অভীক সরকার
৭৪৯ খ্রিস্টাব্দ৷ নালন্দা মহাবিহার, পাটলিপুত্র, মগধ৷
.
পদ্মসম্ভব যখন সভায় প্রবেশ করলেন, সেই গভীর রাতেও অনেক লোক উপস্থিত৷ তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের গেরুয়া পোশাক, মস্তক মুণ্ডিত৷ বোঝাই যায়—এঁরা নালন্দার ভন্তে বা অধ্যাপক৷
বাকিদের দেখলে অবশ্য শ্রদ্ধা হওয়া মুশকিল৷ তাঁদের ময়লা পোশাক আর নোংরা দাড়িগোঁফ দেখলে বোঝা যায়, সমাজের নিম্নশ্রেণীতে এঁদের বাস৷ তাঁদের বসে থাকার ভঙ্গিতে কিন্তু কোনও হীনমন্যতা নেই৷ আশ্চর্য আর সহজ প্রশান্তি ছড়িয়ে আছে প্রত্যেকের শরীরে৷ উপস্থিত আছেন একজন নারীও৷ এই অঞ্চলের বৌদ্ধ ভিক্ষুণীদের মধ্যে প্রজ্ঞায় ও শীলে এই বিদুষী তরুণীটি অত্যন্ত সম্মানের পাত্রী৷
তবে সকলের মধ্যে প্রথমেই দর্শকের মনোযোগ কেড়ে নেন যে দুজন, তাঁদের ব্যক্তিত্বের মধ্যে ঝলসে উঠছে শান্ত গাম্ভীর্য৷ তাঁদের একজন অপেক্ষাকৃত তরুণ, তিনি পরেছেন বৌদ্ধশ্রমণদের গেরুয়া পোশাক৷ মধ্য তিরিশের এই যুবকটির উজ্জ্বল চক্ষু দুটিতে গভীর প্রজ্ঞা ও অসামান্য মেধার চিহ্ন জ্বলজ্বল করছে৷ অন্যজনকে দেখলেই বোঝা যায় ইনি জাতিতে ক্ষত্রিয়৷ বয়সে প্রৌঢ় হলে কী হবে; বলিষ্ঠ শরীর, বিপুল পেশী এবং কঠিন দৃষ্টিতে সেটা পরিস্ফূট।
পদ্মসম্ভবকে সভায় ঢুকতে দেখে অনেকের মুখেই সসম্ভ্রম বিস্ময়ের ছায়া খেলে গেল৷ উদীয়ানের রাজকুমারের অবিশ্বাস্য কীর্তিকলাপের বিবরণ এখনই প্রায় অলৌকিক কাহিনির স্থান নিয়েছে৷ লোকে তো এমনও বলে যে, ইনি নাকি জন্মগতভাবেই গুহ্যজ্ঞানসিদ্ধ, অমিত ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতার অধিকারী৷ উদীয়ান ও লিচ্ছবীর জনসাধারণের কাছে ইনি স্বয়ং দ্বিতীয় অমিতাভ; কেউ কেউ এমনও বলে যে ইনি নিজেই অবলোকিতেশ্বর৷
পদ্মসম্ভবের দিকে অনিমেষে তাকিয়ে ছিলেন প্রৌঢ় ক্ষত্রিয়পুরুষটি৷ আহা, কী মনোহর রূপই না ঈশ্বর দিয়েছেন এই যুবককে৷ গাত্রবর্ণ ঘোর তাম্রাভ, টানাটানা চক্ষে যেন স্বয়ং ব্রজের বংশীধারী শ্রীকৃষ্ণ৷ ঘন কুঞ্চিত চুল, নাক সামান্য চাপা, দুই বাহু আজানুলম্বিত৷
পদ্মসম্ভব ঢুকেই প্রণত হলেন শ্রমণের সামনে, শ্রদ্ধাভরে বললেন, ‘মাতা সরস্বতীর সাক্ষাৎ বরপুত্র, ভারতভূমির শ্রেষ্ঠতম পণ্ডিত আচার্য শান্তরক্ষিতকে আমার প্রণাম৷’
আসন হতে দ্রুত উঠে এসে পদ্মসম্ভবকে গভীর আলিঙ্গনে বুকে টেনে নিলেন শান্তরক্ষিত৷ তিনি বড় স্নেহ করেন অমিত শক্তিধর এই রাজকুমারকে৷ শুধু স্নেহ নয়, অনেকখানি শ্রদ্ধাও তার সঙ্গে মিশে থাকে৷ সস্নেহে প্রশ্ন করলেন, ‘সব কুশল তো রাজকুমার? যে কঠিন কাজের জন্য আপনাকে তিব্বতে পাঠানো হয়েছিল, তা সুসম্পন্ন হয়েছে? আমার প্রিয় শিষ্য কমলশীল সুস্থ দেহে ফিরে এসেছে?’
‘তা আর পুরোপুরি সম্পন্ন হল কই? যে বটুয়াটির জন্য যাওয়া, সেটি হাতে পেয়েছি বটে, সঙ্গে একটি পত্রও ছিল। কিন্তু রাস্তায় আবার তিন অপোগণ্ডের সঙ্গে দেখা৷ ঠাণ্ডা মাথায় তাদের দুটো ভালো কথা বলতে গেলাম, অসভ্যের মতো দাঁতমুখ খিঁচিয়ে তেড়ে এল! কী সমস্যা বলুন দেখি৷’
‘সে কী! তারা কারা?’
‘কীসব উদ্ভট নাম, মনে নেই৷ পালের গোদাটির নাম বোধহয় মাশাং৷’
‘মাশাং? তিব্বতের মহামন্ত্রী মাশাং? আপনি ঠিক শুনেছেন রাজকুমার? তিনি নিজে এসেছিলেন আপনাদের বাধা দিতে?’ শিহরিত স্বরে প্রশ্ন করেন অন্যতম শিষ্য হরিভদ্র৷
‘হ্যাঁ তিনিই।’ বলেন পদ্মসম্ভব, ‘লোকটা যেমন মর্কট, তেমনই শুয়োরের মতো ঘোঁতঘোঁত করে৷ মাথায় খুব আলতো করে সামান্য একটা চাঁটি মেরেছি কি মারিনি, হাঁউমাউ করে সে কী চিৎকার৷’
‘তারপর?’ প্রশ্ন করেন সেই ক্ষত্রিয় পুরুষ৷ পদ্মসম্ভবের কথা শুনে বেশ আমোদ বোধ করছিলেন তিনি৷
‘তারপর? হুমম…’ ভুরু কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করেন পদ্মসম্ভব, ‘দুটোর মুণ্ডু ওড়ালাম, আর একটার সঙ্গে কী করেছি মনে নেই৷ তবে দুঃখের কথা, পালের গোদা হাত ছেড়ে পালিয়ে গেল।’
‘মাশাং-এর ব্যবস্থা পরে করা যাবে, আর্য৷ কিন্তু আমার শিষ্য কমলশীল কোথায়? কেমন আছে সে?’ আচার্য শান্তরক্ষিত দৃশ্যতই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।
‘তাঁকে আর এত অবধি আনা গেল না আচার্য৷ তিনি বড় কাহিল হয়ে পড়েছেন৷ তাঁকে কজঙ্গলে রেখে এসেছি, সিদ্ধাচার্য শবরবজ্রের কাছে৷’
‘কেমন আছে কমলশীল? তার কোনও ক্ষতি হয়নি তো?’
‘না, না, তিনি শারীরিকভাবে ঠিকই আছেন, মানসিকভাবে একটু…আসলে মাশাং তাঁকে বিশেষভাবে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করছিলেন কিনা, তার বিবরণ শুনেই তিনি মানসিকভাবে একটু, মানে ইয়ে আর কী…সামান্য আহত হয়েছেন৷ অথচ বিচলিত হওয়ার কোনও কারণই ছিল না আচার্য৷ আমি তো সেই আপ্যায়নের বিবরণ শুনে বেশ আনন্দিত হই৷ কিন্তু আপনার শিষ্যটি এতই দুর্বলচিত্তের যে…’
‘আপ্যায়নের বিবরণ শুনতে পারি কি?’ সভ্যদের মধ্যে একজন বলেন৷
‘আরে সেসব শুনে তো আমারই ইচ্ছে করছিল ওদের হাতে বন্দি হতে, বুঝলেন মিত্র ঢেণ্ঢন৷ ছাং নামের তিব্বতী সুরা আর চমরী গাইয়ের মাংস দিয়ে আপ্যায়নের শুরু, বুঝলেন তো? অতঃপর এক সুন্দরী বারবণিতার সঙ্গে কিছু উত্তেজক মুহূর্ত কাটানোর সুযোগ…’
শুনেই বৌদ্ধ শ্রমণেরা সমবেতভাবে শিহরিত হলেন, ছিছিক্কারের শব্দে ভরে গেল সেই সভা৷ তথাগতের নামে স্বস্তিবাচন উচ্চারণ করলেন আচার্য শান্তরক্ষিত৷ মুচকি হাসলেন প্রৌঢ় ক্ষত্রিয়।
কলরব থেমে যাওয়ার পর সভায় উপস্থিত একমাত্র ভিক্ষুণীর শান্ত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘আর্য পদ্মসম্ভব দেখছি সুন্দরী বারবণিতার সঙ্গে উত্তেজক মুহূর্ত কাটানোর ব্যাপারে বড়োই ব্যগ্র হয়ে পড়েছেন!’
পদ্মসম্ভব প্রথমে লক্ষ করেননি ভিক্ষুণীটিকে৷ এবারে খুবই লজ্জিত হলেন তিনি, জিভ কেটে বললেন, ‘প্রব্রাজিকা মন্দর্ভাও উপস্থিত দেখছি৷ এহে। আমি অত্যন্ত লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী আর্যা। প্রগলভতা মার্জনা করবেন৷’
মন্দর্ভার কমনীয় মুখখানি কিঞ্চিত রক্তবর্ণ হল৷ সেটা রাজকুমার পদ্মসম্ভবের সঙ্গে লক্ষ করলেন আরেকজনও৷
আচার্য শান্তরক্ষিত৷ রক্তের সম্পর্কে ভিক্ষুণী মন্দর্ভার জ্যেষ্ঠভ্রাতা তিনি!
আজ থেকে বেশ কয়েকমাস আগে এই রাজকুমারকে প্রথমবারের জন্য দেখেছেন মন্দর্ভা৷ নালন্দা মহাবিহারের বাইরে, গভীর অরণ্যের মধ্যে এক গোপন কুটীরে আয়োজন করা হয়েছিল এক মন্ত্রণাসভার৷ সেই সভায় রাজকুমার পদ্মসম্ভব এবং আচার্য শান্তরক্ষিতের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন তিনিও৷
সেই সভাতেই আচার্য শান্তরক্ষিত জানান যে, পোন পুরোহিতদের গোপন ভাণ্ডার থেকে দুটি অমূল্য সম্পদ চুরি করে আনার জন্যেই কমলশীলকে তিব্বত পাঠিয়েছেন তিনি৷ কমলশীল জানিয়েছেন যে তিনি সফল হলেও, তিব্বত থেকে পালিয়ে আসাটা খুবই বিপজ্জনক৷ চুরি টের পাওয়া মাত্র মাশাং এবং তার অনুগামী সামন্তরা খ্যাপা নেকড়ের মতো খুঁজে বেড়াবে তাঁকে৷ এখনও অবধি তিব্বতের সর্বত্র সম্রাটের শাসন চলে না, রাজধানীর বাইরে বেশিরভাগ অঞ্চলই সামন্তদের অধীনে৷ তাদের অনেকেই আবার পোন ধর্মের পুরোহিত, মাশাং-এর কাছের লোক৷ ফলে বাইরের সাহায্য ছাড়া এই জিনিস তিব্বতের বাইরে নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব৷ অথচ সে সাহায্য এত গোপনে হতে হবে যে, কেউ যেন এই অভিযোগ না তোলে—গৌড় বা বঙ্গের বৌদ্ধরা তিব্বতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাচ্ছে৷
বিপদ বুঝে গোপনে পত্র পাঠিয়েছেন কমলশীল। জানিয়েছেন যে—সেই দৈবী অস্ত্রদুটি যদি তিব্বতের বাইরে বার করে নিয়ে যেতে হয়, তাহলে অন্য কোনও কৌশল অবলম্বন করতে হবে আচার্য শান্তরক্ষিতকে৷ সঙ্গে এ-ও জানিয়েছেন যে দৈবগতিতে তাঁর হাতে একটি আশ্চর্য পত্র এসে পৌঁছেছে। আচার্য শান্তরক্ষিতের সেই পত্রটি পাঠ করা আশু প্রয়োজন।
সেই সভাতেই আচার্য শান্তরক্ষিত রাজকুমার পদ্মসম্ভবকে অনুরোধ করেন এই কাজের দায়িত্ব নিতে৷ প্রস্তাব শোনামাত্র সহর্ষে সম্মত হন পদ্মসম্ভব। সব রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজে তাঁর বরাবরই প্রবল উৎসাহ৷
সেইদিন থেকে এই যুবককে দেখে নিজের সদ্য কৈশোর পেরোনো দেহে ও মনে এক আশ্চর্য চাঞ্চল্য অনুভব করেছেন মন্দর্ভা৷ গোপন মন্ত্রণাসভাটির পর থেকেই তাঁর নিভৃত স্বপ্নে বারবার হানা দিয়েছে এই আশ্চর্যবুদ্ধি পরিহাসপ্রিয় রাজপুত্র৷ সেই কিশোরীসুলভ চাঞ্চল্যের লক্ষণগুলিকে চিনে নিতে ভুল হয়নি তাঁর৷
ছিঃ ছিঃ ছিঃ, বৌদ্ধসঙ্ঘের ভিক্ষুণী তিনি৷ তাঁর কী এমন চাপল্য শোভা পায়?
তার পর থেকেই লজ্জায় ও পাপবোধে বেশ কিছুদিন আক্রান্ত ছিলেন মন্দর্ভা৷ নিজেকে বহুবার শাসন করেছেন তিনি, কঠোর সাধনায় ডুবিয়ে দিয়েছেন৷ নিজেকে বলেছেন তাঁর পক্ষে এমন জাগতিক বাসনায় অভিভূত হওয়া ঘোরতর পাপ৷
কিন্তু তবুও, তবুও যাবতীয় ঔচিত্যের কঠিন বাঁধন ভেঙে এই অনিন্দ্যসুন্দর রাজকুমারকে দেখামাত্র তাঁর তরুণী হৃদয় প্রদীপের মতো পুড়তে শুরু করে কেন? কেনই বা এঁর মুখে অন্য রমণীর কথা শুনে তাঁর হৃদয় সহসা ঈর্ষাজর্জর হয়ে পড়ে?
নিজেকে সংযত করলেন।
ইতিমধ্যে আচার্য শান্তরক্ষিত পদ্মসম্ভবকে তাঁর পাশেই যত্ন করে বসিয়েছেন৷ তারপর আচার্য প্রৌঢ় ক্ষত্রিয়পুরুষটির সঙ্গে পরিচয় করাচ্ছিলেন রাজপুত্র পদ্মসম্ভবকে৷
এই সময় সহসা খুলে গেল সভাগৃহের দরজা৷ ঝড়ের মতো সেখানে এসে দাঁড়ালেন এক দীপ্যমান পুরুষ৷ নবদুর্বাদলশ্যাম সেই পুরুষটি তাঁর আজানুচুম্বিত বাহুতে আর মায়া-ঢলোঢলো আয়ত চক্ষু দুটিতে যেন মর্ত্যধামে দ্বিতীয় বিষ্ণু৷ তাঁকে দেখেই সশ্রদ্ধায় উঠে দাঁড়ালেন সভায় উপস্থিত সকল সভ্য৷ আচার্য শান্তরক্ষিত কৃতাঞ্জলিপুটে প্রণত অভিবাদন জানালেন তাঁকে৷ উপস্থিত প্রত্যেকে করজোড়ে, অনিমেষ নয়নে দেখতে থাকলেন এই ঈশ্বরোপম মানুষটিকে৷
যদিও তিনি সেসব নিয়ে বিন্দুমাত্র ব্যগ্র ছিলেন না৷ সাগ্রহে প্রশ্ন করলে, ‘ফিরেছে কমলশীল? পেরেছে সে? তিব্বত থেকে সেই অতি প্রয়োজনীয় অস্ত্র দুটি নিয়ে আসতে পেরেছে? তাহলে কি চূড়ান্ত সংগ্রামের সময় এসে গেছে শান্তরক্ষিত?’
সশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন আচার্য, ‘হ্যাঁ লোকেশ্বর, আপনার আশীর্বাদে সবই নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন হয়েছে৷ অনুগ্রহ করে আসন গ্রহণ করুন, প্রভু৷ আজকে আমাদের অভ্যুত্থানের শেষ পর্যায়টির পরিকল্পনার দিন৷ আমরা আজকের সভা সেই কারণেই আহ্বান করেছি৷’
তারপর সভার দিকে ফিরে আচার্য শান্তরক্ষিত শান্তকণ্ঠে বললেন, ‘যাঁর জন্যে আমরা উদগ্রীব হয়ে প্রতীক্ষা আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম, অবশেষে তিনি আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছেন৷ তাঁরই আদেশে, তাঁরই প্রদর্শিত পথে আমরা অত্যাচারী শাসকদের হাত থেকে আমাদের মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে ব্রতী হয়েছি৷’ এই বলে তিনি ফিরে তাকালেন সেই মহাপুরুষটির দিকে, তারপর ভক্তিনম্রস্বরে বললেন, ‘হে প্রভু মহাযোগী লোকেশ্বর মৎস্যেন্দ্রনাথ! আমাদের মতো অভাজনদের আপনিই পথ দেখান৷’
.
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন