অভীক সরকার
পরিচারক এসে প্রণাম করে দাঁড়াতেই শয্যার ওপর উঠে বসলেন অগ্নিমিত্র। তাঁর চোখেমুখে চাপা উত্তেজনার ছাপ। এই মুহূর্তটির অপেক্ষা করছিলেন তিনি। অবশেষে, অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসেছে।
‘তিনি কি একাই এসেছেন?’
‘না প্রভু, ভাঁড়ুদত্তও সঙ্গে আছেন।’
প্রীত হলেন অগ্নিমিত্র। বণিকশ্রেণীর মানুষদের তিনি চিরকালই দেখেছেন শাসকের পক্ষ নিতে। স্বাভাবিক, কারণ শাসকের কোপে পড়া মানে বাণিজ্যের ক্ষতি, অর্থাগমের ক্ষতি। কোনও বণিকই সেই ঝুঁকি নেন না।
তাদের মধ্যেও কেউ কেউ আছেন যাঁরা নিজগুণেই শাসকদের বিশেষ প্রিয় হয়ে ওঠেন। শাসকপক্ষের প্রীতিবর্ধক কাজে সহযোগিতা করেন, শাসকপক্ষের আদিষ্ট কর্ম সম্পাদনে বিশেষ উৎসাহ নেন। ভাঁড়ুদত্ত এমনই একজন মানুষ।
ভাঁড়ুদত্তর আবাসলয়টি এই কর্মান্তবাসকের উচ্চবর্গের আনন্দনিকেতন বিশেষ। সেখানে অনেকানেক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ক্লান্তি অপনোদন করতে আসেন। তাই বহুদিন থেকেই ভাঁডুদত্ত’র মাধ্বীশালার ওপর রাষ্ট্রশক্তির দৃষ্টি রয়েছে।
শান্তঘোষ একবারই মিলিত হয়েছিলেন ভাঁড়ুদত্তর সঙ্গে। অগ্নিমিত্রও ছিলেন সেই আলাপচারিতায়। এই অর্থলোভী মনুষ্যটিকে স্ববশে আনতে বেশি পরিশ্রম হয়নি তাঁদের।
‘ওঁদের আসতে বলো।’ আদেশ দিলেন অগ্নিমিত্র।
সামান্য অপেক্ষার পর ওঁরা দেখা দিলেন। শাসকবান্ধব ভাঁড়ুদত্ত এবং জনৈক অতিথি। নবাগত অতিথিটির আচার আচরণের মধ্যে অস্বস্তির চিহ্ন প্রবল। মুখচ্ছবি শীর্ণ। অক্ষিমণি চঞ্চল। হাত দুখানি পরস্পরের মধ্যে অঙ্গুষ্ঠবদ্ধ।
নবাগত আগন্তুককে স্বাগতসম্ভাষণ জানালেন অগ্নিমিত্র, ‘আসুন ভন্তে, আপনার জন্যই তো এত আয়োজন। তারপর, কোন মদিরাসেবন ইচ্ছা করেন বলুন, অরিষ্ট না মৈরেয়?’
.
‘মাহেন্দ্রক্ষণ সমাগতপ্রায় কুমার। আজ রাতেই আমাদের সেই মহাকর্মসাধনে প্রবৃত্ত হতে হবে। আর সময় নেই।’
মানুষটি বসেছিলেন পদ্মাসনে। সামনে একটি প্রদীপ। তার শিখার মৃদু কম্পনে পিছনের দেওয়ালে দুটি মানুষের ছায়াচিত্র ফুটে উঠছিল।
‘কিন্তু লোকেশ্বর,’ সংশয়াকুল স্বরে প্রশ্ন করলেন পদ্মসম্ভব, ‘আপনি এই ঔষধির গুণাগুণ সম্পর্কে নিঃসন্দেহ তো?’
‘যদি আমার চরেরা সঠিক সংবাদ দিয়ে থাকে, তাহলে এই ঔষধি কিছুতেই ব্যর্থ হতে পারে না কুমার। আর যে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে এই লতাগুল্মটি রক্ষিত ছিল, তাতে তো প্রমাণ হয়েই যায় এই সেই প্রার্থিত সর্ববিষহর ঔষধি।’
পদ্মসম্ভব তবুও ইতস্তত করতে লাগলেন। মৎস্যেন্দ্রনাথ বললেন, ‘আমি আপনার চাঞ্চল্যের কারণ অনুমান করতে পারি কুমার। কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের সামনে অন্য কোনও পথ নেই।’
পাশের ঘর থেকে শিলবাটার শব্দ ভেসে আসছিল। কমলশীল প্রাণ হাতে করে যে সর্ববিষহর লতাগুল্মটি নিয়ে এসেছেন, তার থেকে ঔষধ প্রস্তুত করা হচ্ছে। ভিক্ষুণী মন্দর্ভা স্বয়ং তার দায়িত্ব নিয়েছেন৷ আয়ুর্বেদ বিদ্যায় অসামান্য ব্যুৎপত্তি আছে তাঁর। নালন্দা মহাবিহারের শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার দায়িত্ব তিনিই নির্বাহ করেন।
তাঁকে সাহায্য করছেন এক তরুণী। তাঁর মুখখানি আবেগহীন এবং গম্ভীর হওয়ায় বয়সের তুলনায় তাঁকে অনেক বয়স্ক দেখায়। এই বিংশতিবর্ষীয়াকে দেখলে কে বলবে অস্ত্র হাতে কী ভয়ঙ্কর হতে পারেন তিনি। রাজসেবকপ্রধান গিরিকিশোরকে সম্মুখ দ্বৈরথে স্বহস্তে বধ করেছেন। তাঁর এক খড়্গাঘাতে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে আনন্দগুপ্ত’র মস্তক। তাঁর অসামান্য যুদ্ধকৌশল দেখে বিস্মিত হয়েছেন বপ্যট স্বয়ং।
ঘরের এককোণে চুপ করে বসে আছেন দুজন। গোপালদেব এবং আচার্য শান্তরক্ষিত। গোপালদেব নির্বিকার। তাঁর শান্ত সমাহিত মুখ দেখে মনের মধ্যে কী চলছে বোঝা অসম্ভব। আচার্য শান্তরক্ষিতের মুখে অবশ্য উদ্বেগ এবং উত্তেজনা স্পষ্ট। তিনি শাস্ত্রাধ্যায়ী শিক্ষক। কর্তব্যের প্রেরণায় এই মহাবিদ্রোহের একজন অংশ হয়ে পড়েছেন বটে, কিন্তু স্থৈর্য আয়ত্ত করতে পারেননি।
গোপালদেব চেয়েছিলেন বিংশতিবর্ষীয়া কন্যাটির দিকে। তিনি মহাবীর, ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ। জীবন ও মৃত্যুকে দুই হাতে অঙ্গদের মতই ধারণ করেন তিনি। নিঃশঙ্কহৃদয়ে, ভাবনাহীন চিত্তে শত্রুনিপাতে তাঁর দক্ষতা সহজসিদ্ধ। কিন্তু এই কন্যার যুদ্ধক্ষমতা তাঁকে বিস্মিত করেছে। কী অনায়াস অস্ত্রচালনা, কী দ্রুত শরীরসঞ্চালন, কী শান্ত অথচ নির্ভয়চিত্ত একাগ্রতা। বঙ্গদেশের মৃদু, শান্ত, শ্যামল মৃত্তিকায় এমন বীরাঙ্গনা জন্ম নেয় তা হলে?
যুবক গোপালদেবের হৃদয় শ্রদ্ধার সঙ্গে এক অন্য অনুভূতিতে ভরে যাচ্ছিল। একে বীর তিনি, তদুপরি সুপুরুষ। অদ্যাবধি নারীদের কাছ থেকে প্রণয় ইঙ্গিত কম পাননি। কিন্তু কোনও কারণে গোপালদেবের হৃদয়ের গোপন গহীন কন্দর নির্জিতই রয়ে গেছিল। অথচ সেই রক্তাক্ত রাত্রির পর থেকে এই তরুণীর খড়্গধারী উন্মুক্তকেশী চামুণ্ডারূপটি তাঁর হৃদয়ে প্রোথিত হয়ে গেছে। তিনি সেই ভয়ঙ্করসুন্দর রূপ ভুলতে পারছেন না।
মন্দর্ভা কাজ করতে করতে নীচু স্বরে আদেশ দিচ্ছিলেন তরুণীকে। তরুণী যন্ত্রের মতো আদেশ পালন করে যাচ্ছিল। গোপালদেব সামান্য অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘আর্যা, আর কতক্ষণ?’
মন্দর্ভা উত্তর দিলেন, ‘আরও কিছু সময় লাগবে, আর্য গোপালদেব। ধৈর্য ধরতে শিখুন। এ আপনার খড়্গের তীক্ষ্ণমার্জনা নয়।’
গোপালদেব অপ্রস্তুত হলেন। আর্যা মন্দর্ভাকে তিনি অত্যন্ত ভয় করে চলেন। বয়সে ছোট হলে কী হবে, এই ভিক্ষুণীর চরিত্রে, ব্যক্তিত্বে, আচরণে এমন একটি দার্ঢ্য আছে যা তাঁর মতো যুদ্ধনায়কের কাছ থেকেও সম্ভ্রম দাবি করে। তিনি শুধু লক্ষ করলেন যে মন্দর্ভার বাক্য শুনে তাঁকে অপ্রতিভ হতে দেখে তরুণীর ওষ্ঠে একটি বঙ্কিমরেখা দেখা গেল।
যাক, এ মেয়ে তাহলে হাসে, পাষাণ প্রতিমা নয়!
গোপালদেব সন্তর্পণে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালেন। তাঁরা এখন যেখানে আশ্রয় নিয়েছেন তার তুল্য নিরাপদ, গোপন স্থান কর্মান্তবাসকে আর দ্বিতীয়টি নেই। প্রকাশচন্দ্র আর তার বেতনভুক সারমেয়র দল শত চেষ্টাতেও এর সন্ধান পাবে না। নিজের মনেই মহর্ষি মৎস্যেন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধাবনত হলেন গোপালদেব। এই অসামান্য সাংগঠনিক ক্ষমতা সত্যিই শিক্ষণীয়।
স্ফটিকনির্মল আকাশ থেকে হিমঋতুচ্ছায়া সূক্ষ্ম কুয়াশার মতো নেমে আসছে পৃথিবীর ওপর। একটু দূরে কলস্বিনী মেঘান্দ। এখান থেকে তার ক্ষীণ স্রোতগর্জন শোনা যায়। অঙ্গনে কয়েকটি কেতকী, জাতি এবং নাগচম্পার গাছ৷ দূরে দেখা যায় কয়েকটি কক্ষে প্রদীপশিখা। আরও দূরের কোন মন্দির থেকে সান্ধ্যারতির ঘণ্টাধ্বনি ভেসে এল।
আকাশের দিকে চেয়ে রইলেন গোপালদেব। অগণন নীহারিকাপুঞ্জ থেকে স্নিগ্ধ আলোকবিন্দুর মতো নেমে আসছে নক্ষত্রের আলো। সেই অলৌকিক নক্ষত্রালোকে জীবন্ত হয়ে উঠেছে লালিম্ববন পর্বত আর তার সংলগ্ন অরণ্যানী।
আজ হতে প্রায় অর্ধশতবৎসর পূর্বে তাঁর পিতামহ আচার্য দয়িতবিষ্ণু কর্মান্তবাসকের ভূমিতে দাঁড়িয়ে কি এভাবেই দেখেছিলেন আকাশ? কী দেখেছিলেন? অনাগত পরাজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী? অবশ্যম্ভাবী সর্বনাশের অভ্রান্ত দিকচিহ্ন?
কয়েক দণ্ড সময় কেটে গেল। কে যেন তাঁকে পিছন থেকে ডাকল, ‘আর্য গোপালদেব, আসুন। আপনার ঔষধি প্রস্তুত।’
গোপালদেব ফিরে তাকালেন। সেই তরুণী তাঁর ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে, হাতে একটি প্রদীপ। গম্ভীর অথচ কমনীয় মুখখানি প্রদীপের শিখায় সদ্যস্নাতা করবীর মতো পবিত্র দেখাচ্ছে। গোপালদেব মৃদু হেসে বললেন, ‘চলুন আর্যা।’
এখান থেকে দেখা যাচ্ছিল, ঘরের মধ্যে একটি পাথরের পাত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছেন ভিক্ষুণী মন্দর্ভা৷ তাঁর একপাশে আচার্য শান্তরক্ষিত, অন্যপাশে কুমার পদ্মসম্ভব। আর তাঁদের পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং মৎস্যেন্দ্রনাথ।
এই দৃশ্য দেখে মনে যেটুকু সংশয় ছিল তা কেটে গেল গোপালদেবের। এঁরা যদি সঙ্গে থাকেন তো ত্রিলোকে কাউকে ভয় পান না তিনি। স্বয়ং যমরাজকেও না।
ঘরের দিকে এগোতে যাচ্ছেন, এইসময় তরুণী বলে ওঠে, ‘কুমার, আমার বড় ভয় করছে। অবলোকিতেশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি আপনি যেন সুস্থ থাকেন।’
মুহূর্তের মধ্যে যেন স্তব্ধ হল সৌর আবর্তন। গোপালদেবের বুকের মধ্যে জ্বলে উঠল সহস্র আলোকমঞ্জীর। এক কোমল কস্তুরীঘ্রাণ তাঁর ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে অপার্থিব স্রোত হয়ে নেমে আসতে লাগল তাঁর সুষুম্নাকাণ্ড বেয়ে।
গোপালদেব হেসে বললেন, ‘আমার ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করবেন আর্যা। আমাদের অনেক যৌথ সংগ্রাম বাকি রয়ে গেল।’
তরুণী বললেন, ‘আর্যা নয় কুমার। আমার নাম দেদ্দদেবী। আমাকে সেই নামেই ডাকবেন।’
.
মানুষটি কতক্ষণ বনতলে শুয়েছিল, সে জানে না। এতদিনের পরিশ্রমে অভুক্ত অশান্ত দেহ একেবারে ভেঙে পড়েছিল। তাই চোখ খুলে যখন সে দেখল যে তখনও রাত্রির ঘন অন্ধকার, তখন সে বিশেষ আশ্চর্য হয়নি। আশ্চর্য হল আকাশের দিকে তাকিয়ে।
নক্ষত্রের বিচলন বা চন্দ্রকলার হ্রাসপ্রাপ্তি দেখে দিনক্ষণ গণনা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু তাঁর স্মৃতি যদি খুব বিশ্বাসঘাতকতা না করে, তাহলে বর্তমান চান্দ্রতিথি জানাচ্ছে যে উপর্যুপরি দুই রাত সে এখানে নিদ্রাভিভূত ছিল।
কথাটি হৃদয়ঙ্গম হতেই একটা শিহরিত অনুভূতি নেমে গেল তার মেরুদণ্ড দিয়ে। দীর্ঘ দুইটি দিন এই হিংস্র উন্মুক্ত অরণ্যপ্রান্তরে ঘুমিয়েছিল সে? তা সত্বেও সে জীবিত? কোনও বন্য পশুর খাদ্য হয়নি? কোনও মহাসর্পের কালদংশনের শিকার হয়নি?
এ নিশ্চয়ই নিয়তিনির্দিষ্ট কাললক্ষণ। অর্থাৎ এত সহজে মরণ হবে না তার!
কথাটা মাথায় আসতেই শরীরে মনে যেন দ্বিগুণ বল ফিরে এল। দ্রুত উঠে পড়ল ভূমিশয্যা ছেড়ে। কোঁচড়ে তখনও কিছু ফল রয়ে গেছিল, তার একটি দ্রুত নিঃশেষ করল সে। তারপর ফের এগোতে লাগল তার উদ্দিষ্ট পথে। কর্মান্তবাসকের দিকে।
যে করেই হোক প্রকাশচন্দ্রের কাছে পৌঁছতে হবেই তাকে। আর পৌঁছতে হবে অতি দ্রুত৷ যে সুনিপুণ ষড়যন্ত্রের জাল ঘিরে ধরেছে কর্মান্তবাসককে, তা ছিন্ন করতেই হবে। চাই কী, হয়তো মহারানি তাকে বিক্রমপুরের সামন্তই করে দিলেন। আর সেদিন সে দেখে নেবে কত বড় সামন্ত হয়েছে ধর্মসেন! মনশ্চক্ষে নিজের নামটিও দেখতে পেল সে, মহাসামন্ত চণ্ডকীর্তি।
আজ থেকে ঠিক এক মাস আগের ঘটনা। নৈশাহার সমাপ্ত করে সবে শয্যাগ্রহণ করতে যাবে, এমন সময় দ্বারে মৃদু করাঘাত। এই করাঘাতের ক্রম এবং ছন্দ তার পরিচিত। দ্বার উন্মুক্ত করতেই দ্রুত প্রবেশ করেছিল তার ব্যক্তিগত চর, ভীম।
ভীম মহাসামন্ত ধর্মসেনের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী। ধর্মসেন তাকে নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ গুপ্ত আলোচনা তার সামনেই হয়। ভীমও প্রভুগতপ্রাণ, বিশ্বাসহন্তা হওয়ার কথা চিন্তাই করতে পারে না।
তবুও বহু আয়াসে, সেই অসম্ভব কর্ম সম্ভব করেছিল চণ্ডকীর্তি। অর্থ নয়, ভয় নয়, নারীসংসর্গবর্জিত ভীমকে ধর্মসেন প্রলোভিত করেছিল নারীদেহ দিয়ে। আর সেই পাপকর্মে তাকে যথাবিহিত সাহায্য করেছিল বিক্রমপুরের উদীয়মান নগরনটী, সেঁউতি। উদ্ভিন্নযৌবনা এই বারবধূর বরতনুর জালে জড়িয়ে পড়েছিল ভীম। ফেরার পথ ছিল না তার।
ভীম সেই রাতে যা বলেছিল, তাতে হাত পা অবশ হয়ে এসেছিল চণ্ডকীর্তির।
বিক্রমপুরনরেশ যে বহুবিধ কারণে কর্মান্তবাসকের প্রতি বিরূপ, সে ইঙ্গিত অনেকবারই পেয়েছে চণ্ডকীর্তি। কিন্তু সে জানত যে, ধর্মসেন যতই প্রতাপশালী দুর্দমনীয় সামন্ত হন না কেন, অযথা চন্দ্রশাসকদের বিরুদ্ধতা করার মতো দুর্বুদ্ধি কখনই হবে না তাঁর।
কিন্তু সেই রাতে ভীম জানিয়েছিল—সেই দুর্বুদ্ধিই হয়েছে ধর্মসেনের। আরও বেশ কয়েকজন সামন্ত’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে এক অবিশ্বাস্য অন্তর্ঘাতের পরিকল্পনা করেছেন তিনি।
সেই পরিকল্পনার কথা শুনে স্থির থাকতে পারেনি চণ্ডকীর্তি। ভেবেছিল পরদিন ভোর হওয়ার আগেই পৌঁছে যাবে বিক্রমপুরের গুপ্তচর প্রধানের কাছে। এত বড় স্পর্ধা কী করে হয় ধর্মসেনের, সেই সংবাদটা নেওয়া প্রয়োজন।
কিন্তু পারেনি চণ্ডকীর্তি। গুপ্তচর প্রধানের কাছ থেকে কোনও প্রয়োজনীয় সংবাদই নিষ্কাশন করতে পারেনি সে। ধূর্ত প্রৌঢ়টি যেন কোন জাদুমন্ত্রে বদলে গেছিলেন। মাথা নেড়ে যান্ত্রিক স্বরে শুধু বলে যাচ্ছিলেন, ‘অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গীন চণ্ডকীর্তি। এই সময়ে আমাদের নিশ্চুপ এবং নিষ্ক্রিয় থাকা উচিত। ধর্মসেন যা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন ঠিকই নিচ্ছেন। এতে শেষাবধি বিক্রমপুর তথা বঙ্গদেশের উপকারই হবে।’
তখনই মনে হয়েছিল চণ্ডকীর্তির, কোথাও একটা মস্ত বড় ফাঁকি রয়ে গেছে। প্রাজ্ঞ মানুষটির এই আচরণ অস্বাভাবিক।
পর দিন থেকেই সে বুঝতে পারছিল যে, তার চারিপাশে একটা অদৃশ্য জাল যেন বিছিয়ে দিয়েছে কেউ। কোন অদৃশ্য চোখ যেন নিরীক্ষণ করে চলেছে তার প্রতিটি পদক্ষেপ। সর্বক্ষণ। সে কোথায় যায়, কাদের সঙ্গে কথা বলে, কী খায়, কোন মদিরা পান করে—সব কিছুই যেন কাদের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের অধীন।
নিজেকে আরও গুটিয়ে নিয়েছিল চণ্ডকীর্তি।
এদিকে দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছিল বিক্রমপুরের রাজনৈতিক আবহাওয়া। চারদিকে সৈন্যবিদ্রোহের রণধ্বনি, অথচ রাজপ্রাসাদ বিস্ময়জনকভাবে নিরুদ্বেগ। এক এক করে বেশ কিছু ক্ষুদ্র অমাত্য এবং রাজসভাসদরা অকস্মাৎ অদৃশ্য হতে লাগলেন। কয়েকদিন বাদে তাঁদের দেহ পাওয়া যেতে লাগল বিক্রমপুরের বিভিন্ন অস্থানে কুস্থানে। কুখ্যাত শৌণ্ডিকালয়ে, বহুগম্যা বারবণিতাগৃহে, নির্জন অরণ্যপ্রদেশে।
সমস্ত ইন্দ্রিয় প্রখর হয়ে উঠছিল চণ্ডকীর্তির। এই আপাত-বিশৃঙ্খলার মধ্যেও একটি সুচারু সাধারণী সূত্র তার সন্ধানী চক্ষু এড়াতে পারেনি। কোথাও যেন কিছু একটা অসঙ্গতি।
আজ থেকে ঠিক দুইদিন আগে সেই অসঙ্গতি স্পষ্ট হয়ে গেছিল তার কাছে। তারপর থেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছে সে।
নিজের ভাবনা থেকে সহসা জেগে উঠল সে। কোথা থেকে যেন কুলুকুলু ধ্বনি ভেসে আসছে না? এর অর্থ কাছেপিঠেই কোথাও নদী আছে, অর্থাৎ কী না জল! পেয়।
তৃষ্ণায় গলা কাঠ হয়ে গেছিল চণ্ডকীর্তির। সেই শব্দের উৎসের দিকে ছুটল সে।
একটি সুবিশাল অশ্বত্থবৃক্ষ পার হতেই ছোট্ট নদী চোখে পড়ল তার। অরণ্যের কোন অন্ধকার প্রান্ত থেকে বয়ে এসেছে সে, বয়ে গেছে দক্ষিণের দিকে। চণ্ডকীর্তি প্রায় উড়ে গিয়ে সেই ক্ষীণকায়া তটিনীর কূলে শুয়ে আকণ্ঠ জল পান করতে লাগল।
তৃষ্ণাজর্জর বুক শীতল হতেই তার শিক্ষিত কানে এল শব্দটা। আগেই আসা উচিত ছিল যদিও, কিন্তু তৃষ্ণার্ত চণ্ডকীর্তির অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলি স্বাভাবিকভাবে কাজ করছিল না।
ব্রাহ্মমুহূর্ত শুরু হতে আর কয়েকদণ্ড বাকি। রাত্রির তমসা সামান্য স্বচ্ছ হয়ে এসেছে। খানিক দৃষ্টি দিতেই সে দেখতে পেল, নদীর অপর তটপ্রান্ত জুড়ে কয়েকটি দেহ। কয়েকটি নয়। কয়েক সার দেহ। একের পর এক বিচিত্র ভঙ্গিমায় শুয়ে আছে। অন্ততপক্ষে শতখানেক তো বটেই। মৃতদেহ নাকি?
একটু পরেই অবশ্য ভুল ভেঙে গেল তার। খানিকপর একটি আবছায়া দেহ কোথা থেকে যেন উদয় হল দেহগুলির মধ্যে। মনে হল, সে যেন প্রহরা দিচ্ছিল সমগ্র স্থানটি। এক এক করে নাম ধরে ডাকতে লাগল সে, আর এক একটি শরীর তাতে সাড়া দিয়ে জেগে উঠতে লাগল।
এই ঘন আরণ্যক অন্ধকারে এত মানুষ! বোধবুদ্ধি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল চণ্ডকীর্তির। তার মানে ওরা মৃতদেহ নয়? এত মানুষ নদীতীরে নিশ্চিন্তে রাত্রিযাপন করছিল? কিন্তু কেন? এরা তো তীর্থিক নয়! সৈন্য নয়!
তাহলে এরা কারা?
ধীরে, অতি ধীরে নিজের দেহ পিছিয়ে নিতে লাগল চণ্ডকীর্তি৷ ওরা যেন না দেখে ফেলে তাকে। তাকে জানতে হবে এরা কারা। কোথায় যাচ্ছে। এবং কেন।
অশ্বত্থবৃক্ষটির আড়ালে উঠে দাঁড়াল চণ্ডকীর্তি। তারপর সাবধানে তাকাল নদীর অপর প্রান্তের দিকে।
ততক্ষণে আকাশ স্বচ্ছ হয়ে এসেছে৷ ব্রাহ্মমুহূর্ত আগতপ্রায়। শরীরগুলি উঠে দাঁড়াল ছায়ামানুষের মতো। আর তাদের দেখে হাত-পা শীতল হয়ে এল চণ্ডকীর্তির।
নদীর অপর পারে উঠে দাঁড়িয়েছে একের পর এক সারি সারি উলঙ্গ নারীমূর্তি। এই অর্ধতমসাচ্ছন্ন রাত্রিতে কী ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে তাদের সুঠাম দেহ, উদ্ধত স্তন, উন্মুক্ত কেশদাম!
এরা কারা? কোন গহীন পাতাল থেকে উঠে এসেছে এই নগ্ন নারীর দল? কোন সর্বনাশের সঙ্কেত নিয়ে এসেছে?
এক পা, দু’পা করে পিছিয়ে যাচ্ছিল চণ্ডকীর্তি। ঠিক চতুর্থ পদক্ষেপের পর কর্ণমূলে একটি তীক্ষ্ণ ধাতব স্পর্শ পেয়ে থামতে বাধ্য হল সে। কে যেন উৎফুল্লস্বরে বলে উঠল, ‘বারে বা বাহ, এই দেখ, অনেকদিন পর বেশ নধর একটি মানুষ পাওয়া গেছে রে কালী। মনে হচ্ছে ঝলসে খেতে বেশ আনন্দই হবে, কী বলিস? তোরা না হয় হাত পা, পাছা আর মাথাটা নিস। বাকিটা আমার জন্য ছেড়ে রাখিস বুঝলি। আমার আবার মানুষের পাঁজর আর মেটে খুব পছন্দ, জানিসই তো।’
.
মহার্ঘ অরিষ্টপানে হয়তো কিঞ্চিৎ প্রগলভ হয়ে থাকবেন নবাগত অতিথি। অথবা এমত দুর্মূল্য মদিরাপানের অভ্যাস নেই তাঁর। নইলে ষষ্ঠ পাত্রটি নিঃশেষিত হওয়ার পর কেনই বা অসংলগ্ন স্বরে চিৎকার করে উঠবেন তিনি, ‘অর্থ কই মহামান্য অগ্নিমিত্র? কোথায় সেই অর্থ, যার লোভে আমি আমার ইষ্ট, ইহকাল, পরকাল সব নরকাগ্নিতে সমর্পণ করলাম?’
মদিরাপান করতে করতে সামান্য হাসলেন অগ্নিমিত্র। কূট এবং কৌশলী বাক্যপ্রয়োগে অপরপক্ষ থেকে সংবাদ নিষ্কাশনে তাঁর বিশেষ প্রসিদ্ধি। আর এই নবাগত অতিথি তো জনৈক বিভ্রান্তচিত্ত বৌদ্ধসন্ন্যাসী বই আর কেউ নয়!
আপাতত প্রয়োজনীয় যাবতীয় সংবাদ এই মূর্খটির থেকে নিষ্কাশন করে নিয়েছেন তিনি। আপাতত এর প্রয়োজন শূন্য।
মদ্যপানের অবসরেই অগ্নিমিত্রর অঙ্গুলি ইঙ্গিতে কয়েকটি দীর্ঘদেহী ছায়া প্রবেশ করল এই কক্ষে। সেই ইঙ্গিত অপ্রকৃতিস্থ। নবাগত অতিথি লক্ষ করলেন না। লক্ষ করলেন ভাঁড়ুদত্ত। তাঁর মুখচ্ছবি কঠিনরূপ ধারণ করল।
দীর্ঘদেহী ছায়াশরীরগুলি অধিক সময় ব্যয় করল না। চকিতে একটি বস্ত্রখণ্ড নবাগত অতিথির মুখ চেপে ধরল। সামান্য শারীরী প্রতিবাদের পর নিশ্চল হয়ে পড়লেন অতিথি মহাশয়। ছায়াশরীরগুলি এবং জ্ঞানহীন দেহটি অপসৃত হল।
.
ঘরটি সাধারণ, মাটি ও পাথর দিয়ে তৈরি। একটি মাত্র বাতায়ন উত্তরদিকে। তার মধ্য দিয়ে ত্রয়োদশীর অন্ধকার ছড়িয়ে আসছিল ঘরটির ভেতরে।
দ্বারপ্রান্তে একটি দীপ জ্বলছে। তাতে অবশ্য কক্ষের অন্ধকার দূর হয়নি। প্রদীপশিখার কাছে স্তূপীকৃত কর্পূর রাখা। কর্পূরের স্নিগ্ধ অথচ তীব্র গন্ধে কক্ষের বাতাস ভারী হয়ে আছে।
কক্ষের ঠিক মধ্যস্থলে একটি কাঠের পাটাতন পাতা। তার ওপর একটি বলিষ্ঠ দেহ শায়িত। দেহটি সম্পূর্ণ নগ্ন, একটি সুতো অবধি নেই। হাত এবং পা রজ্জুবদ্ধ।
লক্ষ করলে বোঝা যায় যে শুয়ে থাকা মানুষটি এখনই স্নান করে এসেছে। তার সিক্ত কেশ থেকে ক্ষীণ জলের ধারা বয়ে নেমে আসছে কাঠের পাটাতন বেয়ে৷ মানুষটির সমস্ত শরীরে অগুরুর স্নিগ্ধ ঘ্রাণ।
তার মাথার কাছে দুইটি মানুষ বসে আছেন। একজন নারী, আর একজন পুরুষ। দুজনের মনের মধ্যে জমে থাকা উদ্বেগ তাঁদের চোখেমুখে স্পষ্ট। দুজনেরই কপালে স্বেদবিন্দু জমে উঠেছে আসন্ন প্রক্রিয়াটির সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায়।
নারীর হাতে একটি পাথরের পাত্র। তার মধ্যে টলটল করছে ঘনকৃষ্ণবর্ণের এক সান্দ্র তরল। তার গন্ধ অত্যন্ত উগ্র। নারীটি বুঝতে পারছিলেন, হাতে ধরা পাত্রটি ধীরে ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
নারীটি মৃদুস্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘আর কতক্ষণ ভন্তে?’
পুরুষটি গম্ভীরস্বরে বললেন, ‘অধৈর্য হবেন না ভিক্ষুণী মন্দর্ভা। আর মাত্র কয়েক পলের অপেক্ষা। এখনই কৃত্তিকায় চন্দ্র আর তুলায় রবি প্রবেশ করবেন। সোম এখন কৃত্তিকার আলোকে উজ্জ্বল হবেন, আর রবি নীচস্থ। তখনই আসবে পবিত্র মুহূর্ত।’
মন্দর্ভা চুপ হয়ে গেলেন। পাত্রটি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে৷ মন্দর্ভা পাত্রটি একবার এই হাত থেকে ওই হাতে নিতে লাগলেন। তাঁর করতল ক্রমশ রক্তবর্ণ ধারণ করতে লাগল।
সেদিকে একবার তাকালেন আচার্য শান্তরক্ষিত। বললেন, ‘বায়ুস্পর্শে এই তরল ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, সেরকমই প্রয়োগশ্রুতি। আমি জানি আপনার অসুবিধা হচ্ছে। কিন্তু আমি আপনাকে সাহায্য করতে অপারগ ভিক্ষুণী মন্দর্ভা। এই ঔষধ সম্পূর্ণভাবে নারীহস্তে প্রস্তুত হতে হবে, নারীহস্তে রক্ষিত হতে হবে, নারীহস্তে সেবিত হতে হবে। এই এর প্রয়োগবিধি।’
‘কিন্তু কেন ভন্তে?’
মৃদু হাসলেন আচার্য শান্তরক্ষিত, ‘কারণ নারীর কল্যাণস্পর্শের থেকে পবিত্রতম বিষহর আর কিছুই হতে পারে না, আর্যা মন্দর্ভা।’
এই সময় মানুষটি চোখ খুলে চাইলেন। মৃদুস্বরে একবারমাত্র বললেন, ‘আচার্য…’
শান্তরক্ষিত বললেন, ‘সময় এসেছে ভিক্ষুণী, ঔষধ প্রয়োগ করুন।’
মন্দর্ভা বড় যত্নে, বড় আদরের সঙ্গে পাত্রস্থিত তরলটি গোপালদেবের মুখে ঢেলে দিতে লাগলেন। মনে হল যেন মাতৃসমা কনিষ্ঠা বড় মমতার সঙ্গে অসুস্থ অগ্রজের মুখে ঔষধ ঢেলে দিচ্ছেন।
কিছুটা তরল মুখে যাওয়ার পর মুখ বিকৃত করলেন গোপালদেব। সামান্য থামলেন মন্দর্ভা। তারপর পুনরায় তরল ঢালতে লাগলেন।
এইবার খক খক করে কেশে উঠলেন গোপাল। মাথা একদিকে কাত করলেন। মনে হল যেন সেই উগ্রগন্ধী তরল বমন করে দেবেন বাইরে। মন্দর্ভা দ্রুত নাক চেপে ধরলেন গোপালদেবের। তিনি নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য মুখ হাঁ করতেই তরল তাঁর পেটে চলে গেল৷
কিছুক্ষণের নীরবতা। তার পরেই যেন অসহ্য যন্ত্রণায় শরীর মুচড়ে উঠল গোপালদেবের। বলশালী দেহটি প্রবল আক্ষেপে কেঁপে উঠল একবার। তারপর জ্বরগ্রস্ত রোগীর মতো কাঁপতে লাগলেন। প্রবল কষ্টে তাঁর মুখ বিকৃত হয়ে এল৷ মনে হল কাঠের পাটাতন যেন দুটুকরো হয়ে যাবে যে কোনও মুহূর্তে।
সেই দৃশ্যের অভিঘাতে কেঁপে গেলেন মন্দর্ভা এবং শান্তরক্ষিত। আতঙ্কিত মন্দর্ভা অগ্রজের হাত চেপে ধরলেন। শান্তরক্ষিত বললেন, ‘বাকি ঔষধটুকু সেবন করান ভিক্ষুণী।’
সম্পর্কে সহোদর-সহোদরা হলেও সদ্ধর্ম গ্রহণের পর একে অন্যকে সাধারণ ভিক্ষুর মতোই সম্বোধন করেন। কিন্তু আজ আর থাকতে পারলেন না মন্দর্ভা, সজলচোখে বললেন, ‘ভাই, ও যে মরে যাবে।’
আচার্য শান্তরক্ষিত বামহাত অনুজার মাথায় রাখলেন। রুদ্ধস্বরে বললেন, ‘ভয় পাস না বোন, যা হচ্ছে ঠিকই হচ্ছে। জেনে রাখিস, আমরা ধর্মের পথে আছি। স্বয়ং তথাগত আমাদের সহায়। বাকিটুকু খাইয়ে দে, যে করে হোক। লোকেশ্বর মৎস্যেন্দ্রনাথ যে ঔষধ আনিয়েছেন, তার ওপর বিশ্বাস রাখ।’
মন্দর্ভা ধীরে ধীরে সন্তর্পণে বাকি ঔষধটি গোপালদেবের মুখের কাছে আনলেন। আর ঠিক তখনই যেন কোন যাদুমন্ত্রে গোপালের সমস্ত শরীর স্থির হয়ে গেল। আর খুলে গেল দুটি চোখ।
সেই প্রায়ান্ধকার ঘরে, প্রদীপের আলোয় স্তম্ভিত মন্দর্ভা আর শান্তরক্ষিত দেখলেন—গোপালের চোখদুটি লাল, টকটকে লাল। আর অক্ষিকোটরে কোনো মণি নেই!
মন্দর্ভার হাত দুটি ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল সেই অতিলৌকিক দৃশ্য দেখে। শান্তরক্ষিতের কপালে স্বেদবিন্দু আরও ঘন হয়ে এল। তিনি কম্পিতস্বরে বললেন, ‘বোন, ওর মুখে বাকি তরলটুকু ঢেলে দে। ভয় পাস না।’
মন্দর্ভা কোনওক্রমে পাত্রটি গোপালদেবের মুখের ওপর নিয়ে যেতেই গোপালের মাথাটি ধীরে ধীরে মন্দর্ভার দিকে ঘুরে গেল। তারপর সম্পূর্ণ অজানা এক কর্কশ স্বর নির্গত হল গোপালদেবের কণ্ঠ থেকে, ‘দয়া করো নারী, দয়া।’
মন্দর্ভা আর পারলেন না। কোনওমতে অবশিষ্ট তরলটুকু গোপালের মুখে ঢেলে দিয়ে জ্যামুক্ত শরের মতো সরে গেলেন ঘরের অন্যপ্রান্তে।
গোপাল তরল গলাধঃকরণ করলেন। তারপর সহসা শান্ত হয়ে গেলেন। যেন সমস্ত দুঃখ-যন্ত্রণা চকিতে অন্তর্হিত হয়েছে। চোখ দুখানি বন্ধ হয়ে এল। সমস্ত শরীর স্থির, নিষ্পন্দ।
একটু পর অনেকখানি সাহস একত্রিত করে গোপালদেবের মুখের ওপর ঝুঁকে এলেন শান্তরক্ষিত। শ্বাস চলছে তো মানুষটির। হৃৎপিণ্ডের শব্দ শোনা যাচ্ছে তো?
ধক করে আবার খুলে গেল গোপালদেবের চোখ। তারা এখন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। অক্ষিগোলক উধাও। অস্বাভাবিক স্বরে গোপালদেব বলে উঠলেন, ‘আহ, বড় কষ্ট, বড় কষ্ট। একটু জল দেবে কেউ? একটু জল দাও না। আর যে পারি না।’
আর সহ্য করতে পারলেন না মন্দর্ভা। দ্রুত ঘরের বাইরে চলে গেলেন। স্থির হয়ে বসে রইলেন শান্তরক্ষিত। আজ সমস্ত রাত্রি গোপালদেবকে এইভাবেই থাকতে হবে। এক বিন্দু জল দেওয়াও নিষিদ্ধ!
গোপালদেবের মাথার কাছে বসে পদ্মাসনে ধ্যানস্থ হলেন নালন্দার অধ্যক্ষ আচার্য শান্তরক্ষিত। সাধনালব্ধ শক্তি তাঁরও কম নয় কিছু। দেখা যাক, যোগবলে তিনি গোপালদেবের যন্ত্রণার কিছু উপশম করতে পারেন কি না।
.
কাঞ্চনাদেবী বসেছিলেন মেরুদণ্ড ঋজু করে। পদ্মাসনে। পরিধানে একটি শুভ্র কার্পাসবস্ত্র। পলিতকেশরাশি উন্মুক্ত। শুষ্ক হাতদুটি জুড়ে বার্ধক্যের সহস্র শিরা উপশিরা। চোখ স্থির এবং আবেগহীন। তাঁর জরাকবলিত মুখে এখনও রাজকীয় আভিজাত্য এবং দৃঢ়তার অবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়।
তাঁর সামনে মৎস্যেন্দ্রনাথ আর বপ্যট বসেছিলেন। তাঁদের সবল সমর্থ শরীরে মৃদু দীপালোক খেলে যাচ্ছিল দীঘির জলে প্রতিফলিত জ্যোৎস্নার মতো। বসার ভঙ্গিতে সম্ভ্রমের ভাব ছিল স্পষ্ট।
মৎস্যেন্দ্রনাথ মৃদুস্বরে বললেন, ‘রাজমাতা…!’
কাঞ্চনা কঠিনস্বরে বললেন, ‘ওই নামে আমাকে সম্বোধন করবেন না আর্য মৎস্যেন্দ্রনাথ। এই সম্মান আমি বহুপূর্বেই হারিয়েছি৷ তাকে আর ফিরে পেতে চাই না।’
মৎস্যেন্দ্রনাথ করজোড়ে বললেন, ‘সন্তানের জন্য মাতার আদেশ শিরোধার্য। কিন্তু এক্ষেত্রে আপনার আজ্ঞাপালনে আমরা অপারগ মাতা। আমাদের কাছে মহারাজ ধর্মচন্দ্র এবং কুমার আনন্দচন্দ্রই বঙ্গদেশের সিংহাসনের বৈধ উত্তরাধিকারী। এই কামোন্মাদ নাগিনীর শাসন আমরা মানি না। আপনিই আমাদের রাজমাতা।’
বৃদ্ধার চিবুক কঠিন হল। তিনি বললেন, ‘আমার স্বামী আর সন্তান মৃত। ন্যায্যত আমি রাজমাতা অভিধার উপযুক্ত নই। তবুও আমি এই নিয়ে তর্ক করব না, কারণ এই সঙ্কটকাল তর্কাতিপাতে কালক্ষেপের জন্য নয়। বলুন, আপনাদের কী সাহায্য করতে পারি।’
বপ্যট বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘মা, আপনার শুভাশিস আর আশীর্বাদ ব্যতীত আর কিছুই চাই না আমাদের।’
এই প্রথম কাঞ্চনাদেবীর অধরে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। তিনি বললেন, ‘আর্য, জানি আপনি মহাবীর, খণ্ডিতারাতি বপ্যট। কিন্তু বিস্মরণ হবেন না, আমি একজন প্রাক্তন মহারানি। কূটনীতিতে আমার অধিকার আপনার থেকে কিঞ্চিৎ অধিক। এক স্বামীহারা, সন্তানহারা মায়ের আশীর্বাদ আপনাদের সঙ্গে সর্বদাই রয়েছে। কিন্তু মহাবল পদ্মসম্ভবের মতো একজন অদ্ভুতকর্মা মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওই নরক থেকে আমাকে উদ্ধার করে এনেছেন শুধু আশীর্বাদের জন্য, এই কথা বিশ্বাস করতে বলেন?’
বপ্যট অপ্রতিভ হলেন। তিনি কূটনীতিক ভাষাপটুত্বে অভ্যস্ত নন। বুঝলেন যে, এই বৃদ্ধা অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এবং স্পষ্টবক্তা। তিনি আর অযথা বাগাড়ম্বরের মধ্যে গেলেন না। সরাসরি প্রসঙ্গে এলেন। বললেন, ‘রাজমাতা, আপনি জানেন যে শতবর্ষব্যাপী মাৎস্যন্যায় এই দেশের ভাগ্যে কী অভাবনীয় দুর্ভোগ এনে দিয়েছে। তার ওপর প্রকাশচন্দ্র আর এই নাগিনীর কুশাসনে বঙ্গদেশের শ্বাসবায়ু ওষ্ঠাগতপ্রায়।
‘অনেকদিন ধরেই সমাজের সর্বস্তরে এই অপশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছিল। শুধুমাত্র উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে সেই বিক্ষোভ কোনও পরিণতিসূচক রূপ নিতে পারছিল না। অবশেষে লোকেশ্বর মৎস্যেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে আমরা বিদ্রোহী হয়েছি। এই বিদ্রোহের বিশদ পরিকল্পনা তথা ঘটনাপ্রবাহ বিবৃত করে ধৈর্যচ্যুতি ঘটাব না। শুধু এইমাত্র জেনে রাখুন যে, আমরা চূড়ান্ত সংঘাতের জন্য প্রস্তুত। কেবল একটিমাত্র তথ্য আমাদের অজানা মাতা। সে জন্যই আপনার দ্বারস্থ হওয়া।’
রাজমাতা কাঞ্চনাদেবী। স্থিরস্বরে বললেন, ‘শুধুমাত্র একটি তথ্যের জন্য এত প্রাণপাত? বলুন আর্য, কী সেই অতি মূল্যবান তথ্য, যার জন্য আপনারা এত ঝুঁকি নিয়ে আমাকে উদ্ধার করে এনেছেন।’
বৃদ্ধার বক্তব্যের মধ্যে কিছু তিক্ততা ছিল৷ সেটি অগ্রাহ্য করলেন বপ্যট। বললেন, ‘মাতা, এই বিদ্রোহ তখনই সার্থক হবে, যখন আমরা এই নারকীযজ্ঞের দুই হোতা, বঙ্গরাজ্ঞী এবং তাঁর ভৈরব প্রকাশচন্দ্র, এই দুজনকে হত্যা করতে পারব। তবেই উৎখাত হবে এই কুৎসিত কুশাসন।
‘কিন্তু মহারানিকে হত্যা করা অত সহজ নয়। তিনি শুধু একজন বিষকন্যা নন, অলৌকিক শক্তির অধিকারিণী এক বিশিষ্ট নাগিনী। প্রকাশচন্দ্রও একজন পিশাচসিদ্ধ, চীনাচারতন্ত্রে মহারথ ঐন্দ্রজালিক। এই দুজনের স্বরূপ আপনার থেকে উত্তম আর কেউ জানে না। তদুপরি এঁদের সদাসর্বদাই ঘিরে থাকে শিক্ষিত প্রহরীর দল, ছ’জন উচ্চপদস্থ রাজপদোপজীবি এবং সর্বোপরি প্রকাশচন্দ্রের নিজস্ব অলৌকিক অতিপ্রাকৃত সিদ্ধি। সেই প্রহরাবৃত্ত ভেদ করা প্রায় অসম্ভব।
‘তবুও, সেই প্রহরাবৃত্ত ভেদ করার পরেও, যদিবা আমাদের ঘাতক সেই নাগিনী বা প্রকাশচন্দ্র অবধি পৌঁছে যায়ও, তবুও তাঁদের বধ করার কোনও নির্দিষ্ট উপায় আছে কি না সে বিষয়ে আমরা নিঃসন্দেহ হতে চাই। তাই আপনার শরণাপন্ন হওয়া। আপনি ছাড়া এই নারীকে উত্তমরূপে চেনেন এমন কেউ আমাদের মধ্যে নেই।’
তিক্ত হাসলেন কাঞ্চনাদেবী, ‘উত্তমরূপে চেনা? তাই বটে। সপত্নীকে উত্তমরূপে অন্য কেই বা চেনে।
‘শুনুন আর্য৷ এই নারীর স্বরূপ আপনাদের কাছে ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই উন্মোচিত। আশা করি জানেন যে, এঁর শিরায় বইছে প্রাচীন নাগজাতির রক্তধারা। এও জানেন যে, এই নারীর মা ছিলেন মহাচীনের সম্রাজ্ঞী। শুধু তৎকালীন মহাচীনের কেন, এই সসাগরা ধরিত্রীর শ্রেষ্ঠতম বিষবৈদ্য ছিলেন তিনি। তার সঙ্গে তন্ত্রশাস্ত্রে মহাসিদ্ধা ছিলেন তিনি, ডাকিনীবিদ্যায় অলৌকিক বিভূতি আয়ত্ত করেছিলেন।
‘তিনি তাঁর কন্যাকে নাগজাতির শতসহস্র বছরের অধীত বিদ্যা দিয়ে তিলে তিলে প্রস্তুত করেছেন। নিজের অধীত যাবতীয় বিদ্যা এবং প্রকরণ উজাড় করে দিয়েছেন নিজের কন্যার মধ্যে।
শুনুন আর্য মৎস্যেন্দ্রনাথ, এই নারীর হত্যার পরিকল্পনা প্রায় অসম্ভব। কারণ দেহাকৃতিতে মানুষী হলেও ইনি প্রকৃতপক্ষে একটি পিশাচী নাগিনী। এঁর প্রাণ নেই, তাই ইনি চিরজীবী, চিরযৌবনা। এঁর শরীরে মানুষী রক্তমাংস নেই, তাই কোনও সাধারণ অস্ত্রাঘাতে একে বধ করা যায় না। এঁর প্রাণবীজ এক প্রাচীন নাগমন্ত্রে নির্মিত।
‘আরও জেনে রাখুন আর্য, এই সমস্ত ষড়যন্ত্রের মুখ্য আয়ুধ ওই কামুক নাগিনী হতে পারে বটে, কিন্তু মূল চক্রী প্রকাশচন্দ্রই৷ তাঁকে হত্যা করলে তবেই মুক্তি। প্রকাশচন্দ্রই ধনুক, রানি জ্যা’তে আরোপিত তীর। প্রকাশচন্দ্রই যন্ত্রী, রানি যন্ত্র৷
‘প্রকাশচন্দ্র নিজে জন্মসূত্রে আশ্চর্য আধিভৌতিক শক্তির অধিকারী। চৈনিক তন্ত্রসাধনায় তাঁর সেই শক্তি বহুগুণ বর্ধিত হয়েছে। তাঁর সঙ্গে মিলিত হয়ে সেই চীনসম্রাজ্ঞী তাঁর কন্যাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য একটি অসামান্য সাধন সম্ভব করেছিলেন।’
এতক্ষণ দুজনে একাগ্রচিত্তে শুনছিলেন। কাঞ্চনাদেবী থামতে প্রশ্ন করলেন, ‘কী সেই সাধন, রাজমাতা?’
অন্ধকার ঘরে যেন দৈববাণীর মতো শোনাল সেই বৃদ্ধার গম্ভীর কণ্ঠস্বর, ‘প্রকাশচন্দ্র তাঁর জীবনীশক্তির একটি অংশ বঙ্গরনির পৈশাচীবীজে সন্নিবেশিত করে রেখেছেন। তাঁকে হত্যা করতে গেলে আগে রানিকে হত্যা করতে হবে। যতক্ষণ ওই নাগিনী জীবিত আছে, ততক্ষণ প্রকাশচন্দ্রের মৃত্যু নেই।’
স্তম্ভিত হয়ে রইলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ এবং বপ্যট। এ তো অসম্ভব! এই অসম্ভবের জন্যই জীবনের সবকিছু ছেড়ে এই মহাবিপ্লবে যোগদান করেছেন তাঁরা? আর শুধু তাঁরা কেন, আচার্য শান্তরক্ষিত, কুমার পদ্মসম্ভব, কুমার জয়াপীড়, ভিক্ষুণী মন্দর্ভা, আরও কত না শৈব সন্ন্যাসী এবং সহজিয়া বৌদ্ধদের দল, গৌড়েশ্বর জয়ন্ত, মুখ্য সামন্তচক্র, কতশত সঙ্গী, সাথী, সহযোদ্ধা—এঁদের এতদিনের তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নসৌধ এক নিমেষে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে?
কাঞ্চনাদেবী দুজনের মুখের দিকে তাকালেন। বললেন, ‘নিরাশ হবেন না আর্য। কোনও মানুষী কৌশলই কখনও অভেদ্য, অপরাজেয় হতে পারে না। যুদ্ধে যে পক্ষ ধর্মের পথে থাকে, ঈশ্বর স্বয়ং তাদের সহায় হন।
‘এবার যে কথা বলব, মন দিয়ে শুনবেন। এই গূঢ় তথ্য অতি গোপন, কেবলমাত্র প্রকাশচন্দ্র আর ওই নারীই জানে। আর জানতেন মহারাজ ধর্মচন্দ্র। কোনও এক দুর্বল অসতর্ক মুহূর্তে আমার স্বামীকে জানিয়ে ফেলেছিল ওই নাগিনী। তার পর তাঁর জীবনসংশয় ঘটে। আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা নেই জেনে সেই অতি গোপন, অতি গূঢ় তথ্য তিনি আমাকে জানিয়ে গিয়েছিলেন।
‘পক্ষকাল ধরে এই পিশাচীর বিষগ্রন্থিতে মহাকালকূট বিষ জমা হতে থাকে। পক্ষকালের অন্তে সেই বিষের নিষ্কাশন না হলে ইনি সেই বিষের আবেশে উন্মাদপ্রায় হয়ে যান। আর তখনই এঁর কামতৃষ্ণা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয়।
‘সেই জন্যই প্রতি পক্ষকালে একটি সমর্থ যুবকের প্রয়োজন হয় এই নারীর। নিজের কামতৃপ্তির জন্যও বটে, নিজের মহাবিষ উদগীরণের জন্যও বটে৷ আর যখন কোনও যুবকশরীর জোটে না, তখন?
তখন প্রকাশচন্দ্রই আসেন সেই নাগিনীর ভয়াল ভয়ঙ্কর কামাবেগ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। তিনি, একমাত্র তিনিই পারেন ওই কামোন্মত্ত বিষধর নাগকন্যাকে শান্ত করতে, সেই মহাবিষ ধারণ করতে।
এই নারীর বিষগ্রন্থিটির একটি বৈশিষ্ট্য আছে৷ এর মধ্যে দংশনযোগ্য বিষ প্রস্তুত হতে ঠিক এক পক্ষকাল সময় প্রয়োজন। তার পূর্বে এই বিষের মারণক্ষমতা প্রায় শূন্য৷ অর্থাৎ একবার যদি সেই নাগিনীর দংশন ব্যর্থ করে দেওয়া যায়, তবে অন্তত এক পক্ষকাল এঁর সঙ্গে অন্য সাধারণ নারীর কোনও প্রভেদ নেই।
তবে ওই দংশনের কাল এড়ানো বড় কঠিন, প্রায় অসম্ভব। আর সেই দংশনে যা বিষ, দশটি পূর্ণবয়স্ক হাতিকে মুহূর্তের মধ্যে হত্যা করার পক্ষে যথেষ্ট।’
চুপ করলেন কাঞ্চনাদেবী। মৎস্যেন্দ্রনাথ প্রশ্ন করলেন, ‘কিন্তু দেবী, এখানেই তো শেষ নয়। আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য প্রকাশচন্দ্রের সঙ্গে ওই পিশাচীমূর্তিরও সামূহিক বিনাশ। তার যদি কোনও মানুষী শরীর না থাকে, তবে তাকে হত্যা করব কী করে?’
ধীরে ধীরে মাথা ওপর নীচে করলেন কাঞ্চনাদেবী, ‘আছে আর্য, আছে। এই নারীকে হত্যার একটি, কেবলমাত্র একটিই উপায় আছে। যে নাগপিশাচীর আত্মা ওই শরীর অধিকার করে আছে, তা অধিষ্ঠান করে রানির কপালে, ভ্রুমধ্যে। ঠিক সেইখানে অগ্নিবাণ বিদ্ধ করতে হবে। ওটিই একমাত্র উপায়। অগ্নিদাহন ব্যতীত ওই পিশাচীর মৃত্যু নেই।’
কিছুক্ষণ স্তব্ধ রইলেন তিনজন। তারপর মৎস্যেন্দ্রনাথ বললেন, ‘দেবী, ঈশ্বরেচ্ছায় এই নাগিনীকে নিশ্চিহ্ন করার দুটি উপায়ই আপাতত আমাদের করায়ত্ত। আশীর্বাদ করুন, চূড়ান্ত সংগ্রামে যেন বিজয়ী হই।’
.
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন