পটমঞ্জরী – ৮

অভীক সরকার

মৎস্যেন্দ্রনাথের কথা শেষ হলে প্রত্যেক নির্বাক হয়ে বসে রইলেন। মহাসামন্ত ধর্মসেন অভিভূতস্বরে বললেন, ‘এ যে আমাদের স্বপ্নেরও অগোচর। সম্রাট রাজভটের বৈধ উত্তরাধিকারী আবার তাঁর প্রাপ্য সিংহাসন ফিরে পাবেন, এই দীর্ণ ভূমিতে শান্তি এবং সুশাসন ফিরে আসবে, এর থেকে আনন্দের বিষয় আর কী হতে পারে?’

সামন্ত অধিরথ বলে উঠলেন, ‘কিছু মুহূর্ত পূর্বাবধি আমার মনে সংশয় ছিল বটে। স্বীকার করতে বাধা নেই, এখন আমি সম্পূর্ণ নিঃসংশয়।’

উপস্থিত অন্যান্য সামন্তরা হর্ষধ্বনি করে উঠলেন। পরিত্যক্ত প্রাসাদের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে যেন নতুন করে আশার উজ্জ্বল জ্যোতি জেগে উঠল।

গৌড়েশ্বর জয়ন্ত প্রৌঢ় হয়েছেন। তবুও তিনি যখন পরের প্রশ্নটি করলেন, তাঁর স্বরের মধ্যে নবযৌবনের উত্তেজনার আভাস পাওয়া গেল, ‘তাহলে, এবার আমাদের কী কর্তব্য লোকেশ্বর?’

মৎস্যেন্দ্রনাথ বললেন, ‘আমরা ইতিমধ্যেই বঙ্গদেশের রাজপদোপজীবিদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে স্বপক্ষে আনতে পেরেছি। তাঁরা নিয়মিত আমাদের সংবাদ দিয়ে চলেছেন। প্রকাশচন্দ্র এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা ভালোই বুঝেছেন যে মহাবিদ্রোহ আসন্নপ্রায়। কর্মান্তবাসকের সর্বত্র নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে চতুর্গুণ। সৈন্যবাহিনীকে সদাপ্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। রাজসেবক বাহিনীকে বিশেষ আদেশ দেওয়া হয়েছে প্রতিটি গ্রাম, পল্লী, পণ্যবিথী এবং মন্দিরে সতর্ক থাকার জন্য।

‘আমরা সরাসরি আক্রমণ করে কর্মান্তবাসক পদানত করতে পারব না। সংখ্যায় এবং রণকুশলতায় শত্রুপক্ষ আমাদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে। আমাদের পথ হবে অন্তর্ঘাতের পথ। ক্ষণিক এবং ঝটিকা আক্রমণের পথ। শত্রুকে স্তম্ভিত করে দিতে হবে৷ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য যুদ্ধক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে৷ প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য সমস্ত উপায়ে শাসনব্যবস্থাকে উত্যক্ত করে যেতে হবে।’

‘যেমন?’

‘আপনারা কর দেওয়া বন্ধ করে দিন। বা বিলম্বিত করুন। বলুন, প্রজারা অবাধ্য হয়েছে, তারা কর দিতে চাইছে না।’

‘এই যুক্তি প্রকাশচন্দ্রের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না যোগীবর। তিনি প্রশ্ন করবেন সামন্তসৈন্যরা আছে কী করতে? তাদের প্রয়োগ করুন।’

‘সঠিক বলেছেন সামন্ত অধিরথ। সেই নির্দেশ এলে আপনাদের অধীনস্থ সৈন্যপ্রধানদের বলুন বিদ্রোহের নাটক করতে। তারা যেন আপনাদের রাজসভার কোনও মুখ্য রাজকর্মকর্তাকে বন্দি করে। তিনি মহামাত্য হতে পারেন, মহাপ্রতীহার হতে পারেন, অথবা আবস্থিক, মহাসান্ধিবিগ্রহিক, ঔদ্রঙ্গিক, বাহনায়ক, বিষয়পতি যে কেউ হতে পারেন।’

‘বিষয়টি কি এতই সরল?’ সন্দেহের সুরে প্রশ্ন করেন একজন।

‘অবশ্যই নয় সামন্ত,’ গম্ভীরস্বরে বললেন বপ্যট, ‘আপনাদের সম্মতি পেলে সমগ্র পরিকল্পনাটি বিশদে বলতে পারি।’

‘বলুন আর্য বপ্যট।’

‘শাস্ত্রে বলে নৃপঃ কর্ণেন পশ্যতি। চন্দ্রবংশের দ্বারা নিযুক্ত হলেও, মহারানির তৎপাদপরিগৃহীত হলেও আপনারা বহুলাংশে স্বাধীন নরপতি। অবশ্যই আপনাদের প্রত্যেকের নিজস্ব গুপ্তচরবাহিনী আছে।’

উপস্থিত সামন্তরা স্মিত হাসলেন। কিছু বললেন না।

‘আপাতত আপনারা আপনাদের গুপ্তচরবাহিনীকে পরস্পরের বিরুদ্ধে নিযুক্ত করে রেখেছেন। তাই তো?’

মুহূর্তে সামন্তরাজারা গম্ভীর হয়ে গেলেন৷

‘আমার অনুরোধ, অনতিবিলম্বে আপনাদের গুপ্তচরবাহিনীকে রাজ্যের মধ্যে ফিরিয়ে আনুন। তারপর আপনার একান্ত অনুগত এবং বিশ্বস্ত গুপ্তচরদের নিযুক্ত করুন আপনার রাজসভার সদস্যদের জন্য। তাঁরা কী করেন, কোথায় যান, কার সঙ্গে দেখা করেন, কাদের ওপর নির্ভর করেন, তাঁদের অভ্যাস কী, দুর্বলতা কোথায়, সমস্ত সংবাদ সংগ্রহ করুন। এই মুহূর্তে আপনার অমাত্যদের মধ্যে কারা কারা চন্দ্রবংশের একান্ত অনুগত তার সন্ধান পাওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন।’

‘তারপর?’ প্রশ্ন করলেন গৌড়েশ্বর জয়ন্ত।

‘হ্যাঁ, পরের অংশটিই অতীব গুরুত্বপূর্ণ,’ আলোচনার রাশ নিজের হাতে তুলে নিলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ, ‘আপনারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে সৈন্যপ্রধান, মহাপ্রতীহার এবং বিষয়পতি, এই তিন পদাধিকারী সম্পূর্ণভাবে আপনার বিশ্বস্ত হওয়া উচিত। সৈন্য এবং অর্থ, এই হচ্ছে রাজ্যশাসনের অস্থি এবং মজ্জা। এই দুটি বিষয় যেন নিঃসংশয়ে আপনাদের করতলগত হয়।

‘প্রথমেই এই তিনটি অধিকরণে নিজের অধিকার স্থাপন করুন। তারপর অনুগত সৈন্যপ্রধানের দ্বারা মিথ্যা সেনাবিদ্রোহের আয়োজন করুন। বিদ্রোহী সেনারা যেন সেইসব রাজকর্মচারীদেরই বন্দি করে যারা গোপনে চন্দ্রবংশের প্রতি অনুগত।’

এতক্ষণে বিষয়টি বুঝলেন রাজারা৷ নড়েচড়ে বসলেন।

‘বন্দি রাজকর্মচারীদের কাছে কৌশলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করুন যেন তাঁরা সৈন্যবিদ্রোহ এবং নিজেদের বন্দি হওয়ার সংবাদ নিজস্ব সূত্রে কর্মান্তবাসকে পাঠাতে পারেন। শান্তঘোষ এবং আনন্দগুপ্ত কিছুতেই যেন বিশ্বস্ত সূত্রের সংবাদ উপেক্ষা করতে না পারেন।’

মাথা নাড়লেন উপস্থিত সামন্তরা। গৌড়েশ্বর বললেন, ‘এতদ্বারা বোঝানো যাবে যে বঙ্গদেশের বিভিন্নস্থানে সেনাবিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছে। তাই তো?’

‘ঠিক তাই। আপনারা মহারানির কাছে আবেদন জানাবেন যেন কর্মান্তবাসক থেকে সৈন্য পাঠানো হয়। আপনাদের সাহায্যের আশু প্রয়োজন। প্রয়োজন হলে যেন অন্যান্য সামন্তদের অনুরোধ করা হয় সৈন্য পাঠিয়ে আপনাদের সাহায্য করার জন্য।’

‘কিন্তু অন্যান্য সামন্তরা এই প্রস্তাবে আপত্তি জানাবেন না?’

‘না, জানাবেন না৷’ বললেন গৌড়েশ্বর জয়ন্ত, ‘তাঁরা বরং চাইবেন এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে। সমগ্র বঙ্গদেশ জুড়ে এখন ঘোর মাৎস্যন্যায়। আপনার পার্শ্ববর্তী সামন্ত মহোদয় আপনার শাসনভূমিটি হস্তগত করার এমন সুবর্ণসুযোগ কোনওমতেই ছাড়বেন না। তিনি প্রবল উৎসাহে নিজের সৈন্য পাঠাবেন। এমনকী কর্মান্তবাসক থেকে আদেশ আসার আগেই যদি সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে দেন তাহলে আশ্চর্য হব না। এই সুযোগে তিনি আপনার ভূম্যধিকার, সম্পদ, নারী সব কিছু উদরসাৎ করবেন। আর এই অনাচারের পরিবর্তে না হয় কিছু মূল্য ধরে দেবেন। অর্থাৎ কিছু অতিরিক্ত কর উপঢৌকন পাঠিয়ে দেবেন কর্মান্তবাসকে। তাহলেই সব শান্তিকল্যাণ।’

সভাস্থলে উপস্থিত সামন্তরা মৌন রইলেন। এই বক্তব্যের রূঢ় সত্যতা তাঁদের থেকে বেশি আর কে জানে!

বপ্যট বলতে শুরু করলেন, ‘এই পরিস্থিতিতেই চতুরঙ্গ ক্রীড়ার মোক্ষম চাল আমাদের দিতে হবে। যেই মুহূর্তে কর্মান্তবাসক বা অন্যান্য সামন্তবর্গের সৈন্যদল আপনাদের ভূম্যধিকারে প্রবেশ করবে, তখন থেকে আপনাদের অনুগত কর্মচারী সাহায্য করার নাম করে তাদের বিভ্রান্ত করবে। তাদের কর্তব্য সম্পাদনের পথে বাধা সৃষ্টি করবে। আপনার গুপ্তবাহিনীর সাধারণ নাগরিকের ছদ্মবেশে তাদের গুপ্ত আক্রমণ করবে, উত্যক্ত করবে।’

‘কিন্তু এমন করে কী সুবিধা হবে? মানে আমাদের মূল উদ্দেশ্য কী?’ হরিকেলের জয়নাথের প্রশ্ন শুনে বোঝা গেল যে পরিকল্পনাটি এখনও সবার সম্যকরূপে প্রণিধান হয়নি।

‘আগামী কার্তিকী অমাবস্যার দিন কর্মান্তবাসকে দেবী বজ্রযোগিনীর মহাপূজা। তার আগেই আমাদের মধ্যে যাঁরা এই বিদ্রোহের মূল উদ্যোক্তা, তাঁরা পৌঁছে যাবেন কর্মান্তবাসকে। ওই দিন প্রকাশচন্দ্র এবং অন্য ছয় মুখ্য রাজন্যদের সঙ্গে রাজ্ঞী স্বয়ং মন্দিরে আসেন পূজার্চনার জন্য। আমাদের প্রথম আঘাত হানা হবে সেইদিন। সেইদিন যা আলোড়ন সৃষ্টি হবে তার অভিঘাত আপনারা চিন্তাও করতে পারছেন না। শাসকের বুকে ভয় ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যা যথেষ্ট।

তারপর থেকেই নিশ্চিতভাবে সমগ্র কর্মান্তবাসকে বিদ্রোহীদের সন্ধান চলবে। আমরা এমন কূটকৌশল করেছি যেন আমাদের গুপ্তগৃহের সন্ধান আনন্দগুপ্ত’র কাছে পৌঁছয়। সেটিও প্রকৃতপক্ষে একটি ফাঁদ। শত্রুর প্রথম আঘাতের ক্ষত নিরাময় হওয়ার আগেই সেটি হবে আমাদের দ্বিতীয় আঘাত। তারপরেই আমরা হানব আমাদের চূড়ান্ত আক্রমণ।

আপনাদের যে পরিকল্পনার কথা বলা হল তার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের আক্রমণের সময় চন্দ্রবংশের এবং তাদের অনুগত সামন্তসৈন্যদের একটি বৃহৎ অংশকে ব্যতিব্যস্ত রাখা, অবরুদ্ধ করে রাখা। অন্তত একমাস, ন্যূনপক্ষে একপক্ষকাল আপনাদের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে। এই সময়ে বিভিন্ন সূত্রে ক্রমাগত কর্মান্তবাসকে সংবাদ পাঠাতে হবে যে আপনারা প্রত্যেকে বিদ্রোহী সৈন্যদের সঙ্গে মরণাপন্ন যুদ্ধে রত।’

উপস্থিত সামন্তরা নিজেদের মধ্যে নিভৃত আলোচনায় রত হলেন। মৎস্যেন্দ্রনাথ, বপ্যট আর গৌড়েশ্বর জয়ন্ত চুপ রইলেন। তিনজনের মনেই প্রবল উৎকণ্ঠা। তাঁরাই এই পরিকল্পনার প্রধান রূপকার। এই সভার সাফল্যের ওপর নির্ভর করছে এই মহাবিদ্রোহের ভবিষ্যত।

কিছুক্ষণ পর গুঞ্জন বন্ধ হল। সামন্তবর্গকে দেখে দেখে মনে হল পরিকল্পনাটি তাঁদের মনঃপূত হয়েছে। মহাসামন্ত ধর্মসেন বললেন, ‘আমরা আপনাদের সঙ্গে সহমত হলাম যোগীবর। আমাদের ওপর যে দায়িত্ব ন্যস্ত করেছেন, তার যথাযথ পালনের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ রইলাম। কিন্তু ওই রাজ্ঞী আর প্রকাশচন্দ্রকে হত্যা না করতে পারলে এই বিদ্রোহে জয়লাভের সম্ভাবনা সুদূর পরাহত। আর দুজনেই বিভিন্ন ঐশী শক্তির অধিকারী বলে প্রকাশ। সে বিষয়ে আপনাদের পরিকল্পনা কী?’

প্রদীপের শিখাটি যেন অকস্মাৎ স্থির হয়ে গেল। সবার দৃষ্টি ন্যস্ত হল মৎস্যেন্দ্রনাথের ওপর। তিনি প্রথমে স্মিত হাসলেন। তারপর গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘ক্ষমা করবেন আর্য। সে বিষয়ে আমাদের পরিকল্পনা এতই গোপন যে প্রকাশ্যে বলা সমীচীন মনে করছি না।

‘তার মানে এই নয় যে আপনাদের অবিশ্বাস করছি। এইটুকু আপনাদের আশ্বাস দিতে পারি যে এই দুজনের মৃত্যুবাণ আমাদের হাতে। কিন্তু চূড়ান্ত আক্রমণের পূর্বে আমাদের কিছু নির্দিষ্ট সংবাদ প্রয়োজন। প্রাসাদে প্রবেশ করার জন্য কিছু কূটকৌশল প্রয়োজন। আমাদের সহযোগীরা এই মুহূর্তে সেইসব কর্মে ব্যপৃত। তবে আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখুন, আদিনাথের কৃপায়, জগদীশ্বরী মহামায়ার কৃপায় আমরা অবশ্যই জয়যুক্ত হব।’

গৌড়েশ্বর জয়ন্ত সামান্য ইতস্তত করে বললেন, ‘আমার জন্য কোনও আদেশ লোকেশ্বর?’

মৎস্যেন্দ্রনাথ হেসে বললেন, ‘আপনার জামাতাকে আমাদের সহায়তা করতে বলে ইতিমধ্যেই আপনার কর্ম সম্পাদন করেছেন মহারাজ। আপনার জন্য আর একটিই কর্ম নির্দিষ্ট আছে৷ আমার ভ্রাতৃপ্রতিম শবরবজ্র তাঁর কিছু সঙ্গীসাথী নিয়ে কজঙ্গল থেকে কর্মান্তবাসকের দিক যাত্রা করেছেন। তাঁদের জন্য কিছু দ্রুতগামী বাহন, আর কয়েকদিনের পাথেয়’র ব্যবস্থা করে দিলে বাধিত হই।’

গৌড়েশ্বর উঠে দাঁড়িয়ে যুক্তকরে বললেন, ‘যথা আজ্ঞা।’

.

‘এই নারী বিষবিদ্যায় মহাকুশল, সে নিশ্চয়ই আপনাদের অজানা নয়। তাই এঁকে হত্যা করার আগে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে সর্বাংশে নিশ্চিত হতে হবে।’

‘তার ব্যবস্থা করা হয়েছে আর্য চারুদত্ত।’

‘আর প্রকাশচন্দ্রের ঐশী শক্তির সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রয়োজন তন্ত্রবিদ্যায় সমান শক্তিশালী একজন কোনও সাধকের।’

মৃদু হাসলেন কাহ্নপা, ‘সে ব্যবস্থাও রয়েছে আর্য চারুদত্ত। যোগীশ্বর মৎস্যেন্দ্রনাথ স্বয়ং যাদের সহায়, তাদের আবার ভয় কী?’

‘কিন্তু, আর একটি তথ্য আপনাদের জানতে হবে কাহ্ন। এই নারীকে হত্যার জন্য সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেটি কী সে ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ অন্ধকারে৷’

‘কিছু আলোকপাত করতে পারবেন?’

‘শুনেছি এই নারীকে হত্যার একটি বিশেষ উপায় আছে। ব্যস, এই পর্যন্ত জানি। কী সেই উপায় বলতে পারব না।’

‘কে বলতে পারবেন আপনার কোনও ধারণা?’

চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলেন চারুদত্ত। সেই অজস্র বলিরেখাঙ্কিত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কাহ্নপা। কে বলবে, এই মানুষটি এককালে বঙ্গদেশের শাসনক্ষমতার অন্যতম স্তম্ভ ছিলেন। নিজের হাতে সম্রাট রাজভটকে হত্যা করেছেন, বলভটকে পুত্তলিকা বানিয়ে শাসনক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন, প্রকাশচন্দ্রকে সেই পাপের ভাগীদার করেছেন। অবশেষে ধূর্ত প্রকাশচন্দ্র শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই এঁকে বন্দি করেছেন। আজ ইনি দীনহীন সহায়সম্বলহীন অবস্থায় এই অস্বাস্থ্যকর দেশে এসে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষারত।

এঁর সংবাদ দিয়েছিলেন জয়নাথ, ইনি হরিকেলের সামন্ত হরিদত্ত’র অমাত্য। হরিদত্ত প্রকাশচন্দ্রের আত্মীয়, বিশেষ অনুগৃহীতও বটে। ক্রূরতায়, ধূর্ততায়, নৃশংসতায় ইনি দ্বিতীয় প্রকাশচন্দ্র।

তবে হরিদত্তর একটি বিশেষ দুর্বলতা আছে। হরিদত্ত অত্যন্ত নারীলোলুপ। নিয়মিত গণিকাসম্ভোগ তো বটেই, পরস্ত্রী হরণেও ইনি বিশেষ সিদ্ধিলাভ করেছেন। এঁর একটি বিশিষ্ট বাহিনী আছে, সুন্দরী যুবতী কন্যা বা স্ত্রী হরণ করাই যাদের একমাত্র কাজ।

আর সেই রন্ধ্রপথেই এঁর সর্বনাশের পথ উন্মুক্ত হয়।

অমাত্য জয়নাথের একটি পঞ্চদশবর্ষীয়া পরমাসুন্দরী ভাগিনেয়ী ছিল। অপুত্রক জয়নাথ তাকে নিজের কন্যার মতো স্নেহ করতেন। তার জন্য উপযুক্ত পাত্রও দেখেছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হল না।

বিবাহের রাত্রে হরিদত্ত’র ভৈরববাহিনী বিবাহমণ্ডল থেকে মেয়েটিকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। বাধা দিতে গিয়ে জয়নাথের রক্ষীরা এবং পাত্রটি নিহত হয়। মেয়েটির আর কোনও সংবাদ পাওয়া যায়নি।

ঘটনার সময় জয়নাথ অকুস্থলে ছিলেন না। সংবাদ পেয়ে তিনি ছুটতে ছুটতে এসে দেখেন সর্বনাশ হয়ে গেছে। সেই রাতেই তিনি উন্মাদের মতো ছুটে যান হরিদত্ত’র প্রাসাদে, যদি প্রাণপ্রিয় ভাগিনেয়ীকে উদ্ধার করা যায়।

কিন্তু হরিদত্ত তাঁর প্রাসাদে মেয়েটির থাকার কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। এমনকী অস্বীকার করেন এই দুষ্কর্মে তাঁর বাহিনীর কারও লিপ্ত থাকার কথাও। তবে আশ্বাস দেন যে এই ব্যাপারে তিনি একটি তথ্যানুসন্ধানী সমিতি গঠন করবেন। তারা কন্যাটিকে উদ্ধার করার ব্যাপারে সম্পূর্ণ সহায়তা করবে।

আর সেই সমিতির সর্বময় কর্মকর্তা কাকে নিযুক্ত করা হল? হরিদত্ত’র ভৈরববাহিনীর প্রধান গিরিকিশোরকে!

বলা বাহুল্য মেয়েটির আর সন্ধান পাওয়া যায়নি। অনেক পরে জয়নাথ অত্যন্ত গোপনসূত্রে জেনেছিলেন সেই রাতে কর্মান্তবাসকের গূঢ়পুরুষপ্রধান আনন্দদত্ত হরিকেলনরেশের আতিথ্য স্বীকার করেছিলেন। মেয়েটিকে এনে তাঁকে উপঢৌকন দেওয়া হয়৷ সেই হতভাগিনীকে একাধিকবার ভোগ করার পর তার অচৈতন্য দেহটি গোপনে মেঘনার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

সেই থেকে জয়নাথ পুরোপুরি চুপ হয়ে যান। পদত্যাগ করার উপায় তাঁর ছিল না৷ সেক্ষেত্রে হরিদত্ত কিছুতেই এমন প্রভাবশালী শত্রুকে বেঁচে থাকতে দিতেন না। তিনি সু্যোগ খুঁজছিলেন প্রতিশোধ নেওয়ার।

আর সেই প্রতিশোধের সুবর্ণ সুযোগ এখন জয়নাথের সামনে এসেছে।

‘একজন আছেন যিনি বলতে পারেন৷’ স্তব্ধতা ভেঙে বলে উঠলেন চারুদত্ত, ‘কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছনো অসম্ভব।’

‘কে তিনি?’

‘সম্রাট বলভটের মৃত্যুর পর কে বঙ্গদেশের সম্রাট হন মনে আছে?’

‘মহারাজ ধর্মচন্দ্র।’

‘মহারাজ ধর্মচন্দ্রের কীভাবে মৃত্যু হয় জানেন?’

‘শুনেছি। বাকিটা অনুমান করতে পারি।’

‘মহারাজ ধর্মচন্দ্রের প্রথমা মহিষীর নাম কাঞ্চনাদেবী। তিনি স্বচক্ষে মহারাজের হত্যা দেখে ফেলেছিলেন। সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে তিনি পাগলিনী হয়ে যান।’

‘তাঁর তো কোনও সন্ধান নেই জানি। তিনি জীবিত না মৃত…’

‘তিনি বেঁচে আছেন কাহ্ন,’ সাগ্রহে এগিয়ে এলেন চারুদত্ত, ‘প্রকাশচন্দ্রের গুপ্ত কারাগারের নাম শুনেছ?’

‘শুনেছি আর্য। সে নাকি নরকবিশেষ।’

‘সম্পূর্ণ নির্ভুল শুনেছ। কাঞ্চনাদেবী সেই কারাগারে বন্দি আছেন বহুকাল। বাইরে কেতকদাস নামের যে রক্ষীটিকে দেখলে, এখানে আসার পূর্বে সেইই ছিল ওই কারাগারের রক্ষী। তার মুখে শুনেছি। এখনও বেঁচে আছেন সেই হতভাগিনী নারী। একবার যদি তাঁর কাছে পৌঁছতে পার, তবে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে। আমি নিশ্চিত, একমাত্র তিনিই অব্যর্থভাবে সন্ধান দিতে পারেন রাজ্ঞী এবং প্রকাশচন্দ্রের মৃত্যু উপায়ের।’

নিমেষে কাহ্নপা শিহরিত, ‘আপনি ঠিক বলছেন আর্য?’

‘অবশ্যই। মহারাজ ধর্মচন্দ্র’র মৃত্যুর পর উন্মাদবৎ কাঞ্চনাদেবীকে প্রথমে তাঁর কক্ষে অবরূদ্ধ রাখা হয়। কিন্তু সেখানে তিনি রাতদিন বিচিত্র এবং অসংলগ্ন কথা বলতেন। তার কিছু কিছু খুব কৌতূহলপ্রদ। যেমন, ‘আমি জানি ওই রাক্ষসী মরবে কী করে।’ অথবা, ‘নিজের ভাইকে মেরে পার পাবেন না প্রকাশচন্দ্র, আপনার মৃত্যুবাণ কোথায় রাখা আছে জানি।’

কাহ্নপা স্থিরনেত্রে তাকিয়ে রইলেন বৃদ্ধের দিকে।

‘এইভাবে চলতে চলতে একদিন কাঞ্চনাদেবী কক্ষের বাইরে বেরিয়ে এসে প্রকাশচন্দ্র আর রাজ্ঞীর উদ্দেশে উচ্চৈঃস্বরে গালমন্দ করতে থাকেন। সেইদিনই কাঞ্চনাদেবীকে কারাগারে বন্দি করা হয়। তবে জানি না তিনি এখনও জীবিত আছেন কি না।’

‘হুম। সেই কারাগারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা কঠিন হবে না। আমাদের মধ্যে কেউ স্বেচ্ছায় ধরা দিলেই তাকে মহাসমাদরে সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে আসা…’

‘কেউ আছে তোমাদের মধ্যে যিনি পারবেন এই কাজ? যিনি ওই নরকের ভেতরে প্রবেশ করতে পারবেন? কাঞ্চনাদেবীর কাছে পৌঁছতে পারবেন? যদি পৌঁছতে পারেন, তাহলে সেখান থেকে পালানোর উপায় আমি বলে দেব।’

বিস্মিত হলেন কাহ্ন, ‘কীরকম?’

‘ওই কারাগারের মধ্যে একটি অত্যন্ত গোপন সুড়ঙ্গ আছে, যার সন্ধান কেউ জানে না। কারণ যারা এই সুড়ঙ্গ বানিয়েছিল, তাদের কাউকেই আর বাঁচিয়ে রাখা হয়নি।’

উত্তরোত্তর আশ্চর্য হচ্ছিলেন কাহ্নপা। তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘কিন্ত সেই সুড়ঙ্গের সংবাদ আপনি জানলেন কী করে?

একটা কৌতুকের হাসি ছড়িয়ে পড়ল নবতিপর বৃদ্ধের মুখে, ‘কারণ ওই কারাগার সম্পূর্ণভাবে আমারই পরিকল্পনায় তৈরি।’

.

কমলাঙ্ক। কর্মান্তবাসকের পূর্ব উপকণ্ঠ।

ব্রাহ্মণবটুটি উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন গ্রামের সীমানায়। সীমানা বলতে ধানের খেত এবং গ্রামের প্রান্তবর্তী অরণ্যটির মধ্যবর্তী একটি সরু আল। অরণ্য বিশেষ সুবিধার নয়। বুনো মোষ ও শুকর তো আছেই, তার সঙ্গে আছে শিয়াল আর জংলী কুকুর। মাঝে মাঝে বাঘেরও দেখা পাওয়া যায়। প্রায়শই খাদ্যের সন্ধানে তারা হানা দেয় গ্রামের মধ্যে। দরিদ্র গ্রামবাসীর গোয়াল থেকে টেনে নিয়ে যায় গবাদি পশু৷ গ্রামের শেষে বাস করে দুর্ধর্ষ কিরাতজাতি৷ তারা ছাড়া এর অভ্যন্তরে প্রবেশ করার সাহস কারও নেই৷ গ্রামবাসীরা সভয়ে এবং সযত্নে এড়িয়ে চলে এই বনভূমিকে৷

অথচ তাঁকে এই মুহূর্তে এখানেই অপেক্ষা করতে হবে। কারণ লোকেশ্বর মৎস্যেন্দ্রনাথ চরমুখে সংবাদ পাঠিয়েছেন যে, তিনি আসছেন এই পথেই৷

সন্ধ্যা নেমে আসছে৷ গোধূলির স্বর্ণাভ আভায় পশ্চিমদিগন্ত রক্তমলিন। নীড়ে ফেরা পাখিদের কলকাকলিতে চারিদিক মুখরিত। এখন শরৎকাল। বাতাসে হিমের ভাব৷ ইতিমধ্যেই চারিদিকে নেমে এসেছে কুয়াশার আচ্ছাদন। ব্রাহ্মণ যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, তার থেকে বেশ কিছু দূরে অরণ্যের অন্যধারে অস্পৃশ্য কিরাতজাতির বাস। তারা বোধহয় আগুন জ্বালিয়ে আজকের শিকারলব্ধ পশুটির সৎকারে ব্যস্ত। সেই ধোঁয়ার রাশি বাতাসে ভর করে এদিকে ভেসে এসে কুহেলিজাল আরও ঘন করে তুলেছে। ইতিমধ্যেই গুল্মলতারাজির মধ্যে জ্বলে উঠতে শুরু করেছে জুনিপোকার দল। ঝিল্লীরবের সমবেত ঐকতান শুরু হতে চলেছে।

একটু চঞ্চল হয়ে উঠলেন ব্রাহ্মণ। কেউ যদি দেখে ফেলে, এই সময়ে তিনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন—তাহলে সর্বনাশ। সময় ভালো না। প্রকাশচন্দ্রের চরেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে সর্বত্র। চারিদিকে অবিশ্বাসের বাতাবরণ। কে কখন কার নাম স্থানীয় মাণ্ডলিক বা ভুক্তিপতির কানে তুলে দেবে, বলা দুষ্কর। প্রবাদে বলে ‘নৃপ কর্ণেন পশ্যতি,’—রাজা কান দিয়ে দেখেন। এখন বঙ্গদেশের ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ প্রতিটি ভূম্যধিকারী স্বক্ষেত্রে রাজা হয়ে বসেছেন। এবং তাঁরা আর কোনও রাজসুলভ গুণ আয়ত্ত করুন না করুন, এই ‘কানে দেখা’-র অভ্যাসটি সযত্নে আত্মীকৃত করেছেন। তাঁরা কিছু তলিয়ে ভাবেন না, অভিযোগের সম্ভাব্যতা-অসম্ভাব্যতা বিচার করেন না, সংবাদ শোনামাত্র ‘দোষী’র শাস্তিবিধান করেন।

ব্রাহ্মণটি তার উত্তরীয় অঙ্গে জড়িয়ে একটি শিমূলবৃক্ষের তলায় অন্ধকারে মিশে গেলেন।

সারা দেশে এখন ভয় এবং আতঙ্কের পরিস্থিতি। ঘরে ঘরে ধূমায়িত হচ্ছে তীব্র অসন্তোষ। দারিদ্র্যের জালে, করভারে নিষ্পেষিত সাধারণ মানুষ মাঝে মধ্যেই বিদ্রোহ এবং বিক্ষোভের পথ বেছে নিচ্ছেন। মাঝেমধ্যেই এখান ওখান থেকে রাজদ্রোহের সংবাদ পাওয়া যায়। প্রকাশচন্দ্রের সৈন্যসামন্তের দল সেগুলি নির্মমভাব দমন করে৷ যদি দণ্ডনায়কের কানে আসে, কোনও গ্রামে রাজদ্রোহের স্ফুলিঙ্গমাত্র দেখা দিয়েছে—তাহলে আর রক্ষা নেই। প্রকাশচন্দ্রের ঘাতকের দল ভীমবেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই গ্রামের নিরন্ন, অর্ধমৃত মানুষের উপর।

ইতিমধ্যেই সংবাদ এসেছে সমতটের তিনখানি গ্রাম, বজ্রিণীসার, মঠবাড়ি এবং জম্বুসর সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত। হরিকেলের ধীবররা একবার বিদ্রোহী হয়েছিল। তাদের প্রত্যেকটি পুরুষকে হত্যা করা হয়েছে। নারী ও শিশুদের দাসী হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে বিদেশী বণিকদের কাছে। হরিকেলের সমুদ্রোপকূলে এখন শ্মশানের স্তব্ধতা।

তবে এত করেও কি সব ক্ষোভ আর বিদ্রোহের আগুন নেভাতে পেরেছেন প্রকাশচন্দ্র? রাজক্ষমতার অপ্রতিহত প্রতাপ কি তাঁর শাসনকে নিরঙ্কুশ করতে পেরেছে? পারেনি।

বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলার সামাজিক ও ধর্মীয় জগতে এক নিঃশব্দ পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছিল৷ মহাযানপন্থার দিন বহুদিন আগেই গত। এখন সর্বত্র বজ্রযানের জয়জয়কার। নিরাকার বুদ্ধোপাসনার স্থান নিয়েছে আদিবুদ্ধ তথা পঞ্চস্কন্ধাধিপতি পঞ্চধ্যানীবুদ্ধের বিভিন্ন মূর্তিপূজা। ভিক্ষুর বদলে এখন গৃহী বৌদ্ধরা দলে ভারী।

তাদের বৌদ্ধশাস্ত্রপাঠে রুচি নেই, তার বদলে ধারণী ও মন্ত্রোচ্চারণে মুক্তির উপায় খোঁজে। শূন্যতা ও উপায়ের মিলনে নির্বাণ বোঝে না, মৈথুনক্রিয়ায় রত হয়ে যৌনসুখানুভূতিকেই নির্বাণসুখ বলে মনে করে। বিহারের বজ্রযানী অধ্যক্ষরা এখন গুরুর পদ অলঙ্কৃত করেছেন। গুরুর আদেশই এখন বৌদ্ধদের কাছে ধর্ম। তত্ত্বালোচনা নয়, দশকুশল নয়, পারমিতা নয়, শীল ও বিনয় পালন নয়; তাঁদের ধর্মাচরণের মূল সাধনা এখন হঠযোগ।

অধুনা বজ্রযানের বদলে বঙ্গদেশের বুকে মাথা তুলছে এক নবীন ধর্মমত। সহজযান। আশ্চর্যের বিষয় হল, এই মতের যাঁরা সিদ্ধপুরুষ বা আচার্য, তাঁরা কেউ কোনও বৌদ্ধ বিহারের ভিক্ষু বা সন্ন্যাসী নন। অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষ। কেউ কেউ আবার স্বেচ্ছায় রাজগৃহ বা উচ্চবিত্ত জীবন ছেড়ে মুক্তির খোঁজে নেমে এসেছেন পথের ধুলায়। এঁদের মধ্যে কেউ কৈবর্ত জালিক, কেউ বা ব্যাধ, কেউ আবার বারবণিতাগৃহের দ্বারপাল। এঁদের মধ্যে ভিক্ষুক আছেন, আছেন রজক, কৃষিজীবী, তন্তুবায়-কুবিন্দক, অথবা চর্মকার। এমনকি একজন ঠগও আছেন, সিদ্ধিলাভ করার আগে মানুষকে প্রবঞ্চনা করাই ছিল যাঁর পেশা!

অথচ এই সিদ্ধদের জনপ্রিয়তা অতি দ্রুত ক্রমবর্ধমান। এঁদের আচার-আচরণ অন্ত্যজ শ্রেণীর সমাজবিধির অনুকূল। মদ্য-মাংস-মৈথুন—কিছুতেই এঁদের বিরাগ নেই। ভদ্রসমাজের বাইরে ছায়ার মতো এঁদের গতিবিধি। এঁদের হদিশ পাওয়া দুষ্কর। মাছ যেমন জলের মধ্যে স্বচ্ছন্দ থাকে, এঁরাও সেভাবে মিশে থাকেন জনসাধারণের মধ্যে। প্রকাশচন্দ্রের চরেরা সংবাদ এনেছে—এঁরাই গোপনে গোপনে জনসাধারণকে উত্তেজিত করছেন, মন্ত্রণা দিচ্ছেন, সংগঠিত করছেন। আর তাঁদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন একজন শৈবযোগী। লোকেশ্বর মৎস্যেন্দ্রনাথ।

.

বিশ্বস্ত ঘাতকদের দিয়ে একটি বিশেষ বাহিনী নির্মাণ করেছেন প্রকাশচন্দ্র। এই বাহিনীর নাম ‘রাজসেবক।’ এদের একমাত্র কাজ হচ্ছে রাজদ্রোহীদের সন্ধান করে বেড়ানো। এদের অসাধ্য কিছু নেই। গুপ্তহত্যা থেকে শুরু করে অপহরণ, বিনা বিচারে কাউকে আটক করে রাখা, বন্দিদের ওপর অকথ্য, অবর্ণনীয় অত্যাচার করা, রাতের অন্ধকারে হানা দিয়ে গ্রামের পর গ্রাম ভস্মীভূত করা—এসবই এদের কাছে অতি-সাধারণ ব্যাপার। রাজসেবকবাহিনীর নাম শুনলেই সাধারণ বঙ্গবাসী ভয়ে থরথর কাঁপতে থাকে।

এত করেও নিশ্চিন্তে বসে নেই প্রকাশচন্দ্র ও তাঁর সঙ্গীসাথীরা। সম্পূর্ণ কর্মান্তবাসক মুড়ে ফেলা হয়েছে নিরাপত্তার নিশ্ছিদ্র আবরণে। নগরের সমস্ত বাণিজ্যকেন্দ্রগুলিতে কড়া প্রহরা। মন্দির থেকে শৌণ্ডিকালয়, বন্দর থেকে বারবধূগৃহ, সর্বত্র।

শিমূল গাছটির গায়ে হাত বোলালেন ব্রাহ্মণ। এই গাছটি তাঁর প্রায় সমবয়সি। এবার ধীরে ধীরে পরপারে যাওয়ার সময় এসেছে৷ মৃত্যুকে তিনি ভয় পান না। কিন্তু অসতর্কতার জন্য ধরা পড়ে গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হওয়াতে তাঁর আপত্তি আছে৷ পরমব্রহ্মে লীন হওয়ার আগে তাঁর কিছু কর্মের ঋণ রয়ে গেছে৷ সেটি শেষ না করে তিনি শান্তিতে মরতেও পারবেন না।

অরণ্য প্রান্ত থেকে কিছু ক্ষীণ শব্দ ভেসে এল। ব্রাহ্মণ সতর্কচোখে চারিদিক একবার দেখে নিয়ে দ্রুত এগোলেন শব্দের উৎসের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অরণ্যের ভেতর থেকে দুজন মানুষের অবয়ব স্পষ্ট হল৷ একজন মানুষ অন্য আরেকজনের ওপর ভর দিয়ে অতি কষ্টে হেঁটে আসছেন। প্রথম মানুষটি আহত, বিব্রতও বটে। তিনি বারবার ক্ষমা চাইছেন তাঁকে বয়ে-আনা দ্বিতীয় মানুষটির কাছে। কাতরস্বরে বলছেন, ‘আমি অত্যন্ত লজ্জিত, ভদ্র গোপালদেব। যদি না দেখতাম লক্ষ্মী অরণ্যের গভীরে পালিয়ে যাচ্ছে, তাহলে হয়তো আমি এইভাবে আহত হতাম না। এই অঞ্চল আমার মাতৃভূমি। আমার ডানহাতের রেখার মতই চেনা। সারাজীবন আমি এই অঞ্চলে গোরুর গাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে এসেছি। লোকেশ্বর সেই জন্যই আমাকে নির্বাচিত করেছিলেন এই কাজের জন্য। অথচ আমি এতই অপদার্থ যে এই সামান্য কাজটুকুও নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে পারলাম না…’

দ্বিতীয় পুরুষটি এসব প্রলাপে বিন্দুমাত্র বিচলিত হচ্ছিলেন না। দৃঢ় পদক্ষেপে বয়ে আনছিলেন প্রথমজনকে। আরও কাছাকাছি আসার পর দুজনকে ভালোভাবে দেখতে পেলেন ব্রাহ্মণ। আহত মানুষটি কিঞ্চিৎ স্থূলবপু। পরনে একটি হ্রস্ব অধোবাস, মালকোঁচাটি আঁটো করে কোমরে জড়ানো। অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গে কয়েকটি গভীর ক্ষত। সেখান থেকে নেমে এসেছে দরদর রক্তের ধারা। থরথর করে কাঁপছেন মানুষটি। কোনওমতে টেনে আনছেন তাঁর ডান পা’টি। সেটি সম্পূর্ণভাবে ক্ষতবিক্ষত৷ বোঝাই যাচ্ছে যে, কোনও এক বন্য জন্তুর আক্রমণে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটি।

তবে ব্রাহ্মণের মনোযোগ অন্য মানুষটি।

ইনি উচ্চতায় প্রথমজনের তুলনায় অনেকখানি দীঘল। টানটান নির্মেদ শরীর। বক্ষটি বটবৃক্ষের মতো প্রশস্ত ও সবল। দুই বাহুতে অমিত বলের আভাস। কুঞ্চিত কেশদাম নেমে এসেছে ঘাড় পর্যন্ত। শান্ত ও গভীর চক্ষু। তিনি শান্তস্বরে প্রবোধ দিচ্ছিলেন আহত সঙ্গীকে, ‘আপনার বিব্রত হওয়ার কোনও কারণ নেই ভাই সুদাস। আমরা তো জেনেশুনেই এই শ্বাপদসঙ্কুল অরন্যের পথ বেছে নিয়েছিলাম, যাতে শত্রুপক্ষের চোখ এড়ানো যায়৷ আমরা তো এও জানতাম যে এ পথে হিংস্র বন্যজন্তুদের আক্রমণের আশঙ্কা আছে। আপনি নিজেকে দোষী ভাবছেন কেন?’

আহত মানুষটি কাতরে উঠলেন, ‘আপনার যদি কিছু হয়ে যেত আর্য? আমি লোকেশ্বরকে মুখ দেখাতাম কী করে?’

‘কিছু হলে হতো৷ আমরা যেদিন এই পথ বেছে নিয়েছি, সেদিনই তো আমাদের ভাগ্য স্থির হয়ে গেছে সুদাস। আমরা তো জানি যে পদে পদে বিপদের আশঙ্কা নিয়েই আমাদের চলতে হবে৷ আপনি এত বিচলিত হবেন না। যেটুকু দুর্ভোগ ভাগ্যে লেখা ছিল, তাই হয়েছে। আমরা তো দেবী চণ্ডীর আশীর্বাদে জীবিত রয়েছি। আমরা তো শেষ পর্যন্ত সক্ষম হয়েছি এই অরণ্য অতিক্রম করতে।’

‘আমার গাই দুটি…ও হো হো হো…তাদের আমি নিজের সন্তানের মতো দেখতাম যে আর্য। ওরে ধবলী, ওরে লক্ষ্মী…’ চাপাস্বরে ডুকরে উঠলেন আহত মানুষটি। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে তিনি এখনও অপ্রকৃতিস্থ৷

এইবার ব্রাহ্মণ এগিয়ে এসে তাঁদের গতিরোধ করে দাঁড়ালেন। প্রথম পুরুষটি থমকালেন মুহূর্তের জন্য। তারপরেই কোন এক অলৌকিক উপায়ে তাঁর হাতে উঠে এল একটি মস্ত খড়গ। হিসহিসে স্বরে প্রশ্ন করলেন সেই বলশালী পুরুষ, ‘কে আপনি? পরিচয় দিন।’

ব্রাহ্মণ শান্তস্বরে বললেন, ‘অধমের নাম কান্তিপ্রভ।’

প্রথম পুরুষটি বললেন, ‘সূত্র উচ্চারণ করুন।’

ব্রাহ্মণ উচ্চারণ করলেন, ‘কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল।’

পুরুষটি প্রত্যুত্তর করলেন, ‘চঞ্চল চীএ পইঠো কাল।’ বলে খড়্গটি নামিয়ে রাখলেন। তাঁর পথশ্রমে ক্লান্ত মুখখানিতে জ্বলে উঠল আনন্দের আলো। হাসিমুখে বললেন, ‘প্রণাম ব্রাহ্মণদেব। আমি ব্যপটপুত্র গোপাল। অস্ত্রচালনার জন্য মার্জনা করবেন।’

কান্তিপ্রভ স্মিতহাস্যে বললেন, ‘মার্জনাভিক্ষার প্রয়োজন নেই। এই সামান্য সতর্কতাটুকু না নিলে তো লোকেশ্বর-প্রেরিত নায়কের বোধ বিবেচনার প্রতি আমার বিশ্বাস টলে যেত মশাই।’

‘লোকেশ্বরের প্রেরিত নায়কের ওপর বিপুল আস্থা রেখেছেন দেখছি।’

‘তিনি মহাযোগী। স্বয়ং আদিদেব শিবের অবতার। নায়ক নির্বাচনে তাঁর ভুল হতে পারে না।’

‘লোকেশ্বরও কিন্তু আপনার ওপর অনেক ভরসা করেন, আর্য। আপনার ব্যাপারে তিনি অনেক কিছুই বলেছেন আমাকে।’

কান্তিপ্রভ সহাস্যে বললেন, ‘আশা করি কটু কিছু বলেননি।’

হাসলেন গোপাল, ‘কটু বলে কটু? সেসব ভয়ানক বাক্য শুনলে যে লজ্জায় আপনার কর্ণমূল রক্তবর্ণ ধারণ করবে।’

‘বুঝেছি!’—ছদ্মদুঃখে মুখখানি করুণ করলেন কান্তিপ্রভ,’ লোকমুখে এও শুনেছি তিনি আমাকে শ্যালক বলে সম্বোধন করেন। দুঃখের বিষয় মহাযোগীর কোনও গৃহিনীও নেই যে নিজেকে সেই মহিয়সীর সহোদর কল্পনা করে আহ্লাদিত বোধ করব।’

হাসতে লাগলেন গোপাল, ‘পিতা এবং লোকেশ্বর আপনার পরিহাসপ্রিয়তার কথা বলেছিলেন বটে। আপনার সঙ্গে আলাপিত হয়ে সুখী বোধ করছি আর্য কান্তিপ্রভ।’

‘সে তো বুঝলাম। কিন্তু আপনার সঙ্গীটি কে? ইনি এমন ভয়ানক আহত হলেন কী করে?’

আহত ব্যক্তিটি কোনওমতে হাত দুখানি জড়ো করে অভিবাদন করলেন। ক্লিষ্টস্বরে বললেন, ‘অধমের নাম সুদাস, জাতিতে গোয়ালা। পেশা গরুর গাড়ি চালানো।’

ভ্রুকুঞ্চিত করলেন কান্তিপ্রভ, ‘কোন গ্রাম?’

‘আজ্ঞে অধমের নিবাস তারাপুকুর গ্রামে।’

‘বুঝলাম। এই অবস্থা হল কী করে?’

সুদাস এবং গোপাল দুজনেই তাঁদের যাত্রার কাহিনি বিবৃত করলেন।

লোকেশ্বরের পরিকল্পনা অনুযায়ী আসন্ন অভ্যুত্থানের নায়কেরা বিভিন্ন দিক থেকে কর্মান্তবাসকে প্রবেশ করা শুরু করেছেন। শাক্যপ্রভ, হরিপ্রভ এবং ঢেণ্ঢনপা প্রবেশ করবেন হরিকেলের প্রান্ত থেকে। বঙ্গভূমির মতো হরিকেলও এখন চন্দ্রবংশের পদানত। সেখানকার সামন্ত নৃশংস, লম্পট হরিদত্ত। হরিদত্তর মহামাত্য জয়নাথ গোপনে গোপনে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তিনিই স্বীকৃত হয়েছেন এই গোপনকর্মে সহায়তা করতে। কম্বলপা এবং জলন্ধরনাথ বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর বেশে প্রবেশ করবেন কর্মান্তবাসকে। পদ্মসম্ভব এবং ভিক্ষুণী মন্দর্ভা সর্বাণীমন্দিরের তীর্থিক সেজে প্রবেশ করবেন উত্তর দিক থেকে, সুবর্ণগ্রাম হয়ে বিক্রমপুরের পথে। আর পূর্বদিক থেকে প্রবেশ করবেন গোপালদেব। অভ্যুত্থানের প্রধান দুই কুশীলব, আচার্য মৎস্যেন্দ্রনাথ আর বপ্যট কোথা থেকে কীভাবে কর্মান্তবাসকে আসবেন সে তথ্য কারো কাছে নেই। সমগ্র পরিকল্পনা গোপনীয়তার আবরণে গুপ্ত। কেউ জানেন না অন্য দল কী করবে। শুধুমাত্র মৎস্যেন্দ্রনাথ জানেন কখন কোথায় কীভাবে কী হবে। তাঁর গোপন চরেরা সংবাদ পৌঁছে দেয় এখান থেকে ওখানে।

কর্ণসুবর্ণ অবধি পৌঁছতে তাঁদের বিশেষ কষ্ট করতে হয়নি। সেখান থেকে তাঁরা বণিকের বেশে ত্রিবেণী হয়ে আসেন জাহোরের অরণ্য অবধি। এরপর থেকেই চন্দ্রবংশের শাসন শুরু৷ এই অরণ্য অতিক্রম করা তাঁদের পরিকল্পনার মধ্যেই ছিল। তার কারণ দুটি। প্রথম কারণ যদি হয় প্রকাশচন্দ্রের সৈন্যদের দৃষ্টি এড়ানো, তবে দ্বিতীয় কারণ এই যে, অরণ্যের মধ্যবর্তী পথটি অন্য পথের তুলনায় দুর্গম হলেও সংক্ষিপ্ত। সুদাস একদা এই অঞ্চলের সবচাইতে দক্ষ গোশকট-চালক ছিল। সেইজন্যই তাকে নির্বাচন করা।

দেড়দিনের যাত্রাপথের প্রথমদিন নির্বিঘ্নেই কেটে যায়। বিপদ হয় দ্বিতীয় দিনে এসে। দুজনে যখন কমলাঙ্ক থেকে কয়েক যোজন দূরে, তখন অতর্কিতে তাঁদের ওপর আক্রমণ করে একটি বাঘ। সমুদ্রতীরবর্তী উপবঙ্গের বনাঞ্চল এখান থেকে বেশি দূরে নয়। সেখান থেকে দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাঘেদের উপদ্রব আছেই। কিন্তু সচরাচর তারা মানুষ এড়িয়ে চলে। এই শার্দূল মহাশয় বোধহয় বৃদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। তাই দুটি নধর গাভী এবং মনুষ্যসন্তান দেখে লোভ সংবরণ করতে পারেননি।

কান্তিপ্রভ শিহরিত হলেন, ‘হা ঈশ্বর! তারপর? তারপর কী হল?’

চুপ করে রইলেন গোপাল। সুদাস যুক্তকর মাথায় ঠেকালেন। ‘দীর্ঘদিন ধরে কমলাঙ্ক গ্রামের দণ্ডনায়ক দিবোদাসের গোয়ালে কাজ করেছি। বীর কিছু কম দেখিনি। কিন্তু বপ্যটপুত্র গোপালদেবের মতো বীর আর কাউকে দেখিনি আজ অবধি।

বাঘটি ধবলীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে আমরা গাড়ি থেকে ছিটকে পড়ে যাই। উঠতে আমাদের একটু সময় লাগে। উঠে দেখি তার মধ্যেই ধবলীর ঘাড় ভেঙে তাকে জঙ্গলের মধ্যে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে বিশালদেহী জন্তুটা। তার মস্ত হাঁড়ির মতো মুখ, বন কাঁপানো হুঙ্কার আর উৎকট গন্ধে আমি প্রায় মূর্ছা যাই আর কি। কিন্তু গোপালদেব তার মধ্যেই কোমর থেকে একটি আধ হাত লম্বা ছুরি বার করে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সেই বুড়ো বাঘটির ওপর।’

মুখখানি হাঁ হয়ে গেল কান্তিপ্রভর। শুধু ছুরি হাতে ক্ষুধার্ত বাঘের মুখে এইভাবে রুখে দাঁড়ানো সম্ভব?

‘তখন আমিও সাহস করে উঠে একটি কুড়াল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম জন্তুটার ওপর। ইতিমধ্যে লক্ষ্মীও মুক্ত হয়েছে তার বাঁধন থেকে। ভয় পেয়ে সে পালিয়ে গেল অরণ্যের আরও গভীরে। আমি সেদিকে যাওয়ার চেষ্টা করতেই বাঘটা ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। প্রথমেই থাবা বসাল আমার ডান পায়ের ওপর। আমি কিন্তু তখনও লড়ে যাচ্ছি। গোপালদেব বাঘটার পিঠের ওপর বসে একের পর এক ছুরিকাঘাত করে যাচ্ছেন তার গলায় এবং মুখে। শেষে একটি মোক্ষম আঘাতে ছুরিটি ঢুকে যায় বাঘটির চোখে। তারপরেই সে ভীষণ আর্তনাদে আমাকে ছেড়ে অরণ্যের মধ্যে ছুটে পালায়।’

‘গোপালদেবই আমাকে উদ্ধার করেন। তখনও একটু দূর থেকে বাঘের মরণ-আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদে আমি সামান্য সুস্থ হলে দুজনে গিয়ে দেখি—একটি অশ্বত্থ গাছের নীচে সেই বুড়ো বাঘের মৃতদেহ পড়ে আছে।’

স্খলিতস্বরে কান্তিপ্রভ বললেন, ‘অবিশ্বাস্য! সামান্য ছুরি হাতে বাঘ শিকার?’

সুদাস ওই অবস্থাতেই বিচলিত এবং গদগদসুরে বললেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। বীর গোপালদেব কেবলমাত্র একটি ছুরি হাতে পূর্ণবয়স্ক বাঘকে শিকার করেছেন, এই অবিশ্বাস্য অকল্পনীয় বীরগাথা আমি ভুলব না।’

অভিভূত হলেন কান্তিপ্রভ। প্রশ্ন করলেন, ‘আর্য গোপালদেব, একটি কথা বলুন। আপনি তো জানতেন যে আপনি একটি মহৎ কর্মের জন্য উদ্দিষ্ট। যদি দুটি গাভী আর একটি মানুষকে হিংস্র বন্য জন্তুর আক্রমণ থেকে বাঁচাতে গিয়ে আপনি মৃত্যুবরণ করতেন? তাহলে কী হতো?’

গোপালদেবের শান্ত চক্ষুদুখানি ধ্বক জ্বলে উঠল। বললেন, ‘এর উত্তর আমার সাধ্যের বাইরে আর্য কান্তিপ্রভ। আপনি বরং এই প্রশ্নের উত্তর দিন, বাহিনীর সেরা নায়ক কি শুধুমাত্র চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্যই নির্দিষ্ট? এ কী চতুরঙ্গ ক্রীড়া যে রাজা ও রানিকে সবচেয়ে সুরক্ষিত রাখা হবে শেষ যুদ্ধকৌশলের জন্য? রাজা কি নায়কের ভূমিকা পালন করেন শুধুমাত্র রাজাসনে বসার জন্য? যে নায়ক সামান্য বন্য জন্তুর থেকে তাঁর অনুগত প্রজাদের রক্ষা করতে পারেন না, তিনি কীসের রাজা? তিনি কীসের নায়ক? যে রাজা তাঁর দরিদ্রতম, নির্বলতম, অসহায়তম প্রজার জীবনরক্ষার্থে নিজের জীবন বাজি রাখতে পারেন না, তিনি কীসের প্রজাপালক? আমি মরলে মরব, এক গোপালের বদলে সহস্র গোপাল আসবে। মৎস্যেন্দ্রনাথ আমার মতো সহস্র গোপালদেব সৃষ্টি করতে পারেন। কিন্তু আজ আমি যদি প্রাণভয়ে কর্তব্যপালনে বিমুখ হই, তাহলে বলতে হয়—মহর্ষি মৎস্যেন্দ্রনাথ ভুল মানুষে আস্থা রেখেছেন। তাঁর সামনে দাঁড়াব কোন মুখে?’

কান্তিপ্রভ এর উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই কিরাত জনবসতি থেকে মহা হট্টগোলের শব্দ ভেসে এলো। সকলে সচকিতে হয়ে সেদিকে তাকালেন। ইতিমধ্যেই সেদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার আকাশ ছেয়ে ফেলেছে আগুনের লেলিহান শিখা আর কালো ধোঁয়া। ভেসে আসছে মানুষের আর্তনাদ।

কান্তিপ্রভ দাঁতে দাঁত ঘষলেন, ‘গর্ভস্রাবের দল কি এই হতদরিদ্র কিরাতদেরও রেহাই দেবে না?’

শাস্ত্রাধ্যায়ী ব্রাহ্মণের মুখে অশ্লীল কুবাক্য শুনে সামান্য থমকে গেলেন গোপালদেব। উদ্বিগ্নস্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘কী হয়েছে আর্য?’

কান্তিপ্রভ চাপা অথচ উত্তেজিত স্বরে বললেন, ‘খুব সম্ভবত প্রকাশচন্দ্রের অনুগত রাজসেবকবাহিনী এসেছে। এই আর্তনাদ তাদেরই জয়নির্ঘোষ, গোপাল।’

‘সে কী? হঠাৎ অসহায় বনচারী কিরাতদের ওপর আক্রমণের কারণ? এদের তো না আছে ধনসম্পদ, না আছে কর্ষণযোগ্য ভূমি।’

‘আর কিছু না থাক, নারীসম্পদ তো আছে।’

‘নারী? কিরাত-নারী লুণ্ঠনের উদ্দেশে এই অভিযান? কিন্তু কেন?’

‘আহুতির জন্য আর্য গোপাল। প্রকাশচন্দ্রের প্রবর্তিত নতুন ধর্মটির জন্য প্রয়োজন নিত্য আহুতি। এই আর্তনাদ সেই যজ্ঞের আহুতি।’

‘নতুন ধর্ম? যজ্ঞ? আহুতি? এসব কী বলছেন আর্য কান্তিপ্রভ?’ বিস্মিতস্বরে প্রশ্ন করলেন গোপালদেব।

তীব্র ঘৃণা মিশিয়ে উচ্চারণ করলেন কান্তিপ্রভ, ‘তিব্বতীয় পোন ধর্মের কড়াইতে আদিম লৌকিক ধর্ম আর নবোত্থিত বজ্রযানী বৌদ্ধধর্ম মিশ্রিত করে এক অপূর্ব ধর্ম প্রস্তুত করেছেন প্রকাশচন্দ্র। তার নাম নাকি নব্য তন্ত্রধর্ম। অধুনা আবিষ্কৃত ক্রিয়াটির তারা নাম রেখেছে স্বয়ং মহামায়া’র নামে, ভৈরবীচক্র। এই চক্রে বহু নারী-পুরুষ একত্রিত হয়ে মদ্য মাংস মৎস্য আহার করে, তারপর বিচিত্র মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে একটি ভয়ঙ্কর কর্মে লিপ্ত হয়।’

‘কী সেটি?’

‘যৌথযৌনসঙ্গম।’

স্তম্ভিত হলেন গোপালদেব, ‘বলেন কী আর্য কান্তিপ্রভ!’

‘হ্যাঁ৷ শুধু তাই নয়, চক্রপ্রবর্তকদের মতে, বলতেও ঘৃণাবোধ হয়, এই চক্রে নাকি মাতা বা ভগিনীর সঙ্গে যৌনসঙ্গমও স্বীকৃত!’

অসহ্য! সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল গোপালদেবের।

‘শুধু তাই? চক্রমধ্যে পুরুষ মাত্রেই নাকি স্বয়ং দেবাদিদেব শিবশম্ভু, নারীমাত্রেই নাকি স্বয়ং ভগবতী। তাই এই চক্রে জাতিবিচার নেই। এই যৌথযৌনচক্রে সবাই ব্রাহ্মণজাতি। এই পাপকর্মে যুক্ত হওয়ার জন্য প্রকাশচন্দ্র বহুবিধ বিট নিয়োগ করেছেন। তাদের কাজই হচ্ছে কুমারী কন্যা বা কূলবধূদের এই পথে টেনে আনা।’

‘কিন্তু কুমারী কন্যা বা কূলবধূরা এই অশ্লীল প্রস্তাবে সম্মত হয় বা কেন?’

ক্লান্ত হাসি খেলে গেল কান্তিপ্রভর মুখে, ‘কারণ স্বয়ং রাজা যে প্রথাকে আচরণীয় ধর্ম বলে ঘোষণা করেন, প্রজারাও সেই ধর্মেরই অনুশাসন মেনে চলে৷ প্রকাশচন্দ্র ঘোষণা করেছেন—মদ্যমাংস আহারই শীল৷ মৈথুনেই মোক্ষ। লাম্পট্যই পরমার্থ। এই নবোদিত তন্ত্রধর্মে ক্রিয়াকর্মে নিজের গৃহলক্ষ্মীদের উৎসর্গ করা নাকি মহাপুণ্যকর্ম। কুমারী কন্যা হলে তো কথাই নেই।’

আশ্চর্য হলেন গোপালদেব, ‘রাজা ভ্রান্ত হতে পারেন, ধর্মনীতি ভ্রান্ত হতে পারে। কিন্তু মানুষের নীতিবোধ? সাধারণের ঔচিত্য-অনৌচিত্যবোধও কি বিলুপ্ত?’

‘নীতি? অনুশাসন? শৃঙ্খলা? ঔচিত্যবোধ? সেসব অনেকদিন আগেই বঙ্গভূমি ত্যাগ করেছে আর্য গোপালদেব৷’

তবুও সংশয় যায় না গোপালদেবের, ‘কিন্তু বঙ্গদেশের মায়েরা, বধূরা এই অনাচার সহ্য করছেন?’

‘অন্ন আর্য, অন্ন। অন্নচিন্তা চমৎকারা। অন্নই সেই মহতী আকর্ষণ, যার জন্য সদ্বংশের রমণীরাও আজ এই পাপপথে পা বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। অন্নাভাবে ক্লিষ্ট বঙ্গজনকে দেখুন। মা হয়ে এক নারী কীভাবে চোখের সামনে নিজের সন্তানকে অনাহারে মরতে দিতে পারে? কীভাবে পারে তার পিতা, তার মাতা, তার সহোদরকে ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করতে দেখতে? আর যাঁরা এখনও সে পাপকর্মে লিপ্ত হননি, তাঁদের জন্য রয়েছে ওই ওরা, চন্দ্ররাজের পালিত সারমেয় শাবকদের দল।’

গোপাল একবার স্থিরচোখে তাকালেন কান্তিপ্রভ’র দিকে, আরেকবার কিরাতপল্লীর দিকে। তারপর সুদাসকে সেই শিমূলবৃক্ষতলে সযত্নে স্থাপন করে বললেন, ‘সুদাস, কিঞ্চিৎ বিশ্রাম নিন। মনে হচ্ছে সারমেয় বিতাড়নে না নামলেই নয়।’

.

রাজপ্রাসাদের পূর্ব ও দক্ষিণ প্রান্ত জুড়ে অবস্থিত এই ঘরটি রানির শয়নকক্ষ। আকারে এবং সাজসজ্জায় এটিই রাজপ্রাসাদের উৎকৃষ্টতম ঘর। কক্ষের দেওয়াল জুড়ে কয়েকটি বড় বড় বাতায়ন৷ সেই পথে ভেসে-আসা বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে উজ্জ্বল রঙের দুর্মূল্য চীনাংশুকের পর্দা।

ঘরের চারকোণে চারটি কাঠের ত্রিপদী৷ তাদের উপর কাঁসার জলাধার৷ সেই জলে ভাসছে কিছু আধফোটা পদ্মকুঁড়ি। জলাধারের জলে মিশ্রিত কর্পূর ও চন্দনের সুগন্ধ ঘরটিকে মোহময় আবেশে পূর্ণ করে রেখেছে।

ঘরের ভূমিটি মৃগচর্মের চিত্রকম্বলে আবৃত। তার ওপর পা ফেলামাত্র গোড়ালি অবধি ডুবে যায়, এমনই নরম। দেওয়ালগুলি বিভিন্ন লতাপাতা, ফুল, পশুপ্রাণী এবং মানুষ মানুষীর চিত্রে সজ্জিত। চিত্রগুলি ভালো করে দেখলে বোঝা যায়, তার অধিকাংশই কামকলা বিষয়ক।

ঘরের মধ্যে আলোর উৎস হচ্ছে ঘরের চার কোণে রাখা চারটি বড় দীপদান। তার ওপর সোনার প্রদীপ জ্বলছে। প্রদীপের ঘিয়ের মধ্যে ডুবিয়ে রাখা আছে কিছু শুষ্ক গুল্মলতা। মিষ্ট ও স্নিগ্ধ আঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে ঘরটির বাতাসে।

 উত্তর পশ্চিম কোণে একটি অলিন্দ। তার ছাদ থেকে ঝুলছে একটি সোনার খাঁচা। খাঁচাটি আপাতত শূন্য। মৃদুমন্দ হাওয়ায় সেটি দুলছে। সেই শূন্য সোনার খাঁচাটি ঘিরে, অলিন্দটি ঘিরে, ঘরের সুমিষ্ট বাতাস মথিত করে স্তব্ধ চরাচর ভেসে যাচ্ছে আজ রাত্রের এই অবারিত পূর্ণিমা জোৎস্নায়।

সময় রাত্রির তৃতীয় প্রহর। ঘরটির ঠিক মধ্যস্থানে অতি মহার্ঘ চন্দনপালঙ্ক পাতা। তার উপরে আরামপ্রদ সুখশয্যা। সেই সুখশয্যার উপর দুখানি নগ্ন শরীর পরস্পরকে জড়িয়ে রয়েছে। তাদের তীব্র আশ্লেষবন্ধনে বিচিত্র শব্দ ভেসে আসছে। চুম্বন ও শীৎকারের শব্দে ঘরের বাতাস মদমত্ত। পালঙ্কের দুপাশে দুজন কিঙ্করী বিশাল চামর হাতে ব্যজনে ব্যাপৃত।

যিনি নারী, তাঁর অঙ্গসৌষ্ঠব অতুলনীয়। গাত্রবর্ণ তপ্তকাঞ্চনতুল্য। গ্রীবাদেশ অতি মনোহর। স্তন পীনোন্নত৷ ঝরনার মতো কেশদাম তাঁর ক্ষীণকটি অবধি বিস্তৃত। সামান্য তির্যক চক্ষু দুখানি বড়ই চঞ্চল, কটাক্ষমাত্রে শিকারের প্রতি কামশর নিক্ষিপ্ত হয়। নাসিকাটি ইষৎ খর্ব। পত্রল ওষ্ঠ দুটি রক্তরাগরঞ্জিত। বাম অধরোষ্ঠে একটি ক্ষুদ্র তিল।

পুরুষটির গায়ের রঙ ঘোর কৃষ্ণ। পেশিবহুল দেহ৷ চোখদুটি স্থূল এবং কামাতুর। পুরুষটি তাঁর স্থূল ওষ্ঠ দিয়ে নারীটির কোমল গ্রীবাদেশ চুম্বনরত। তাঁর বলিষ্ঠ বাহুদুটি নারীটির দেবভোগ্য দেহখানি সবলে আলিঙ্গন করে আছে।

রানি ঈষৎ স্খলিতস্বরে বললেন, ‘অতি উত্তম। আশা করি আপনিই আমাকে যথাযথ তৃপ্তি দিতে পারবেন। কী বলেন, নাগর?’

পুরুষটি অপরিমিত পৈষ্ঠীপানে কিঞ্চিৎ বেপথু ছিলেন। তিনি তাঁর বামহাত দিয়ে নারীটির গণ্ডদেশ দৃঢ়ভাবে ধারণ করে বললেন, ‘পারব বইকি, রানি! আপনাকে তৃপ্ত করা কি যে সে পুরুষের কর্ম? আমি পৌণ্ড্রের বণিজপ্রধান বিমানবিহারীর পুত্র অনঙ্গমিত্র৷ আমি পারব না তো কে পারবে?’

নারীটির তির্যক চক্ষুদুটি সামান্য বক্র হল। পুরুষটি সেটি লক্ষ করলেন না। তিনি একজন দাসীকে ইঙ্গিত করলেন ঘরের এককোণে রাখা সুগন্ধী তাম্বুলকলঞ্জটি এনে দিতে। তারপর তাম্বুলকলঞ্জ হাতে পরম সুখাবেশে শয্যায় লম্বমান হলেন। সুগন্ধী তাম্বুলে ঘরের বাতাস আর্দ্র হয়ে উঠল। আরেক দাসী পানীয়ের পাত্র রানির হাতে এনে দিল।

রানি পানীয় এক গণ্ডূষে নিঃশেষ করে কিছুক্ষণ মুখখানি বিকৃত করে রইলেন। কিছু পরে অন্ধকারের মধ্যেও তাঁর চক্ষুদুটি জ্বলে উঠল। সামান্য মদানসস্বরে বললেন, ‘সে না হয় বুঝলাম৷ কিন্তু মহাশয়ের পৌরুষ এখনও এত শিথিল কেন?’

দাসীদুটি যান্ত্রিকস্বরে হেসে উঠল। সেই হাসি শুনে পুরুষটির অভিমান আহত হল। তিনি নারীর কেশ আকর্ষণ করে তাঁর ওষ্ঠদ্বয় নিজের ওষ্ঠপ্রান্তে নিয়ে এলেন৷ তারপর রানির ওষ্ঠচুম্বন করতে করতে কামতাড়িত স্বরে বললেন,’ ‘চুম্বন করতে থাক রে বহুগামী রণ্ডা। চুম্বনস্পর্শ ব্যতীত কি পৌরুষ জাগে রে? আজ ভালো আমায় তৃপ্ত কর৷ কাল প্রত্যুষে আমি বঙ্গদেশের সম্রাট হব। তুই হবি আমার সাম্রাজ্ঞী, বঙ্গবিজেতা অনঙ্গমিত্রর প্রধানা মহিষী।’

মুহূর্তের মধ্যে জ্বলে উঠল নারীটির চোখ। তবে সে মুহূর্তের জন্যই। অনঙ্গ খেয়াল করলেন না৷

চুম্বনের সময় পুরুষটির সামান্য অস্বস্তি হতে লাগল। তবে তার কারণটি তিনি ঠিক অনুধাবন করতে পারলেন না। একবার তাঁর মনে হল—একটি নয়, দুই জিহ্বা তাঁর ওষ্ঠ লেহন করছে৷ তিনি নেশাতুরস্বরে বললেন, ‘জানি তুই অনেক পুরুষের অঙ্কশায়িনী হয়েছিস৷ কিন্তু আজ থেকে সেসব বন্ধ করতে হবে৷ আর হ্যাঁ, অভিষেকের সময় আমার পিতা-পিতৃব্যরা উপস্থিত থাকবেন৷’

রানি সর্পিল গতিতে উঠে এলেন পুরুষটির ওপর। তারপর নিজের মধ্যে অনঙ্গের পৌরুষ প্রোথিত করে স্খলিত কণ্ঠে বললেন, ‘অবশ্যই আর্য। আপনি আমার প্রভু, আমি আপনার দাসী। এই নারী, এই রাজপ্রাসাদ, অগণিত দাসদাসী, এই বিস্তীর্ণ বঙ্গদেশ আপনার ভোগ্য। আসুন প্রভু, আমাকে গ্রহণ করুন।’

নারীটি কয়েকবার নিতম্ব চালনা করতেই পুরুষটির কামাগ্নি আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরিত হল।

পরম আবেশে কিছুক্ষণ তীব্র অনঙ্গসুখ উপভোগ করেছিলেন অনঙ্গ। আঃ, এই তো পরম সুখ৷

নাহ্, এইবার আসন পরিবর্তন করা উচিত। মহর্ষি বাৎস্যায়ন তো অনেক আসনেরই সন্ধান দিয়ে গেছেন।

অনঙ্গমিত্র দুই হাত দিয়ে রানির নিতম্ব নিষ্পেষণ করতে গেলেন। কিন্তু তার আগেই নারীর পদ্মের ডাঁটার মতো বাম হাতটি তাঁর দুই বলিষ্ঠ বাহু ধরে ফেলল।

নিজের দুই হাত মুক্ত করতে গিয়ে অনঙ্গমিত্র আশ্চর্যের সঙ্গে আবিষ্কার করলেন যে, তিনি হাত নাড়াতে পারছেন না। আবার চেষ্টা করলেন৷ পারলেন না।

আশ্চর্য হলেন অনঙ্গমিত্র। তিনি কম বলশালী নন। নিয়মিত দৈহিক অনুশীলন করে থাকেন। সন্তরণে, নৌচালনায়, মল্লযুদ্ধে সত্যব্রতর সমকক্ষ যুবক পুণ্ড্রবর্ধনে কমই আছেন। তবুও এই মদালসা রমণী একটিমাত্র হাতে তাঁর দুটি বলশালী বাহু এমন ভাবে ধরে রেখেছে যে, তিনি তাঁর হাত দুটি মুক্ত করতে পারছেন না? এত শক্তি ধরে এই নারী?

সহসা তিনি এক ঝটকায় নিজেকে মুক্ত করে উঠে বসতে গেলেন। কিন্তু সবিস্ময়ে আবিষ্কার করলেন যে তিনি তাও পারছেন না। তাঁর দেহের নিম্নাংশ এখন সেই লৌহকঠিন উরুস্তম্ভের মধ্যে বদ্ধ! তাহলে কি বিশাখসেনের কথাই সত্য? এ কি ইন্দ্রজাল? না মায়া?

বিমানবিহারীর বয়স হয়েছে অনেক। তাঁর বাণিজ্যের অধিকাংশ দায়িত্ব এখন জ্যেষ্ঠপুত্র অনঙ্গমিত্রর উপর ন্যস্ত। সেই সূত্রেই তিনি এসেছিলেন কর্মান্তবাসকে। অধিকাংশ শ্রেষ্ঠীদের মতো এই দেশের শৌল্কিক, গৌল্মিক, মহামাণ্ডলিক, ভুক্তিপতি আদি সমস্ত প্রধান রাজকর্মচারীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অতি সুমধুর। কর্মান্তবাসকের বর্তমান ভুক্তিপতি হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী অমিতাভভট্ট। কর্মান্তবাসকে চিরকাল প্রধানমন্ত্রীই পদাধিকার বলে রাজধানীর ভুক্তিপতি হয়ে এসেছেন৷ ইনি স্বভাবে নাট্যমোদী এবং কাব্যপ্রেমী। অনঙ্গমিত্রকে সেইজন্য অশ্বঘোষ, কালিদাস, বাণভট্ট, ভাস, ভারবী থেকে শুরু করে বিশাখদত্তর কাব্য অবধি কণ্ঠস্থ করতে হয়েছে। কী আর করা যাবে, যে পূজার যা উপচার! বঙ্গীয় রাজপদোপজীবিদের অধিকাংশই সরাসরি উৎকোচ গ্রহণ করেন, মুদ্রায় অথবা দ্রব্যে। তবে অমিতাভট্টর মতো কিছু রাজন্যকে সংস্কৃতিশাস্ত্রে পূজা করতে হয়। তবেই তাঁরা প্রসন্ন হন।

অমিতাভভট্টর হিরণ্যসামুদায়িক হচ্ছেন বিশাখসেন। ইনি একাধারে কর্মান্তবাসকের বাণিজ্য এবং কৃষিকর সংগ্রাহক। মদ্যপ্রেমী এবং নারীসংসর্গলোলুপ এই মানুষটি অনঙ্গমিত্রর সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবও। তাঁর মুখেই এই আশ্চর্য কথা শুনেছিলেন অনঙ্গমিত্র।

বঙ্গদেশের রানি নাকি এক অদ্ভুত প্রতিজ্ঞা করেছেন। যে যুবা তাঁকে কোনও এক পূর্ণিমা বা অমাবস্যার রাতে রতিক্রিয়ায় সম্পূর্ণ তৃপ্ত করতে পারবে, তাকেই তিনি বিবাহ করবেন। সেই যুবক হবেন দেশের সার্বভৌম সম্রাট।

শুনেই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন অনঙ্গমিত্র। কাম্বোজ থেকে বৎস, উত্তরকুরু থেকে চেরদেশ, এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাণিজ্যসংসাধনে গতায়াত আছে পুণ্ড্রবর্ধনের উদীয়মান শ্রেষ্ঠীসম্রাট অনঙ্গমিত্রর। কার্যব্যপদেশে ভিন্নরাজ্যে অবস্থিতিকালে সেখানকার নারীরত্নদের সঙ্গসুখ উপভোগ না-করাকে পাপকর্ম বলে বিবেচনা করেন তিনি।

তাই এই প্রতিজ্ঞা শোনা মাত্র তিনি বিশাখসেনকে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন—যাতে অন্তত একবার তাঁকে ভাগ্যপরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়।

শুনে ইতস্তত করছিলেন বিশাখসেন। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল যে, তাঁর বিলক্ষণ আপত্তি আছে। সেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখে আশ্চর্য হচ্ছিলেন অনঙ্গমিত্র। এমন দ্বিধার কারণ কী?

কর্মান্তবাসকের শ্রেষ্ঠ শৌণ্ডিকালয়টির অধিকারী হচ্ছেন জনৈক ভাঁড়ুদত্ত। ভাঁড়ুদত্ত নিজে তো বটেই, তাঁর শৌণ্ডিকালয়টিও কম প্রাচীন নয়। নিয়মিত এখানে আসেন, এমন রাজকর্মচারীদের সংখ্যাও কম নয়। লোকে জানে এবং স্বীকার করে বঙ্গদেশের রাজনীতিস্রোতে মাঝে মাঝেই যেসব কূটঘূর্ণি দেখা যায়, তার অধিকাংশই ভাঁড়ুদত্তের বারুণীবক্ষে সৃষ্ট । দুই বন্ধুতে এই আলোচনাটিও সেখানেই ঘটছিল।

অনঙ্গমিত্র এক নিঃশ্বাসে একপাত্র অত্যুৎকৃষ্ট মদ্য শেষ করে পানপাত্র সশব্দে নামিয়ে রেখেছিলেন। তারপর উন্মত্ত আরক্তচক্ষে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি কি আমার পৌরুষের প্রতি সন্দেহ পোষণ করছ, মিত্র?’

অরিষ্টর ষষ্ঠ পাত্র নিঃশেষ করে বিশাখসেন বললেন, ‘কর্মটি বড় সহজ নয় হে মিত্র। তোমার কি মনে হয়, বঙ্গদেশে পুরুষের অভাব আছে? বিষয়টি এত সহজ হলে কি আর এই দেশের পুরুষকূল নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকত?’

এক কথায় বিশাখসেনের বক্তব্যটি নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন অনঙ্গমিত্র, ‘কিছু মনে করো না ভ্রাত, সবাই জানে যে তোমাদের বঙ্গদেশের যুবাদের পৌরুষ ক্ষমতা পুণ্ড্রবর্ধনের যুবকদের তুলনায় অতি ক্ষীণ। একবার সুযোগ দিয়েই দেখো না। যদি এই দেশের আধিপত্য একবার আমার হাতে আসে মিত্র, তবে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য তোমার থেকে যোগ্য আর কাউকে দেখি না।’

এত বড় আশ্বাসেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি বিশাখসেন। চাপাস্বরে বলেছিলেন, ‘কথা তা নয় মিত্র। আমি ভীত অন্য কারণে।’

‘কী?’

‘এই প্রকল্পটি চলছে কম দিন নয়। যে-কোনও সমর্থ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী পুরুষের কাছে কতটা আকর্ষণীয়— বুঝতেই পারছ। আজ অবধি অন্তত শতাধিক পুরুষ এই কর্মে উদ্যোগী হয়েছে। কিন্তু…’

‘কিন্তু?’

কণ্ঠস্বর একেবারে উদারায় নামিয়ে বলেছিলেন বিশাখসেন, ‘আজ অবধি কেউ সফলকাম হয়নি। কালরাত্রি প্রভাত হলে দেখা যায়—প্রাসাদের প্রধান দ্বারের সামনে তার মৃতদেহখানি পড়ে আছে।’

‘বটে?’ ভ্রুকুঞ্চন করেছিলেন অনঙ্গমিত্র।

‘শুধু তাই নয় বন্ধু। সেই শরীর বিষের প্রভাবে এমনই কৃষ্ণনীল হয়ে থাকে যে দেখলে ভয় করে। মনে হয় যেন বজ্রপাতে নিহত হয়েছে মানুষটি।’

অনঙ্গমিত্র হা-হা করে হেসে উঠে বলেছিলেন, ‘তোমরা কি নিয়মিত গঞ্জিকাসেবনের অভ্যাস করছ আজকাল?’

‘বিশ্বাস করা না করা তোমার ইচ্ছা বন্ধু৷ ‘কিন্তু, স্বচক্ষে দেখা এ ঘটনা কী করে অস্বীকার করি বন্ধু?’

পুনরায় সশব্দে হেসে উঠেছিলেন অনঙ্গমিত্র, ‘আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা কোরো না মিত্র। শুধু রানির শয়নকক্ষ অবধি আমাকে এগিয়ে দাও। আর হ্যাঁ, প্রধানমন্ত্রী পদে অভিষেক অনুষ্ঠানের জন্য একটি ভালো দেখে রেশমবস্ত্র পছন্দ করে রেখো।’

মদ্যাসক্তি বোধহয় মানুষের বোধশক্তিকে কিঞ্চিৎ শিথিল করে দেয়। বিশাখসেন কথা বাড়াননি। বন্ধুর অনুরোধ রেখেছিলেন।

কথাগুলি মনে পড়তেই ঘামতে শুরু করছেন অনঙ্গমিত্র৷ তিনি বুঝতে পারলেন—ইতিমধ্যেই নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে ঘরের সব প্রদীপ। আলো বলতে জানালা দিয়ে আসা জোৎস্না৷ অপার্থিব জ্যোৎস্নায় অনঙ্গমিত্র দেখলেন, দাসীদুটি অন্তর্হিত। এই অন্ধকারে শুধুমাত্র তিনি আর রানি৷

নারী স্থির হলেন। শীতল স্বরে বললেন, ‘কী নাগর, ভোগ করবে না আমাকে? তৃপ্ত করবে না আমার বাসনা। এসো পুরুষ, আমাকে তৃপ্ত করো, আমাকে মুক্ত করো, আমাকে পূর্ণ করো…’

বহুকষ্টে চক্ষু উন্মীলিত করলেন অনঙ্গমিত্র। উদভ্রান্ত হয়ে পড়লেন। দেখলেন উলঙ্গিনী নারীর কুঞ্চিত কেশদাম বাতাসে উড়ছে সর্পিণীদলের মতো। স্তনদুটি অস্বাভাবিক স্ফীত। আর পদ্মের পাপড়ির মতো আঁখি দুটি…

পদ্মের পাপড়ি? নাকি নরকের অঙ্গার? ওই জ্বলন্ত অক্ষিদুখানি কার? ওই শীতল, ক্রুর, উদগ্র, হিংস্র দৃষ্টি কার? ও কি পাতালের গহীন অন্ধকার থেকে উঠে আসা মূর্তিমতী অভিশাপ?

এই অপার্থিব দৃশ্য দেখে অন্তরাত্মা অবধি কেঁপে উঠছে অনঙ্গমিত্রর। জীবনে এত তীব্র ভয় তিনি পাননি। আর্তনাদ করে উঠতে চাইলে, কিন্তু কণ্ঠ দিয়ে স্বর ফুটল না।

নারীটি ঝুঁকে এলেন অনঙ্গমিত্রর উপর৷ হিসহিস করে বললেন, ‘কী নাগর? তৃপ্ত করবে না আমাকে? রাজা হবে না তুমি? রাজা হবে না এই দেশের? উঁ?’

অনঙ্গমিত্রর সর্বাঙ্গ থরথর কাঁপছিল, স্বেদস্রোত বইছিল জলের মতো৷ বললেন, ‘আমাকে ছেড়ে দিন।…অধমের অপরাধ ..ক্ষমা করুন।’

‘ক্ষমা! আপনি!’ উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলেন সেই নারী, ‘এ কী কথা গো নাগর? তুমি না পুরুষ? এই না কিছু পূর্বেই আমাকে রণ্ডা, বারবণিতা বলে সম্বোধন করছিলে? আর এই কয়েকমুহূর্তেই ‘আপনি?’ এ তো ভারি মজার কথা।’

‘ক্ষমা রানি…ক্ষমা।’

উন্মাদের মতো হেসে উঠলেন সেই নারী। অন্ধকার প্রকোষ্ঠে, জোৎস্নাময় অলিন্দে, উতল বাতাসে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে ফেরে সেই হাসি। অজানা আতঙ্কে শিউরে উঠল নিস্তব্ধ রাত্রি। হাসি থামলে রানি বললে, ‘ছিঃ স্বামী, ওকথা বলতে হয়? আপনি না আমার আমার প্রভু? আসুন স্বামী, আপনাকে ভালোবাসায় সোহাগে ভরিয়ে দিই।’

অনঙ্গমিত্র কিছু বলার আগেই রানি ঝুঁকে এলেন তাঁর মুখের ওপর। চুম্বনের ভঙ্গিতে অধর সামান্য উন্মুক্ত হল৷ তখনই অনঙ্গমিত্র দেখলেন যে নারীটির শ্বদন্তদুটি প্রায় দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে। হয়ে উঠেছে আরও বক্র, আরও তীক্ষ্ণ।

আর জিহ্বা? সাক্ষাৎ মৃত্যুর সম্মুখীন হয়ে অনঙ্গমিত্র দেখলেন এই রমণীর জিহ্বা মধ্য হতে দুইভাগে বিভক্ত। ঠিক যেমন সাপের হয়!

পরমুহূর্তে দুখানি তীক্ষ্ম, উগ্র বিষদন্ত নেমে এল অনঙ্গর গণ্ডদেশে।

.

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন