অভীক সরকার
৭৪৮ খ্রিস্টাব্দ৷ ইয়েদং উপত্যকা, দক্ষিণ তিব্বত৷
.
হাড়-হিম-করা আতঙ্কে পটে আঁকা ছবিটির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন যুবক শ্রমণটি৷ সেই বিস্ফোরণের শব্দ তাঁর যাবতীয় ইন্দ্রিয়গুলোকে অসাড় করে দিয়েছিল৷ চারিদিকে তুষারঝড়ের দাপট বেড়ে উঠেছে আরও৷ তার মধ্যেই তিনি দেখলেন যে, তাঁর পায়ের কাছে পড়ে আছে কমলবুদ্ধির নিথর দেহ৷
বিস্ফারিত চক্ষে সেদিকেই তাকিয়ে ছিলেন তিনি৷ কমলবুদ্ধির মাথা যেন অজানা কীসের আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে৷ মনে হচ্ছে যেন একটুকরো সূঁচালো পাথর কমলবুদ্ধির মাথার একদিক দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে গেছে অন্যদিক দিয়ে৷ অথচ আশেপাশে সেই পাথরটির চিহ্নমাত্র নেই! কমলবুদ্ধির রক্তে আর মাথার খুলির ভাঙা অংশে ছেয়ে ছিল শ্রমণের পায়ের কাছের তুষারস্তূপ৷ আর তারই মধ্যে রক্তাক্ত গেরুয়া বস্ত্রটি সর্বাঙ্গে জড়িয়ে শুয়ে ছিল কমলবুদ্ধি, যেন সমস্তদিন কঠোর পরিশ্রমের পর এই মাত্র ঘুমিয়েছে সে৷
জীবনে অনেক ভয় পেয়েছেন শ্রমণ, কিন্তু এমন তীব্র মৃত্যুভয় এই প্রথম৷ থরথর কাঁপতে থাকলেন তিনি৷
‘বাহ বাহ, নির্জীব বাঙালি পণ্ডিতটা ভয়ে কেমন কাঁপছে দেখেছিস, জনছুব?’ প্রশ্ন করে প্রথম ছায়াটি৷
‘তাই তো দেখছি প্রভু মাশাং৷ ব্যাটার মগজটাই বড়, গায়ে জোরটোর কিছু আছে বলে মনে হয় না৷ এটাকে ধরে নিয়ে গিয়ে দেবী একজটার সামনে উৎসর্গ করলে হয় না প্রভু?’ বলে ওঠে দ্বিতীয় ছায়াটি৷
‘তোর মনে হয় এই বাঙালি শ্চেনমিনপা’টাকে দেবী একজটা বলি হিসেবে স্বীকার করবেন?’ চিন্তিত স্বর শোনা যায় এক অস্বাভাবিক বিশালদেহী ছায়ার থেকে, ‘আপনি কী মনে করেন প্রভু মাশাং? তার থেকে এটিকে উলঙ্গ করে চোমোলাংমার চূড়ায় বেঁধে রেখে এলে হয় না?’
খলখল হাসি শোনা যায় প্রথম ছায়াটির কাছ থেকে৷ সেই হাসি শুনে বুকের রক্ত শুকিয়ে গেল শ্রমণের৷ এরই মধ্যে বিরক্ত কণ্ঠস্বর শোনা যায় দ্বিতীয় ছায়াটির, ‘তোর কবে বুদ্ধি হবে রে ছুলঠিম? এই মর্কটটার জন্যে অত কষ্ট কে করবে শুনি? তুই?’
দুজনের মধ্যে একটা ঝগড়া বেঁধে উঠতে যাচ্ছিল৷ থামিয়ে দিয়ে প্রথম ছায়াটি বলে ওঠে, ‘না রে জনছুব, এত সহজে এটাকে মরতে দিচ্ছি না আমি৷ এখন বাঁধ এটাকে, বেঁধে নিয়ে চল রাজদরবারে৷ বলব—আমাদের গুহ্যধ্যানচক্রের পুঁথি চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছিল লোকটা৷ তোরা তো জানিস, একবার চোর বলে প্রমাণ করলে ওই মূর্খ সম্রাটের আর কিছুই করার থাকবে না৷’
‘বাঃ বাঃ! বেশ বেশ৷ তারপর প্রভু?’ প্রশ্ন করে তৃতীয় ছায়াটি৷
‘তারপর চোরের মার মারব এটাকে৷ এদিকে তোরা রটিয়ে দিস যে, গত সপ্তাহে রাজপ্রাসাদে যে আগুন লেগেছিল, আর রাজার সেরা ঘোড়াটা হঠাৎ করে মরে গেল, সেসব এর জন্যেই৷ কী রে, পারবি না?’
‘বিলক্ষণ পারব প্রভু৷’ বাকিরা সোৎসাহে বলে ওঠে৷
‘তারপর আর কী, আমি বলে দেব যে, আদিদেব নাংওয়া ওদেন ক্রুদ্ধ হবেন যদি একে চিরাগ নাগপোর সামনে বলি না-দেওয়া হয়৷ এইটুকুও যদি না পারি, তাহলে আর মন্ত্রী হলাম কেন, তোরাই বল৷’
‘সে তো বটেই, সে তো বটেই!’ বোঝার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে ওরা৷
‘শোন বোকারা, একটা জিনিস শেখাই তোদের৷ কাউকে এমনি এমনি মেরে দিলে সে হঠাৎ করে মস্ত বড় বীর হয়ে যায়, বুঝলি৷ লোকে চুকচুক করতে করতে বলে, ‘আহা রে, লোকটা কত ভালো ছিল৷’
‘তাই নাকি প্রভু!’ অবাক কণ্ঠস্বর শোনা যায় একজনের, ‘তাহলে সেক্ষেত্রে কী করা উচিত?’
‘মারতে হলে আগে তার নামে অপবাদ দিতে হয় বুঝলি৷ জনসমক্ষে ভদ্রতার পোশাকটা খুলে নিতে হয়৷ নইলে আর খুন করে কীসের মজা বল দেখি? কোমরে দড়ি বেঁধে রাজপথ দিয়ে চুলের মুঠি ধরে উলঙ্গ করে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাব, লোকে হাততালি দেবে, থুতু দেবে, পাথর ছুঁড়বে—তাতে মজা বেশি না? গালি দেবে ওর নামে, ওর মা’কে বলবে বেশ্যা, ওর পিতাকে বলবে গর্ভস্রাব, তাতে তোরা বেশি আনন্দ পাবি না?’
হাত-পা অবশ হয়ে আসে বৌদ্ধ শ্রমণটির৷ কী ভয়ানক! প্রবল ভয়ে আর আতঙ্কে নিশ্চল হয়ে থাকেন তিনি৷
‘হে হে হে, সে বেশ মজা হবে কিন্তু৷ আমি নিয়ে যাব প্রভু, আমি নিয়ে যাব এটাকে…’ আবদার করে একজন৷
‘আঃ, চুপ কর জনছুব, গোল করিস না! একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হচ্ছে, তার মধ্যে…ইয়ে তারপর এটাকে নিয়ে কী করবেন প্রভু?’ অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠে ছুলঠিম নামের সেই বিশালদেহী পর্বতনন্দন৷
‘এটাকে সর্বসমক্ষে ছাং আর চমরী গাইয়ের মাংস খাওয়াব ভাবছি রে ছুলঠিম৷ খি খি খি, কেমন মজা হবে বলত তোরা?’
‘বেশ হবে প্রভু৷ অতি চমৎকার হবে৷ কিন্তু তারপর কী হবে প্রভু মাশাং?’ বাকিরা বেশ উৎসাহিত৷
‘তারপর এটাকে এক যুবতী বেশ্যার সঙ্গে সর্বসমক্ষে যৌনসঙ্গম করতে বাধ্য করলে কেমন হয়?’ মতামত চাইলেন মাশাং৷ তিব্বত রাজদরবারের প্রধানমন্ত্রী, পোন ধর্মের প্রধানতম পৃষ্ঠপোষক মাশাং৷
ঘৃণা আর বিবমিষায় প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন শ্রমণ৷ প্রাণপণে তিনি প্রার্থনা করছিলেন, তাঁর সঙ্গে এসব ঘটার আগেই যেন ধর্মপাল যম স্বয়ং মৃত্যু হিসেবে নেমে আসেন৷
‘চিরাগ নাগপো’র সামনে উৎসর্গ করার সময় পাথর দিয়ে এক এক করে এই বাঙালিটার হাত পা ভাঙা হবে না, প্রভু মাশাং?’ উৎসাহিত হয়ে পড়ে চতুর্থ ছায়াটি৷
‘হবে রে রিনছেন, হবে৷ এত উত্তেজিত হচ্ছিস কেন?’ বলতে বলতে তুষারকুহেলি সরিয়ে সেই শ্রমণের সামনে এসে দাঁড়ালেন চারজনেই৷ প্রত্যেকের পরনে পোন-পুরোহিতদের চিরপরিচিত নীল আর কালো রঙের পোশাক৷ তাদের চোখে ক্ষিপ্ত ক্ষুধার্ত দৃষ্টি, অধরে তাচ্ছিল্যের উগ্র হাসি৷
পেছনের তিনজনের হাতে ধরা ছিল তিব্বতের ক্ষুরধার অসি দ’পদম, এক কোপে শত্রুর মুণ্ডু উড়িয়ে দিতে যার বিশেষ খ্যাতি আছে৷ শুধু সামনের মানুষটির হাতে ধরা ছিল অন্য একটি অস্ত্র, যা দেখে দুঃসহ আতঙ্কের মধ্যেও ঘেমে উঠলেন শ্রমণ৷
চণ্ডবজ্র৷ অব্যর্থ মৃত্যুর যমদূত৷ এই তাহলে কেড়ে নিয়েছে কমলবুদ্ধির প্রাণ!
‘কী রে বাঙালি, তুই আর এই চমরী গাইয়ের অণ্ডকোষ, তোরা ভেবেছিলিটা কী? দুজনে মিলে আমাদের গোপন গুহা থেকে চণ্ডবজ্র আর যমান্তকের লতাচূর্ণ চুরি করে নিয়ে যাবি, আর আমরা কিছু টের পাব না?’
বিকট সুরে হেসে উঠলেন সর্বাগ্রবর্তী পুরুষটি৷ বাকিরা তাতে যোগ্য সঙ্গত দিল৷
‘আমি কিন্তু ওর হাত দুটো মুচড়ে মুচড়ে ভাঙতে চাই প্রভু, অনুমতি পাব আশা করি৷’ সামান্য আদুরে স্বরে অনুরোধ করে জনছুব৷
‘পাবি রে জনছুব পাবি৷’
‘পা দু-টো ভাঙার দায়িত্ব তাহলে এই অধমকে দেওয়া হোক প্রভু মাশাং৷’ কাতর স্বর শোনা যায় রিনছেনের৷
‘আচ্ছা, পা-দুটোর দায়িত্ব তাহলে তুই-ই নিস৷’ যেন নিজের সম্পত্তি বিলিয়ে দিচ্ছেন, এই ভঙ্গিতে বললেন মাশাং৷
‘আমার জন্য তাহলে আর কী রইলটা কী? যা, সব তোরাই নিয়ে নে, যা৷’ অভিমানী কণ্ঠ শোনা যায় ছুলঠিমের৷
আতঙ্কে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়েছিল বৌদ্ধ শ্রমণটির৷ কিন্তু তিনি কিছু বলার চেষ্টা করার আগেই…
‘তোমার জন্যে তো আমি রইলাম ছুলঠিম৷ দেখো তো পছন্দ হয় কী না৷’ কোথা থেকে যেন ভেসে এল শান্ত এক কণ্ঠস্বর৷
শ্রমণ দাঁড়িয়েছিলেন এক তুষারপ্রাচীরের দিকে পিঠ ফিরিয়ে৷ প্রাচীরটি উচ্চতায় তিন-চার মানুষের সমান৷ যেখানে প্রাচীর শেষ হচ্ছে, সেখান থেকে একটি সমতলভূমি শুরু৷ কথাটি ভেসে এল যেন সেখান থেকেই৷
পাঁচ জোড়া চোখ চলে গেল উপরে৷
সেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন এক দীর্ঘদেহী পুরুষ৷ চারিদিকের শুভ্র তুষারপাতের মধ্যে আঁটোসাটো কালো রঙের পোশাকে তাঁকে দেখাচ্ছে স্থির বিদ্যুতের মতো৷ শুধুমাত্র চোখ আর ঠোঁট বাদ দিয়ে তাঁর পুরো মুখ ঢাকা৷ অনিন্দ্যসুন্দর সুঠাম দেহ৷
ঘোর আতঙ্কের মধ্যেও বৌদ্ধ শ্রমণটির দেহে শিহরণ জাগল! উদীয়ানের যুবরাজ৷ আচার্য শান্তরক্ষিতের প্রেরিত অতি বিশ্বস্ত গুপ্তপুরুষ৷
বামহাতে একটি অদ্ভুত দেখতে খর্বকায় ধনু ধরে আছেন সেই আগন্তুক। শিথিল জ্যা-তে একটি শর আরোপিত৷ পিঠে একটি তূণীর, এখান থেকে তার মাথাটি দেখা যাচ্ছে শুধু৷ সেই ধনুটি দেখামাত্র রোমাঞ্চিত হলেন শ্রমণ৷ আর কেউ না জানুক, তিনি জানেন ওই খর্বকায় অথচ মহাশক্তিশালী ধনুটির মাহাত্ম্য। তিনি এও জানেন—কোন তীব্র বিষে নিষিক্ত ওই ছোট ছোট তীরগুলি৷ কামরূপের পূর্বতম প্রান্তের অরণ্যবেষ্টিত পার্বত্য অঞ্চলের নাম নাগাঞ্চিভূমি৷ সেখানকার দুর্ধর্ষ উপজাতীয় যোদ্ধারা ব্যবহার করে এই ধনু৷
‘এই অদ্ভুতদর্শন জীবটা কে, প্রভু মাশাং?’ উত্তেজিত স্বরে প্রশ্ন করে রিনছেন৷ মাশাং-এর অনুগামীদের মধ্যে সে অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান৷ মানুষটির আবির্ভাব তার ঠিক ভালো ঠেকছিল না৷
‘বঙ্গভূমির এক নির্জীব বাঙালি বললে কি তোমাদের পোষাবে রিনছেন?’ সামান্য চিন্তিত শোনায় আগন্তুকের কণ্ঠস্বর, ‘নাকি আবার নামটাও বলতে হবে তার সঙ্গে? নাম না বললে তোমরা কি খুব অসন্তুষ্ট হবে ভাই?’
‘কে তুই?’ চিৎকার করে ওঠে জনছুব৷
‘আমি কে? সে কথা এত সহজে কী করে বলি বলো তো ভাই জনছুব? সে কথা বলা ভারি পরিশ্রমের কাজ, বুঝলে হে! আমাদের শাস্ত্রে বলেছে ‘আত্মানং বিদ্ধি,’ মানে নিজেকে বিদ্ধ করলেই আত্মা ভারি খুশি হন, ঠিক বলেছি কি না? তুমি অবশ্য বুদ্ধিমান মানুষ জনছুব, তুমি বুঝবে, এ বিশ্বাস আমার আছে।’
নির্বোধের মতো মাথা হেলায় জনছুব৷
‘নাম বল শয়তান, একবার তোর নামটা বল শুধু৷ তারপর তোর মস্তিষ্কের ঘিলু দিয়ে মেখে মন্ত্রশোধিত অন্ন যদি গ্রহণ না করেছি…’ প্রবল ক্রোধে থরথর কেঁপে ওঠেন মহামন্ত্রী মাশাং৷
‘নাম? নাম জানতে চাইছ তুমি? আমার নামধাম সবই তোমাকে বলতে হবে মাশাং? তবে তাই নাহয় বলছি তোমাকে৷ কিন্তু বলছিলাম যে, শুধু নিজের পরিচয় দিলেই হবে তো? নাকি আবার আমার পিতৃদেবের নাম, মাতুলবংশের কুলপঞ্জী—এসবও সবিস্তারে বলতে হবে? এসব না বললে কি খুবই অভিমান করবে ভাই মাশাং?’
‘শয়তান, তুই এখানে এলি কী করে?’ ছুলঠিম ক্রোধে উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে৷
‘আরে আর বলো না রে ভাই, সে অতি দীর্ঘ পথ৷ প্রথমে নালন্দা থেকে কজঙ্গল এলাম ঘোড়ার গাড়ি চড়ে। সে আবার ভয়ানক বেতো ঘোড়া বুঝলে! তারপর সেখান থেকে কামরূপ অবধি এলাম একটি পণ্যবোঝাই নৌকায়৷ ঝড়জলের মধ্য দিয়ে সে অতি বিশ্রী যাত্রা৷ মধ্যবারেন্দ্রীতে তো একবার ঝড়ের মধ্যে পড়ে ডুবতেই চলেছিলাম প্রায়৷ তারপর কামরূপ থেকে একটি অশ্বতরের পিঠে চড়ে পাহাড়ি পথে এই এখানে৷ সেও পাক্কা তিনদিনের রাস্তা৷ ওওওহহ্! পিঠের হাড়গুলো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে হে ছুলঠিম৷ আচ্ছা, তোমাদের এখানে ভালো বৈদ্য আছে কেউ, অ্যাঁ?’
‘তুই…তুই…ঠাট্টা করছিস আমাদের সঙ্গে?’ জনছুব হিংস্র ভাবে হাতের দ’পদমটা আন্দোলিত করে৷
‘ঠাট্টা? বলি এই পার্বত্যপথে এতখানি আসা কী ঠাট্টা মনে হল তোমাদের? ছিঃ ছিঃ, এটাকে পথ বলো তোমরা? বলি আমাদের কামরূপের অরণ্যপথও এর থেকে ঢের ভালো, বুঝলে?
‘তোর…তোর এত বড় সাহস…’ প্রচণ্ড ক্রোধে কথা হারিয়ে ফেলে রিনছেন৷
‘আচ্ছা ভাই মাশাং একটা কথা বলো তো, তুমি কি মদ্যপান আর নারীসংসর্গে এত ব্যস্ত থাকো যে, দেশের পথঘাটের অবস্থা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার কোনও সময়ই পাও না?
‘বেশ্যার বাচ্চা, তোর এত সাহস যে…’ উন্মত্ত ক্রোধে বক্তব্য শেষ করতে পারেন না মাশাং৷
‘রাগ করলে নাকি মাশাং?’ প্রশ্ন করেন সেই অজানা আগন্তুক, তারপর বোধহয় সামান্য লজ্জা পেলেন তিনি। বললেন, ‘এখানে এসে তোমাদের বিরক্ত করলাম না তো? মনে তো হচ্ছে নিতান্ত অনিচ্ছাতেই তোমাদের কাজকর্মে কিছু বাধা দিয়ে ফেলেছি মাশাং৷ এ হে হে, কিছু ভুল করে ফেললাম নাকি?’
দাঁত কিড়মিড় করেন মহামন্ত্রী মাশাং, এই উৎপাত আশা করেননি তিনি৷ সজোরে চিৎকার করে উঠলেন, ‘জনছুব, ছুলঠিম, রিনছেন, হাঁ করে তাকিয়ে দেখছিস কী? এই শয়তানটাকেও বন্দি করে নিয়ে আয়৷ এ অবশ্যই মায়াজাদুকর৷ নইলে এখানে এই সময়েই উপস্থিত হল কী করে?’
সেই অদ্ভুত দর্শনধারী মানুষটি এরপর যা করলেন তাকে ইন্দ্রজাল বললেও কম বলা হয়!
প্রায় তিন থেকে চার মানুষ-সমান উচ্চতা থেকেই লাফ দিলেন নীচের দিকে৷ না, দেহভঙ্গিতে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হল না তাঁর৷ দৃঢ় ও ঋজু ভাবে নেমে আসতে আসতেই শরসন্ধান করলেন তিনি, টানটান হল জ্যা’খানি আর অব্যর্থ মৃত্যুর ঠিকানা নিয়ে একটি শর উৎক্ষিপ্ত হল সামনের দিকে৷
যতক্ষণে সেই মৃত্যুদূত খুঁজে নিয়েছে তার আশ্রয়, ততক্ষণে তিনি নেমে এলেন শ্রমণের ঠিক পাশে৷ নেমে এলেন এমন অনায়াসে, দেখে মনে হল যেন বাতাস কেটে মোনাল পাখির একটি পালক নেমে এল মাটিতে৷ তখন তাঁদের সামনে শায়িত দুটি দেহ৷
একটি কমলবুদ্ধির৷
আরেকটি বিশালদেহী ছুলঠিমের৷
একটি খর্বকায় শর প্রায় পুরোপুরি গেঁথে আছে ছুলঠিমের বুকের বাঁদিকে৷ বোঝাই যায় যে প্রবল শক্তিতে সরাসরি হৃৎপিণ্ডে বিদ্ধ হয়েছে সেটি৷ ছুলঠিমের মুখে অবশ্য সামান্য বিস্ময়বোধ ছাড়া মৃত্যুর আর কোনও চিহ্নই নেই৷ মহান মৃত্যুবিহঙ্গ খ্যুং গনপো যে এইভাবে হঠাৎ ডানা মেলে নেমে আসতে পারেন তার ওপর, সেটি বোধহয় সে স্বপ্নেও ভাবেনি!
বিস্ফারিত চোখে ছুলঠিমের দেহের দিকে তাকিয়েছিল তিনটি তিব্বতী, নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না তারা৷ উড়ন্ত অবস্থা থেকে এত ক্ষিপ্রতায় ও এমন নিপুণ নিশানায় তীর ছুঁড়তে আজ অবধি আর কাউকে দেখেনি এই তিন তিব্বতনন্দন৷
তারপর যেভাবে বন্য নেকড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার শিকারের ওপর, ঠিক সেভাবেই উন্মুক্ত দ’পদম হাতে দৌড়ে এল ওরা৷
উদীয়ানের রাজপুত্র তখন ফেলে দিয়েছেন তার ধনুটি৷ তাঁর হাতে উঠে এসেছে একটি অতি ভীষণদর্শন বিশালকায় খড়্গ, যার মাথার দিকটা চাঁদের মতো বাঁকানো৷
এ অস্ত্রও চেনেন শ্রমণ৷ কজঙ্গলের শবর জনজাতির বড় প্রিয় এই খড়্গ৷ এই দিয়ে দেবী পর্ণশবরীর সামনে বন্য মহিষ উৎসর্গ করে তারা৷
তাদের ভাষায় এর নাম দা’ বা দাও!
.
.
৭০০ খ্রিস্টাব্দ। রাজপ্রাসাদ, কর্মান্তবাসক, বঙ্গদেশ।
.
সেই একই রাত্রি৷ নিদ্রাহীন রাত জাগছেন আরও তিনজন মানুষ।
স্পষ্ট ও উজ্জ্বল আকাশ জুড়ে অজস্র প্রশ্নের মতো নেমে আসছে তরল অন্ধকারের স্রোত৷ একটি কালপেঁচা তীক্ষ্ণস্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল উত্তরদিকে; তারপর চতুর্দিক জুড়ে ছায়ার মতো, রাতের কুয়াশার মতো নেমে এল অনন্ত নৈঃশব্দ্য৷ চারিদিকে জনপ্রাণীর শব্দমাত্র নেই৷ বাতাসে অল্প শীতের আভাস। বনে-বনান্তরে গাছের পাতায় ক্লান্ত মর্মরধ্বনি৷ দূরে দিগন্তে যেখানে ঘননীল আকাশ মিশেছে কৃষ্ণচরাচরে, সেইখানে একটি বড় হ্রদ৷ হ্রদের জলে ছোট ছোট ঢেউয়ের মাথায় ভেসে যাচ্ছে খণ্ড খণ্ড চন্দ্রজোছনা৷ তার একপাশে বিস্তীর্ণ প্রান্তর, আরেকপাশে একটি রাজপ্রাসাদ৷
সেই রাজপ্রাসাদের দ্বিতলে তিনজন বসে আছেন পাথরের মূর্তির মতো৷ অন্ধকার প্রাসাদের একটি জানালা প্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত। তারই মধ্যে তিনটি দীর্ঘ ছায়া থেকে থেকে কেঁপে উঠছে।
এঁদের মধ্যে যাঁর বয়স অপেক্ষাকৃত কম, তিনি বসে আছেন একটি রাজসিক আসনে৷ তাঁর প্রশস্ত বুকে শোভা পাচ্ছে বহুমূল্য রত্নহার, দুইহাতে মাণিক্যখচিত অঙ্গদ, দুই কানের কুণ্ডলে ঠিকরে উঠছে স্বর্ণদ্যুতির অহঙ্কার৷ দেহটি সুঠাম হলে কী হবে, এই অল্প বয়সেই সুদর্শন যুবকটির চোখের নীচে গাঢ় কালির চিহ্ন, অবয়ব জুড়ে অতিরিক্ত ইন্দ্রিয়াসক্তির সাক্ষ্য স্পষ্ট।
বাকি দুজনও বসে আছেন তাঁর কাছেই। তাঁদের বসার ভঙ্গিতে বোঝা যায় যে তাঁরা এই নবীন যুবার বিশেষ আস্থার পাত্র। তাই তাঁদের আচরণে বিনয় আছে, ভয় নেই। শ্রদ্ধা আছে, আশঙ্কা নেই।
স্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন খর্বনাসা গৌরবর্ণ পুরুষটি। তাঁর উচ্চারণে স্পষ্ট বোঝা যায় যে এই দেশের ভাষা তাঁর মাতৃভাষা নয়, এই ভাষা তিনি আয়ত্ত করেছেন।
‘আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা কালই বাস্তব রূপ পাচ্ছে তো ভাগিনেয়? সব কিছু ঠিকঠাক তো?’
যুবক প্রথমেই উত্তর করলেন না৷ একবার তাকালেন বক্তার দিকে, তারপর অন্যমনষ্কভাবে বললেন, ‘এখনও স্থির করতে করতে পারিনি মাতুল চারুদত্ত। আমার মনে হয় এই মুহূর্তে এত তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন নেই, এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের সাবধানী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।’
ভ্রু কুঞ্চিত করেই মুখে কৃত্রিম মিষ্টি হাসি ফিরিয়ে আনলেন সেই বিদেশি পুরুষ, ‘আমার কথা যদি শোনো ভাগিনেয়, শাস্ত্রে বলে শুভস্য শীঘ্রম, অশুভস্য কাল হরণম্। ভালো কাজে দেরি হওয়া ঠিক নয়৷ আর তাছাড়া আগামীকাল তোমার অভিষেক, এই বঙ্গভূমির সম্রাট হবে তুমি। এখন এত ভাবাভাবির মধ্যে গেলে তোমার চলবে?’
‘কিন্তু মাতুল, অভিষেকের দিনেই এত বড় একটি সিদ্ধান্ত কী করে নিই? তাও অমাত্যদের সঙ্গে এ বিষয়ে কিছুমাত্র আলোচনা না করে?’
‘এ ব্যতীত তিব্বতরাজের নিঃশর্ত সমর্থন পাওয়ার আর কি কোনও উপায় তোমার জানা আছে ভাগিনেয়?’ চারুদত্ত প্রতিপ্রশ্ন করেন৷
‘কিন্তু…কিন্তু মাতুল…এর ফলাফল হিসেবে রাজকোষের ওপর যে বিপুল চাপ পড়বে…’
‘এ আলোচনা আমরা আগেই করিনি কি ভাগিনেয়?’ সামান্য অধীরতাই বোধহয় প্রকাশ পায় বক্তার স্বরে, ‘আমাদের তো কথাই হয়েছিল যে, তোমার রাজ্যপ্রাপ্তির পরেই তিব্বতরাজের সহায়তায় আমরা দিগ্বিজয়ে বার হব৷ আমাদের জয়ধ্বজা উড়বে গুর্জরদেশ থেকে যবদ্বীপ অবধি৷ পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়বে সমগ্র উত্তরাবর্ত৷ বিজিত দেশগুলি থেকে লুণ্ঠন করে আনব বিপুল ধনসম্পদ৷ এ সব তো স্থির হয়েই আছে! আর এই বিপুল সাহায্যের প্রতিদানে যে সামান্য সুবিধা তিব্বত-নরেশ চেয়েছেন, তা খুব অযৌক্তিক নয়!’
ইতস্তত করেন নবীন যুবক৷ সেই দোলাচল প্রকাশ পায় তাঁর কণ্ঠস্বরেও, ‘আমার আশঙ্কা অন্যখানে, মাতুল চারুদত্ত৷ আমার আশঙ্কা আমাদের এই পরিকল্পনা কতখানি বাস্তব সেই নিয়ে৷ আমাদের পরিকল্পনা কি একটু বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয়? অঙ্গ, পুন্ড্রবর্ধন, মগধ, লিচ্ছবী, মালব, কান্যকুব্জ…এইসব বিচিত্র ভাষাভাষী, বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষকে একসূত্রে গেঁথে একটি স্বতন্ত্র, সার্বভৌম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার কল্পনা স্বপ্নমাত্র নয় তো?’
আলোছায়ার মধ্যেই চারুদত্তের মুখে অদ্ভুত মরিয়া এক আতঙ্কের ভাব খেলে গেল, যা বাকি দুজনের কেউই লক্ষ করলেন না।
তিব্বত থেকে গত মাসেই প্রধানমন্ত্রী গার তিরিলিং-এর গোপন আদেশ এসেছে চারুদত্তের কাছে, সে আদেশ সংক্ষিপ্ত, নির্দিষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন৷ কাল রাজসভার অধিবেশন শেষ হওয়ার আগে যদি সেই আদেশের পালন না হয়, তাহলে পরের দিন ভোর হওয়ার আগেই চারুদত্তের একগাছি চুলও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না৷
সেই থেকে চারুদত্তের চোখে ঘুম নেই, প্রাণে স্বস্তি নেই, মনে আনন্দ নেই৷
মনের ভাব গোপন করে বললেন চারুদত্ত, ‘এখন এই প্রশ্ন ওঠার কারণ কী ভাগিনেয়? তোমার মনে তো এমন ছোটখাটো সংশয় আসার কথা নয়! বীরত্বে তুমি গৌড়পতি শশাঙ্কের সমতুল্য, করুণায় স্বয়ং সম্রাট হর্ষ৷ আমি তো প্রায়ই বলি—প্রতাপে, মেধায়, করুণায় আমার ভাগিনেয় সাক্ষাৎ অমিতাভর অবতার৷’
এই পর্যন্ত বলে সরু চোখে একবার ভাগিনেয়র দিকে তাকালেন তিনি৷ তারপর যোগ করলেন, ‘তিব্বতাধিপতির সঙ্গে আমাদের এই চুক্তিই একদিন তোমার পুণ্য নিয়তি হয়ে দেখা দেবে ভাগিনেয়, আর একদিন এই নিয়তির নির্দেশে তুমি ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট হবে৷ তুমি কি নিজেকে সাধারণ পুরুষ ভাবো? রাজচক্রবর্তী সম্রাটের ভাগ্যলিখন নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছ, সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের পরে তুমিই হবে ভারতভূমির শ্রেষ্ঠতম নৃপতি৷ আজ তোমার নিয়তি তোমাকে আহ্বান করছে ভাগিনেয়! ওঠো, জাগো…রাজলক্ষ্মীর বরমাল্য আজ তোমার কণ্ঠদেশে…’
তৃতীয় পুরুষটি যেখানে বসেছিলেন সেখানে আলোয় ছায়ায় আঁধারে তৈরি হয়েছিল এক অপার্থিব মায়াবিভ্রম৷ তাঁর মুখের নীচের অংশটুকু দেখা যাচ্ছিল৷ সেই অন্ধকারের ছায়ায় ফুটে ছিল একটি দৃঢ় চিবুক এবং বাঁকা ঠোঁট৷ কালো কাপড়ে সমস্ত শরীর ঢেকে বসেছিলেন মানুষটি৷ তাঁর বসে থাকার ঋজু ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল যেন একটি উন্মুক্ত তরবারি নিষ্কম্প দীপশিখার মতো ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে৷
শান্ত চোখে এই নাটক দেখে যাচ্ছিলেন সেই অজ্ঞাতপরিচয় পুরুষ৷ তাঁর মনে হচ্ছিল যেন এক কুশলী ব্যাধ ফাঁদ পেতেছে নির্বোধ ছাগশিশু ধরবার জন্যে৷ সেই পুরোনো খেলা, শুধু কুশীলবেরা নতুন, এই যা৷ তবে কি না এক্ষেত্রে এই নাটকের অধিকারী তিনিই৷ ছাগশিশুও তাঁর, ব্যাধও তাঁর, ফাঁদও তাঁরই৷ কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার শাস্ত্রে তিনি বিশেষ পণ্ডিত৷ তারপর দুটি কাঁটাকেই কী করে ছুঁড়ে ফেলতে হয়, সেও তাঁর ভালোই জানা৷ তবে আজকের রাত অতি গুরুত্বপূর্ণ, আজই অতি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তদুটি এই মূর্খ অর্বাচীনটিকে দিয়ে অনুমোদিত করিয়ে নিতে হবে৷ এর থেকে ভালো সময় আর হয় না৷
তিনি পাথরের মূর্তির মতো নির্বাক থেকে সবকিছু শান্তভাবে দেখে যাচ্ছেন৷ মহাচীন থেকে কম অর্থ নিয়ে আসেননি তিনি৷ একবার শুধু রাজসভায় জায়গা পাওয়ার অপেক্ষা, ব্যস, তারপরেই রাজসিংহাসন তাঁর হাতের মুঠোয়৷ উৎকোচে বশীভূত হয় না এমন রাজপুরুষ হয় নাকি?
তবে একজন, শুধু একজনকেই তাঁর ভয়৷
বাতায়নের বাইরে অন্ধকার রাত্রির দিকে চক্ষু মেলে দেখছিলেন সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ নবীন যুবক, অশান্ত ও দীর্ণ বঙ্গভূমির নতুন শাসক৷ শান্ত নীল আকাশ থেকে কি কোনও মহাজাগতিক সংকেতধ্বনি শুনতে চাইছিলেন ভাবী সম্রাট? পেতে চাইছিলেন কোনও অতিলৌকিক ইঙ্গিত?
দেশের অবস্থা এমনিতেই খুব একটা ভালো নয়৷ সম্রাট শশাঙ্কের মৃত্যুর পর থেকেই ভারতবর্ষের পূর্বভাগ জুড়ে যে অরাজক বিশৃঙ্খলা চলছে, তার থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনও আশু লক্ষণ নেই৷ সম্রাট রাজভট অতি দৃঢ়ভাবে এতদিন রাজ্যশাসন করে এসেছেন৷ তাই অন্তত এখানে বহু চেষ্টাতেও কোনও রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি৷
তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে মানুষের মধ্যে বিপুল অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে৷ রাজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে রাজ্যের আপামর জনসাধারণ৷
কিন্তু তিনি নিজে?
এক আচ্ছন্ন ঔদাসীন্য যেন এই সবকিছু থেকে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে রেখেছে তাঁকে৷ সেই নির্মোহ নিরাসক্তির আবরণ পেরিয়ে এত কথাবার্তা, আলোচনা, পরিকল্পনা, মন্ত্রণা, ষড়যন্ত্র—এসব কিছুই তাঁর মনে আজকাল কোনও ছাপই ফেলে না৷ প্রতিটি সংবাদ যেন তাঁর চৈতন্যে একবার আঘাত করেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে মহাশূন্যে মিলিয়ে যায়, তার কোনও অবশেষই থেকে যায় না৷
এমনকী আজকাল কোনও বিষয় নিয়ে বেশি ভাবতেও পারেন না তিনি৷ মাঝে মাঝেই মাথার ভিতরটা শূন্য হয়ে যায়৷ তারপরেই তীব্র যন্ত্রণায় উন্মাদপ্রায় হয়ে যান তিনি, এই অবস্থা চলে যতক্ষণ না মাতুল এসে সেই বিশেষ ওষুধটি তাঁর হাতে তুলে দিচ্ছেন৷
মাথার যন্ত্রণাটা আসবে আসবে করছিল৷ তবুও ভ্রূক্ষেপ করলেন না নতুন সম্রাট৷ মাতুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘অভিজ্ঞ অমাত্যদের পরামর্শ আমি উপেক্ষাও করতে পারি মাতুল৷ সে অধিকার আমার আছে৷ কিন্তু তাই বলে তাঁদের পরামর্শ না শোনার কথা বলি কী করে?’
প্রমাদ গুনলেন চারুদত্ত৷ হাতে সময় বড়ই কম, এই সময়ে হঠাৎ এই অপোগণ্ডটির বুদ্ধি গজিয়ে ওঠা বড়ই বিপদের কথা! লক্ষণ ভালো নয়!
‘আমার মতে তাঁদের পরামর্শ শোনার কোনও প্রয়োজনই নেই ভাগিনেয়৷ রাজসভার ওই বৃদ্ধ পরগাছাগুলোর কাজই হচ্ছে সমস্ত শুভকর্মে বাধা দিয়ে সেইটি পণ্ড করা৷’
উদ্ভ্রান্ত চোখ তুলে তাকালেন নবীন যুবক। দুজনের দিকে পর্যায়ক্রমে দেখলেন। তারপর স্খলিতস্বরে বললেন, ‘আমি জানি না মাতুল—কী ঘটতে চলেছে; কিন্তু আমি এই প্রস্তাবে অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করছি। আমার মন বলছে যে, এই বিষয়ে উচ্চপদস্থ অমাত্যদের মতামত নেওয়াও অত্যন্ত আবশ্যক। তাঁরা যে শুধু অভিজ্ঞই নন, রাজ্যের হিতাকাঙ্ক্ষীও বটে। পিতাকেও দেখেছি অত্যন্ত ছোটখাটো বিষয় হলেও এঁদের মতামত নিতে। আর আজ এত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তাঁদের পরামর্শ ছাড়াই…’
‘তুমি বৃথাই চিন্তিত হচ্ছ, ভাগিনেয়৷ মহাবলশালী তিব্বত-নরেশ ঠিদু স্রোংচান স্বয়ং যখন তোমার সহায়, তখন এত চিন্তা আর উদ্বেগের তো কোন কারণই নেই৷ আমাদের এই মিত্র তো প্রধানমন্ত্রী তিরিলিং-এর স্বাক্ষরিত চুক্তিপত্র নিয়েই এসেছেন৷’ এই বলে সেই তৃতীয় পুরুষটির দিকে ইঙ্গিত করলেন চারুদত্ত৷ সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন সেই রহস্যময় পুরুষ৷
‘কিন্তু মাতুল, সে চুক্তিতে তো কোথাও সম্রাটের স্বাক্ষরচিহ্ন নেই৷’
‘আহা, যেখানে প্রধানমন্ত্রী নিজে সম্মতি দিয়েছেন সেখানে আবার সম্রাটের আলাদা করে অনুমতি দেওয়ার কী প্রয়োজন? আর আমি ওখানকারই লোক, আমি এসব নিয়মটিয়ম খুব ভালো করে জানি ভাগিনেয়৷ তুমি এ বিষয়ে একদম নিশ্চিন্ত থাকতে পারো৷’ ভাগিনেয়কে ভরসা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন চারুদত্ত৷ এই বলে সেই রহস্যময় তৃতীয় পুরুষটির দিকে আড়চোখে তাকালেন তিনি, তারপর বললেন, ‘তার উপর তুমি নিজেও মহাশক্তিশালী যোদ্ধা৷ ছোটখাটো সামন্ত আর রাজাদের জন্য তো তুমি একাই যথেষ্ট৷ তোমার দরকার কি এইসব সামান্য বেতনভুক কর্মচারীদের পরামর্শ নেওয়ার?’ নবীন সম্রাটকে উত্তেজিত করার প্রবল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন চারুদত্ত৷
এইবার মহাস্ত্র প্রয়োগের সময় এসেছে! নিজেই নিজেকে বললেন তিনি৷
ঘরের কোনায় রাখা স্বর্ণকলসটির দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি, কুলুঙ্গি থেকে দুটি পানপাত্র নামিয়ে আনলেন নিজের হাতেই৷ তারপর জিগ্যেস করলেন, ‘আজ মনে হয় ভাগিনেয়র মস্তিষ্ক চঞ্চল হয়ে আছে, তাই না? নইলে এমন জলবত্তরলং বিষয় নিয়ে এত প্রশ্ন ওঠার কথাই না৷ তবে ভাগিনেয়র আর দোষ কী? কয়েকদিন ধরে তার ওপর যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, দেখে তো আমারই শরীরটা কেমন যেন…’, বলতে বলতে দুটি পানপাত্র পূর্ণ করার উদ্যোগ নিলেন৷ তারপর প্রশ্ন করলেন, ‘আজ সম্রাটের কোন পানীয় সেবনের ইচ্ছা শুনি? উৎকৃষ্ট গৌড়ী আছে, মাধ্বী আছে, মৈরেয়ও আছে৷ এমনকী দণ্ডভুক্তি থেকে আনা উত্তম পৈষ্ঠীও আছে কিছু…’
লক্ষণ একটুও ভালো লাগছিল না চারুদত্তের৷ এই যুবকের বয়ঃসন্ধিকাল থেকে তাকে অল্প অল্প করে নিজের হাতের মুঠোয় এনেছেন তিনি৷ তার জন্যে বিপুল পরিশ্রম গেছে তাঁর৷ ভাগিনেয়কে নারী ও সুরায় আসক্ত করিয়েছেন যৌবনের শুরুর দিনগুলি থেকেই৷ দেশবিদেশ থেকে অতি গোপনে আনিয়েছেন বিচিত্র সব নেশাবস্তু৷ বিভিন্ন মদ্য থেকে শুরু করে প্রবরদেশের গঞ্জিকা, তিব্বতীয় নীলকৃষ্ণপুষ্প থেকে শুরু করে চের দেশের নারিকেলজাত ক্বাত্থ, প্রাণীজ থেকে উদ্ভিজ্জ, সমস্ত ধরনের নেশাদ্রব্য ব্যবহারে অভ্যস্ত তাঁর আদরের ভাগিনেয়৷
তবে ইনি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন যে বস্তুটি, সেটির জন্মস্থান সুদূর গান্ধারভূমিতে৷ অহিফেনকে বিশেষ উপায়ে পাতিত ও শোধিত করে প্রস্তুত করা হয় শুভ্রবর্ণ ভস্ম৷ শিকারকে আচ্ছন্নতায় বশীভূত করে ফেলতে এর জুড়ি নেই৷
বুকের কাছে হাত দিলেন৷ বটুয়াটি সঙ্গে আছে তো?
আপাতত এই দিয়েই ভাগিনেয়কে নিয়ন্ত্রণ করেন চারুদত্ত৷ এমনই তীব্র আকর্ষণ সেই শুভ্রবর্ণ ভস্মটির, যে প্রয়োজনের সময়ে সেটি হাতের কাছে না পেলে উন্মত্ত হয়ে ওঠে যুবক৷
আর পেলে? তখন তো অতি উত্তম৷ অসংলগ্ন আচরণ, উদ্ধত ও ইতরজনের মতো ব্যবহার, অনর্থক হিংস্রতা—সব মিলিয়ে এই মানুষটিকে তখন নিয়ন্ত্রণ করাই কঠিন হয়ে পড়ে৷
রাজপরিবারে এই নিয়ে অনেক অশান্তি হয়েছে৷ কোনও বৈদ্যই এই রোগ নিরাময় করতে পারেননি৷ সন্তানের এই দুরারোগ্য অসুখ দেখে জীবনের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণায় শয্যা নিয়েছেন চারুদত্তের ভগিনী, রানি চন্দ্রাবতী৷ জাগতিক কোনও ব্যাপারেই আর তাঁর আসক্তি নেই৷ সম্রাট রাজভট নিজেও শেষ জীবন বড় কষ্টে কাটাননি কি? শেষাবধি সেই যন্ত্রণা থেকে তাঁকে মুক্তি দিতেই তো চারুদত্তকে বাধ্য হয়েই সেই রাতে…
মুহূর্তের জন্যে তীব্র অনুশোচনা গ্রাস করতে চাইছিল চারুদত্তকে৷ কিন্তু আসন্ন কর্তব্যের কথা ভেবে নিজেকে ফের স্বাভাবিক করলেন৷ অর্থের সামনে কে কার ভগিনী, কে কার মাতুল? বিশেষত যাঁর মাথার ওপর উদ্যত হয়ে আছে মৃত্যুভয়ের মহাখড়্গ?
অভ্যস্ত হাতে একটি সুরাপাত্রে পরিমাণ মতো মাধ্বী ঢাললেন তিনি৷ তারপর ডান হাতটি ঢুকিয়ে দিলেন ঊর্ধ্বাঙ্গের অঙ্গবস্ত্রটির ভেতরে৷ সেখান থেকে অতি সন্তর্পণে বের করে আনলেন একটি ছোট চামড়ার বটুয়া৷ তার ভিতর থেকে অতি সন্তর্পণে তুলে আনলেন কিছু সাদা রঙের গুঁড়ো, মিশিয়ে দিলেন সেই পানীয়তে৷ তারপর অতি স্নেহের সঙ্গে সেটি তুলে দিলেন যুবকটির হাতে৷
মাতুলের উত্তেজক ভাষণে বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন যুবক৷ এমনিতেই বেশি চিন্তাভাবনা সহ্য হয় না তাঁর৷ তার ওপর মাথার যন্ত্রণা ফিরে আসছিল৷ একমুহূর্তে পানীয় নিঃশেষ করলেন সেই নবীন যুবক৷
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ভাগিনেয়র দিকে লক্ষ রাখছিলেন চারুদত্ত৷ এসব কাজের মূল্য কি শুধু অর্থ দিয়ে হয়? নিজের পানপাত্রে দীর্ঘ চুমুক দিতে দিতে নিজেকে বলছিলেন তিনি৷ এর জন্যে চাই ধৈর্য, সাহস আর বুদ্ধি৷ সাধে কী আর চারুদত্তকে অত চিন্তাভাবনার পর পাঠানো হয়েছিল এই দেশে?
‘এখন কি কিঞ্চিৎ সুস্থির বোধ করছ ভাগিনেয়?’
এতক্ষণ চোখ বুজে ছিলেন নবীন সম্রাট৷ এইবার চোখ খুললেন তিনি৷ ইতিমধ্যেই চক্ষু লাল হয়ে গেছে তাঁর৷ সামান্য বাঁকা সুরে বললেন, ‘কী যেন বলছিলেন মাতুল? তাহলে চুক্তিতে প্রধানমন্ত্রী তিরিলিং এর অভিজ্ঞানই যথেষ্ট?’
‘নিশ্চয়৷’ স্বস্তির শ্বাস ফেললেন চারুদত্ত৷ ভাগিনেয়র এই লক্ষণ খুবই ভালোভাবে চেনেন তিনি, তবুও সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হওয়া উচিত হবে কি?
এই দেশের রক্তে অবাধ্যতা আর বিদ্রোহের বীজ খেলা করে বেড়ায়৷ সহজে কি এই রাত এসেছে তাঁর কাছে? সম্রাট রাজভট বেঁচে থাকলে কি আর এসব সম্ভব হতো?
অনেকদিন হয়ে গেল এই দেশে এসেছেন চারুদত্ত, এখনও এই দেশের মায়েদের দুধের জাদু বুঝে উঠতে পারলেন না তিনি৷ একটিমাত্র কৈবর্ত নারীর দুধের ঋণ যে তাঁর ইচ্ছাপূরণের পথে এত বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে, কেই বা ভেবেছিল?
খড়্গবংশের প্রতিষ্ঠার পেছনে হাত ছিল তিব্বত-নরেশ স্রোংচান গাম্পোর৷ ভারতের পূর্বভাগ জয় করে দেশে ফিরে যাওয়ার আগে এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করে যান তিনি৷ এঁদের প্রথম তিন নৃপতি খড়্গোদ্যম, জাতখড়্গ, এবং দেবখড়্গ—তিনজনেরই দেহে ছিল তিব্বতের রক্ত এবং তিনজনেই ছিলেন পরম বৌদ্ধ। এমনকী খড়্গোদ্যম এবং জাতখড়্গের দুই রাজ্ঞীও ছিলেন তিব্বতদেশীয়।
কিন্তু ‘ক্ষিতিপতি’ দেবখড়্গ তাঁদের পারিবারিক রীতি অগ্রাহ্য করে বিয়ে করেন এক এদেশীয় নারীকে। মহারানি প্রভাবতী৷
প্রভাবতী ছিলেন বরেন্দ্রীর মেয়ে, কৈবর্তরাজকন্যা। সম্রাট রাজভট তাঁরই গর্ভজাত সন্তান। নিজের মা’কে প্রাণাধিক ভালোবাসতেন রাজভট, এই দেশকে তারও বেশি৷
উদার হেসে বললেন চারুদত্ত, ‘এই তো, ভাগিনেয়র মনটা এবার একটু প্রফুল্ল হয়েছে মনে হচ্ছে! বাহ বাহ, বেশ ভালো৷ তা ভাগিনেয়র মনে আছে নিশ্চয়ই, কী কী করতে হবে আমাদের?’
‘আছে বইকি! সামান্য ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন নবনিযুক্ত সম্রাট। কণ্ঠস্বরে ঝলসে উঠছিল অপরিসীম ঔদ্ধত্য, ‘একদিন এই বিশাল ভারতভূমি আমার পদানত হবে৷ সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের পর একমাত্র রাজচক্রবর্তী সম্রাট হব আমি৷ তাই না মাতুল?’
‘বটেই তো ভাগিনেয়৷’ আরও উৎসাহ দেন চারুদত্ত৷
‘কলিঙ্গ থেকে কাশ্মীর আমার পায়ের নীচে আসবে, কামরূপ নরেশ নিজে এসে আমার পা ধুইয়ে দেবেন’ চক্ষু দুটি আরও লাল হয়ে উঠছিল যুবকের, ‘গৌড়বঙ্গের এই অপোগণ্ড সামন্তগুলোকে নিয়ে কী করা যায় মাতুল?’
‘রাজপ্রাসাদ নিয়মিত পরিষ্কার করার কাজে লাগিয়ে দিলে কেমন হয় ভাগিনেয়?’
এতক্ষণ ঘরে উপস্থিত তৃতীয় পুরুষটি কোনও কথা বলেননি৷ এইবার তিনি একটু মৃদু শব্দ করলেন৷ ঈঙ্গিত বুঝতে দেরি হল না চারুদত্তের৷ বাজে কথা অনেক হয়েছে, এইবার আসল কাজ৷
‘কিন্তু তুমি তো জানো ভাগিনেয়, সমস্ত ভালো কাজে বাধা দেওয়াই এদেশের মানুষের একমাত্র স্বভাব৷ তোমাকে কিন্তু সেই নিয়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে৷ আমার চিন্তা হচ্ছে ওরা আবার আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা পণ্ড না করে দেয়৷ কণ্ঠে আশঙ্কা ফুটিয়ে তুললেন চারুদত্ত৷
‘তারা কারা? রাজার ইচ্ছেয় বাধা দেয়, কাদের এত স্পর্ধা?’
চাপা উল্লাসের ভাব খেলে গেল বাকি দুজনের মুখে৷ ওষুধ ধরেছে৷ এইবার, অতি ধীরে, খেলিয়ে তুলতে হবে৷
‘কারা আবার? তোমার বৃদ্ধ অমাত্যরা৷’ মুখ ভার করলেন চারুদত্ত, ‘প্রতিটি কাজে প্রশ্ন তোলাই যাদের কাজ—তারা! আমার কথা যদি শোনো ভাগিনেয়, এই বৃদ্ধদের অনুমতি নিয়ে চলতে গেলে তোমার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে৷’
‘এত স্পর্ধা ওদের হবেই না৷ কালই আপনার ইচ্ছাপূরণ হবে৷’
যুদ্ধজয়ের হাসি ফুটে ওঠে তৃতীয় পুরুষটির মুখে৷ যাক, ভাগ্যের চাকা অবশেষে তাঁর পক্ষে ঘুরতে শুরু করেছে৷ একবার শুধু রাজসভায় স্থান পাওয়ার অপেক্ষা৷ তারপর তিনি জানেন কীভাবে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়৷ কাজ হয়ে যাওয়ার পর এই দুজনকেই ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতো ফেলে দিতে তাঁর একমুহূর্ত সময় লাগবে না৷
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন চারুদত্তও৷ এতদিন পর, অবশেষে৷ সেই বহু ঈপ্সিত ক্ষণটি আজ তাঁর হাতের মুঠোয়৷ চাপ ক্রমশই বাড়ছিল চারুদত্তের উপর। সেই চাপ আর নিতে পারছিলেন না তিনি৷
তিব্বতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ক্ষমতার পাল্লা ক্রমেই ঝুঁকে পড়ছিল ভারতীয়দের দিকে। শক্তিশালী সামন্তদের বশ করতে গিয়ে তিব্বতসম্রাট ক্রমেই আরও বেশি আঁকড়ে ধরছিলেন বৌদ্ধধর্ম, আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম৷ সামন্তদের বেশিরভাগই আবার তিব্বতের প্রাচীন পোন ধর্মের অনুসারী৷ এদের নেতৃত্বে আছেন মহা কূটবুদ্ধি মন্ত্রী, গার সামন্ত বংশের সন্তান তিরিলিং।
ওদিকে মহাশক্তিশালী তিব্বত ক্রমেই ব্যতিব্যস্ত করে তুলছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীনকে৷ ফলে চীনের তাং রাজবংশও চাইছিল তিব্বত সম্রাটকে নিয়ন্ত্রণ করতে৷ তাং রাজবংশের রাজপুরুষরা তখন চৈনিক বৌদ্ধদের সাহায্যে মদত দিতে থাকলেন তিব্বতের প্রভাবশালী সামন্তদের, উদ্দেশ্য তিব্বতসম্রাটকে নিয়ন্ত্রণ করা৷ মহামন্ত্রী তিরিলিং অতি সহজে যুক্ত হয়ে গেলেন তাদের দলে৷
তিব্বতের সামন্তরা জানতেন যে, সম্রাটকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে গেলে ভারতীয় বৌদ্ধদের শাসনে রাখতে হবে৷ কারণ তাঁরাই ধর্মীয় এবং নৈতিক শক্তি যোগাচ্ছেন সম্রাটকে৷ তাঁদের জন্যেই আজ তিব্বতে পোন ধর্ম বিপদের মুখে৷ সামন্তদের ক্ষমতা প্রশ্নের সামনে৷ তাঁদেরই চরবৃত্তি নিয়ে এদেশে আসেন চারুদত্ত৷
কিন্তু এতদিন ধরে সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থই হয়েছে তাঁর৷ রাজসচিব তিনি, রাজসভায় যথেষ্ট উচ্চপদে আসীন৷ রাজ্যের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতামত দেওয়ার অধিকার পেয়েছেন, কিন্তু কোনও কাজের কাজ করাতে পারেননি সম্রাটকে দিয়ে।
‘তাহলে শেষ পর্যন্ত কী ঠিক হল?’ গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন তৃতীয় পুরুষটি৷ তাঁর স্বরের গাম্ভীর্যে বোঝা যায় যে তিনি কোনও সামান্য পুরুষ নন৷ নবীন যুবক চোখ মেলে তাকালেন তাঁর দিকে৷ তাঁর নেশাগ্রস্ত চোখে ধরা পড়ে পুরুষটির স্থির এবং শীতল দৃষ্টি৷ ইতিমধ্যেই চারুদত্তের দেওয়া চতুর্থ পাত্র শেষ করেছেন৷ এই জ্বলন্ত দৃষ্টির সামনে সহসা শীত করে ওঠে সম্রাটের!
‘তাহলে কি এই ঠিক হল যে, আমাদের এই বন্ধুটিকে কালকেই নিয়োগ করা হবে দ্বিতীয় রাজসচিব রূপে?’ উদগ্র আগ্রহে ভাগিনেয়র দিকে তাকালেন চারুদত্ত৷
অস্ফূটে বললেন নবীন সম্রাট, ‘হ্যাঁ মাতুল, তাই হবে৷’
‘আর পূর্বসমুদ্রের বাণিজ্যপথে তিব্বতদেশের নিঃশুল্ক বাণিজ্যের অধিকার?’
‘সে অনুমতিও কালই দিচ্ছি৷’
আনন্দে চারুদত্তের চোখে জল চলে আসছিল৷ তিব্বতের বহির্বাণিজ্যের রাশ এখনও মন্ত্রী তিরিলিং-এর হাতেই৷ পূর্বসমুদ্রপথে তিব্বতীয় বণিকদের জন্য নিঃশুল্ক বাণিজ্যের অধিকার আদায় করা মানে তিব্বতের রাজসভায় মন্ত্রীমশাইয়ের প্রভাব প্রতিপত্তি দ্বিগুণ চতুর্গুণ হয়ে যাওয়া৷ আর প্রতিশ্রুতিমতো বাড়তি লভ্যাংশের এক দশমাংশ তো চারুদত্ত পাচ্ছেনই৷
হে ঈশ্বর, এত সুখ লেখা ছিল চারুদত্তের কপালে? সে যে অনেক মুদ্রা!
‘আর যদি অন্যান্য অমাত্যরা আপত্তি তোলেন?’ অজ্ঞাতপরিচয় পুরুষটির কণ্ঠস্বরে এমন মসৃণ শীতলতা আছে যে, এই স্বর শুনলেই শ্রোতার মনে অপার্থিব ভয় জেগে ওঠে৷
‘কে আপত্তি তুলবে? কার ঘাড়ে কটা মাথা যে আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলবে?’ ক্রুদ্ধ স্বরে প্রশ্ন করেন নবীন সম্রাট৷
‘সাহস অনেকেরই আছে রাজন৷’ স্থির নিরাসক্ত কণ্ঠে জানান সেই অজ্ঞাত পুরুষটি৷
নবীন সম্রাটকে দেখে মনে হল এখনই বিপুল আক্রোশে ফেটে পড়বেন৷ সজোরে নিজের আসনের হাতলে ঘুঁষি মারলেন তিনি। তারপরে উন্মত্তস্বরে চিৎকার করে উঠলেন, ‘কার এত বড় স্পর্ধা—আমি জানতে চাই মাতুল! আমি জানতে চাই—কার এত সাহস যে আমাকে সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলার কথা ভাবে?’
‘অনেকেই আছেন রাজন, তবে ভয় একজনকেই।’ এই বলে উঠে দাঁড়ান অজ্ঞাতনামা তৃতীয় পুরুষ৷ বাঘের মতো নিঃশব্দ দ্রুত পায়ে সম্রাটের কাছে চলে আসেন তিনি, কাঁধে হাত রেখে বলেন, ‘তাঁকে এই রাজসভা থেকে সরাতে পারলেই আমাদের কার্যসিদ্ধির পথে আর বাধা থাকে না, রাজন।’
নবীন যুবক রাজবংশের সন্তান। নিজেও কম শক্তি ধরেন না৷ তবু তিনিও স্তম্ভিত হয়ে গেলেন এই মানুষটির দানবীয় শক্তিতে৷ এঁর ব্যাপারে আগেই অনেক কিছু শুনেছিলেন তিনি, এখন অনুভব করলেন যে ইনি সামান্য কেউ নন!
‘কে সেই অমাত্য? আপনি চেনেন তাঁকে? মাতুল চারুদত্ত, আপনি জানেন কার কথা ইনি বলছেন?’ সন্দিগ্ধস্বরে প্রশ্ন করলেন নবীন সম্রাট৷
‘জানি ভাগিনেয়।’ ভাগিনেয়র হাতে পঞ্চম পাত্র তুলে দিতে দিতে অকম্পিত স্বরে বললেন চারুদত্ত৷
‘কে সেই বিশ্বাসঘাতক?’
‘রাজপণ্ডিত দয়িতবিষ্ণু।’
.
৭৪৯ খ্রিস্টাব্দ| চম্পানগরী, মগধ|
.
বর্ষার শেষ৷ আকাশে শরতের প্রসন্ন রোদ৷ তার নীচে দিগন্ত অবধি ছেয়ে আছে সবুজ শালিধানের খেত৷ দুটি খেতের মধ্যবর্তী আলপথ ধরে তিনি হেঁটে আসছিলেন৷
তাঁর দীর্ঘ নির্মেদ শরীর দেখে বরেন্দ্রীর সুপুষ্ট ইক্ষুর কথা মনে পড়ে৷ তেমনই পুষ্ট অথচ মেদবর্জিত সুঠাম ঋজু দেহ৷ তিনি বিশালদেহী নন, তবুও শরীরে বিপুল শক্তির আভাস স্পষ্ট৷ নবদুর্বাদলশ্যাম মানুষটির মুখে সবসময়ই এমন একটি প্রসন্ন হাসি, যা দেখলেই মানুষের মন ভালো হয়ে যায়৷ পদ্মের পাপড়ির মতো তাঁর চোখদুটি স্নেহে ও প্রেমে সিক্ত৷
বরেন্দ্রীর আখের সঙ্গে নিজের দেহের তুলনা তিনি আগেও শুনেছেন৷ আগে শুনলে বিস্মিত হতেন, আজকাল কৌতুক অনুভব করেন৷ হতেও পারে, বরেন্দ্রভূমির মাটি দিয়ে গড়া তাঁর শরীর, বরেন্দ্রীর বায়ু তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাসে, তাঁর প্রতিটি রক্তের ফোঁটায় করতোয়ার জলের শব্দ৷ তিনি বরেন্দ্রীর ঘরের ছেলে, বারেন্দ্রীর মহাবলী কেবট্ট, অর্থাৎ কৈবর্ত সমাজের প্রধানপুরুষ, এ নিয়ে চাপা গর্ব আছে তাঁর!
কৈবর্ত? সত্যিই কি তিনি কৈবর্ত?
মৃদু হাসলেন তিনি৷ নাহ, কারও প্রতি তাঁর কোনও অভিযোগ নেই৷ শাস্ত্রে বলে নিয়তিঃ কেন বাধ্যতে৷ বিধাতাপুরুষের বিধান ভাগ্যে নিয়েই প্রতিটি শিশু জন্মগ্রহণ করে, এ কথা তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন৷ না হলে তাঁর সঙ্গেই বা এমন কেন হবে?
জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ তিনি, মহাপণ্ডিতবংশে তাঁর জন্ম৷ পূজাপাঠ ও অধ্যাপনায় জীবন কাটানোর কথা তাঁর, অথচ ভাগ্যের কী ফের! গণ্ডযোগে জাত বলে ব্রাহ্মণ পিতামাতা জন্মাবার পরেই ত্যাগ করেন তাঁকে৷ তাঁর কেবট্টজাতীয় ধাইকে আদেশ দেন দুধের পুত্তলিটিকে করতোয়ার খরস্রোতে ফেলে আসার জন্যে৷ গণ্ডযোগ জ্যোতিষমতে ভারি অশুভ যোগ কিনা!
মনে মনেই তিনি নিজের কৈবর্তমায়ের চরণবন্দনা করেন। দুধের পুত্তলিটির ওপর সেই ধাইমায়ের করুণা না-জন্মালে আজ তিনি বেঁচে থাকতেন না৷ সেই স্নেহদুগ্ধের ঋণ তাঁকে যে মায়ার রশিতে বেঁধে রেখেছে, তার থেকে মুক্তির কোনও ইচ্ছা তাঁর নেই৷ তিনি সিদ্ধ, তিনি জ্ঞানী, তিনি মুক্তপুরুষ৷ কিন্তু তিনি এই নশ্বর পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ, বর্ণ, স্পর্শের মধ্যেই নিজের মোক্ষ খুঁজে ফেরেন, তিনি জানেন যে বৈরাগ্যসাধনে মুক্তির পথ তাঁর নয়৷ এই দেশ, দেশের মাটি, দেশের মানুষ—এসবই বড় প্রিয় তাঁর৷ দেশকে আরও ভালোভাবে জানবেন বলেই এই বিশাল ভারতদেশ তিনি পায়ে হেঁটে ঘুরেছেন৷ রাজপদপোজীবি থেকে নাগরিক সমাজ, আজীবিক থেকে তীর্থিক, যুদ্ধব্যবসায়ী থেকে বৌদ্ধ শ্রমণ—সমস্ত মতের, সমস্ত স্তরের মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা করেন৷ তবে তাঁর প্রকৃত অনুরাগী হচ্ছে দেশের নিম্নশ্রেণীর ব্রাত্য, অন্ত্যজ, শূদ্রজনেরা৷ শবর, হাড়ি, ডোম, ব্যাধ, পুলিন্দ—এদের কাছে তিনি সাক্ষাৎ মহাদেবের অবতার৷ এরাই তাঁর প্রকৃত আত্মজন৷ তাঁর কথায় এরা পারে না হেন কাজ নেই৷ তাঁদের কাছে তিনি বহু বিচিত্র নামে পরিচিত; গৌড়ীশদেব, শ্রী পিম্বলীদেব, শ্রী ভৈরবানন্দ, শ্রী ইন্দ্রানন্দদেব, আরও কত কী! তবে যে নামে তিনি সর্বত্র পরিচিত সেটি হচ্ছে…
অকস্মাৎ দূর থেকে ভেসে-আসা অস্পষ্ট কোলাহলের শব্দ! মাথা তুলে দূরে তাকালেন তিনি৷ দেখলেন—ঘন ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে আকাশে। নির্ঘাৎ আগুন লেগেছে নিকটবর্তী গ্রামে৷
মুহূর্তে আলপথ ভেঙে শালিধানের চারাগুলির মধ্যে নেমে গেলেন। সর্পিলগতিতে দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকলেন হতভাগ্য গ্রামটির দিকে৷
.
৭০০ খ্রিস্টাব্দ| রাজসভা, কর্মান্তবাসক, বঙ্গদেশ|
.
প্রকাশ্য রাজসভায় দাঁড়িয়ে ক্রোধে ক্ষোভে অপমানে থরথর করে কাঁপছিলেন মধ্যবয়সি ব্রাহ্মণপণ্ডিত। দরদর ঘামে ভেসে যাচ্ছিল উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ দেহটি, মুখখানি অপমানে টকটকে লাল হয়ে আছে।
শুধু বঙ্গদেশ কেন, হরিকেল থেকে বারেন্দ্রী অবধি তাঁর পাণ্ডিত্যের খ্যাতিতে পরিপূর্ণ। তাঁর প্রজ্ঞা, শীল এবং বিনয়ে মুগ্ধ হয়ে সম্রাট রাজভট নিজে তাঁকে নিয়োগ করেছিলেন রাজপণ্ডিত হিসেবে। সেই থেকে ধীরে ধীরে নিজের জ্ঞানে ও গুণে সর্বজনশ্রদ্ধেয় হয়ে উঠেছেন তিনি। তাঁর পরামর্শ নিতে আসেন মহামাত্য থেকে শুরু করে মহাসান্ধিবিগ্রহিক, দণ্ডপাশিক থেকে শুরু করে মহামাণ্ডলিক, কে নয়? আচরণে, জ্ঞানে, গরিমায়, প্রভাবে তিনি সর্ববিদ্যাবিশুদ্ধ রাজপণ্ডিত দয়িতবিষ্ণু। তাঁকেই প্রকাশ্য সভায় অসতীভর্তা বলে অপমান করলেন সম্রাট?
রাজসভা স্তব্ধ। প্রধান সেনাপতি প্রৌঢ় আনন্দদত্ত স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন এই উদ্ধত সম্রাটের দিকে। বৃদ্ধ মহামাত্য বুদ্ধদাসের দুই চোখ বন্ধ৷ দণ্ডনায়ক বিশালকীর্তি বয়সে নবীন, দয়িতবিষ্ণুর প্রিয় ছাত্রদের মধ্যে একজন সে৷ স্থির চোখে সেও দেখে যাচ্ছে এই উদ্ধত রাজার অসভ্যতা।
সপ্তাহ তিনেক হয়েছে, বঙ্গাধিপতি খড়্গরাজ রাজভটের দেহাবসান হয়েছে, তুষিতস্বর্গে স্থান পেয়েছেন তিনি৷ এই ইন্দ্রপতনে প্রায় একপক্ষকাল ধরে শোকপালন হয়েছে এই রাজ্যে৷ শ্রাদ্ধাদি সংস্কারের পর আজই রাজসভার প্রথম অধিবেশন।
সিংহাসনে বসেছেন নতুন সম্রাট, রাজভটপুত্র বলভট৷ প্রয়াত সম্রাটের আত্মার মঙ্গলকামনাসূচক অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে। সামন্ত, অমাত্য ও রাজকর্মচারীরা সবে আসন গ্রহণ করেছেন, এমন সময় সম্রাট জানান যে তাঁর কিছু বলার আছে৷ তাতে কেউই আশ্চর্য হয়নি, কারণ এটাই প্রথা৷ এই সময় সম্রাট সদ্ধর্মের প্রতি অনুরাগ ও ত্রিরত্নের প্রতি আনুগত্যের কথা উচ্চারণ করেন। প্রবীণ রাজসভাসদ ও কর্মচারীদের সাহায্য প্রার্থনা করেন৷ ফলে সকলে উদগ্রীব হয়ে রইলেন সম্রাট কী বলেন তা শোনার জন্যে৷
সম্রাট প্রথমেই প্রথানুযায়ী ভগবান তথাগতে অবিচল আস্থার কথা জানালেন৷ পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন৷ সভাসদদের আহ্বান জানালেন তাঁকে রাজ্যশাসনে সহায়তা করার জন্যে৷ আর তারপরেই হল সেই বিস্ফোরক ঘোষণা৷
‘আমার মনে হয় যে,’ গম্ভীরস্বরে বললেন তিনি, ‘বৈদেশিক শক্তিগুলির সঙ্গে আমাদের আরও যোগাযোগ বাড়ানো দরকার৷ যা পরিস্থিতি, তাতে অবশ্যই আমাদের এমন শক্তিশালী মিত্র প্রয়োজন, যিনি আমাদের ওপর শত্রুর আক্রমণ হলে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে পারেন।’ এই বলে তিনি উদগ্রীব মুখগুলির ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন৷ তারপর বললেন, ‘আপনারা সকলেই জানেন যে তিব্বতের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক অনেক দিনের৷ আমার মনে হয় তিব্বতই আমাদের সেই মিত্রশক্তি হওয়ার পক্ষে সবচেয়ে উত্তম পক্ষ৷ তাই আমি স্থির করেছি যে তিব্বতের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করব, এবং তার পরিবর্তে আমি তিব্বতীয় বণিকদের পূর্ব সমুদ্রপথে নিঃশুল্ক বাণিজ্যের অধিকার দেব।’
সভা মুহূর্ত হতবাক হয়ে পড়ল৷ নবীনসম্রাট এতবড় একটি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কোনও সামন্ত, অমাত্য, বিষয়পতি—কারও সঙ্গে আলোচনা না করেই? আর এর ফলে রাজস্বের যে বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হবে তার পূরণ হবে কী করে? ভূম্যধিকারীদের ওপর আরও করভার চাপিয়ে? রাজসভা গুঞ্জনে ভরে উঠল।
তবে গুঞ্জন অবশ্য উঠেই থেমে গেল! কারণ রাজা পুনরায় বলতে শুরু করেছেন, ‘আমি এও স্থির করেছি যে, তিব্বতের সঙ্গে বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নত করার জন্যে আমি আমার এক অতি বিশ্বাসভাজন সামন্তকে দ্বিতীয় রাজসচিব হিসেবে নিয়োগ করব।’
সভায় প্রবল বিস্ময় ও উত্তেজনার ঢেউ বয়ে গেল৷ মহামাত্য আছেন, মহাসান্ধিবিগ্রহিক আছেন, রাজপণ্ডিত আছেন। এঁদের অগ্রাহ্য করে, অন্যান্য সামন্তদের সঙ্গে আলোচনা না-করে রাজসচিব নিয়োগ পুরোপুরিভাবে প্রথাবিরুদ্ধ কাজ। রাজসচিব প্রায় রাজার কাছাকাছি মর্যাদা পেয়ে থাকেন। সেই পদে রাজবংশের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বাসভাজন কোনও রাজপুরুষকে নিয়োগ করাই প্রথা। নইলে রাজ্যের বিভিন্ন গোপন সংবাদ শত্রুদের হাতে চলে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। আর এখন গৌড় বা বঙ্গভূমির যা অবস্থা, সেখানে এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাউকে অধিষ্ঠিত করার আগে দু’বার ভাবতে হয় বইকি!
প্রয়াত সম্রাট রাজভটের রাজসচিব ছিলেন তাঁর শ্যালক৷ ইনি জীবনের অনেকটা সময় মহাচীনে কাটিয়েছেন। রাজপুরুষদের মধ্যে কানাঘুষো আছে যে, ইনি মহাচীনের তাং শাসকবংশের, তথা তিব্বতের রাজসভার শক্তিশালী সামন্তচক্রের বিশেষ আস্থাভাজন৷ রাজসভার অধিকাংশ অমাত্যই এই মানুষটিকে অবিশ্বাসের চোখে দেখেন৷ কথাটা সম্রাট রাজভটের কানে উঠতে দেরি হয়নি৷ রাজভট বিচক্ষণ রাজা ছিলেন, তাই শ্যালকমশাইটি রাজকার্যে অনেক অনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলেও সম্রাট রাজভট তাঁকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না৷
আজ উলটে গেছে পাশার দান, পালটে গেছে ক্ষমতার সমীকরণ৷ নবীন সম্রাটের ডানদিকে, সগৌরবে বসে আছেন বর্তমান সম্রাটের বিদেশীয় মাতুল, সম্রাট রাজভট যাঁর এদেশীয় নাম দিয়েছিলেন চারুদত্ত।
‘আমি স্থির করেছি,’ গম্ভীরস্বরে বলছিলেন সম্রাট, ‘মাতুল শ্রীচারুদত্তকে এই তিব্বত দেশ সম্পর্কিত কাজে সাহায্য করার জন্যে আমাদেরই এক সামন্তকে দ্বিতীয় রাজসচিব হিসেবে নিযুক্ত করা হবে।’
সভার সবার মনের কথা অনুমান করে সেনাপতি আনন্দদত্ত উঠে দাঁড়াতেই, সেদিকে তাকালেন সম্রাট, ‘সেনাপ্রধান কিছু বলবেন মনে হচ্ছে।’
‘সম্রাট, আমার মনে হয় এই সিদ্ধান্তদুটি গ্রহণ করার আগে আপনার একবার গুরুত্বপূর্ণ অমাত্যদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত।’
‘কিন্তু কেন?’
‘কারণ সেটাই প্রথা, রাজন। আপনার পিতা, প্রয়াত সম্রাটও সভাসদদের পরামর্শ ছাড়া কোনও সিদ্ধান্ত…’
‘আপনি কী বলতে চাইছেন আনন্দদত্ত? রাজার নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনও ক্ষমতা নেই? নিজের পছন্দের কাউকে কোনও রাজপদে নিয়োগ করার অধিকার নেই?’
কোনও সম্মানসূচক সম্বোধন ছাড়াই রাজার মুখে ‘আনন্দদত্ত’ শুনে একবার দাঁতে দাঁত ঘষলেন সেনাপতি। ছেলের বয়সি এই যুবরাজকে তিনি নিজে ছোটবেলা থেকে অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছেন। নিজের হাতে ধনুর্বিদ্যা শিখিয়েছেন, শিখিয়েছেন তরবারি-চালনা, শিখিয়েছেন নারাচ ও ভল্লের ব্যবহার। এমনকি যুবরাজের প্রাথমিক রাজনীতির পাঠও তাঁরই হাতে। আজ সেই নবীন তরুণ প্রকাশ্য রাজসভায় তাঁকে নাম ধরে সম্বোধন করছে? রাজা হয়েই ধরাকে সরাজ্ঞান করে সে, এতদূর স্পর্ধা?
গোপনে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কে জানে, হয়তো তাঁরই শিক্ষাদানে কিছু ভুল রয়ে গিয়ে থাকবে। ধীরে ধীরে পিছু হঠে নিজের আসনে বসলেন আনন্দদত্ত।
উঠে দাঁড়ালেন বৃদ্ধ মহামাত্য বুদ্ধদাস। ইনি শুধু সম্রাট রাজভট নন, বর্তমান সম্রাটের পিতামহ দেবখড়্গের সময় থেকে এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন।
‘রাজন, এই বৃদ্ধ অমাত্যের অভিবাদন গ্রহণ করুন। আপনার বক্তব্য যথার্থ, রাজ্যের বিষয়ে রাজার ইচ্ছেই শেষ কথা। তবুও…’ এইপর্যন্ত বলে একটুখানির জন্য চুপ রইলেন সেই অমাত্য।
‘তবুও কী, মহামাত্য বুদ্ধদাস?’ অসহিষ্ণুস্বরে প্রশ্ন করলেন সম্রাট।
‘রাজন, আপনি বয়সে নবীন, আজই আপনার অভিষেক ঘটেছে। আশা করি পরম কারুণিক তথাগতের ইচ্ছায় আপনি নিশ্চয়ই একদিন রাজচক্রবর্তী হবেন, সসাগরা ধরিত্রীর অধিপতি হবেন। কিন্তু এই পৃথিবীতে সময় বড়ই বলবান। আমি অনুরোধ করব, উপযুক্ত সময় না-আসা অবধি সম্রাট তাঁর বৃদ্ধ অমাত্যদের বিপুল অভিজ্ঞতার সদ্ব্যবহার করবেন। প্রয়াত সম্রাটও কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা তথা আনুগত্যের…’
‘আনুগত্য? হা হা হা, পথের কুকুরকে একের পর এক মাংসের টুকরো ছুঁড়ে দিতে থাকলে তারও আনুগত্য কিনে নেওয়া সম্ভব মহামাত্য। এতে আর আশ্চর্য কী? আনুগত্য দিয়ে কী প্রমাণ হয়?’ অসংলগ্ন স্বরে হেসে উঠলেন বলভট৷
এই ইতর অপমানে নীল হয়ে গেলেন মহামাত্য বুদ্ধদাস। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন৷ সভায় ক্ষুব্ধ গুঞ্জন ঝড়ের মতো বেড়ে উঠল৷ প্রবীণ অমাত্যদের সঙ্গে এ কেমন ব্যবহার সম্রাটের? এঁরা তো ভুল কিছু বলেননি৷ সম্রাট কি উন্মাদ হয়ে গেছেন?
তবে আবারও তাড়াতাড়িই থেমে গেল সেই গুঞ্জন। কারণ উঠে দাঁড়িয়েছেন রাজপণ্ডিত দয়িতবিষ্ণু।
‘রাজাজ্ঞা শিরোধার্য বটে।’ গমগম করে উঠল সেই গম্ভীর কণ্ঠস্বর, ‘কিন্তু মহারাজ, বলতে বাধ্য হচ্ছি যে আপনার ব্যবহার অত্যন্ত আপত্তিকর। আমরা আপনার অন্নদাস বটে, ক্রীতদাস নই। আপনি আমাদের অনুরোধ বা পরামর্শ উপেক্ষা করতে পারেন, কিন্তু এইভাবে অপমান করতে পারেন না।’ বলতে বলতে দয়িতবিষ্ণু লক্ষ করছিলেন যে সম্রাটের চোখ অস্বাভাবিক রকমের লাল, সামান্য টলছেন।’
‘তাই নাকি রাজপণ্ডিত?’ গরগর করে উঠলেন বলভট৷
‘আমি সম্রাটকে অনুরোধ করব, গুরুত্বপূর্ণ অমাত্যদের প্রকাশ্যে অপমান করার আগে তিনি যেন একবার রাষ্ট্রনীতি এবং কূটনীতির মূলমন্ত্রগুলি স্মরণ করেন। মহামতি চাণক্য বলেছেন যে মুখ্য রাজপুরুষদের অসন্তুষ্ট করে কোনও শাসকই…’
‘আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?’ রাগে থমথম করছে সম্রাটের মুখ৷ দয়িতবিষ্ণুর সন্দেহ হয় যে ইনি প্রকৃতিস্থ নন৷
‘না রাজন। শুধুমাত্র রাজ্যশাসনের নীতিগুলি আপনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি। সম্রাট কী জানেন পূর্বসমুদ্রপথে তিব্বতীয় বা অন্য বিদেশীয় বণিকদের নিঃশুল্ক বাণিজ্যের অধিকার দেওয়ার অর্থ কী?’
‘তুমিই বলো হে দয়িতবিষ্ণু, আমরা শুনি৷’ খানিকটা উপহাসই ছুঁড়ে দিলেন চারুদত্ত৷
চারুদত্তকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলেন দয়িতবিষ্ণু৷ সম্রাটের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন, ‘এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পূর্বে একবার শৌল্কিক তথা বিষয়পতিদের সঙ্গে আলাপ করার প্রয়োজন বোধ করেছিলেন আপনি? এর ফলে দেশের রাজস্বসংগ্রহ কী বিপুল পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সে বিষয়ে কোনও ধারণা কি শ্রদ্ধেয় রাজসচিব চারুদত্ত আপনাকে দিয়েছেন?’
‘দেখো পণ্ডিত, নিজেকে বেশি চালাক মনে করো না।’ চারুদত্ত, তপ্তস্বরে বলে উঠলেন, ‘তুমি যদি মনে করো যে বিদেশনীতি আর বাণিজ্যের তুমিই সব বোঝ…’
হাত তুলে চারুদত্তকে নিরস্ত করলেন দয়িতবিষ্ণু, ‘সম্রাট কী লক্ষ করেছেন যে, গত বেশ কয়েক দশক ধরে রাজকোষে বাণিজ্যিক করের পরিমাণ কী ভাবে কমে এসেছে? নব্যাবকাশিকানগর, কোটিবর্ষ, একের পর এক জলবন্দর বন্ধ হয়ে গেছে নাব্যতার অভাবে৷ তাম্রলিপ্তর মতো বিখ্যাত বন্দর ধুঁকছে৷ তার ওপর সুদূর প্রতীচ্যে যেখানে আমাদের বণিকরা বাণিজ্য করতে যেত, সেই সুবিশাল রোমক সাম্রাজ্যের আজ চিহ্নমাত্র নেই৷ কী হতে চলেছে ভবিষ্যত?’ একটানে এতটা বলে হাঁপাচ্ছিলেন দয়িতবিষ্ণু৷
‘তাতে কী হয়েছে? আমাদের রাজস্বের পরিমাণ তো কমেনি,’ বললেন সম্রাট বলভট৷
মৃদু হাসলেন দয়িতবিষ্ণু, ‘কেন কমেনি সে কথাটাও কি ভেবে দেখেছেন রাজন? আমাদের সদ্যপ্রয়াত সম্রাটও তো তিব্বতের প্রতি বিশেষ মৈত্রীভাবাপন্ন ছিলেন, তবুও তিনি কেন তিব্বতীয় বণিকদের এই বিশেষ সুবিধা দান করেননি? কী তার কারণ?’
‘বাজে কথা কম বলো হে পণ্ডিত! তুমি কী মনে করো, সম্রাটের থেকে তুমি বেশি বোঝ?’ ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে যাচ্ছিলেন চারুদত্ত৷
চারুদত্তকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলেন দয়িতবিষ্ণু৷ তিনি বুঝতে পারছিলেন, কাল রাত্রেই যে গভীর ষড়যন্ত্রের কথা বলছিলেন নিজের স্ত্রীকে, তা শিকড় ছড়াতে শুরু করেছে৷ এসব তারই লক্ষণ৷ তবে সে এত দ্রুত শুরু করবে, ভাবেননি তিনি৷
এই যুদ্ধ আজ জিততে হবে তাঁকে, যে কোনও মূল্যে৷ নইলে দেশের সামনে সমূহ বিপদ৷ চোয়াল শক্ত করলেন দয়িতবিষ্ণু৷
রাজন, আপনার প্রশ্নেরই উত্তর দিই আগে৷ বাণিজ্যিক করের পরিমাণ প্রভূত পরিমাণে কমে এলেও রাজস্বের পরিমাণ না কমার কারণ কি জানেন? কারণ এই ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে ভূমিজ রাজস্ব থেকে৷ ক্রমেই আমরা ভূমির ওপর করের বোঝা বাড়িয়ে চলেছি৷ আর তার ফলে নাভিশ্বাস উঠছে দেশের কৃষক ও ভূমিদাসদের৷ ফলে দিকে দিকে বেড়ে উঠছে প্রবল অসন্তোষ…’
‘তার সঙ্গে তিব্বতীয় বণিকদের পূর্ব সমুদ্রে নিঃশুল্ক বাণিজ্যের অধিকার দিতে তোমার আপত্তির কারণ কি জানতে পারি, অ্যাঁ?’ তড়বড় করে উঠলেন চারুদত্ত, ‘সম্রাট চাইছেন তিব্বতের সঙ্গে মিত্রতা বাড়াতে, ব্যস৷ রাজার ইচ্ছেই শেষ কথা! এখানে ওইসব ছোটলোক কৃষকদের কথা টেনে আনছ কেন?’
‘সে তো বটেই, সে তো বটেই।’ মুখে কৃত্রিম আক্ষেপের চুকচুক আওয়াজ করলেন দয়িতবিষ্ণু৷ ‘তিব্বতের লোক আপনি, বঙ্গভূমির কৃষকদের জন্যে আপনার কীসের চিন্তা চারুদত্ত? হাজার হোক, এ তো আর আপনার নিজের দেশ তিব্বত নয়!’
‘না না, কথাটা আমি ওভাবে বলতে চাইনি, হেঁ-হেঁ৷’ প্রগলভ হাসি দিয়ে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছিলেন রাজসচিব৷
‘তা আমাকে একটা কথা বলুন তো চারুদত্ত! তিব্বতের সঙ্গে মিত্রতা বাড়াবার জন্যে তো আপনিই যথেষ্ঠ ছিলেন৷ একে আপনি ওই দেশের লোক, তার ওপর প্রয়াত সম্রাটের শ্যালক, বর্তমান সম্রাটের মাতুল৷ আপনি থাকতে হঠাৎ অন্য লোক কেন? তিব্বতের মহামন্ত্রী তিরিলিং কি আপনার ওপর আর আস্থা রাখতে পারছেন না?’
ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতো ছিটকে উঠলেন চারুদত্ত৷ তাঁকে দেখলে মনে হচ্ছিল রাজসভা না-হলে বোধহয় এখানেই দাঁত নখ বার করে দয়িতবিষ্ণুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন তিনি৷ তাঁর হাত ধরে ফেললেন সম্রাট বলভট৷
‘তা এখন কি আমরা আপনার প্রস্তাবিত রাজসচিবের পরিচয় জানতে পারি রাজন?’ সামান্য লঘুস্বরেই প্রশ্ন করলেন দয়িতবিষ্ণু৷
‘হ্যাঁ, অতি অবশ্যই পারেন। আমি চন্দ্রবংশের প্রকাশচন্দ্রকে এই পদে নিয়োগ করতে চাই।’ যন্ত্রের মতো বললেন বলভট৷
নামটি শোনামাত্র রাজসভায় আবার বিপুল গুঞ্জন উঠল। এবার তা দ্বিগুণ উচ্চকিত৷
চন্দ্রবংশ হরিকেলের এক অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও প্রতাপশালী সামন্তবংশ৷ এমন দুর্দ্ধর্ষ সামন্তবংশকে বশে রাখতে সম্রাট রাজভটকেও যথেষ্ট বেগ পেতে হতো৷ তাদেরই একজনকে, সভার বিনা অনুমোদনে এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করছেন নবীন সম্রাট? এতে খড়্গবংশের সার্বভৌমত্বের ওপর কী কঠিন আঘাত আসতে পারে, সে বিষয়ে এই অনভিজ্ঞ সম্রাটের কোনও ধারণা আছে? তার ওপর প্রকাশচন্দ্র? যাঁর অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার ব্যাপারে সত্যিমিথ্যে অনেক রটনা ভেসে বেড়ায় এই দেশের বাতাসে?
‘প্রকাশচন্দ্র!’ রাজপণ্ডিত দয়িতবিষ্ণুর স্বরে ফুটে ওঠে বিহ্বলতা৷ তিনি জানতেন যে অপরপক্ষ অতি যত্নে সাজাচ্ছে তাদের ঘুঁটি৷ অনুমান করেছিলেন যে এই পাশাখেলায় একটা অভাবনীয় দান আসতে চলেছে তাঁদের সামনে৷ কিন্তু শত্রুপক্ষ যে হঠাৎ করে এই চাল চালবে সেটা স্বপ্নেও ভাবেননি৷
‘আমাদের রাজপণ্ডিতের মনে হচ্ছে সামন্ত প্রকাশচন্দ্রকে নিয়ে কোনও আপত্তি আছে?’ সম্রাটের সুরে ব্যঙ্গের ছাপ স্পষ্ট৷
‘হ্যাঁ সম্রাট, আছে৷’ বিহ্বল ভাব ঝেড়ে স্বাভাবিক হলেন দয়িতবিষ্ণু৷
‘আছে? বাঃ-বাঃ৷ রাজপণ্ডিত তাহলে কূটনীতিও বুঝছেন আজকাল?’
আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছিলেন দয়িতবিষ্ণু৷ কতই বা বয়েস এই যুবকের? এই তো সেদিনও তাঁর কাছে বসে বিদ্যালাভ করেছে এই কুমার৷ তখনও কিন্তু তার ব্যবহারে এই উগ্রতা, এই অশালীন আচরণ এত প্রকট হয়ে ওঠেনি৷ তখন তো এই কিশোরকে নিয়ে অনেক আশাও পোষণ করতেন তিনি৷ ভাবতেন যে এই যুবক একদিন বিদ্যায়, বুদ্ধিতে, শৌর্যে বিশালকীর্তি হবে৷ এমনকী এই গোপন আকাঙ্ক্ষাও তাঁর মনের মধ্যে ছিল যে, তাঁকে রাজপথে যেতে দেখে রাজ্যের বাসিন্দারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করবে—ওই দেখো, ওই যে প্রৌঢ়কে দেখছ পায়ে হেঁটে সর্বাণীদেবীর মন্দিরে পুজো দিতে যেতে, তিনিই মহান সম্রাট বলভটের শিক্ষাগুরু আচার্য দয়িতবিষ্ণু!
কিন্তু সেই শিশুটি যতই বড় হতে থাকল, ততই যেন তাঁর আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে থাকল সে৷ ধীরে ধীরে দেখতে পেলেন দয়িতবিষ্ণু, কোনও এক অজ্ঞাত কারণে বদলে যাচ্ছে সেই বুদ্ধিমান, বিনয়ী কিশোরটি৷ সারাদিন সে ব্যস্ত থাকে অবিরাম মদ্যপানে। রাতদিন আমোদ-প্রমোদ ছাড়া মন ওঠে না তার৷ রাজনর্তকী আর নগরনটী ছাড়া দিনই কাটে না! তার সাম্প্রতিক অসুস্থতার কথাও জানেন তিনি৷ হাতে-গোনা যে কয়েকজনের কাছে সম্রাট রাজভট মনের দুঃখের কথা খুলে বলতেন, তিনি তাঁদের মধ্যে একজন৷ সেই সময়ে এই চারুদত্তকে দেখেছেন রাজকুমারকে সবসময় আগলে আগলে রাখতে৷
‘সম্রাটের বেতনভুক কর্মচারী আমি, তাই তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য৷ সবিনয়ে জানাই যে বর্তমান সম্রাটের ভূতপূর্ব এই শিক্ষক রাষ্ট্রনীতি তথা কূটনীতিতেও সামান্য কিছু জ্ঞানের অধিকারী৷ শুধু প্রয়াত সম্রাট কেন, রাজ্যের মহামাত্য, মহামাণ্ডলিক, দণ্ডনায়ক, এমনকী বিশিষ্ট ভুক্তিপতিরাও এই ব্রাহ্মণের মতামতে বিশেষ আস্থা রেখে থাকেন৷ তাই কূটনীতি বুঝি না বলাটা চরম ধৃষ্টতা হয়ে যাবে যে সম্রাট৷’
‘বটে? তা আপনার আপত্তির কারণগুলি জানাতে আপত্তি আছে নাকি?’
অসম্মানটা গায়ে মাখলেন না দয়িতবিষ্ণু৷ মুখে স্মিত হাসিটি টেনে বললেন, ‘আপত্তির প্রশ্নই ওঠে না সম্রাট! আপনাকে সঠিক পরামর্শ দেওয়াই তো আমাদের পবিত্র কর্তব্য…’
‘আঃ, বড় বাজে বকছ হে ব্রাহ্মণ! কাজের কথাটা ঝটপট বলে ফেলো তো দেখি!’ রাজসচিব চারুদত্ত বললেন৷
অতি কষ্টে নিজের রাগ সামলালেন দয়িতবিষ্ণু৷ এককালে এই দ্বিপদ প্রাণীটিকে তিনি ও অন্যান্য অমাত্যরা উপেক্ষাই করতেন৷ আজ ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়েছে, আজ এর দাপট সইতেই হবে!
‘তার কারণ সামন্ত প্রকাশচন্দ্রের এই দেশ তথা খড়্গবংশের প্রতি আনুগত্য নিয়ে আমার মনে সন্দেহ আছে রাজন৷ ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, ইনি এই রাজ্যে চন্দ্রবংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চান৷ কথাগুলো গোপন সভাতেই আলোচনা করা উচিত ছিল, কিন্তু মহারাজ আমাকে বাধ্য করলেন প্রকাশ্য সভায় এই বক্তব্য রাখতে৷’
ভ্রূকুঞ্চন করলেন সম্রাট বলভট, ‘আপনার এই অযথা অভিযোগের স্বপক্ষে কোনও প্রমাণ আছে?’
‘আছে সম্রাট৷ আপনি কি জানেন প্রকাশচন্দ্র প্রথম জীবনে কোথায় ছিলেন? কী করছিলেন?’
‘সে কাহিনি বোধহয় অনেকেই জানি পণ্ডিত। তোমাকে আবার ব্যাখ্যা করে বলতে হবে নাকি?’
ব্যঙ্গের হাসি খেলে গেল দয়িতবিষ্ণুর মুখে, ‘বেশ বেশ৷ রাজসচিব যখন বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা চাইছেন না তাহলে বর্তমানকালেই ফিরে আসা যাক। মহামান্য সম্রাট কি জানেন বিগত কয়েক বছর প্রকাশচন্দ্র কোথায় ছিলেন? আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে হরিকেলে ফিরে আসার ঠিক পূর্বে কোথায় ছিলেন তিনি?’
‘কোনও এক মহাবিহারে ছিলেন বলে জানি, অধ্যাপনা অথবা…’—মনে করার চেষ্টা করতে থাকেন সম্রাট বলভট৷
‘কোন মহাবিহার? নালন্দা নয়, রক্তমৃত্তিকা নয়, এমনকী ভাসু বিহারও নয়৷ কোন মহাবিহারে অধ্যাপনা করছিলেন প্রকাশচন্দ্র?’
সম্রাট চুপ করে থাকেন৷ চারুদত্তের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে৷
দয়িতবিষ্ণুর কণ্ঠ আরও খর হয়ে ওঠে, ‘দীর্ঘদিন অদর্শনের পর প্রকাশচন্দ্র যে বিজাতীয় নারীটিকে নিয়ে ফিরেছেন তিনি কোন দেশের বা কোন জাতির, অথবা তাঁর বংশপরিচয় কী, এসব জানেন রাজন?’
‘অন্যের পরিবার নিয়ে প্রকাশ্য আলোচনা আমি রুচিবিকারের লক্ষণ বলে মনে করি৷’ গম্ভীরস্বরে বললেন সম্রাট।
‘প্রকাশচন্দ্র সাধারণ কেউ হলে এই প্রশ্ন উঠত না রাজন। কিন্তু যিনি মহারাজসচিবের মতো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হতে চলেছেন, তাঁর কাজকর্ম, কথাবার্তা, চালচলন, ইতিহাস, সবকিছুই পূঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার করে দেখা উচিত৷ নইলে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায় সম্রাট,’ বলতে থাকলেন দয়িতবিষ্ণু, ‘কে এই বিদেশীয় নারী? কী তার ইতিহাস? প্রকাশচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর উদ্বাহসংস্কারহীন কীসের সম্পর্ক?’
‘শুনেছি ইনি প্রকাশচন্দ্রের সাধনসঙ্গিনী!’ চারুদত্তর স্বরে স্পষ্টতই অস্বস্তি।
‘সাধনসঙ্গিনী!’ ব্যঙ্গের হাসি চওড়া হল দয়িতবিষ্ণুর মুখে, ‘কীসের সাধন রাজসচিব?’
ঘামতে থাকেন চারুদত্ত। হা ঈশ্বর, লভ্যাংশের এক দশমাংশ… এত কাছে এসেও অধরা থেকে যাবে?
‘রাজসচিবের নীরবতাই আমাদের অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছে!’ বলতে থাকেন দয়িতবিষ্ণু, ‘আপাতত আমার মূল বক্তব্যে ফিরি। শুনুন রাজন, আমার কাছে নিশ্চিত প্রমাণ আছে যে ইনি সেই সময়ে তিব্বতে অবস্থান করছিলেন৷’
‘তাতে কী প্রমাণ হয় পণ্ডিত? তিব্বতে যাওয়া বা থাকা পাপ? নাকি বঙ্গবাসীদের পক্ষে তিব্বতযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে?’
‘না রাজন৷ তিব্বতের সঙ্গে আমাদের এতদিনের সুসম্পর্ক, আমাদের মিত্ররাজ্য তিব্বত, সেখানে যাওয়া নিষিদ্ধ হবে কেন? তা এমন মিত্ররাজ্যে এঁকে এত গোপনে কেন যেতে হয়েছিল, সেই নিয়ে কিছু বলবেন নাকি মিত্র চারুদত্ত? তার ওপর সেক্ষেত্রে মহাবিহারে অধ্যয়ন করার মিথ্যা কাহিনিটিই বা প্রচার করতে হল কেন? প্রশ্ন আরও আছে সম্রাট৷ আপনি কি জানেন যে ইনি তিব্বতে কোথায় অবস্থান করছিলেন?’
‘তার সঙ্গে প্রকাশচন্দ্রের রাজসচিব হিসেবে নিয়োগের কী সম্পর্ক?’
‘অবশ্যই সম্পর্ক আছে রাজন! আমাদের কাছে নিশ্চিত সংবাদ আছে যে, ইনি গোপনে তিব্বতের মহামন্ত্রী তিরিলিং-এর বাড়িতে আতিথ্যগ্রহণ করেছিলেন৷’
‘তাতে আপত্তির কী আছে? বঙ্গদেশের অন্যতম প্রভাবশালী সামন্তকে তিব্বতের মহামন্ত্রী আতিথ্য দিয়েছেন, এ তো ভালো কথা৷’ সতর্কস্বরে কথা ঘোরাবার চেষ্টা করেন চারুদত্ত৷
‘বটেই তো।’ শত্রুকে বাগে পেয়েছেন দয়িতবিষ্ণু, ‘তা অমন প্রভাবশালী সামন্তবংশের উত্তরাধিকারী তিব্বতে গেছেন, সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে অবস্থান করেছেন, অথচ সে ব্যাপারে তিব্বতনৃপতি ঠিদু স্রোংচান কিছু জানেন না কেন—সে বিষয়ে কিছু আলোকপাত করবেন নাকি চারুদত্ত?’
‘আপনার কথা ক্রমশই অবোধ্য হয়ে উঠছে, পণ্ডিত৷ প্রকাশচন্দ্র কোথায় যাবেন আর যাবেন না, কোথায় থাকবেন আর থাকবেন না—সে ব্যাপারে আপনার এত কৌতূহল কেন?’ বিরক্তস্বরে প্রশ্ন করেন সম্রাট বলভট৷
‘তিব্বতের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কী চলছে, সে কথা আপনার জানা থাকলে আজ এই প্রশ্ন তুলতেন না সম্রাট৷’ উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকেন দয়িতবিষ্ণু, ‘তিব্বতের মহামন্ত্রী তিরিলিং আসলে গার পরিবারের মহাসামন্ত৷ এই গার পরিবার তিব্বতের রাজনীতিতে অতি ক্ষমতাশালী পরিবার, একসময়ে তাদের হাতেই ছিল তিব্বতের প্রকৃত শাসনক্ষমতা৷’
‘তাহলে তো সামন্ত প্রকাশচন্দ্রের সঙ্গে মন্ত্রী তিরিলিং-এর সুসম্পর্ক আমাদের জন্যে আরও সুখবর, পণ্ডিত!’ বিস্মিত স্বরে প্রশ্ন করেন সম্রাট বলভট৷
‘আজ্ঞে না সম্রাট! ওই জন্যেই বলেছিলাম—তিব্বতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি জানলে আপনি এই মন্তব্য করতেন না। বুঝতে পারতেন, প্রকাশচন্দ্রকে রাজসচিব পদে নিয়োগ করার তাৎপর্য কী৷ এখন যিনি তিব্বতনরেশ, সেই ঠিদু স্রোংচান মহা শক্তিশালী পুরুষ, মহাচীন অবধি কাঁপছে তাঁর ভয়ে৷ তিনি চান তিব্বতের যাবতীয় কর্তৃত্ব নিজের হাতে নিতে৷ তাঁর সঙ্গে তিব্বতের সামন্তশ্রেণী এবং তাদের অধিনায়ক মন্ত্রী তিরিলিং-এর প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা৷’
‘তাতে আমাদের অসুবিধা বা আপত্তির কারণ কী পণ্ডিত?’ স্খলিতস্বরে প্রশ্ন করতে করতে চারুদত্তের বাড়িয়ে দেওয়া চামড়ার বটুয়ার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দুই আঙুলে সাদা রঙের গুঁড়ো চিমটি-ভর তুলে নিজের মুখের মধ্যে ফেললেন সম্রাট বলভট৷
সেই বটুয়াটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন দয়িতবিষ্ণু। এরই কথা রাজবৈদ্য চন্দ্রসার তাঁকে বলছিলেন বটে! তিনি একবার চারুদত্তকে দেখে ফেলেছিলেন অতি গোপনে এই বটুয়া রাজকুমারের হাতে তুলে দিতে৷ তারপরেই নাকি রাজকুমার হঠাৎ অত্যন্ত উগ্র হয়ে ওঠেন৷ পরে চারুদত্তকে এই নিয়ে প্রশ্ন করাতে মহাক্রুদ্ধ হন চারুদত্ত৷
কী আছে ওই বটুয়াতে? কীসের ভস্ম ওটা?
‘তাতে আমাদের আপত্তির কারণ একটাই সম্রাট৷ সম্রাট ঠিদু স্রোংচান সদ্ধর্মের অনুগামী, আর মন্ত্রী তিরিলিং তিব্বতীয় পোন ধর্মের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক৷ একে তিনি তীব্র বৌদ্ধবিদ্বেষী মানুষ, তার ওপর একই কারণে তিনি ভারতবিরোধীও বটে৷ এমন শত্রুপক্ষের বাড়িতে আমাদের নবনিযুক্ত রাজসচিব টানা এক বছরের জন্যে গোপনে আতিথ্য নিলে তা আমাদের পক্ষে চিন্তার কার বইকি!’
‘সর্ববিদ্যাবিশুদ্ধ রাজপণ্ডিত দয়িতবিষ্ণু আমার ব্যাপারে এত সংবাদ রাখেন জেনে অত্যন্ত প্রীত বোধ করছি, এ আমার পরম সৌভাগ্য!’
প্রত্যেকের দৃষ্টি চলে যায় রাজসভার প্রবেশপথের দিকে৷ সেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন এক দীর্ঘদেহী পুরুষ৷
প্রকাশচন্দ্র!
সভায় মুহূর্তের মধ্যে অত্যন্ত টানটান পরিস্থিতি তৈরি হল৷ সভার প্রত্যেকে তাকিয়ে রইলেন এই বিশালদেহী ও বলশালী পুরুষটির দিকে৷ তাঁর উঁচু কপাল আর চওড়া কাঁধে ব্যক্তিত্বের ছাপ স্পষ্ট৷ তবে মানুষটির আসল বৈশিষ্ট্য তাঁর চোখ দুটিতে৷ সেই চোখ দুটির দিকে তাকালেই মনে হয়—এত স্থির, এত ক্রূর, এত হিমায়িত দৃষ্টি পার্থিব জগতে খুব কম দেখা যায়৷
দ্রুত ও দীর্ঘ পদক্ষেপে সভার দরজা থেকে সিংহাসন অবধি পথটি অতিক্রম করলেন প্রকাশচন্দ্র৷ নত হয়ে অভিবাদন করলেন সম্রাট বলভটকে৷ সম্রাট বলভট তাঁকে নিজের পাশের আসনে বসতে ইঙ্গিত করলে আসন গ্রহণ করলেন প্রকাশচন্দ্র৷ তারপর স্মিতহাস্যে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বলুন দয়িতবিষ্ণু, আমার বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ উত্থাপিত করছিলেন যেন?’
এতক্ষণ অবধি এই দ্বৈরথসমরে জিতে যাওয়ার আশা করছিলেন দয়িতবিষ্ণু৷ কিন্তু নাহ, আর বোধহয় শেষরক্ষা হল না৷ এই প্রথম তিনি উপলব্ধি করলেন যে ভাগ্যের চাকা তাঁর বিপক্ষে গড়াতে শুরু করেছে৷ বিজয়লক্ষ্মী ছেড়ে যাচ্ছেন তাঁর পক্ষ৷
দুচোখ বন্ধ করে মনে মনে স্বস্তিবচন উচ্চারণ করলেন তিনি, ‘মঙ্গলম্ ভগবান বিষ্ণু, মঙ্গলম্ গড়ুরধ্বজ, মঙ্গলম্ পুণ্ডরীকাক্ষ, মঙ্গলায় তনো হরিঃ৷’
সমস্ত স্নায়ু সংহত করে এবার প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের জন্যে প্রস্তুত হলেন তিনি৷
‘প্রকাশচন্দ্র, আপনি কি জানাবেন যে, তিব্বতে মন্ত্রী তিরিলিং-এর আতিথ্য উপভোগ করার সময় পোন ধর্মের ঠিক কোন কোন প্রেতসাধনা আর জাদুবিদ্যা শিখেছেন?’ প্রথম আঘাত তিনিই শুরু করলেন। শাস্ত্রে বলে—আক্রমণই প্রতিরক্ষার শ্রেষ্ঠতম উপায়৷
মৃদু হাসলেন প্রকাশচন্দ্র, ‘যদি করেই থাকি, তাতে আপনার উষ্মার কারণ কী দয়িতবিষ্ণু?’
‘উষ্মার কারণ আছে প্রকাশচন্দ্র৷ কারণ আমাদের কাছে সংবাদ আছে যে পোন ধর্মের সমস্ত বিকৃত, ঘৃণ্য, অশ্লীল প্রথাগুলিকে আপনি সদ্ধর্মের মূল আচারগুলির সঙ্গে সুকৌশলে মিশ্রিত করে তন্ত্রের নামে এক কুৎসিত সাধনপদ্ধতির সৃষ্টি করছেন৷ আপনি আসার পর থেকে হরিকেলের বিপুল অঞ্চলে আজ অবাধে মদ্যপান, যৌথ যৌনসঙ্গম, নরবলির মতো অসভ্য ও নৃশংস আচার ধর্মের নামে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে৷ পোন পুরোহিতদের পূজ্য বন্য, অসভ্য এবং বীভৎস মূর্তিগুলি এনে আপনি…’
‘চুপ করো পণ্ডিত, তোমার এতদূর সাহস যে আমাদের পোন ধর্মের দেবদেবীদের গালি দাও? তোমার ওই নোংরা জিভ একটানে ছিঁড়ে ফেলব আমি।’ ক্রোধে কাঁপছিলেন চারুদত্ত৷
ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি খেলে যায় দয়িতবিষ্ণুর, ‘যাক, রাজসচিব চারুদত্ত শেষ পর্যন্ত তাহলে স্বীকার করলেন যে উনি বৌদ্ধ নন, উনি আসলে পোন ধর্মের অনুসারী! বাঃ বাঃ! এতদিন ধরে অনেক কষ্টে বৌদ্ধ হওয়ার অভিনয় করেছেন আপনি হে রাজসচিব৷ আপনার এই অবিশ্বাস্য অভিনয় প্রতিভা আমার সশ্রদ্ধ সম্মান দাবি করে!’ এই বলে আভূমি প্রণত হওয়ার ভান করলেন দয়িতবিষ্ণু৷
সমগ্র রাজসভা পটে আঁকা ছবিটির মতো স্থির হয়ে আছে৷ এতবছর ধরে এতবড় মিথ্যাচার করে এসেছেন রাজসচিব? তিনি বৌদ্ধ নন? এই অপরাধে তো শিরচ্ছেদ হওয়া উচিত৷
কিন্তু সে দায়িত্ব নেবে কে? সম্রাট বলভটের চোখ আরও ঘোলাটে হয়ে আসছে, চারুদত্তের মুখে আতঙ্কের আর অপ্রস্তুত হওয়ার ছাপ স্পষ্ট৷ এই সময় হাল ধরলেন প্রকাশচন্দ্র৷
‘আপনি সনাতন ধর্মাবলম্বী, পণ্ডিত৷ আপনাদের সনাতন ধর্মে যেমন সৌর, গাণপত্য, শৈব ইত্যকার বিভেদ আছে, তেমন আমাদের সদ্ধর্মেও বিভিন্ন ধর্মমত আছে পণ্ডিত৷ মহাচার্য অসঙ্গ ও বসুবন্ধুর যোগাচারবিজ্ঞান অনুযায়ী…’
‘পাপ মুখে ও-দুটি নাম উচ্চারণ করবেন না প্রকাশচন্দ্র’, ক্রুদ্ধ সিংহের মতো রুষে উঠলেন দয়িতবিষ্ণু, ‘আপনি ও আপনার সাঙ্গোপাঙ্গদের প্রচারিত পাপাচারগুলোকে আপনারা যোগাচারবিজ্ঞান বলতে চান? বৌদ্ধ দর্শনের এই বিকৃতি ঘটাবেন বলেই তিব্বত থেকে প্রেতসাধনা শিখে এসেছেন আপনি? দশকুশলের পরিবর্তে অপরিমিত মদ্যপান? প্রজ্ঞা ও উপায়ের নামে অন্যের কুলবধূ নিয়ে উদ্দাম যৌনচক্র? নির্বাণের পরিবর্তে নরবলি?’
‘আহ, পণ্ডিত, চুপ করো!’ চারুদত্তের এগিয়ে দেওয়া বটুয়া থেকে আরও এক চিমটি সাদা গুঁড়ো মুখে ফেলে গর্জে ওঠেন সম্রাট৷ আপনি-টাপনি নয়, এবার সরাসরি তুমিতে নেমে এসেছেন৷
সমস্ত রাজসভায় যেন একটি পালক পড়লেও শব্দ শোনা যাবে এমন স্তব্ধতা৷ এ কী অভিযোগ তুললেন দয়িতবিষ্ণু?
‘ধর্মের কথা থাক পণ্ডিত, সে বিচার রাজা করবেন৷ আর আপনি তো ধর্মে বৈষ্ণব, সনাতনপন্থী৷ সদ্ধর্মের গতি নিয়ে আপনি এত চিন্তিত কেন?’ চারুদত্ত প্রশ্ন করলেন৷ একটু, আর একটুখানি৷ জয়ের গন্ধ পেতে শুরু করেছেন৷
‘কারণ ধর্মই শাসনক্ষমতা অধিকারের অন্যতম অস্ত্র৷ আমি মনে করি এই দেশে তন্ত্রের নামে পোন ধর্মের যাবতীয় পাপাচার আর বীভৎস দেবদেবীর মূর্তিপূজা প্রচলন করে প্রকাশচন্দ্র আসলে চান সদ্ধর্মের সর্বনাশ করতে, চান এই দেশের রাজসিংহাসন দখল করতে৷ তাঁকে সম্পূর্ণভাবে মদত দিচ্ছেন তিব্বতের সামন্তপ্রভুরা আর চৈনিক বৌদ্ধরা৷ তাঁরা চান বঙ্গদেশ দুর্বল হোক, তিব্বতে ভারতীয় বৌদ্ধধর্মের প্রভাব খর্ব হোক৷’
‘তাই নাকি পণ্ডিত? এটাই কারণ? নাকি এই দেশের রাজসিংহাসন আপনিই দখল করতে চান বলে এসব গালগল্প শোনাচ্ছেন আমাদের?’ শান্ত ও শীতলস্বরে প্রশ্ন করেন প্রকাশচন্দ্র৷
হঠাৎ যেন একটা ধাক্কা খেয়ে থেমে যান দয়িতবিষ্ণু। আকস্মিক এই অভিযোগের কারণ? এই আক্রমণের উৎস অনুমান করতে পারছিলেন। কিন্তু…কিন্তু সেসব তো এদের জানার কথা নয়!
‘এর মানে কী প্রকাশচন্দ্র?’
‘বটে? এর কারণ কী—সেটা বুঝতে পারছ না তুমি?’ দাঁতে দাঁত ঘষলেন সম্রাট বলভট, ‘ও হে অসতীভর্তা, তোমার নিজের পত্নী অন্যের অঙ্কশায়িনী হওয়ার সময়ে তুমি সেটা বুঝতে পারো তো?’
উজ্জ্বল রাজসভায় যেন হঠাৎই বিস্ফোরিত হল একরাশ গাঢ় অন্ধকার৷ এক ফেনিল অন্ধ আবর্তে, গহীন নিঃসীমতার মধ্যে, অনন্ত হাহাকারের মধ্যে তলিয়ে যেতে লাগল সব৷ তার আদি নেই, অন্ত নেই, ঊর্ধ্ব নেই, অধঃ নেই৷
‘কী হে পণ্ডিত, চুপ করে আছ কেন? নাকি তোমার স্ত্রী তোমার অনুমতি নিয়েই আমার পিতার শয্যার শোভা বাড়াতে গেছিলেন?’
‘রাজন, স্তব্ধ হন! এই কুবাক্য আপনার মুখে শোভা পায় না। মনে রাখবেন আপনি খড়্গবংশের মহান নৃপতি রাজভটের সন্তান। আমি শুধু রাজপণ্ডিতই নই, আপনার পিতার প্রিয় বয়স্যও বটে। আমার প্রতি এমন গর্হিত আচরণ…’
‘থামো হে কুচক্রী ব্রাহ্মণ, নপুংসক বিট। নিজের স্ত্রীকে উপহার দিয়ে যে নিজের প্রভুর প্রিয় হতে চায়, তার সঙ্গে কার তুলনা চলে জানো? দেহোপজীবিনীর দ্বাররক্ষীর!’ হিসহিস করে উঠল বলভটের বেপথু কণ্ঠস্বর৷
মুহূর্তের জন্যে মাথা নীচু করলেন দয়িতবিষ্ণু৷ শেষ পর্যন্ত হেরেই গেলেন তিনি, এই বিন্দু থেকে আর ফেরত যাওয়ার উপায় নেই৷ আপাতত নিয়তির হাতেই ছেড়ে দিতে হবে এই দেশের ভবিষ্যৎ৷ আরও কত মুহূর্ত যে এই মুহূর্তটির কাছে ঋণী হয়ে রইল, সে কথা একদিন ইতিহাস বলবে৷
‘এই অভিযোগের কারণ জানতে পারি সম্রাট?’ নির্লিপ্ত অবসাদে আশ্চর্য শীতল ও ধারালো শোনাল সর্বজনশ্রদ্ধেয় রাজপণ্ডিতের কণ্ঠস্বর৷
সম্রাটের হয়ে জবাব দিলেন প্রকাশচন্দ্র৷ মসৃণ স্বরে একইসঙ্গে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ আর বিপুল অপমান মিশিয়ে বললেন, ‘রাজপণ্ডিতের শাস্ত্রজ্ঞান অগাধ হলে কী হবে, কাণ্ডজ্ঞানের বড়ই অভাব দেখা যাচ্ছে৷ মনে হয় উনি বোধহয় ভাবেন যে, রাজ্যের লোকজন সব নির্বোধ, কেউই কিছু বোঝে না৷’
‘অনর্থক বাচালতা বন্ধ করুন প্রকাশচন্দ্র।’ সেই একই স্বরে উত্তর দিলেন দয়িতবিষ্ণু, ‘যা বলতে চান সরাসরি বলুন৷’
ধ্বক করে জ্বলে উঠল প্রকাশচন্দ্রের চোখদুটি, যেমন রাজগোক্ষুরোর মাথায় জ্বলে ওঠে দুটি রক্তমাণিক৷ দুজনেই দুজনের দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ৷
‘দয়া করে তাহলে কি রাজসভাকে জানাবেন পণ্ডিত দয়িতবিষ্ণু, আপনার পুত্রসন্তানটির প্রকৃত পিতা কে?’ চিবিয়ে চিবিয়ে প্রশ্ন করলেন প্রকাশচন্দ্র, ‘কেন বয়ঃপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে ফুটে উঠছে সম্রাট রাজভটের ছাপ? কোন জাদুবিদ্যায় দশ বছর বয়সি ব্রাহ্মণসন্তান তরবারি চালনায়, অশ্বচালনায় আর ধনুর্বিদ্যায় রাজ্যের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাদের সমকক্ষ হওয়ার শক্তি রাখে?’ একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটাতে লাগলেন তিনি, ‘উত্তর দিন পণ্ডিত৷ নিশ্চুপ থাকবেন না৷ আমাদের সন্দেহ যে, আপনি ও আপনার দুশ্চরিত্রা গৃহিণী মিলে খড়্গরাজসিংহাসন হস্তগত করার এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র রচনা করেছেন৷ রাজরক্তের উত্তরাধিকারের দোহাই দিয়ে বর্তমান সম্রাটের এক প্রতিস্পর্ধী…’
সভার মধ্যে প্রচণ্ড হট্টগোল শুরু হল৷ বিস্ময়ে, ক্রোধে, ক্ষোভে উঠে দাঁড়ালেন সভাসদেরা৷ আনন্দদত্ত কোষমুক্ত করলেন তাঁর তরবারি, বিশালকীর্তি তাঁর হাত ধরে আটকালেন তাঁকে৷ স্থিরবুদ্ধি বুদ্ধদাস অবধি উত্তেজিত হয়ে তথাগত’র নামে অভিশাপ দিতে উদ্যত হলেন প্রকাশচন্দ্রকে৷ মহাক্রুদ্ধ হয়ে উঠে দাঁড়ালেন মহাসামন্ত লোকনাথ৷ সমতটের রাতবংশ মহাপ্রতাপশালী সামন্তবংশ, তাঁরা দয়িতবিষ্ণুকে রাজগুরুতুল্য সম্মান দেন৷ তাঁদের যুবরাজ বলধারণ রাত প্রবল রাগে চিৎকার করে গালিগালাজ করতে লাগলেন৷ মহামাণ্ডলিক আর অন্যান্য অমাত্য সামন্তরা হতবুদ্ধি হয় ইতিউতি চাইতে লাগলেন৷ মহাপ্রতীহার বজ্রপাণি অত্যন্ত সতর্ক পুরুষ, তাঁর ইঙ্গিতে কয়েকজন দেহরক্ষী খোলা তরবারি হাতে সম্রাটকে ঘিরে দাঁড়াল৷
আর এইসবের মধ্যে দয়িতবিষ্ণু আর প্রকাশচন্দ্র দুই যুদ্ধরত সিংহের মতো পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলেন৷ চারপাশের এই বিক্ষুব্ধ পরিবেশ তাঁদের বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারল না৷
একবার হাত তুলে সভার কোলাহল শান্ত করলেন দয়িতবিষ্ণু, তারপর মৃদু হেসে সম্রাটকে বললেন, ‘সম্রাট যখন আমার ও আমার পরিবারের নামে এত বড় অভিযোগ তুলেছেন, তখন এই রাজসভায় আমার আর না থাকাই উচিত৷ তাই এই মুহূর্তেই আমি আমার যাবতীয় দায়িত্বভার ত্যাগ করছি৷ আশা করি সম্রাট তার অনুমতি দিতে দ্বিধা করবেন না৷’
‘আচ্ছা৷ তাই হবে পণ্ডিত৷ তোমার ইচ্ছাই মেনে নিলাম৷ এই রাজ্য থেকে এখনই দূর হয়ে যাও৷’ জড়িতস্বরে বললেন সম্রাট বলভট৷
‘শিরোধার্য৷ কাল ভোর হওয়ার আগেই আমি সপরিবারে এই রাজ্য ছেড়ে আমার জন্মভূমি বরেন্দ্রীর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করব৷ আশা করব খড়্গবংশের প্রতি আমার এতদিনের সেবা ও আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে সম্রাট আমাকে নিরুপদ্রবে ও নিঃশঙ্কচিত্তে দেশত্যাগের অনুমতি দেবেন৷ আমি এও অনুরোধ করব, অগ্রজতুল্য আনন্দদত্তকে যেন আমাকে সপরিবারে বঙ্গভূমির সীমানা অবধি ছেড়ে দিয়ে আসার আদেশ দেওয়া হয়৷’
চারুদত্ত ও প্রকাশচন্দ্র আপত্তি করে ওঠার আগেই সম্রাট গম্ভীরমুখে বললেন, ‘তথাস্তু৷’
গোপনে অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। বুদ্ধিমান পণ্ডিত সঠিক অনুমান করেছেন যে, যাত্রাপথেই গুপ্তঘাতকের হাতে সপরিবারে নিহত হতে পারেন তিনি৷ তাই আনন্দদত্তকে সঙ্গী হিসেবে চাইলেন৷ ওদিকে চারুদত্ত আর প্রকাশচন্দ্রের মুখে স্পষ্টই হতাশার ছায়া৷ লোকটাকে কারাগারে বদ্ধ করে গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা যে এইভাবে বানচাল হয়ে যাবে—তা ভাবতেও পারেননি তাঁরা৷ তাঁদের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে সামান্য হাসলেন আনন্দদত্ত। তিনি সঙ্গে থাকতে দয়িতবিষ্ণুর কেশাগ্র স্পর্শ করে—এমন সাহস এই রাজ্যে কারও নেই৷ তার পরেই একবার গভীর বেদনায় চোখ বুজলেন তিনি৷ অনুজপ্রতিম এই পণ্ডিতকে বড় ভালোবাসেন আনন্দদত্ত৷
‘আরও শুনুন সম্রাট৷ আপনি কথা দিয়েছেন যে, আমাকে বিনা উপদ্রবে সপরিবারে রাজ্যের সীমানা অতিক্রম করতে দেবেন৷ প্রতিশ্রুতিভঙ্গের মতো গর্হিত কাজ যে সম্রাট রাজভটের পুত্র করবেন না—সে বিশ্বাস আমার আছে৷ তাই সেই বিশ্বাসে ভর হয়েই একটি সত্য আপনাদের জানিয়ে যাই৷’
প্রত্যেকে নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইলেন দয়িতবিষ্ণুর দিকে৷ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন প্রকাশচন্দ্রও৷
‘পরম মিত্র প্রকাশচন্দ্র যা বলেছেন তা সত্য বটে…’
সমস্ত সভা মূক ও উদগ্রীব!
‘কিন্তু অর্ধসত্য!’
সভাস্থ প্রতিটি সভ্যকে দেখে মনে হল যেন কৌতূহল আর বিস্ময়ের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছেন তাঁরা৷ প্রত্যেকের মুখে হতভম্ব অবিশ্বাসের ছাপ৷
‘আমার পুত্র আমার ঔরসজাত নয় এ কথা সত্য৷ এই বালকের দেহে বইছে প্রয়াত সম্রাট রাজভটের রক্ত, তাও সত্য৷’
রাজসভা স্তব্ধ, হতবুদ্ধি। এ কী স্বীকারোক্তি করছেন রাজপণ্ডিত?
‘কিন্তু সম্রাট,’ একটু থেমে মৃদু হেসে বললেন দয়িতবিষ্ণু, ‘এই বালক যেমন আমার ঔরসজাত নয়, তেমন আমার স্ত্রীর গর্ভজাতও নয়!’
.
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন