অভীক সরকার
অন্ধকার কুটির। জানালাদুটি বন্ধ৷ অল্প হাওয়ায় দরজা কাঁপছে তিরতির করে। অশ্বত্থের কাণ্ড-জটা বেয়ে, বৃক্ষশাখানির্মিত দরজার ফাঁক দিয়ে বিষণ্ণ চাঁদের আলো উঁকি মারছে। চারিদিকে কোনও শব্দ নেই। ঘরের মধ্যে জমাট বাঁধা স্তব্ধতাও যেন শ্বাস বন্ধ করে রয়েছে।
ধীরে ধীরে দরজাটি উন্মুক্ত হল। কয়েকটি ছায়ামূর্তি নিঃসাড়ে, নিঃশব্দে ঢুকে এল ভেতরে। দুজন দরজার বাইরে রয়ে গেল, পাহারা দেওয়ার জন্য।
আগন্তুকরা সবাই মাটিতে গোল হয়ে বসলেন। একটু পরে চকমকি পাথরের ঠোকাঠুকির শব্দ। একটি শুষ্ক গাছের ডাল জ্বলে উঠল। তারপর কেউ সেই অগ্নিশিখাটি নিয়ে একটি প্রদীপ জ্বালালেন।
প্রদীপের অল্প আলোয় ঘরটি আলোকিত হয়ে উঠল। সেই আলোয় দেখা গেল ঘরের মাঝখানে একটি কাঠের তৈরি নীচু চতুর্পদী। তার ওপর একটি বড় মাটির প্রদীপ। পাশে রাখা রয়েছে একটি অতি দীর্ঘ তরবারি।
মৎস্যেন্দ্রনাথ রুদ্ধস্বরে বললেন, ‘প্রকাশচন্দ্রের অজেয় তাংদাও৷ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম তরবারি শিল্পী শাও ফেং-এর বানানো সর্বোত্তম শিল্প।’
উপস্থিত বাকিরা উদগ্র আগ্রহের সঙ্গে তরবারিটিকে দেখতে লাগলেন।
তরবারিটি দৈর্ঘ্যে দু’হাত লম্বা, হাতলটি আধ হাত। হাতলে সোনা আর হাতির দাঁতের বিচিত্রসুন্দর কারুকার্য। লৌহনির্মিত তীক্ষ্ণধার দেহকাণ্ডটি ছয় অঙ্গুলি প্রশস্ত। প্রদীপের স্তিমিত আলোয় ঝিকিয়ে উঠছে ফলার উদ্ধত ঔজ্জ্বল্য। হাতলের বাঁটের কাছে একটি ধাতুনির্মিত বলয়। তাতে কোনও এক অজানা লিপিতে লেখা কয়েকটি অক্ষর। শীর্ষটি ঈষৎ বক্র ও ক্রুর।
‘কীভাবে এটি হস্তগত হল প্রভু?’ প্রশ্ন করলেন কান্তিপ্রভ। তাঁকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে, তিনি এখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না—প্রকাশচন্দ্রের অজেয় তরবারি এখন তাঁর কুটিরে। এই তরবারি চিরকাল বঙ্গবাসীর মনে যুগপৎ ভয় এবং সমীহ সৃষ্টি করে এসেছে। লোকমুখে প্রচলিত যে, যতদিন এই তরবারি প্রকাশচন্দ্রের হাতে থাকবে, ততদিন তিনি যে-কোনও দ্বন্দ্বে বা রণে অপরাজেয় থাকবেন।
‘আমাদের বন্ধু, কুমার বিনয়াদিত্য জয়াপীড়ের সৌজন্যে।’ মৎস্যেন্দ্রনাথ মৃদু হাসলেন।
জয়াপীড় কিছু বললেন না। এখনও তাঁর মুখের একদিক ফোলা। চোখের নীচে গভীর ক্ষত। ডান বাহুতে একটি কাপড়ের পট্টি বাঁধা। সেটি কালচে রক্তে মাখামাখি। তিনি উদাসীন স্বরে বললেন, ‘গৌড়ের রাজপথে একদা সিংহশিকার করেছিলাম বটে, কিন্তু সে নেহাত বাধ্য হয়েই। কিন্তু ওই উন্মত্ত মহিষের পিঠে চড়া আর স্বয়ং যমরাজকে ভোজসভায় আমন্ত্রণ জানান যে একই ব্যাপার–সেটি পূর্বে অনুমান করিনি। করলে এই কাজে সম্মত হতাম কি না বলতে পারি না।’
‘হুম, কুমারের অভিজ্ঞতা বিশেষ সুখকর হয়নি মনে হচ্ছে।’
কথাটা শুনেই একবার সামান্য কেঁপে উঠলেন জয়াপীড়, তারপর বললেন, ‘বাপরে বাপ কোনওমতে মোষটার পিঠে চড়েছি কি চড়িনি, মনে হল যেন রোখের বশে কোন এক মারাত্মক ঘূর্ণিঝঞ্ঝার টুঁটিই টিপে ধরেছি, আর সে ক্রমাগত আমাকে নীচে ফেলে পিষে মারবে বলে মাথা ঝাঁকিয়ে চলেছে। কী তার আক্রোশ! কী তার উন্মত্ততা! বাপ রে, এমন প্রলয়ঙ্করী জীব জীবনে দুটি দেখিনি।’ বলে একবার চোখ বুজে শিউরে উঠলেন জয়াপীড়।
‘এরজন্যই তো একজন বীরোত্তমের প্রয়োজন হয় কুমার।’ জয়াপীড়ের পিঠে হাত রাখলেন বপ্যট, ‘তবে একজন অভিজ্ঞ যোদ্ধা হিসেবে এ কথা বলতে পারি, আজ আপনি যে অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছেন, তার তুলনা নেই। আপনি বীর ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়ের যোগ্য উত্তরসূরি।’
এসব কথা শুনছিলেন না আচার্য শান্তরক্ষিত। তিনি বললেন, ‘এই তরবারির বিশেষত্ব কী, প্রভু?’
প্রদীপের আলো মৎস্যেন্দ্রনাথের শান্ত স্থিতধী মুখের উপর আলোছায়ায় আলপনা আঁকছিল। তিনি স্বগতসুরে বলতে লাগলেন, ‘তরবারিটি যে বিশিষ্ট সে নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার বিশেষত্বর বিষয়ে জানার আগে আরও কয়েকটি ব্যাপার আমাদের বিশদে জানতে হবে ভ্রাতা৷ মহাঅভ্যুত্থান আমাদের দ্বারপ্রান্তে। এখন সময় এসেছে সমস্ত কিছু বিশদে ব্যক্ত করার।
‘এই মুহূর্তে বঙ্গদেশের ভাগ্য ঘিরে রেখেছে তিনটি প্রধান রহস্যজাল। সেগুলির মীমাংসা না করে এই অভ্যুত্থান সফল করা কঠিন। তার মধ্যে আপাতত খণ্ডিতারাতি বপ্যটের বংশ ও জন্মসংক্রান্ত রহস্যটির সমাধান হয়েছে। আমরা জানি যে কুমার গোপালদেবের বঙ্গদেশের শাসক হওয়ার পূর্ণ অধিকার আছে। যোগ্যতাও যে আছে তার প্রমাণ গোপালদেব নিজেই দেবেন।
‘দ্বিতীয় রহস্যটি হচ্ছে–প্রকাশচন্দ্রের এই অতিলৌকিক, অতিমানবিক শক্তির উৎস কী? এবং প্রকৃতপক্ষে তিনি কী চান। এবং কে এই রানি? কে তিনি? এই রঙ্গমঞ্চে তিনি প্রধানা নায়িকার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন কী করে?
বহুদিন ধরে আমি এই দ্বিতীয় রহস্য সমাধানের চেষ্টায় রত ছিলাম। এর জন্য আমাকে বহুদিন ধরে বহু শ্রমে বহু অনুসন্ধান করতে হয়েছে। দেশে-বিদেশে অনেক চর প্রেরণ করেছি। বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। অনেক তথ্য আহরণ করেছি। কিন্তু কিছুতেই কোনও সমাধানসূত্র খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে দেবাদিদেব আদিনাথ দয়া করলেন। অকস্মাৎ এক ঝটিকায় সমস্ত রহস্যের উপর হতে যবনিকা উত্তোলিত হল।
প্রতিবেশী দেশগুলি যে সদা সর্বদাই একে অন্য দেশের অভ্যন্তরে নিজ নিজ চর প্রেরণ করে, সে আপনাদের অজানা নয়। চীন দেশেও তিব্বতনরেশ মে অগছোমের প্রেরিত কয়েকটি গুপ্তচর দল সক্রিয়। তাদের মধ্যে একটি দলের অধিনায়ক হলেন রিনছেন সাংপো। গুপ্তচরবিদ্যায় ইনি তিব্বতে প্রায় প্রবাদপুরুষ।
‘আজ থেকে দুই বৎসর পূর্বে রিনছেন সাংপোর হাতে দৈবাৎ রাজকীয় গ্রন্থাগারের কিছু গোপন পুঁথি এসে পড়ে। তাতে তিনি এমন কিছু খুঁজে পান, যা তাঁর কৌতূহল চতুর্গুণ বর্ধিত করে। অনেক গোপন সন্ধান চালানোর পর গত হেমন্তে জনৈক চীনদেশীয় বৃদ্ধের সঙ্গে রিনছেন সাংপো’র যোগাযোগ হয়। এই বৃদ্ধের পিতামহ চীনের সম্রাট গাওজং-এর ঘনিষ্ঠতম মন্ত্রী ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে সেই ধুরন্ধর গুপ্তপুরুষটি এক অত্যন্ত গোপন ও চাঞ্চল্যকর কাহিনি উদ্ধার করেন। তিনি সেই দীর্ঘ কাহিনি লিপিবদ্ধ করে তিব্বত রাজপুত্র ঠ্রিসং দেৎসেনের উদ্দেশে একটি দীর্ঘ পত্র প্রেরণ করেন। কুমার দেৎসেন সেটির গুরুত্ব অনুধাবন করে ভন্তে কমলশীলের হাতে দেন। কমলশীল রাজপুত্র পদ্মসম্ভবের সহায়তায় সেই পত্রটি সহ আরও দুখানি অতি মূল্যবান বস্তু সঙ্গে নিয়ে গৌড়ে ফিরে আসতে সমর্থ হয়। সেই পত্রটির সহায়তায় আমি সমগ্র পরিস্থিতি সম্যকভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছি। অসামান্য এবং অত্যাশ্চর্য কাহিনি। তবে তার আগে চীনদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আপনাদের জানা উচিত। আপনারা মন দিয়ে শুনুন।
আজ থেকে শত বৎসর পূর্বে চীনদেশ শাসন করছিলেন তাং বংশের মহাপরাক্রমশালী সম্রাট তাইজং এবং তাঁর পুত্র সম্রাট গাওজং।
চীন সম্রাটদের মধ্যে রাজ্যের সুন্দরীতম কন্যাদের উপপত্নীরূপে গ্রহণ করার প্রথা আছে। রাজার রক্ষিতা হতে পারা চীনদেশে বিশেষ গৌরবের বিষয়। রাজানুগ্রহপ্রার্থীরা সম্রাটের অন্তঃপুরে নিজ নিজ কন্যাদের পাঠাতে পারলে নিজেদের সৌভাগ্যবান বিবেচিত করেন।
সম্রাট তাইজং-এর উপপত্নীদের মধ্যে একটি চতুর্দশী কন্যা ছিল, নাম য়ু জেতিয়ান। তার পিতা ছিলেন তাং রাজসভার এক উচ্চপদস্থ রাজন্য।
য়ু জেতিয়ান তাঁর সময়ের নারীদের তুলনায় বিদ্যায় ও বুদ্ধিতে অনেকাংশে অগ্রসর ছিলেন। তিনি লিখতে ও পড়তে পারতেন। বিবিধ বাদ্যযন্ত্রে তাঁর নৈপুণ্য ছিল। তাঁর প্রতিভা দেখে সম্রাট তাইজং চমৎকৃত হন এবং য়ু জেতিয়ানকে তাঁর সচিব পদে নিয়োগ করেন।
য়ু জেতিয়ান অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী নারী ছিলেন। তিনি দ্রুত রাজকার্য-সংক্রান্ত যাবতীয় নিয়ম ও পদ্ধতি শিখে নেন এবং রাজসভায় তাঁর প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন। বিদেশনীতি বা কূটনীতিতে তাঁর আশ্চর্য ব্যুৎপত্তি ছিল। তিব্বতরাজ স্রোংচান গ্যাম্পোর সঙ্গে রাজকুমারী ওয়েনচেং-এর বিবাহও তাঁর বুদ্ধিতেই স্থির করা হয়। ক্রমেই তিনি সম্রাটের নির্ভরযোগ্য সঙ্গিনী হয়ে ওঠেন।
এই সময়েই তাঁর পরিচয় হয় সম্রাট তাইজং এর সন্তান, তরুণ রাজপুত্র গাওজং এর সঙ্গে।
কিন্তু পরিচয় ঘনিষ্ঠ হওয়ার আগেই সম্রাট তাইজং মৃত্যুবরণ করেন।
চীনের প্রথা হচ্ছে সম্রাট দেহরক্ষা করলে রাজার সমস্ত উপপত্নীদের মস্তক মুণ্ডন করে সঙ্ঘের শরণ নিতে হয়, যাতে রাজার উচ্ছিষ্ট অন্য কেউ ভোগ করতে না পারে। সম্রাট তাওজং-এর তিরোধানের পর য়ু জেতিয়ানও সেই প্রথানুসারে সঙ্ঘে প্রবেশ করেন। কিন্তু এরপরেই ঘটে যায় এক আশ্চর্য কাণ্ড। কয়েকমাস পরেই দেখা গেল য়ু জেতিয়ান ফিরে এসেছেন রাজপ্রাসাদে, এবং নির্বাচিত হয়েছেন নতুন সম্রাট গাওজং-এর প্রধানা উপমহিষী রূপে।’
‘এ যে ঘোর অজাচার।’ অস্ফুটস্বরে বললেন বপ্যট।
ম্লান হেসে মাথা নাড়লেন মৎস্যেন্দ্রনাথ। ‘সেই অজাচারের বিষই তো প্রবেশ করেছে বঙ্গদেশের রাজপ্রাসাদে। নইলে রাজকুমার আনন্দচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর বিমাতার বিবাহ কি আমরা দুঃস্বপ্নেও আশঙ্কা করেছিলাম মিত্র বপ্যট?’
বপ্যট চুপ করে গেলেন। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ।
‘সম্রাট গাওজং দুর্দান্ত প্রকৃতির সম্রাট হলেও কোনও এক অজানা রোগে প্রায়শই রাজকর্ম থেকে অব্যাহতি নিতেন। তাঁর পরিবর্তে রাজকার্য সামলাতেন তাঁর প্রিয়তমা উপপত্নী, য়ু জেতিয়ান।
বলা বাহুল্য, য়ু জেতিয়ানের এই উত্থান রাজসভার অনেকেই ভালোভাবে নেননি। তবে তাঁদের ক্ষোভ নিয়ে সম্রাটের ঘনিষ্ঠতম উপপত্নীর কোনও চিন্তা ছিল না। তাঁর দুশ্চিন্তা ছিল অন্য দুই মহিলাকে নিয়ে। সম্রাটের বৈধ পত্নী, সম্রাজ্ঞী ওয়াং; এবং য়ু জেতিয়ানের পূর্বে যিনি প্রধানা উপপত্নী ছিলেন, সেই সুন্দরীশ্রেষ্ঠা ঝাও শুফেই।
সম্রাজ্ঞী ওয়াং সন্তানহীনা ছিলেন। ঝাও শুফেই-এর একটি পুত্র ও দুটি কন্যাসন্তান ছিল। প্রথা অনুযায়ী ঝাও-এর জ্যেষ্ঠ পুত্রেরই পরবর্তী সম্রাট হওয়ার কথা। কিন্তু তাঁরা প্রমাদ গণলেন যখন য়ু জেতিয়ান পরপর দুটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিলেন। সম্রাট যদি প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে ঝাও শুফেই-এর পুত্রের বদলে প্রিয়তমা য়ু জেতিয়ানের পুত্রকে উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করেন?
এই নিয়ে রাজপ্রাসাদের মধ্যে একটা চোরা স্রোত বইতে লাগল।
এদিকে সম্রাটের শারীরিক অবস্থার দিন দিন অবনতি হচ্ছে। রাজকার্য পরিচালিত হচ্ছে য়ু জেতিয়ান-এর পরামর্শ অনুসারে। রাজবৈদ্য সন্দেহ করছেন রাজার ওপর কোনও দীর্ঘস্থায়ী কিন্তু অব্যর্থ বিষপ্রয়োগ করা হয়েছে। সন্দেহের তীর য়ু জেতিয়ানের দিকেই। কিন্তু তার কোনও প্রমাণ নেই।
এমন সময় য়ু জেতিয়ানের একটি কন্যাসন্তান হয়। আর এখান থেকেই সমস্ত সর্বনাশের শুরু।’
সবাই একটু নড়ে চড়ে বসেন। প্রদীপের শিখা ম্লান হয়ে আসছিল। কান্তিপ্রভ প্রদীপের মধ্যে একটু সর্ষের তেল ঢেলে দিতে পলিতাটি ফের উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
‘যেদিন কন্যা জন্মগ্রহণ করে, সেইদিনই সন্ধেবেলায় তার মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়। শিশুটির গলায় ছিল আঙুলের দাগ। স্পষ্ট বোঝা যায় কেউ শ্বাসরূদ্ধ করে হত্যা করেছে এই সদ্যোজাত নিষ্পাপ শিশুটিকে।
‘য়ু জেতিয়ান অভিযোগ আনেন–সন্তানহীনা সম্রাজ্ঞী ওয়াং ঈর্ষাবশত তাঁর কন্যাকে হত্যা করেছেন। কারণ মৃত্যুর আগে শেষবারের মতো যখন শিশুটিকে জীবিত দেখা যায়, তখন সম্রাজ্ঞী ওয়াং ছাড়া তার কাছে আর কেউ ছিল না। আর এই ঘৃণ্যকর্মে তাঁকে যোগ্য সহায়তা করেছেন ঝাও শুফেই!
তাং বংশের বিচারব্যবস্থা বড়ই কঠিন। সম্রাজ্ঞী ওয়াং এবং ঝাও শুফেই-এর বিরুদ্ধে বিচার শুরু হল। সম্রাজ্ঞীরা নির্দোষ প্রমাণ করতে পারলেন না। তাঁদের হাত পা কেটে মদের জালার মধ্যে ডুবিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল। য়ু জেতিয়ানের পথ নিষ্কণ্টক হল। তিনি সম্রাট গাওজং-এর প্রধানা মহিষীর পদে অধিষ্ঠিতা হলেন। শিশুটির মৃতদেহ নিয়ে য়ু জেতিয়ান চলে গেলেন তাঁর পিতৃগৃহে, সেখানেই সমাধিস্থ করবেন বলে।
এরপর য়ু জেতিয়ান-এর দ্রুত উত্থান ঘটে। কালক্রমে তিনি মহাচীনের প্রথম এবং অদ্যাবধি একমাত্র নারী শাসকের পদে আসীন হন। কিন্তু এই অবধি যা বললাম, তা সবই প্রকাশ্য কাহিনি৷ তাহলে রিনছেন সাংপো’র হাতে এমন কী তথ্য তুলে দিলেন সেই বৃদ্ধ?
‘তিনি তুলে দিয়েছিলেন য়ু জেতিয়ান-এর শৈশব, পরিবার এবং ওই মৃত শিশুটি নিয়ে এক রোমহষর্ক সত্য, যা বহু সাবধানে গোপন রাখা হয়েছিল রাজপরিবারের পক্ষ থেকে। সেই রোমহর্ষক তথ্যটি জ্ঞাত হওয়া মাত্র গুপ্তচরশ্রেষ্ঠ রিনছেন সাংপো তার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেন। তিনি তাঁর অধীনস্থ সমস্ত গুপ্তচরদের আদেশ দেন য়ু জেতিয়ানের শৈশবের ব্যাপারে যাবতীয় সংবাদ সংগ্রহ করে আনতে। তিব্বতী গুপ্তপুরুষেরা বহু কষ্টে যেসব তথ্য উদ্ধার করে এনেছেন, সেসব একত্র করে কাহিনিটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া গেছে।’
উপস্থিত প্রত্যেকে নিঃশ্বাস বন্ধ করে মৎস্যেন্দ্রনাথের প্রতিটি কথা শুনছিলেন। বাইরে তখন রাতচরা পাখির টি টি শব্দের সঙ্গে মিশেছে মৃদু বাতাসের শব্দ। এই কুটিরটি কমলাঙ্ক গ্রামের একদম শেষপ্রান্তে, অরণ্যের সীমারেখার ভিতরে। বৃক্ষশাখানির্মিত কুটিরটি একটি অতি বৃহৎ অশ্বত্থের পাদদেশে অবস্থিত। সেটির চারিপাশে নেমে এসেছে অশ্বত্থের বৃহৎ কাণ্ডজটারাশি। বহিরাগত কারও পক্ষে এই গোপন গৃহটি আবিষ্কার করা শুধু কঠিনই নয়, অসম্ভবও বটে।
কান্তিপ্রভ’র আদেশ বা অনুরোধে অরণ্যচারী কিরাতদল এই গোপন কুটির প্রস্তুত করে দিয়েছে মাসাধিককাল পূর্বে। ব্রাহ্মণ কান্তিপ্রভ এই কিরাতদের স্পর্শ করেন না বটে, কিন্তু এদের সুখ সুবিধার যথেষ্ট সংবাদ রাখেন। এদের বক্তব্য গ্রামিক বা পঞ্চকুল অবধি পৌঁছে দেওয়া, কারও জটিল রোগব্যাধিতে গ্রামের একমাত্র অম্বষ্ঠ বৈদ্যটির কাছ থেকে ঔষধ এনে দেওয়া, এইসব দায়িত্ব তিনি স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তাই তারাও তাঁকে ঈশ্বরপ্রতিম শ্রদ্ধা করে। অন্যান্য ব্রাহ্মণেরা এজন্য তাঁকে যথেষ্ট উপহাস করেন বটে, তবে কান্তিপ্রভ সেসব স্মিতহাস্যে এড়িয়ে যান।
আপাতত এই কুটিরের বাইরে উন্মুক্ত তরবারি হস্তে প্রহরারত আছেন রাজকুমার পদ্মসম্ভব এবং বপ্যটপুত্র গোপালদেব। আরও কিছু দূরে ধনুর্বাণ ও কুঠার হাতে আপাতঅদৃশ্য প্রহরাবৃত্ত রচনা করে রয়েছে অরণ্যচারী কিরাতদল। তাদের চোখ এবং কান এড়িয়ে একটি শশকও প্রবেশ করতে পারবে না এই গোপন কুটিরে, এতই নিশ্ছিদ্র সেই প্রহরা।
‘কথিত আছে যেদিন য়ু জেতিয়ান জন্ম নেন, সেইদিন ছিল পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ, যা কি না সমগ্র চীনদেশ জুড়ে দৃশ্যমান ছিল। সেই অত্যন্ত অশুভ সময়ে জন্মগ্রহণ করা নারীটি জন্ম থেকেই কিছু আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। আগেই বলেছি, তাঁর বাবা য়ু শিহুও ছিলেন একজন প্রভাবশালী রাজকর্মচারী। তিনি তাঁর একমাত্র কন্যাকে সাধ্যমত শিক্ষাদান করেন, যা ওই দেশের নারীদের পক্ষে বিরল ঘটনা। তবে তার কারণ ছিল।
‘য়ু শিহুও’র পরিবারে বহু প্রাচীন কাল থেকে এক বিশেষ গুপ্তবিদ্যার প্রচলন ছিল–বিষবিদ্যা। বিষ ও বিষের প্রতিষেধক, এ বিষয়ে তাঁদের কাছে সহস্রাধিক বৎসরের সঞ্চিত বিদ্যার আধার ছিল। তাঁরা জানতেন না এহেন বিষের সন্ধান এই পৃথিবীতে নেই। সেই বিষবিদ্যা দিয়ে তাঁরা প্রাণহরণ করতেও জানতেন, প্রাণদান করতেও জানতেন। তাঁরা জানতেন কীভাবে এই বিদ্যার প্রয়োগে মানুষকে দীর্ঘজীবন দান করা যায়, ইচ্ছামৃত্যুর অধিকারী করা যায়, আশ্চর্য ঐশী ক্ষমতা অধিগত করা যায়।
‘য়ু জেতিয়ান শৈশব থেকেই সেই বিদ্যায় অদ্ভুত ব্যুৎপত্তি দেখাতে থাকেন। তাঁর পরিবারের লোকজন নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত যে, সাক্ষাৎ নাগমাতা কা দে লু তাঁদের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় যাবতীয় বিষবিদ্যা অধিগত করাই শুধু নয়, নিজের প্রতিভায় য়ু জেতিয়ান এক আশ্চর্য উদ্ভাবন করেন। তার রাসায়নিক প্রয়োগে একজন মানুষকে জড়পদার্থে পরিণত করে রাখা যায়। আবার বিরুদ্ধ রসায়ন প্রয়োগে তাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়।
‘তবে যে বিশেষ বিষবিদ্যায় য়ু জেতিয়ান আশ্চর্য প্রসিদ্ধি লাভ করেন তার নাম আমার জানা নেই বটে, কিন্তু তার প্রয়োগের ফলে যে কী অনর্থ উৎপন্ন হয় সেটি আমরা, বঙ্গবাসীরা, অস্থিতে অস্থিতে অনুভব করছি।’
‘কী সে বিদ্যা, প্রভু?’ শুষ্ক স্বরে প্রশ্ন করলেন জয়াপীড়।
‘নাগকন্যা।’ ফিসফিস করে বললেন মৎস্যেন্দ্রনাথ, ‘য়ু জেতিয়ান পারতেন একজন নারীকে অর্ধেক মানুষী, অর্ধেক নাগিনী করে তুলতে৷ সেই নারী তখন তার নিজের ইচ্ছায় একবার মানুষী আরেকবার নাগিনীরূপ ধারণ করতে পারত। তার বিষের তীব্রতা এতই প্রবল যে শিকারের সমস্ত দেহ ঘোর কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে। সেই মৃতদেহ এতই বিষাক্ত হয়ে দাঁড়ায় যে সেটি স্পর্শমাত্রে স্পর্শকের জীবন সংশয় হতে পারে।’
ঘোর উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালেন বপ্যট, ‘এ যে অবিশ্বাস্য! আপনি কী বলতে চাইছেন লোকেশ্বর? বঙ্গদেশের রানি প্রকৃতপক্ষে…’ অন্যান্যরাও শ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইলেন মৎস্যেন্দ্রনাথের দিকে।
এই সময়ে দূরে কোথাও যেন একটা ক্ষীণ শিসের শব্দ হল। কিন্তু প্রত্যেকে এতই উত্তেজিত ছিলেন যে কেউ বিশেষ মনোযোগ দিলেন না।
ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন মৎস্যেন্দ্রনাথ। তারপর গম্ভীরস্বরে বললেন, ‘হ্যাঁ ভ্রাতা বপ্যট, তাং সম্রাজ্ঞী য়ু জেতিয়ানের সেই আপাতমৃত কন্যাই এই দেশের রানি।’
উপস্থিত প্রত্যেকে প্রস্তরবৎ বসে রইলেন। কারও মুখে একটি শব্দ উচ্চারিত হল না।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মৎস্যেন্দ্রনাথ, ‘আমার কাছে প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই বটে, তবে সমস্ত সূত্র একই দিকে ইঙ্গিত করছে। নিজের সদ্যোজাত শিশুকন্যাটিকে উচ্চাকাঙ্ক্ষীর যূপকাষ্ঠে বলি দিয়েছিলেন নাগসম্রাজ্ঞী য়ু জেতিয়ান। নিজের উদ্ভাবিত বিষে তাকে মৃতবৎ আচ্ছন্ন করে রাখেন, এবং তার কণ্ঠে স্বহস্তের পাঁচ অঙ্গুলির ছাপ এঁকে দেন, যাতে সম্রাজ্ঞী ওয়াং এবং ঝাও শুফেইয়ের ওপর সেই ঘৃণ্য অপরাধের কলঙ্কলেপন করা যায়৷ তাঁদের মৃত্যুদণ্ডের দিকে ঠেলে দেওয়া যায়।
তারপর তিনি শিশুটিকে নিয়ে চলে যান তাঁর পিতৃগৃহে, পারিবারিক সমাধিস্থলে৷ সেখানে তিনি শিশুটিকে জীবিতাবস্থায় ফিরিয়ে আনেন। লোকচক্ষুর অন্তরালে শিশুকন্যাটি বড় হতে থাকে, যতদিন না তাকে বৃহত্তর উদ্দেশে উৎসর্গ করা যায়।’
‘কিন্তু লোকেশ্বর, চীনের এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজরক্ষিতার সঙ্গে বঙ্গদেশের ভাগ্য এমন অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে গেল কী করে?’ প্রশ্ন করলেন শান্তরক্ষিত।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মৎস্যেন্দ্রনাথ, ‘নিয়তি, নিয়তি কেন বাধ্যতে! নইলে চীন আর তিব্বতের অন্তর্বিরোধের ছায়া বঙ্গদেশের ভাগ্যাকাশে এমন পূর্ণগ্রাস গ্রহণ ডেকে আনবে কেন?
‘তাং বংশ অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজবংশ। মহারাজ তাইজং বিশ্বাস করতেন পূর্ব চীন সমুদ্র থেকে কাম্বোজ দেশ, গান্ধার থেকে ভারতভূমি শাসন করার একমাত্র ঈশ্বরদত্ত অধিকার মহান তাং রাজবংশের। তিনি এও জানতেন ভারতবর্ষ অধিকার করার পথে তাঁর সবচেয়ে বড় কাঁটা তিব্বত। তিব্বত অধিকারে না এলে মহাচীনের পক্ষে ভারতভূমি হস্তগত করার স্বপ্ন সফল হবে না।
কিন্তু তখন তিব্বতে এক নতুন নায়ক মাথা তুলছেন, স্রোংচান গ্যাম্পো। সাহসে দুর্জয়, যুদ্ধে রণদুর্মদ মহাবীর। তাঁকে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে পরাস্ত করা দুর্ধর্ষ তাইজং-এর পক্ষেও অসম্ভব। নিয়তির নির্বন্ধে সম্রাটের সামনে এক সুবর্ণসুযোগ এসে উপস্থিত হল।
‘স্রোংচান গ্যাম্পো একবার চীন দেশ ভ্রমণে এসে এক অভিজাতবংশীয়া চীনা তরুণীর সঙ্গে পরিচিত হন এবং প্রথম দর্শনেই তাঁর প্রেমে পড়েন। এঁর নাম রাজকুমারী ওয়েনচেং, সম্রাট তাইজং-এর দূরসম্পর্কের এক ভাই দাওজং-এর কন্যা। স্রোংচান গ্যাম্পো তাং রাজসভায় রাজকুমারী ওয়েনচেং-এর সঙ্গে তাঁর বিবাহের প্রস্তাব পাঠালেন।
‘কিন্তু দাওজং রাজসভার মহা প্রতিপত্তিশালী রাজন্য, একাধারে মহাসান্ধিবিগ্রহিক এবং প্রধান বিচারপতি। তিনি এই অর্ধবর্বর তিব্বতী রাজার সঙ্গে তাঁর মেয়ের বিবাহ দিতে অস্বীকৃত হলেন।
ক্রুদ্ধ স্রোংচান গ্যাম্পো সসৈন্যে তাং রাজধানী লুওই-ইয়াং অবরোধ করলেন। অসভ্য বর্বর তিব্বতী সৈন্যবাহিনীর হাতে তাং রাজবংশের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটল। প্রত্যাখ্যাত স্রোংচানের ক্রোধাগ্নিতে ভস্মীভূত হতে থাকল লুওই-ইয়াং-এর পার্শ্ববর্তী গ্রাম ও নগরসমূহ।
এইসময় রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করলেন য়ু জেতিয়ান। তিনি প্রশ্ন করলেন—এত অনর্থক বাদ বিসম্বাদ যুদ্ধোদ্যোগ কীসের জন্য? জয়লক্ষ্মী যখন স্বয়ং রাজদ্বারে উপস্থিত, তখন ভল্ল তরবারি সহযোগে তাঁকে তাড়না করার অর্থ কী?’…
কুটিরের বাইরে থেকে অত্যন্ত ক্ষীণ কিছু শাখাপ্রশাখা ভাঙার শব্দ উঠেই থেমে গেল। বপ্যট একবার ভ্রুকুঞ্চন করে দরজার দিকে তাকালেন। তারপর পুনরায় কাহিনিতে মনোনিবেশ করলেন।
‘য়ু জেতিয়ান সম্রাটকে বোঝালেন—তিব্বতকে বশীভূত করার এই হচ্ছে সুবর্ণ সুযোগ। একবার যদি রাজঅন্তঃপুর করায়ত্ত হয়, রাজা যদি চীন রাজকুমারীর সৌন্দর্যে বশীভূত হন, তাহলে তিব্বত রাজসভায় চৈনিক প্রভাব বিস্তার করতে কতক্ষণ? দেশ দখল করতে হলে সদাসর্বদা যে তার ভূমিই দখল করতে হবে তার কী প্রয়োজন!
মহারাজ তাইজং এই যুক্তিতে চমৎকৃত হলেন। বিশ্বস্ত ভ্রাতা দাইজং-কে প্রাসাদে ডেকে প্রভূত পরামর্শ হল। অবশেষে কুমারী ওয়েনচেং তিব্বতনরেশ স্রোংচান গ্যাম্পো’র ঘরণী হয়ে, শাক্যমুনির তরুণ রাজকুমারমূর্তি নিয়ে, পোতালা প্রাসাদে গমন করলেন। চীন সম্রাটের পরিকল্পনা কালসর্প হয়ে তিব্বত রাজ-অন্তঃপুরবাসিনী হল।
কিন্তু য়ু জেতিয়ান আর সম্রাট তাইজং-এর ষড়যন্ত্র সফল হল না।
স্রোংচান গ্যাম্পো’র প্রথমা স্ত্রী ছিলেন লিচ্ছবিরাজ অংশুবর্মণের কন্যা ভৃকুটী। তিনি ভগবান তথাগত’র পুণ্য জন্মস্থান কপিলাবস্তুর ভূমিকন্যা। তিনিও বিবাহের পর তারা, অক্ষোভ্য এবং মৈত্রেয়মূর্তি নিয়ে এসেছেন। তিব্বতরাজ স্রোংচান গ্যাম্পো দুই মহিষীর জন্য দুটি পৃথক মন্দির নির্মাণ করে দিলেন। তাঁর উৎসাহে তিব্বতীয় লিপি ও ব্যাকরণের জন্ম হল। বিভিন্ন বৌদ্ধ পুঁথির পাঠোদ্ধার করে তার তিব্বতীয় অনুবাদ শুরু হল। শুরু হল দুই মহিষীর মধ্যে প্রাধান্য বিস্তারের সংগ্রাম।
তিব্বতের রাজসভায় সামন্তশাসকরা চিরকালই প্রভূত ক্ষমতা ভোগ করে এসেছেন। তাঁরা মহারাজের বৌদ্ধধর্মে মতির কথা শুনে আশঙ্কিত হলেন। স্পষ্ট হয়ে গেল যে সম্রাট সামন্তপ্রভাব খর্ব করে নিরঙ্কুশ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে চান। সামন্তরা প্রায় প্রত্যেকেই তিব্বতের প্রাচীন পোন ধর্মের অনুসারী। তাই রাজদণ্ড এবং সামন্তচক্রের এই দ্বৈরথে মহারাজ স্রোংচান গ্যাম্পো অবলম্বন করলেন বৌদ্ধধর্ম, আর তাতে তাঁর প্রধান সঙ্গী হলেন তাঁর মহিষী ভৃকুটী।
দুই মহিষীর মধ্যে মনোমালিন্যের কথা গোপন রইল না। সামন্তরা দেখলেন শক্তিবৃদ্ধির এই সুবর্ণসুযোগ। তাঁরা গোপনে রাজ্ঞী ওয়েনচেং-এর পক্ষাবলম্বন করলেন। তাং রাজসভার সঙ্গে তাঁদের যোগসূত্র তৈরি হল। তাঁরা সম্রাট তাইজং-কে জানালেন তিব্বতনরেশকে নৈতিক শক্তি যোগাচ্ছেন ভারতীয় বৌদ্ধপণ্ডিত, শ্চেনমুনপা’রা। আরও বিশেষ করে বলতে গেলে বঙ্গদেশের বৌদ্ধপণ্ডিতবর্গ।’
‘সেইদিনই প্রবল ক্রুদ্ধ হলেন তাইজং এবং য়ু জেতিয়ান। তাং বংশ সহস্রাধিককাল রাজত্ব করবে, এই সসাগরা পৃথিবী তার অধীনস্থ হবে, এর কি অন্যথা হতে পারে কখনও? সেই ইশ্বরনির্দিষ্ট পথ রোধ করে রাখবে ক’জন নির্বীর্য বঙ্গদেশী বৌদ্ধপণ্ডিত?
‘সেইদিনই দু’জনে বঙ্গদেশের সর্বাংশে সর্বনাশ সাধনে বদ্ধপরিকর হন। তাঁরা প্রতিজ্ঞা করেন—প্রয়োজন হলে দীর্ঘকালব্যাপী পরিকল্পনা নিতে হবে, যাতে বঙ্গদেশের সমূহ ক্ষতি হয়।
‘কী করে সেই কূটপরিকল্পনা সফল হবে?
তাঁরা স্থির করেন—সর্বাগ্রে বঙ্গদেশের ধর্মনাশ করতে হবে। কারণ সম্রাট তাইজং জানতেন যে, ধর্ম দুষ্ট হলে মানুষ নষ্ট হয়, আর মানুষ নষ্ট হলে দেশ উৎসন্নে যায়। তিনি জানতেন ধর্মহীন, নীতিহীন দেশের থাকা না-থাকা সমান।’
এই সময় বাইরে বেশ কিছু রাতচরা পাখি কাছেই টি টি করে ডেকে উঠল। বপ্যটের ভ্রু কুঞ্চিত হল। তিনি ভ্রুকুঞ্চিত করে মৎস্যেন্দ্রনাথের দিকে তাকালেন। চোখে চোখে কথা হয়ে গেল। বপ্যট তাঁর তরবারি উঠিয়ে নিয়ে নিঃশব্দে বাইরে চলে গেলেন।
‘কিন্তু এই পরিকল্পনা রূপায়ণের পথে মস্ত অসুবিধা ছিল। এর জন্য তাঁদের প্রয়োজন ছিল এমন একজন অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন মানুষের, তাং রাজবংশের অনুগত এমন একজন ভৃত্যের, কূটপ্রতিভায় যে অতুলনীয়। যার দেহ বঙ্গদেশের জলবায়ুতে পুষ্ট, কিন্তু বিবেক ও চৈতন্য তাং বংশের কাছে বন্ধকীকৃত। তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য সম্রাট তাইজং-এর আদেশানুসারে বঙ্গদেশের সর্বনাশ করা।
আর সেই মাহেন্দ্রক্ষণে য়ু জেতিয়ান-এর কাছে এসে পৌঁছলেন এক তরুণ ক্রীতদাস, যার জন্ম বঙ্গদেশে৷ এবং যার জন্মলক্ষণ তাঁর নিজের জন্মলক্ষণের সঙ্গেও মিলে যায়।’
‘কিন্তু তিনি, মানে প্রকাশচন্দ্র সেখানে পৌঁছলেন কী করে?’ অন্ধকারে প্রশ্নটি ভেসে এল৷
‘প্রকাশচন্দ্রের জীবনের প্রথম দিকের কাহিনি এখানে অনেকেই অবগত। তবু আপনার অবগতির জন্য জানাই, ইনি হরিকেলের চন্দ্রবংশের মহারাজ দিবানাথের ঔরসজাত পুত্র। দিবানাথ যখন হরিকেলের শাসনক্ষমতা অধিকার করেন, তখন বঙ্গদেশ শাসন করছেন সম্রাট দেবখড়্গ। দিবানাথ দুর্দান্ত প্রকৃতির সামন্ত ছিলেন। তাঁকে বশ করতে সম্রাটকে যথেষ্ট কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছিল।
‘প্রকাশচন্দ্র পালিত হন মহারাজের আত্মীয়, অনন্তচন্দ্রের গৃহে। অনন্তচন্দ্র বণিক ছিলেন। প্রকাশচন্দ্র যখন পঞ্চদশবর্ষীয় বালক, তখন অনন্তচন্দ্র তাঁকে সঙ্গে নেন যবদ্বীপে বাণিজ্যের উদ্দেশে। সেই যাত্রায় প্রবল সামুদ্রিক ঝড়ে অনন্তচন্দ্রের নৌবহর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তাঁর সঙ্গীসাথীদের প্রায় সকলের সলিলসমাধি ঘটে। অনন্তচন্দ্র কোনওক্রমে বেঁচে যান। বহু শ্রমে, বহু ক্লেশে তিনি তাঁর দু-তিনজন জীবিত সঙ্গীদের নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। প্রকাশচন্দ্রের কোনও খোঁজ পাওয়া যায় না। সবাই অনুমান করে নেন, প্রকাশচন্দ্রও সেই সামুদ্রিক ঝড়ে নিহত হয়েছেন।’
ঠিক এই সময়েই ঘরের দরজা ক্ষণিকের জন্য উন্মুক্ত হয়েই বন্ধ হয়ে গেল। বায়ুপ্রবাহের জন্য? বুঝলেন না মৎস্যেন্দ্রনাথ। কিছু ক্ষীণ শব্দ ভেসে এল দরজার সামনে থেকে।
‘তার প্রায় বিশ বৎসর পর, তখন বঙ্গদেশের সিংহাসনে আসীন খড়্গসম্রাট রাজভট, প্রকাশচন্দ্র দেশে ফিরে এলেন। সঙ্গে এক অপরূপা সুন্দরী নারী। সেই নারীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি চন্দ্রবংশের শাসনভার হস্তগত করেন। বিশ বৎসর ধরে তিনি কোথায় ছিলেন, কী করছিলেন, কীভাবে ফিরে এলেন, ফিরে আসার পর কীভাবে তিনি নিজের পরিচয় প্রমাণ করলেন—সেসব দীর্ঘ কাহিনি। তাতে আমাদের প্রয়োজন নেই। শুধু একদিন অকস্মাৎ জানা গেল, চন্দ্রবংশের শাসনভার অধিগত হয়েছে প্রকাশচন্দ্রের হাতে। তার সঙ্গে হরিকেল জুড়ে তিনি এক নতুন ব্যভিচারী ধর্ম শুরু করেছেন৷
তারপর ধীরে ধীরে তিনি কীভাবে সম্রাট বলভটকে বশ করে সম্রাটের মাতুল চারুদত্ত’র সহায়তায় বঙ্গদেশের শাসনে অধিষ্ঠিত হলেন, সেই কাহিনি আমাদের জানা৷ তবে আমি নিঃসন্দেহ যে তাঁর সঙ্গে আসা নারীটিই সম্রাজ্ঞী য়ু জেতিয়ান-এর সেই কন্যা, এবং বঙ্গদেশের বর্তমান রানি।’
একটু আগের কণ্ঠ ফের বলে উঠল, ‘বাহ বাহ, শৈবযোগী দেখছি একজন অতি উৎকৃষ্ট মহাসান্ধিবিগ্রহিক তথা গুপ্তপুরুষও। দেশ বিদেশের অনেক সংবাদ রাখেন। রাজ সচিব প্রকাশচন্দ্র আর আমাদের রাজ্ঞীর সর্বাঙ্গীন পরিচয় জানার জন্য জীবনপাতই করে ফেলেছেন। তা মহাপ্রাজ্ঞ যোগীপ্রবর আপাতত নিজের সঙ্গীসাথীদের সংবাদ রেখেছেন কি?’
চমকে উঠলেন ঘরের প্রত্যেকে। মুহূর্তে ঘরের ভেতরে ঢুকে এসেছে কয়েকজন মানুষ, তাদের হাতে মশাল। সেই আলোয় দেখা গেল, অন্তত দশজন সশস্ত্র রাজসেবকসৈন্য ঘিরে ধরেছে তাঁদের।
জয়াপীড় হুঙ্কার দিয়ে তাঁর অসিটি কোষমুক্ত করতে যাচ্ছিলেন, একটি তীক্ষ্ণধার ভল্ল তাঁর স্কন্ধস্পর্শ করল।
বাহিনীর প্রধানের দিকে তাকিয়ে মৎস্যেন্দ্রনাথ স্থির কণ্ঠে বললেন, ‘কী সৌভাগ্য, মহাপ্রতীহার শান্তঘোষ স্বয়ং। পথ চিনে আসতে কষ্ট হয়নি মহাত্মন? সব কিছু কুশল ও মঙ্গল তো?’
শান্তঘোষের চোখ একবার জ্বলেই নিভে গেল। শীতলস্বরে বললেন, ‘আমার সব কিছুই অত্যন্ত কুশল ও মঙ্গল যোগীবর। এবার সঙ্গীসাথীসহ গাত্রোত্থান করুন, মহারাজ্ঞী স্বয়ং আপনাদের সঙ্গে কিছু বার্তালাপ করতে চান। আর মহারাজসচিব তথা মহামাত্য প্রকাশচন্দ্র তো আপনাদের সঙ্গে আলাপিত হওয়ার জন্য বড়ই উদগ্রীব হয়ে আছেন।’
মৎস্যেন্দ্রনাথ যুক্তকর মাথায় ঠেকালেন, ‘মহারানির অসীম অনুগ্রহ।’
‘আর তুমি, মূর্খ ব্রাহ্মণ,’ কান্তিপ্রভ’র দিকে ফিরলেন শান্তঘোষ, ‘শেষবার নিজের পত্নী ও কন্যার সঙ্গে দেখা করে যেও। অনেকদিনের সম্পর্ক তো, এটুকু দয়া আমরা করেই থাকি। আমাদের রাজসেবকসৈন্যরা আবার তোমার কন্যার সঙ্গে আলাপ করার জন্য অতি ব্যগ্র হয়ে উঠেছে।’
কান্তিপ্রভ কিছু বললেন না। নির্নিমেষে চেয়ে রইলেন শান্তঘোষের দিকে।
শান্তঘোষ এবার ফিরলেন আচার্য শান্তরক্ষিতের দিকে। ছদ্মবিস্ময়ের ভাব করে বললেন, ‘অহো, বঙ্গদেশের কী অসীম সৌভাগ্য, স্বয়ং আচার্য শান্তরক্ষিত আজ আমাদের মধ্যে এসে উপস্থিত হয়েছে। আপনার চরণস্পর্শে আজ এই দেশের প্রতিটি ধূলিকণা ধন্য হল ভন্তে। রাজ্ঞী আজকের রাত্রিটি আপনার সঙ্গে শাস্ত্রালোচনায় অতিবাহিত করবেন বলে স্থির করেছেন। আপনার আশৈশব ব্রহ্মচর্যের ব্যাপারে তাঁর কিছু জিজ্ঞাস্য আছে বলে মনে হল।’
চোখ বন্ধ করলেন ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠতম পণ্ডিত, শান্তরক্ষিত। ঠোঁট সামান্য নড়ে স্থির হল।
তরবারির অগ্রভাগ দিয়ে জয়াপীড়ের চিবুকটি নিজের দিকে ঘোরাবার চেষ্টা করলেন শান্তঘোষ। ব্যঙ্গস্বরে বললেন, ‘আহা, গৌড়েশ্বর জয়ন্ত উপযুক্ত জামাতাই পেয়েছেন বটে। পরের রাজ্যে তস্করের মতো প্রবেশ করে রাজদ্রোহে ইন্ধন সরবরাহ—এই তো জামাতার উপযুক্ত কর্ম। তবে বঙ্গদেশের জামাতা-আপ্যায়নের সুনাম আছে, সে সুনাম আমরা ক্ষুন্ন হতে দিতে পারি না। গাত্রোত্থান করুন৷ কাল না হয়…’
কথা বলতে বলতে শান্তঘোষ বোধহয় অন্যমনস্ক হয়েছিলেন। এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন জয়াপীড়। এক ঝটকায় তাঁর ডান কাঁধ স্পর্শ করে থাকা ভল্লটি ধরে টান দিতেই ভল্লধারী সৈন্য উলটে পড়ল সামনের দিকে। একই সঙ্গে বামহাত তাঁর কটিদেশ থেকে বার করে এনেছে একটি ছুরিকা। সেটি তিনি সজোরে বসিয়ে দিলেন শান্তঘোষের উরুদেশে। শান্তঘোষ চিৎকার করে উঠলেন। বাকি সৈন্যরা নিমেষে তাদের ভল্লগুলি তুলে জয়াপীড়ের ওপর লক্ষ স্থির করতেই মৎস্যেন্দ্রনাথ তৎক্ষণাৎ প্রদীপটি উলটে দিলে! জয়াপীড় ঝাঁপ দিলেন প্রকাশচন্দ্রের তরবারির দিকে।
বাইরে সশস্ত্র রাজসেবক সৈন্যরা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছিল কুটির ঘিরে। তখন কুটিরের মধ্যে ঘটে চলেছে, অবিশ্বাস্য নাটক।
আনন্দগুপ্ত দূরে একটি অশ্বত্থের নীচে অপেক্ষা করছিলেন। আকাশে প্রথমার ক্ষীণ চন্দ্রমা। তাঁর মাথার ঠিক ওপরে একটি অশ্বত্থের শাখা দুলছিল। তাঁর মুখ একবার আলোকিত হচ্ছিল, আরেকবার অন্ধকার।
কান্তিপ্রভ’র উপর তাঁর গুপ্তচরদের অনেক দিন ধরেই লক্ষ ছিল। স্থানীয় সমিতি সূত্রে তিনি সংবাদ পাচ্ছিলেন যে, গত কয়েক মাস যাবৎ এই ব্রাহ্মণ কমলাঙ্ক গ্রামের যাবতীয় কিরাত, শবর এবং অন্ত্যজ শ্রেণীর কাছে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন। তাঁর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা স্থানীয় সমিতির প্রধান তথা গ্রামপতির কাছে ক্রমেই অস্বস্তিকর হয়ে উঠছিল।
বঙ্গদেশের অলিখিত নিয়ম, একমাত্র চন্দ্রবংশের অন্ধ অনুগামী বা তাঁদের অনুমোদিত গুটিকয় ভাগ্যবান ব্যতীত কারও পক্ষে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা নিষিদ্ধ। কারও মধ্যে সেই লক্ষণ দেখা গেলেই চন্দ্রবংশের পোষিত স্থানীয় সমিতির সদস্যরা সর্বশক্তি দিয়ে তার চরিত্র হননে নেমে পড়ে। তার নামে কালিমা, কুৎসা, মিথ্যে অভিযোগ আর স্বকপোলকল্পিত কলঙ্ককাহিনির স্রোত বইয়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু শতেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই ব্রাহ্মণের চরিত্রে বিন্দুমাত্র কালিমালেপন সম্ভব হয়নি। কান্তিপ্রভ’র পাণ্ডিত্য, চরিত্র, বিনয় এবং সুমধুর ব্যবহার তাঁকে ক্রমেই কমলাঙ্ক গ্রামে জনপ্রিয় করে তুলছিল। এতে আনন্দগুপ্ত’র উদ্বেগ বেড়েছে বই কমেনি।
ঠিক এই সময়ে অশ্বত্থের শীর্ষদেশ থেকে একটি জলের ফোঁটা আনন্দগুপ্ত’র মাথায় ঝরে পড়ল।…
দিকে দিকে যে চন্দ্রবংশের অরাজক শাসনের বিরুদ্ধে জনসাধারণের ক্ষোভ ক্রমেই ধূমায়িত হচ্ছে এবং ক্ষুব্ধ জনতার নেতৃত্ব দিতে উঠে এসেছেন অন্ত্যজ শ্রেণীর বৌদ্ধ সাধক ও শৈবযোগীদের একটি গোষ্ঠী, সে সংবাদও রাজপদাধিকারীদের মধ্যে গোপন ছিল না। শুধু তাদের অধিনায়কদের চিহ্নিত করা সম্ভবপর হচ্ছিল না।
তাই যেদিন এই অরণ্য-সন্নিহিত স্থানটিতে জনৈক অস্ত্রধারী মানুষ সম্পূর্ণ একটি সশস্ত্র গ্রামরক্ষীবাহিনীকে একাকী ধ্বংস করলেন, সেদিনই আনন্দগুপ্ত’র মস্তিষ্কের ধূসর কোষ জাগ্রত হয়ে উঠেছিল। এই স্পর্ধা তো রাজদ্রোহের সঙ্গে তুলনীয়! এই মানুষটি নিশ্চয়ই তাদের মধ্যেই একজন। নইলে এত সাহস কার হবে?
আনন্দগুপ্ত’র কাছে এ ঘটনা ঘোর বিপদের সংকেত৷ সেদিন এই গ্রামে যা ঘটেছে, কাল বজ্রযোগিনী মন্দিরের পূজাপ্রাঙ্গনে যা ঘটেছে তা অচিন্ত্যনীয়। এতটাই সংগঠিত হয়ে উঠেছে এরা? এত শক্তিশালী? অতর্কিতে এত দ্রুত, এত অব্যর্থ আঘাত হানতে পারে?
আনন্দগুপ্ত জানেন, এর অর্থ একটাই। এর পেছনে অবশ্যই এক বা একাধিক অন্তর্ঘাতকের গুপ্তসহায়তা রয়েছে। অন্যথায় কোনও বহিরাগত শক্তির পক্ষেই প্রকাশ্যে এমন সংগঠিত তাণ্ডব চালান অসম্ভব।
কে বা কারা হতে পারে সেই অন্তর্ঘাতক? অবশ্যই এমন কেউ যার সমাজের সর্বস্তরে যোগাযোগ আছে, যে স্বীয় গুণে খ্যাতিমান পুরুষ, যার কাছে চন্দ্রবংশের অন্ধ আনুগত্য আশা করা অসম্ভব৷
অবশ্য এই মুহূর্তে কে যে চন্দ্রবংশের প্রতি প্রকাশ্যে অন্ধ আনুগত্য প্রকাশ করছে আর গোপনে রাজদ্রোহীদের সহায়তা করছে, সে নিয়ে গুপ্তপুরুষ আনন্দগুপ্ত নিজেও সন্দিহান। তবুও পাশার ঘুঁটিগুলি মেলাতে অসুবিধা হয়নি তাঁর। যে মুহূর্তে আনন্দগুপ্ত’র গুপ্তচর এসে খবর দিল যে কান্তিপ্রভ’র কুটিরে একজন বিদেশী এসে আশ্রয় নিয়েছেন, তার সঙ্গে কমলাঙ্ক গ্রামের পার্শ্ববর্তী অন্ত্যজ গ্রামগুলিতে বেশ কিছু অচেনা মানুষের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে, সেদিনই তিনি প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছিলেন। তবে সাবধানে, যথাযোগ্য সতর্কতা সহ। মুহূর্তে মুহূর্তে স্থানীয় সমিতির সদস্য তথা রাষ্ট্রীয় গুপ্তচরবাহিনী তাঁকে এই ক’টি পরিবারের প্রতিটি আনাগোনার সংবাদ সরবরাহ করে গেছে।
আজ রাত্রে আনন্দগুপ্ত এমনিতেও এদের এই গুপ্তকুটিরে হানা দিতেন। কিন্তু তার পূর্বেই, বজ্রযোগিনী মন্দিরে পূজা উৎসবের মধ্যেই যে এরা এত বড় আঘাত হানবে, তার কোনও সঙ্কেত তাঁর কাছে ছিল না।
বজ্রযোগিনী পূজার নিরাপত্তার দায়িত্ব তাঁর। বৎসরের এই একটি দিনেই রাজ্ঞী ও রাজসচিব সহ বঙ্গদেশের সপ্তরাজন্য একই স্থানে একত্রিত হন। ফলে অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা থেকেই যায়। কিন্তু আনন্দগুপ্ত’র সুচারু পরিচালনায় আজ অবধি এই উৎসবে কোনওদিন ছন্দপতন হয়নি৷ এজন্য তাঁর একটা প্রচ্ছন্ন অহঙ্কারও ছিল।
কিন্তু সেই অহঙ্কার আজ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। অন্যান্য রাজন্যবর্গ, প্রকাশচন্দ্র এবং স্বয়ং রাজ্ঞীর চোখে সেই অবিশ্বাসের ছায়াই দেখেছেন তিনি। তাতে তাঁর অন্তরাত্মা মরমে মরে গেছে। তার সমুদায় ব্যর্থতার দায়িত্ব তাঁর, একমাত্র তাঁরই।
অশ্বত্থের মাথা থেকে আবারও একটি জলবিন্দু ঝরে পড়ল। উত্তরীয় দিয়ে আবার মাথা একবার মুছে নিলেন আনন্দগুপ্ত।
তাঁর মনের মধ্যে অস্বস্তিকর প্রশ্নটি পুনরায় জেগে উঠল। এত শক্তিশালী এরা? এত সংগঠিত? তিনি গুঢ়পুরুষ বাহিনীর প্রধান আনন্দগুপ্ত। তাঁর অগোচরে এই বিষবৃক্ষ এতদুর শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে?
কাল থেকে মরমে মরে আছেন আনন্দগুপ্ত। ক্ষুব্ধ, আহত, অপমানিত বাঘের মতো ছটফট করেছেন। যে করেই হোক ভূলুণ্ঠিত সম্মান উদ্ধার করতেই হবে। রাজদ্রোহী, দেশদ্রোহী সারমেয় সন্তানদের প্রকাশ্য রাজপথে রজ্জুবদ্ধ পশুর মতো কশাঘাত করতে করতে নিয়ে যাবেন তিনি। আর কালক্ষেপ করেননি, মহাপ্রতীহার শান্তঘোষের সাহায্য প্রার্থনা করেছেন অভিযান সফল করার জন্য।
দুঃসহ ক্রোধে আনন্ধগুপ্ত’র সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছিল। তাই আবার যখন অশ্বত্থের মাথা থেকে কয়েকটি তরলবিন্দু তাঁর মাথায় ঝরে পড়ল, তখনও ঠিকমতো অনুধাবন করতে পারলেন না তিনি। তাঁর মনের মধ্যে কয়েকটি অস্বস্তিকর প্রশ্ন খেলা করছিল।
শুরু থেকেই এই গুপ্ত অভিযানের বেশ কিছু লক্ষণ তাঁর ঠিক সুবিধার লাগছে না।
এই কুটিরের সংবাদ তাঁকে এনে দেয় ভাঁড়ুদত্তের নিযুক্ত এক মূক ও বধির চর। চরটির একটি আশ্চর্য প্রতিভা আছে। শ্রবণে অক্ষম হলে কী হবে, বক্তার ওষ্ঠসঞ্চালন দেখে সে প্রতিটি শব্দ অনুধাবনের ক্ষমতা রাখে। বলাবাহুল্য ভাঁড়ুদত্ত’র এই গুপ্তবৃত্তির সংবাদ একমাত্র আনন্দগুপ্ত ব্যতীত আর কেউ রাখেন না। শান্তঘোষও নয়। তার কথামতই তাঁরা এসেছিলেন গ্রামটিকে ঘিরে, অরণ্যের মধ্য থেকে।
প্রথমা’র রাত্রি সত্বেও পথ চিনে আসতে শান্তঘোষ বা তাঁর বিশেষ ক্লেশ হয়নি। আর সৈন্যদের তো এমনিতেও অরণ্যচারণার অভ্যাস আছে। কিন্তু কুটিরের নিকটবর্তী হয়ে যখন তিনি দেখলেন কুটিরটির দ্বারে কোনও প্রহরা নেই, তখন তাঁর মনে সামান্য দ্বিধা উৎপন্ন হয়েছিল। কুটিরের অভ্যন্তরে রাজদ্রোহীদের এমন গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশ, আর দ্বারখানি সম্পূর্ণভাবে অরক্ষিত?
তবে তৎক্ষণাৎ এই চিন্তা মন থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। এই মূর্খের দল ভাবতেই পারেনি যে এমন সাফল্য উদযাপনের দিনেই এমন দারুণ প্রত্যাঘাত নেমে আসতে পারে তাদের উপর৷
দাঁতে দাঁত ঘষেছিলেন আনন্দগুপ্ত। ভালো রে ভালো! ওই আনন্দে ওরা যতটা ডুবে থাকে ততই ভালো।
অশ্বত্থশীর্ষ থেকে ঝরে পড়া তরলবিন্দু উত্তরীয় দিয়ে মুছে নিলেন আনন্দগুপ্ত। এত জল কীসের? তেমন তো বৃষ্টি হয়নি এই অঞ্চলে!
তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন তার থেকে অনতিদূরে কুটিরটি বেষ্টন করে অবস্থান নিয়েছে রাজসেবকসেনা। তাদের মধ্য থেকে পাঁচজন সৈন্য নিয়ে কুটীরের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন শান্তঘোষ।
চারিদিকে নিবিড় আরণ্যক নীরবতা। কুটিরের মধ্য থেকে ম্লান আলোকরেখা আনন্দগুপ্তকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে তাঁদের লক্ষ্যভেদ অনিবার্য। একবার শুধু ওই কুটিরে শান্তঘোষের প্রবেশের অপেক্ষা। তারপরেই…
কিন্তু…কিন্তু…এই অরণ্যের প্রান্তদেশে আদিম কিরাতজাতির বাস। এই সময়ে মদ্যপ কিরাতদের উল্লাসবাদ্য এবং যৌথনৃত্যের শব্দ বহুদূর হতে শোনা যায়। আজ নৈঃশব্দ্য কেন? এই অঞ্চলের বন্যসারমেয়কূল তাদের ক্ষিপ্রতা, উগ্রতা এবং হিংস্রতার জন্য কুখ্যাত। তাঁরা এতদূর এলেন৷ এদের সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না কেন?
কান্তিপ্রভ’র স্ত্রী এবং কন্যাকে ধরে নিয়ে আসার জন্য রাজসেবকপ্রধান গিরিকিশোর নিজেই গিয়েছিলেন তার কুটিরে। গিয়েছিলেন দুজন রাজসেবকসহ, অভিযান শুরুর কিছু আগেই৷ পরিকল্পনা ছিল, যে মুহূর্তে কুচক্রীদল একত্র হবে, ঠিক সেই মুহূর্তেই কান্তিপ্রভ’র অরক্ষিত অন্তঃপুরে প্রবেশ করবেন গিরিকিশোর। নারীনির্যাতনে গিরিকিশোরের খ্যাতি প্রবাদপ্রতিম। তাঁকে দেখামাত্র নারীরা আতঙ্কে পাণ্ডুবর্ণ হয়ে যায়। গৃহস্থরা তাদের স্ত্রীকন্যাদের তৎক্ষণাৎ অন্দরে লুকিয়ে রাখে। এহেন গিরিকিশোর দুজন অবলা বঙ্গললনার কেশাকর্ষণ করে গ্রামপথ দিয়ে টেনে আনতে এত কালক্ষেপ করছেন কেন?
গিরিকিশোরের সন্ধানে আরও দুজন রাজসেবককে পাঠানো হয়েছে। তারাই বা ফিরে আসতে এত সময় নিচ্ছে কেন?
আবার অশ্বত্থের শীর্ষ থেকে তরলবিন্দু। বিরক্ত হলেন আনন্দগুপ্ত। উত্তরীয় দিয়ে মাথা একবার মুছে নিলেন। এত জল কোথা থেকে আসছে? মুখ তুলে ওপরে তাকাবেন, ঠিক এই সময়ে দুজন সৈন্য নিঃশব্দে আনন্দগুপ্ত’র পিছনে এসে দাঁড়াল৷ ঘাড় না ঘুরিয়েই তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘গিরিকিশোর এসেছে?’
উত্তর এল, ‘না প্রভু। কান্তিপ্রভ’র কুটিরে তাঁকে দেখতে পেলাম না।’
আবার টুপ টুপ করে বেশ কিছু তরলবিন্দু। কিন্তু সেদিকে মন দিলেন না আনন্দগুপ্ত। তিনি পুনরায় অঙ্গবস্ত্রটি দিয়ে মাথা ও ঘাড় মুছে ভ্রুকুটি করে বললেন, ‘দেখতে পেলে না মানে?’
‘কান্তিপ্রভ’র কুটির নিষ্প্রদীপ ও জনশূন্য প্রভু। আমরা চারিদিক ভালো করে দেখে এসেছি৷ কোনও জনপ্রাণীর চিহ্নমাত্র নেই।’
অকস্মাৎ আনন্দগুপ্ত’র ঘাড়ের রোমগুলি দাঁড়িয়ে গেল। তাঁর অবচেতনে কোনও অজানা বিপদের ছায়াপাতমাত্র এই ঘটনা ঘটে৷ কী যেন একটা ঠিক হচ্ছে না! কী সেটা?
‘আর গিরিকিশোর?’
‘তাঁরও কোনও সন্ধান নেই প্রভু।’ উত্তর দিল দ্বিতীয় জন।
এইবারে বুঝলেন আনন্দগুপ্ত। এই স্বরদুটি বিলক্ষণ চেনেন তিনি।
বজ্রযোগিনী মন্দিরের সামনে সমবেত সেই জনারণ্যে তিনি ছিলেন। ছদ্মবেশে সমস্ত ঘটমান পরিস্থিতির ওপর লক্ষ রেখে চলেছিলেন। মন্দিরের সামনে যখন নাটিকাটি চলছিল, তখন তিনি নাট্যদলের দুজন সুবেশ তরুণকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এখানে কী হচ্ছে ভায়া? এ পূজা কোথায়, এ তো কৌতুকের রঙ্গ মনে হচ্ছে। এই দেশে দেবীপূজা এইরকমই হয় নাকি?’
একজন সকৌতুকে উত্তর দিয়েছিল, ‘মহাশয় এই দেশে নতুন মনে হচ্ছে। পূর্বে কখনও বজ্রযোগিনীর উৎসবে অংশগ্রহণের সৌভাগ্য হয়নি, তাই না?’
অন্যজন গম্ভীরমুখে উত্তর দিয়েছিল, ‘অত কথার কী দরকার ভ্রাত? সরাসরি উত্তর দিলেই তো হয়। শুনুন মহাশয়, একে বুদ্ধনাটিকা বলে।’
অন্য কেউ হলে অত শব্দব্রহ্মের মধ্যে শ্রুত স্বরদুটি স্মরণে থাকত না। কিন্তু আনন্দগুপ্ত গুপ্তচরবৃত্তিতে সিদ্ধপুরুষ। এই দুটি কণ্ঠস্বর তাঁর বিলক্ষণ স্মরণে আছে।
কালকের নাট্যদলের কুশীলবদের স্বর এখানে কেন? রাজসেবকসেনার বেশে এরা কারা?
মুহূর্তের মধ্যে আনন্দগুপ্ত’র চোখের সামনে থেকে আড়াল সরে গেল। আপত অসঙ্গতিগুলির উত্তর পেয়ে গেছেন তিনি। আর উত্তরটি হৃদয়ঙ্গম করা মাত্র ভয়ঙ্কর সত্য তাঁর মস্তিষ্কে বিদ্যুতের মতো গেঁথে গেল।
ওই নাট্যদলই তার মানে মূল চক্রীদের গোষ্ঠী। কালকের ধ্বংসকাণ্ড তাদেরই কর্ম। তাদেরই দুইজন এখন রাজসেবকসেনার বেশ ধরে তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।
অর্থাৎ পুরো ঘটনাটাই সাজানো। অতি যত্নে তাঁদের জন্য ফাঁদ পাতা হয়েছে এই অরণ্যের মধ্যে। তারা জানত আজ রাত্রে আনন্দগুপ্ত সদলবলে অভিযানে নেমেছেন। তারা জানত মহাপ্রতীহার শান্তঘোষ নিজে আসছেন রাজসেবকসেনা নিয়ে। তা সত্বেও তারা তাদের আয়োজন প্রত্যাহার করেনি। অর্থাৎ তাঁরা যেমন এই কুচক্রীদের আয়োজনের সংবাদ রাখছেন, তারাও তাঁদের সমস্ত অভিযানের অগ্রিম সূচনা পেয়ে যাচ্ছে!
এই অভিযানের সংবাদ জানতেন কেবলমাত্র মহারানি নিজে আর প্রকাশচন্দ্র সহ বাকি ছ’জন রাজপুরুষ। তা সত্বেও এদের কাছে এই অভিযানের সংবাদ ফাঁস হয়ে যাওয়ার একটাই অর্থ।
তাঁদের মধ্যে, এই সপ্তরাজন্যের মধ্যেই একজন বিশ্বাসঘাতক লুকিয়ে আছে!
শিকার করতে এসে এখন তাঁরা নিজেরাই শিকার!
সন্তর্পণে তিনি তাঁর ডানহাতটি কোষবদ্ধ তরবারির হাতলে রাখলেন। সতর্কস্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘সন্ধান নেই মানে? তাঁকে যে কান্তিপ্রভর কুটিরে পাঠানো হল?’
অশ্বত্থের শীর্ষদেশ থেকে বামাকণ্ঠে উত্তর এল, ‘আপনাদের পরম অনুগত ভৃত্য, শ্রী গিরিকিশোর আপাতত এখানে, মহামান্য আনন্দগুপ্ত।’
দু’খানি তরবারির অগ্রভাগ তাঁর কাঁধ স্পর্শ করেছে। স্তম্ভিত আনন্দগুপ্ত ওপরে তাকাতেই দেখলেন—অশ্বত্থের শীর্ষদেশে বেঁধে রাখা আছে একটি মানুষের দেহ। আর তার পাশে একটি ছায়ামূর্তি। পরক্ষণেই দেহটি ফেলে দেওয়া হল! সেটি এসে পড়ল আনন্দগুপ্তর পায়ের কাছে।
গিরিকিশোর!
কিন্তু এ কী অবস্থা হয়েছে মহাবীর গিরিকিশোরের! বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন আনন্দগুপ্ত। সম্পূর্ণ উলঙ্গ দেহ, অস্ত্রাঘাতে ছিন্নভিন্ন। হাত-পা মুখ বাঁধা। ক্ষীণ চন্দ্রালোকে দেখা যাচ্ছিল তার সমস্ত শরীর ভেসে যাচ্ছে রক্তে। শরীরে সাড় আছে বটে, তবে না থাকার মতোই।
সচকিত হয়ে নিজের উত্তরীয়র দিকে তাকালেন আনন্দগুপ্ত। শ্বেত শুভ্র উত্তরীয়তে কয়েকটি গাঢ় কৃষ্ণবর্ণের দাগ৷ এতক্ষণে বুঝলেন আনন্দগুপ্ত, এই বৃষ্টিহীন রাত্রিতে তাঁর মাথায় ঝরে পড়া তরলবিন্দু জল নয়, ছিল গিরিকিশোরের রক্ত!
সমস্ত শরীর শক্ত হয়ে উঠল আনন্দগুপ্ত’র। মাথার মধ্যে বেজে উঠেছে বিপদসঙ্কেত। বিপদ! সামনে ভয়ঙ্কর বিপদ!
ততক্ষণে অশ্বত্থ-শীর্ষের ছায়ামূর্তিটি সরীসৃপের মতো শাখাপ্রশাখা বেয়ে তরতরিয়ে নেমে এসেছে মাটিতে। কৃষ্ণবস্ত্রাবৃত দেহটি খর্বকায় কিন্তু সবল। একটি খড়্গ আনন্দগুপ্ত’র কণ্ঠদেশে ধরে সেই ছায়ামূর্তি ক্রুরকণ্ঠে বলল, ‘আপনার অনুগত পাপবুদ্ধির অবস্থা দেখলেন তো রাজন্যপ্রবর? এই ধর্ষক পশুটির পুরুষাঙ্গখানি আপাতত অরণ্যের পশুদের খাদ্য হয়েছে। জেনে রাখুন, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনার আর আপনার সঙ্গীদের অবস্থাও তাই হতে চলেছে।’
এই অবস্থাতেও বুদ্ধিভ্রষ্ট হননি আনন্দগুপ্ত। বিদেশে এরকম বহু বিপদজনক পরিস্থিতি নিজের স্থিরবুদ্ধি এবং সাহসে ভর করে নির্বিঘ্নে পার করেছেন তিনি।
চারিপাশে তাকিয়ে একবার পরিস্থিতি অনুধাবন করে নিলেন আনন্দগুপ্ত। সামান্য দূরে কুটীরের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে রাজসেবকসেনা। কিছু আগেই অতি সন্তর্পণে কুটিরের অন্দরে প্রবেশ করেছেন শান্তঘোষ। কিছু শব্দ ভেসে আসছে কুটীরটি থেকে। সেনারা জানে না যে কী ভীষণ বিপদের মধ্যে আছেন তিনি।
দ্রুত চিন্তা করলেন আনন্দগুপ্ত। একবার উচ্চকণ্ঠে সংকেত দেওয়ার অপেক্ষামাত্র। রাজসেবকসেনার আঘাত করার দ্রুততা ভয়ঙ্কর কালসর্পের থেকেও ক্ষিপ্রতর। মুহূর্তের মধ্যে এই তিন আততায়ীর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে বটে, কিন্তু তার আগে এরা যে তাঁর মুণ্ডখানি দেহকাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে, সেটা নিশ্চিত।
তাহলে উপায়?
আনন্দগুপ্ত’র অভিজ্ঞতা বলে এইসব ক্ষেত্রে বাক্যবিন্যাসের জাল ছড়াতে হয়৷ কথায় কথায় বিলম্বিত করতে হয় মুহূর্ত। তারপর সঠিক ক্ষণ খুঁজে নিয়ে প্রত্যাঘাত হানতে হয় বিদ্যুতের মতো।
আনন্দগুপ্ত চাপাস্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমরা কারা?’
পিছনে দাঁড়ানো দুই অস্ত্রধারীর একজন উত্তর দিল, ‘আজ্ঞে আমরা আপনার আজ্ঞাবহ দাস, প্রভু।’
ব্যঙ্গ গায়ে মাখলেন না আনন্দগুপ্ত? ‘কী চাও তোমরা।’
অন্য স্বরটি গম্ভীরস্বরে উত্তর করল, ‘আজ্ঞে, আপনার মুণ্ড।’
‘তোমরা জানো আমি কে?’
‘না জানলে কি আর এই অশ্বত্থের তলায় আপনার জন্য ফাঁদ পাতি, প্রভু আনন্দগুপ্ত?’ সেই কৌতুকস্বর।
‘আমাকে হত্যা করার ফলাফল জানো তো?’
‘সে নিয়ে আপনাকে না ভাবলেও চলবে। আপাতত বরং যমরাজের কাছে কীভাবে এই ইহজীবনে কৃত অপরাধের দায় থেকে অব্যাহতি চাইবেন, সেই নিয়ে ভাবুন।’ উত্তর দিল দ্বিতীয় স্বর।
‘ওরে মূর্খের দল, রাজাদেশে কৃত অকর্তব্যের দায় অধীনস্থের ওপর বর্তায় না, সে কথা জানিস না?’ এদের উত্তেজিত করতে চাইছেন আনন্দগুপ্ত। কুটিরের মধ্য থেকে কিছু কথা ভেসে আসছে৷ আনন্দগুপ্ত জানেন ও শান্তঘোষের স্বর।
তরবারি দুটি আরও গভীর ভাবে চেপে বসেছে স্কন্ধে। আনন্দগুপ্ত অনুভব করলেন যে তাঁর দেহ থেকে রক্তপাত শুরু হয়েছে। কৌতুকস্বর এবার অকস্মাৎ তীব্র, ‘রাজাজ্ঞার দোহাই দিয়ে নিরীহ মানুষের ওপর কৃত অত্যাচারের পাপ থেকে নিষ্কৃতি পাবেন না আনন্দগুপ্ত। শত সহস্র সর্বহারার চোখের জল, শত সহস্র দরিদ্র কৃষকের হাহাকার, শত সহস্র ধর্ষিতা বঙ্গনারীর লাঞ্ছিত সিঁদুরের অভিশাপ আপনাদের কাউকে অব্যাহতি দেবে না।’
‘সে বিচার ঈশ্বর করবেন। তোমরা বিচার করার কে?’
‘সে তো বটেই। ঈশ্বর যাতে দ্রুত সে বিচার সম্পন্ন করতে পারেন তার জন্যই তো এ আয়োজন।’
‘কে হত্যা করবে আমাকে? এই অবলা নারী?’
নারী দৃপ্তকণ্ঠে স্বরে বলে উঠল, ‘কেন রে পশু, এই অবলা নারী যদি নরাধম গিরিকিশোরের এই অবস্থা করতে পারে, তাহলে তুই কোন বীর?’
এইবার সত্যিই ভয় পেলেন, ভীত হলেন আনন্দগুপ্ত। রক্তস্নাত খড়্গ থেকে উঠে আসছিল জান্তব ঘ্রাণ। মেয়েটি যে মিথ্যে বলছে না, তার প্রমাণ ছিল তার রক্তচক্ষুতে, এই প্রায়ান্ধকারেও যেটি ধক-ধক করে জ্বলছিল।
সামান্য স্খলিতস্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘কে তুমি?’
খড়্গটি আরও হিংস্রভাবে চেপে বসল তাঁর কণ্ঠনালীর ওপর। প্রবল ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারিত হল, ‘আমি কে, তা জানতে চাস? তবে দেখ,’ এই বলে সেই নারী নিজের মুখখানি অনাবৃত করলেন, ‘আমাকে চিনতে পারিস রে পাপপিণ্ড? আমার কথা মনে পড়ে আনন্দগুপ্ত? আমি অমাত্য জয়নাথের সেই ভাগিনেয়ী, দেদ্দদেবী।’
আনন্দগুপ্ত আতঙ্কে স্থবির হয়ে যাওয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে কুটির থেকে নিঃশব্দ বিদীর্ণ করে ভেসে এল শান্তঘোষের আর্তচিৎকার। রাজসেবকসেনা তৎক্ষণাৎ দু’হাতে কুঠার আর খড়্গ নিয়ে প্রস্তুতি নিল। কিন্তু তারা কুটিরের দিকে অগ্রসর হতে না হতেই অরণ্য প্রকম্পিত করে ভীমনাদ ভেসে এল, ‘জয় গৌড়, জয় বঙ্গ, জয় শশাঙ্ক।’
সঙ্গে সঙ্গে অরণ্যের বিচিত্র গোপন স্থান থেকে জেগে উঠল কিরাতযোদ্ধাদের ছায়া-অবয়ব। তাদের কটিদেশে তীক্ষ্ণধার দাও, হাতে খর্বকায় অথচ শক্তিশালী ধনু। সেই ধনু থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসতে লাগল মর্মভেদী বিষাক্ত তীরের দল। আক্রোমণোদ্যত রাজসেবকসৈন্যদের অধিকাংশ তাতেই ধরাশায়ী হল। যারা ধরাশায়ী হল না তাদের জন্য মহাদ্রুমের শাখা-প্রশাখা থেকে কুঠার হাতে লাফিয়ে নেমে এল কিরাত আর শবরের দল। তাদের জান্তব আক্রোশের সঙ্গে মিশেছে সামরিক প্রশিক্ষণের ক্ষিপ্রতা। রাজসেবকসেনা এই প্রশিক্ষিত উন্মত্ততার সঙ্গে পরিচিত নয়। তারা নির্মমভাবে নিহত হতে থাকল।
অরণ্যের মধ্যে সেই ঘোর যুদ্ধটির সমাপ্তি আনন্দগুপ্ত আর শান্তঘোষ কেউই দেখতে পেলেন না। কারণ তাঁদের মুণ্ডদুখানি অরণ্যের মধ্যে দুই যুযুধান প্রতিপক্ষের পায়ের কাছে ইতস্তত ঘোরাফেরা করছিল।
.
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন