পটমঞ্জরী – ৪

অভীক সরকার

৭৪৯ খ্রিস্টাব্দ৷ চম্পানগরী, মগধ৷

.

বিশেষ কিছু শারীরিক ব্যায়াম আর শ্বাসবায়ুর নিয়ন্ত্রণ রোজই অভ্যাস করেন মানুষটি৷ এ সব তাঁর গুরুরই শিক্ষা৷ নিজ প্রতিভাবলে সেসব গূঢ় সাধনা আরও তীক্ষ্ণ, আরও গভীর, আরও অন্তর্গূঢ় করেছেন তিনি৷ এখন একান্ত নির্জনে যখন সাধনপীঠে বসেন, তখন কখনও কখনও নিজের মেরুদণ্ডের মধ্য দিয়ে এক অলৌকিক দ্যুতির চলাচল বুঝতে পারেন৷ লিঙ্গমূল হতে ব্রহ্মতালু অবধি সেই অপার্থিব দ্যুতি সাপের মতো খেলে বেড়ায়৷

দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন বাতাসে সাঁতার কেটে প্রায় উড়ে যাচ্ছেন তিনি, এতই দ্রুত ছিল তাঁর হাঁটার বেগ৷ তাঁর উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলছিল আকাশে সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলীর আরও ঘন হয়ে ওঠা৷ তাঁর মন বলছিল, আবারও সর্বনাশ নেমে এসেছে বঙ্গদেশের কোনও অভাগা পল্লীর ওপরে৷

কিছুক্ষণের মধ্যে সেই গ্রামটিতে পৌঁছে গেলেন তিনি৷ কান্না আর আর্তনাদের রোল তাঁর কানে আসতেই তিনি বুঝলেন যে, তাঁর আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে৷

গ্রামের শেষে একটি ভাঙা কুটিরের আড়ালে থেকে নির্নিমেষ এক নৃশংস নরমেধযজ্ঞ দেখে যেতে থাকলেন সেই মানুষটি৷

একদল সশস্ত্র লোক তাণ্ডবনৃত্য শুরু করেছে সেই গ্রামটিতে৷ আগুন লাগাচ্ছে একের পর এক কুটীরে, বাইরে ছুঁড়ে ফেলছে দরিদ্র গ্রামবাসীর সংসারের সর্বস্ব৷ ভয়ে আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে এদিক-ওদিক পালাচ্ছে বাসিন্দারা; আর তাদের হাহাকার আর কান্নার শব্দে যেন আরও দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে আগুনের লেলিহান শিখা৷

দৈত্যাকার লোকগুলির ভাবলেশহীন মুখ আর হাতের অস্ত্র দেখে দেখেই বোঝা যায়—কোনও এক ভূস্বামীর পোষা সৈন্যদল তারা৷ গ্রামের মধ্যে একটি উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে হাসিমুখে সেই দক্ষযজ্ঞ পর্যবেক্ষণ করছেন এক বিশালাকার মানুষ৷ তাঁর পরনের দামি কাপড়ে আর অলঙ্কারে বোঝা যায় যে—ইনিই সেই ভূস্বামী৷

পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন গ্রামের বৃদ্ধ মণ্ডলপতি; মুহূর্তে তাঁর চুলের মুঠি ধরে সামন্তপ্রভুটির সামনে উপস্থিত করলো এক সৈন্য৷

‘দয়া—প্রভু, দয়া করুন৷ আপনি আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা৷ আপনি বিরূপ হলে আমরা কোথায় যাই? দয়া করুন প্রভু, আপনার দুটি পায়ে পড়ি, আমাদের আশ্রয় এভাবে কেড়ে নেবেন না৷’ বলতে বলতে চোখের জলে ভেসে যায় সেই বৃদ্ধের রুক্ষশুষ্ক বুকখানি৷

মুখ দিয়ে চুকচুক আওয়াজ করেন সেই অসুরাকৃতি পুরুষটি, ‘আহারে, বড় কষ্ট হচ্ছে তোদের তাই না রে? আমারও যে দুঃখু হচ্ছে, সে তোদের কী করে বোঝাই? বড় দুঃখ রে বুড়ো, আমার প্রাণেও বড়ই দুঃখ৷’

‘প্রভু, আপনি অন্নদাতা, মাতা-পিতার সমান৷ দরিদ্রের এত বড় সর্বনাশ করবেন না প্রভু!’

সামান্য নীচু হয়ে নিজের মুখটা সেই বৃদ্ধের মুখের কাছে নিয়ে আসেন ভূস্বামীটি। তারপর বলেন ‘আমারও কি এসব করতে ইচ্ছা করে রে দ্বিজদাস? কিন্তু না করে উপায় কী বল? কোনও উপায় কি আর তোরা রেখেছিস রে? কত মাসের কর বাকি রেখেছিস—সে কথা খেয়াল আছে?’

‘প্রভু…প্রভু…’ কান্না থামতে চায় না বৃদ্ধের৷

‘প্রভু প্রভু করে এত কান্নাকাটি করছিস তো বটে৷ কিন্তু তোরা এরকম করলে তোদের প্রভুরই বা কী করে চলবে—সেটা নিয়ে ভেবেছিস কিছু? আমার মেয়ের বিবাহদায় শিয়রে উপস্থিত, আবার ভুক্তিপতি আমার কাছে পত্র পাঠিয়েছেন বাকি থাকা সমস্ত কর দ্রুত মিটিয়ে দেওয়ার জন্যে৷ আমি কোথায় যাই বল তো দেখি?’

‘প্রভু, দরিদ্রের সব কিছু কেড়ে নেবেন না, ঈশ্বরের দোহাই৷’ উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে বৃদ্ধের গলা, ‘পথের ভিখারী করে দেবেন না প্রভু৷ সবার ঘরেই ছোট ছোট শিশুরা আছে, তারাও আমাদের মতই আধপেটা খেয়ে আছে বহুদিন৷ আপনার ঘরেও তো একটি কন্যা আছে প্রভু, তার মুখের দিকে চেয়ে…’

দড়াম! বৃদ্ধের মুখে সজোরে একটি লাথি এসে পড়ল। ওঁক শব্দ তুলে সামান্য দূরে ছিটকে পড়লেন বৃদ্ধ৷ হিসহিস করে ওঠেন সেই ভূস্বামী, ‘শোন বুড়ো, তোরা আধপেটা খেয়ে থাকবি নাকি না-খেয়ে থাকবি—সেসব দেখার প্রয়োজন বোধ করি না৷ যদি সমস্ত বকেয়া কর মিটিয়ে দিস তো ভালো৷ নইলে তোদের সবকটা জোয়ান ছেলে আর মেয়েকে প্রকাশ্য রাস্তায় উলঙ্গ করে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে নগরে নিয়ে গিয়ে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেব৷ বকেয়া কর আমার চাই৷’

ধীরে ধীরে উঠে বসেন সেই বৃদ্ধ৷ রক্তমাখা থুতু ফেলেন। তারপর মাথা তুলে তাকান ভূস্বামীটির দিকে৷ বলে ওঠেন, ‘ছিঃ প্রভু, আপনি আমাদের মানুষ বলে মনে করেন না?’

‘মানুষ? ওরে—মান আর হুঁশ থাকলে কি আর কর ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করতিস তোরা? সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে অপোগণ্ডের দল রাজকর দিতে অস্বীকার করে তাদের আমি পথের কুকুর মনে করি৷ তাদের আবার সম্মান অসম্মান কী?’

‘কুকুর?’ ধ্বক করে দুচোখ জ্বলে ওঠে সেই বৃদ্ধের, ‘আপনার জিভে ওকথা এল কী করে প্রভু? আমরা নিজেদের পরিশ্রমের অন্নে নিজেদের পেট ভরাই৷ আমাদের কুকুর বলার আগে আপনার বিবেকে একবারও বাধল না?’

‘বিবেক! বটে? মুখে খুব বুলি ফুটেছে দেখছি! বলি এতই যখন বিবেক-টিবেক আছে তোদের, তখন রাজকর বাকি রাখিস কোন বিবেকে?’

‘ইচ্ছে করে বাকি রাখিনি প্রভু! কোনওদিন কি জানতে চেয়েছেন—কেন কর দিতে পারছি না আমরা? একবারও ভেবে দেখেছেন প্রভু?’

‘ভেবে দেখব? বলিস কি রে! তোদের কথা আজকাল ভেবেও দেখতে হবে!’ চক্ষু বড় করে বলেন ভূস্বামী ভদ্রবাহু৷

‘হ্যাঁ প্রভু, দেখতে হবে বইকি! প্রজারা কি কেবলমাত্র করদান করার যন্ত্র? তাদের ভালোমন্দ দেখার দায় নেই আপনার?’

‘দায়? তোর আস্পর্দা যে মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।’

‘না প্রভু। যা সত্যি সেটাই বলছি। ভেবে দেখেছেন কি, বছরের পর বছর কীভাবে করের হার বাড়িয়ে চলেছেন আপনি? সামান্য যেটুকু ফসল ফলাই আমরা, আগে তার ছয়ভাগের একভাগ দিতে হতো, এখন তার তিনভাগের দুইভাগ আপনি দখল করেন৷ আপনার বাড়ির বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষ্যে পার্বণী আদায় করেন৷ তারও ওপর যখন ইচ্ছে আমাদের দিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে খাটিয়ে নেন৷ এর পরেও আমাদের কুকুর বলছেন? পরের শ্রমের অন্নে ভাগ বসাতে আপনার সংকোচ হয় না প্রভু?’

বিস্ময়ে আর ক্রোধে প্রথমে বাকস্ফূর্তি হয় না ভূস্বামীর৷ তারপর হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন তিনি, ‘বটে? নীচুজাতের মুখে এত বড় কথা? এতবড় সাহস? প্রাণের ভয় নেই তোর?’

ধীরে উঠে বসেন সেই বৃদ্ধ; ঠোঁটের প্রান্ত থেকে গড়িয়ে পড়ে রক্ত, চোখের প্রান্ত থেকে অশ্রু৷

‘ভয়? আজ আমাদের পেটে ভাত নেই, পরনের কাপড় নেই, ঘরের ছেলেমেয়েদের দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছেন৷ এর পরেও আর কীসের ভয় বাকি থাকে প্রভু ভদ্রবাহু?’

‘বটে? তোর আর কোনও ভয় নেই বলছিস? তা বেশ,’ শয়তানি হাসি খেলে যায় ভদ্রবাহুর মুখে, ‘তোর মেয়ে শুনলাম কালই বাপের বাড়িতে এসেছে? আর তোর নাতনীটি নাকি বড়ই মনোলোভা হয়েছে? আহা রে, ভাবছি আজ একইসঙ্গে মা মেয়েকে দিয়ে আমার শয্যার শোভা বাড়াব৷ ওরে কে কোথায় আছিস? মেয়ে আর নাতনীর সঙ্গে এই বাচাল বুড়োকেও বেঁধে নিয়ে চল৷ আজ আমরা সবাই মিলে সারা রাত ধরে মা-মেয়ের শরীরের আনন্দ নেব ভাবছি৷ তোরা দেখিস—সেই সময় যেন এই বৃদ্ধ আমাদের চামর দুলিয়ে হাওয়া করতে ব্যস্ত থাকে’, এই বলে অশ্লীল ও অসভ্য আনন্দে শরীর দুলিয়ে হাসতে থাকেন ভদ্রবাহু আর তাঁর সঙ্গীসাথীরা৷

কুটিরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা যোগীবরের সমস্ত শরীর তীব্র ক্রোধে দাউদাউ জ্বলতে থাকে৷ অতি কষ্টে নিজেকে স্থির রাখেন তিনি৷

একদিন সময় আসবে৷ এই অসহ্য অত্যাচারের প্রতিটি মুহূর্তের প্রতিশোধ নেওয়া হবে৷ কিন্তু আজ সেই সময় নয়৷ আজ সেই দিন নয়৷ নিজেকে বোঝান তিনি৷

প্রবল ঘৃণায় আর রাগে বিকৃত হয়ে যায় দ্বিজদাসের মুখখানি৷ বলে ওঠেন তিনি, ‘শোনো হে ভদ্রবাহু, শোনো হে অত্যাচারী ভূস্বামীদের দল, তোমাদের দিন শেষ হয়ে এসেছে৷ তোমাদের ওই কামলোলুপা রানি, আর তার ওই বেতালসিদ্ধ প্রকাশচন্দ্র, তারা কেউ তোমাদের বাঁচাতে পারবে না৷’

‘তাই নাকি রে? কী করবি তুই, শুনি?’

‘আমি? হা হা হা…’ অপ্রকৃতিস্থ স্বরে হেসে ওঠেন দ্বিজদাস, ‘আমি নয়, আমরা৷ শুনে রাখো ভদ্রবাহু, তিনি আসছেন, সবাইকে নিয়ে আসছেন৷’

‘কে আসছেন? কার কথা বলছিস তুই?’

‘তিনি আমাদের ঈশ্বর৷ স্বয়ং আদিনাথের ত্রিশূল হাতে আসছেন তিনি৷ দিকে দিকে তাঁর ভৈরব বাহিনী প্রস্তুত হচ্ছে৷ তোমাদের অশুভ রক্তের একটি ফোঁটাও এই দেশের মাটিতে পড়তে দেব না হে, তোমাদের প্রতিটি অত্যাচারের ঋণ কড়ায় গণ্ডায় শোধ করে দেব৷’ এই বলে পাগলের মতো করে হেসে ওঠেন সেই বৃদ্ধ৷

আর সহ্য হয় না ভদ্রবাহুর, পাশের সৈন্যটির হাত থেকে ছিনিয়ে নেন ভল্ল! সজোরে গেঁথে দেন বৃদ্ধের বুকে৷

একবার ঘোলাটে চোখ তুলে চারিদিকে তাকান সেই বৃদ্ধ৷ তারপর একবার তাকালেন আকাশের দিকে৷ যেন শেষবারের মতো দেখে নিতে চাইলেন বড় সাধের, বড় মায়ার, বড় ভালোবাসার এই মাটি, এই আকাশ৷

তারপর ফের বিড়বিড় করলেন তিনি, ‘আসছেন, তিনি আসছেন৷ ওঁরা আসছেন৷’

.

৭৪৯ খ্রিস্টাব্দ ৷ নালন্দা মহাবিহার, পাটলিপুত্র, মগধ৷

.

শরৎকাল। সন্ধ্যা শেষ হয়েছে৷ অন্ধকারে অদূরের মহাবিহারটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন অশ্বারোহী পুরুষটি৷

নালন্দা মহাবিহার৷

গত দুশো বছরেরও বেশি সময় ধরে অর্ধেক পৃথিবী জুড়ে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিয়েছে এই বিহার৷ ভারতবর্ষের অহঙ্কার শুধু তার রাজচক্রবর্তী সম্রাটদের বিজয়গাথার মধ্যে নয়, সেই অহঙ্কারের অনেকখানি মিশে আছে তার বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক অবদানের মধ্যেও৷

ভারতের এই সারস্বত ঐতিহ্যের মধ্যে গরিমায়, প্রভাবে ও উৎকর্ষে উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক এই নালন্দা৷ ভারতের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় ও বিদগ্ধ পুরুষেরা অধ্যয়ন বা অধ্যাপনা করেছেন এই মহাবিহারে৷ মহাযান বৌদ্ধধর্মের সম্পূর্ণ দার্শনিক ভিত্তিই তো এই মহাবিহারের মাটি দিয়ে তৈরি৷ আচার্য আর্যদেব, আচার্য দিঙনাগ, আচার্য ধর্মকীর্তি, আচার্য শান্তিদেব—ভারতভূমিকে একের পর এক মহান বৌদ্ধাচার্য উপহার দিয়েছে নালন্দা মহাবিহার৷

তিব্বত থেকে মহাচীন, দ্বারাবতী থেকে সিংহলভূমি, গান্ধার থেকে বালিদ্বীপ, বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শিক্ষার্থীরা আসেন এখানে৷ অধ্যয়ন করেন ষড়দর্শন, শব্দবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, ব্যাকরণ এমনকি চিকিৎসাশাস্ত্রও৷

বাতাসে সামান্য শীতের আমেজ৷ বিহারের উত্তর দিকের দরজার প্রহরী দরজার এক কোণে গুটিসুটি মেরে দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল৷ গ্রাম থেকে তার সম্বন্ধী এসেছিল আজ৷ একে তো তার সঙ্গে বসে চমৎকার কাঞ্জিক মদ্যপান হয়েছে, তার ওপর রাত্রের খাবারটি আজ বড় মনমতো হয়েছ তার৷ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কোনও স্বপ্ন দেখে খিল খিল করে হাসছিল সে৷

সহসা কাঁধে টোকা পড়তে ধড়ফড় করে উঠে পড়ে রক্ষী৷ চোখ কচলে দেখে সামনে এক দীর্ঘদেহী পুরুষ৷ তাঁর সমস্ত দেহ কালো কাপড়ে ঢাকা, বাঁহাতে একটি ঘোড়ার লাগাম ধরে আছেন৷ ঘোড়াটি পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে৷

‘ক্কী ক্কী,…ক্কাকে চাই শুনি, অ্যাঁ?’ ধমকে উঠলেও প্রহরীটি, বোঝা যায় যে বিলক্ষণ ভয় পেয়েছে৷

‘একে বর্ষার রাত, তার ওপর মুখে ভুরভুর করে করছে মদের গন্ধ! না হে বাপু, ঘুমিয়ে পড়ার জন্যে তোমাকে মোটেও দোষ দিতে পারলাম না৷’ কৌতুকস্বর শোনা যায় আগন্তুকের৷

‘এত রাতে, কী ব্যাপার? যা বলার চটপট বলে ফেলো৷’ প্রহরী সামলে ওঠার চেষ্টা করে৷

‘আমারই কী ইচ্ছে করে হে এই এত রাতে এখানে আসতে? তবে না এসে উপায় কী বলো? স্বয়ং আচার্য শান্তরক্ষিত যদি আমাকে ডেকে থাকেন, না এসে আমার উপায় আছে? অমন মস্ত পণ্ডিত লোক…’

‘আচার্য তোমাকে ডেকেছেন? আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ তুমি, অ্যাঁ? ঠাট্টা? বলি যাঁর নাম করলে তিনি কে জানো? মা সরস্বতীর সাক্ষাৎ বরপুত্র তিনি, চীন থেকে বাহ্লীকদেশ অবধি পণ্ডিতরা যাঁর নাম শুনলে মাথা নীচু করেন, সেই পণ্ডিতশিরোমণি শান্তরক্ষিত তোমাকে ডেকেছেন আলাপ করার জন্যে?’

‘ডাকেননি বলছ? আমার তাহলে ভুলই হল নাকি?’

‘আমাকে দেখে কী তোমার মূর্খ মনে হচ্ছে? শোনো হে আগন্তুক, আমার নাম মল্ল সিংহোদর, একটি চাপড়ে তোমার মাথাটি গুঁড়োগুঁড়ো করে দিতে আমার মুহূর্তের বেশি সময় লাগবে না৷

‘সিংহোদর? তা সিংহোদর কবে থেকে এমন ভুঁড়ো শেয়াল হয়ে গেল বলো তো?’ বলতে বলতে সামান্য নত হয়ে ডানহাতের তর্জনী দিয়ে সিংহোদরের পেটে একটি খোঁচা দেন সেই আগন্তুক৷

মুহূর্তে প্রহরীর মনে হয় কে যেন একটি জ্বলন্ত লোহার শিক সজোরে তার পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল৷ প্রবল শ্বাসকষ্টে হাঁপ টানতে টানতে ক্রমশ বেঁকে যেতে থাকে সে, চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসে তার৷

বাঁ-হাতের উলটো দিক দিয়ে সিংহোদরের পিঠে হালকা করে একটি চাপড় দেন সেই আগন্তুক, পরক্ষণেই প্রবল কাশির দমকে ফেটে পড়ে মল্লবীর সিংহোদর৷ শ্বাসকষ্ট কেটে গেছে তার৷ কাশি কিছুটা কমলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘আপনি কে প্রভু?’

‘আহা, আমাকে আবার খামোখা আপনি টাপনি কেন? তুমিটাই তো দিব্যি শোনাচ্ছিল হে৷’ হাঁ-হাঁ করে ওঠেন আগন্তুক, ‘আর ওসব মল্লযুদ্ধের ছোটখাট দু-একটা কৌশল হে, এমন কোনও বড় ব্যাপার নয়৷’

‘অধীনকে আর লজ্জা দেবেন না প্রভু৷ আপনার কী সেবা করতে পারি বলুন?’

‘অতি সামান্য কাজ৷ চট করে আচার্যকে আমার আসার সংবাদটা দিয়ে এসো৷ আর হ্যাঁ, যাওয়ার আগে তোমার ওই কাঞ্জিকের হাঁড়িটা দিয়ে যেও বাপু৷’

কোনও কথা না বলে কাঞ্জিক মদের বিশাল জালাটি আগন্তুকের দিকে এগিয়ে দেয় সিংহোদর৷ হাতে পাওয়া মাত্র আগন্তুক আর দেরি করেন না, দুহাতে জালাটি তোলেন আর হাঁ করে মুখের মধ্যে ঢালতে থাকেন মাগধী সুরা৷

সে দিকে চক্ষু বিস্ফারিত করে তাকিয়ে থাকে সিংহোদর৷ অমন বিশাল পানীয়ের জালা এত অবলীলায় দুহাতে তুলে সেখান থেকে সরাসরি পান করার লোক এই বিশ্বচরাচরে কেউ আছে বলে তার ধারণা ছিল না৷ তবে তখনও তার অবাক হওয়ার বাকি ছিল৷

তার চোখের সামনে দেখতে দেখতে খালি হয়ে গেল সেই বিশাল মাটির জালা৷ শেষ বিন্দুটুকু অবধি গলায় ঢেলে জালাটি দূরে ছুঁড়ে দেন আগন্তুক৷

তৃপ্তির ঢেকুর তুলে আগন্তুক বলেন, ‘বাহ, বাহ, বড় ভালো জিনিস হে৷ যেমন স্বাদ তেমনই তীব্রতা৷ আমাদের ওদিকে বুঝলে কি না, কাঞ্জিকটা না ঠিক তেমন ভালো বানায় না৷ তবে হ্যাঁ, নারকেল ফুল পচিয়ে, বুঝলে কিনা, একধরনের আরক বানাই আমরা৷ সেও ভারি মধুর খেতে হে৷ আমার সঙ্গে আমাদের দেশে একবার যাবে নাকি ভাই চক্রধর?’

‘চক্রধর না প্রভু, ইয়ে আমার নাম সিংহোদর৷ আচার্যকে সংবাদ দিই প্রভু?’

‘দেবে? না-দিলেই নয়? আচ্ছা তবে তাই দাও হে৷ আর যাওয়ার আগে যদি আরেকটি কাঞ্জিকের হাঁড়ি দিয়ে যাও বৃষস্কন্ধ…’

‘আজ্ঞে আমার নাম বৃষস্কন্ধও নয় প্রভু, আমার নাম চক্র…ইয়ে…সিংহোদর৷ অনুগ্রহ করে যদি আপনার নামটি বলতেন৷’

‘নাম?’ এই বলে হাসি হাসি মুখে সিংহোদরের দিকে চোখ তুলে তাকান সেই আগন্তুক, সেই হাসিতে মিশে আছে কিছু নির্দোষ কৌতুক, ‘নাম জিগ্যেস করছ চক্রসম্বর? বলি আমার নাম যদি সরোরুহবজ্র হয়, তাহলে কি চিনতে কিছু সুবিধা হবে? বা যদি বলি রাহুলভদ্র? চিনতে কি পারবেন আচার্য?’

শুনে খানিকক্ষণ হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সিংহোদর৷ ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে সিংহোদরের হাত-পা৷ ইনিই তাহলে সেই রূপকথার রাজপুত্র? ইনিই তিনি?

খুঁজেপেতে নিজেই আরেকটি মদের জালা বের করেন আগন্তুক, তারপর সেটি দুহাতে তুলে গলায় ঢালার আগে একটু থামেন; বলেন, ‘যাওয়ার আগে আমার ঘোড়াটিকে কিছু খেতে দিও তো সামন্তভদ্র, বেচারী অনেকক্ষণ ধরে কিছু খায়নি৷ আর হ্যাঁ, আমার আসল নামটাই আচার্যকে জানিও৷ তাঁকে বোলো যে রাজা ইন্দ্রভূতির সন্তান তাঁর আদেশ পালন করে তিব্বত থেকে ফিরে এসেছে৷’ এই বলে সামান্য থামেন তিনি, তারপর বলেন, ‘বলো যে—রাজপুত্র পদ্মসম্ভব এসেছেন৷’

.

.

৭৪৯ খ্রিস্টাব্দ| পার্বত্য কজঙ্গল|

.

গহীন অরণ্যের মধ্যে ছোট পাহাড়৷ তার চূড়ায় একটি বড় নিমগাছ৷ নিমগাছের নীচে মাটি আর পাথরের মন্দির, ঘন ছায়াবৃত৷

মন্দিরের মধ্যে এক বৌদ্ধ শ্রমণ এবং আর এক শবর যুবক নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিলেন৷

বৌদ্ধ শ্রমণ বয়সে তরুণ৷ অপার বিস্ময়ে তিনি দেখছিলেন মন্দিরের মূর্তিটি৷ নালন্দায় নিত্যপূজা হয় এমন মূর্তির সংখ্যা নেহাত অল্প নয়৷ শ্রমণ নিজেও নিয়মিত অবলোকিতেশ্বরের পূজা করেন৷ দীর্ঘ তিব্বতপ্রবাসেও বহু বিচিত্র মূর্তি কম দেখেননি। কিন্তু এমন মূর্তি আজ অবধি তাঁর চোখে পড়েনি৷

প্রতিমাটি পাথরের৷ একটি বড় পাথর কুঁদে কুঁদে কোনও অখ্যাত শবরশিল্পী রূপদান করেছে এই মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর৷ দেবী অতি ভীষণদর্শনা, অতিবিস্তারবদনা, লোলজিহ্ব৷ পীনোন্নতপয়োধরা দেবীর ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, নিম্নাঙ্গে গাছের পাতা ও বাকলের আচ্ছাদন৷ দ্বিভূজা দেবীর দক্ষিণহস্তটি বরাভয় ভঙ্গিতে ঊর্ধে উত্থিত, বামহস্তটি বরদমুদ্রায় অগ্রবর্তী৷

‘ইনি কোন দেবী, মিত্র শবর?’ বিহ্বলস্বরে বললেন শ্রমণ৷

‘ইনি আমাদের একজন ভারি জাগ্রত দেবী।’ ফিসফিস করে বললেন শবর যুবক। রোগ বালাই হলে আমরা এখানেই হত্যে দিই৷ আর বড় কোনও মড়ক লাগলে তো কথাই নেই, তখন মহা ধূমধাম করে এঁর পূজা হয়৷’ এই বলে থামলেন তিনি৷ তারপর বললেন, ‘দেবী ঠাকুরানি আবার যেমন রাগী, তেমনই উঁচু নজর তাঁর! বুনো মোষের মাংস আর ভালো মহুয়ার মদ না পেলে ওঁর মন ওঠে না৷’

কী আশ্চর্য রূপ মাতৃমূর্তির৷ কী ভয়ঙ্কর অথচ কী মানুষী, কী ক্রুদ্ধ অথচ কী স্নেহময়ী এই দেবী৷ যেন এক সামান্য শবরকন্যার সমস্ত লালিত্য, সমস্ত উগ্রতা, সমস্ত স্নেহ, সমস্ত ক্রোধ একত্রে রূপ নিয়েছে এই দেবীমূর্তিতে৷ তিব্বতে প্রবাসকালে পোন ধর্মের ভীষণদর্শন দেবদেবীদের মূর্তি কম দেখেননি শ্রমণ৷ সেসব মূর্তি দেখে ঘৃণায় বমি উঠে আসত তাঁর৷ কিন্তু, কই, এই করালবদনা দেবীমূর্তি দেখে তাঁর মনে ভয়ের পরিবর্তে ভক্তিভাব জেগে উঠছে কেন?

ভক্তি? শুধুই ভক্তি? তাহলে তরুণ সন্ন্যাসীর হঠাৎ করে কেন মনে পড়ে যাবে তাঁর গর্ভধারিণীর স্নেহঢলঢল মুখখানি?

দীর্ঘ প্রবাসের পর সবে দেশে ফিরেছেন শ্রমণ৷ আচার্য শান্তরক্ষিতের আদেশে একটি অতি গোপন কাজে তিব্বতে গিয়েছিলেন তিনি৷ বহু কষ্টে, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সেই জটিল কাজ শেষ করে সদ্য দেশে ফিরেছেন তিনি৷ দুটি গোপন বস্তু আর একটি পত্র চুরি করে এনেছেন, সঙ্গী রাজপুত্রটির হাত দিয়ে তা পাঠিয়ে দিয়েছেন আচার্যর কাছে৷ তিনি রয়ে গেছেন একটি বিশেষ কারণে৷

তাঁর পূর্বাশ্রমের ঘরখানি, এখান থেকে কয়েক ক্রোশ পশ্চিমে৷ ইচ্ছা আছে, নালন্দা যাওয়ার আগে একবার মায়ের সঙ্গে দেখা করে যাবেন শ্রমণ৷ আহা, কতদিন দেখেননি মাকে৷

দু’চোখ বন্ধ করলেন তিনি৷ বহুদিন পূর্বে ছেড়ে আসা বাস্তুভিটার জন্যে, আম আর কাঁঠাল গাছে ছায়াময় গ্রামটির জন্যে, মাতৃদেবী ভগবতীর করুণ মুখখানির কথা মনে পড়ে সহসা তাঁর চক্ষু সজল হয়ে উঠল৷

‘তবে রাগী হলে কী হবে, দেবীকে কিন্তু আমরা বড় ভালোবাসি ভায়া,’ উৎসাহিত হয়ে ওঠেন শবর যুবকটি৷ অসভ্য আরণ্যক আদিবাসীকূলে জন্মগ্রহণ করেও দৈববলে আশ্চর্য সাধনসিদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছেন তিনি৷ লোকে বলে, আর্য অবলোকিতেশ্বর স্বয়ং নাকি এক ব্যাধের রূপ ধরে এসে এঁকে দশকুশল দান করেন৷ লোকায়ত সহজ সাধনার যে নতুন সিদ্ধিমার্গ উন্মোচিত হয়েছে, তাতে বিশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয় এঁর নাম৷ ময়ূরবসন, গিরিনাথ—নানান নামে এঁর পরিচিতি৷ সাধারণ মানুষ অবশ্য অন্য নামেই চেনে বেশি এঁকে, শবরবজ্র৷

তিনি বলতে থাকেন, ‘ঘরের মেয়ের মতই ভালোবাসি৷ নইলে কথায় কথায় এত রাগ কে-ই বা সহ্য করবে হে? নিজের মেয়ে বলেই না সহ্য করি এত! তবে মেয়ে আমাদের ভারি সোহাগীও বটে, তেমন দয়াবতীও৷ বিপদে আপদে এই মেয়েই আমাদের রক্ষা করে৷ অবরে-সবরে মেয়ের সঙ্গে আমরা সুখদুঃখের দুটো কথাও বলি৷’

‘তাই নাকি? ইনি তাহলে দেবী নন? আপনাদের ঘরের মেয়ে, মিত্র?’

‘বটেই তো।’ বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠলেন শবরবজ্র, ‘মেয়ে তো বটেই! দেবীও বটে, আবার ঘরের মেয়েও বটে৷ নিত্যি পূজা তো আছেই, তার ওপর বর্ষার সময় শেষ হলে আকাশ যখন বেশ পরিষ্কার হয়ে আসে, তখন একদিন দিনক্ষণ দেখে আমরা এই দস্যি মেয়েটার মহাধূমধামে পূজা করি, বুঝলে ভায়া৷’

‘তাই নাকি?’ মনের মেঘ কেটে যাচ্ছিল শ্রমণের৷

‘তখন তো হরিণ, মোষ, বুনো বরা আর অঢেল মহুয়া না পেলে শুধু এই বেটি কেন, আমাদের সমাজের লোকজনও ভারি রাগ করে ভাই৷ পাঁচদিন ধরে কজঙ্গল থেকে বিন্ধ্যাচল অবধি সে এক মোচ্ছব চলে হে৷ ও, তুমি তো আবার দুধ আর ফল ছাড়া কিছুই খাও না৷ তবে দেবীর সামনে আমাদের ছেলেমেয়েরা সুন্দর নাচ-গানের অনুষ্ঠান করে, দেখলে তোমার ভালো লাগবেই৷ গত কয়েক বছর ধরে আমরা বুদ্ধনাটকও শুরু করেছি, বুঝলে হে৷’

ধীরে ধীরে মন প্রসন্ন হয়ে উঠছিল শ্রমণের৷ এই সহজ মানুষটিকে, এই সহজ ভূমিকে, এই জনজাতিকে, এই সহজ পূজোপচারকে ক্রমেই ভালোবেসে ফেলছিলেন৷ দেবীর মধ্যে নিজের মায়ের মুখখানি খুঁজে পাচ্ছিলেন৷

‘এই দেবীর নাম কী মিত্র?’

‘নাম? কোনও নাম তো দিইনি ভাই!’ উত্তর করেন সেই শবর যুবক, ‘নাম দেওয়ার কথা মনেই আসেনি৷’

‘মিত্র, অনুমতি দিন,’ গলা বুজে আসে শ্রমণের৷ সেই কোন শৈশবে সাধের ঘর ছেড়ে, ঘরের আঙিনা ছেড়ে, গ্রামের ছোট্ট শান্ত নদীটি ছেড়ে, বন্ধুবান্ধবদের ছেড়ে, মায়ের স্নেহের আঁচলটি ছেড়ে শ্রমণ হয়েছিলেন তিনি৷ তারপর পতিতোদ্ধারিনী গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে কত না জল৷ নালন্দা, কামরূপ, তিব্বত, ষড়যন্ত্রে দীর্ণ রাজপরিবার, অরাজকতায় ক্ষিণ্ণক্ষিপ্ত বঙ্গভূমি, আর সেই বঙ্গভূমির উদ্ধারকল্পে আচার্য শান্তরক্ষিত আর লোকেশ্বরের মিলিত বিশাল পরিকল্পনা—এই বিপুল কর্মস্রোতে কবেই ভুলে গেছেন সেই স্নেহের ছায়া-সুনিবিড়, সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলা শান্ত কুটিরটি৷

মনে মনে দেবীর কাছে প্রার্থনা করলেন তিনি৷ সবকিছু ছেড়ে যে কাজে ব্রতী হয়েছেন তিনি, তা যেন জয়যুক্ত হয়৷ যেন এই দেশের ঘরে ঘরে প্রদীপের মঙ্গলশিখা আর শঙ্খধ্বনির কোমল শান্ত সন্ধ্যাটি ফিরে আসে৷ এছাড়া ইহজীবনে আর কিছুই চাই না তাঁর৷

‘অনুমতি দিন মিত্র,’ গভীর আবেগে স্বর কাঁপতে থাকে সেই শ্রমণের, ‘আমি শবরদেশের এই পর্ণ-বল্কল-পরিহিতা দেবীর নাম দিলাম দেবী পর্ণশবরী৷ এঁকে দেখে আমার গর্ভধারিণী ভগবতী দেবীর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে মিত্র৷ অনুমতি দিন, আমি জনসাধারণ্যে দেবী সর্বশবরনাম ভগবতীর পূজা প্রচার করতে চাই৷’

শোনামাত্র প্রথমে বাকরুদ্ধ হয়ে ছিলেন সেই সহজস্বভাব শবরটি, কয়েকমুহূর্ত পরে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলন, ‘বলো কী ভাই কমলশীল? আমাদের মেয়ে তোমাদের মতো ভদ্রজনের পূজাও পাবে? সে তো বড় আনন্দের কথা৷’

‘অবশ্যই মিত্র৷ ইনি সাক্ষাৎ শক্তি, দৈত্যদর্পনিসূদিনী দেবী চণ্ডী৷ আজ বঙ্গভূমির ভাগ্যে যে কালরাত্রি নেমে এসেছে, তা দূর করতে হলে এই বনভূমির, এই পার্বত্যদেশের, এই অরণ্যের আশীর্বাদ চাই৷’ আবেগাপ্লুত স্বরে বলছিলেন কমলশীল, আচার্য শান্তরক্ষিতের প্রিয়তম শিষ্য কমলশীল৷ ‘সেইদিন আর বেশি দূরে নেই বন্ধু, যেদিন এই দেশের সাধারণ মানুষের বিদ্রোহে উৎখাত হবে এই অত্যাচারী, কামলোলুপা, উন্মাদবুদ্ধি রানির রাজত্ব৷ সেইদিন শবরদেশের এই করালবদনা শক্তিদায়িনী মেয়েটিকে আমাদের বড় প্রয়োজন হবে৷ আপনার অনুমতি আছে তো?’

কিছুক্ষণ অভিভূতের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন সিদ্ধাচার্য শবরবজ্র৷ তারপর কমলশীলকে ভীম আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘শবর জনজাতি তোমাদের সঙ্গে আছে ভাই৷ প্রয়োজনে খবর দিও৷ এই দেশের নামে, আমাদের এই মেয়ের নামে আমাদের প্রতিটি রক্তবিন্দু উৎসর্গ করলাম৷’

.

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন