অভীক সরকার
চুম্বনের ঠিক পূর্বমুহূর্তে কী যেন একটা অস্বস্তি হল গোপালদেবের। মনে হল কে যেন তাঁর মুখটি সামান্য সরিয়ে দিল। দুটি ওষ্ঠ যেন বিকর্ষণ করছে পরস্পরকে।
নারীটি সামান্য অবাক হলেন। তারপর কামজড়িত স্বরে বললেন, ‘কী হল প্রভু, আসুন, আমাদের অধরে অধরে প্রেমের পুষ্প প্রস্ফূটিত হোক।’
পুষ্প শব্দটি শুনেই আচ্ছন্ন, বিহ্বল গোপালদেবের মাথার মধ্যে কী যেন একটি কথা ভেসে উঠল।
মৎস্যেন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে বিশেষ ঔষধটি তাঁকে সেবন করানো হয়েছে, তার অনেক গুণাগুণের মধ্যে একটি হচ্ছে বিষবিকর্ষণ। যে কোনও বিষাক্ত বস্তু, দ্রব্য বা প্রাণী থেকে স্বতই বিকর্ষিত হওয়ার ক্ষমতা আছে এর।
কথাটা মাথায় আসতেই সচকিত হলেন গোপালদেব। মাথার মধ্যেকার ধোঁয়াশা ভাবটাও খানিক স্তিমিত হয়ে এসেছে। প্রথমেই তাঁর মাথায় যে প্রশ্নটা এল, কীসে বিকর্ষিত হল তাঁর দেহ?
টানা টানা চোখদুটির দিকে তাকালেন গোপালদেব। আহা, ঈশ্বর স্বয়ং যেন তাঁর তুলিতে নিপুণভাবে এঁকেছেন ওই আঁখিদুটি। কত মায়া, কত প্রেম, কত না বলা কথাই যেন জমে আছে ওই দুটি চোখে।
আর রক্তিম দাড়িম্বর মতো বক্ষদুটি, যেমন উষ্ণ, তেমনই নরম। গোপালদেবের ইচ্ছা হল সপ্রেম হস্তে দলিতমথিত করেন ও দুটি।
আর নদীর বাঁকের মতো ঠোঁটদুটির তো কথাই নেই। যেন নাম না জানা কোনও শিল্পীর অমর সৃষ্টি। আর সেই ঠোঁটদুটির ফাঁকে…
একটু থামলেন গোপালদেব৷ ক্ষণমুহূর্তের জন্য তাঁর মনে হল—কী যেন একটা ওই ঠোঁটদুটির মাঝে উঁকি দিয়েই চলে গেল। কী ওটা?
.
.
বিদ্রোহীবাহিনীর উপর বন্যার মতো আছড়ে পড়ল কালকূটসেনা, যেভাবে ক্ষুদ্র দ্বীপের ওপর আছড়ে পড়ে প্রবল ঝঞ্ঝাসংক্ষুব্ধ ঊর্মিমালা, যেভাবে দাবানলের ওপর আছড়ে পড়ে বিপুল নির্ঝরপ্রবাহ।
জয়াপীড়ের প্রথম খড়্গাঘাতেই দুজন কালকূটসেনা মুণ্ডহীন হল। তাঁর রণহুঙ্কার পার্বত্যসিংহের মতো ভীষণ, গম্ভীর এবং ভীতিপ্রদ। তিনি সিংহবিক্রমে কালকূটসেনা সংহারে রত হলেন।
একটু দূরেই ছিলেন পদ্মসম্ভব। তাঁর এক হাতে দা’ও, অন্য হাতে ভীমদর্শন অসি। তিনি সব্যসাচী, তাঁকে দুই হাতে শত্রুসৈন্য নিপাত করতে দেখে মনে হল যেন বহুদিন বাদে অস্ত্রধারণ করতে পেরে ভারি প্রসন্ন হয়েছেন।
দেদ্দদেবীকে দেখে মনে হল যেন একটি জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড যুদ্ধক্ষেত্রটি দ্রুতবেগে প্রদক্ষিণ করছে৷ তাঁর দ্রুতচকিত চলন বিভ্রান্ত এবং বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছিল কালকূটসেনার সঙ্ঘ গঠন।
আর মৎস্যেন্দ্রনাথ! কে জানত যোগেশ্বর নিজে এমন দুর্দান্ত রণকুশল যোদ্ধা? অমিতবিক্রমে তিনি চালনা করছিলেন তাঁর ত্রিশূলটি। যেন আদিদেব মহাদেব স্বয়ং অবতীর্ণ হয়েছেন এই ধরাধামে।
কিন্তু এতদসত্বেও ঘটনাপ্রবাহ প্রথম থেকেই বিদ্রোহীদের বিপক্ষে যাচ্ছিল। প্রথমত, তাঁরা সর্বাংশে অপ্রস্তুত। দ্বিতীয়ত, কালকূট সেনা বঙ্গদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ রণকুশল বাহিনী। তাদের প্রশিক্ষণ, যুদ্ধদক্ষতা, সঙ্ঘশক্তি প্রশ্নাতীত। শৈবযোগী আর সহজিয়া সন্ন্যাসীরা যতই উজ্জীবিত, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোন না কেন, রণচাতুর্যে কিছুতেই এদের তুল্য নন।
বিদ্রোহীদলের সদস্যরা একে একে আহত এবং নিহত হতে লাগলেন। বিদ্রোহীদের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসতে লাগল।
বপ্যট একটি বিশাল খড়্গ হাতে দুই কালকূট সেনার সঙ্গে যুদ্ধরত ছিলেন। তিনি একবার চারিদিকে তাকিয়ে প্রমাদ গণলেন। কালকূট সেনা আহত হলেও তাদের দৈহিক সক্ষমতা অতুলনীয়, রণভূমি ছাড়ার প্রশ্নই নেই। তাই যুদ্ধরত কালকূট সেনার সংখ্যা খুব বেশি কমছে না। অথচ বিদ্রোহী সেনা সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে।
কালকূটসেনা কৌশলে এক এক জন বিদ্রোহী নেতাদের ঘিরে ছোট ছোট বৃত্ত রচনা করছে। তাদের অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। মন্দর্ভা আর শান্তরক্ষিতকে ঘিরে বৃত্তটি ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। আর হয়তো বেশিক্ষণ নয়। দেদ্দদেবী সেদিকে যেতে চাইলেও তাঁকে বাধা দিচ্ছে চারজন কালকূট সেনা।
ওদিকে মৎস্যেন্দ্রনাথ তাঁর ত্রিশূল নিয়ে প্রাণপণে যুদ্ধ করে করে চলেছেন। তাঁর সর্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত। এরই মধ্যে একবার আর্তনাদ করে উঠলেন মন্দর্ভা। বপ্যট তাকিয়ে দেখলেন, এক কালকূটসেনা সবলে টেনে ধরেছে তাঁর কেশরাশি। শান্তরক্ষিত নিরস্ত্র, তাঁর হাতের অস্ত্র খসে পড়েছে মাটিতে। একটি অসি উত্তোলিত হল, এই বুঝি ভূলুণ্ঠিত হয় ভারতের শ্রেষ্ঠতম আচার্য শান্তরক্ষিতের মাথা।
এই প্রথম কুমার গোপালদেবের অভাব অনুভব করলেন অসহায় বপ্যট। গোপালদেব একাই এই কালকূটসেনার অর্ধেকের স্পর্ধা দমন করতে পারেন। তিনি থাকলে আজ এই অবশ্যম্ভাবী সর্বনাশের সম্মুখীন হতে হতো না তাঁদের।
কিন্তু সেই তীক্ষ্ণধার অসি আচার্য শান্তরক্ষিতের কণ্ঠায় নেমে আসার আগেই তীর ছুটে এল উত্তোলিত অসি লক্ষ্য করে। বপ্যট তাকিয়ে দেখলেন ঘুরে দাঁড়িয়েছেন কুমার পদ্মসম্ভব, হাতে সেই খর্বকায় নাগাঞ্চি ধনু। তাঁর চারিপাশে মৃত কালকূটসেনার স্তূপ। তাঁর পেশি ফুলে উঠেছে সিংহের কেশরের মতো। উন্মুক্ত কেশরাশি উড়ছে আগুনের মতো। দুচোখে ক্রোধ। রক্তঘামে ভিজে গেছে সমস্ত দেহ।
এই প্রথম পদ্মসম্ভবের বিপুল বলের আভাস পেলেন বপ্যট, আর অত্যন্ত আশ্চর্য হলেন। তিনি চিরকাল পদ্মসম্ভবকে দেখে এসেছেন একজন সাধারণ বুদ্ধিমান কৌতুকপ্রিয় বঙ্গবাসী রূপে। একটু আগেই তাঁকে একবার উত্তেজিত হতে দেখেছিলেন, আর এখন দেখলেন ক্রুদ্ধ ভৈরবাবতারে।
হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন পদ্মসম্ভব। তারপর ধনুর্বাণ ফেলে রক্তস্নাত দা’ও নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মন্দর্ভার উদ্ধারকল্পে।
শান্তচোখে সমস্ত ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলেন প্রকাশচন্দ্র। আর কতক্ষণ? এক দণ্ড? দুই দণ্ড?
একবার বামহাতের তর্জনীর দিকে তাকালেন তিনি। আঙুলটি এখনও নীলাভ হয়ে আছে৷ রানি এখন মহাবিষে পরিপূর্ণ৷ একটিমাত্র দংশন। আর তারপরেই গোপালদেবের কর্তিত মুণ্ড নিয়ে ছুটে আসবে মাধব। সেই রকমই কথা হয়ে আছে।
প্রকাশচন্দ্র কালকূটসেনার দ্বিতীয় অংশকে আদেশ দিলেন আক্রমণের। এই আক্রমণ প্রতিহত করা অসম্ভব।
আরেকদল কালকূটসেনাকে এগিয়ে আসতে দেখে প্রমাদ গণলেন বপ্যট৷ তাঁর কিরাত-শবর সৈন্যদল কোথায়?
ততক্ষণে মৎস্যেন্দ্রনাথ এবং জয়াপীড়কে ঘিরে ফেলেছে কালকূটসেনার একটি বৃহৎ অংশ। দেদ্দদেবী এসে যোগ দিয়েছেন পদ্মসম্ভবের সঙ্গে। তাঁরা রক্ষা করার চেষ্টা করছেন শান্তরক্ষিত এবং ভিক্ষুণী মন্দর্ভাকে। জয়াপীড় একত্রিত হয়েছেন জালন্ধরনাথ, এবং বেঁচে থাকা অল্প কয়েকজন শৈব এবং সহজ সন্ন্যাসীদের সঙ্গে।
প্রকাশচন্দ্র নির্ভারচিত্তে উঠে দাঁড়ালেন। আর অর্ধদণ্ড মাত্র৷ তারপরেই বিজয়লক্ষ্মী তাঁর…
তাঁর ভাবনা মনেই রইল। অগ্রসর দ্বিতীয় কালকূটসেনার দিকে উড়ে এল একঝাঁক তীর। উড়ে এল লালিম্ববনের ভেতর থেকে। সঙ্গে শত শত মোষের শিঙার ধ্বনি। তারপরেই জঙ্গলের আবরণ থেকে বেরিয়ে এল কৃষ্ণকায় ভীমদর্শন কিরাত-শবরের দল।
স্বস্তির শ্বাস ফেললেন বপ্যট৷ তাঁর বাহিনী এসে গেছে।
প্রথমে স্তম্ভিত, তারপর ক্রোধদীপ্ত হলেন প্রকাশচন্দ্র। তুলে নিলেন তাঁর মহাখড়্গ। সারথিকে বললেন তাঁর রথ জয়াপীড়ের দিকে চালনা করতে।
.
রানি একটানে খুলে নিলেন গোপালদেবের উত্তরীয়। তারপর তাঁকে সবলে আলিঙ্গন করে লেহন করতে থাকলেন কর্ণমূল।
গোপালদেবের সুঠাম বুকে দুটি উদ্ধত এবং কোমল স্তন নিষ্পিষ্ট হচ্ছিল। কর্ণমূলে শিরশিরানির সঙ্গে ভেসে আসছে এক কামার্তা নারীর আকুল নিবেদন, ‘আমাকে গ্রহণ করুন আর্য, বিদ্ধ করুন আপনার পৌরুষে। আমার নারীত্বের অর্ঘ্য গ্রহণ করুন। আমাকে সম্পূর্ণ করুন।’
যে কোনও সমর্থ পুরুষের শরীর এই আহ্বানে সাড়া দিতে, এই আগুনে নিজেকে সমর্পণ করতে বাধ্য। বহু তপস্যায় এমন বরবর্ণিনী তিলোত্তমা স্বয়মাগতা হয়। কিন্তু সেই স্পর্শে গোপালদেবের অস্বস্তি বহুগুণ বর্ধিত হল।
এক অবলা কামিনীর পেলব হাত দু’খানি এমন শক্ত, সবল, লৌহকঠিন হয় কী করে?
হাত দুটির স্পর্শ মাঝেমধ্যে এমন পিচ্ছিল, সর্পিল অনুভূত হচ্ছে কেন?
কর্ণমূলে যে শব্দগুলি ভেসে আসছে তার মধ্যে একটি অতি ক্ষীণ হিসহিস শব্দ শ্রুত হচ্ছে কেন?
গোপালদেব যেন আচম্বিতে সম্পূর্ণ জাগ্রত হয়ে উঠলেন। জেগে উঠলেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে, নিদ্রা থেকে জাগরণের দিকে, বিহ্বলতা থেকে সচেতনতার দিকে। তাঁর মনে পড়ে গেছে তিনি কেন এসেছেন এখানে।
শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করলেন গোপালদেব, তারপর সবলে নিজেকে মুক্ত করলেন সেই কামিনীপাশ থেকে।
নারীশরীর ছিটকে পড়ে গেল শয্যার ওপর। কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা। তারপর ধীরে ধীরে উঠে বসলেন বঙ্গদেশের মহারাজ্ঞী। অন্ধকারের মধ্যে তাঁর চোখ দু’খানি একবার ধক করে জ্বলে উঠেই নিভে গেল। তারপর ধীরে ধীরে তাঁর ওষ্ঠপ্রান্তে একটি হাসি ফুটে উঠল। আদুরে স্বরে তিনি বললেন, ‘কী হল নাথ, অভাগিনীকে কি পছন্দ হল না? নাকি বিদ্রোহের ভার, যুদ্ধদ্যোগের ক্লান্তি আপনাকে গ্রাস করেছে? আসুন, এই শয্যায় একবার উপবেশন করুন প্রভু। আপনার শ্রান্তিভার লাঘব করিয়ে…’
‘স্তব্ধ হ কুলটা নাগিনী।’ ধমকে উঠলেন গোপালদেব, ‘নিজের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হ। আজ তোর সমস্ত কামজ্বালা জন্মের মতো মিটিয়ে দিতে এসেছি, তোর আর তোর সঙ্গীদের এতদিনের পাপের প্রতিশোধ নিতে এসেছি।’
মহারানি কিছুক্ষণ সর্পিল চোখে চেয়ে রইলেন গোপালদেবের দিকে। তারপর ব্যঙ্গখলখল স্বরে বলে উঠলেন, ‘মৃত্যু? আমার? তোর হাতে?’ বলতে-বলতেই উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলেন রানি।
আর তখনই তাঁর মুখগহ্বরের দিকে চোখ গেল গোপালদেবের। তিনি দেখলেন রানির জিহ্বাটি মানুষী জিহ্বা নয়। অবিকল সাপের মতো, দু’ভাগে বিভক্ত।
গোপালদেব অসমসাহসী পুরুষ। তবু তিনিও মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠলেন। কী বীভৎস! কী সাঙ্ঘাতিক!
তবে তাঁর আতঙ্কিত হওয়া তখনও বাকি ছিল।
গোপালদেবের ভীত, বিস্ফারিত চোখের সামনেই নারীদেহটি মোচড়াতে শুরু করল। মনে হল যেন অসহ্য যন্ত্রণায় বেঁকেচুরে যাচ্ছে দেহটি। কিন্তু যন্ত্রণার আর্তনাদ নয়, প্রতিটি মোচড়ের সঙ্গে সেই নারীর গলা থেকে ভেসে আসছিল খলখল হাসি।
একসময় দেহটি গড়াতে গড়াতে শয্যার অন্য পাশে পড়ে গেল। হাসির শব্দ তখনও ভেসে আসছে। তবে ক্রমেই তার চরিত্র বদলে যাচ্ছিল। একটা তীব্র হিসহিস শব্দ ক্রমেই দখল করে নিচ্ছিল সেই বীভৎস হাসির স্বর।
একটু পরে সব শব্দ স্তব্ধ হয়ে গেল। সমস্ত ঘর জুড়ে অস্বাভাবিক নৈঃশব্দ্য।
তারপর গোপালদেবের ব্রহ্মরন্ধ্র অবধি কাঁপিয়ে দিয়ে শয্যার ওপাশে উঠে এল অতিকায়, অতি বিশাল, অতি বীভৎস এক মহাভুজঙ্গ। তার উদ্ধত ফণার উচ্চতা গোপালদেবের মাথা পেরিয়ে। তার দেহকাণ্ডের প্রস্থ মানুষ প্রমাণ। তার সমস্ত দেহ ঘন কালো। অতল রাত্রির মতো কালো, সর্বগ্রাসী সর্বনাশের মতো কালো।
বিশাল ফণাটি এদিক ওদিক দুলল খানিকক্ষণ। তারপর তার স্ফটিককৃষ্ণ চোখদুটি স্থির হল গোপালদেবের ওপর। রক্তলাল চেরা জিভটি বেরিয়ে এল। তার প্রান্তভাগ খানিক কাঁপল তিরতির করে৷ তারপর সেই মহাকায় ভুজঙ্গ শয্যা বেয়ে এগিয়ে আসতে থাকল গোপালদেবের দিকে।
.
প্রকাশচন্দ্রের যুদ্ধপারঙ্গমতা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন বপ্যট।
তিনি নিজে মহাশূরবীর, শস্ত্রযুদ্ধে মহারথ। তাঁর পুত্র গোপালদেবও মহাবলশালী যোদ্ধা, সম্ভবত বঙ্গদেশের শ্রেষ্ঠতম শূরবীর। তিনি কুমার জয়াপীড় এবং কুমার পদ্মসম্ভবের অতিলৌকিক শারীরিক বল এবং যোদ্ধৃক্ষমতার ব্যাপারে সম্যকরূপে অবগত। কিন্তু তাঁরাও প্রকাশচন্দ্রের ধারেকাছে আসেন না।
প্রকাশচন্দ্র শত্রুনিধন করছিলেন এমন অনায়াসে, দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোনও কৃষক হেমন্তের শেষে নীবারকর্তনে রত। তাঁর একটি একটি খড়্গাঘাতে একাধিক বিদ্রোহী সৈন্য ধরাশায়ী হচ্ছিল। এত কুশলতার সঙ্গে, এত অনায়াসে, এত সাবলীল ভাবে যে শত্রুনিধন করা যায়, তা খণ্ডিতারাতি বপ্যটেরও স্বপ্নের অগোচরে ছিল।
যুদ্ধ হচ্ছিল সমানে সমানে। শবরের দল প্রশিক্ষণে কালকূটসেনার থেকে পিছিয়ে থাকলেও সংকল্পে দৃঢ়বদ্ধ। তাদের দৈহিক বল এবং দৈহিক আঘাত সহ্য করার ক্ষমতাও কালকূটসেনার সঙ্গে তুল্যমূল্য। তদুপরি তারা সংখ্যাতেও বেশি।
তবে তারা অসমসাহসী, প্রশিক্ষিত কালকূটসেনার সঙ্গে সমানে সমানে যুঝে চলেছিল তাদের আজন্মসঞ্চিত ক্রোধের ওপর ভর করে। ক্রোধ তাদের এই অবস্থার ওপর, এই শাসনের ওপর, এই শোষণের ওপর, এই মাৎস্যন্যায়ের ওপর। সেই মহাপবিত্র ক্রোধ যেন দাবানলের মতো ভস্ম করে দিতে চাইছিল কালকূটসেনাকে।
জয়াপীড় এবং তাঁর সঙ্গী কিরাত সৈন্যদল ভীমবিক্রমে ধ্বংস করছিলেন কালকূটসেনার দক্ষিণভাগ। পদ্মসম্ভব আজ মহাভৈরবরূপ ধারণ করেছেন। তিনি একাই সর্বগ্রাসী হুতাশনের মতো সংহার করছেন কালকূটসেনার উত্তরাংশ।
প্রকাশচন্দ্রের রথ অনায়াসে এসে উপস্থিত হল জয়াপীড়ের সামনে। জয়াপীড় এক আঘাতে এক কালকূটসেনার মুণ্ডচ্ছেদ করে রক্তস্নাত শার্দূলের মতো প্রকাশচন্দ্রের সম্মুখীন হলেন।
প্রকাশচন্দ্র ধীর, শান্ত অথচ দৃপ্ত পদক্ষেপে অবতারণ করলেন রথ থেকে। তারপর নিজের অস্ত্র উত্তোলিত করে বললেন, ‘তস্করের হাতে বহুমূল্য মণি আর শিশুর হাতে তীক্ষ্ণধার অসি শোভা দেয় না কুমার। ওই মহাখড়্গ মন্ত্রপূত। অনধিকারীর হাতে বিশ্রী দেখায়। ওটি আমার হাতে দিন।’
জয়াপীড় তাঁর খড়্গহাতে হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লেন প্রকাশচন্দ্রের ওপর।
.
গোপালদেব প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় পিছিয়ে গেলেন খানিকটা। তারপর দৌড়ে গেলেন দরজার দিকে। বদ্ধ কক্ষে এই মহানাগিনীর সঙ্গে সংগ্রামে রত হওয়া আর মৃত্যুকে আহ্বান করে আনা একই। উন্মুক্ত প্রান্তরে যে কোনও সরীসৃপের আক্রমণ প্রতিহত করা বরং অনেক সহজ।
কিন্তু দরজাটি হাত দিয়ে টেনে বুঝলেন যে দরজাটি বন্ধ। তাঁর জীবিত থাকার কোনও সম্ভাবনাই রাখেনি শত্রুপক্ষ।
ঘুরে দাঁড়ালেন গোপালদেব। মহাসর্প ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে। কটিদেশে হাত দিলেন গোপালদেব। বার করে আনলেন সেই মহাযন্ত্র, যা পোন পুরোহিতদের গোপন ভাণ্ডার থেকে বহু কষ্টে উদ্ধার করে এনেছেন ভন্তে কমলশীল এবং কুমার পদ্মসম্ভব।
যন্ত্রটির আকৃতি বড়ই অদ্ভুত। একটি লৌহনির্মিত নল, দৈর্ঘ্যে এক বিতস্তির কাছাকাছি। নলের শেষের এক তৃতীয়াংশ উল্লম্বভাবে বক্র। বাঁকানো অংশটি তুলনামূলক ভাবে অনেক স্থূল। তার গায়ে কাঠের আবরণ। সেই কাঠের মধ্যস্থল থেকে একটি স্থূল পলিতা বেরিয়ে আছে।
যন্ত্রটি প্রয়োগপদ্ধতি কিঞ্চিৎ জটিল। লৌহনলের সম্মুখভাগ লক্ষ্যের দিকে স্থির করে পলিতায় অগ্নিসংযোগ করতে হয়। তারপরেই মারণাগ্নি ধেয়ে যায় লক্ষ্যের দিকে।
মূল পরিকল্পনা এই ছিল যে গোপালদেব প্রাসাদে প্রবেশ করে রানিকে বলপ্রয়োগে বন্দি করবেন। তারপর কাঞ্চনাদেবীর কথামতো রানির ভ্রূমধ্যে প্রয়োগ করবেন এই মারণ অগ্নি। তাতেই নিহত হবে সেই শতাব্দীপ্রাচীন নাগপিশাচী।
কিন্তু সে সম্ভাবনা এখন সুদূর পরাহত বললে কম বলা হয়।
সেই মহাভুজঙ্গ এসে দাঁড়িয়েছে গোপালদেবের ঠিক সামনে। তার অতি ভয়ঙ্কর, অতি ভীতিপ্রদ উপস্থিতিই কোনও সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত জড়ভরত করে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট। তার ঘনকৃষ্ণস্ফটিক চোখদুটি গোপালদেবের ঠিক মুখোমুখি। সেই স্থির, নিষ্কম্প, অচঞ্চল চোখদুটিতে একটিই বার্তা লেখা আছে। মৃত্যু।
গোপালদেব চকিতে ঝাঁপ দিলেন মেঝের ওপর। দরজার অন্যপ্রান্তে এখনও একটি দীপ জ্বলছে ক্ষীণভাবে। আগুন, সামান্য একটু আগুন চাই তাঁর এখন।
কিন্তু তার আগেই সেই মহানাগিনী দ্রুত জড়িয়ে ফেলল তাঁর দেহ৷ প্রথমে পা, তারপর কোমর, তারপর ঊর্ধ্বাঙ্গের অর্ধাংশ। আর হাতের যন্ত্রটি ছিটকে চলে গেল অন্যপ্রান্তে।
ধীরে ধীরে সেই নাগিনীর উদ্যত ফণা উঠে এল গোপালদেবের বুকের ওপর। উঠতে পারছিলেন না তিনি। ক্রমেই তাঁর দেহের ওপর চাপ বাড়ছিল। মনে হচ্ছিল যেন ফুসফুসটি গলা দিয়ে বের হয়ে আসবে। মহাবলশালী তিনি। দেহে অযুতহস্তীর শক্তি ধরেন। তবুও তিনি এই আসুরিক শক্তির সামনে অসহায়ের মতো হাঁ করছিলেন একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য।
সেই বিশালাকার ফণাটি দুদিকে দুলল খানিক। তারপর অনেকটা নীচু হয়ে গোপালদেবের ঠিক মুখোমুখি স্থির হল। ক্রূর, শীতল দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল তাঁর বিস্ফারিত, আতঙ্কিত চোখের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে মুখ হাঁ করল।
এক প্রাচীন পিশাচগন্ধ নাসারন্ধ্র বন্ধ করে দিল গোপালদেবের। যেন নরকের গভীর থেকে উঠে এসেছে এই পচিত, দূষিত কটুঘ্রাণ।
ফণাটি খানিক উঁচু হল। তারপর দু’খানি বিষদন্ত সজোরে নেমে এল গোপালদেবের বুকের ওপর।
গোপালদেবের পৃথিবী অন্ধকার হয়ে এল।
.
প্রকাশচন্দ্রের আক্রমণ কিছুটা সামলেই জয়াপীড় বুঝে গেলেন যে ইনি শারীরিক বলে এবং যুদ্ধকৌশলে তাঁর থেকে অনেক এগিয়ে। যেমন অদ্ভুত তাঁর খড়্গচালনা, তেমন দ্রুত তাঁর চলন। জয়াপীড় তাঁর খড়্গ চালনা করছিলেন দুই হাতে৷ আর প্রায় একই আকারের বিশাল খড়্গ প্রকাশচন্দ্র চালনা করছিলেন এক হাতে।
জয়াপীড়ের বিপুল আঘাত এড়িয়ে সরে দাঁড়ালেন প্রকাশচন্দ্র। জয়াপীড় খানিকটা এগিয়ে গিয়েই গড়িয়ে গেলেন। মুহূর্তের মধ্যে প্রকাশচন্দ্রের খড়্গ আছড়ে পড়ল যেখানে জয়াপীড়ের মুণ্ডখানি ছিল। জয়াপীড় এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিহত করলেন পরের আক্রমণ। খড়্গে খড়্গে আগুনের ফুলকি ছুটল।
আস্তে আস্তে পিছিয়ে যাচ্ছিলেন জয়াপীড়। প্রায় দুই দণ্ড ধরে একনাগাড়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন তিনি। মহাবলশালী যোদ্ধা হলে কী হবে, তিনিও মানুষ, তাঁর জীবনীশক্তি অনিঃশেষ নয়। ক্রমেই তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন।
তাঁর পিঠ ঠেকে গেল প্রকাশচন্দ্রের রথে। এক লাফে রথে উঠে পড়লেন তিনি, তারপর রথধ্বজা ভেঙে সেটিকে ভল্লের মতো ছুঁড়লেন প্রকাশচন্দ্রের দিকে। প্রকাশচন্দ্র হেলায় সেটি দ্বিখণ্ডিত করলেন। তারপর তিনিও লাফিয়ে উঠলেন রথে। খড়্গ চালালেন জয়াপীড়ের মাথা লক্ষ্য করে। শরীরের সমস্ত ভারসাম্য দুই উরুতে বজায় রেখে মাথাটি সম্পূর্ণ পিছন দিকে হেলিয়ে দিলেন জয়াপীড়। প্রকাশচন্দ্রের খড়্গ মৃত্যুর শিস তুলে বাতাসে কেটে গেল।
জয়াপীড় লাফিয়ে নামলেন মাটিতে। তারপর এক খড়্গাঘাতে রথের ধুরা আর যুগম কেটে দিলেন। ষাঁড়দুটি মুক্ত হয়ে খুরে খুরে ধুলো উড়িয়ে যুদ্ধরত সৈন্যদের দিকে ধাবিত হল।
প্রকাশচন্দ্র ক্রুদ্ধ হয়ে রথে সজোরে পদাঘাত করলেন। ওই একই আঘাতে রথটি বিপুল শব্দে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে ভেঙে পড়ল। একটি চক্র ছিটকে এসে লাগল জয়াপীড়ের পেটে। জয়াপীড় পড়ে গেলেন। তাঁর খড়্গ ছিটকে গেল অন্যদিকে। জয়াপীড়ের সমস্ত জীবনীশক্তি শেষবিন্দুতে এসে দাঁড়াল।
প্রকাশচন্দ্র ধীরেসুস্থে এসে দাঁড়ালেন মাটিতে শুয়ে থাকা মৃতপ্রায় জয়াপীড়ের কাছে। তারপর হাঁপাতে থাকা জয়াপীড়ের মাথা লক্ষ্য করে খড়্গ তুললেন।
জয়াপীড় বহুকষ্টে তাঁর হাতের কাছে পড়ে থাকা একটি কাঠের টুকরো তুলে নিলেন। তারপর শরীরের জমে থাকা সমস্ত শক্তি দিয়ে গেঁথে দিলেন প্রকাশচন্দ্রের পায়ে।
প্রকাশচন্দ্র আর্তনাদ করলেন না বটে। তবে তাঁর ভারসাম্য সামান্য টলে গেল। তবে সে মুহূর্তের বিক্ষেপমাত্র। তারপর তিনি ফের তুলে নিলেন তাঁর খড়্গ। জয়াপীড়ের মুণ্ডচ্ছেদ কেবলমাত্র সময়ের অপেক্ষা।
ঠিক সেই মুহূর্তেই সাঁই সাঁই শব্দ তুলে ছুটে এল একটি ভল্ল। সেটি প্রকাশচন্দ্রের খড়্গে আঘাত করে তাকে বিচ্যুত করল বহুদূরে। প্রকাশচন্দ্র চমকে ঘুরে দাঁড়ালেন। তাঁর দিকে ভীমবেগে দৌড়ে আসছেন বিদ্রোহীদের প্রধান সেনাপতি, বপ্যট। তাঁর হাতে একটি ভয়ালদর্শন অসি।
প্রকাশচন্দ্র একলাফে পৌঁছলেন জয়াপীড়ের হস্তবিচ্যুত খড়্গটির কাছে, তাঁর অজেয় তাংদা’ও এর কাছে। যে মন্ত্রপূত মহাখড়্গ হাতে থাকলে তিনি অযোধ্যা, অপরাজেয়।
সেই মন্ত্রপূত খড়্গ হাতে প্রকাশচন্দ্র যখন উঠে দাঁড়ালেন তখন তাঁকে দেখে মনে হল যেন বজ্র হাতে উঠে দাঁড়িয়েছেন বৃত্রঘ্ন ইন্দ্র স্বয়ং। সেই দৃশ্য দেখে কালকূটসেনা হর্ষধ্বনি করে উঠল, ‘জয় একেশ্বর প্রকাশচন্দ্রের জয়। জয় বঙ্গরাজ্ঞীর জয়।’ সেই শুনে বিদ্রোহী কিরাত শবরসেনাও মহা হুঙ্কারে প্রতিধ্বনি করল, ‘জয় গৌড়, জয় বঙ্গ, জয় শশাঙ্ক।’
.
মৃত্যুর নরম অন্ধকার জঠরে শুয়েছিল একটি প্রাণ। তার আকার নেই, অবয়ব নেই, মাত্রা নেই। শুধু প্রাণের উদ্দীপন আছে। জীবনের সাড়া আছে। যদিও সে না থাকার মতই। তার অস্তিত্ব, ইশারা, লক্ষণ—সবই এখন পিণ্ডমাত্র।
এক নীল অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে সব কিছু যেন তলিয়ে যাচ্ছিল। ক্রমে সেই নীল রঙ হয়ে উঠছিল আরও ঘন, আরও গহীন, আরও কালো। তার মাত্রা নেই, বেধ নেই, ঊর্ধ্ব নেই, অধঃ নেই, শুরু নেই, শেষ নেই। শুধু আছে ঘূর্ণির টানে এক নিঃসীম অতলে তলিয়ে যাওয়া।
তলিয়ে যেতে যেতে ক্রমেই গাঢ় থেকে গাঢ়তর ঘুমে ঢলে পড়ছিল সেই প্রাণবিন্দু। তার অসাড় চৈতন্যে রেখাপাত করে যাচ্ছিল কয়েকটি শব্দ, কয়েকটি বাক্য, দুখানি আতুর, আকুল চোখ…
‘কুমার…আমার বড় ভয় করছে…ওই কামুক ডাকিনীর সঙ্গে যেন…’
আলো। ক্ষীণ অথচ অস্পষ্ট কিছু আলোর বিন্দু। তারপর আলোর বিন্দুগুলি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল।
.
বপ্যট বিপুল বেগে আঘাত করলেন প্রকাশচন্দ্রকে। সেই ধাক্কায় কিছুটা পিছিয়ে গেলেন প্রকাশচন্দ্র। বুঝলেন যে এইবার একজন সমান বলস্পর্ধীকে পেয়েছেন তিনি।
দুই মহারথী বিপুল বিক্রমে একে অন্যকে আক্রমণ এবং অন্যের আক্রমণ প্রতিহত করতে লাগলেন। খড়্গে অসিতে ঝনঝনানিতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গতে মনে হল শালিবন বিহারের সামনে যেন পূর্বসমুদ্রের একটুকরো বিপুল ঝঞ্ঝা উঠে এসেছে।
খানিক পরেই বোঝা গেল দৈহিক বলে এবং অস্ত্রকৌশলে দুজনেই তুল্যমূল্য হলে কী হবে, বপ্যটের নড়াচড়া বা চলন প্রকাশচন্দ্রের তুলনায় সামান্য হলেও ধীর। তিনি প্রৌঢ় হয়েছেন, আর নাগসম্রাজ্ঞী য়ু জেতিয়ানের আশীর্বাদে প্রকাশচন্দ্র চিরযৌবনের অধিকারী।
লক্ষ করলেন প্রকাশচন্দ্রও। তিনি ঘুরে ঘুরে আক্রমণ করতে লাগলেন বপ্যটকে। চেষ্টা করলেন যাতে বপ্যটকে আরও বেশি নড়াচড়া করতে হয়, আরও ছুটতে হয়।
বপ্যট ইতিমধ্যেই যুদ্ধক্লান্ত ছিলেন। শ্রান্তি আর অবিরল রক্তক্ষরণ তাঁকে ক্রমাগত দুর্বল করে তুলেছিল। এই ক্রমাগত দ্রুতচলন তাঁকে আরও শ্রান্ত করে তুলছিল। তিনি হাঁপিয়ে যাচ্ছিলেন। ক্রমেই আরও ক্লান্ত, আরও মন্থর হয়ে পড়ছিলেন। লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছিলেন বার বার।
একবার প্রকাশচন্দ্রের খড়্গ তাঁর বাম বাহু ছুঁয়ে গেল। রক্তপাত হতে লাগল সেখান থেকে। ক্রুদ্ধ বপ্যট তাঁর অসি দিয়ে ভীমবেগে আক্রমণ করলেন প্রকাশচন্দ্রকে। প্রকাশচন্দ্র নীচু হয়ে সরে গেলেন। তারপর খড়্গচালনা করলেন বপ্যটের পায়ের দিকে। বপ্যট লাফিয়ে উঠলেন। কিন্তু তাঁর এতক্ষণের শ্রান্তি তাঁকে এইবার প্রতারিত করল। সামান্য বিলম্ব হয়ে গেল তাঁর। প্রকাশচন্দ্রের মহাখড়্গ তাঁর গুল্ফে আঘাত করে পায়ের প্রধান শিরাটি কেটে দিল।
পড়ে গেলেন বপ্যট। দ্রুত উঠে আসার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। ডান পায়ের পাতা প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সেই অবস্থাতেই উঠে বসে প্রতিহত করলেন প্রকাশচন্দ্রের পরের আঘাত। কিন্তু বেশিক্ষণ নয়। প্রকাশচন্দ্র এক ঝটকায় তাঁর অসিটি দূরে ফেলে দিলেন। তারপর তাঁর তাংদাও প্রোথিত করে দিলেন বপ্যটের বুকে।
ভলকে ভলকে রক্ত উঠে যুদ্ধক্ষেত্রের মাটি ভিজিয়ে দিল। হাঁ করে একবার লম্বা শ্বাস নিলেন বহুযুদ্ধের নায়ক, খণ্ডিতারাতি বপ্যট। অস্ফূটে উচ্চারণ করলেন, ‘গোপাল, গোপাল।’ তারপর তাঁর মাথাটি একদিকে হেলে গেল।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে দুচোখ খুলে গেল গোপালদেবের।
.
বহুদূর থেকে যুদ্ধের কোলাহল কানে আসছিল ওদের। শুনে বনচর মানুষটি ক্রমেই উতলা হয়ে উঠছিল। বার বার তাড়া দিচ্ছিল চণ্ডকীর্তিকে, ‘তাড়াতাড়ি চল শুয়ার। আর কত দেরি করবি, প্রভু যে আমাদের অপেক্ষায় আছেন।’ তার ব্যবহার ক্রমেই রুক্ষ হয়ে উঠছিল। ভাষা হয়ে উঠছিল অশ্রাব্য৷
ভীত কুকুরের মতো এগিয়ে যাচ্ছিল চণ্ডকীর্তি। এগিয়ে যাচ্ছিল সংকীর্ণ গিরিপথটি বেয়ে। তার গলায় একটি রশি। তার শেষভাগ ধরে রেখেছে সেই বনচর মানুষটি। আর তার পেছনে পেছনে শত শত ভয়াবহ উলঙ্গ ডাকিনীর দল। প্রতি ডাকিনীর সঙ্গে তার পোষ্য শিবা!
ধীরে ধীরে গিরিপথের শীর্ষবিন্দুতে এসে উপস্থিত হল চণ্ডকীর্তি। তারপর একটি পাথরের আড়াল থেকে সামান্য উঁকি দিল।
শালিবন বিহার আর তার সামনের উন্মুক্ত প্রান্তর তাদের সামনে এখন স্পষ্ট।
.
খানিকক্ষণ স্থির শুয়ে রইলেন গোপালদেব। ধীরে ধীরে কক্ষের চিত্রবিচিত্র ছাদ তাঁর সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল।
তাঁর সারা দেহ জুড়ে এক আশ্চর্য নির্ভার প্রশান্তি। প্রবল জ্বরের উপশম হলে যেমন বোধ হয়, ঠিক তেমনই বোধ করছেন তিনি।
ধীরে, অতি ধীরে ঘাড় ঘোরালেন গোপালদেব। বাঁদিকে কিছু নেই। এবার ডানদিকে।
ডানদিকে মেঝেতে ও কে শুয়ে? ও কার শরীর?
ধীরে ধীরে উঠে বসলেন গোপালদেব। তাঁর থেকে সামান্য দূরে একটি শীর্ণ, সম্পূর্ণ নগ্ন নারীশরীর শুয়ে আছে শীতল মেঝেতে।
এদিক ওদিক তাকালেন গোপালদেব। তাঁর অস্ত্রটি কোথায়?
.
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন