অভীক সরকার
পূর্ণিমার পূর্বরাত্রে দুগ্ধ ফেননিভ জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে মেঘান্দ তীরবর্তী এই শ্মশান। রাতচরা পাখিদের ডাকে রাত্রি কর্ণময়। এদিকে ওদিকে দু-চারটি চিতা জ্বলছে। তবে অন্য মানুষজন ত্রিসীমানায় নেই। চারিদিকে রাজসেবকদের সতর্ক প্রহরা। তাদের নেতৃত্বে মাধব।
কমলাঙ্ক গ্রামের সেই লজ্জাজনক পরাজয়ের পর মাধবের জন্য চূড়ান্ত শাস্তিই ধার্য ছিল। কিন্তু কোনও এক অলৌকিক কারণে বেঁচে গেছে সে। সেই অভাবনীয় করুণার জন্য মহারানির প্রতি তার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই।
মাধব জানে যে আজ এই মহাশ্মশানে বঙ্গদেশের মহামান্য মহারাজ্ঞী এবং মহারাজসচিব প্রকাশচন্দ্র মহাভৈরবীক্রিয়ায় বসবেন। সঙ্গে থাকবেন অন্যান্য রাজন্যবর্গ। তবে তার কাছে সংবাদ আছে যে, রাজন্যবর্গের মধ্যে উপস্থিত থাকবেন কেবলমাত্র রাজগুরু বিশুদ্ধকীর্তি এবং জিতসেন। আনন্দগুপ্ত আর শান্তঘোষের মৃত্যুসংবাদ এখন আর রাজসেবক বাহিনীর উচ্চ পদাধিকারীদের কাছে গোপন নেই। তাঁদের উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে মহাসান্ধিবিগ্রহিক অগ্নিমিত্র’র আকস্মিক অন্তর্ধান। গতকাল দ্বিপ্রাহরিক আহারের পর একাই কোথায় যেন বেরিয়ে যান তিনি। কোথায় যাচ্ছেন কাউকে বলে যাননি। প্রধানমন্ত্রী গেছেন হরিকেল, মহারাজসচিবের বিশেষ ‘অনুরোধে।’
একটু পরে একটি রথে চড়ে জিতসেন এবং বিশুদ্ধকীর্তি এলেন। মাধব এবং অন্যান্য রক্ষীরা অভিবাদন জানাল। জিতসেন অভিবাদন গ্রহণ করলেন, কিন্তু বিশুদ্ধকীর্তি কোনও উত্তর দিলেন না। আশ্চর্য হল মাধব। বিশুদ্ধকীর্তি অত্যন্ত রসিক এবং স্নেহময় মানুষ। কেউ প্রণত হলেই তিনি স্বস্তিবাচন উচ্চারণ করেন। দুজনে গিয়ে তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট আসনে বসলেন। তারপর প্রতীক্ষা মহামান্য মহারানি এবং প্রকাশচন্দ্রের জন্য।
.
অর্ধকলস পুষ্পজাত মদিরার পর আরও দুই ঘট অতি উৎকৃষ্ট শিধু। তারপর মায়া নামের ওই কামিনী এতক্ষণ ভুমানন্দের চূড়ান্ত শীর্ষে রেখেছিল সিংহোদরকে! সেই আনন্দের তুলনা নেই। এতদিনের বুভুক্ষু কৃচ্ছ্রসাধনের পর আজ যেন ব্রতভঙ্গের উদযাপন চলছিল সিংহোদরের সমস্ত শরীর জুড়ে।
মায়া চলে গেছে কিছুক্ষণ হল। এই মুহূর্তে রমণক্লান্ত মদিরাবিষ্ট সিংহোদরের মাথার মধ্যে একটি অস্বস্তিকর চিন্তা খেলা করে যাচ্ছে।
কী যেন একটা ঠিক হয়নি। কিছু একটা ঘটেছে যা যুক্তিসংগত নয়। কিন্তু সেটি যে কী, তার মস্তিষ্কে ধরা দিচ্ছিল না।
সহসা চোখ খুলে গেল তার। দ্রুত উঠে বসল সে। তার মনে পড়ে গেছে কী সেই অসঙ্গতি। ভাঁড়ুদত্ত’র তো তাকে চেনার কথা নয়। আর মূক মানুষটির পক্ষেও ভাঁড়ুদত্তকে তার নাম জানানো একেবারেই অসম্ভব। তাহলে তিনি কী করে প্রথম দর্শনেই সিংহোদরকে নাম ধরে সম্বোধন করলেন?
মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল সিংহোদরের। ফাঁদে পড়েছে সে। এ সব কিছুই পূর্বপরিকল্পিত। অর্থাৎ এরা জানত যে সিংহোদর ওই কিরাতপল্লীতেই আছে, কিন্তু পল্লীর ঠিক কোথায় সে ব্যাপারে অবগত ছিল না। তাই অনেকদিন ধরেই ওই মূক মানুষটি ওখানে শৌণ্ডিকের ছদ্মবেশে অপেক্ষা করছিল। আর কুমার পদ্মসম্ভবের কথা না শুনে মূর্খের মতো সেই ফাঁদে পা দিয়েছে।
পোশাকের দিকে হাত বাড়াল সিংহোদর। যে করে হোক তাকে এই মুহূর্তে পালাতে হবে। নিজের মুর্খামির জন্য এত বড় সর্বনাশ হতে দিতে পারে না সে। কিছুতেই না।
কিন্তু তার আগেই খুলে গেল কক্ষের দ্বার। ভাঁড়ুদত্ত প্রবেশ করলেন। তার সঙ্গেই প্রবেশ করল আরও একজন যাকে দেখামাত্র সিংহোদরের হৃৎপিণ্ড কণ্ঠনালীতে আটকে গেল। সেই সেতুরক্ষী!
রঙ্গলাল উদার হেসে বলল, ‘আরে মিত্র সিংহোদর যে। সংবাদ সব ভালো তো? মায়া তোমার যথোপযুক্ত যত্ন নিয়েছে তো?’
সিংহোদরের গলায় কোনও স্বর ফুটল না।
রঙ্গলালের পিছন পিছন দুজন ভীমদর্শন রাজসেবক প্রবেশ করল। তাদের শরীর বিশাল, হাতের অস্ত্র কুৎসিত এবং চোখ শীতল।
রঙ্গলালের হাসি আকর্ণবিস্তৃত হল। বিগলিতস্বরে বলল, ‘তোমার সঙ্গে আবার কবে মিলিত হব সেই চিন্তায় রাতের ঘুম হচ্ছিল না হে। আজ অবশ্য নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারব। এখন গাত্রোত্থান করো দেখি। মহামান্য রাজসচিব আবার তোমার সঙ্গে আলাপিত হওয়ার জন্য বড়ই উতলা হয়ে আছেন।’
.
প্রকাশচন্দ্র আর মহারানি এলেন রাত্রির প্রথম যাম পরে করে। রানি একটি কৃষ্ণবর্ণের শাটিকা পরিহিতা। ঘন কৃষ্ণকুঞ্চিত কেশগুচ্ছ চূড়া করে বাঁধা। শরীর আভরণহীন। মুখখানি রুক্ষ, শুষ্ক এবং গম্ভীর।
প্রকাশচন্দ্রের মুখ দেখে তাঁর মনের ভাব বোঝার উপায় নেই। তিনি তাঁর স্বভাবজ নির্লিপ্তমুখে এসে আসন গ্রহণ করলেন। জিতসেন সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানালেন। বিশুদ্ধকীর্তি উচ্চারণ করলেন স্বস্তিবাচন। প্রকাশচন্দ্র নিরাসক্ত মুখে বললেন, ‘আচার্য বিশুদ্ধকীর্তিকে আমার প্রণাম। মিত্র জিতসেনকে অভিবাদন।’
জিতসেন সশ্রদ্ধভাবে প্রশ্ন করলেন, ‘আজকের চক্রের কী আয়োজন প্রভু?’
প্রকাশচন্দ্র উত্তর দিলেন না৷ তার পরিবর্তে তিনি মাধবের দিকে ফিরে বললেন, ‘মাধব, সমস্ত রক্ষীদের এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাও। আজ এই শ্মশানের ত্রিসীমানায় যেন কেউ না আসে।’
মাধব ইতস্তত করল। যদি কোনও অঘটন ঘটে যায়?
প্রকাশচন্দ্র তার মনের কথা বুঝতে পেরে বললেন, ‘দ্বিধার কোনও কারণ নেই মাধব। আজ কোনও অঘটন ঘটবে না। কারণ আজ কোনও মানুষ বা প্রাণীর এই শ্মশানভূমির নিকটস্থ হওয়ার ক্ষমতা নেই।’
মাধব মাথা নত করে প্রস্থান করল।
বিশুদ্ধকীর্তির মুখ দেখে বোঝা দুষ্কর, কী অবিশ্বাস্য প্রলয় তাঁর মনের মধ্যে ঘটছে। প্রিয়তম শিষ্য বুদ্ধগুপ্ত’র মৃত্যু সংবাদ, অগ্নিমিত্র’র সঙ্গে তাঁর বাদানুবাদ, মালিনীর বিষপ্রয়োগে অগ্নিমিত্র হত্যা, সবই ঘটে গেছে অত্যন্ত দ্রুতলয়ে। মিত্রবর্গের কাউকে জানাতে পারেননি সেই সংবাদ। অগ্নিমিত্র’র মৃতদেহটি কোনওমতে তাঁর কক্ষের পশ্চাতবর্তী অরণ্যের মধ্যে এক গহ্বরে নিক্ষেপ করে এসেছেন। মালিনী স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তাকে একটি ভেষজ ঔষধি প্রয়োগে তিনি গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন করে এসেছেন। এই চক্রশেষে তিনি শালিবন বিহারে ফিরে মৎস্যেন্দ্রনাথকে সব কিছু বিস্তারিত জানাবেন, এই স্থির করেছেন।
প্রকাশচন্দ্র উঠে দাঁড়িয়ে ঘট থেকে জল নিয়ে বৃত্তাকারে ছিটিয়ে দিলেন। তীব্র কটুগন্ধে চারিদিক ভরে গেল। বিশুদ্ধকীর্তি নাসিকা কুঞ্চিত করলেন। কীসের গন্ধ?
প্রকাশচন্দ্র এবার একটি শুষ্ক কৃষ্ণ বৃক্ষশাখা তুলে নিলেন হাতে। বিশুদ্ধকীর্তি বুঝতে পারলেন বৃক্ষশাখাটি কী। বজ্রপাতে মৃত নিম্ববৃক্ষের শাখা। খুব সম্ভবত কোনও শ্মশানভূমিজাত। প্রকাশচন্দ্র তাই দিয়ে একটি অতি বৃহৎ বর্গক্ষেত্র আঁকলেন মাটিতে। সেই বর্গক্ষেত্রর মধ্যস্থানে রইলেন তাঁরা।
সতর্ক হলেন বিশুদ্ধকীর্তি। বজ্রযানে সিদ্ধ তন্ত্রবিদ তিনি। তিনি জানেন কোন কার্যে এই বজ্রপাতদগ্ধ শ্মশাননিম্বশাখার প্রয়োজন হয়। মায়াবন্ধন।
প্রকাশচন্দ্র যখন মাটিতে আঁচড় কাটছিলেন, তাঁর দিকে তীক্ষ্ণচোখে চেয়ে রইলেন বিশুদ্ধকীর্তি। মায়াবন্ধন সর্বোচ্চস্তরের বন্ধন। শুধু ভূবন্ধন নয়, মায়াবন্ধনে রূপ, সংজ্ঞা, বেদনা, সংস্কার আদি পঞ্চস্কন্ধ বদ্ধ হয়। বদ্ধ হয় সমগ্র প্রকৃতি। প্রতীত্যসমুৎপাদকে বদ্ধ করতে পারে এই বন্ধন।
এই বন্ধনক্ষেত্রে যাবতীয় কার্যকারণ অক্রিয়াশীল, যাবতীয় পঞ্চভূত সান্দ্র এবং যাবতীয় কালচক্র স্তব্ধ হয়ে থাকে। আধিদৈবিক, আধিভৌতিক এবং পারত্রিক, এই ত্রিভূতজগত মায়াবন্ধনে অধিষ্ঠান করে।
প্রকাশচন্দ্র এখানে মায়াবন্ধন করছেন কেন? কী এমন ঘটতে যাচ্ছে?
প্রকাশচন্দ্র বর্গক্ষেত্রটির উত্তরপূর্ব প্রান্তে এসে দাঁড়ালেন। দুহাত ওপরে তুলে অজানা ভাষায় কী যেন একটা উচ্চারণ করলেন তিনি। বিশুদ্ধকীর্তির মনে হল—এ কোনও এক জটিল মন্ত্র। তার সুর আদিম এবং অস্বস্তিকর। শ্রবণমাত্রে প্রাণে ভয় জাগে।
বিশুদ্ধকীর্তি অলক্ষ্যে নিজের দুহাতের আঙুল মুদ্রাবদ্ধ করলেন। তাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, এখানে এমন কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, যা স্বাভাবিক নয়।
প্রকাশচন্দ্র সেই একই আচার বর্গক্ষেত্রটির বাকি তিন প্রান্তদেশে করলেন। বিশুদ্ধকীর্তির মনে হল শেষ মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেত্রটি ঘিরে এক একটি অদৃশ্য আবরণ নেমে এল।
জিতসেন এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলেন, কিছু বুঝতে পারছিলেন না। এর আগে একত্রে অনেক চক্রানুষ্ঠান করেছেন। কিন্তু আজ প্রকাশচন্দ্র যা করছেন তা সম্পূর্ণ অন্যরকম।
প্রকাশচন্দ্র এবার এসে তাঁদের মধ্যে বসলেন। মাটিতে একটি চতুর্শীর্ষ নক্ষত্র আঁকলেন। শীর্ষগুলির প্রান্তদেশে রইলেন চারজন। নক্ষত্রের ঠিক মধ্যস্থানে কয়েকটি শুষ্ক বৃক্ষশাখ এবং গুল্মলতা এনে রাখলেন। কয়েকটি বৃক্ষশাখা চিনতে পারলেন বিশুদ্ধকীর্তি, অশ্বত্থ, দাড়িম্ব, বেল ইত্যাদি। কয়েকটি চিনতে পারলেন না। গুল্মলতাগুলি এতই প্রাচীন, এতই শুষ্ক যে তাদের দেখে চেনার উপায় নেই।
বৃক্ষশাখাগুলি দিয়ে একটি যন্ত্র প্রস্তুত করলেন প্রকাশচন্দ্র। তার মধ্যে গুল্মলতাগুলি রাখলেন। তারপর তাতে অগ্নিসংযোগ করলেন।
অজানা ধূম্রগন্ধ ভেসে এল বিশুদ্ধকীর্তির নাকে। বহুপুরাতন, বহুপ্রাচীন আবেশ মিশে আছে সেই গন্ধে।
বাকিদের মুখের দিকে একবার তাকালেন বিশুদ্ধকীর্তি। জিতসেনের মুখে অস্বস্তি। মহারানির মুখে একটা চাপা উল্লাসের ভাব। তার মধ্যে একটা জান্তব ক্ষুধা মিশে আছে।
নিজের হস্তমুদ্রা দৃঢ় করলেন বিশুদ্ধকীর্তি। অত্যন্ত অস্বাভাবিক কিছু ঘটতে চলেছে। তাঁর সমস্ত ইন্দ্রিয় বলছে—একটা বিপদ আসন্ন! মহাবিপদ।
প্রকাশচন্দ্র গম্ভীরসুরে বললেন, ‘আপনারা জানেন যে আজ আমরা মহাবিপদের সম্মুখীন। একদল বহিরাগত বিদ্রোহী আমাদের দেশের সর্বনাশসাধনে সমুদ্যত। তাদের মধ্যে যেমন সহজিয়া নামের বিকৃত সদ্ধর্মীরা আছে, তেমন রয়েছে কৌপীনধারী উচ্ছৃঙ্খল শৈব সাধকের দল। এদের একমাত্র উদ্দেশ্য আমাদের বঙ্গদেশের সুস্থিতি নষ্ট করা এবং শান্তি ভঙ্গ করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা।
কিন্তু আমরা, দেশের এই সর্বনাশ হতে দিতে পারি না। আমরা চেষ্টা করেছি এদের সমস্ত প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের প্রতিটি চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে।’
এত পর্যন্ত বলে অতি দীর্ঘ শ্বাস নিলেন প্রকাশচন্দ্র। তারপর বললেন, ‘আমরা মহারানির অধীনে অর্ধশতাধিক কালের কাছাকাছি এই ভূমি শাসন করে এসেছি। ক্রমে আমরা সপ্তরাজন্য মিলে রাজ্ঞীর ধর্মধ্বজতলে এই শাসন সুসংহত করেছি, সুসংগঠিত করেছি। আমাদের ধর্মের ধ্বজপতাকা উড়ছে সর্বত্র।
‘কিন্তু তদসত্বেও এই বৌদ্ধপাষণ্ড আর বিপথগামী শৈবযোগীদের দল আমাদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র রচনা করেছে। তার মূল অনেক গভীর। আমরা বজ্রযোগিনী মন্দিরের ঘটনায় তার প্রমাণ পেয়েছি। প্রমাণ পেয়েছি আরও অনেক সূত্রে। আপনাদের জানিয়ে রাখি, কালকের মধ্যেই আমি চূড়ান্ত আক্রমণের আশঙ্কা করছি।
‘আমাদের উচিত ছিল এই কঠিন মুহূর্তে সঙ্ঘবদ্ধ থাকা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সঙ্গীদের অনেকেই আমাদের সঙ্গে আর নেই। আনন্দগুপ্ত আর শান্তঘোষের হত্যাসংবাদ আপনাদের জানা। খানিক পূর্বেই আমি আমার সাধনার শক্তিবলে অবগত হয়েছি যে, খুব সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী অমিতাভভট্ট আর বেঁচে নেই…’
বিশুদ্ধকীর্তির হস্তমুদ্রা সঞ্চালন মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল।
‘মহাসান্ধিবিগ্রহিক অগ্নিমিত্রও আর আমাদের মধ্যে নেই।’
মুদ্রাসঞ্চালন দ্রুত হল।
‘আজ তাই আমাদের আরও কঠিনভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে৷ সেই জন্যই বিশেষ পূজার আয়োজন করেছি। এই পূজার উদ্দেশ্য মহারানির জন্য এক অতিবিশিষ্ট অতিপ্রাকৃত রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করা। কারণ আমরা জানি যে, রানিই স্বয়ং বঙ্গদেশ, বঙ্গদেশই সাক্ষাৎ রানি। তাই তাঁকে রক্ষা করাই আমাদের প্রধানতম দায়িত্ব।’
জিতসেন হতভম্বের মতো একবার বিশুদ্ধকীর্তি আর একবার প্রকাশচন্দ্রের দিকে তাকালেন। তাঁর মাথার মধ্যে কিছু ঢুকছে না।
প্রকাশচন্দ্র চারটি পাত্রে একটি মিষ্টগন্ধী ঘন কৃষ্ণবর্ণের তরল ঢাললেন। তারপর পাত্রগুলি সবার হাতে তুলে দিয়ে আদেশের সুরে বললেন, ‘পান করুন।’
সেই সুমিষ্টগন্ধী তরল ঈষদুষ্ণ মদিরার মতো গলা বেয়ে নামতে লাগল বিশুদ্ধকীর্তির। এক উষ্ণ মাদকতা ছড়িয়ে পড়ল তাঁর শরীরে।
‘আপনাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ জানা প্রয়োজন। আমি বা রাজ্ঞী এতদিন এই সংবাদ আপনাদের থেকে গোপন রেখেছিলাম। আমরা দুজন ছাড়া আর যেক’জন একথা জানতেন তাঁরা আজ আর কেউ বেঁচে নেই। কিন্তু এই তথ্য আপনাদের জানা প্রয়োজন।’
মেরুদণ্ড টানটান করে বসলেন বিশুদ্ধকীর্তি। তিনি বুঝতে পেরেছেন কী বলতে চলেছেন প্রকাশচন্দ্র, কোন মারাত্মক সত্য উন্মোচিত হতে চলেছে তাঁদের সামনে।
‘আপনাদের জানাই যে আমাদের নেত্রী, বঙ্গদেশের মহারানি প্রকৃতপক্ষে কোনও মানুষ নন, একজন নাগকন্যা।’
.
শ্মশানভূমির মধ্যে চারজন মানুষ পদ্মাসনে বসে ধ্যানমগ্ন। সমগ্র স্থানটির মধ্যে এক রহস্যময় নীরবতা। কোথাও কোনও শব্দ নেই, প্রাণের সাড়া নেই।
বিশুদ্ধকীর্তি একটি আশ্চর্য অনুভূতির মধ্যে ছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল তিনি যেন মহাশূন্যে ভেসে আছেন। তাঁর চৈতন্য আবিষ্ট, কিন্তু প্রখর। তাঁর চিন্তা নিয়ন্ত্রিত, কিন্তু তীক্ষ্ণ। তাঁর একাগ্রতা এবং ধীশক্তি বহুগুণে বর্ধিত হয়েছে, কিন্তু তার গতি তাঁর ইচ্ছাধীন নয়। তরলের মাদকতা তাঁকে বশীভূত করে ফেলেছে, বুঝতে পারছিলেন বিশুদ্ধকীর্তি। একটা স্থির উত্তেজনার স্রোত ক্রমেই তাঁর নাভিমূল থেকে ঊর্ধ্বমুখে ধাবিত হচ্ছিল, যেভাবে নিঃশঙ্ক শশকের দিকে একাগ্রচিত্তে এগিয়ে চলে ধূর্ত অজগর।
প্রকাশচন্দ্র তাঁদের একটি মন্ত্র দিয়েছেন জপ করার জন্য। মন্ত্রটি বিজাতীয়, শব্দগুলির প্রকরণ শুনে মনে হয়, এ যেন এই পৃথিবীর শব্দ নয়। তার প্রতিটি ধ্বনির উচ্চারণে মস্তিষ্কের কোষ শান্ত, শীতল এবং নিবিড় হয়ে আসে।
একটু পর একটা ক্ষীণ হিসহিসানির শব্দ কানে আসে বিশুদ্ধকীর্তির। কেউ যেন ধীরে, অতি ধীরে শ্বাস নিচ্ছে। তিনি সেদিকে মনোযোগ দিলেন না, মন্ত্রধ্যান করতে লাগলেন।
হিসহিসানির শব্দ ক্রমে বাড়ছে। প্রথমে ক্ষীণ ও ধীরলয়ে। তারপর একটু দ্রুত এবং উচ্চকিত।
চোখ খুলতে গেলেন বিশুদ্ধকীর্তি। কিন্তু তাঁর মস্তিষ্কের মধ্যে প্রকাশচন্দ্রের নির্দেশ ভেসে এল, ‘মন্ত্র জপ করতে থাকুন আচার্য। এখনও সময় হয়নি।’
এর অর্থ, তাঁর মন দখল করে ফেলেছেন প্রকাশচন্দ্র। শুধু তাই নয়, নিজের মানসিক চিন্তাতরঙ্গকেও বিশুদ্ধকীর্তির মস্তিষ্কে প্রক্ষেপণ করতে পারছেন।
এতক্ষণে তরলের মাহাত্ম্য বুঝতে পারলেন বিশুদ্ধকীর্তি। এখন তিনি প্রকাশচন্দ্রের ক্রীড়নক মাত্র!
হিসহিসানির শব্দ ক্রমেই বেড়ে উঠছে। আরও ধীর, আরও গভীর, আরও শীতল৷
সহসা বিশুদ্ধকীর্তি অনুভব করলেন পারিপার্শ্বিকের তাপমাত্রা দ্রুত নেমে আসছে। এই শৈত্য হেমন্তের স্নিগ্ধ শৈত্য নয়। অনেক শীতল, অনেক হিংস্র।
বিশুদ্ধকীর্তির সর্বাঙ্গে সেই শৈত্য ধীর লয়ে কামড় বসাতে লাগল। তাঁর দাঁতে দাঁত লেগে যেতে লাগল। হাত পায়ের সাড় চলে যেতে লাগল। যেন ডুবে যাচ্ছেন তিনি। অজ্ঞান শৈত্যের মধ্যে যেন একটু একটু করে বিলীন হয়ে যাচ্ছেন। কেবল থেকে যাচ্ছে সেই মৃত্যুশীতল হিসহিস শব্দ।
একটু পর সেই ঘন অন্ধকারের মধ্যে একটি ধূসর পর্দা কে যেন টেনে দিল। তার মধ্যে একটি একটি করে ফুটে উঠল অন্ধকারের বিন্দু। প্রথমে স্থির। ধীরে, অতি ধীরে তারা কম্পমান হল। কম্পন ক্রমে বাড়তে লাগল। একটু পরে সেই কম্পনে গতি এল, এল ছন্দ। এল তাল, এল লয়।
তারপর শুরু হল তাদের নাচ। নাচতেই নাচতেই বিন্দুরা একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে যেতে লাগল। তৈরি হল বিন্দুসমষ্টি। তারপর সেই বিন্দুসমষ্টি আকার নিতে লাগল। তৈরি করল অবয়ব।
সেই অন্ধকার যেন তার সীমাহীন গর্ভের মধ্যে নিবিড়ভাবে আঁকড়ে ধরেছে বিশুদ্ধকীর্তিকে।
সেই অবয়ব তৈরি করেছে বিভিন্ন চরিত্র। ছবি আরও স্পষ্ট হয়ে এসেছে। একটু পরেই শুরু হল ছায়ানাটিকা।
উন্মাদের মতো, আতঙ্কিত পশুদের মতো পালিয়ে যাচ্ছে একদল নরনারী। পিছনে জ্বলছে বনভূমি। তাদের মধ্যে এক শিশুকন্যা ভীতচোখে তাকিয়ে রয়েছে সেই সর্বগ্রাসী দাবানলের দিকে।
গভীর রাত্রি। উঁচু দুর্গপ্রাকার। ধীরে ধীরে সেই দুর্গপ্রাকার পেরিয়ে কারা যেন নেমে আসছে। তাদের হাতে প্রজ্জ্বলন্ত উল্কা, কটিবন্ধে করাল খড়্গ, চোখে জিঘাংসা। তারপর চারিদিকে আগুন আর আগুন।
এক নারী পেরিয়ে যাচ্ছেন শুভ্র তুষারাবৃত গিরিপথ। একটি কিশোর আর একটি শিশুকন্যার হাত ধরে। সঙ্গী একজন বৃদ্ধ আর দু-একজন বিজাতীয় কিশোর। পথের আড়ালে হারিয়ে যাওয়ার আগে ফেলে আসা জন্মভূমির দিকে একবার সজল চোখে তাকালেন। তারপর চোখের জল মুছে চিবুক কঠিন করে মুখ ফেরালেন সামনের দিকে।
অন্ধকার গর্ভগৃহ। বিচিত্রদর্শন এক পাত্রে জ্বলছে আগুন। একদিকে একটি প্রস্তরনির্মিত নাগমূর্তি। তার সামনে একটি ধ্যানস্থ শিশুকন্যা বসে।
কোনও এক বিদেশীয় রাজগৃহ। অতুলনীয় বৈভব। সেই শিশুকন্যা এখন কিশোরী।
একটি বিশাল রাজশয্যা। একজন অসুস্থ মানুষ শেষ শয়ানে। সেই কিশোরী এখন যুবতী। সে ধরে আছে মৃত্যুপথযাত্রীর হাত। ধীরে ধীরে হাত খুলে গেল। উঠে দাঁড়াল সেই যুবতী।
যুবতীর কোলে সদ্যোজাত শিশুকন্যা। মৃতবৎ। রাজশকট ছুটে চলেছে পার্বত্য প্রদেশের পথ ধরে।
পুনরায় সেই অন্ধকার গর্ভগৃহ। প্রস্তরনির্মিত নাগমূর্তি। সেই মৃতবৎ শিশুকন্যাটি শুয়ে আছে নাগমূর্তির সামনে। যুবতী এখন সম্পূর্ণ নগ্ন। দুই হাত উপরে তুলে, দুলে দুলে এক অদ্ভুত ভাষায় মন্ত্র পড়ছে।
মন্ত্রের ভাষা যদিও পরিচিত। একটু আগেই প্রকাশচন্দ্র এই ভাষার মন্ত্রই জপ করতে বলেছেন বিশুদ্ধকীর্তিকে।
শিশুকন্যার চোখ খুলে গেল হঠাৎ করে। চোখের মধ্যে শুধু অন্ধকার। ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত হাসি। ধীরে ধীরে হাসি আরও প্রসারিত হল। দন্তহীন মুখখানি খুলে গেল।
ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটি জিহ্বা। মানুষের নয়, সাপের!
আর পারলেন না বিশুদ্ধকীর্তি। সমস্ত মানসিক শক্তি সংহত করলেন। চৈতন্যকে স্থির করলেন সহস্রারে। তারপর প্রবল মানসিক শক্তিতে ধীরে ধীরে নিজের চেতনাকে টেনে তুলতে লাগলেন এই অন্ধকারের করাল গ্রাস থেকে। এই তো, একটু একটু করে চেতনা ফিরে আসছে তাঁর। মনে হচ্ছে যেন তমসার গভীর অন্তরাল থেকে ক্রমেই আলোর দিকে ফিরছেন তিনি।
অকস্মাৎ চোখ খুলে গেল বিশুদ্ধকীর্তির। প্রথমে কিছু দেখতে পেলেন না। হৃৎপিণ্ডের মধ্যে সহস্র অশ্বের ক্ষুরধ্বনি। হাত-পা কম্পমান। এই শীতের মধ্যেও সর্বাঙ্গ স্বেদলিপ্ত।
একটু একটু করে দৃষ্টিশক্তি ফিরে এসেছে বিশুদ্ধকীর্তির। সামনের দিকে তাকাতেই ভয়ে আতঙ্কে বোবা হয়ে গেলেন তিনি।
তাঁর পাশে ধ্যানস্থ জিতসেন। চক্ষু মুদ্রিত। শরীর নিস্পন্দ। মনে হচ্ছে যেন মানুষ নয়, একটি প্রস্তরমূর্তি বসে আছে।
বিশুদ্ধকীর্তির ঠিক সামনে প্রকাশচন্দ্র বসে। তিনি তাকিয়ে আছেন বিশুদ্ধকীর্তির দিকেই। তাঁর পাশে বসে থাকার কথা মহারানির।
কিন্তু কোথায় তিনি?
মহারানি নেই। তার বদলে তাঁর আসনে কুণ্ডলীকৃত একটি অতিবৃহৎ, অতি বিশালকায়, মানুষপ্রমাণ কালনাগিনী। তার বিশাল ফণা স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে তাঁদের দিকেই। তার জান্তব এবং রক্তমদির চক্ষুদুটি ক্রূর ও শীতল। সেইদিকে তাকিয়ে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল বিশুদ্ধকীর্তির। সেই নাগিনীর প্রতিটি গাঢ় হিসহিসানি যেন পাতালের বুক থেকে, নরকের আগুন থেকে, সর্বনাশের গর্ভ থেকে উঠে আসছে।
আতঙ্কিত এবং স্তম্ভিত বিশুদ্ধকীর্তির দিকে তাকিয়ে প্রকাশচন্দ্র বললেন, ‘বিশ্বাস করুন আচার্য, আমি চাইনি এই দৃশ্য আপনি দেখুন। কিন্তু কিছু করার নেই। এখন আর ফেরার পথ নেই আমাদের।’
বিশুদ্ধকীর্তির কণ্ঠা দুবার ওঠানামা করল। কোনও স্বর ফুটল না।
উঠে দাঁড়ালেন প্রকাশচন্দ্র। সেই কালনাগিনী উদ্ধত ফণা তাঁর সমান উচ্চতার। তিনি বাম হাতটি নাগিনীর ফণার উপর স্নেহভ’রে রাখলেন। বললেন, ‘আজ আর সত্যিই আমাদের ফেরার পথ নেই আচার্য বিশুদ্ধকীর্তি। আমাদের স্বপ্ন, পরিকল্পনা, যা আমি আর রানি এতদিন ধরে গভীর সংগোপনে লালন করেছি, সবই আজ বিপন্ন। আমার গণনা বলছে, একটা চূড়ান্ত সময় উপস্থিত। আর কালই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।’ সামান্য থামলেন প্রকাশচন্দ্র। ইত্যবসরে একবার জিতসেনের দিকে চাইলেন বিশুদ্ধকীর্তি। নিঃসাড়, নিস্পন্দ দেহ।
‘তাই আজই এই অতি বিশেষ, অতিগূঢ় চক্রের আয়োজন করতে বাধ্য হয়েছি। এর নাম মহানাগিনীচক্র। রানি পরবর্তী অষ্টপ্রহর এই মহানাগিনী অবতারে অধিষ্ঠান করবেন, এই দেহে বা মনুষ্যদেহে। এর মধ্যে তিনি অজেয়া, অযোধ্যা, অপরাজিতা। এই অষ্টপ্রহরের মধ্যে তাঁকে বিনাশ করতে পারে এমন মানুষ, মন্ত্র বা শক্তি ত্রিজগতে নেই।
‘কিন্তু সেই পথে এখনও কিছু ক্রিয়া বাকি।
‘এই মহানাগিনীরূপ ধারণ করতে হলে একটি বিশেষ অর্ঘ্যের প্রয়োজন হয়। তবেই নাগিনীক্ষমতার পূর্ণ বিকাশ ঘটে।’
এতক্ষণে বিশুদ্ধকীর্তির স্বর ফুটল। স্খলিতস্বরে বললেন, ‘কোন অর্ঘ্য প্রভু?’
স্থির চোখে বিশুদ্ধকীর্তিকে দেখলেন প্রকাশচন্দ্র। নাগিনীর ফণা আরও উচ্চ, আরও স্থির, নিষ্কম্প হিসহিসানির শব্দ হয়ে উঠল আরও তীব্র।
‘অনুগত…’
নাগিনীর মুখগহ্বর উন্মুক্ত হল। আদিম জান্তব গন্ধ অসাড় করে দিল বিশুদ্ধকীর্তির নাসারন্ধ্র।
‘ভৃত্যের…’
ফণা সামান্য পশ্চাদগামী হল।
‘দেহকাণ্ড।’
আকস্মিক বিদ্যুৎঝলকে নাগিনীর ফণা নেমে এল স্থির এবং নিস্পন্দ জিতসেনের উপর। পরমুহূর্তেই ফণাটি ঊর্ধ্বমুখী হল৷ বিশুদ্ধকীর্তি বিস্ফারিত নেত্রে এক অপার্থিব দৃশ্য দেখলেন। নির্মল আকাশে চতুর্দশীর চন্দ্রমা। তার প্রেক্ষাপটে কোনও এক আদিম মহাকায় মহানাগ উদরসাৎ করছে তার শিকার। সেই উর্ধ্বোত্থিত নাগমুখে ধীরে ধীরে জিতসেনের মাথা, শরীর এবং শেষে পা’দুখানি অদৃশ্য হয়ে গেল।
এই অবিশ্বাস্য অতিলৌকিক দৃশ্য দেখে হাত পা থরথর করে কাঁপতে লাগল বিশুদ্ধকীর্তির। মনে হল যেন অজ্ঞান হয়ে যাবেন তিনি। তাঁর স্নায়ু আর সুস্থ নেই, তাঁর চৈতন্য বশে নেই।
সেই নাগিনী জিতসেনকে গ্রাস করে কুণ্ডলীকৃত হয়ে বসল। নিমীলিত হল তার ফণা।
প্রকাশচন্দ্র এবার ধীরেসুস্থে এসে বসলেন বিশুদ্ধকীর্তির সামনে। তারপর ধীরস্বরে বললেন, ‘রানি অবশ্য আপনাকেই ভোগ হিসেবে পছন্দ করেছিলেন আচার্য। কিন্তু আমিই আপত্তি করলাম। কেন জানেন?’
বিহ্বলচক্ষে চেয়ে রইলেন বিশুদ্ধকীর্তি।
‘কারণ আনুগত্য প্রশ্নহীন নয় এমন ভৃত্য মহারানির ভোগ হতে পারে না।’
বিশুদ্ধকীর্তির ওষ্ঠ কম্পিত হল মাত্র।
‘মল্ল সিংহোদরকে তো নিশ্চয়ই চেনেন আচার্য। শত হোক, কুমার পদ্মসম্ভবের প্রিয়পাত্র। আপনাদেরও প্রিয়পাত্র। আপাতত তার শরীরের বিভিন্ন অংশ নিয়ে আমাদের সেবকবাহিনী সামান্য ব্যস্ত আছে।’
‘অনেক কথাই অবশ্য সে আমাদের জানিয়েছে। তবে যে অবস্থায় তাকে দেখে এসেছি, খুব সম্ভবত বাকি কথা বলার অবস্থায় সে আর নেই। অগত্যা, রানির ভোগ হওয়ার সৌভাগ্য আর আপনার কপালে জুটল না।’
এই বলে স্মিতহাস্যে বিশুদ্ধকীর্তির সামনে এসে বসলেন প্রকাশচন্দ্র। বললেন, ‘নিন, প্রথম থেকেই শুরু করুন দেখি। তারা এই মুহূর্তে সদলবলে কোথায় আছে?’
এতক্ষণ পর এই প্রথম স্বর ফুটল আচার্য বিশুদ্ধকীর্তির। ক্ষীণকণ্ঠে বললেন, ‘শালিবন বিহারে।’
.
‘আপনি সঠিক বলছেন এই পরিকল্পনায় বিপদের কোনও আশঙ্কা নেই?’
‘না যোগীবর, এর থেকে প্রকৃষ্ট সুযোগ আর পাবেন না। কাল পূর্ণিমা, মহারানির কামনাতৃপ্তির দিন। কাল প্রভাত থেকেই ঘোষকের দল কর্মান্তবাসক জুড়ে সমর্থ যুবকের সন্ধানে বেরিয়ে পড়বে। এদিকে প্রকাশচন্দ্র আজ প্রভাতে রওনা দেবেন হরিকেলের উদ্দেশে। আপনার পরিকল্পনায় সৈন্যদলের বৃহদংশ অন্যত্র ব্যস্ত। অর্থাৎ কর্মান্তবাসক প্রকৃতপক্ষে অরক্ষিত। এই সুযোগে মহাবীর গোপাল রাজ্যার্থী হয়ে মহারানির শয়নকক্ষে প্রবেশ করে তাঁকে হত্যা করুন। আর আমাদের বাকি সহকর্মীরা না হয় কর্মান্তবাসকের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করুন।’
রাত্রির শেষ প্রহর। শালিবন বিহারের গুপ্তকক্ষে অধিবেশনে বসেছেন বিপ্লবের সমস্ত অধিকর্তারা। আচার্য বিশুদ্ধকীর্তি একটু আগেই ফিরেছেন চক্রানুষ্ঠান থেকে। এসেই তিনি এই পরিকল্পনা জানিয়েছেন। তাঁর মতে, কালই চূড়ান্ত আক্রমণের প্রকৃষ্টতম তিথি। তিনি চান কালই যেন চূড়ান্ত আক্রমণ করা হয়।
সমস্ত কিছু মনে মনে একবার পর্যালোচনা করে নিলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ। তারপর বপ্যটের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘আর্য বপ্যট, আপনার বাহিনী প্রস্তুত তো?’
অরণ্যবাসী কিরাত এবং শবরদের প্রশিক্ষণ দিয়ে একটি গুপ্তবাহিনী প্রস্তুত করেছেন বপ্যট। তাদের কর্মক্ষমতা শান্তঘোষ এবং আনন্দগুপ্ত বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে একবার প্রমাণিত হয়ে গেছে। তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ লোকেশ্বর, আমরা প্রস্তুত।’
‘কুমার জয়াপীড়, কুমার পদ্মসম্ভব, আপনাদের কী মত?’
জয়াপীড় বললেন, ‘আমি অনেকদিন থেকেই প্রস্তুত। আপনার অনুমতি পেলেই হয়।’
পদ্মসম্ভব ইতস্তত করছিলেন। সেই দেখে মৎস্যেন্দ্রনাথ প্রশ্ন করলেন, ‘কিছু বলবেন কুমার?’
পদ্মসম্ভব বললেন, ‘আমাকে ক্ষমা করবেন আপনারা, আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলছে—আমাদের আরও ধৈর্য ধরা উচিত। কোথাও যেন কিছু একটা ঠিক হচ্ছে না।’
‘কী ঠিক হচ্ছে না আর্য?’
‘বেশ কিছু লক্ষণ সুসঙ্গত নয়। আপনার কি মনে হচ্ছে না লোকেশ্বর, যে সব কিছুই বড় সহজে হয়ে যাচ্ছে? মনে হচ্ছে না, যেন বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা অতি যত্নসহকারে আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে?’
‘এমত মনে হওয়ার কারণ?’
‘আছে যোগীশ্বর, এবং তার স্বপক্ষে আমার কিছু যুক্তিও আছে।’
‘যেমন?’ প্রশ্ন করলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ।
‘প্রথমত, প্রকাশচন্দ্র জানেন যে বস্তুতপক্ষে তাঁর রাজধানী অরক্ষিত। বিদ্রোহীরা যে শুধু প্রবল প্রতাপে উদ্যত তাই নয়, তারা কর্মান্তবাসকেই কোথাও আত্মগোপন করে আছে। তিনি নিশ্চয়ই জানেন যে, যে-কোনওদিন, যে-কোনও মুহূর্তে আঘাত নেমে আসতে পারে। তবুও তিনি প্রভাতে কর্মান্তবাসক ত্যাগ করছেন? এত আশঙ্কা মাথায় নিয়েও?’
কেউ কোনও উত্তর দিলেন না। বিশুদ্ধকীর্তির বুক কাঁপছে।
‘দ্বিতীয়ত, মল্ল সিংহোদরের কাল থেকে কোনও সন্ধান নেই। আমি জেনেছি, গতকাল সন্ধ্যাবেলার সামান্য পূর্বে সে তার গুপ্তগৃহ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। কারণ অজানা। তারপর থেকে থেকে তার আর কোনও সন্ধান নেই।
‘তৃতীয়ত, আচার্য বুদ্ধগুপ্তরও কোনও সংবাদ নেই অনেকদিন। সে বিষয়ে আমরা অনেকেই অন্ধকারে। তিনি আমাদের অন্তরঙ্গ গোষ্ঠীর একজন। যদি বুদ্ধগুপ্ত এবং সিংহোদর ইতিমধ্যেই শত্রুপক্ষের দ্বারা ধৃত হয়ে থাকেন, তবে?’
সভাস্থ প্রত্যেকে চুপ করে রইলেন। বিশুদ্ধকীর্তির হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হল।
‘চতুর্থত, আমরা জানি যে মহারানি সপ্তরাজন্য পরিবেষ্টিত হয়ে এই বঙ্গভূমি শাসন করেন। তাঁদের মধ্যে প্রকাশচন্দ্রকে বাদ দিলে বাকি থাকেন ছয় জন। তাঁদের মধ্যে আচার্য স্বয়ং একজন। বাকি পাঁচজনের মধ্যে শান্তঘোষ আর আনন্দগুপ্তর নিহত হওয়ার সংবাদ আমরা জানি। কিন্তু বাকি তিন জন, অমিতাভভট্ট, অগ্নিমিত্র এবং জিতসেন কোথায় আছেন, কী করছেন, সে সংবাদ আমরা জানি না। যদি শত্রুপক্ষের এই আপাত উদাসীনতা কোনও ষড়যন্ত্র হয়? যদি এমন হয় যে তাঁরা অপেক্ষা করে আছেন আমাদের এই ভুল পদক্ষেপের জন্য?’
পদ্মসম্ভবের বক্তব্য শেষ হলে সভাস্থলে অস্বাভাবিক নৈঃশব্দ্য নেমে এল। প্রত্যেকে পদ্মসম্ভবের প্রতিটি বক্তব্যের যুক্তি বিচার করে দেখছেন।
মৃদু কেশে গলা পরিষ্কার করলেন বিশুদ্ধকীর্তি, ‘মল্ল সিংহোদরের অন্তর্ধানের ব্যাপারে কিছু বলতে পারব না। তবে কুমার পদ্মসম্ভবের অন্য তিনটি প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে আছে।
‘আপনারা নিশ্চয়ই প্রকাশচন্দ্রের একদা ঘনিষ্ঠতম সহযোগী চারুদত্তর ব্যাপারে অবগত আছেন। রাজমাতা কাঞ্চনাদেবীর ব্যাপারে বিশদে তিনিই জানিয়েছিলেন আমাদের। জানিয়েছিলেন তাঁকে উদ্ধারের পথও।
‘আজ সন্ধ্যায় হরিকেল থেকে এক বিশেষ বার্তাবহ কর্মান্তবাসকে এসে পৌঁছেছে। সে জানিয়েছে, কয়েকদিন পূর্বে চারুদত্তর দেহাবসান ঘটেছে। তাঁর উপাধান থেকে একটি গোপন ভূর্জপত্র উদ্ধার হয়েছে। রক্ষীদলের মনে হয়েছে পত্রটি প্রকাশচন্দ্রের উদ্দেশে, এবং অত্যন্ত গোপন বিষয়ে লিখিত। সেই সংবাদ পেয়েই প্রকাশচন্দ্র দ্রুত হরিকেল রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন।
‘সপ্তরাজন্য’র অপর তিনজনের ব্যাপারে কুমার পদ্মসম্ভব যে প্রশ্ন তুলেছেন তা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত এবং প্রাসঙ্গিক। অত্যন্ত গোপন সূত্রে আমি সংবাদ পেয়েছি যে অগ্নি মত্র, অমিতাভভট্ট, এবং জিতসেন, তিনজনই এইমুহূর্তে মৃত। কোথায়, কেন, কীভাবে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা আমি দেব না, দেওয়া সম্ভব নয়। আপাতত আমার কথা সত্য বলে মেনে নিতে সমবেত ভদ্রমণ্ডলীকে অনুরোধ করছি।’
আচার্য বিশুদ্ধকীর্তির বক্তব্য শেষ হলে সভাস্থলে আবার নিস্তব্ধতা নেমে এল। মনে হল প্রত্যেকে শেষ সংবাদটির অভিঘাত সম্যকরূপে গ্রহণের চেষ্টা করছেন।
জয়াপীড় স্বভাবে কিঞ্চিৎ চঞ্চল। সবার প্রথমে তিনিই প্রশ্ন করলেন, ‘কী বলছেন কী আচার্য? এই তিনজন মৃত? আপনি সত্য বলছেন?’
বিশুদ্ধকীর্তি কঠিন দৃষ্টিতে জয়াপীড়ের দিকে তাকালেন, ‘আমার আহরিত সংবাদের যাথার্থ্যতা নিয়ে কি আপনার মনে কোনও শঙ্কা আছে কুমার?’
জয়াপীড় অপ্রতিভ হলেন, ‘না, তা নয়। সংবাদটি এতই আকস্মিক যে সামান্য বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। প্রগলভতা মার্জনা করবেন।’
বপ্যট বললেন, ‘কিন্তু আচার্য, সেক্ষেত্রে তো বিষয়টি আরও গুরুতর হয়ে দাঁড়ায়। যে সংবাদ আপনি জানেন, আশা করি তা প্রকাশচন্দ্রেরও অগোচরে নেই। সপ্তরাজন্য’র মধ্যে পাঁচজন মৃত, রাজধানী প্রকৃতপক্ষে অরক্ষিত, তা সত্বেও তাঁকে আজই কর্মান্তবাসক ত্যাগ করতে হল?’
বপ্যটের প্রশ্নের মধ্যে সন্দেহের সুরটি বিশুদ্ধকীর্তির কানে বাজল। তাঁর হৃৎস্পন্দন দ্বিগুণ বর্ধিত হয়েছে। অকম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘আমি যা সত্য বলে জানি তাই আপনাদের জানালাম, আর্য বপ্যট। আমার মতে কালই চূড়ান্ত আঘাত হানবার প্রকৃষ্ট সময়। এখন যোগীশ্বর মৎস্যেন্দ্রনাথ যা আদেশ করেন।’
সভার এক প্রান্ত থেকে দেদ্দদেবীর তরুণীকণ্ঠ ভেসে এল, ‘আচার্য, আপনার প্রিয়তম শিষ্য বুদ্ধগুপ্ত কোথায়?’
সামান্য অস্বস্তির সঙ্গে উত্তর দিলেন আচার্য, ‘এই প্রশ্নের উত্তর দিতে কিঞ্চিৎ সঙ্কোচ বোধ করছি আর্যা দেদ্দদেবী। কারণটি হৃদয়বিদারক।’
মন্দর্ভা কৌতূহলী হলেন, ‘কী কারণ আচার্য?’
‘বুদ্ধগুপ্ত পথভ্রষ্ট হয়েছে। তাকে আমি বিশেষ স্নেহ করতাম। আমার অবর্তমানে সেই হতো শালিবন বিহারের আচার্য। কিন্তু, সে কামনার আগুনে নিজের ইহকাল পরকাল নষ্ট করেছে৷’ এত অবধি বলে সামান্য থামলেন বিশুদ্ধকীর্তি। তারপর গভীর আক্ষেপের সঙ্গে বললেন, ‘শুনেছি ভাঁড়ুদত্তর শৌণ্ডিকালয়ের মায়া নামের জনৈক বারাঙ্গনার সঙ্গে সে পলাতক। সংবাদ পেয়েছি তারা বারেন্দ্রীর দিকে গেছে।’
জয়াপীড় হতাশার সুরে বললেন, ‘যাহ, মায়া চলে গেল।’ কথাটি বলেই জয়াপীড়ের চোখ পড়ল মন্দর্ভার দিকে। তিনি কঠিন চোখে তাঁর দিকেই চেয়ে আছেন। ঢোঁক গিলে চুপ করে গেলেন জয়াপীড়।
কুমার পদ্মসম্ভব এবং দেদ্দদেবী মুখে স্মিত হাসি দেখা গেল। পদ্মসম্ভব ছদ্ম সহানুভূতির সুরে বললেন, ‘দুঃখ কোর না ভাই। বঙ্গদেশে এমন সুস্তনী কিঙ্কিণীর অভাব নেই। আমি নিজেই কয়েকজনকে চিনি। তাদের সঙ্গে নাহয় পরে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব।’ বলেই তিনি হাসিমুখে দেবী মন্দর্ভার দিকে তাকালেন। মন্দর্ভার দৃষ্টি স্থির, কঠিন এবং অগ্নিবর্ষী।
দেদ্দদেবী একবার কুমার পদ্মসম্ভব আর একবার ভিক্ষুণী মন্দর্ভার দিকে তাকালেন। তারপর বস্ত্রাঞ্চল মুখে দিয়ে হাসি চাপলেন।
মৎস্যেন্দ্রনাথ বিরক্তস্বরে বললেন, ‘এই কি পরিহাসের সময়? এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে চলেছি, আর আপনাদের এই প্রগলভ আচরণ?’
সভাস্থলে গাম্ভীর্য ফিরে এল। বপ্যট বললেন, ‘লোকেশ্বর, তাহলে শেষাবধি কী সিদ্ধান্ত নিতে চলেছি আমরা? আপনার কী অভিমত এই পরিকল্পনার ব্যাপারে?’
উঠে দাঁড়ালেন মহাযোগী মৎস্যেন্দ্রনাথ। ধীরে ধীরে গিয়ে দাঁড়ালেন বাতায়নের সামনে। তাঁর দিকে উৎকণ্ঠিত মুখে তাকিয়ে রইলেন কয়েকজন নারী এবং পুরুষ, যাঁরা নিজেদের জীবন পণ করে নেমেছেন এই মহাসংগ্রামে। মুঠোয় ধরেছেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর উদ্যত ফণা। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসায় উৎসর্গ করেছেন নিজেদের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ–সব কিছু।
স্বচ্ছ আকাশের দিকে নির্নিমেষে তাকিয়েছিলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ। রাত্রি শেষপ্রায়। চতুর্দশীর চন্দ্রজোছনা এখন ম্লান। লালিম্ববন পাহাড়ের ঘনকৃষ্ণ অরণ্য সেই দুগ্ধধবল আলোয় ভারি আশ্চর্য, ভারি মায়াবী দেখাচ্ছে।
সেইদিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ। এতদিন ধরে বহু প্রযত্নে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন তিনি, প্রস্তুত করেছেন এক মহাবিদ্রোহের পটভূমি, কালই হয়তো তার অন্তিমক্ষণ উপস্থিত। এই দুখিনী, বঙ্গদেশের শতাব্দীব্যাপী দুঃশাসনকাল হয়তো কালই শেষ হবে।
কিন্তু যদি না হয়? যদি তাঁদের প্রস্তুতিতে কোথাও কোনও ত্রুটি থেকে থাকে? যদি তাঁদের পরিকল্পনায় এমন কোনও বিচ্যুতি থেকে যায়, যা তাঁরা লক্ষ করেননি?
পিছনে দাঁড়ান শ্রান্ত, উদ্বিগ্ন এবং উৎকণ্ঠিত মুখগুলি মনশ্চক্ষে ভেসে উঠল মৎস্যেন্দ্রনাথের। এদের অধিকাংশই তাঁর সন্তানসম, কেউ বা তাঁর বয়স্য সহযোগী। তাঁর একটি সিদ্ধান্ত, তাঁর একটি হ্যাঁ বা না এদের এতদিনের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দিতে পারে। নিমেষে নস্যাৎ করতে পারে এদের এতদিনের উদ্যোগ।
তাঁর সিদ্ধান্ত। একমাত্র তাঁরই সিদ্ধান্ত।
দুই কর যুক্ত করলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ। পদ্মপলাশতুল্য চোখ দুটি নিমীলিত হল। ভগবান তথাগত বলে গেছিলেন আত্মদীপ ভব, আত্মশরণ ভব, অনন্যশরণ ভব। নিজেই নিজের প্রদীপ হয়ে জ্বলে ওঠো, নিজেই নিজের আত্মশক্তির শরণ নাও। মানুষ নিজেই এক অনন্তশক্তির উৎস। সে চাইলে নিমেষে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল এই ত্রিভুবনের অধীশ্বর হতে পারে। মানুষই পারে মানুষের দুঃখকষ্ট মোচন করতে। মানুষই পারে দুর্দম শত্রুর কবল থেকে জীবন পণ রেখে জননীকে, জন্মভূমিকে উদ্ধার করতে। কোনও ঐশী বা দৈবশক্তি নয়, মানুষই মানুষের একমাত্র আশ্রয়, শেষ অবলম্বন।
ব্রাহ্মমুহূর্ত আগতপ্রায়। পুবদিগন্তে আবছায়া আলোর খেলা। জবাকুসুমসঙ্কাশ সূর্যদেব উদিত হতে চলেছে। সেদিকে তাকিয়ে যুক্তকর মাথায় ঠেকালেন তিনি। হে আদিনাথ, হে পূর্ণেশ্বর, হে আমার বৈরাগ্যসুন্দর, তোমার সন্তানদের তুমি আশীর্বাদ করো। তাদের স্বপ্নগুলি যেন সার্থক হয়। এই জগতের সমস্ত অন্ধকার, সমস্ত পাপ, সমস্ত অশিব পেরিয়ে তারা যেন জয়যুক্ত হয়, সদ্ধর্মপথযাত্রী হয়। হে নাথ, অপাবৃত হোক তোমার কল্পতরু মূর্তি। তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক প্রভু।
ঘুরে দাঁড়ালেন মহাযোগীশ্বর মৎস্যেন্দ্রনাথ। যে বরাভয়মূর্তি দেখে আসমুদ্রহিমাচল তাঁর শরণাগত হয়েছে, সেই মূর্তি ধারণ করলেন তিনি। বামহাতখানি পদ্মমুদ্রায় বক্ষলগ্ন। দক্ষিণহস্তে মৃগমুদ্রা। তার তর্জনী এবং কনিষ্ঠা প্রসারিত, অন্যান্য অঙ্গুলিগুলি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে বদ্ধ। চোখ দু’খানি অবলোকিত।
উপস্থিত সভ্যরা শিহরিত হলেন। মুহূর্তের মধ্যে তাঁরা প্রণত হলেন মহাযোগী লোকেশ্বর মৎস্যেন্দ্রনাথের পদপ্রান্তে। মৎস্যেন্দ্রনাথ বললেন, ‘তোমাদের জয় হোক।’
সভ্যরা হর্ষোল্লাস করে উঠলেন। কালই সেই দিন। শতাব্দীব্যাপী মাৎস্যন্যায় থেকে বঙ্গদেশের মুক্তির দিন।
.
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন