অভীক সরকার
কর্মান্তবাসকের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র নগরের প্রাণস্বরূপ। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বণিকদল এবং ক্রেতাদের সমাগমে প্রতিদিনই লোকারণ্য হয়ে থাকে। পশ্চিমের বজ্রভূমি থেকে হীরকব্যবসায়ীরা আসেন। কজঙ্গলের খনিতে এক বিশেষ ধরণের খনিজ রৌপ্য পাওয়া যায়, তার রং অগুরুপুষ্পের মতো, নাম গৌড়িক। তার সম্ভার নিয়ে আসেন রাঢ়ের বণিকদল। কামরূপ এবং প্রাগজ্যোতিষপুরের বণিকেরা নিয়ে আসেন কাঞ্চনবর্ণের দুকূল এবং কাষায় বস্ত্র। কাশী এবং মধুরা থেকে আসে অতি উত্তম কার্পাসবস্ত্র, যদিও তার সূক্ষ্মতা বঙ্গদেশের কার্পাস বা রেশমবস্ত্রের তুলনায় নিকৃষ্ট।
এছাড়াও ভোটদেশ থেকে আসে অত্যুত্তম পিপ্পলী। এই পিপ্পলীর বড় সুনাম, বঙ্গ হতে সেই পিপ্পলী যায় সুদূর পূর্বে—রোমক দেশ অবধি। দণ্ডভুক্তি এবং অঙ্গদেশ থেকে আসে বিশেষ প্রণালীতে প্রস্তুত দ্বিমুখী তরবারি। গত বেশ কয়েকবছর ধরে আরবদেশে এই তরবারির চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী। হরিকেলের সমুদ্র বন্দর থেকে আসে মালয় দেশের উত্তম মুক্তা এবং সামুদ্রিক লবণ। আর সমুদ্র বন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করে গুবাক এবং অগুরু। হরিকেল এবং তাম্রলিপ্তির ব্যবসায়ীদের সমুদ্রবাণিজ্যে বিশেষ খ্যাতি আছে। যদিও অতীতের সেই গৌরব এখন অনেক অস্তমিত, তবুও নেই নেই করেও যা আছে, তা কম নয়।
এই সদাব্যস্ত এবং অতিবৃহৎ পণ্যকেন্দ্রটি গড়ে উঠেছে এক বৃহৎ মন্দিরকে ঘিরে। মন্দিরের উপাস্য দেবী বজ্রযোগিনী। তিনি দেব হেরুকের সঙ্গে যুগনদ্ধ মূর্তিতে অধিষ্ঠিতা।
মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ভন্তে বুদ্ধগুপ্ত। সাধনায় ও শীলে তাঁর তুল্য বৌদ্ধাচার্য্য সমগ্র কর্মান্তবাসকে বিরল।
কর্মান্তবাসকের উপান্তে লালিম্ববন পাহাড়। পাহাড়ের সানুদেশে অবস্থিত বিখ্যাত বৌদ্ধশাস্ত্রচর্চা কেন্দ্র শালিবন বিহার। সমগ্র বঙ্গদেশে বজ্রযানশিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে শালিবনবিহারের বড়ই সুনাম। বুদ্ধগুপ্ত এই শালিবনবিহারের উপাধিবারিক৷
বজ্রযোগিনীপূজায় ও মন্দিরের অপরাপর কর্মকাণ্ডে আচার্য বুদ্ধগুপ্তকে সাহায্য করেন আরও চারজন শ্রমণ। এঁরা প্রত্যেকেই যুবক, শালিবনবিহারের ছাত্র এবং বুদ্ধগুপ্ত’র শিষ্যও বটে। তবে ভন্তে বুদ্ধগুপ্ত গৈরিক কাষায় ধারণ করেন, এঁরা পরেন শুভ্রবস্ত্র।
আজ কার্তিকী চতুর্দশী, মহাপুণ্য দিন। কাল কার্তিকী অমাবস্যা, দেবী বজ্রযোগিনীর উপাসনার প্রকৃষ্টতম তিথি। এই তিথিতেই নাকি দেবী বজ্রযোগিনী নিজহস্তে নিজের মস্তক ছেদন করে দেবী ছিন্নমুণ্ডা হয়েছিলেন। সেই উপলক্ষ্যে এই বিস্তীর্ণ গৌড়বঙ্গের শতসহস্র বজ্রযোগীরা উপস্থিত হয়েছেন কর্মান্তবাসকে। তাঁদের উলঙ্গ ও ভস্মাচ্ছাদিত দেহের বাহারে, ‘জ্জয়জ্জয়বজ্রযোগিনী’ হুঙ্কারে, খর্পর ও খট্বাঙ্গের আস্ফালনে, কণ্ঠে প্রলম্বিত নরকরোটিমালার বীভৎস প্রদর্শনে সমগ্র কর্মান্তবাসক উচ্চকিত।
প্রথা অনুসারে কাল ব্রাহ্মমুহূর্তে মেঘান্দনদীতে মহাস্নান হবে। তখন এই খর্পরখট্বাঙ্গধারী মহাবজ্রযোগীদের সঙ্গে অগণিত পুণ্যার্থীও নদীতে অবগাহন করে নিজের অন্তরাত্মাকে পরিশুদ্ধ করবেন। তারপর দিনভর নগরীতে উৎসব। ভোর হতে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত ভক্তের দল কাঁসা অথবা রূপোর থালায় নানা অর্ঘ্য-উপাচার সাজিয়ে আসবেন দেবী বজ্রযোগিনীর মন্দিরে। কামনা করবেন অবিরল ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষসুখের। এই পূজার্চনা চলবে দ্বিপ্রহর অবধি। অতঃপর স্বয়ং রানি এবং প্রকাশচন্দ্র মন্দিরে আসবেন সপারিষদ। তাঁদের উপস্থিতিতে মন্দিরসম্মুখে একশো আটখানি মহিষ বলি হবে। দেবী বজ্রযোগিনী সেই বলির রক্তে তৃপ্ত হয়ে অক্ষয় রাজশৌর্যের টীকা পরিয়ে দেবেন এই বঙ্গদেশের রানি এবং তাঁর একান্ত সহায়ক প্রকাশচন্দ্রের ললাটে।
এখন অপরাহ্নবেলা। বাণিজ্যকেন্দ্র আপাতত কিঞ্চিৎ জনহীন। ভিনদেশীয় বণিকেরা তাঁদের পান্থশালায় বিশ্রাম নিতে ফিরে গেছেন। দেশীয় বাণিজ্যরথীরা সুখীগৃহকোণে ফিরে এসেছেন। বিপণিগুলি শূন্য পড়ে রয়েছে।
একজন মলিনবেশ যুবক অতি দীনহীন ভাবে মন্দিরের মধ্যে এককোণে সসঙ্কোচে দাঁড়িয়ে চারিদিক তাকিয়ে দেখছিল।
দেবী বজ্রযোগিনীর সমগ্র মন্দিরটি এখন ধৌত এবং পরিষ্কৃত। মন্দিরের প্রাচীর ঘিরে সারিবদ্ধ সুসজ্জিত বংশদণ্ড। বংশদণ্ডগুলির মাথায় রঙিন বস্ত্রের দিকমালা ও কিঙ্কিণীমালা; তারা মৃদুমন্দ হাওয়ায় উড়ন্ত। কিঙ্কিণীমালায় ছোট ছোট ঘুঙুর লাগানো। বাতাস বইলেই সেখান হতে টুংটাং শব্দ আসছে। এছাড়াও মন্দিরের মধ্যে গর্ভগৃহ ঘিরে বিভিন্ন রঙিন কাপাসবস্ত্রের ধ্বজপতাকা উড়ছে। সেগুলি বেশ বাহারি, চারিপাশে ঝালর দেওয়া, মধ্যভাগে রেশমি সুতোর কারুকাজ।
মন্দিরপ্রাঙ্গণের ঠিক মধ্যস্থানে, গর্ভগৃহের সামনে একটি মাটির তৈরি ধর্মস্তূপ। তার উপর একটি বৃহৎ চন্দ্রাতপছত্র। ছত্রটির সারা গায়ে অভ্রের অপরূপ কারুকার্য, স্তূপ ঘিরে মাটিতে প্রচুর ছোট ছোট কাঠের মূর্তি রাখা। সেসব মূর্তির কিছু বিভিন্ন পশুপাখির, কিছু বিভিন্ন যাত্রীশকটের, কিছু বিভিন্ন আকার ও প্রকারের নৌকার। বঙ্গজন বড়ই নদী, নৌকা এবং নৌবাণিজ্যপ্রিয় জাতি। এ সব তারই চিহ্ন।
মন্দিরের প্রধান দ্বারের দুপাশে দু’খানি তাম্রকলস রাখা। কলসের ওপর আম্রশাখ, তার ওপর ডাব। কলসে, আম্রপত্রে এবং ডাবে চন্দন এবং কাঁচা হলুদ দিয়ে মঙ্গলচিহ্ন অঙ্কিত। কলসে ধর্ম, আম্রপল্লবে সঙ্ঘ এবং ডাবে বুদ্ধ চিহ্নিত হন।
মঙ্গলকলসের সামনে দুখানি মস্তবড় দীপবৃক্ষ৷ পিত্তলের প্রতি দীপবৃক্ষে একশো আটটি করে দীপদান, প্রতিটি দীপদান সর্ষের তেলে পরিপূর্ণ, তার মধ্যে কাপাসের শিখা। আজ সন্ধ্যা হতে দু’দিন ব্যাপী এই দীপবৃক্ষের প্রতিটি প্রদীপ জ্বালানো থাকবে। কাল ব্রাহ্মমুহূর্ত থেকে দেবী বজ্রযোগিনীর মন্দিরে উৎসব। সমগ্র প্রাঙ্গণ দীপের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
যুবকটি যে কতক্ষণ ধরে এই অপরূপ মন্দিরসজ্জা নিরীক্ষণ করত, সে বলা কঠিন। সূর্য অস্তাচলগামী। সেই আলোয় মন্দির যেন ব্রীড়াবনতা নববধূর মতো লজ্জারুণ। যুবকটি তদগতচিত্তে এই সৌন্দর্যসুধা পান করছিল।
পিঠে একটি স্পর্শ পেয়ে ত্বরিতে ঘুরে দাঁড়াল সে। দেখল, একজন ভন্তে। তাঁর হাতে একটি ছোট থালা, তাতে কিছু ফল সাজানো। সামান্য নীচুস্বরে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কে, পথিক?’
পথিক বিনম্রস্বরে বলল, ‘আমি এক অতি দরিদ্র সামান্য গৌড়বাসী, ভন্তে।’
‘এখানে কী চাই?’
পথিক আবৃত্তি করল, ‘সোনে ভরিলী করুণা নাবী। রূপা থোই নাহিক ঠাবী।’
বৌদ্ধ আচার্য উঠে দাঁড়ালেন। ইশারায় সেই যুবককে বললেন তাঁকে অনুসরণ করতে।
.
গ্রামরক্ষীদলের প্রধান যখন থরথর কম্পিত দেহে রাজসভায় উপস্থিত হল, তখন সবে প্রভাত হয়েছে। রাজসভায় দুইখানি সিংহাসনই শূন্য৷ সভাসদেরা এখনও সবাই এসে উপস্থিত হননি। কেবল মহাসন্ধিবিগ্রহিক অগ্নিমিত্র এবং গুপ্তচরবাহিনীর প্রধান আনন্দগুপ্ত উপস্থিত।
অগ্নিমিত্র এবং আনন্দগুপ্ত দুজনের মুখমণ্ডল গম্ভীর। তাঁরা মহারানিকে অনুরোধ করে আজ বিশেষ কয়েকজন সভাসদ ছাড়া বাকিদের রাজসভায় উপস্থিতির ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করেছেন৷ সংবাদ অতি গুরুতর, এবং এর ফল যে সুদূরপ্রসারী—সে বিষয়ে তাঁরা নিঃসন্দেহ। এত সতর্কতা সেইজন্যেই।
এই রাজসভাটি প্রকৃতপক্ষে একটি পরিবর্তিত জয়স্কন্ধাবার৷ খড়্গবংশের নৃপতিদের প্রথমে কোনও স্থায়ী রাজপ্রাসাদ বা রাজসভা ছিল না৷ ভ্রাম্যমাণ জয়স্কন্ধাবার থেকে তাঁরা রাজ্যশাসন করতেন। খুব সম্ভবত তিব্বতের যে রাজবংশ এই খড়্গবংশের প্রতিষ্ঠাতা, সেই যাযাবর উপজাতীয় রাজাদের অনুকরণে এই প্রথার সূচনা৷
এই প্রথার অবসান ঘটান সম্রাট দেবখড়্গ৷ এই প্রাসাদ এবং সভার নির্মাণকার্যের সূচনা তাঁর হাতেই, আর শেষ হয় সম্রাট রাজভটের সময়। পূর্বসূরিদের ভ্রাম্যমাণ রাজসভার অনুসরণে এই জয়স্কন্ধাবারটিকে স্থায়ী সভাগৃহের রূপ দেওয়া হয়।
রক্ষীপ্রধানের মুখে স্পষ্টতই ভয় এবং আতঙ্কের ভাব। তার পিছনে তিনজন ভল্লধারী রাজসেবকসৈন্য ভাবলেশহীন মুখে দণ্ডায়মান৷
কিছু পরেই সভায় উপস্থিত হলেন মহাদণ্ডনায়ক জিতসেন এবং মহাপ্রতিহার শান্তঘোষ। দুজনে সংবাদ পাওয়ামাত্র উপস্থিত হয়েছেন, আলঙ্করিক বেশভূষা পরিধানের সময় পাননি। জিতসেন এসেই উদ্বিগ্নস্বরে বললেন, ‘কী হয়েছে আনন্দগুপ্ত? কেন হঠাৎ এই আহ্বান? আবার কি বহির্শত্রুর আক্রমণের সংবাদ? নাকি কোনও সামন্তরাজা বিদ্রোহী?’
উত্তর দিলেন অগ্নিমিত্র। শীতল এবং সামান্য সানুনাসিক স্বরে বললেন, ‘তার থেকেও ভয়াবহ কিছু ঘটতে চলেছে ভ্রাতা জিতসেন। মহারানি আর রাজসচিব আসুন। সব বিস্তারিত বলছি।’
শান্তঘোষ সার্থকনামা। তাঁকে কেউ বিচলিত বা ক্রুদ্ধ হতে দেখেনি। তিনি বললেন, ‘আচার্যদেব কোথায়? আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী?’
বলতে-বলতেই রাজপরিবারের কুলগুরু আচার্য বিশুদ্ধকীর্তি এবং প্রধানমন্ত্রী অমিতাভভট্ট প্রবেশ করলেন সভামধ্যে। উপস্থিত চারজন আভূমি নত হয়ে প্রণাম করলেন কুলগুরুকে। তারপর সামান্য মাথা নত করে প্রধানমন্ত্রীকে অভিবাদন জানালেন। বিশুদ্ধকীর্তি স্বস্তিবাচন উচ্চারণ করে বললেন, ‘কী হয়েছে অগ্নিমিত্র? এই অতর্কিত ঝটিকাসভা আহ্বানের কারণ? আর এই কাপুরুষ গ্রামরক্ষকটিকেই বা এখানে আনা হয়েছে কী করতে?’
ছয় জন মহাপ্রতাপশালী রাজন্য নিজ নিজ আসন গ্রহণ করলেন। রক্ষীবাহিনীর প্রধানটি ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। তার হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল।
আনন্দগুপ্ত বলতে লাগলেন, ‘আপনারা জানেন যে আজকের রাত্রি শেষে কাল থেকে কর্মান্তবাসকে বাৎসরিক মহোৎসব শুরু। সেই মহোৎসবে অংশ নিতে নানা দেশ থেকে অনেক পুণ্যার্থীরা এসেছেন। এসেছেন অনেকানেক পূজ্যপাদ বজ্রযোগীরা। কাল মহাস্নানের অব্যবহিত পরে দেবী বজ্রযোগিনীর মহাপূজা শুরু।
‘প্রতিবারের মতো এইবারেও আমরা কাল রাত্রে মেঘান্দ নদীতীরের মহাশ্মশানে ভৈরবীচক্রের আয়োজন করেছি। আমরা ছয় জন এবং মহারাজসচিব প্রকাশচন্দ্র সেই ভৈরবীচক্রে উপস্থিত থাকবেন। চক্রানুষ্ঠানের জন্য যা যা প্রয়োজন সেসবের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ মদ্যের মধ্যে উত্তম গৌড়ী, পৈষ্টী এবং মাধ্বী থাকছে। থাকছে ভর্জিত শাল, পাঠীন এবং রোহিত মৎস্যের স্তূপ। তার সঙ্গে যাতে বরাহ, শল্যক, মৃগ ইত্যাদি পশুমাংসের অভাব না-হয়, সে দিকেও দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।
‘প্রতিবারের ন্যায় হিরণ্যসামুদায়িক বিশাখসেন এই সমস্ত অনুষ্ঠানের ভার নিয়েছেন। এইবারের ভৈরবীচক্র আয়োজিত হবে দেবী কুরুকুল্লার অর্চনার অঙ্গ হিসেবে। ইনি বড় জাগ্রত দেবী। দেবীমূর্তি সন্ধ্যার মধ্যে প্রস্তুত করে, রাত্রিতে পূজাপাঠ সমাপন করে পরদিন ব্রাহ্মমুহূর্তের পূর্বে বিসর্জন দিতে হয়।’
আচার্য বিশুদ্ধকীর্তি মাথা নাড়লেন। এই বৎসরের ভৈরবীচক্রে কুরুকুল্লা আরাধনার পরিকল্পনা তাঁরই। এত অনুপুঙ্খ বর্ণনাও মুখ্যত তাঁকে অবগত করার জন্যই।
‘এই ভৈরবীচক্র, আপনারা জানেনই, সাধনসঙ্গিনী বিনা অসম্ভব। প্রতি বৎসরই আমরা শাস্ত্রের নির্দেশে অন্ত্যজ জাতি থেকে সাধনসঙ্গিনী নির্বাচিত করে থাকি। বিশেষ করে ডোম্বিনী, রজকিনী, চণ্ডালিনী, শবরী—এই অন্ত্যজ নারীদের যদি চক্রে সাধনসঙ্গিনী রূপে বরণ করা যায়, তাহলে ফল শুভ হয়।’
সভাস্থ সবার মনেই গত ভৈরবীচক্রের স্মৃতি ভেসে উঠলো। জিতসেনের ভাগ্যে একটি উদ্ভিন্নযৌবনা ডোম্বিনী জুটেছিল। তার সেই কৃষ্ণশঙ্খসদৃশ স্তনদ্বয়, আয়ত মৃগলোচন, সেই অনাঘ্রাত যৌবন, সেই উদগ্র যৌনপ্রহার, সেই শীৎকার…
জিতসেনের পৌরুষ উত্তেজিত হয়ে উঠছিল। কোলের ওপর একটি উপাধান টেনে নিলেন তিনি।
বিশুদ্ধকীর্তির শ্মশ্রুগুম্ফশোভিত ওষ্ঠে একটি স্মিত হাসি খেলে যায়। গত ভৈরবীচক্রের মালিনীটি আপাতত তাঁর উদ্যানের শোভাবর্ধনের কার্যে নিযুক্ত। সেই থেকে ভন্তে বিশুদ্ধকীর্তির প্রতিটি রাত্রিই চক্ররাত্রি। মালিনীর বাস ছিল বারবণিতা পল্লির ভাঙা পর্ণকুটিরে। এখন তার মাটির বাড়ি, বাঁশের ছাউনি, মনোহারি সাজসজ্জা। তার কানে রূপার ঝুমকো দোলে, পায়ে নতুন মল উঠেছে। বিশুদ্ধকীর্তি তাঁর একটি আদুরে নাম দিয়েছেন, নন্দিনী।
অমিতাভভট্ট রাজনীতিজ্ঞ হলে কী হবে, প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন নাট্যকার ও কবি। সেই কারণে তিনি সংস্কৃতিমোদী মানুষের কাছে জনপ্রিয়ও বটে। কাব্য ও নাটিকা গৌড়বঙ্গের আপামর জনসাধারণের প্রাণের আরাম। বঙ্গজনবাসীর উদরে খাদ্য জুটুক না জুটুক, হৃদয়টি কাব্যরসে টইটম্বুর হওয়া চাইই চাই। অমিতাভভট্ট তার সার্থক প্রতিভূ। গত ভৈরবীচক্রে তাঁর ভাগ্যে একটি মধ্যবয়সি চণ্ডালীর প্রাপ্তিযোগ হয়েছিল। চৌষট্টি কামকলায় সেই চণ্ডালীর সিদ্ধি মহারথীতুল্য। ভাস ও ভারবি থেকে শুরু করে মহাকবি কালিদাসের নাট্যরসাস্বাদনে তার অধিকার যে কোনও ব্যাকরণতীর্থ-কাব্যচঞ্চুর তুলনায় কম কিছু নয়।
গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অমিতাভভট্ট। তাঁর অকলঙ্কিত শুভ্রপট্টবাসে এই অতি তুচ্ছ, অতি নগণ্য চারিত্রিক স্খলন দগদগে ক্ষতর মতো চিহ্নিত। তিনি কিছুতেই সেই স্মৃতি মুছে ফেলতে পারেন না।
শুধুমাত্র শান্তঘোষের মুখমণ্ডল অবিকৃত থাকে। বাকিরা শান্তঘোষের অশান্ত কামোন্মত্ততার ব্যাপারে সম্যক অবগত। প্রতিটি ভৈরবীচক্রে শান্তঘোষের একটি করে অনাঘ্রাতা এবং সদ্য রজঃস্বলা কুমারীকন্যা প্রয়োজন হয়। আচার্য বিশুদ্ধকীর্তি বলেছেন যে, বজ্রসাধনায় কুমারী-রজ-রক্ততুল্য মহাপবিত্র বস্তু আর কিছু নেই। তবে শান্তঘোষ ভৈরবীচক্র চলাকালীন কুমারী রজরক্ত ও কুমারীরক্তের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য করেন না।
আনন্দগুপ্ত পুনরায় বলতে শুরু করলেন, ‘আপনারা এও জানেন যে গত কয়েক বছর ধরে কর্মান্তবাসক তথা বঙ্গদেশে বিশুদ্ধ ধর্মচেতনার প্রভাব ক্রমেই কমে আসছে। আজকাল ভৈরবীচক্র সহ বিভিন্ন গূহ্যসাধনার জন্য প্রাপ্তব্য শক্তির সংখ্যা ক্রমেই অপ্রতুল হয়ে উঠছে। পূর্বে বঙ্গজ গৃহস্থরা যতটা সোৎসাহে বজ্রসাধনার জন্য পরিবারস্থ নারীদের উৎসর্গ করতেন, অধুনা তার অধোগতি লক্ষনীয়। আজকাল বলপ্রয়োগ ছাড়া সাধনসঙ্গিনী জোগাড় করা অসাধ্য হয়ে উঠেছে।’
‘বলপ্রয়োগের ব্যাপারে কিছু সংবাদ আমার কর্ণগোচর হয়েছে আনন্দগুপ্ত।’ বলে উঠলেন বিশুদ্ধকীর্তি, ‘তার সবই যে প্রীতিবর্ধক, তা নয়।’
‘রাজগুরু নিশ্চয়ই ভালোভাবেই জানেন যে, এই দেশের জনগণ বড়ই অবোধ এবং অর্বাচীন। কোন পথে যে তাদের আত্মিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সম্ভব, কীসে যে তাদের বোধিচিত্তের সম্যক উদ্বোধন ঘটবে, সেই বিষয়ে তারা সম্পূর্ণভাবে অজ্ঞ। নিজেদের শ্রেয় সম্পর্কে তাদের কোনও ধারণাই নেই।
‘কিন্তু রোগী যদি তার নিজের রোগের উপশম না চায়, তাহলে তাকে বলপূর্বক তিক্ত ঔষধ সেবনে বাধ্য করার নিদান শাস্ত্রেই রয়েছে। তাই নেহাত নিরূপায় হয়েই আমাদের কিছু আপাত-অপ্রীতিকর পন্থা গ্রহণ করতে হয়েছে। শাস্ত্রের নিদান অনুসারে আমরা, বঙ্গজাতির এই সপ্ত-অভিভাবক, চক্রসাধনার জন্য শক্তিসংগ্রহ প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ বাধ্যতামূলক করেছি।’
এই পর্যন্ত বলে কিছুক্ষণ নির্বাক রইলেন আনন্দগুপ্ত। তারপর পুনরায় বলতে শুরু করলেন। ‘গতকাল সেই মহতী উদ্দেশেই কমলাঙ্ক গ্রামের সন্নিহিত অরণ্যে আমাদের সৈন্যবাহিনী সদস্যরা অভিযান চালিয়েছিল। জঙ্গলটি অতি ভয়াবহ। দুর্ধর্ষ কিরাতজাতির বাস৷ আপনারা তো জানেনই যে চক্রসাধনায়…’
‘অন্ত্যজ কিরাতরমণীদের স্থান বিশেষ শীর্ষে, তাই তো?’
সকলে সচকিত হয়ে দেখলেন, সভাস্থলে প্রবেশ করেছেন মহারাজসচিব প্রকাশচন্দ্র এবং বঙ্গদেশের একচ্ছত্রাধিপ রানি—সম্রাজ্ঞী স্বয়ং।
.
মধ্যবয়সি ভন্তে এবং সেই ভবঘুরে যুবকটি যখন মন্দিরচত্বর ছাড়িয়ে নগরের পশ্চিমপ্রান্তে প্রবেশ করলেন, তখন বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যা হয় হয়। অস্তাচলগামী সূর্যের রক্তাভ স্বর্ণকিরণে ধুইয়ে দিচ্ছে কর্মান্তবাসকের আকাশ, মাটি ও দিগন্ত৷
এখন বেশভূষা দেখে অবশ্য এই দুজনকে সন্ন্যাসী এবং ভবঘুরে বলে চেনা দুষ্কর। বৌদ্ধ আচার্যের পরনে এখন রাজকীয় পরিধান। তাঁকে দেখে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী বলে মনে হয়। তাঁর মুণ্ডিতমস্তকে একটি বহুমূল্য রেশমী উষ্ণীষ। ভবঘুরে যুবকটির সুগৌর ঊর্ধ্বাঙ্গ সূক্ষ্ম কাপাস বস্ত্রে আবৃত। নিম্নাঙ্গে একটি কচ্ছযুক্ত কাষায় অধোবদন। তার যৌবনপ্রফুল্ল মুখ হতে শ্মশ্রুগুম্ফ অন্তর্হিত। সদ্যস্নাত তৈলসিক্ত চুল থেকে চুঁইয়ে পড়ছে জলবিন্দু। আপাতনিরীহ যুবকটির চোখের মধ্যে তীক্ষ্ম ঔজ্জ্বল্য আছে।
দুজনে ক্রমে মেঘান্দ নদীতীরের একটি বিশেষ অঞ্চলে এসে উপস্থিত হলেন। সাধারণ কর্মান্তকবাসীদের এখানে বিশেষ দেখা যায় না বটে, কিন্তু বহির্দেশাগত বণিক, উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী এবং অন্যান্য ধনীব্যক্তিদের মধ্যে স্থানটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। এখানে শৌণ্ডিকালয়, বারবণিতাগৃহ-সহ নানাবিধ মনোরঞ্জনের বিবিধ উত্তেজক উপকরণ উপলব্ধ। এই অঞ্চলে ধনবান পুরুষেরা আমোদকাতর হয়ে অকাতরে ব্যয় করে থাকেন। সেই সূত্রে বঙ্গদেশের কিঞ্চিৎ বৈদেশিক স্বর্ণমুদ্রা আয় হয়।
বর্তমানে বঙ্গীয় রাজকোষে স্বর্ণের অভাব হিরণ্যসামুদায়িকদের অশেষ শিরঃপীড়ার কারণ। বস্তুতপক্ষে মহাবল শশাঙ্কের সময় হতেই বঙ্গীয় মুদ্রায় স্বর্ণের পরিমাণ ক্ষীণ হতে হতে এখন সম্পূর্ণ বিলীন। এর কারণ সমুদ্রবাণিজ্যর সর্বগ্রাসী অবক্ষয়। পূর্বে সমুদ্রবাণিজ্যপথে বঙ্গদেশে যে পরিমাণ স্বর্ণদিনার এবং রৌপ্যদ্রহ্মের আগমন ঘটত, এখন তার এক-দশমাংশও আয় হয় না। সরস্বতী তথা অন্যান্য সমুদ্রাভিমুখী নদীগুলির নাব্যতাহ্রাসের কারণে বঙ্গের বহু বন্দরনগরী এখন পরিত্যক্ত। স্বর্ণাভাবে এখন বঙ্গদেশে মুদ্রা হিসেবে প্রচলিত হয়েছে কড়ি এবং কপর্দক। কর্মান্তবাসকের রাজকোষে স্বর্ণমুদ্রার আয়ের জন্য তাই এই ব্যবস্থা।
দুজনে একটি মাটির তৈরি দ্বিতল শৌণ্ডিকালয়ে এসে উপস্থিত হলেন। তার সামনের উদ্যান বড়ই মনোহর। সেখানে নানা দেশ থেকে আনা ফুলের সমাহার। উদ্যানের সীমানা জুড়ে নিয়মিত ব্যবধানে তাল ও তমাল প্রোথিত। সামান্য দূরে মেঘান্দ নদীর ফেনিল স্রোত বহমান। মৃদুমন্দ পবন সঞ্চালনে, উদ্যানের শেফালি ও রজনীগন্ধার সুগন্ধে অপরাহ্নটি বড় মধুর হয়ে উঠেছে।
শৌণ্ডিকালয়টির সামনে এখনই মধুলোভী রসিকজন একে একে সমবেত হতে শুরু করেছেন। এক বিপুলোদর ব্যক্তি সহাস্যমুখে সমবেত ভদ্রজনদের অভ্যর্থনাকর্মে ব্যস্ত। বিশিষ্ট অভিজাতবর্গ ব্যতীত এই পানশালায় বিশেষ কেউ আসেন না। তাই শৌণ্ডিকালয়ের অধিকর্তা প্রত্যহ স্বয়ং উপস্থিত থাকেন অতিথিসম্ভাষণের জন্য। সুডৌল বক্ষিনী, শঙ্খিনী সুন্দরীরা অতিথিদের ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে।
একটু লক্ষ করলে বোঝা যায় যে, এই জনারণ্যেও এমন দু-চারজন আছে—যারা ঠিক মধুলোভী সাধারণ মানুষ নয়। তাদের শ্যেনদৃষ্টি চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বলিষ্ঠ দেহ এবং কটিদেশে কোষবদ্ধ তরবারি অন্যকিছুর ইঙ্গিত দেয়।
যুবকটি নীচু স্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘এই কি সেই ভাঁড়ুদত্তের প্রসিদ্ধ মধুশালা?’
আচার্য মাথা নাড়লেন। তারপর মৃদুস্বরে বললেন, ‘হ্যাঁ আর্য, এই-ই সেই ভাঁড়ুদত্তের প্রসিদ্ধ আসবালয়; চিরবসন্তের আসক্তিনিকেতন। ওই যে স্থূলকায় বৃদ্ধ মহিষটিকে দেখছ, তিনিই স্বয়ং ভাঁড়ুদত্ত। ভালো কথা, নগরে প্রবেশকালে দ্বারপাল যে অভিজ্ঞানটি দিয়েছেন, সেটি সঙ্গে আছে তো?’
যুবকটি কটিদেশ থেকে একটি নামাঙ্কিত চতুষ্কী বার করে আচার্যর হাতে দিলেন। আচার্য সেটি নিয়ে ভাঁড়ুদত্তের দিকে অগ্রসর হতেই ভাঁড়ুদত্তের দৃষ্টি এল এইদিকে।
তিনি অভ্যস্ত সম্ভাষণ করে বললেন, ‘আসুন আর্য, ভাঁড়ুদত্তের মদিরালয়ে আপনাদের স্বাগত।’
আচার্য ভাঁড়ুদত্তের কানে কানে কিছু বলামাত্র ভাঁড়ুদত্তের চোখমুখের ভাব বদলে গেল। আচার্যকে দ্রুত অন্যদিকে টেনে নিয়ে চারিদিক একবার দেখে নিলেন। তারপর রুদ্ধস্বরে বললেন, ‘এ কী ভন্তে, আপনি এখানে? এরকম অসময়ে? আপনি কি জানেন না এখন কী চলছে? জানেন না, রাজার আদেশে চারিদিকে গুপ্তচর এবং গুপ্তরক্ষীদল ঘুরে বেড়াচ্ছে?’
আচার্য নীচুস্বরে বললেন, ‘জানি। আজ এক বিশেষ অতিথি এসেছেন। তাঁর সঙ্গে কিছু একান্ত আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে মিত্র। তাই এখানে আসা।’
‘কিন্তু আচার্য, সে আলোচনা তো শালিবনবিহারে আপনার প্রকোষ্ঠেও হতে পারত!’
‘না, মিত্র ভাঁড়ুদত্ত। এখন অচেনা অজানা কাউকে নিয়ে বিহারের আবাসে প্রবেশ করা যায় না। ভন্তে বিশুদ্ধকীর্তির নিষেধাজ্ঞা আছে। তাছাড়া এই মুহূর্তে বিহারের কে যে শত্রুপক্ষে, আর কে যে মিত্রপক্ষে—সে বোঝা দুষ্কর। বঙ্গদেশে এখন মদিরালয়ই একমাত্র স্থান, যেখানে যে কাউকে নিয়ে নিঃসঙ্কোচে প্রবেশ করা যায়।’
দূরে দাঁড়ানো যুবকটির দিকে ইঙ্গিত করলেন ভাঁড়ুদত্ত, ‘ইনি কে আচার্য?’
চতুষ্কীটি ভাঁড়ুদত্তের হাতে তুলে দিয়ে চাপাস্বরে কিছু বললেন আচার্য বুদ্ধগুপ্ত। শোনামাত্র ভাঁড়ুদত্তের চোখদুটি বড় বড় হয়ে উঠল। তিনি ব্যগ্রভাবে বললেন, ‘আসমুদ্রহিমাচলজয়ী কাশ্মীরনরেশ ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়ের পৌত্র, গৌড়নরেশ জয়ন্তর জামাতা, বীর শ্রীবিনয়াদিত্য জয়াপীড়কে অধমের পর্ণকুটিরে স্বাগত।’ তারপর একটি সুতন্বী কিঙ্কিণীকে ডেকে বললেন, ‘মায়া, এঁরা আমার বিশেষ অতিথি, এঁদের উত্তর-পূর্বের কক্ষটিতে নিয়ে যাও।’
মদিরালয়ের উত্তর-পূর্বের ঘরটি অন্য ঘরগুলির থেকে একটু আলাদা। ঘরের ঠিক মধ্যস্থানে উপাধানযুক্ত আরামপ্রদ আসনের ব্যবস্থা। আসনের সামনে একটি কাঠের নীচু চতুর্পদী। তার ওপর তামার জলপাত্র। কক্ষটির চারটি দেওয়াল বিভিন্ন ভঙ্গিতে নৃত্যরত নরনারী মূর্তিতে শোভিত। ছাদ থেকে চারখানি দীপদান নেমে এসেছে অনেকখানি। সেখান হতে উত্থিত অগুরু এবং কর্পূরের উগ্র গন্ধে কক্ষটি পরিপূর্ণ।
যুবক এবং আচার্য সেখানে প্রবেশ করে দেখলেন, কক্ষটিতে একটিও জানালা নেই। শুধু তাই নয়, ঘরের তিনপাশে আর অন্য কোনও ঘর নেই। আসনটিও এমনভাবে অবস্থিত যে, যিনি তাতে বসবেন তাঁর মুখ সবসময়ই দরজার দিকেই থাকবে।
মায়া নামক কিঙ্করী সামান্য ঝুঁকে বললেন, ‘দ্বার বন্ধ করে দিই আর্য? আপনাদের এই কক্ষে কেউ বিব্রত করবে না৷’
আচার্য নিরাসক্তসুরে বললেন, ‘তার প্রয়োজন নেই কন্যা। দ্বার উন্মুক্তই থাকুক। কেউ যেন আপাতত আমাদের বিরক্ত না করে, সেইটি দেখবেন।’
গমনোদ্যত কিঙ্করীর নিতম্বের দিকে তাকিয়ে যুবকটি বললেন, ‘কিঙ্করীর অঙ্গসৌষ্ঠব কিন্তু বড়ই উত্তেজক, ভন্তে। লক্ষ করেছেন কি?’
বিরক্ত হলেন আচার্য, ‘না হে ভ্রাত জয়াপীড়৷ আমি সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। কামিনীকাঞ্চনে আসক্তি বাল্যেই ত্যাগ করেছি।’
মৃদু হেসে জয়াপীড় বললেন, ‘কাঞ্চনে অবশ্য আমারও তেমন আসক্তি নেই আচার্য। নইলে বিশ্বাসঘাতক জজ্জ যেদিন কাশ্মীরের সিংহাসন দখল করলেন, তারপর থেকে তো বলতে গেলে কপর্দকহীন সন্ন্যাসীই হয়ে গেছিলাম একপ্রকার। কিন্তু কামিনী? না আচার্য, ওই আসক্তিটি বোধহয় ইহজীবনে ছাড়তে পারব না। দেখুন না, বহুকষ্টে গৌড়ে এসে পৌঁছলাম; ভাবলাম—বাকি জীবনটা সন্ন্যাসীর মতো নিরাসক্তভাবে কাটিয়ে দেব। অথচ বিধাতা বিমুখ হলেন। এখন আমার অবস্থা দেখুন, একদিকে নর্তকী কমলা, আরেকদিকে রাজকন্যা কল্যাণী।’
কঠিনস্বরে আচার্য বুদ্ধগুপ্ত প্রশ্ন করলেন, ‘সেই জন্যেই কি নারী দেখলেই অসভ্যের মতো তার অঙ্গসৌষ্ঠব অবলোকন করে থাকেন আপনি?’
জয়াপীড়ের ওষ্ঠে সামান্য হাসি ফুটে উঠল, ‘কিছু মনে করবেন না আচার্য। আপনি সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হতে পারেন, কিন্তু আমি একজন গৃহী যুবক। জীবনের রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণ-স্পর্শ ইত্যাদির প্রতি আমার আসক্তি বড়ই তীব্র৷ তার মধ্যে উত্তম সুরা এবং উত্তম নারী, দুটি আমার প্রধান দুর্বলতা। তাছাড়া কে না জানে— শৌণ্ডিকালয়ের কিঙ্করী মাত্রেই সহজলভ্যা ও উন্মুক্তা।’
আচার্যর কণ্ঠ কঠিন হল, ‘ভ্রাত জয়াপীড়! নারী বিষয়ক কথা ত্যাগ করে কি আমরা আমাদের মূল আলোচনায় প্রবেশ করতে পারি?’
‘আহা, তা নয়! আমি বলতে চাইছিলাম যে কিঙ্করীটি যেমন রূপসী, তেমনই উদারহৃদয়।’
‘একবার দেখেই যে কোনও নারীর ঔদার্য বুঝে ফেলা বড়ই কৃতিত্বের কাজ ভ্রাতা, স্বীকার করছি। আপনার চরিত্রটি যে স্বর্ণমণ্ডিত সে ব্যাপারেও সম্যক অবগত হওয়া গেল। আশা করছি আমাদের অভিযান সফল হলে বঙ্গরাজসভায় উচ্চপদই পাবেন। আপাতত ওইটিই এ দেশের রাজন্যবর্গের মধ্যে স্থান পাওয়ার সর্বোৎকৃষ্ট লক্ষণ কী না।’
এই সময় মায়া নামের কিঙ্করীটি অরিষ্ট এবং মৈরেয়পূর্ণ দু’খানি কলস রেখে গেলেন। যাওয়ার সময় একটি মোহিনী কটাক্ষ করে গেলেন জয়াপীড়ের দিকে। আচার্য বিরক্ত হলেন। জয়াপীড় দ্রুত বিষয়ান্তরে গিয়ে বললেন, ‘ও সব ছাড়ুন। এখানকার সংবাদ কী? গৌড়নরেশ আদেশ দিয়েছেন—আমি যেন সর্বোতভাবে আপনাদের সাহায্য করি।’
আচার্য একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, ‘সংবাদ ভালো নয়, ভ্রাতা।’
‘সে তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু কেন?’
‘বঙ্গদেশ আজ এক অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের সম্মুখীন। চারিদিকে সর্বব্যাপী অরাজকতা। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, বঙ্গরাজ্ঞীর কঠিন শাসন৷’
‘শাসন তো কঠিন হওয়াই বাঞ্ছনীয়, আচার্য। শাসনদণ্ড কোমল ও পেলব হলে তো শাসন করাই দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে৷ শাসকবর্গের অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ জাগ্রত হয়।’
একটি পাত্র মৈরেয়পূর্ণ করতে করতে মাথা নাড়লেন আচার্য। বললেন, ‘ঠিকই বলেছেন বটে। দেশের শাসনরজ্জুটি যে একটু সবল হওয়া প্রয়োজন, সে কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু সেই রজ্জু যদি ক্রমেই ফাঁস হয়ে দেশের কণ্ঠদেশে চেপে বসে তবে তো দেশের প্রাণসংশয় উপস্থিত হয়। শাসন শুধু কঠিন হলে তো কথা ছিল না, কিন্তু সেই সঙ্গে বড় নৃশংসও যে।’
‘শাসন যদি নৃশংসই হবে, তাহলে রাজ্য অরাজক হয় কী করে? একমাত্র একজন শক্তিশালী ও সবল রাজাই তো নৃশংস শাসন চালাতে সক্ষম।’
ম্লান হাসলেন আচার্য, ‘নৃশংস হওয়ার সঙ্গে শক্তিশালী হওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই ভ্রাতা। দয়া ও করুণা সবলের লক্ষণ। নৃশংসতা ভীরু কাপুরুষের চিহ্ন। অত্যাচারী মাত্রেই জানবেন দুর্বল ও অক্ষম, সদাসর্বদা প্রাণভয়ে ভীত। আর আপনার কথা যদি মেনেও নিই, তবুও জেনে রাখুন—রাজা শক্তিশালী হওয়ার সঙ্গে রাজ্য সুশাসিত হওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। রাজা যদি চান তিনি রাজদণ্ড চালনা করবেন কেবলমাত্র ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য, তাহলে তিনি যতই সবল আর সক্ষম হোন না কেন, শাসন যতই কঠিন হোক না কেন—রাজ্য কুশাসনের গ্রাসে পড়তে বাধ্য৷’
‘হুম। একটু বিশদে জানালে ভালো হয়।’ পানপাত্র হাতে তুলে নিলেন জয়াপীড়।
‘কী আর বলব। যত দিন যাচ্ছে, ততই এই উন্মাদ রানির রাজত্ব সহ্য করা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে ভ্রাতা। শাস্ত্রে বলে রাজনিন্দা মহাপাপ। অনুমান করি রাজ্ঞীনিন্দার পাপও তার কাছাকাছিই হবে। কিন্তু এমন কামুক, উন্মার্গগামী, উন্মাদচরিত্র নারী যে দেশের সিংহাসনে আসীন, তার দুর্ভাগ্যের কথা আর কী বলব। সেই দেশের জন্য স্বয়ং ঈশ্বরের করুণাও বড় অল্প মনে হয়।’ মৈরেয়পূর্ণ পাত্রে চুমুক দিলেন আচার্য।
খুক খুক করে হাসলেন জয়াপীড়, ‘কিন্তু আচার্য, শ্বশুরমশাই যে আমাকে বলেছেন কয়েক বৎসর পূর্বে নাকি আপনারাই, এই বৌদ্ধ ধর্মগুরুরাই উঠে পড়ে লেগেছিলেন প্রকাশচন্দ্রকে বঙ্গদেশের শাসনক্ষমতায় আসীন করতে? তখন তো কত গোপন সভা, কত গোপন ষড়, কত গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা। সব বিস্মরণ হয়েছেন নাকি? নাকি এই কয়েক বৎসরেই মোহভঙ্গ হল?’
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আচার্য, ‘কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয় আর্য, আবার মিথ্যাও নয়। বলতে পারেন অর্ধসত্য। প্রকাশচন্দ্র রাজক্ষমতা অধিগত করেন সম্রাট রাজভটের তিব্বতীয় রাজ্ঞীর ভ্রাতা, রাজশ্যালক চারুদত্তকে বিভিন্ন উপায়ে বশীভূত করে। তবে আমরা, বৌদ্ধ আচার্যরা যে বিভিন্ন প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য কারণে সেই সময় প্রকাশচন্দ্রকে প্রতিপোষণা করেছি—সে কথা অস্বীকার করা অসম্ভব।’
‘তাহলে এখন এই আক্ষেপের কারণ? এই বিরুদ্ধ ষড়ের আয়োজন?’
স্তিমিতস্বরে আচার্য বললেন, ‘বড় ভুল হয়ে গেছে ভ্রাতা জয়াপীড়, বড় ভুল হয়ে গেছে। আমরা বুঝিনি যে, দেশজুড়ে অসংখ্য বিহার ও সদ্ধর্মস্তূপনির্মাণ, বৌদ্ধসংঘারামগুলিতে অপরিমিত দানধ্যান আসলে একটি মস্ত বড় কূট চাল ছিল। আমরা বুঝিনি যে, সেই কূট চালে মোহাবিষ্ট হয়ে, কত বড় সর্বনাশ ডেকে এনেছি নিজেদের। তাই তো পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে আপনাকে ডেকে আনা।’
‘সর্বনাশ বলছেন কেন?’
‘বঙ্গদেশের কোনও সংবাদই কি গৌড়ে পৌঁছয় না?’ ক্ষুণ্ণ হলেন আচার্য, ‘কী বিপুল অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে, অসীম দৈন্যের মধ্য দিয়ে, অরাজক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছে এই দেশের মানুষ, তার কোনও সন্দেশই কি আপনারা রাখেন না?’
‘কিছু কিছু কানে এসেছে আচার্য। কিন্তু পরিস্থিতি যে এতটা ভয়াবহ, কল্পনা করতে পারিনি। কিন্তু এই অবস্থা তো একদিনে হয়নি। পরিস্থিতির এত অবনতি হল কী করে?’
দীর্ঘশ্বাস প্রথমে চাপলেন আচার্য। তারপর ধীরে ধীরে সেটি ত্যাগ করে বললেন, ‘সে অনেক দীর্ঘ কাহিনি। সংক্ষেপে বলছি শুনুন।
‘সম্রাট বলভটের সিংহাসনে আরোহণের দিন রাজসভায় ঘটে যাওয়া সেই মহাআলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনার কথা তো সবই জানেন। বস্তুতপক্ষে সেইদিন থেকেই বঙ্গদেশের রাজত্বের ভার এই মহাকূট, মহাধূর্ত, মহাখল মহাসামন্ত প্রকাশচন্দ্রের হস্তগত।
‘প্রকাশচন্দ্র প্রথমেই সম্রাট রাজভটের অনুগামীদের এক এক করে নিশ্চিহ্ন করলেন। সম্রাট রাজভটের তিব্বতী মহিষী অকস্মাৎ আত্মঘাতী হলেন। প্রকাশচন্দ্রের পাপকাজের প্রধান অবলম্বন, সম্রাট রাজভটের শ্যালক চারুদত্ত একদিন উধাও হয়ে গেলেন, তাঁর কোনো সংবাদই পাওয়া গেল না।’
তারপর প্রকাশচন্দ্র উৎকোচে বশীভূত করলেন শীর্ষস্থানীয় বৌদ্ধ আচার্যদের। নিজের বশংবদ অনুগামীদের অধিষ্ঠিত করলেন সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে।
‘রাজপ্রাসাদের চারদিকে নেমে এল লৌহকঠিন যবনিকা। রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে কী হচ্ছে না-হচ্ছে সেই সংবাদ বাইরে আসা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল।
‘কিন্তু বাঙালি অত্যন্ত সংবাদ-উৎসুক জাতি। ভেসে আসতে লাগল, নানা কথা। প্রকাশচন্দ্র আর তাঁর সঙ্গীসাথীরা নাকি রাজপ্রাসাদের মধ্যে ভয়াবহ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করা শুরু করেছেন। সেইসব অদ্ভুত এবং ভয়াবহ ধর্মকৃত্যের বর্ণনা যেমন বিভীষিকাময়, তেমনই আতঙ্কজনক। তার মধ্যে নরবলি থেকে শুরু করে সর্বাঙ্গে নররক্ত লেপন করে যৌনক্রিয়া, শিশুকাম থেকে শুরু করে সদ্যরজঃস্বলা কিশোরীদের রজরক্ত নিয়ে অদ্ভুত পূজা, অম্বুবাচীর রাত্রে বিধবা নারীদের নিয়ে গণসম্ভোগ…সবকিছুই আছে।
‘শুধু কি তাই? মাঝেমধ্যেই নাকি গভীর রাত্রে নারকীয় আর্তনাদ ভেসে আসে প্রাসাদ থেকে। সেই মর্মান্তিক আর্তনাদ শুনলে বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। কেউ কেউ নাকি দেখেছে, অমাবস্যার মধ্যরাতে অশরীরী ছায়ামূর্তিরা দলে দলে নেমে আসছে রাজপ্রাসাদের ছাদে। আবার কেউ দেখেছে প্রবল ঝঞ্ঝাবাত্যার দিনে প্রকাশচন্দ্র নাকি রাজপ্রাসাদের শীর্ষদেশে দাঁড়িয়ে আকাশ থেকে বিদ্যুৎ আকর্ষণ করে নিজবক্ষে ধারণ করছেন।’
অবিশ্বাসের সুরে জয়াপীড় বললেন, ‘এসব গল্পকথা প্রকাশচন্দ্র নিজেই তাঁর অনুগত ভৃত্যদের দিয়ে রটনা করাননি তো?’
‘হতে পারে। এসবই শ্রুত, প্রত্যক্ষ নয়। কিন্তু যদি ধরেও নিই এসব রটনা, অন্তত একটি ঘটনা আমরা নিশ্চিত সত্য বলেই জানি। অবিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই।’
‘কী সেই সত্য?’
প্রৌঢ় আচার্য ক্ষণেক স্তব্ধ হয়ে রইলেন। শেষে মৈরেয় পাত্র নিঃশেষিত করে বললেন, ‘যবে থেকে এই নারী রাজপ্রাসাদে এসেছেন, প্রাসাদের অভ্যন্তরে কোনও পশু বা পাখি প্রবেশ করে না। এমনকী প্রাসাদের ওপর দিয়ে কোনও পাখি ওড়ে না। প্রাসাদের ছায়া যেখানে পড়ে, সেখানেও কোনও পশুপাখি বসে না।’
আশ্চর্য হলেন জয়াপীড়, ‘আমাদের কাশ্মীর দেশেও অনেকানেক অদ্ভুত লোকশ্রুতি শুনতে পাওয়া যায়। কিন্তু এমন বিচিত্র কথা কখনও শুনিনি আচার্য।’
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আচার্য, ‘স্বচক্ষে দেখা সত্যকে অস্বীকার করি কী করে? অভিশাপ…আর্য জয়াপীড়, অভিশাপ। এই নারীর বেশে এক নারকীয় অভিশাপ নেমে এসেছে এই বঙ্গদেশের বুকে। তাই তো আজ বড় কষ্টে, বড় দুঃখে প্রতিবেশী রাজশক্তির কাছে সাহায্যের ভিক্ষা চাইতে হচ্ছে।’
‘হুম, অবগত হলাম। কিন্তু আচার্য, কে এই নারী? ইনি বঙ্গদেশে এলেন কোথা থেকে? আর আপনারাই বা এঁকে পেলেন কোথায়?’
‘আমরা আনিনি, ভ্রাত জয়াপীড়। ইনি নিজে এসেছেন এই দেশে, ঘোর নিয়তি যেমন নেমে আসে শাপগ্রস্ত ভূমির ওপর। এঁকে রাজসান্নিধ্যে এনেছেন প্রকাশচন্দ্র। সেসব অনেক গূঢ় কথা, এখন সেসব প্রকাশের সময় নয়৷ শুধু জেনে রাখুন—ইনি প্রকাশচন্দ্রের শুধু শিষ্যা নন, স্বয়ং শক্তি, আত্মার আত্মীয়, সাধনসঙ্গিনী। প্রকাশচন্দ্র এঁকে কোথা থেকে পেলেন, বা ইনি কোন বংশের, কোন জাতির, কোন দেশের নারী—সে বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞাত।’
‘কিন্তু এই সামান্যা নারী সমগ্র বঙ্গদেশের রানি হয়ে উঠলেন কীভাবে?’
‘সে এই দীর্ঘ কাহিনির অন্য অর্ধাংশ। কিঞ্চিৎ মনযোগ দিয়ে শুনুন ভ্রাত।
‘সম্রাট হওয়ার পর কুমার বলভট বাঁচেননি বেশীদিন। বঙ্গজনের বিশ্বাস, কোনও এক জটিল বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল তাঁকে। তারপর সম্রাট বলভটের শিশুপুত্র, উদীর্ণখড়্গের যে কী হল—সে সংবাদ পাওয়াই গেল না। লোকশ্রুতি, শিশুটিকে মেঘান্দ নদীর জলে ডুবিয়ে হত্যা করেন প্রকাশচন্দ্র স্বয়ং। বলভটের পত্নী, সম্রাজ্ঞী ঊর্মিমালা শোকে দুঃখে আত্মঘাতী হলেন। কেউ কেউ আবার বলেন, তাঁকে হত্যা করা হয়।
‘রাজপুত্র উদীর্ণখড়্গের পর বঙ্গদেশের সম্রাট হন প্রকাশচন্দ্রের জ্ঞাতিভ্রাতা ধর্মচন্দ্র। তখনই এই রানির আবির্ভাব। প্রকাশচন্দ্র এঁর সঙ্গে ভ্রাতা ধর্মচন্দ্রের বিবাহ দেন। যদিও ধর্মচন্দ্রের এক গৃহিণী পূর্বেই বিদ্যমান ছিলেন।’
‘সে কী? এই যে বললেন ইনি প্রকাশচন্দ্রের…’
ম্লান হাসলেন আচার্য বুদ্ধগুপ্ত, ‘চতুরঙ্গ বোঝেন—আর্য জয়াপীড়? এই চতুরঙ্গ ক্রীড়ায় কেবলমাত্র একজনই রাজা আর একজনই রানি। প্রকাশচন্দ্র আর এই নারী। বাকি সবাই ক্রীড়নক। ধর্মচন্দ্র নামেই সম্রাট ছিলেন। রানি এবং প্রকাশচন্দ্রের অঙ্গুলিসংকেতে উঠতেন, এবং বসতেন।
‘কিন্তু ধর্মচন্দ্রের কপালে রাজভোগ বেশিদিন সহ্য হল না। একদিন হঠাৎ আমরা তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংবাদ পেলাম। রাজপ্রাসাদসূত্রে জানানো হল যে উদ্যানে ভ্রমণকালে তিনি সর্পদংশনে প্রাণত্যাগ করেন। কিন্তু…’
‘কিন্তু কী?’
‘বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারলাম যে সংবাদটি সম্পূর্ণ ভুল।’
‘কেন? আর এই বিশ্বস্ত সূত্রই কে বা কারা?’
‘ততদিনে আমরা, বৌদ্ধ আচার্যরা বুঝতে আরম্ভ করেছি যে কোন মহাপাপ বঙ্গদেশ গ্রাস করতে উদ্যত৷ আমরা ভিতরে ভিতরে সংগঠিত হচ্ছি। কয়েকজন সামন্ত ও মহাসামন্ত, যাঁরা খড়্গবংশের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন, তাঁরা গোপনে গোপনে আমাদের সহায়তা দানে প্রতিশ্রুত হয়েছেন। রাজপ্রাসাদের কিছু নিম্নস্তরের কর্মচারীকে আমরা স্বর্ণদিনারে বশীভূত করলাম। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন রাজবৈদ্য কুল্লুকভট্টর শিষ্য ও সহায়কসচিব। তাঁর মাধ্যমে যে সংবাদ পাওয়া গেল তা অত্যন্ত চমকপ্রদ।
‘জানা গেল যে, মহারাজ ধর্মচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রীর কোনও স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিল না। মহারাজ এই নারীকে কিছুটা ভয়ই পেতেন। তিনি সচরাচর তাঁর প্রথমা স্ত্রী’র কক্ষেই রাত্রিযাপন করতেন। আর যখন দ্বিতীয়া স্ত্রী’র কক্ষে রাত্রিবাসে যেতেন, তখন নিজের ইচ্ছানুসারে যেতেন না। যেতেন সেই নারীর দ্বারা আদিষ্ট হয়ে।’
‘সে কী? মহারাজ নিজ ইচ্ছায় তাঁর ধর্মপত্নীতে উপগত হতে পারতেন না?’
‘না। এই নারী মহা-স্বৈরিণী। নিজ কামাগ্নি প্রশমনের প্রয়োজন হলে তবেই ধর্মচন্দ্রকে আদেশ করতেন তাঁর কক্ষে রাত্রিবাস করতে। সেই আদেশ উপেক্ষা করার সাহস মহারাজের ছিল না। তবে এই ঘটনা তখনই ঘটত, যখন প্রকাশচন্দ্র প্রাসাদে অনুপস্থিত থাকতেন।
‘এখানে একটি সত্য রাখা প্রয়োজন। ধর্মচন্দ্রের দ্বিতীয়া স্ত্রীর কক্ষে প্রকাশচন্দ্রের অবাধ যাতায়াত ছিল ও আছে—এই সত্যটি সর্বজনবিদিত। দুজনে নাকি প্রায়শই অর্গলবদ্ধ কক্ষে রাত্রিভর কীসব গুপ্ত অনুষ্ঠান করেন। তখনও করতেন, এখনও করেন।
‘রাজপ্রাসাদের কর্মচারীরা এবিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রাখতেন। এখানে উল্লেখ করে রাখা ভালো যে সেই বিশেষ গোপন অনুষ্ঠানের সময় কারও, এমনকী স্বয়ং মহারাজেরও নিজের ধর্মপত্নীর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি ছিল না।
‘কিন্তু যেদিন মহারাজ ধর্মচন্দ্রের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়, তার ঠিক আগের রাত্রে এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছিল। সেদিন কোনও কারণে মহারাজ কিছু উত্তেজিত ছিলেন। সেইরাত্রে তিনি রাজসচিব প্রকাশচন্দ্রের ভবনে বিশেষ দূত পাঠান তাঁকে তাঁর সামনে সেই দণ্ডেই উপস্থিত হওয়ার আদেশ জানিয়ে। দূত ফিরে এসে জানায় যে রাজসচিব এখন তাঁর সাধনসঙ্গিনীর সঙ্গে বিশেষ ধর্মীয় আচারে লিপ্ত, এই মুহূর্তে তাঁর পক্ষে রাজসকাশে উপস্থিত হওয়া অসম্ভব।
‘শেষবার ধর্মচন্দ্রকে দেখা যায় উন্মুক্ত তরবারি হস্তে তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রীর শয়নকক্ষের দিকে উন্মাদের মতো ধেয়ে যেতে।’
‘হুম। পুরুষের যৌনঈর্ষার মতো অন্ধ আবেগ আর হয় না। আর সেই অন্ধ ক্রোধ যদি কোনও ক্ষমতাবান পুরুষের হয়—তবে তো কথাই নেই!’
আচার্য যেন শুনেও শুনলেন না। বলে যেতে লাগলেন, ‘পরদিন প্রভাতে মহারাজ ধর্মচন্দ্রের শয্যায় তাঁর প্রাণহীন দেহ পাওয়া যায়। তাঁর প্রথমা স্ত্রী সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তাঁর পাশেই শায়িত ছিলেন।
‘পরিচারকেরা লক্ষ করে যে, মহারাজের কণ্ঠদেশে দুটি বিষদন্তের গভীর ক্ষত। সেই ক্ষতদুটির মধ্যেকার দূরত্ব অস্বাভাবিক রকমের বড়। কোনও বিষধর সর্পের মুখব্যাদান অত বিস্তৃত হওয়া অসম্ভব। শুধু তাই নয়, ক্ষতদুটিও অস্বাভাবিক গভীর। অমন গভীর দংশন শুধু সর্প কেন, পৃথিবীর কোনও সরীসৃপ বা প্রাণীর পক্ষে সম্ভবই নয়।’
জয়াপীড় তৃতীয় পাত্র শেষ করতে গিয়েও থেমে গেলেন, ‘এর অর্থ?’
‘সেই অর্থটাই তো আমরা সবাই খুঁজছি ভ্রাত জয়াপীড়। তবে আপনার আশ্চর্য হওয়ার মতো কারণ এখনও রয়ে গেছে।’
‘কী আচার্য?’
‘ধর্মচন্দ্রের সমস্ত দেহ নাকি বিষের প্রভাবে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছিল।’
ভ্রুকুঞ্চিত হল জয়াপীড়ের, ‘তীব্র বিষপ্রয়োগে দেহ নীলবর্ণ হয় বলে শুনেছি। কৃষ্ণবর্ণ তো কখনও শুনিনি!’
‘হ্যাঁ৷ শুধু তাই নয়। শোনা যায়, মৃতদেহটি দেখে মনে হচ্ছিল যে, মহারাজ বজ্রাঘাতে দেহত্যাগ করেছেন—এতটাই ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হয়েছিল তার দেহ। রাজবৈদ্য কুল্লুকভট্ট নিজেও নাকি মৃতদেহ দেখে এমন আতঙ্কিত হয়েছিলেন যে, মৃতদেহ নিজে স্পর্শ করতে অস্বীকার করেন, অন্য কাউকেও স্পর্শ করতে নিষেধ করে দেন। শেষে ধর্মচন্দ্রের দুই বিশ্বস্ত দেহরক্ষী বাঁশের মাচায় মহারাজের মৃতদেহটি কোনওমতে তুলে নিয়ে গিয়ে মহাশ্মশানে দাহকার্য সমাধা করে। সেই সময় শ্মশানে অন্য কারও উপস্থিত থাকার অনুমতি দেননি প্রকাশচন্দ্র।’
‘কিমাশ্চর্যম! রাজার মৃতদেহের সৎকার হচ্ছে এইভাবে!’
‘শুধু তাই নয় ভ্রাত! তদ্যবধি মহারাজ ধর্মচন্দ্রের প্রথমা স্ত্রী কাঞ্চনাদেবীর কোনও সংবাদ নেই।’
‘অর্থাৎ?’ চমকিত হন জয়াপীড়।
‘এই প্রশ্নের উত্তর মাসাধিককাল পূর্বাবধি শুধু আমি কেন, আমাদের কারও কাছেই ছিল না, তবে এখন আছে। সে যাই হোক, শেষাংশ শুনুন আপাতত।
‘ধর্মচন্দ্রের পর রাজা হন তাঁর প্রথম স্ত্রীর পুত্র, সদ্যযুবা আনন্দচন্দ্র। অবস্থাটি অনুধাবন করুন একবার। মহারাজ ধর্মচন্দ্রের মৃত্যুরহস্য নিয়ে প্রাসাদের অভ্যন্তরে উথালপাথাল চলছে। আনন্দচন্দ্রের মাতৃদেবী উন্মাদপ্রায়৷ যদিও সেইসবের বিবরণ জনারণ্যে প্রকাশিত হচ্ছে না। বঙ্গজন এক অনভিজ্ঞ সদ্যযুবাকে রাজা বলে স্বীকার করে নেবে কী না সে নিয়েও রাজন্যবর্গ যথেষ্ট সন্দিহান।
‘এমন অনিশ্চয় অবস্থার মধ্যেই প্রকাশচন্দ্র বঙ্গরাজনীতির চতুরঙ্গ ক্রীড়াঙ্গনে তাঁর পরের দান নিক্ষেপ করলেন। তিনি ধর্মচন্দ্রের দ্বিতীয় স্ত্রী তথা নিজের সাধনসঙ্গিনীর সঙ্গে আনন্দচন্দ্রের বিবাহ দিলেন।’
‘সে কী!’ ঘৃণায় চোখমুখ বিকৃত করলেন জয়াপীড়, ‘ছিঃ ছিঃ ছিঃ। এই অজাচার আপনারা সহ্য করলেন কী ভাবে? এদেশ থেকে কি সদ্ধর্মের শেষ চিহ্নটুকুও লুপ্ত হয়েছে? বিমাতার সঙ্গে সন্তানের বিবাহ!’
ম্লান হাসলেন বৌদ্ধাচার্য, ‘আগেই বলেছিলাম ভ্রাতা, ভঙ্গ বঙ্গদেশের এই চতুরঙ্গ ক্রীড়ায় কেবলমাত্র একজনই রাজা আর একজনই রানি, বাকি সবাই ক্রীড়নক।’
জয়াপীড়ের চক্ষু ক্রমেই আরক্ত হয়ে উঠছিল৷ তিনি স্খলিতস্বরে বললেন, ‘তারপর? আনন্দচন্দ্রের কী হল?’
‘ছয়টি মাস। মাত্র ছয়টিমাস বেঁচে ছিল সেই কিশোর। তারপরেই একদিন তার মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয় তার ধর্মমহিষীর কক্ষদ্বারের ঠিক বাইরে। কণ্ঠে সেই একই বিষদন্ত লক্ষণ। মৃতদেহ সেই একইভাবে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ৷ একই ভাবে মার্জার-সারমেয়বৎ দাহসংস্কার।’
উত্তেজিত জয়াপীড় সম্মুখস্থ চতুর্পদীটির ওপর সজোরে মুষ্ট্যাঘাত করে বললেন, ‘অসম্ভব ভন্তে, এ অসম্ভব।’
‘সেই অসম্ভবই সম্ভব হয়েছে ভ্রাতা।’
‘কে এই নারী, ভন্তে? এত ক্ষমতা ইনি পেলেন কোথা থেকে?’
‘কে এই নারী—সে সংবাদ ধীরে ধীরে আমাদের সামনে উন্মোচিত হচ্ছে ভ্রাতা। এ মানুষী-নারী নয়, সাক্ষাৎ কালপিশাচী। প্রকাশচন্দ্র তাঁর নারকী সাধনার বিন্দু বিন্দু দিয়ে এই মহা অনিষ্টকারী রমণী সৃষ্টি করেছেন। প্রকাশচন্দ্র যেমন চিরযুবক, ইনিও তেমনই চিরযৌবনা। প্রকাশচন্দ্রের মতো ইনিও অদ্ভুত এবং আশ্চর্য অতিপ্রাকৃত শক্তির অধিকারিনী। ইনি প্রকাশচন্দ্রের সর্বোত্তম আয়ুধ, ভয়ঙ্করতম খড়্গ, তীক্ষ্ণতম ভল্ল।’
‘কিন্তু এসব করে প্রকাশচন্দ্রের লাভ কী? তিনি কী চান?’
‘তিনি যে কী চান, এই প্রশ্নের উত্তর আমরাও সন্ধান করে ফিরছি৷ তা না হলে এই পাপ থেকে বঙ্গভূমিকে মুক্ত করা অসম্ভব। আর শুধু প্রকাশচন্দ্র কেন, তাঁর সঙ্গে আরও ছয় জন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী রয়েছেন। মহারানি এই সপ্তরথীবেষ্টিত হয়ে দোর্দণ্ড প্রতাপে বঙ্গভূমি শাসন করছেন। সেই শাসনযন্ত্রের নিপীড়নে দেশের চারিদিকে এখন ত্রাহি ত্রাহি আর্তনাদ।’
‘আমাকে কী করতে আদেশ করেন ভন্তে?’
জয়াপীড়ের দক্ষিণ হস্ত ধরে ফেললেন আচার্য। ‘আপনার বহুবিচিত্র কর্মকাণ্ডের কথা শুনেছি, মহাবীর জয়াপীড়। যিনি সামান্য ছুরিকাহস্তে একাকী পূর্ণবয়স্ক সিংহশিকারে সমর্থ হন, তাঁর মতো এক দুঃসাহসী এবং বীর যুবাপুরুষ আমাদের প্রয়োজন। আমরা আজ পঞ্চগৌড়েশ্বর মহারাজ জয়ন্তর জামাতা, আসমুদ্রহিমাচলজয়ী মহাবীর ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়ের পৌত্র, বিনয়াদিত্য জয়াপীড়ের কাছে সেই সাহায্য ভিক্ষা করছি।’
‘কিন্তু আমি আর আপনি—দুজনে একত্র হয়ে এই অতিবৃহৎ কর্ম সম্পাদনে সমর্থ হব?’
‘আমরা একা নই ভ্রাত জয়াপীড়। বঙ্গভূমিকে অপশাসন থেকে মুক্ত করার এই মহতী যজ্ঞে আরও অনেকে আমাদের সঙ্গী হয়েছেন।’
‘তাঁরা কে বা কারা?’
‘সহজিয়া সিদ্ধ সাধকরা। তাঁরা জনগণের নাড়ীনক্ষত্র বোঝেন। অন্ত্যজ, দলিত, নিপীড়িত জনজাতির মধ্যে তাঁদের প্রভাব অসীম। গৌড়বঙ্গের সহজিয়া সিদ্ধরা একত্র হচ্ছেন। দিকে দিকে তাঁদের আহ্বানে একত্রিত হচ্ছে বিদ্রোহী জনসাধারণ। তারা ক্ষোভে, ক্রোধে ফুঁসছে। সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায় সমাগত। আজ কালের মধ্যেই তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়বেন তাঁদের সংগঠন শক্তি নিয়ে। আর তাঁদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুই মহাবলশালী পুরুষ সিংহ।’
জয়াপীড় কিছু বললেন না। নির্নিমেষে তাকিয়ে রইলেন আচার্যর দিকে।
‘সর্ববিদ্যাবিশুদ্ধ আচার্য দয়িতবিষ্ণুর পুত্র খণ্ডিতারাতি বপ্যট এবং তপশ্চর্যায় যিনি আদিদেব মহেশ্বরের সমতুল্য, সেই মহাযোগী লোকেশ্বর মৎস্যেন্দ্রনাথ।’
স্থির দৃষ্টিতে আচার্যের দিকে ক্ষণকাল চেয়ে রইলেন জয়াপীড়। তারপর মৃদুস্বরে বললেন, ‘পিতামহ ললিতাদিত্য মুক্তাপীড় মহাবীর ছিলেন। স্বীয় বাহুবলে অর্ধেক পৃথিবী জয় করেছিলেন। তাঁর সৈন্যদলের পদভারে মেদিনী কম্পিত হতো। কিন্তু তাঁর জীবনকৃত্যে দুটি অনপনেয় কলঙ্ক ছিল।’
‘জানি জয়াপীড়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে মদ্যপ অবস্থায় অগ্নিসংযোগে প্রবরদেশ ধ্বংস করা।’
‘ঠিক।’ সম্মতি জানালেন জয়াপীড়, ‘এবং দ্বিতীয়টি বহুদিন যাবৎ আপামর বঙ্গজনের হৃদয়ের রক্তক্ষরণের কারণ৷ গৃহদেবতা পরিহাসকেশবের নামে শপথ করে তিনি ভীত ও সন্ত্রস্ত বঙ্গাধিপকে কাশ্মীরে আমন্ত্রণ করেন, এবং গুপ্তঘাতকের দ্বারা তাঁকে ত্রিগ্রামীতে হত্যা করান। এই পাপের ক্ষমা নেই আচার্য। আমার পিতামহ যে একজন ক্রূরকর্মা বিশ্বাসঘাতক, এই চিন্তা আমাকে জন্মাবধি কুরে কুরে খেয়েছে।
‘কিন্তু ঈশ্বরের কী অসীম অনুগ্রহ! আজ ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়ের পৌত্র জয়াপীড়ের সামনে সুযোগ এসেছে সেই কলঙ্ক অপনোদনের। এ আনন্দ আমি রাখি কোথায়? আমার রক্তে প্রবাহিত বিশ্বাসঘাতকতার দোষ শুদ্ধ হোক। বঙ্গজনের দুঃখ ঘুচে যাক। রামস্বামীর মন্দিরে প্রভুর সম্মানরক্ষার্থে নিহত গৌড়বীরদের আত্মা শান্তি পাক। আচার্য বুদ্ধগুপ্ত, আমি এই সংগ্রামের অংশ হতে পারলে সৌভাগ্যবান মনে করব।’
উঠে দাঁড়ালেন শালিবন বিহারের উপাধিবারিক, বজ্রযোগিনী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ভন্তে বুদ্ধগুপ্ত। তারপর স্মিত হাস্যে বললেন, ‘তাহলে এসো জয়াপীড়। তোমাকে এই যজ্ঞের ঋত্বিক এবং যজ্ঞযন্ত্রের বাকি অধ্বর্যুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।’
.
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন