অভীক সরকার
আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুঞ্চিত হল প্রহরীর৷ আসার কথা তো ঘনরাম আর তার ছোট ভাইয়ের। এই কুটিরটি তারাই পরিষ্কার করে দিয়ে যায় প্রতি সপ্তাহে একবার। তাদের বদলে এরা কারা? এদের তো কখনও দেখা যায়নি।
হরিকেলের এই নিরালা অরণ্যের মধ্যে মানুষের চলাচল এমনিতেই কম। একদিকে পূর্বসমুদ্র, আরেকদিকে ঘন তালতমাল-বনরাজিনীলা। অরণ্যের এই অংশে সাধারণ মানুষের চলাচলের ওপর কঠিন নিষেধাজ্ঞা আছে৷ কমন্তিবাসকের বিশেষ অনুমতিপত্র ছাড়া এখানে কারও আসা নিষিদ্ধ।
তার কারণ এখানে একটি পর্ণকুটিরে কঠিন প্রহরায় থাকেন বঙ্গদেশের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বন্দি।
আজ থেকে নয়, প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে থেকে।
অরণ্য শেষ হলে বালুরাশি। তারপরে সমুদ্র। পূর্বসমুদ্রের লবণাক্ত বাতাস সদা সর্বদাই বয়ে যায় অরণ্যের মধ্য দিয়ে। স্থানটি অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। শীতকাল ছাড়া স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া। গ্রীষ্মকালে তো সাক্ষাৎ নরক। রোগব্যাধি লেগেই আছে।
এই অঞ্চলেই রয়েছে এক প্রশস্ত পর্ণকুটির। সেখানে থাকেন একজন নবতিপর বৃদ্ধ। শীর্ণ, শুষ্ক, এবং লোলঅস্থিচর্মসার এই মানুষটিকে দেখে বোঝা অসম্ভব যে আজ থেকে প্রায় অর্ধশতক পূর্বে এঁর অঙ্গুলিহেলনেই বঙ্গদেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হতো।
রক্ষীটি গম্ভীরস্বরে প্রশ্ন করে, ‘কে তোমরা?’
আগন্তুক দুজনের কটিদেশে ছিন্ন অধোবাস, ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। ধূলিধূসরিত অঙ্গে, পিঙ্গল জটাজূটকেশে ক্লিষ্ট মুখায়বে দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। প্রথমে যে দাঁড়িয়ে আছে তার শরীরখানি সবল এবং ঋজু। দ্বিতীয়জন অপেক্ষাকৃত খর্ব এবং দুর্বল। তার হাতে একটি বড় মাটির কলস।
প্রথমজন সঙ্কুচিত হয়ে বলল, ‘ক্ষমা করবেন আজ্ঞে, আজ আমাদের ঘর পরিষ্কার করার দিন কি না তাই এসেছি। ভিতরে যাওয়ার অনুমতি দিন প্রভু।’
রক্ষীটি একবার সতর্ক চোখে চারিদিক দেখে নিল। সমুদ্রের দিকে প্রহরা কিঞ্চিৎ শিথিল। স্বাভাবিক। গত অর্ধশতক ধরে ওই পথে কেউ এসে নামেনি এই হতভাগ্য বৃদ্ধকে উদ্ধার করার জন্য। সেইদিকের প্রহরীরা বালুতটে বিশ্রাম নিচ্ছে। অন্যদিকেও দূরে দূরে প্রহরারত বাকি প্রহরীরা মাটিতে বসে সামান্য ঝিমিয়ে নিচ্ছে। এতদিনের অনভ্যাস সবার আচরণেই শৈথিল্য এনে দিয়েছে।
‘সে তো ঘনরাম আর তার ভাই এসে করে দিয়ে যায়। তোরা কে?’
‘আজ্ঞে আমার নাম ঠগন, আর আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার নাম কাহ্ন।’
‘সে তো বুঝলাম। কিন্তু তোদের তো আসার কথা নয়।’
দুজনের মধ্যে যে অপেক্ষাকৃত বয়স্ক, সে কম্পিতহস্তে বলল, ‘আমরা ঘনরামের আত্মীয় আজ্ঞে। ওদের মা মরে গেল তো দুদিন আগে৷ তাই ঘনরাম বলল, ‘ওরে কাহ্ন, দেশের বাড়ি যেতে হবে। এই কাজটা করে দিস বাপধন।’
রক্ষীটি হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, ‘রসিকতা হচ্ছে আমার সঙ্গে? এ কী সাধারণ ভদ্রাসন যে অমুকের পরিবর্তে তমুক কাজ করে দিয়ে যাবে? কোথায় এসেছিস জানিস তোরা?’
আগন্তুক দুজনে হতভম্বের মতো একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।
‘তোদের এতদূর আসতে দিল কে? অরণ্যের বাইরে তো প্রহরীদল রয়েছে। তারা আটকায়নি তোদের?’
‘আটকেছিল প্রভু৷ তবে আদেশপত্র দেখে ছেড়ে দিল।’
‘আদেশপত্র দেখা।’
বয়স্কব্যক্তিটি নোংরা ধূলিধূসরিত অধোবাসের ভিতর থেকে একটি আদেশনামা বার করে দিল। রক্ষীটি সেটি পড়তে শুরু করলেন।
যতক্ষণ রক্ষীটি সেই আদেশনামা পড়ছিলেন, ততক্ষণ যদি কেউ দুই আগন্তুকের মুখের ভাব লক্ষ করত তাহলে দেখতে পেত অন্য চিত্র।
রক্ষীটি অত্যন্ত সতর্কচোখে আদেশপত্রটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করছিল। তাদের ওপর আদেশ এসেছে প্রহরা আরও কঠিন করার জন্য। সারা দেশে নাকি রাজদ্রোহের প্রচেষ্টা চলছে। কাণাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে এর পেছনে নাকি প্রশাসনের কয়েকজন পাকা মাথার লোক আছে।
আদেশপত্রটি ভালো করে পরীক্ষা করার পর নিশ্চিত হল রক্ষী। উচ্চৈঃস্বরে ডাকল, ‘কেতকদাস, এদের ভেতরে নিয়ে যাও।’
এক রক্ষী বাইরে বেরিয়ে এল। নিদ্রাতুর স্বরে বলল, ‘এরা আবার কারা?’
‘এরা কুটির পরিষ্কার করতে এসেছে।
‘সে তো ঘনরাম আর তার ভাই আসে। এরা কারা?’
প্রথম রক্ষীটি বিরক্তস্বরে বলল, ‘এরা ঘনরাম আর তার ভাইয়ের পরিবর্তে এসেছে। সঙ্গে প্রতীহারের স্বাক্ষরিত আদেশপত্রও এনেছে৷ অনর্থক প্রশ্ন না করে এদের ভেতরে নিয়ে যাও।’
কেতকদাস বিরস বদনে বলল, ‘চল রে, তোদের ঘরগুলো দেখিয়ে দিই। নাম কী তোদের?’
খর্বকায় আগন্তুক জড়োসড়ো হয়ে বলল, ‘আজ্ঞে আমার নাম ঠগন, আর ওর নাম কাহ্ন।’
এমন অদ্ভুত নাম শুনে কেতকদাস হো হো করে হেসে উঠল। ব্যঙ্গ করে বলল, ‘পিতামাতা নাম রেখেছিলেন বটে একখানা। তা ঠগন মহাশয়, হাতের ওই কলসটা নামিয়ে রেখে স্থির হয়ে দাঁড়ান তো। আপনাদের শারীরিক পরীক্ষাটুকু হয়ে যাক।’
দুজনের শরীরের বিভিন্ন স্থানে হাত দিয়ে যখন লুকোনো অস্ত্র বা আপত্তিকর কিছুই পাওয়া গেল না তখন কেতকদাসের নজর গেল কলসটার দিকে।
‘কী আছে ওতে?’
‘আজ্ঞে কিঞ্চিৎ মৈরেয় আছে। ঘর পরিষ্কার অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজ কি না। তাই ভাবছিলাম কাজ শেষ হলে দুই ভাই মিলে একটু মৈরেয় পান করব। এই আর কি?’
রক্ষীদুজনের চোখে চোখে কথা হয়ে গেল। কেতকদাস গম্ভীরস্বরে বলল, ‘তোরা জানিস, এখানে সুরা নিয়ে আসা কত গর্হিত অপরাধ?’
‘না তো প্রভু।’
অন্য রক্ষীটি বলল, ‘জানিস, এর জন্য তোদের কারাবাস হতে পারে?’
‘অথবা সপরিবারে নির্বাসন।’
‘এমনকী প্রাণদণ্ড হওয়াও বিচিত্র নয়!’
আগন্তুক দুজনের চোখেমুখে বিচিত্র ছায়া খেলে গেল। কাহ্ন বলল, ‘ভুল হয়ে গেছে প্রভু। অপরাধ মার্জনা করে দিন।’
‘ভুল?’ দুই রক্ষী একত্রে গর্জে ওঠে, ‘এই গর্হিত অপরাধের মার্জনা? ওসব ভুলে যা পামর। বরং মুণ্ডচ্ছেদ বা শূলারোহন, কোনটা তোদের পছন্দ সেটা বেছে নে।’
হাউ-হাউ করে কেঁদে ওঠে ঠগন, ‘হায়-হায়, না জেনে কী ভুল করে ফেললাম। ক্ষমা করুন প্রভু, ক্ষমা৷ এই কলস আমি এই মুহূর্তেই ভেঙে ফেলছি।’
প্রথম রক্ষী হাঁ-হাঁ করে ওঠে, ‘আরে না না, একদম না। ওসব ভেঙে ফেলার চিন্তা মাথাতেও যেন না আসে। ব্যাপারটা বিস্তারিত ভাবে পর্যালোচনা করে দেখার জন্য ওটা আমাদের নিয়ে নিতে হবে যে। নইলে তোদের অপরাধ প্রমাণ করব কী করে?
‘দয়া করুন প্রভু। কিছু একটা উপায় বার করুন৷ যাতে গরিবের প্রাণ রক্ষা হয়।’
‘আহ, গোল করিসনি। ব্যাপারটা ভেবে দেখতে দে। ভায়া কেতকদাস, দুখানি পাত্র জোগাড় করে আনো দেখি। আমার কেমন যেন মনে পড়ছে, সুরার স্বাদ তেমন উৎকৃষ্ট হলে অল্প শাস্তির ওপর দিয়ে নিষ্কৃতি পাওয়ার একটা উপায় বোধহয় আছে।’
ইতস্তত করে কাহ্ন নামের লোকটি, ‘আপনারা কি এখন এই মদিরা পান করবেন প্রভু?’
‘আহা, ওকে পান করা বলে না। বলে পর্যালোচনা। বুঝেছিস?’
‘বুঝেছি প্রভু।’
‘কী বুঝলি?’
‘আজ্ঞে…’
‘পর্যালোচনা। এই তো ঠিক ঠিক বুঝে ফেলেছিস।’
‘তা, বলছিলাম কি প্রভু, এই পর্যালোচনা না কী একটা বললেন, তারপর কি কিছু আশা থাকলেও থাকতে পারে?’
‘সেটা অবশ্য নির্ভর করছে সুরার উৎকৃষ্টতার উপর।’
‘মানে দেশের বিধান বাঁচিয়ে…’
‘আহা, বিধান থাকলে তার প্র, পরা, অপ, সম, উপ, এসবও তো আছে। মেলা গোল করিসনি, ব্যাপারটা আমাদের ভেবে দেখতে দে।’
ঠগন ভয়ে ভয়ে বলল, ‘আরও একটি কলসি সঙ্গে রয়েছে প্রভু। কিছু দূরে রেখে এসেছি। আপনারা অনুমতি করলে বিস্তারিত পর্যালোচনার জন্য সেটাও নিয়ে আসতে পারি।’
প্রথম রক্ষী চাপা উল্লাসের সঙ্গে বলল, ‘বটে? নিয়ে আয় দেখি। এক কলসির বদলে দু’কলসি উৎকৃষ্ট সুরায় অপরাধ অর্ধেক হয়ে যায় বলেই তো মনে হচ্ছে?’
কেতকদাস বলল, ‘সে তো বটেই।’
ঠগন ভয়ে ভয়ে বলল, ‘আর আরও চার কলসি সুরায়?’
রক্ষী দুইজন স্থির চোখে তাকিয়ে রইল।
কাহ্ন ইতস্তত করে বলল, ‘অরণ্যের বাইরে আমাদের গরুর গাড়িটি রেখে এসেছি প্রভু। ভেবেছিলাম কাজ শেষ হলে বস্তিতে ফিরে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে বসে একটু, ওই আর কি…পর্যালোচনা।’
প্রথম রক্ষী গম্ভীরস্বরে বলল, ‘ভাই কেতকদাস।’
‘বলো ভাই।’
‘আরও চার কলসি সুরায়?’
‘অপরাধ সম্পূর্ণ রূপে নির্মূল হয়।’
‘তাহলে আপাতত কিংকর্তব্যম?’
কেতকদাস তার হাতের ভল্ল দিয়ে ঠগনের পেটে একটি খোঁচা মেরে বলল, ‘গাড়িটা আমরাই এখানে নিয়ে আসছি, বুঝলি। আর তুই আপাতত আমাদের এই সুরা পর্যালোচনার কাজে একটু সাহায্য কর। এই কাহ্ন না কে, সেই বরং ঘর পরিষ্কারের পুরো কাজটা করুক। আমরা বাকি রক্ষীদের ডেকে আনি। পর্যালোচনা কি আর যেমন তেমন ব্যাপার রে?’
দুজনেই শশব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গেল বাকিদের ডেকে আনার জন্য। চারিদিক ফাঁকা দেখে সিদ্ধ ঠগনপা নিম্নস্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘লোকেশ্বর মিথ্যা আদেশপত্রটি কোথা থেকে পেলেন? আশ্চর্য কাণ্ড? এমন চমৎকার নকল তো আমিও করতে পারি না।’
আচার্য কাহ্নপা চাপাস্বরে বললেন, ‘মিথ্যা কেন হবে ভাই? এই আদেশনামা সর্বাংশে সত্য।’
ঠগনপা সপ্রশ্নচোখে তাকালেন। কাহ্নপা একচোখ টিপে বললেন, ‘হরিকেলের মহামাত্য জয়নাথ আমাদের সহায়, আগেও একবার বলেছি তোমাকে। তোমার বোধহয় স্মরণে নেই।’
‘কিন্তু এই বৃদ্ধ’র কাছে এত ঝুঁকি নিয়ে আসার কারণ কী ভ্রাতা?’
‘আছে আছে। কাজ শেষ হোক। যেতে যেতে বলব। জানো তো চূড়ান্ত আঘাতের আগে শত্রুর গোপন, দুর্বলতম স্থানগুলির ব্যাপারে সব তথ্য একত্র করতে হয়।’
‘কিন্তু ইনি তো…’
‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু, এই আপ্তবাক্যে বিশ্বাস রাখো তো ভায়া! আরও জেনে রাখো, যদি ঘনিষ্ঠতম বন্ধু, পাপের ভাগীদার, শত্রু হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তার মতো ক্ষতি আর কেউ করতে পারে না।’
‘কিন্তু ইনি যে আমাদের সহায়তা করবেন তার নিশ্চয়তা কী?’
‘নেই। কোনও নিশ্চয়তা নেই। সেই জন্যেই তো লোকেশ্বর তোমাকে আমাকে পাঠিয়েছেন এই কাজে। আমাদের সাফল্যের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে ভাই। দেখো যেন কোনও ভুলচুক না হয়।’
ততক্ষণে উৎসাহী রক্ষীদের একাংশ এগিয়ে এসেছে। তাদের দুজন ঠগনপা’কে নিয়ে বেরিয়ে গেল মৈরেয়কলসপূর্ণ গরুর গাড়ির সন্ধানে। কেতকদাস কাহ্নকে ভেতরে নিয়ে গেলেন।
.
অন্ধকার ঘর। ঘরের ঠিক মধ্যস্থানে একটি ত্রিপদী। তার ওপর একটি দীপ জ্বলছে। দীপটিকে ঘিরে বেশ কয়েকজন পুরুষ বসে আছেন। তাদের কারও মুখ স্পষ্ট দেখা না গেলেও পোশাকে, অলঙ্কারে এবং ব্যক্তিত্বে বোঝা যায় যে এঁরা কেউ সাধারণ নন।
স্থানটি জাহোরের এক পরিত্যক্ত প্রাসাদ। এককালে এখানে এক সম্পন্ন ভূস্বামী বাস করতেন। পার্শ্ববর্তী রাজ্য সমতটের মহাপ্রতাপশালী সামন্ত অনন্তঘোষের আক্রমণে তাঁর রাজত্ব ছারেখারে যায়। ভূস্বামীটি সপুত্র নিহত হন। তাঁর স্ত্রী এবং পুত্রবধূ নিরুদ্দেশ হয়ে যান। প্রাসাদটি অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করা হয়।
সেই পরিত্যক্ত, ভগ্নস্তূপ প্রাসাদে বহুদিন পরে আবার দীপালোক জ্বলে উঠেছে। তবে সেই দীপালোক গৃহস্থালীর আনন্দের নয়, বরং গুপ্ত ষড়যন্ত্রের।
ঘরটির গবাক্ষ অস্থায়ী বস্ত্রে ঢাকা। প্রাসাদের বিভিন্ন স্থানে সতর্ক প্রহরা। অচেনা কাউকে এদিকে আসতে দেখলেই পাখির শিসের শব্দে জানান দেওয়া হবে।
প্রথমে কথা বললেন এক প্রৌঢ় পুরুষ, ‘মহর্ষি, উপস্থিত অভ্যাগতদের আজকের এই সভার আহ্বানের উদ্দেশ্য জানানো হোক।’
উঠে দাঁড়ালেন মৎস্যেন্দ্রনাথ, ‘উপস্থিত মহামান্য সামন্তবর্গ এবং গৌড়নরেশ জয়ন্তকে ধন্যবাদ জানাই এই সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য। আপনারা প্রত্যেকেই শক্তিশালী, প্রভাবশালী এবং কৃতবিদ্যপুরুষ। প্রত্যেকেই স্বরাজ্যে সম্রাট। আপনাদের মধ্যে যে কেউ এই সভার আহ্বায়ক হতে পারতেন। তা সত্বেও এই পরিত্যক্ত প্রাসাদে এই সভা আহ্বান করার পেছনে তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য আছে। প্রথমত, আমরা যে মহতী ধর্মযুদ্ধে ব্রতী হতে চলেছি, নিরপেক্ষতা তার প্রধান স্তম্ভ। এই যুদ্ধ কোনও একক ভূস্বামীর, কোনও একক সামন্তের যুদ্ধ নয়। এই যুদ্ধের উদ্দেশ্য রাজ্যলিপ্সা নয়, পরস্বাপহরণ নয়, পররাজ্যগ্রাস নয়। আমাদের মাতৃভূমি আজ যে কুৎসিত অপশাসনের করালগ্রাসে পতিত হয়েছে তার থেকে উদ্ধার পাওয়াই এই ধর্মযুদ্ধের উদ্দেশ্য। এ কারও একক প্রচেষ্টায় সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন প্রত্যেকের সম্মিলিত অংশগ্রহণ। তাই এই পরিত্যক্ত প্রাসাদটি নির্বাচিত করা হয়েছে, যা এখানে উপস্থিত সামন্ত ভূস্বামীদের কারও একক অধীনস্থ নয়।
দ্বিতীয়ত, গোপনীয়তা। ব্যক্তিগতভাবে আমরা সবাই প্রকাশচন্দ্র এবং তাঁর ছয় সহযোগীর বিচিত্র সব কূটকৌশলের ব্যাপারে সম্যকরূপে জানি। আপনাদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ হয়েই এখানে আপনাদের আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু আপনাদের প্রাসাদের বা সভার কারা কারা যে চন্দ্রবংশের গুপ্তচর সে বোঝা অসাধ্য। তাই আপনাদের কোনও পূর্বাভাস না দিয়ে এখানে আহ্বান করেছি। জানবেন, এই মুহূর্তে আপনাদের প্রাসাদের প্রতিটি প্রাচীরও কর্ণময়।
তৃতীয়ত, এই পরিত্যক্ত প্রাসাদ প্রতিমুহূর্তে আমাদের মনে করিয়ে দেবে সমগ্র বঙ্গদেশ জুড়ে এই শতবৎসরব্যাপী মাৎস্যন্যায় কী অবিশ্বাস্য অরাজকতার জন্ম দিয়েছে। মনে রাখবেন, আজ যদি আমরা একত্র হয়ে এই অত্যাচারী রানির শাসন উৎখাত না করি, কাল এই অবস্থা আপনাদেরও হতে পারে।’
মৎস্যেন্দ্রনাথ চুপ করলেন। অন্য এক সামন্ত প্রশ্ন করলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য এক বটে। তবে আমার কিছু জিজ্ঞাস্য আছে।’
‘বলুন মহাসামন্ত ধর্মসেন।’
‘মহর্ষি, আপনাকে আমরা একজন ধর্মপুরুষ বলে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু রাজনীতির অঙ্গনে আপনি এলেন কেন?’
‘কারণ ধর্মই জাতির মেরুদণ্ড, তাই। আর জাতির স্বার্থদর্শনের নামই তো রাজনীতি। তাই আজ যখন বাঙালি জাতি এই কুশাসনের সম্মুখীন হয়ে বিলুপ্তপ্রায়, তখন অধিকারভেদে আমাদের প্রত্যেককে একত্রিত হতেই হবে। যদি দেশই না থাকে, জাতিই না থাকে, তাহলে ধর্ম নিয়ে করব কী?’
‘আপনি কী বলতে চাইছেন লোকেশ্বর? এই সময়ে আমাদের ধর্মাশ্রয়ী হওয়া উচিত? যখন প্রকাশচন্দ্র আরও একটি বহুল জনপ্রিয় ধর্মের অবতারণা করেছেন এই বঙ্গে, তার জনপ্রিয়তা ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী। আপনি কি ধর্মে ধর্মে বিভেদ চাইছেন?’
অন্ধকারের মধ্যেও মৎস্যেন্দ্রনাথের চক্ষুদুটি জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো জ্বলে উঠল। ‘ধর্মে ধর্মে বিভেদ বলবেন না মহামাত্য জয়নাথ। বিভেদ ধর্মে ধর্মে হয় না, ধর্মে অধর্মে হয়। ধর্মের নামে অনিয়ন্ত্রিত মদ্যপান, উন্মত্ত উচ্ছৃঙ্খলতা, অবাধ যৌনসম্ভোগ, পরনারীহরণ, বলাৎকার, এ কী ধর্ম?’
‘আপনি কি ধর্মের সঙ্গে নীতিবোধকে যুক্ত করতে চাইছেন লোকেশ্বর?’
‘অবশ্যই! নীতিবোধ বাদ দিয়ে সমাজ সংস্থিতির থাকে কী সামন্ত সীতাপতি? আর সমাজ সংস্থিতি বাদ দিলে ধর্মেরই বা কী থাকে?’
‘কিন্তু আপনার ধর্মবোধ কি মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতার বিপক্ষে নয়?’ প্রশ্ন করলেন একজন প্রৌঢ়।
‘হাসালেন আচার্য!’ ব্যঙ্গস্বরে বললেন মৎস্যেন্দ্রনাথ, ‘মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতার ধুয়ো তুলে যারা সমাজ সংস্থিতি বিনষ্ট করতে চায়, জানবেন তারাই মানুষের স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় শত্রু। আপনিও তো একজন শ্রদ্ধেয় ধর্মবেত্তা। আপনিই বলুন না, বঙ্গদেশে অবাধ নীতিবোধহীন উচ্ছৃঙ্খলতার যে প্রাপ্ত স্বাধীনতা আছে, প্রকাশচন্দ্র আর রানির অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য সমালোচনার সেই স্বাধীনতা আছে তো?’
বৃদ্ধ আচার্য চুপ করে গেলেন। বর্তমানে বঙ্গদেশে শাসকের বিরুদ্ধে সমালোচনার শাস্তি বড় ভয়ানক।
‘কিন্তু আচার্য, আপনার কথামতো যদি মেনেও নিই যে প্রকাশচন্দ্রের প্রবর্তিত ধর্ম ভ্রান্ত ও ভ্রষ্ট, তার বিপরীতে আপনার ধর্ম যে অভ্রান্ত তার প্রমাণ কী?’
‘হা ঈশ্বর, এতদিন যে দেশের জলবায়ুতে আপনার দেহ মন পুষ্ট হল, তার নিজস্ব, ভূমিজ ধর্মকে আপনি এখনও চিনতে পারেননি সামন্ত অধিরথ?’ উত্তেজিত হয়ে উঠছিলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ, ‘একটি সম্পূর্ণ বিজাতীয়, বিদেশীয় অসভ্য অনৈতিক মতবাদকে এদেশের ধর্ম বলে মেনে নিতে আপনাদের লজ্জাবোধ হয় না? নীতিবোধের বিচ্যুতিগুলিকেও ধর্ম বলে মেনে নিতে আপনার গ্লানিবোধ হয় না? নাকি তার জন্যেও প্রকাশচন্দ্রের অধ্যাদেশ প্রয়োজন?’
সহসা নীরবতা নেমে এল সবার মধ্যে। মৎস্যেন্দ্রনাথ বুঝতে পারলেন উত্তেজিত হয়ে কিছু কঠোর কটূক্তি করে ফেলেছেন। কিঞ্চিৎ নরম সুরে বললেন, ‘উত্তেজনা ক্ষমা করবেন আর্য। কিন্তু আমি মনে করি এই কুশাসনের অন্যতম স্তম্ভ যে অশ্লীল ধর্ম, তার উৎপাটন আশু প্রয়োজনীয়।’
‘কিন্তু আচার্য,’ এতক্ষণে প্রশ্ন করলেন গৌড়েশ্বর জয়ন্ত, ‘আপনি নাহয় মহাযোগী। সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী৷ কিন্তু, সাধারণ নরনারীর জীবনে সঙ্গম তো জাগতিক প্রয়োজন। আপনি কি কামপ্রবৃত্তিকে গর্হিত বলে মনে করেন?’
‘না গৌড়েশ্বর। কাম সৃষ্টির মূলবিন্দু। বিশ্বসংসারে পুরুষ-প্রকৃতির প্রেরণায় সৃষ্টির বিকাশ হয়। পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনের ফলে বিন্দুর সৃষ্টি বা পতন, আর সেই বিন্দুর মধ্যে সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার অনন্তলীলা নিত্য বহমান। এই বিন্দুতে লীলাময়ী মহামায়া সৃষ্টি ঘটিয়ে থাকেন বলেই তো তিনি বিন্দুবিলাসিনী।
সন্তানোৎপাদনের উদ্দেশে অথবা প্রেমাষ্পদের সঙ্গে সঙ্গমবাসনায় কৃতসঙ্কল্প নর-নারীর মিলনকে তো নিন্দা করি না। আমিও নিজেও তো সেই সৃষ্টিসঙ্গমেরই ফল। কিন্তু শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে স্বেচ্ছাচারী অবাধ যৌনকর্ম, অন্ত্যজ জাতিদের কূলস্ত্রী এবং রজস্বলা কন্যাদের বলপ্রয়োগে সেই যৌনকর্মে অংশগ্রহণে বাধ্য করা, এও কি ধর্মের অনুষঙ্গ গৌড়েশ্বর? শাস্ত্রে বলে স্ত্রীয়ঃ সমস্তা সকলা জগৎসু, নারীশক্তি হতেই জগতের উৎপত্তি। ধর্মের দোহাই দিয়ে সেই নারীশক্তির এহেন অবমাননা কি সহনীয়?
‘আর অবাধ মদ্যপান? তাকিয়ে দেখুন, বঙ্গদেশের প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি নগরে, প্রতিটি পল্লীতে, প্রতিটি পণ্যবিথীতে কত না শৌণ্ডিকালয়। কর্মহীন, অর্থহীন এই জাতিকে মদিরার মৌতাতে ডুবিয়ে নির্বীর্য করে রাখার কী সযত্ন প্রয়াস! অন্নসংস্থানের উপায় নেই, কর্মোদ্যোগের পরিকল্পনা নেই, রয়েছে শুধু ধর্মের নামে অবাধ, উচ্ছৃঙ্খল মদ্যপানের বিধান।
‘মদ্যপান দোষের নয় গৌড়েশ্বর। পরিমিত কিছুই দোষের নয়। কিন্তু কোনও বিষয়ের আতিশয্যই গর্হিত বা অহিতকর। যেমন অতিভোজন দোষের। তেমন অতিকামুকতাও দোষের। তখন তাকে লাম্পট্য বলে। আর সেই লাম্পট্যে যখন দেশের শাসকগোষ্ঠী সবিস্তারে উৎসাহ দেয়, তখন বুঝতে হবে যে দেশের বড়ই দুর্দিন।’
‘কিন্তু আচার্য, ‘একজন বলে ওঠেন, ‘আপনি তো নিজেও তন্ত্রশাস্ত্রের বিষয়ে একজন পণ্ডিত। পঞ্চ ম’কারের বিধান তো এই শাস্ত্রেই রয়েছে।’
‘আছে সামন্ত অধিরথ। সেখানেই তো সুচতুর চালটি চেলেছেন প্রকাশচন্দ্র। বৌদ্ধতন্ত্রের যাবতীয় গূঢ়বিদ্যাকে নামিয়ে এনেছেন হট্টমেলার মধ্যে। যে শাস্ত্রকে বলা হয়েছে স্বীয় মাতার চরিত্রস্খলনের মতো গোপন রাখতে, তাকে সাধারণ্যে উন্মুক্ত করেন দেওয়া হয়েছে অধিকারী অনধিকারী ভেদ না রেখে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তিব্বতীয় পোন ধর্মের যাবতীয় অশ্লীল অসভ্য উপচার। বিজাতীয় ইতর ধর্মকৃত্যকে কেবলমাত্র অর্থান্তরিত করে ভারতীয় তন্ত্রধর্মের মধ্যে সুচতুর কৌশলে প্রবিষ্ট করিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
‘আপনার বক্তব্যটি প্রণিধান হল লোকেশ্বর। যদিও সামন্ত অধিরথের পঞ্চ ম’কারের প্রশ্নটি…’
সামান্য অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ। ‘আজ এই নিয়ে কূট আলোচনার দিন নয় মহাসামন্ত ধর্মসেন। একদিন নাহয় এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। আজ বরং যেজন্য একত্রিত হয়েছি সেই বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া যাক।’
.
নবতিপর বৃদ্ধ মানুষটি বাতায়নের পাশে বসে স্থির অচঞ্চল চোখে সাগরদর্শন করছিলেন। মনে হচ্ছিল যেন কত শত সহস্র বৎসর ধরে উনি ঠিক ওইভাবেই ওখানে বসে আছেন। যেন এই অকূল জলরাশির চঞ্চললীলা দর্শনে তিনি কখনও ক্লান্ত হন না।
কাহ্ন একবার ঘরে ঢুকে অস্পষ্ট শব্দ করলেন। বৃদ্ধ এদিকে তাকালেন না। শুধু অস্ফুটস্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘এসেছ ঘনরাম?’
কাহ্ন উত্তর দিলেন না। বৃদ্ধ আপনমনে বলতে লাগলেন, ‘জানো ঘনরাম, শৈশবে বড় শখ ছিল সমুদ্র দেখার। পার্বত্য দেশের মানুষ আমি, পাহাড়ি ঝরনা আর নদী ছাড়া কিছুই দেখিনি। তাও সেই শীর্ণকায়া নদীর সঙ্গে এই দেশের বিশালকায়া বেগবতী নদীদের কোনও মিলই নেই। এদেশে এসে মেঘান্দ আর লৌহিত্যের বিপুল তরঙ্গ দেখে আমি বিস্ময়ে স্তব্ধ। জলরাশি এত বিপুল, বিশাল, প্রচণ্ড হয়? এত উন্মত্ত, এত প্রলয়ঙ্কর হয়?
‘সেইদিন শুনেছিলাম পূর্বসমুদ্রের জলরাশি নাকি এর চেয়েও প্রকাণ্ড। বিরাট। বিশাল। সেই থেকে বড় বাসনা ছিল, পূর্বসমুদ্র দেখব।
আজ দেখো, নিয়তির কী আশ্চর্য বিধান। গত অর্ধশতক ধরে শুধু এই জলরাশিই দেখে যাচ্ছি। তার আর বিরাম নেই।’
কাহ্ন শান্তস্বরে বললেন, ‘আপনি তো অনেক আগেই দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন আর্য। এখনও জলরাশি দেখতে পান?’
বৃদ্ধ থমকে গেলেন। ধীরে, অতি ধীরে এদিকে ঘুরে বললেন, ‘কে তুমি? এ তো ঘনরামের স্বর নয়।’
কাহ্ন দ্রুত এসে বৃদ্ধের হাত ধরলেন, ‘আমি আপনার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী আর্য চারুদত্ত।’
বৃদ্ধ কিছুক্ষণ কাহ্ন’র হাতদুটি ধরে রইলেন। তারপর অকস্মাৎ ডানহাতে কাহ্ন’র গলা টিপে ধরলেন।
কাহ্ন বলশালী পুরুষ। তিনি ধীরে ধীরে বৃদ্ধের দৃঢ়মুষ্ঠি থেকে নিজেকে মুক্ত করলেন। তারপর বললেন, ‘আমি আপনার শত্রু নই আর্য।’
বৃদ্ধ খলখল স্বরে হেসে উঠলেন, ‘মিত্র? এই শত্রুপুরীতে কোন মিত্র এলি রে? কেন এসেছিস? আমাকে সর্বনাশের পথে আরেকটু এগিয়ে দিতে?’
কাহ্ন বললেন, ‘আমি সত্যিই আপনার মিত্র আর্য চারুদত্ত। আপনার অনেক দিনের গোপন বাসনা পূরণ করতে এসেছি।’
বৃদ্ধ আরও উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলেন, ‘গোপন বাসনা? বাহ বাহ। তা কী এনেছিস আমার জন্য? উত্তম সুরা? সুপক্ব মৃগমাংস? সুন্দরী নারী?’
কাহ্ন শান্তস্বরে বললেন, ‘না আর্য, আমি এসব কিছুই আনিনি। আপনার হৃদয়ে প্রতিশোধের যে আগুন অর্ধশতাব্দী ধরে প্রজ্জ্বলিত, তাকে নির্বাপিত করতে এসেছি।’
বৃদ্ধ আবার হেসে উঠলেন। বললেন, ‘বাহ বাহ! এটা কি প্রকাশচন্দ্র’র নতুন চাল? আমাকে পরীক্ষা করে দেখা কোনও ষড়যন্ত্রে আমি জড়িত কি না? শোন রে চন্দ্রবংশের ক্রীতদাস, তোর ওই বিশ্বাসঘাতক প্রভুকে গিয়ে বলে দিস, উপায় থাকলে আমি তার দুই চোখ উপড়ে সেখানে জ্বলন্ত অঙ্গার ঢেলে দিতাম। আমার সে উপায় নেই, আজ আমি চলচ্ছক্তিহীন বৃদ্ধ। কিন্তু আমার অভিশাপ সর্বদা তার পিছু পিছু ফিরবে। তাকে এক মুহূর্ত শান্তি দেবে না। ওর সর্বনাশ হবে, মহাসর্বনাশ হবে…’
কাহ্ন দ্রুত হাত চেপে ধরলেন বৃদ্ধের, ‘সেই জন্যই তো আপনার কাছে আসা, আর্য চারুদত্ত। আপনার অতৃপ্ত প্রতিশোধের বাসনা পূরণ করতে এসেছি আমি। প্রকাশচন্দ্রের মহা সর্বনাশ হবে, চন্দ্রবংশ ধ্বংস হবে। সেই মহাযজ্ঞে আপনার অর্ঘ্য চাই আর্য চারুদত্ত।’
চারুদত্ত ঘড়ঘড়ে স্বরে বললেন, ‘কে তুই? আমাকে মিথ্যে আশা দিচ্ছিস কেন?’
‘আমার নাম কাহ্ন, আর্য চারুদত্ত। চন্দ্রবংশের কুশাসন থেকে বঙ্গভূমিকে উদ্ধার করার জন্য যে মহাযজ্ঞ চলছে, তার এক সামান্য সেনানী।’
চারুদত্ত ঘোলাটে, প্রায় অন্ধ চোখদুটি দিয়ে চেয়ে রইলেন কাহ্নপা’র দিকে।
চারুদত্ত’র কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কাহ্নপা বললেন, ‘গত সপ্তাহে ঘনরাম আপনাকে কিছু বলে গেছিল?’
চারুদত্ত অস্ফূটে বললেন, ‘হ্যাঁ। সে বলেছিল পরের সপ্তাহে তার বদলে অন্য কেউ আসবে। সে নাকি আমার জন্য কিছু উপহার আনবে।’
‘আর কিছু?’
চারুদত্ত ফিসফিস করে বললেন, ‘আর বলেছিল তাকে একটি সংকেতবাক্য’র অর্ধাংশ বলতে। সে যদি বাকি অর্ধাংশ না বলতে পারে, তাহলে আমি যেন তাকে বিশ্বাস না করি।’
কাহ্নপা চুপ করে তাকিয়ে রইলেন। চারুদত্ত ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলেন, ‘সুজ লাউ সসি লাগেলি তান্তী।’
কাহ্ন বললেন, ‘অণাহা দাণ্ডী বাকি কিঅ অবধূতী।’
চারুদত্ত কাহ্নপার হাত চেপে ধরলেন।
.
‘কিন্তু মহর্ষি, আপনি যা করতে বলছেন সে তো প্রায় অসম্ভব। সর্বস্তরে স্থানীয় সমিতির জাল বিছিয়ে রেখেছেন প্রকাশচন্দ্র আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা। তারা প্রতিনিয়ত রাজ্যের কোথায় কী হচ্ছে তার সংবাদ পৌঁছে দেয় কর্মান্তবাসকে। সর্বত্র কঠিন প্রহরা। তার ওপর চন্দ্রবংশের সুশিক্ষিত সৈন্যদল৷ সর্বোপরি প্রকাশচন্দ্রের নিজস্ব ভৈরববাহিনী আছে, রাজসেবকদল। তাদের পরাস্ত করে আপনি কর্মান্তবাসক অধিকার করার স্বপ্ন দেখছেন? বাতুলের প্রলাপ নয় কি?’
‘আপনার কথা সত্য জয়নাগ। কিন্তু আমরা একা নই। আমাদের সঙ্গে গৌড়বঙ্গের কয়েকজন কৃতবিদ্য পুরুষ আছেন। আপনারা আছেন।’
‘আমরা কয়েকজন সামন্ত আপনাদের সঙ্গে আছি বটে। কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে না সামন্তদের অধিকাংশই প্রকাশচন্দ্রের পক্ষে।’
‘যুদ্ধ কখনও সংখ্যাধিক্যের জোরে জেতা যায় না মহাসামন্ত ধর্মসেন। যুদ্ধ জেতা হয় রণকৌশল, বুদ্ধিমত্তা আর সাহসের জোরে। নইলে মহাভারতের যুদ্ধে পাণ্ডবদের সাত অক্ষৌহিণী সেনা কৌরবদের একাদশ অক্ষৌহিণী সেনার বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে পারত না।’
‘কিন্তু লোকেশ্বর, এ কথা ভুললে চলবে না যে পাণ্ডবদের সঙ্গে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন।’
‘শ্রীকৃষ্ণ নন আচার্য, বলুন ধর্ম। স্বয়ং ধর্ম পাণ্ডবদের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। ন্যায়, সত্য, আর ধর্ম, এই তিনটি যার পক্ষে তার বিজয় অনিবার্য।’
সভায় নীরবতা নেমে এল। ইত্যবসরে মুখ খুললেন সামন্ত বলভদ্র। এতক্ষণ চুপ করেছিলেন তিনি। নীরবতা ভেঙে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘মহর্ষি, ধরে নিলাম এই সংগ্রামে আমাদের জয় অনিবার্য। কিন্তু তারপর? প্রকাশচন্দ্র’র পর কে হবেন বঙ্গভূমির সম্রাট? তিনি কি আমাদের মধ্যেই কেউ? তাহলে কে তিনি?’
সবাই জানতেন এই প্রশ্ন উত্থাপিত হবে। এবং এই প্রশ্নটির নিষ্পত্তির ওপরেই নির্ভর করছে আজকের সভার সাফল্য।
থেমে থেমে প্রতিটি শব্দের উপর জোর দিয়ে উচ্চারণ করলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ, ‘এই প্রশ্নটি উত্থাপন করার জন্য অনেক ধন্যবাদ সামন্ত বলভদ্র। স্পষ্ট জানাচ্ছি যে এখানে উপস্থিত সামন্তদের কাউকেই সেই পদের জন্য আমি মনোনীত করিনি।’
‘কেন লোকেশ্বর? আমরা কি অযোগ্য?’
‘প্রশ্নটি যোগ্যতার নয় সামন্ত বলভদ্র, প্রশ্নটি কূটনীতির।’
মহাসামন্ত ধর্মসেন স্থির এবং শান্তস্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘যদি আমাদের কিছু প্রাপ্তির আশাই না থাকে, তাহলে আমরা এখানে ঠিক কী জন্য এসেছি সেটা কি আমাদের জানাবেন লোকেশ্বর?’
মৎস্যেন্দ্রনাথ ধীরস্থিরস্বরে বললেন, ‘প্রাপ্তি কি কিছুই নেই মহাসামন্ত ধর্মসেন? আমাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য তো এই অরাজক মাৎসন্যায় থেকে উদ্ধার পাওয়া। আজ আপনি আপনার স্বক্ষেত্রে সম্রাট, মহাসামন্ত। কিন্তু কাল যে অন্য কোনও অধিকতর ক্ষমতাশালী ভূস্বামী আপনার ভুক্তিটি অপহরণ করবেন না তার নিশ্চয়তা কী? এই রাক্ষসশাসন, সর্বক্ষণের অনিশ্চয়তা, ধনে প্রাণে নিশ্চিহ্ন হওয়ার আতঙ্ক, তার থেকে মুক্তি পাওয়াও কি একটি প্রাপ্তি নয়?’
‘আপনার কথা সত্য লোকেশ্বর। কিন্তু আমরা যোদ্ধৃবর্গ। প্রয়োজন হলে আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ করতে পারি। শত্রুপাত করতে পারি৷ শত্রু প্রবল হলে বীরগতিও প্রাপ্ত হতে পারি। কিন্তু প্রকাশচন্দ্রের মতো শত্রুর সঙ্গে আগ বাড়িয়ে যুদ্ধঘোষণার জন্য তো কিছু না কিছু কারণ প্রয়োজন।’
‘আপনার বক্তব্য বুঝলাম না সামন্ত বলভদ্র। ঘরে আগুন লাগলে তবেই কি কুয়ো খোঁড়ার উদ্যোগ নেবেন? বিশেষ করে সেই আগুন যখন পাশের পল্লীটি লেলিহান শিখায় দগ্ধ করছে? আমি কি তখনও এই ভেবে ঘুমিয়ে রইব যে যেখানে যাই হোক না কেন, আমার ঘরটি তো নিরাপদ! শত্রু দুয়ারে উপস্থিত, প্রতিবেশীর ঘর জ্বলছে, তার ধনসম্পদ লুন্ঠিত, তার নারী ও কন্যারা অপহৃতা-ধর্ষিতা, তখনও আপনি অপেক্ষা করে থাকবেন কবে সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আপনার ঘরের দুয়ার স্পর্শ করবে?’
সভাস্থলের বিভিন্ন দিক থেকে কিছু অস্বস্তিকর শব্দ ভেসে এল।
‘আজ আর সেই সময় নেই মহামান্য সামন্তবর্গ। আজ সর্বনাশের আগুন আমাদের দরজায় উপস্থিত। আমাদের মান-সম্মান-ধন-সম্পদ-নারীদের সতীত্ব সবই এখন শত্রুদের আক্রমণের লক্ষ্য। এই চন্দ্রবংশীয় বর্বরের দল আজ আমাদের জাতিসত্বা-ধর্ম-সমাজ-আদর্শ-অস্তিত্ব সবকিছুর সমূল বিনাশের উদ্দেশে খড়্গহস্ত। আজ যদি আমরা এই নৃশংস বর্বরদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ না করি তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে উত্তর দিতে পারব না৷ আজ থেকে শতবর্ষ পর যখন আকাশপ্রদীপের আলোরেখা ধরে নেমে আসব, তখন তাদের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারব না।’
সভাস্থলে অখণ্ড নৈঃশব্দ্য।
কিছুক্ষণ পর এক বৃদ্ধ মানুষ প্রশ্ন করলেন, ‘আমার মনে হয় আপনার বক্তব্য আমাদের সবার কাছেই গৃহীত হয়েছে মহর্ষি। এবার আপনি বলুন এই বিপ্লবোত্তর কালে কাকে আপনি বঙ্গদেশের শাসকরূপে দেখতে চাইছেন?’
আধো অন্ধকারের মধ্যেই সবার দিকে একবার চক্ষু ঘুরিয়ে নিলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ। তারপর শান্তস্বরে বললেন, ‘আচার্য দয়িতবিষ্ণুর পৌত্র, খণ্ডিতারাতি বপ্যটের পুত্র, রাজভটবংশাদিপতিত মহাবীর শ্রীগোপালদেব।’
.
‘পাপ মিত্র, পাপ। বিশ্বাসঘাতকতার পাপ, স্বজনহত্যার পাপ, স্বার্থের বশে বহুতর নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করানোর পাপ। সেই পাপে আজ আমার এই অবস্থা।’
‘দুঃখ করবেন না আর্য চারুদত্ত। ঈশ্বর আজ সেই পাপস্খালনের সুযোগ এনে দিয়েছেন আপনার সামনে।’
‘সব পাপের কি স্খালন হয় কাহ্ন? জ্যেষ্ঠার সঙ্গে যখন এই দেশে আসি, তখন কতই বা বয়স আমার। ষোড়শবর্ষীয় কিশোর আমি। সম্রাট রাজভট এই নবীন কিশোরকে শ্যালক নয়, নিজের সহোদরজ্ঞানে স্নেহ করতেন৷ কী পাইনি তাঁর কাছ থেকে? অপরিমিত স্নেহ, অবাধ প্রশ্রয়, যথেচ্ছ স্বাধীনতা, যখন যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। ধীরে ধীরে তাঁর স্নেহাস্পদ বয়স্য হয়ে উঠছিলাম। জ্যেষ্ঠার অনুরোধে সচিব পদমর্যাদা পেলাম। কিন্তু সেই তাঁকেই…’
‘তাঁকেই কী, আর্য চারুদত্ত?’
প্রায় অন্ধ হয়ে যাওয়া চক্ষুদুটি মেলে সমুদ্রের দিকে চেয়ে রইলেন চারুদত্ত। সমুদ্রের লবণাক্ত আর্দ্র বাতাস ধেয়ে আসছিল ঘরের মধ্যে। তার প্রবল গর্জনে কান পাতা দায়। যদিও একটু মনোযোগ দিলে বাইরে সৈন্যদের মত্ত আলোচনার স্বরও কানে আসে।
‘তাকেই হত্যা করলাম মিত্র কাহ্ন। আমি বিশ্বাসঘাতক চারুদত্ত, কৃতঘ্ন চারুদত্ত, এক অন্ধকার রাত্রে আমি আমার স্নেহশীল অগ্রজাভর্তা, প্রতিপালক প্রভু, বঙ্গদেশের সম্রাট রাজভটকে তিব্বতীয় মহাকূটবিষপ্রয়োগে হত্যা করলাম।’
কাহ্ন স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এই সংবাদ মৎস্যেন্দ্রনাথ জানতেন, বলা ভালো অনুমান করেছিলেন। আজ সেটা মিলে গেল৷
‘কিন্তু কেন?’
ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে এদিকে তাকালেন চারুদত্ত।
‘আপনি নিয়তি মানেন মিত্র কাহ্ন?’
‘মানি আর্য চারুদত্ত।’
‘সেই নিয়তিই এর কারণ। নিজের উপরই বিতৃষ্ণা হয় কাহ্ন৷ বিধাতাপুরুষ বোধহয় আমার জন্মলগ্নেই কপালে পাপনিয়তি বলে লিখে দিয়েছিলেন। নইলে এত স্নেহচ্ছায়ায় পালিত হওয়ার পরেও আমার মনে বিদ্বেষবিষ প্রবেশ করবে কেন?
‘সচিব হওয়ার পর ধীরে ধীরে লক্ষ করলাম যে অন্যান্য সভাসদরা প্রকাশ্যে সচিবের উপযুক্ত সম্মান দেখাচ্ছেন বটে, কিন্তু তাঁদের আচার আচরণে প্রকাশ পেতে থাকে যে আমার পদটি সর্বার্থেই আলঙ্কারিক। রাজার শ্যালক বলে ওই আসনে বসার অধিকার পেয়েছি মাত্র৷ শাসনব্যবস্থায় মতামতদানের কোনও ক্ষমতাই আমার নেই।
‘ধীরে ধীরে এই ভাবনা আমার মনের মধ্যে স্থায়ী হয়ে বসল৷ এই চিন্তা আমাকে কুরে কুরে খেতে লাগল। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কটের সময় দেখতাম যে সম্রাট তাঁর প্রধানতম মন্ত্রণাদাতাদের নিয়ে আলোচনায় বসেছেন। কে কে আছেন সেই সভায়? পণ্ডিত দয়িতবিষ্ণু, মহামাত্য বুদ্ধদাস, এবং সেনাপ্রধান আনন্দদত্ত৷ আর আমি চারুদত্ত, রাজসচিব চারুদত্ত, যার কিনা প্রকৃতপক্ষে সম্রাটের প্রতিভূ হওয়ার কথা, সেই আলোচনায় তার কোনও প্রবেশাধিকারই নেই।
‘ঈর্ষার তীব্র বিষ ক্রমেই আমার চেতনাকে আচ্ছন্ন করে তুলছিল। আর সেই অন্ধ ঈর্ষাবিদ্বেষ প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে তুলছিল আমার মনে।
‘সেই সময়ে কিছু দৌত্যের কাজ নিয়ে একবার আমার মাতৃভূমি দর্শনে যাই। সম্রাটই পাঠিয়েছিলেন।
সেইখানেই এক সন্ধ্যায় কিছু পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মদ্যপানের আসরে আমি বলে ফেলি এই ক্ষোভের কথা, অপমানের কথা।
‘জানি না কী করে এই কথা পৌঁছে গেল তিব্বতের মহাসামন্ত, তথা মহামাত্য গার তিরিলিং-এর কানে। সেইদিনই বিধাতাপুরুষ সর্বনাশের পথটি আমার জন্য নির্দিষ্ট করে দিলেন।
‘পরদিনই মহামাত্য’র প্রাসাদে এক গুপ্তসভায় যোগদানের আমন্ত্রণ পেলাম। সেখানে তিনি ছাড়াও তিব্বতী রাজসভার কয়েকজন প্রভাবশালী সামন্ত উপস্থিত ছিলেন। আর ছিলেন কয়েকজন চৈনিক রাজপুরুষ। তাঁরা তাং বংশের প্রেরিত গুপ্তচর।
‘সেইদিনই রূপরেখা রচিত হয় এক মহাষড়যন্ত্রের। বঙ্গভূমির সমূহ সর্বনাশের, সমূলে উৎপাটনের ষড়যন্ত্র। মূল ষড়যন্ত্রকর্তা তাং বংশের মহাপ্রতাপশালী সম্রাট তাইজং আর তাঁর প্রিয়তমা রক্ষিতা য়ু জেতিয়ান। আর তার রূপায়ণে তিব্বতের পোন ধর্মাবলম্বী সামন্তগোষ্ঠী, আমারই স্বধর্মী স্বজাতি।
‘সেই রাতেই এক পোন ধর্মচক্রের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। সেখানে আমার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল এক সুঠামদেহী বঙ্গদেশীয় যুবাপুরুষ আর এক সুন্দরী নারীর সঙ্গে।’
এই পর্যন্ত বলে চুপ করলেন চারুদত্ত। কাহ্ন একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘বাকি ঘটনা আমরা জানি আর্য চারুদত্ত। কার্যসিদ্ধির পর কীভাবে আপনাকে গজভুক্তকপিত্থের মতো পরিত্যাগ করা হয়, এই অস্বাস্থ্যকর প্রদেশে নির্বাসন দেওয়া হয় তাও জানি।’
কপালে করাঘাত করলেন চারুদত্ত, ‘পাপ কাহ্ন পাপ। মহাপাপে পাপী আমি। স্বার্থে অন্ধ হয়ে একজন প্রজাপালক রাজাকে হত্যা করেছি। এক ক্রূরমতি পাপকর্মা পুরুষ আর এক কামুক নাগিনীকে দেশের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছি। এই বিস্তীর্ণ ভূমিকে রাহুর করালগ্রাসে পতিত করেছি। আমার উদ্ধার নেই, মুক্তি নেই, পরিত্রাণ নেই।’
বৃদ্ধের হাত থরথর করে কাঁপছিল। কাহ্নপা দ্রুতহাতে হাতদুটি ধরে বললেন, ‘কে বলল মুক্তি নেই? গত অর্ধশতাব্দী ধরে এই যে নির্বাসনদণ্ড ভোগ করছেন, তাতে কি পাপের ক্ষয় হয়নি?’
‘হয়েছে কাহ্ন?’ সাগ্রহে কাহ্নপা’র হাত দুখানি ধরে প্রশ্ন করলেন চারুদত্ত।
‘হয়েছে আর্য, অবশ্যই হয়েছে। আর আপনার নির্বাসনের কালও শেষ হয়ে এসেছে আর্য চারুদত্ত। আজ চন্দ্রবংশের কুশাসনের বিরুদ্ধে দিকে দিকে বিপ্লবের আগুন জ্বলে উঠেছে। মহাবিদ্রোহ আজ সমাগতপ্রায়। আর সেই মহাযজ্ঞের আগুনে কিছু সমিধ আহরণের জন্যই আজ আমরা আপনার কাছে এসেছি। ঘনরাম আপনাকে পুরস্কারের কথা বলেছিল না? এই সেই পুরস্কার।’
কথাগুলি বোধহয় চারুদত্ত’র হৃদয়ঙ্গম হতে কিছু সময় নিল। তারপরেই চিৎকার করে উঠলেন তিনি, ‘হবে কাহ্ন, সত্যি বলো হবে? এই পাপাচারী নারকী রানির রাজত্ব ধ্বংস হবে? ওই ঐন্দ্রজালিক কাপালিকটার হাত থেকে মুক্তি পাব আমরা?’
কাহ্ন দ্রুত চারুদত্ত’র মুখে হাত চাপা দিলেন। কেউ শুনে ফেললেই সর্বনাশ। ইঙ্গিতে চুপ করতে বললেন চারুদত্তকে। তারপর লঘু পদক্ষেপে দেখতে গেলেন, বাইরে প্রহরীরা কী অবস্থায় আছে।
.
সভাস্থলে একটি বিস্ময়ের গুঞ্জন উঠেই মিলিয়ে গেল। গৌড়েশ্বর জয়ন্ত সন্দিগ্ধস্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘কে এই গোপালদেব? কী পরিচয় এঁর? আর এঁকে রাজভটবংশাদিপতিতই বা বলছেন কেন?’
মৎস্যেন্দ্রনাথের পাশ থেকে এক বিশালদেহী পুরুষ উঠে দাঁড়ালেন৷ উপস্থিত প্রত্যেককে প্রণাম করে বললেন, ‘উপস্থিত অভ্যাগতদের সাদর প্রণাম। অধমের নাম বপ্যট।’
উপস্থিত সামন্ত’রা বপ্যটকে ভালোভাবে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। যুদ্ধব্যবসায়ী বপ্যটের বলবীর্যের খ্যাতি গৌড়বঙ্গের সর্বত্র পরিব্যপ্ত। তবে অনেকেই তাঁকে ইতিপূর্বে চাক্ষুষ দেখেননি।
বপ্যট চারিদিকে একবার তাকিয়ে বললেন, ‘আমি একজন যুদ্ধব্যবসায়ী। অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন সামন্তবর্গের অধীনে যুদ্ধ করাই আমার পেশা। তবে আমার আরও একটি পরিচয় আছে,’ বলে একটু থামলেন বপ্যট৷ তারপর অত্যন্ত নিস্পৃহস্বরে যোগ করলেন, ‘আমি সম্রাট রাজভটের ঔরসজাত পুত্র।’
সভার মধ্যে যেন বিস্ময়ের বিস্ফোরণ ঘটে গেল। উপস্থিত অভ্যাগতবর্গ স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন।
প্রথম কথা বললেন সামন্ত অধিরথ। তিনি চাপা উত্তেজিতস্বরে বললেন, ‘আপনি জানেন কী বলছেন?’
মহাসামন্ত ধর্মসেন আশ্চর্যান্বিত স্বরে বলে উঠলেন, ‘সম্রাট রাজভটের তো একটিই সন্তান ছিল বলে জানতাম, বলভট। আপনার উল্লেখ তো কখনও কোথাও পাইনি!’
উপস্থিত বৃদ্ধ আচার্যটি স্থিরস্বরে বললেন, ‘বলভট ব্যতিরেকে সম্রাট রাজভটের যে একটি অন্য পুত্র ছিল তার উল্লেখ আমি অত্যন্ত গোপনসূত্রে আগেও পেয়েছি। তবে ইনিই যে সেই পুত্র তার সত্যতা নিরূপণ করে নেওয়াই শ্রেয়।’
‘পিতৃপরিচিতি নিয়ে কেউ মিথ্যে কথা বলে না আচার্য। আমি সত্য কথাই বলছি। এবং সেই সূত্রে আরও জানাই যে শ্রীগোপালদেব আমার পুত্র। তার শরীরে সম্রাট রাজভটের রক্তের উত্তরাধিকার বইছে। সেই জন্যেই লোকেশ্বর তাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করেছেন। আমার মনে হয় এই বিষয়ে বরং উনিই বিশদে বলতে পারবেন।’
মৎস্যেন্দ্রনাথ উঠে দাঁড়ালেন। আর তারপর সমবেত সামন্তদের সামনে এক অজানা ইতিহাসের অধ্যায় ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে লাগল।
.
কাহ্নপা দেখলেন কুটিরের দ্বারে মহোৎসব চলছে। ছয়টি মদ্যকলস ঘিরে অন্তত বিশজন প্রহরী বৃত্তাকারে বসে আছে। বেচারি ঠগন তাদের আদেশ পালন করার জন্য উদ্ভ্রান্তের মতো ইতিউতি ধাবমান। কেউ হাসছে, কেউ কাঁদছে, কেউ বা একটি শূন্য কলসীকে জড়িয়ে প্রেমপূর্বক চুম্বনে মত্ত। কেতকদাসকে দেখা গেল অধোবাসের প্রান্তটি অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গে জড়িয়ে, সেটি লাজুক ভাবে দাঁতে কেটে ললিতলবঙ্গলতারূপে বাকি রক্ষীদের মনোরঞ্জন করছে। দু-একজন রক্ষী চিৎকার করে অশ্রাব্যগীতি গাইছে। জনাচারেক রক্ষী নিশ্চিন্তে নিদ্রামগ্ন। প্রথম রক্ষীটি রাজাসনে বসে দু-চারজন মনোযোগী শ্রোতাকে তার বিভিন্ন বীরত্বের গাথা শোনাতে ব্যস্ত।
সন্তর্পণে ভেতরে ফিরে এলেন কাহ্নপা। ছয়টি কলসীতেই মদিরার সঙ্গে অতি অল্প পরিমাণে ধুতুরাবীজ মেশানো ছিল। যাতে এরা আবেশে উন্মত্ত হয়ে যায়, কিন্তু প্রাণহানি না ঘটে।
কাহ্নপা ফিরে এসে দেখলেন চারুদত্ত স্থির হয়ে বসে আছেন। পায়ের শব্দ পেয়ে বললেন, ‘বলো কাহ্ন, কী জানতে চাও?’
কাহ্ন প্রশ্ন করলেন, ‘প্রকাশচন্দ্র আর এই রানিকে হত্যার উপায় জানতে চাই। চাই আরও কিছু তথ্য, যা আপনি মনে করেন আমাদের জানা উচিত।’
চারুদত্ত কিছুক্ষণ চুপ হয়ে বসে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন, ‘এই নারী কে সে আশা করি এতদিনে আপনারা জানেন৷ কিন্তু যা জানেন না সে অত্যন্ত গভীর এবং গোপন সংবাদ। আমি আর প্রকাশচন্দ্র ছাড়া আর কেউ জানেন না।’
কাহ্নপা’র শরীর শক্ত হয়ে এল। পদ্মসম্ভবের তিব্বত থেকে আনা গোপন পত্রটি পাঠ করেছেন আচার্য শান্তরক্ষিত৷ সেখানে উপস্থিত ছিলেন আর মাত্র দুজন, মৎস্যেন্দ্রনাথ আর তিনি নিজে। তিনি বুঝতে পারলেন কোন গূঢ় সংবাদের দিকে ইঙ্গিত করছেন চারুদত্ত। মনের ভাব মনেই চেপে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘কী সেই সংবাদ, আর্য?’
‘এই নারী চৈনিক হলে কী হবে, এঁর দেহে বইছে ভারতীয় রক্ত। আপনাদেরই ভূমির বহু প্রাচীন পাপ আজ নাগরূপ ধারণ করে আপনাদেরই দংশন করতে উদ্যত।
আপনাদের পুরাণে অষ্টনাগের উল্লেখ আছে। সাধারণ লোক নাগ বলতে সাপ বোঝে। কিন্তু নাগ একটি বিশিষ্ট জনজাতি। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এঁদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে৷
অষ্টনাগ প্রকৃতপক্ষে নাগ জনজাতির আটটি মুখ্য প্রবর বা গোত্র৷ তার একটি হচ্ছে কর্কটনাগ। এঁরা প্রকৃতপক্ষে পূর্বভারতের ভূমিজ সন্তান ছিলেন।
কৃষ্ণার্জুন যখন খাণ্ডব বন ধ্বংস করেন, তখন সেখানে কর্কটনাগ জাতির একটি শাখার বসতি ছিল। সেই মারণযজ্ঞ থেকে নিষ্কৃতি পেতে তাঁরা পালিয়ে যান প্রথমে ত্রিগর্ত, তারপর সেখান থেকে কেকয় হয়ে গান্ধার।
পৈশাচী বিষবিদ্যায় কর্কটনাগ গোষ্ঠীর বিশেষ ব্যূৎপত্তি ছিল। তাঁরা গান্ধারের রাজধানী পুষ্কলাবতীতে বিষবৈদ্য হিসেবে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন। ধীরে ধীরে নাগরিক সমাজে তো বটেই, পুষ্কলাবতীর রাজসভাতেও তাঁরা বিশেষ স্থান অধিকার করে নেন। তার কতটা ভয়ে আর কতটা সম্মানে সে বলা অসম্ভব।
এই কর্কটনাগ গোষ্ঠীর মুখ্য পুরুষ ছিলেন দিব্যনাগ। তাঁর একটি সর্বসুলক্ষণা কন্যা ছিলেন, নাম পদ্মাবতী। ইনি বিষবিদ্যায় আশ্চর্য ব্যূৎপত্তি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। লোকে বলত স্বয়ং নাগমাতা অদিতি দিব্যনাগের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছেন।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর উত্তর-পশ্চিম ভারত ধীরে ধীরে মহান নাগরাজ তক্ষকের অধিকারে যায়। তিনি রাজধানী স্থাপন করেন তাঁরই নামাঙ্কিত নগরীতে, তক্ষশীলায়।
খাণ্ডব দাহনের পর থেকেই নাগজাতির সঙ্গে কুরুবংশের বিরোধ চলছিল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর সেই বিরোধ চরমে ওঠে। এরই চূড়ান্ত পর্যায়ে নাগরাজ তক্ষকের প্রেরিত কশ্যপ নামের এক গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হন কুরুরাজ পরীক্ষিত।
পরীক্ষিতের পুত্র জন্মেজয় সিংহাসনে আসীন হয়েই নাগজাতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তক্ষশীলা অবরোধ করা হয়। নাগসৈন্য প্রবল বিক্রমের সঙ্গে সংগ্রাম করতে থাকে।
অবশেষে এক শ্রাবণী অমাবস্যার রাতে কুরুসেনা ধর্মযুদ্ধের নিয়মভঙ্গ করে তক্ষশীলায় প্রবেশ করে। নগরীতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। প্রতিটি পুরুষ, নারী, বৃদ্ধ ও শিশুকে জীবন্ত দগ্ধ করা শুরু হয়। জন্মেজয় এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নাম দেন সর্পযজ্ঞ।
জন্মেজয় হয়তো সমগ্র নগরীটিই ধ্বংস করতেন। কিন্তু বাধ সাধলেন পদ্মাবতীপুত্র আস্তিক।
তক্ষশীলা তখন থেকেই অধ্যয়নকেন্দ্র হিসেবে সুনাম করতে শুরু করেছে। সেখানে ছোটবড় মিলিয়ে বেশ কিছু গুরুকুল ছিল, নাগরাজ তাদের ভরণপোষণ করতেন। পদ্মাবতীপুত্র আস্তিক সেখানে কোনও একটি গুরুকুলে শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন উপলক্ষে উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন তাঁর পিতাও।
ন্যায় এবং স্মৃতিতে আস্তিকের বিশেষ অধিকার ছিল। তিনি সেই হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার পাঁচদিন পর কোনও কৌশলে কুরুরাজ জন্মেজয়ের রাজস্কন্ধাবারে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি নিজের ওজস্বী ভাষণ ও বাকচাতুর্যে জন্মেজয়কে এই সর্পযজ্ঞ থেকে নিবৃত্ত করেন। তক্ষশীলা সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা পেল। নাগজাতি সমূলে উৎপাটিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেল।
কিন্তু দিব্যনাগ জানতেন এই শান্তি সাময়িক। কুরুবংশের প্রতিশোধের আগুন আবার জ্বলে উঠবে একদিন, ছারখার করে দেবে নাগজাতিকে।
তাই একদিন তিনি কন্যা পদ্মাবতী আর পৌত্র আস্তিককে নিয়ে অনির্দেশের পথে যাত্রা করেন। আস্তিক যে গুরুকুলের শিক্ষার্থী ছিলেন, সেখানে তাঁর এক চৈনিকদেশাগত সতীর্থ ছিলেন। তিনিই তাঁদের নিজের দেশে আমন্ত্রণ জানান।
বড় দুঃখে, বড় শোকে পদ্মাবতী আর আস্তিক এই ভারতভূমি ত্যাগ করেন। তার একটি কারণ যদি হয় দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া, তবে দ্বিতীয়টি হচ্ছে যে আস্তিকের পিতা, তথা পদ্মাবতীর স্বামী জরুৎকারু সেই জন্মেজয়’র সর্পযজ্ঞে নিহত হন।
পদ্মাবতী অভিশাপ দিয়ে যান, তাঁর বংশের কোনও এক নারী একদিন নাগকন্যা হয়ে এই দেশে ফিরে আসবে। ফিরে আসবে মূর্তিমান অভিশাপ হয়ে, সর্বগ্রাসী ধ্বংস হয়ে।’
‘কিন্তু এর সঙ্গে আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির কী সম্পর্ক, আর্য চারুদত্ত?’
‘সম্পর্ক আছে মিত্র কাহ্ন!’ দন্তহীন মুখে হাসলেন চারুদত্ত। তারপর সামান্য কৌতুক আর অনেকখানি রহস্য মিশিয়ে বললেন, ‘বঙ্গদেশের বর্তমান রানি হচ্ছেন সেই কর্কটনাগকন্যা পদ্মাবতীর সাক্ষাৎ উত্তরাধিকারী।’
.
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন