সংস্থান করতে পারেন না তাঁকে আবার করদান কীসের!’
‘বলো কী হে? চিন্তার বিষয়। কিন্তু সামন্তপ্রভুরা কী করছেন? তাঁদের রক্ষীবাহিনী?’
‘সেখানেই তো আরও দুশ্চিন্তা৷ সামন্ত প্রভুরা প্রায় সবাই নিষ্ক্রিয়। তার একটা বড় কারণ হল, রক্ষীবাহিনীর মধ্যেও অনেকে আর দেশের মানুষের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে চাইছে না। তাই সামন্তপ্রভুরা সেনাবিদ্রোহের ভয় পাচ্ছেন।’
‘ব্বাবা! তাহলে তো খুবই সঙ্গীন অবস্থা।’
‘সঙ্গীন বলে সঙ্গীন? বিভিন্ন জায়গা থেকে ভয়ঙ্কর সব সংবাদ পাচ্ছি ভায়া। শুনছি, দু-একদিনের মধ্যেই নাকি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিদ্রোহ ঘোষণা করা হবে। তাতে কৃষক আর রক্ষীবাহিনীর অনেকেই যোগ দেবে। সামন্তরাও অনেকে সমর্থন করছেন এই বিদ্রোহ।’
‘চুপ চুপ! বন্দির জন্য খাদ্য আসছে। এখন চুপ থাকো।’
বন্দিনী নিজের কানদুটি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এতক্ষণ যা সব শুনলেন, তার সব সত্যি? এই দেশ তাহলে সত্যিই জেগে উঠেছে! এই জীবনে তিনি দেখে যেতে পারবেন? আবেগে তাঁর হাত পা থরথর করে কাঁপতে লাগল।
কিছু পরে এক বিশালদেহী রক্ষী মস্তবড় পাত্রে করে অন্নব্যঞ্জন নিয়ে এল নতুন বন্দির জন্য। সেই সুপক্ব ব্যঞ্জনের সুঘ্রাণে জিভে জল চলে এল বন্দিনীর। আহা, কতদিন হল ভালো খাদ্য জোটেনি তাঁর।
আগত রক্ষী অন্নপাত্র নামিয়ে দিল মাটিতে। প্রহরারত রক্ষীদল পাত্র ঠেলে দিল কারাকক্ষের মধ্যে। আগন্তুক রক্ষীটি ধীর পায়ে প্রস্থান করল।
বন্দি তাঁর পাত্র নিয়ে কক্ষের শেষপ্রান্তে চলে গেলেন। প্রহরারত রক্ষীরা দুজন আবার বিশ্রম্ভালাপে রত হলেন।
বন্দিটি তাঁর অন্নের স্তূপের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে কী যেন সন্ধান করতে লাগলেন। বস্তুটি হস্তগত হতেই উৎফুল্ল দেখাল তাঁকে। সেটি সন্তর্পণে কটিদেশে গুঁজলেন। তারপর খাদ্যগ্রহণে রত হলেন।
নাহ, ব্যবস্থা তো মন্দ নয়! নিজের মনেই চন্দ্রবংশের আতিথেয়তার ভূয়সী প্রশংসা করলেন তিনি। এই কারাগারের ব্যাপারে যতটা নিন্দা শুনেছিলেন তিনি, অবস্থা ততটা নিকৃষ্ট নয়। লোকে বলে এই কারাগারে নাকি একদিন অন্তর অন্তর বন্দিদের খাদ্য পরিবেশন করা হয়, তাও অপক্ব বা দুর্গন্ধযুক্ত। কই, এই তো তাঁকে সুপক্ব শালিধানের সঙ্গে ওলকন্দের ঝোল দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে হরিণের মাংস। কে বলে প্রকাশচন্দ্রের এই নরকে বন্দিদের অভুক্ত রাখা হয়? যারা বলে তারা মিথ্যুক, তারা শঠ।
.
বিশালদেহী রক্ষী পরিখার সামনে এসে বলল, ‘পাটাতন নামানো হোক।’
সেতুরক্ষী নিরাসক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘অধ্যাদেশ?’
বিশালদেহী রক্ষীটি ক্রুদ্ধস্বরে বলল, ‘একটু আগেই তো এখান থেকে গেলাম, নবাগত বন্দির জন্য খাদ্য নিয়ে। তুমিই তো পাটাতন নামিয়ে যেতে দিলে হে। এক অধ্যাদেশ বার বার দেখাতে হবে নাকি?’
সেতুরক্ষী শীতল ও নৈর্ব্যক্তিক সুরে বললেন, ‘তুমি মনে হচ্ছে এই অঞ্চলে নতুন। এই কারাগারের নিয়মবিধি জানো না। এই পাটাতন ওঠাবার বা নামাবার সময় প্রত্যেকবার মহামান্য প্রকাশচন্দ্রের অভিজ্ঞান আবশ্যক।’
আগত রক্ষী বুঝল যে একটু আগে তার ওই অট্টহাস পূজা নিয়ে বলা কথাটার প্রত্যুত্তর দিল সেতুরক্ষী। সে ক্রুদ্ধভাবে কটিদেশ হতে তাম্রনির্মিত চতুষ্কী বার করে পাটাতনরক্ষীর সামনে মেলে ধরল। সেতুরক্ষীটি একবারমাত্র দেখেই পাটাতন নামানোর জন্য উদ্যোগী হলেন।
বিশালদেহী রক্ষী হেলেদুলে পার হয়ে গেল পরিখা। ওদিকে একদল রক্ষী দাঁড়িয়ে আছে ভল্ল হাতে, এই বিশালদেহী রক্ষীকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাবে।
সেতুরক্ষীটির ভ্রুদুখানি কুঁচকে রইল। কী যেন একটা ঠিক হল না। কী যেন একটা হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হয়নি। কিন্তু সেটা কী? কিছুতেই মনে পড়ছে না।
.
খাদ্যগ্রহণ শেষ হলে শূন্য পাত্র এক পাশে সরিয়ে রাখলেন নবাগত বন্দি। তারপর বেশ হৃষ্টচিত্তে উচ্চৈঃস্বরে বললেন, ‘নাহ, আপনাদের ব্যবস্থা তো বেশ ভালোই দেখছি।’
প্রহরারত রক্ষীদুজন অপ্রস্তুত হল। এই কারাগারে বন্দিদের সঙ্গে বার্তালাপ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু এখন যিনি বন্দি আছেন তিনি সাধারণ মানুষ নন। ইনি নাকি জন্ম থেকেই সহজাত যোগবিভূতির অধিকারী৷ সমস্ত অবিশ্বাস্য এবং অলৌকিক কর্মে এঁর সিদ্ধি প্রবাদপ্রতিম। রক্ষীদের মধ্যে একজন ইতস্তত করে বলল, ‘ইয়ে, আপনার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো কুমার?’
অন্ধকারের মধ্যেই আকর্ণবিস্তৃত হাসলেন পদ্মসম্ভব। ‘না না অসুবিধা কীসের। দিব্য সুন্দর আপ্যায়ন৷ খাবারের স্বাদও চমৎকার। শুধু আপনাদের পাচককে বলবেন যে হরিণের মাংসে একটু টক দিতে। তাতে স্বাদ বেশ খোলতাই হয়। আর ওলকন্দের ঝোলে মরিচ আরেকটু বেশি হলে খারাপ হতো না। আমাদের কামরূপে আবার, বুঝলেন কী না, পিপ্পলি মরিচ একটু বেশিই খাওয়া হয়। তবে হ্যাঁ, পাচকের রান্নার হাত বড়ই উত্তম।
রক্ষীদুজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। অন্যজন সাহস করে বলল, ‘আপনার ব্যাপারে অনেক কিছু শুনেছি প্রভু।’
পদ্মসম্ভব শঙ্কিতস্বরে বললেন, ‘খারাপ কিছু শোনেননি তো? দেখুন মশাই, কয়েকটা কথা স্পষ্ট বলে রাখছি। কারণে অকারণে কিছু শত্রু বানিয়ে ফেলেছি বটে, কিন্তু আমার মতো সচ্চরিত্র, জিতেন্দ্রিয়, মানুষ সচরাচর চোখে পড়ে না। আমার নামে যেসব নিন্দেমন্দ শুনবেন তার অধিকাংশই মিথ্যে। দোষের মধ্যে সুরাসক্তি কিঞ্চিৎ বেশি আর পরিহাস করার স্বভাবটা একটু বেয়াড়া ধরনের। তা দোষেগুণে মিলিয়েই তো মানুষ, না কী?’
দুই রক্ষী হাঁ করে চেয়ে রইলেন।
অভিমান ভরে পদ্মসম্ভব বলতে লাগলেন, ‘স্বভাব চরিত্রে আমার মতো সদাশয় মানুষ আপনি দ্বিতীয় পাবেন? এই তো কুমার জয়াপীড়, সামান্য দুশ্চরিত্র হলে কী হবে, অতবড় বীর, আমার নামে কী কুৎসাটাই না করেন!’
একজন প্রহরী জিজ্ঞাসা করল, ‘কী কুৎসা?’
কারাগারের একেবারে সামনে এগিয়ে এলেন পদ্মসম্ভব, ‘শুনবেন? শুনবেন বলছেন? আহা, আপনারা তাহলে শুনুন।
‘এই তো কাল রাত্রে যখন প্রবল লড়াই চলছে, আমি সবেমাত্র চতুর্থ রাজসেবকসেনার মুণ্ডখানি দেহবিচ্ছিন্ন করে জয়াপীড়কে প্রশ্ন করেছি, ‘কী হে ভায়া, তোমার সংবাদ কী?’ সে তার হাতের ভল্লটি অন্য একটি সৈন্যের তলপেটে বিদ্ধ করে বলল, ‘এই তো, সবে ষষ্ঠ সৈন্য বধ করলাম।’ তাতে আমি সন্দেহ প্রকাশ করতেই সেই বহিরাগত কী বলল জানেন?’
রক্ষীদুটি স্তব্ধ।
পদ্মসম্ভব সেদিকে লক্ষ করলেন না। আরও উৎসাহভরে বলতে লাগলেন, ‘বলল, “যাও যাও, তোমরা পূর্বীদেশের মানুষেরা যুদ্ধের জানোটাই বা কী আর বোঝটাই বা কী? তার ওপর তুমি যেমন অলস, তেমন নারীসংসর্গপ্রিয়। তোমার দ্বারা এসব যুদ্ধ টুদ্ধ হবে না ভায়া।” আচ্ছা, আপনারাই বলুন, এ অপমান নয়? কুৎসা নয়? চরিত্রে কলঙ্কলেপন নয়? না হয় মন্দর্ভা আমাকে প্রীতির চোখেই দেখেন। তাই বলে সেটা অমন সবার সামনে ঘটা করে বলার কী দরকার শুনি?’
রক্ষী দুজন স্তম্ভিত চোখে চেয়ে রইল পদ্মসম্ভবের দিকে। এই সেই রাজকুমার? এই নির্বোধ বাচাল লোক? কোথাও কোনও ভুল হচ্ছে না তো?
এদিকে পদ্মসম্ভব বলেই চলেছেন, ‘সেই জন্যই তো আমাকে নেহাত বাধ্য হয়েই ঝটপট করে আরও দুজন রাজসেবকসৈন্য বধ করে ফেলতে হল। নইলে মুখ দেখাতে পারছিলাম না যে। চারিদিকে অত মান্যগণ্য লোক, সবার সামনে অত বড় অপমানটা মেনে নেওয়া কি ঠিক দেখায়? আপনারাই বলুন।’
‘মান্যগণ্য লোক বলতে?’ নির্বোধের মতো প্রশ্ন করে একজন।
‘সে অবশ্য বেশি নয়, এই যেমন ধরুন লোকেশ্বর মৎস্যেন্দ্রনাথ, বিনয়াদিত্য জয়াপীড়, খণ্ডিতারাতি বপ্যট, বপ্যটপুত্র গোপালদেব, এই ক’জনই। ওহো, ভালো কথা, বলি গোপালদেবের নাম শুনেছেন তো? শোনেননি? বলেন কী? সে তো বড় আশ্চর্যের কথা। তাহলে একটা গোপন সংবাদ দেব নাকি?’
রক্ষী দুজন নির্নিমেষে চেয়ে রইল। খাটো করে পদ্মসম্ভব বললেন, ‘এই গোপালদেবই কিন্তু সামনের ক’দিনের মধ্যে আপনাদের রাজা হবেন, বুঝলেন? কথাটা আবার পাঁচকান করবেন না। অত্যন্ত গুপ্তসংবাদ। আপনাদের বেশ হৃদয়বান বলে মনে হচ্ছে বলেই বললাম।’
রক্ষী দুজন দ্বন্দ্বে পড়ে গেল।
পদ্মসম্ভব কিন্তু থামলেন না। তিনি মুষ্টিবদ্ধ দুটি হাত প্রসারিত করে বললেন, ‘সেই গোপালদেবও যখন ফিকফিক করে হাসতে লাগলেন তখন আর থাকা গেল না বুঝলেন। আমার তখন মনটা ভারি খারাপ হল, বলতে গেলে খুবই অপমানিত বোধ করতে লাগলাম। তাই নেহাত বাধ্য হয়েই আপনাদের ওই শান্তঘোষ নামের লোকটার মুণ্ডখানা নামিয়ে দিতে হল। লোকটা অনেকক্ষণ ধরেই একখানা মস্ত তরবারি নিয়ে নেচে বেড়াচ্ছিল৷ বলে কী না সেটা নাকি আপনাদের ওই প্রকাশচন্দ্রের বিশেষ তরবারি।’
রক্ষীদুজনের শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল। লোকটা কি উন্মাদ?
পদ্মসম্ভব কারাগরাদের বাইরে হাত দুখানি প্রসারিত করে আক্ষেপের সঙ্গে বলতে লাগলেন, ‘সেই দেখে গোপালদেবের সে কী রাগ! বলে কি না, ‘এই যে আপনাকে অত করে বললাম শান্তঘোষ আমার, আর আনন্দগুপ্ত আপনার, আর আপনিও যে ঘাড় নেড়ে সম্মত হলেন, তার কী কোনও মূল্য নেই?’ লোকটা এমনিতে ভালো আর উদার হলেও রাগলে কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। তার ওপর গায়ে হাতির মতো জোর, তেমনই বাঘের মতো ক্ষিপ্র। আপনারা কিন্তু সাবধানে থাকবেন ভায়া। এ মানুষ শাসক হিসেবে প্রকাশচন্দ্রের থেকে কম কঠোর নন।’
রক্ষী দুজনের মাথার মধ্যে বিপদঘণ্টি বেজে উঠল। এসব সংবাদ কারাধ্যক্ষকে জানাতেই হবে। কোথাও একটা মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে। কিছু একটা ঠিক হচ্ছে না…
কিন্তু তারা উঠে দাঁড়াবার আগেই পদ্মসম্ভব আরও গলা নামিয়ে বললেন, ‘তবে গোপালদেবের একটি মস্ত দুর্বলতা আছে৷ জানতে চান নাকি? তাহলে কাছে আসুন। এসব উঁচু স্বরে বলা ঠিক নয়, দেওয়ালেরও কান আছে।’
রক্ষী দুজন কাছে আসতেই দুটি বলিষ্ঠ হাত দিয়ে তাদের কাছে টেনে নিলেন পদ্মসম্ভব, হয়তো বা গোপন কথা বলতেই। সঙ্গে সঙ্গে দুজনেরই মাথা আর ঘাড়ের ঠিক মধ্যস্থলে দু’খানি ক্ষুদ্র এবং তীক্ষ্ণ শলাকা সজোরে বিদ্ধ হল।
সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠল রক্ষী দুজন। তারা তরবারি বার করল। কিন্তু সেই তরবারি তোলবার আগেই তারা আবিষ্কার করল যে অবশ হয়ে আসছে তাদের হাত।
পদ্মসম্ভব তখন স্থির এবং শীতল চোখে লক্ষ করছেন দুজনকে। রক্ষী দুজন চিৎকার করার চেষ্টা করেই বুঝল যে তাদের গলা থেকে স্বর বেরোচ্ছে না। পালাবার জন্য দু-পা এগিয়েই আর পারল না, অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।
কপালের ঘাম মুছলেন পদ্মসম্ভব। মস্ত বড় ঝুঁকি নিয়েছিলেন তিনি। শলাকাদুটিতে যে বিষ মাখানো ছিল তাতে একটি পূর্ণবয়স্ক হাতিকে বেশ কয়েক দণ্ডের জন্য নিদ্রাভিভূত করা যায়। এই ভেষজ বিষের উৎসস্থল কামরূপের পূর্বতম প্রান্তের নাগাভূমির গহীনতম পাহাড়ি অরণ্যে। প্রতি বর্ষায় সেই অরণ্যে এক গুল্মলতা জন্মায়। তার ফুলের নির্যাস থেকে প্রস্তুত হয় এই মহাবিষ। নাগাভূমির বাইরে এর বিষয়ে কেউ জানে না। এর তীব্রতা কালনাগিনীর বিষের থেকেও বহুগুণ অধিক।
ভুলক্রমেও যদি শলাকা দুখানি তাঁর নিজের হাতে বিদ্ধ হতো, তাহলে এতক্ষণে তিনি আর বেঁচে নেই!
কটিদেশ থেকে চামড়ার পট্টিটি বার করে আনলেন পদ্মসম্ভব। তাঁর যা যা প্রয়োজন, তার সবই রয়েছে এখানে। মল্ল সিংহোদর তার কথা রেখেছে।
পট্টি থেকে দৈর্ঘ্যে এক অঙ্গুলি পরিমিত একটি অপেক্ষাকৃত স্থূল শলাকা বার করে আনলেন তিনি। তার অগ্রভাগ বিশেষভাবে বক্র।
কারাকক্ষটির লৌহদ্বার যেখানে মিলেছে, সেখানে একটি চতুষ্কণী লৌহফলক। সেখানে একটি ছিদ্রে শলাকা ঢুকিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করতে লাগলেন৷ একটু পরেই খুট করে একটা শব্দ হল৷ সন্তর্পণে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি।
পাশের কারাকক্ষে বন্দিনী নারীটি গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সম্পূর্ণ বাক্যালাপ স্বকর্ণে শুনেছেন তিনি৷ রক্ষীদুটির অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়াও স্বচক্ষে দেখেছেন। অন্য কোনও নারী হলে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠতেন। কিন্তু এককালে এই দেশের রাজ্ঞী ছিলেন তিনি। এখনও তাঁর স্নায়ুর ওপর কিছু দখল অবশিষ্ট আছে।
পদ্মসম্ভব দ্রুত পাশের কারাকক্ষের দ্বার উন্মুক্ত করলেন। তারপর সামান্য সরে দাঁড়িয়ে সসম্ভ্রমে বললেন, ‘আসুন মা।’
নারীটি বাইরে এলেন। উত্তেজনায় কাঁপছেন। অস্ফুটে প্রশ্ন করলেন, ‘কে তুমি?’
‘আপনার এক সন্তান, মা। দ্রুত আমার সঙ্গে চলুন।’
.
নির্মল শরতের আকাশের দিকে তাকিয়েছিল সেতুরক্ষীটি। অনেকক্ষণ ধরে একটা অস্বস্তি তাঁর মনের মধ্যে কাঁটার মতো বিঁধছে। কিন্তু কী—সেটি কিছুতেই মনে করতে পারছেন না তিনি।
একটু পর সহকারী যুবা এসে সামনে দাঁড়াল। তিনি তার দিকে না তাকিয়েই বললেন, ‘কী চাই?’
‘কালকে আমি হয়তো আসতে পারব না প্রভু।’
ভ্রুকুঞ্চন করলেন সেতুরক্ষী, ‘কেন?’
‘আজ্ঞে কাল আমার একমাত্র ভাগিনেয়র অন্নপ্রাশন।’
‘হুম। ঠিক আছে।’ অন্যমনস্ক ভাবে বললেন সেতুরক্ষী৷ তারপর প্রশ্ন করলেন, ‘তা ভাগিনেয়কে কী দিয়ে আশীর্বাদ করবি?’
‘আজ্ঞে, একটি স্বর্ণনির্মিত অঙ্গদ আর বালা কিনেছি প্রভু…’
লাফিয়ে উঠলেন সেতুরক্ষী, ‘কী বললি আবার বল…’
সামান্য অপ্রস্তুত হল যুবক, কিছু ভুল বলল নাকি? আবার বলল, ‘আজ্ঞে একটি অঙ্গদ আর বালা। নইলে শিশুটির মণিবন্ধ বড় শূন্য দেখায়…’
হাতের ভল্লটি নিয়ে কারাগারের প্রধানদ্বারের দিকে ছুটলেন সেতুরক্ষী। তাঁর মাথার মধ্যে বিপদঘণ্টা বেজে চলছিল।
.
পদ্মসম্ভব একটু এগিয়ে অলিন্দের মুখে একবার উঁকি দিলেন।
অলিন্দ একটু গিয়ে ডানদিকে বেঁকে গেছে৷ সেই বাঁকের মুখে একটি প্রহরী দাঁড়িয়ে। নিদ্রাহীন, ভাবলেশহীন মুখ।
তাঁরা দুজন যেখানে বন্দি ছিলেন, তার পাশে আরও তিনটি কারাকক্ষ আছে। এই পাঁচটি কক্ষগুচ্ছের সামনে থেকে একটি অলিন্দ এঁকেবেঁকে চলে গেছে কারাগারের মুখ্যদ্বারের দিকে। এরকম আরও দুখানি অলিন্দ এসে যুক্ত হয়েছে সেখানে। কারাগারের মুখ্যদ্বারের পাশেই কারাকর্তার কার্যালয়।
সামান্য নীচু হয়ে অস্পষ্ট শব্দ করলেন পদ্মসম্ভব। রক্ষী এদিকে মুখ ফেরাল। গম্ভীরস্বরে প্রশ্ন করল, ‘শ্রীধর, ভদ্রসেন, সব ঠিক তো?’
কোনও উত্তর নেই।
রক্ষীটি আবারও প্রশ্ন করল, ‘উত্তর দাও শ্রীধর।’
কোনও উত্তর নেই।
রক্ষীটি আকর্ষি থেকে দণ্ডদীপিকা খুলে এগিয়ে আসতে থাকল।
দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলেন পদ্মসম্ভব। জ্ঞানহীন রক্ষীদুজনের দেহ এখন কারাকক্ষের মধ্যে। তাদের একজনের পোশাক তাঁর অঙ্গে, তরবারি তাঁর হাতে৷
রক্ষীটি অলিন্দের ঠিক মুখে আসতেই একটি সূক্ষ্ম শলাকা ঠিক তার ডান কানের পাশে বিদ্ধ হল। রক্ষীটি দ্রুত সেটি টেনে বার করে দূরে নিক্ষেপ করল। তারপর ডানদিকে ঘুরেই দেখল তার ঠিক সামনে তরবারিহাতে দাঁড়িয়ে আছেন সেই মানুষটি—একটু আগেই যাঁকে সদ্য বন্দি করে আনা হয়েছে। দ্রুত বিস্ময় কাটিয়ে সে কোষমুক্ত করল তরবারি। কিন্তু তার আগেই একটি মুষ্ট্যাঘাত তাকে বাধ্য করল জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে।
দণ্ডদীপিকা তুলে নিলেন পদ্মসম্ভব। মৃদুস্বরে বললেন, ‘আসুন মা, দেখবেন, যেন শব্দ না হয়।’
.
সেতুরক্ষী উন্মত্তের মতো কারাদ্বারের সামনে এসে উচ্চৈঃস্বরে বলল, ‘দ্বার উন্মুক্ত করো রক্ষী।’
প্রধান দ্বাররক্ষী উঁকি দিয়ে দেখল। একটু পরেই কপিকলের ঘড়ঘড় শব্দ শোনা গেল। দ্বারখানি সামান্য উন্মুক্ত হতেই ঝড়ের মতো প্রবেশ করল সেতুরক্ষী। তারপর কারাকর্তার কার্যালয়ের দ্বারখানির ওপর সজোরে করাঘাত করতে লাগল। বাকি রক্ষীরা সচকিত এবং বিস্মিত হয়ে তাকাল।
কারাকর্তা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। বাইরে এসে বললেন, ‘কী ব্যাপার প্রহরী?’
সেতুরক্ষীটি ঊর্ধ্বশ্বাসে বলল, ‘কয়েক দণ্ড আগে যে রক্ষীটি নবাগত বন্দির জন্য অন্নপাত্র নিয়ে এসেছিল, তার সন্ধানে রক্ষী পাঠান প্রভু, এখনই। আর আমার সঙ্গে আরও দুজন রক্ষী দিন, আমি নবাগত বন্দিটিকে একবার দেখে আসতে চাই।’
কারাকর্তা একবার তাকালেন সেতুরক্ষীর উত্তেজিত মুখের দিকে। একজন রক্ষীকে নির্দেশ দিলেন রাজপ্রাসাদে জেনে নিতে, কে এসেছিল অন্নপাত্র নিয়ে। আর নিজেই দণ্ডদীপিকা তুলে নিয়ে বললেন, ‘চলো।’
.
অলিন্দ দিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে এলেন দুজনে। প্রথম বাঁক পেরিয়ে গেলেন। প্রথম আর দ্বিতীয় বাঁকের মধ্যে দেওয়ালের গায়ে কোথাও একটি গুপ্তপথ আছে। এই অন্ধকারা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র পথ। তার সন্ধান খুব কম মানুষ জানেন।
সেই গুপ্ত পথটির সন্ধান করতে হবে দুজনকে। পথটি কোথায়, বহুকষ্টে সেই সংবাদ সংগ্রহ করেছেন মৎস্যেন্দ্রনাথ। কিন্তু তাকে চেনার কী উপায়—সে ব্যাপারে কেউ জানে না। সম্পূর্ণ নিজের বুদ্ধি ও কৌশলের ওপর নির্ভর করে তাঁকে খুঁজে বার করতে হবে সেই গুপ্তপথের মুখ।
দ্বিতীয় বাঁকের সামনে এসে পদ্মসম্ভব উঁকি দিলেন একবার। দূরে একজন রক্ষী দাঁড়িয়ে। সে এদিকে ফিরে প্রশ্ন করল, ‘কী ব্যাপার?’
দুজনেরই মুখ কৃষ্ণবস্ত্রে আচ্ছাদিত। পদ্মসম্ভব পিছিয়ে এলেন। সঙ্গিনীকে ইশারায় বললেন নিশ্চল হয়ে থাকতে।
এইবার পরীক্ষা। পদ্মসম্ভব নিজের হৃদপিণ্ডের শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছিলেন।
পদ্মসম্ভব দেওয়ালের গায়ে ধীরে ধীরে আঘাত করছেন! কোথাও কোনও ফাঁপা শব্দ উঠছে কি? একটি পূর্ণবয়স্ক মানুষ প্রবেশ করতে পারে এমন একটি গুপ্তপথ দেওয়ালের ওপারে থাকলে তার শব্দ অবশ্যই অন্য হবে। কিন্তু শব্দ শোনা গেল না।
দণ্ডদীপিকার আলো কমে আসতে লাগল। একটু পরেই দীপ্যধিকারী আসবে নতুন আলো নিয়ে। তার পূর্বেই গুপ্তপথটির সন্ধান পেতে হবে তাঁদের। এছাড়া আর পথ নেই তাঁদের সামনে। কারাকক্ষের মধ্যে তিনজন কারারক্ষীর মৃতদেহ শায়িত।
তিনি তাঁর প্রচেষ্টা দ্রুততর করলেন। দুপাশের দেওয়ালে বারংবার আঘাত করে দেখতে লাগলেন পূর্ণদৈর্ঘ্যের মানুষের পালাবার মতো পথের সন্ধান পাওয়া যায় কী না। প্রতিটি জোড় বা ফাটলের মুখ পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন।
কিন্তু না, সব চেষ্টাই নিষ্ফল হল৷ প্রার্থিত পথের চিহ্নই পাওয়া গেল না।
স্বেদবিন্দু জমতে লাগল পদ্মসম্ভবের কপালে৷ দণ্ডদীপিকার আলো আরও ক্ষীণ হয়ে এসেছে। দীপ্যধিকারীর আসতে আর বেশি দেরি নেই। যা করার কিছুক্ষণের মধ্যেই করে ফেলতে হবে।
অসহায়ের মতো একবার অলিন্দের ছাদের দিকে তাকালেন পদ্মসম্ভব। কে জানে, পথটি হয়তো…
সঙ্গী নারীটি একবার শব্দ করতে গিয়ে মুখে আঁচল চাপা দিলেন। পদ্মসম্ভব সচকিত হয়ে নীচে তাকালেন। তারপর তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলেন—একটি ছোট ইঁদুর দেওয়ালের নীচ দিয়ে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল।
অর্থাৎ দেওয়ালের নীচে কোনও না কোনও পথ আছে, সেই পথ দিয়ে মূষিকজাতীয় প্রাণী যাতায়াত করে। নিভু নিভু দণ্ডদীপিকাটি হাতে নীচু হয়ে বসলেন পদ্মসম্ভব।
ইঁদুরটি যেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছিল, তার চারপাশের দেওয়ালটি হাত দিয়ে পরিষ্কার করতে থাকলেন। ধীরে ধীরে অমসৃণ দেওয়ালের গায়ে একটি বড় বৃত্তাকার পাথর ফুটে উঠল। খুব ভালো করে পরীক্ষা করলে বোঝা যায় যে সেটি এই দেওয়ালের অংশ নয়, আলাদা করে প্রস্তুত করে এনে এখানে বসানো হয়েছে। প্রস্থে সেটি প্রায় দুই মানুষ সমান প্রশস্ত।
পদ্মসম্ভব তার গায়ে ধীরে ধীরে তিনবার আঘাত করলেন।
পরক্ষনে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। তরবারির অগ্রভাগ দিয়ে গোল পাথরটির চারিধারে খোঁচাতে লাগলেন। একটু পরেই পাথরটি নড়তে লাগল। অতি সাবধানে সেটি ধাক্কা দিলেন পদ্মসম্ভব।
পাথরটি ধীরে ধীরে ভেতরের দিকে ঘুরে গেল।
দণ্ডদীপিকাটি তিনি নামিয়ে আনলেন।
ভেতরে একটি গুপ্তপথ। প্রস্থে দুই মানুষ সমান হলে কী হবে, উচ্চতা বেশি নয়। তার মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়ার উপায় নেই, চতুষ্পদের মতো চার হাতে পায়ে যেতে হবে।
পদ্মসম্ভব উঠে দাঁড়ালেন। প্রবল পরিশ্রমে তাঁর সমস্ত দেহ ঘর্মাক্ত। এইবার আসল পরীক্ষা। দুজনকে এই গুহাপথের ওপারে পৌঁছতে হবে।
সঙ্গিনীর দিকে ইশারা করলেন পদ্মসম্ভব। তাঁর চোখে একটা আতঙ্কের ছায়া দেখে অভয় ইঙ্গিত করলেন। তারপর তাঁকে সেই গুহাপথে প্রবিষ্ট করে নিজেও অগ্রসর হলেন। বহুকষ্টে হস্তপদদ্বয়ের সঞ্চালনে বৃত্তাকার গুহাদ্বারটি বন্ধ করতেই নিকষ অন্ধকার নেমে এল।
.
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন