অভীক সরকার
বজ্রযোগিনী মন্দিরের সামনে ঘোষক উপস্থিত হতেই তার চারিপাশে ভিড় করে এল অপেক্ষমান জনতা। যদিও তারা জানে, কী ঘোষণা করা হতে চলেছে। তারা জানে যে এই ঘোষণার ফলাফল কী, জানে এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। তা সত্বেও এই পাক্ষিক ঘোষণা শোনার জন্য উৎসুক দর্শকের অভাব হয় না।
এককালে এই পাক্ষিক ঘোষণার পর পরেই কোনও এক বলিষ্ঠ যুবক এগিয়ে যেত ঘোষকের দিকে, ব্যক্ত করত তার মনোবাঞ্ছা। তার দু’চোখে থাকত স্বপ্ন, হৃদয়ে দুঃসহ স্পর্ধা, আকাঙ্ক্ষায় দুর্বার উচ্চাশা। সে নিশ্চিত থাকত যে মাত্র একরাত মহারানিকে তৃপ্ত করতে পারলেই এই বঙ্গদেশের অধীশ্বর হবে সে।
তখন উপস্থিত জনগণ উত্তেজনায় উদ্বেলিত হতো, উৎসাহিত হতো। ভাবত, সত্যই বুঝি এই দেশে এমন কেউ আছে, যে নিজ পৌরুষবলে উদ্ধার করবে এই দীর্ণ বঙ্গভূমি। এমন কেউ আছে, যার বাহুবলে ভর করে উঠে দাঁড়াবে এই ছিন্নক্ষিপ্ত দেশ৷ তার দৃপ্ত শাসনের অধীন হবে সমতট থেকে পৌণ্ড্র, হরিকেল থেকে তাম্রলিপ্ত।
কিন্তু দিনে দিনে সেই আশা ক্ষীণ হতে হতে কবেই মিলিয়ে গেছে। এখন প্রতি পক্ষকালে ঘোষক আদেশানুসারে বজ্রযোগিনী মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ায় বটে, উপস্থিত জনতাও অভ্যাসানুসারে তার সামনে এসে দাঁড়ায়; কিন্তু এখন তাদের উপস্থিতির সঙ্গে এক অর্থহীন তিক্ত নৈর্ব্যক্তিকতা মিশে গেছে।
বহুকাল হল ঘোষকের ঘোষণা শুনে আর কোনও স্পর্ধিত যুবক আসে না। সবাই জেনে গেছে এই অর্থহীন প্রচেষ্টার ফলাফল কী। এখন তাই জনসাধারণ আসে শুধুমাত্র রঙ্গ দেখতে। তারাও জানে, ঘোষকও জানে—এই ঘোষণার কোনও মূল্য নেই। কেউ স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসবে না ওই নাগিনীর ভোগ হওয়ার জন্য।
হ্যাঁ, ভোগ। এই অনুষ্ঠান এখন কেবলমাত্র বঙ্গদেশের মহারানির কামভোগের আয়োজন ছাড়া আর কিছু নয়।
এখন রাজসেবকের দল প্রতি গ্রামে, প্রতি পল্লীতে হিংস্র শ্বাপদের মতো শিকার করে বেড়ায় সমর্থ কিশোর বা যুবকের। তারা জানে যে, প্রতি পূর্ণিমা অথবা অমাবস্যায় বঙ্গদেশের মহারানির একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ-শরীরের প্রয়োজন হয়। তারা জানে যে, রানির পূর্ণ কামতৃপ্তির পর রাজ্যশাসনের অধিকারের আশ্বাস কেবল একটি ফাঁদ মাত্র, মোহজাল। যেভাবে নারী ঊর্ণনাভ কামতৃপ্তির পর, উদ্দেশ্যসাধনের পর, তার পুরুষসঙ্গীটিকে উদরসাৎ করে, সেভাবেই এই কালনাগিনী তার এক রাতের পুরুষসঙ্গীটির জীবনদীপ নির্বাপিত করেন।
ঘোষক তার অভ্যাসানুসারে উচ্চনাদে ঢোলক বাজাতে লাগল। তার পাশে বেশ কয়েকজন রাজসেবক। তাদের শীতল ও সতর্ক চোখগুলি যেন কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। জনতা অপেক্ষা করতে লাগল বহুশ্রুত বাক্যগুলির জন্য।
বেজে উঠল দ্রিমি দ্রিমি রব!
‘শোনো শোনো শোনো বঙ্গবাসী। শ্রীমন্মাহারাজসচিব প্রকাশচন্দ্রের আদেশানুক্রমে ঘোষণা করা হচ্ছে যে, বঙ্গদেশের রাজসিংহাসন একজন সম্রাটের জন্য উৎসাহোন্মুখ। বঙ্গদেশের মহামান্যা মহারানি কামমতি হয়েছেন। যে সক্ষম যুবা একরাত্রের জন্য মহারানিকে পূর্নতৃপ্তির সন্ধান দিতে পারবে, সেই হবে বঙ্গদেশের পরবর্তী সম্রাট। স্বয়ং বঙ্গসম্রাজ্ঞী তাঁর অগ্রমহিষী হবেন, রাজসচিব হবেন তাঁর বিশেষ কিঙ্কর। এই আসমুদ্রহিমাচলব্যাপী বঙ্গদেশ তাঁর শাসনাধীন হবে। বঙ্গদেশের অনন্তসামন্তচক্র হবেন তাঁর আজ্ঞাবহ বশংবদ দাস। শোনো শোনো শোনো, তোমাদের মধ্যে যাঁরা এই সৌভাগ্যের অংশীদার হতে চাও, তাঁরা এই মুহূর্তেই আমাদের সামনে এসো। এই সুযোগ নষ্ট কোরো না, এই আহ্বানের পূর্ণ উপযোগ…’
একটি বলিষ্ঠদেহী তরুণ ভিড় ঠেলে সামনে এসে বলল, ‘ঘোষক, আমি এসেছি। আমি এই সুযোগের সুবিধা নিতে উৎসুক। আমাকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে চলো।’
ঘোষক এতই অবাক হয়ে গেল যে তার বাক্যস্ফূর্তি হল না। তার স্মরণে নেই শেষ কবে কোন আত্মঘাতী মূর্খ এই প্রস্তাবে আগ্রহ দেখিয়ে এগিয়ে এসেছে। সবাই জানে এই আহ্বানে সাড়া দেওয়া মানে সাক্ষাৎ মৃত্যুর পথে চলে আসা। সে যুবকের দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।
যুবকের বামপার্শ্বে এক খর্বকায় তরুণী। তার খরতীব্র চোখ দর্শকের অস্বস্তি জাগায়। তরুণীর ঠিক পিছনে এক পিঙ্গলকেশ তপ্তকাঞ্চনবর্ণ সুদেহী সুপুরুষ যুবা। তার সামান্য পেছনে এক যুবতী। যুবতীর চেষ্টাকৃত ছদ্মবেশ তাঁর অনুপম স্নিগ্ধলাবণ্যকে লুকিয়ে রাখতে পারেনি। তাঁর শান্ত চোখদুটি দেখে বর্ষাশেষের দিঘির কথা মনে পড়ে। যুবতীটির ঠিক ডানপাশে এক দৃপ্তদর্শন তাম্রাভবর্ণ পুরুষ। তাঁর সবল সুঠাম দেহে, পদ্মপলাশতুল্য আঁখিতে, গর্বোদ্ধত গ্রীবায়, এবং সতর্কচঞ্চল দৃষ্টিতে বোঝা যায় যে, ইনি সামান্য কেউ নন।
ঘোষকের সামান্য পিছনে দুজন মানুষ দাঁড়িয়েছিল। তাদের আপাত উদাস মুখে এখন খরতীক্ষ্ণদৃষ্টি। প্রথমজন প্রশ্ন করল, ‘ইনিই গোপালদেব?’
মাধব উত্তর করল, ‘হ্যাঁ রঙ্গলাল, ইনিই গোপালদেব।’
‘কী করে বুঝলে?’
‘মূর্খের মতো প্রশ্ন করো না। এই মহাবল পুরুষটিকে আমি স্বচক্ষে দেখেছি। কমলাঙ্ক গ্রাম সন্নিহিত অরণ্যে ইনি একাই আমাদের সংহার করেছিলেন। কোনওমতে প্রাণ হাতে পালিয়ে এসেছিলাম। আমি ওঁকে চিনব না?’
‘কিন্তু উনি তো একা নন মনে হচ্ছে৷ ওই যে সুদেহী তাম্রবর্ণ পুরুষটিকে দেখছ, ওঁকে আমি নিজের চোখে দেখেছি। উনিই কুমার পদ্মসম্ভব।
‘কিন্তু ওঁর আশেপাশে বাকি যাঁরা আছেন তাঁদের চেন?’
‘পদ্মসম্ভবের পাশে যিনি আছেন, খুব সম্ভবত ভিক্ষুণী মন্দর্ভা। আর ওই পিঙ্গলকেশী গৌরবর্ণ পুরুষটি কুমার জয়াপীড় ব্যতীত আর কেউ হতে পারেন না। কুমার গোপালদেবের পাশে যে তরুনীটি আছে তাঁকে চিনি না। গুপ্তচরেরা সংবাদ এনেছে, হরিকেলের মহামাত্য জয়নাথের সেই অপহৃতা ভাগিনেয়ী নাকি অলৌকিক মন্ত্রবলে জীবিত হয়ে ফিরে এসেছে, যোগ দিয়েছে এই বিদ্রোহীদের সঙ্গে৷ এই তরুণী জয়নাথের ভাগিনেয়ী হলে আশ্চর্য হব না।’
রঙ্গলাল নিমেষে উত্তেজিত হল, ‘তাহলে তো কুচক্রীরা প্রায় সবাই একই সঙ্গে এখানে উপস্থিত৷ রাজসেবকদের ইঙ্গিত করা হোক। এই মুহূর্তে এদের বন্দি করি।’
মাধব দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘ধৈর্য ধরো মিত্র। এই আত্মঘাতী হঠকারিতার কোনও প্রয়োজন নেই। প্রথমত এরা নিরস্ত্র আসেনি এখানে। এদের প্রশিক্ষিত গুপ্তবাহিনীও আশেপাশেই আছে। তারা মুহূর্তে প্রত্যাঘাত করবে। তাতে গোপালদেবকে এদের থেকে বিচ্ছিন্ন করার মূল উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে।
‘দ্বিতীয়ত, আচার্য শান্তরক্ষিত এবং মহাবল বপ্যট সহ রাজদ্রোহের কাণ্ডারীদের অন্য অনেকেই এখানে অনুপস্থিত। তাদের জন্য প্রকাশচন্দ্র অন্য পরিকল্পনা করেছেন।
‘তৃতীয়ত, প্রকাশচন্দ্রের আদেশ, পুরো ক্রিয়াকাণ্ডটিই যেন নিশ্চুপে সাধিত হয়। তিনি চান না এই নিয়ে কোনও উচ্চকিত গোলযোগ হোক।’
রঙ্গলাল চুপ করে গেল।
গোপালদেবকে সামান্য কৃশ এবং দুর্বল দেখাচ্ছিল। তিনি এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই তাঁর পাশে দাঁড়ানো তরুণীটি সবার অলক্ষ্যে তাঁর হাত চেপে ধরল, ‘কুমার…’
গোপালদেব কিছু বললেন না, দেদ্দদেবীর হাতখানি দুর্বলহাতে চেপে ধরলেন।
‘সাবধানে..’
‘জানি আর্যা…’
‘আর্য কমলশীলের আনা যন্ত্রটি…’
‘সঙ্গে আছে আর্যা। ও নিয়ে চিন্তিত হবেন না।’
দেদ্দদেবীর হাত ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন গোপালদেব। তর্জনী থেকে তর্জনীর ছোঁয়াটুকু মিলিয়ে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে দেদ্দদেবী পুনরায় চেপে ধরলেন গোপালদেবের অঙ্গুলি। গোপালদেব থমকে গেলেন।
‘কুমার!’
‘বলুন দেবী!’
ওই কামুক ডাকিনীর সঙ্গে যেন…’
ত্বরিতে দেদ্দদেবীর দিকে ফিরে তাকালেন গোপালদেব। সেই দৃষ্টিতে কতখানি কৌতুক, কতখানি স্নেহ, আর কতখানি ভালোবাসা মিশে ছিল বলা অসম্ভব। দু’খানি পদ্মনয়ন চেয়ে রইল গোপালদেবের সতৃষ্ণ আঁখির দিকে।
ফিসফিস করে গোপালদেব বললেন, ‘আমার দেহ, মন, আত্মা আপনারই দেবী, শুধু আপনারই। ওই বিদেশি নাগিনীর কী সাধ্য, আপনার নৈবেদ্য অপবিত্র করে?’
তর্জনি হতে তর্জনি বিযুক্ত হল। গোপালদেব ধীরপদে এগিয়ে গেলেন ঘোষকের দিকে।
.
নিজের শয্যায় স্থির এবং নিশ্চুপ হয়ে বসে ছিলেন প্রকাশচন্দ্র। তাকিয়ে ছিলেন নিজের প্রসারিত করতলের দিকে।
ঘরটি আশ্চর্যজনকভাবে অতি সাধারণ; প্রসাধন এবং আভরণহীন। বঙ্গদেশের সর্বময় কর্তা যে এরকম নিরলঙ্কার, নিরাভরণ ঘরে থাকতে পারেন সে না দেখলে বিশ্বাস হয় না।
প্রকাশচন্দ্র অনাড়ম্বর জীবনে বিশ্বাস করেন। তাঁর কাছে জাগতিক জীবনের যাবতীয় উল্লাস, আড়ম্বর, বিলাস, ব্যসন সবই অর্থহীন। তাঁর জীবনের একটিই উদ্দেশ্য, একটিই লক্ষ্য, বঙ্গভূমির সামূহিক সর্বনাশ। তিনি চান না কোনও পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আহ্বান তাঁকে তাঁর লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করুক। তিনি জানেন—তাঁর পুরষ্কার ইহজীবনে নয়, লব্ধ হবে জন্মমৃত্যুর আবর্তনচক্রের চংক্রমণে।
নিজের দুই করতলের দিকে তাকিয়ে ছিলেন প্রকাশচন্দ্র। তাঁর করতল প্রশস্ত ও সুন্দর। শুক্র এবং বৃহস্পতির স্থান সুউচ্চ। রবি অতি বলশালী, চন্দ্রমা ম্রিয়মান। শনি স্তিমিত এবং বক্রী। মঙ্গলের স্থান উচ্চ এবং দৃশ্যত রক্তিম।
কিন্তু করতল নয়, প্রকাশচন্দ্র তাকিয়েছিলেন তাঁর আঙুলগুলির দিকে। দুই হাতে দশটি আঙুল। বৃদ্ধাঙ্গুলি বাদ দিলে আটটি।
সপ্তরাজন্য আর মহারাজ্ঞী। আটজন। আটটি আঙুল।
নিজের হাতের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে ছিলেন প্রকাশচন্দ্র। দুই হাতের তর্জনীদুটি বাদে বাকি ছয়টি আঙুল ঘনকৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে।
প্রকাশচন্দ্র জানেন—এর অর্থ কী। ওই ছয় জন মৃত। এই মুহূর্তে একমাত্র তিনি আর রানি, এই ছাড়া তাঁর ঘনিষ্ঠবৃত্তের আর কেউ বেঁচে নেই। একমাত্র বিশুদ্ধকীর্তি ছাড়া। বিশুদ্ধকীর্তি!
একটি তিক্ত হাসির রেখা খেলে গেল প্রকাশচন্দ্রের মুখে। শত্রুর শেষ রাখেন না তিনি। তাঁর কাছে বিশুদ্ধকীর্তি ইতিমধ্যেই মৃত। আজকের রাতটিই আচার্যর জীবনের শেষ রাত।
রাজমাতা ইয়ু জেতিয়ান যে ক’টি অতি গুহ্য নাগসিদ্ধির অধিকার দিয়েছিলেন প্রকাশচন্দ্রকে, এইটি তার অন্যতম। ঘনিষ্ঠবৃত্তের প্রাণচিহ্ন ধারণের অধিকার। সপ্তরাজন্য আর রানি নিজে, যে আটজন মিলে এই প্রকাণ্ড মাৎস্যন্যায়ের আয়োজন করেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের প্রাণচিহ্ন নিজ অঙ্গুলিদর্পণে ধারণ করেন তিনি।
নিজের হাতের প্রায় শুকিয়ে আসা ছ’খানি কালো আঙুলের দিকে নিরাসক্ত ভাবে চেয়ে ছিলেন প্রকাশচন্দ্র। এই মুহূর্তে শুধু তিনি আর রানি, এই দুজনেই বেঁচে আছেন নাগমাতা ইয়ু জেতিয়ান আর তাং রাজবংশের শতাব্দীপ্রাচীন স্বপ্ন সফল করার জন্য৷ তাঁদের পাশে আর কেউ নেই।
এই যুদ্ধ তাঁদের জিততেই হবে। যেনতেন প্রকারেণ।
দ্বারে সামান্য শব্দ হল। কেউ তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। প্রকাশচন্দ্র জানেন কে সে।
‘বলো মাধব।’
দ্বারপ্রান্ত থেকে উত্তেজিত স্বর ভেসে এল, ‘গোপালদেব রাজ্ঞীর প্রাসাদে প্রবেশ করেছেন প্রভু। চূড়ান্ত আক্রমণের আদেশ দেওয়া হোক?’
হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালেন প্রকাশচন্দ্র। এই আক্রমণ, এই যুদ্ধ তিনিই পরিচালনা করবেন। প্রথম এবং হয়তো শেষবারের মতো।
.
দ্বিপ্রাহরিক আহারের ব্যবস্থা অতি সাধারণ। উপস্থিত কারোরই ইচ্ছে ছিল না আহার করার। কিন্তু মৎস্যেন্দ্রনাথ জানেন খালি পেটে যুদ্ধ হয় না।
সমস্ত ব্যবস্থা দেখাশোনা করছিলেন মন্দর্ভা এবং দেদ্দদেবী৷ দেদ্দদেবীর মুখখানি ছলছল৷ সবার মুখ গম্ভীর, ভেতরে চাপা উত্তেজনা।
বপ্যট বললেন, ‘দুপুরের পর থেকেই তাহলে আক্রমণ শুরু হোক?’
মৎস্যেন্দ্রনাথ মাথা নেড়ে সায় দিয়ে সামনে রাখা অন্নপাত্রটি টেনে নিলেন। প্রথম গ্রাস মুখে তুলতে যাবেন, এমন সময় দরজার কাছে ত্রস্ত পদশব্দ। কারা যেন দৌড়ে আসছে। উপস্থিত সদস্যরা সতর্ক হলেন। জয়াপীড় এবং পদ্মসম্ভব উঠে দাঁড়ালেন। কারা আসছে?
তাঁদের বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। শালিবন বিহারের দুজন শিক্ষার্থী হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে লোকেশ্বর, সর্বনাশ হয়ে গেছে।’
প্রত্যেকে নিমেষের মধ্যে উঠে দাঁড়ালেন। শান্তরক্ষিত ব্যগ্রস্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘কী হয়েছে?’
‘সর্বনাশ হয়েছে আচার্য, আমরা অত্যন্ত কুৎসিতভাবে প্রতারিত হয়েছি। ওরা জেনে গেছে—আপনারা এখানেই আছেন, এই শালিবন বিহারেই। ওরা এদিকেই আসছে।’
‘ওরা বলতে কারা?’ এগিয়ে এলেন বপ্যট।
‘রাজসেবকদল, আর…আর…’
‘আর?’
‘তাদের নেতৃত্বে আর কেউ না, স্বয়ং প্রকাশচন্দ্র।’
উপস্থিত প্রত্যেকে বিপুলভাবে চমকিত হলেন। পদ্মসম্ভব দ্রুতবেগে এগিয়ে এলেন, তীব্রস্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘আচার্য বিশুদ্ধকীর্তি কোথায়?’
শিক্ষার্থী দুজনের একটু পেছন থেকে কে যেন বিষণ্ণ গম্ভীর স্বরে বলে উঠল, ‘আচার্য বিশুদ্ধকীর্তি নেই রাজকুমার৷ তিনি পালিয়েছেন। সঙ্গে পালিয়েছে তাঁর পোষ্য রক্ষিতাটিও। এবং শুধু তাই নয়, সেই সঙ্গে নিয়ে গেছেন শালিবন বিহারে রক্ষিত ধনসম্পত্তির একটি অতি বিপুল অংশও।’
সবাই তাকিয়ে দেখলেন এসে দাঁড়িয়েছেন শালিবন বিহারের উজ্জ্বলতম শিক্ষার্থী সিদ্ধার্থশর্মা। বিশুদ্ধকীর্তি বা বুদ্ধগুপ্ত’র অবর্তমানে বিহারের যাবতীয় দায়িত্বকর্ম ইনিই নির্বাহ করেন।
পদ্মসম্ভব অক্ষম আক্রোশে সজোরে পদাঘাত করলেন সামনে রাখা ত্রিপদীটির ওপর। সেটি মুহূর্তের মধ্যে ত্রিধাবিভক্ত হয়ে আছড়ে পড়ল সামনের দেওয়ালে। মন্দর্ভা দ্রুত এগিয়ে এসে পদ্মসম্ভবের হাত ধরলেন।
শান্তরক্ষিতের মুখ পাণ্ডুরবর্ণ ধারণ করল। তিনি ভয়ার্তস্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘এবার কী হবে?’
মৎস্যেন্দ্রনাথ চুপ করে ছিলেন। তিনি উত্তরীয়টি কোমরে বাঁধলেন। তারপর শান্ত এবং দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘এবার সংগ্রাম হবে ভন্তে, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম। আজ মুক্তির মন্দিরের সোপানতল আমাদের রক্তে রঞ্জিত হবে। বহু প্রতীক্ষিত সেই সময় আজ এসেছে ভন্তে, প্রস্তুত হন। আর্য বপ্যট, আপনার সেনাদল প্রস্তুত তো?’
‘তারা প্রস্তুত প্রভু। কিন্তু তাদের কাছে সংবাদ পৌঁছতে কিছু সময় লাগবে। ততক্ষণ রাজসেবক-বাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করে রাখতে হবে আমাদেরই।’
‘কুমার পদ্মসম্ভব? কুমার জয়াপীড়?’
সিংহবিদারী মহাবীর জয়াপীড়ের মুখমণ্ডল আনন্দে ঝলমল করছিল। তিনি প্রকাশচন্দ্রের মহাখড়্গ কোষ হতে নিষ্কাষিত করে বললেন, ‘আদেশ দিন লোকেশ্বর, শত্রুশোনিতে এই মহাখড়্গ স্নান করাই। পিতামহের পাপস্খালন করি। হর হর মহাদেব।’
পদ্মসম্ভব ইতিমধ্যেই অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর কোমরে কুঠার এবং দা’ও। পিঠে তূনীর, হাতে নাগাঞ্চিভূমির খর্ব এবং অতি শক্তিশালী ধনু। তিনি শান্তস্বরে বললেন, ‘আহা, কতদিন পর প্রত্যক্ষ সংগ্রামে যাব, শত্রুরক্তে স্নান করব, হত্যামদে মাতাল হব। আদেশ করুন লোকেশ্বর, যেন শত্রুঘ্ন হই।’
বপ্যট ধীরেসুস্থে তাঁর বহুযুদ্ধের সঙ্গী বিশালাকার খড়্গটি নিষ্কাশিত করলেন। তারপর ধীরস্বরে বললেন, ‘দেবী চুন্দার সেবা করেছিলাম বহুদিন। দেবী প্রসন্ন হয়ে আমাকে দুটি অস্ত্র দান করেন। এক, গোপালদেব, আর দুই, এই খড়্গ। এই অস্ত্র মন্ত্রঃপূত, আজ অবধি শোনিতপান না করে কোষবদ্ধ হয়নি৷ আসুন লোকেশ্বর, এই প্রৌঢ়ের যুদ্ধকৌশল না হয় স্বচক্ষেই দেখে যান।’
মৎস্যেন্দ্রনাথ উজ্জ্বল চোখে সবার দিকে তাকালেন। দেদ্দদেবী ইতিমধ্যেই অস্ত্রসাজে সজ্জিত হয়েছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে যেন স্বয়ং দেবী একজটা সমরে অবতীর্ণ হতে চলেছেন। এমনকি আচার্য শান্তরক্ষিত এবং ভিক্ষুণী মন্দর্ভাও তুলে নিয়েছেন দুটি ত্রিশূল। এই ত্রিশূল মৎস্যেন্দ্রনাথ এবং তাঁর অনুগত শৈবযোগীদের যুদ্ধাস্ত্র।
নিজ নিজ অস্ত্র হাতে উঠে দাঁড়ালেন প্রত্যেকে। হুঙ্কার দিলেন, ‘জয় গৌড়, জয় বঙ্গ, জয় শশাঙ্ক।’
.
প্রশস্ত অলিন্দ ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলেন গোপালদেব। অল্প শীত করছিল তাঁর। প্রাসাদের এই প্রান্তে তেমন রোদ আসে না। চারিদিকে অন্ধকার স্যাঁৎস্যাঁতে ভাব।
তাকাতে তাকাতে বিস্মিত হচ্ছিলেন তিনি। কত মহার্ঘ আভরণে সাজানো এই প্রাসাদ। কত অনুপম দ্রষ্টব্যবস্তু ব্যবহৃত হয়েছে এই প্রাসাদ সাজিয়ে তুলতে। চারিদিকে থরেবিথরে কত না শিল্পসৌন্দর্যের আয়োজন।
অথচ বঙ্গদেশের অর্ধেক মানুষ নিরন্ন, অনাহারক্লিষ্ট। তাদের জীবনের নিরাপত্তা নেই, অন্নের সংস্থান নেই। কিন্তু তাই বলে বঙ্গদেশের রাজপ্রাসাদের অলঙ্করণে বিন্দুমাত্র শৈথিল্য হয়নি।
হাঁটতে হাঁটতে আরও একটি বিষয় অনুভব করলেন গোপালদেব। এখন বেলা দ্বিপ্রহর। সচরাচর এইসময় রাজপ্রাসাদে মানুষজনের আনাগোনা, কর্মব্যস্ততা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু এই অংশটি একেবারে নির্জন। রঙ্গলাল নামের রাজকর্মচারীটি তাঁকে এখানে ঢুকিয়ে দিয়ে ইঙ্গিতে সামনের পথ দেখিয়ে সেই যে চলে গেছে, তারপর থেকে আর একটিও মানুষের দেখা পাননি তিনি।
আশ্চর্য! এত বড় রাজপ্রাসাদে আর মানুষ নেই? নাকি কেউ সামনে আসছে না? পথ নির্দেশ করে দেবে এমন কেউও তো নেই!
অবশ্য পথনির্দেশের তেমন প্রয়োজন ছিল না। অলিন্দটি এঁকেবেঁকে তাঁকে নিয়ে যাচ্ছে নির্দিষ্ট দিকেই।
একটু পরেই অলিন্দপথ শেষ হল। সামনে একটি বিশালাকৃতির দ্বার। তার দেহ বিবিধ কারুকার্য খচিত।
গোপালদেব বুঝতে পারলেন, ক্রীড়ার অন্তিমচরণে এসে উপস্থিত হয়েছেন তিনি। কোমরে হাত দিয়ে একবার অনুভব করে নিলেন, কমলশীলের সযত্নে আনা তিব্বতী যন্ত্রটি সঙ্গে আছে তো?
মনে মনে একবার গৃহদেবী চুন্দার পাদবন্দনা করে নিলেন গোপালদেব। তারপর সুদৃশ্য দ্বার হাত দিয়ে ঠেলে দিলেন।
ঘরের ভিতরটি সুঘ্রাণ ধূমে পরিপূর্ণ। কিছু দেখা যায় না। চারিদিক বড় মায়াময়। সেই মায়াবী ধূম্রজালের মধ্য হতে দুজন অতি অপূর্ব সুন্দরী কিঙ্কিণী বেরিয়ে এসে গোপালদেবের দুই হাত ধরল, ‘আসুন কুমার, আসুন। মহারানি আপনারই অপেক্ষায় আছেন।’
.
চণ্ডকীর্তি অতি করুণদৃষ্টিতে বনচর সঙ্গীটির দিকে তাকাল। সেই দৃষ্টিতে কাতর অনুনয়ের সঙ্গে মিশে ছিল অনেকখানি অসহায়তাও।
বনচর শবর অবশ্য বিন্দুমাত্র করুণাবিগলিত হল না। কর্কশ স্বরে বলল, ‘তাড়াতাড়ি চল। আমাদের আজ বিকেল বা সন্ধের মধ্যেই যে করে হোক সেখানে পৌঁছতে হবে। প্রকাশচন্দ্র স্বয়ং অপেক্ষা করে আছেন সেখানে। নইলে তুই তো জানিস, আমাদের অনেকেই তোর নধর দেহটার দিকে তাকিয়ে আছে।’
কথাটা শুনেই মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল চণ্ডকীর্তির। এই বিকট, উলঙ্গ নারীবাহিনীর পিছনে পিছনে যারা আসছে, তারা তো আরও ভয়াবহ! তাদের মধ্যে চণ্ডকীর্তিকে একবার ছেড়ে দিলে তো তার দেহের একটি অংশও খুঁজে পাওয়া যাবে না!
শিবাদল! চণ্ডকীর্তি আজ অবধি কখনও দেখেনি যে হিংস্র শিবাদলকেও পোষ মানানো যায়!
সামনে লালিম্ববনের গোপন গিরিখাত। এই পথে অতি দ্রুত শালিবন বিহারের প্রধান দ্বারে উপস্থিত হওয়া যায়। আচার্য বিশুদ্ধকীর্তি এবং মহারাজসচিব প্রকাশচন্দ্র বাদে অতি অল্প কয়েকজনই এর সন্ধান রাখেন।
করুণ চোখে সঙ্গী শবরটির দিকে একবার তাকিয়ে সেই পথে পা রাখল চণ্ডকীর্তি।
.
মৎস্যেন্দ্রনাথ এবং অন্যরা শালিবন বিহারের সামনের প্রান্তরে উপস্থিত হয়ে দেখলেন সামনের প্রান্তর শূন্য। শুধু লালিম্ববন পাহাড়ের দিক থেকে ধেয়ে আসছে প্রবল বাতাস।
একটু পর একটি অতি ক্ষীণ শব্দ শোনা গেল। হস্তীর বৃংহণ।
তারপর শব্দগুলি আরও স্পষ্ট হতে লাগল। সৈন্যদের ছন্দোবদ্ধ পায়ের শব্দ। রণহুঙ্কার। ঢাকের শব্দ। লালিম্ববনের পাহাড় ছুঁয়ে আসা বাতাসে এবার মিশতে থাকল ভয়। যেমন স্বচ্ছতোয়া নদীজলে মেশে রক্তের ধারা৷ ধীর, কিন্তু অবশ্যম্ভাবী।
একটু পর দিগন্তের ঠিক মধ্যস্থানে দেখা গেল একটি দীর্ঘ লাঞ্ছনের শীর্ষাংশ। চন্দ্রবংশের শাসনদণ্ডের অগ্রভাগ।
একটু পর উজ্বল নির্মল আকাশের বুকে আস্তে আস্তে ফুটে উঠল চন্দ্রশাসনদণ্ডের সম্পূর্ণ অবয়ব। একটি অর্ধচন্দ্র, এবং একটি বজ্র।
তারপর দেখা দিল একটি মস্তক। একটি অতি বৃহৎ হস্তীর মস্তক। বঙ্গদেশের হস্তীবাহিনীর প্রধানতম, বিশালতম এবং ভয়ালতম অস্ত্র বজ্রঘণ্টা’র মাথা।
তারপর ফুটে উঠল মানুষের মাথা। একটি দুটি করে তারা দিগন্তের প্রেক্ষাপটে ফুটে উঠতে লাগল ঘোর অশনির মতো। এবার যুদ্ধহুঙ্কার আর ঢাকের শব্দ আরও প্রবল হয়ে উঠল। আরও ভয়ঙ্কর। আরও ভয়াবহ।
আর সবার শেষে দেখা গেল সেই ষণ্ডবাহিত রথটি। তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন প্রকাশচন্দ্র। অশনি সঙ্কেতের মতো। স্থির বজ্রপাতের মতো। মহাকালের উদ্যত মহাশূলের মতো। একা। নিঃসঙ্গ। ভয়ঙ্কর৷
বপ্যট উচ্চস্বরে আদেশ দিলেন, ‘প্রত্যেকে একত্রিত হন। অস্ত্র হাতে নিন। আমাদের দুই পাশ রক্ষা করবেন পদ্মসম্ভব এবং জয়াপীড়৷ লোকেশ্বর মৎস্যেন্দ্রনাথ মধ্যস্থলে থাকবেন৷ আর সামনে থাকব আমি। দেদ্দদেবী, আপনি আমার ডানপাশে থাকুন। মনে রাখবেন, বিচ্ছিন্ন হওয়া মানেই মৃত্যু।’
সন্ন্যাসী এবং যোগীদের দল নিজেদের অবস্থান সংহত করলেন। ত্রিশূলের গলায় বাঁধা ঘণ্টাগুলি ঝনঝন করে উঠল রৌদ্রস্নাত স্পর্ধার মতো।
বপ্যট বললেন, ‘আমাদের শবরবাহিনীর কাছে সংবাদ পাঠানো হয়েছে। তাদের এসে পৌঁছতে এক দণ্ডের কিছু অধিক সময় লাগবে৷ ততক্ষণ যে করে হোক এদের আক্রমণ প্রতিরোধ করে রাখতে হবে। সঙ্গীরা, মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য, ন্যায়ের জন্য এবং ধর্মের জন্য ঐক্যবব্ধ হও।’
প্রবল রণহুঙ্কার এবং ঢাকবাদ্যসহ ধীরে ধীরে রাজসেবকদল তাঁদের সামনে এসে দাঁড়াল। তাদের চোখ শান্ত, শীতল ও ক্রূর। তাদের সর্বাঙ্গ বিচিত্র যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত। আর প্রত্যেকের ডানবাহুতে একটি ক্ষুদ্র তাম্রফলক বাঁধা।
তাম্রফলক দেখেই চিনলেন বপ্যট। এরা কালকূট বাহিনী৷ রাজসেবকদের মধ্যেও বিশিষ্টতম ঘাতক গোষ্ঠী।
কালকূট বাহিনীর ঠিক সামনে সেই দুর্মদ রণহস্তী বজ্রঘণ্টা৷ তার বিশাল দন্তদুটি লৌহকণ্টকে আবৃত৷ চোখ রক্তবর্ণ। অল্প অল্প মাথা নাড়ছে সে। একবার মাহুতের ইশারা, ব্যস। এই অল্প কয়েকজন বিদ্রোহীদের পায়ের তলায় পিষে মারতে সে একাই যথেষ্ট।
বাহিনীর শেষে এসে দাঁড়াল প্রকাশচন্দ্রের রথ। ষণ্ডদুখানির শ্বাসের শব্দ এখান থেকেও শোনা যাচ্ছিল। প্রকাশচন্দ্র একবার দেখে নিলেন যুদ্ধপরিস্থিতি। তাঁর ওষ্ঠ প্রান্তে একটি ব্যঙ্গের হাসি খেলে গেল। কতক্ষণ পারবে এরা? এক দণ্ড? দুই দণ্ড?
বামহাতের তর্জনীটি একবার দেখে নিলেন তিনি। আঙুলটি জুড়ে নীল রঙের আভা৷ রানি এখন মহাকামমতী, মহাবিষমতী হয়েছেন। আজ তাঁর দংশন থেকে রক্ষা পাবে—এমন মরমানুষ এই পৃথিবীতে নেই।
প্রকাশচন্দ্রের ইশারায় রণহুংকার আর ঢাকের শব্দ বন্ধ হল। কালকূট বাহিনীর মধ্য থেকে সামনের দিকে এগিয়ে এল একজন ঘোষক। সে উচ্চকণ্ঠে বলল, ‘বিপথগামী বিদ্রোহীরা শোনো। বঙ্গদেশের মাননীয় মহারাজসচিব শ্রীপ্রকাশচন্দ্র বিদ্রোহীদের আহ্বান জানাচ্ছেন অস্ত্র সমর্পণ করে তাঁর শরণাগত হতে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, তিনি বিদ্রোহীদের সমস্ত অভিযোগ শুনবেন এবং তার যথাযথ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করবেন। বিদ্রোহীদের নিরাপত্তা এবং সার্বিক কল্যাণ তাঁর দায়িত্ব। তিনি পরম ক্ষমাশীল ও দয়ালু…’
পদ্মসম্ভবের ধনুকটি উঠতে, আর তার জ্যা’তে শরারোপিত হতে বোধহয় এক পলের অধিক সময় প্রয়োজন হয়নি। ঘোষক দয়ালু শব্দটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে একটি ক্ষুদ্র শর অব্যর্থ নিশানায় বিদ্ধ হল তার ভ্রুমধ্যে। তারপর পর পর আরও দুইটি, তার দুই চোখে।
কয়েক মুহূর্তের নৈঃশব্দ্য। লালিম্ববন পাহাড়ের বাতাস হাহাকারের মতো বয়ে গেল দুই যুযুধান পক্ষের মধ্যে।
প্রকাশচন্দ্র ক্রুদ্ধভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখ রাগে থমথম করছে। তিনি চিৎকার করে উঠলেন, ‘বজ্রঘণ্টা…’
প্রভুর স্বর শুনে উচ্চনাদে ডেকে উঠল সেই মহাহস্তী। তারপর দুলকি চালে দৌড়তে আরম্ভ করল শত্রুদের দিকে।
.
ঘরে ঢুকে প্রথমে কিছুই দেখতে পেলেন না গোপালদেব। এই দ্বিপ্রহরেও ঘরখানি ঘিরে আছে ঘন অন্ধকার। মনে হয় হেমন্তের রৌদ্রের প্রবেশ যেন এই ঘরে নিষিদ্ধ। বাতায়নগুলি চীনাংশুকের আবরণে আবৃত। তাদের মৃদু আন্দোলনে যেটুকু সূর্যরশ্মি এই ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি পেয়েছে, তাতেই এই ঘরখানি উদ্ভাসিত।
ঘন সান্দ্র সিক্ত ধ্রুম্রজালে ঘরের বাতাস ভারী। সেই ধূম আঘ্রাণমাত্রে গোপালদেবের শরীর জাগ্রত হয়ে উঠল! সারা শরীর জুড়ে বিন্দু বিন্দু কামবীজের ইশারা!
ইতিমধ্যে গোপালদেবের দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়ে এসেছে। তিনি লক্ষ করলেন, দরজা বন্ধ করে অন্তর্হিত হয়েছে কিঙ্কিণী দুজন। তাঁর সামনে একটি বিশাল পালঙ্ক। পালঙ্কের গায়ে আঁকা চিত্রবিচিত্র অলঙ্করণ। সবই নরনারীর যৌনক্রীড়ার আখ্যান।
চোখ তুললেন গোপালদেব।
পালঙ্কের ওপর একটি নারীশরীর শায়িত। তার ওপাশে ফেরানো সর্ব অঙ্গে একটি চিত্রিত রেশমবস্ত্রের আবরণ। শয্যায় বিন্যস্ত কুঞ্চিত কেশদাম।
গোপালদেব দু’পা এগোতেই শরীরটি নড়ে উঠল। ধীরে ধীরে শয্যার উপর উঠে বসলেন সেই নারী, তারপর এদিকে ফিরলেন।
স্তম্ভিত হয়ে গেলেন গোপালদেব। নারীশরীর এত সুন্দরও হয়? কী অপরূপা এই রমণী! যেন স্বয়ং মদনদেব তিলতিল করে গড়ে তুলেছেন এঁকে। গাত্রবর্ণ ঈষৎ হরিদ্রাভ৷ সামান্য টানা চোখ দু’খানি মদালস। নাকখানি সামান্য চাপা অথচ অনিন্দ্যসুন্দর। গাল দু’খানি রক্তিম। রেশমবস্ত্রটি কোনওক্রমে উদ্ধত স্তনদুটি আবৃত করার চেষ্টা করছে।
নারীটি গোপালদেবের দিকে তাকিয়ে মদালসনেত্রে সামান্য হাসলেন। তারপর কমনীয় হাত দুটি তুলে কবরীবন্ধন করতে করতে বললেন, ‘এসেছেন প্রভু? আসুন, কত দণ্ড কত পল, কত অনুপল, আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম।’
বলতে বলতেই রেশমবস্ত্রটি বক্ষের আকর্ষণ ত্যাগ করে রমণীর কোলের ওপর পড়ে গেল। উদ্ধত স্তন দু’খানি দর্শনমাত্র গোপালদেব শিহরিত হলেন। আহা, কী ঔদ্ধত্য, কী লাবণ্য, কী মায়াই না ঘিরে আছে ওই কমলপুষ্পদুটি।
কবরীবন্ধন শেষ হলে নারীটি পালঙ্ক থেকে নেমে দাঁড়ালেন। মহার্ঘ রেশমবস্ত্রটি তাঁর পায়ের কাছে অকিঞ্চিৎকর ছিন্নপত্রের মতো পড়ে রইল। গোপালদেব দেখলেন নারীটির ক্ষীণ মধ্যদেশ। দেখলেন রাত্রির মতো গহীন নাভি, দেখলেন পেলব কদলীকাণ্ডের মতো দুই জঙ্ঘা আর দুই জঙ্ঘার মাঝে লাজুক ত্রিকোণদ্বীপ।
গোপালদেবের মস্তিষ্কের মধ্যে জান্তব ইচ্ছার প্রবণতা বুনে দিচ্ছিল সেই সান্দ্র, পিচ্ছিল ধূম্রঘ্রাণ। তাঁর শরীরে ধীরে ধীরে মাথা তুলছে এক অবাধ্য পৌরুষ৷ যেমনভাবে কামার্ত হরিণ খুঁজে ফেরে ঘাইহরিণীকে, তেমনভাবেই সেই পৌরুষ খুঁজে নিতে চাইছে এই স্বয়মাগতা নারীকে।
নারী ধীরে ধীরে অনুপম ছন্দে এগিয়ে এসে দুই বাহু স্থাপন করলেন গোপালদেবের দুই কাঁধে। তারপর কামার্ত আঁখিদুটি গোপালদেবের চোখে রেখে বললেন, ‘এই দুর্ভাগিনীর কথা কি এতদিনে মনে পড়ল নাথ? আসুন, এই অনাথিনীকে পূর্ণ করুন, গর্ভিণী করুন, সম্পূর্ণ করুন।’
বিহ্বল গোপালদেব তাঁর ঘর্মাক্ত হাতদুটি দিয়ে বঙ্গদেশের অধিশ্বরীর দুই গণ্ডদেশ ধারণ করলেন। তারপর তাঁর উদগ্র ওষ্ঠ নামিয়ে আনলেন নারীটির স্ফূরিত অধরের দিকে।
.
দেদ্দদেবী স্থিরচোখে তাকিয়ে ছিলেন তাঁর দিকে ধাবিত ওই মহাভৈরবের দিকে। তিনি এই জীবনে একবার মরেছেন, দ্বিতীয়বার মরতে ভয় পান না। শুধু গোপালদেবের কথা ভেবে তাঁর কণ্ঠার হাড় দুবার ওঠানামা করল।
তাঁর এই ধর্ষিত, লাঞ্ছিত, অকিঞ্চিৎকর জীবন চলে যায় যাক। কিন্তু উনি যেন বিজয়ী হন, অখণ্ড গৌড়বঙ্গের রাজচক্রবর্তী সম্রাট হন। উনি পাটরানি সমভিব্যহারে রাজ্যশাসন করুন, অনিঃশেষ রাজসুখ ভোগ করুন। সুন্দরী স্ত্রী পাশে নিয়ে…
সুন্দরী স্ত্রী পাশে নিয়ে?
দেদ্দদেবীর কণ্ঠা ওঠানামা বন্ধ হল। গোপালদেবের শয্যায় অন্য কোনও নারী শুয়ে আছে, এই দৃশ্য কি নরকে গিয়েও সহ্য করতে পারবেন তিনি?
না। পারবেন না। তাঁকে বাঁচতে হবে। বাঁচতেই হবে।
বজ্রঘণ্টা দৌড়ে আসছিল তাঁর দিকে। তাঁর দিকে এবং লোকেশ্বর মৎস্যেন্দ্রনাথের দিকে। তার রক্তলাল চোখ থেকে, মদস্রাবী গণ্ড থেকে, উন্মত্ত যুদ্ধবৃংহণ থেকে ছড়িয়ে পড়ছিল হিংস্র মৃত্যুর সঙ্কেত।
তাঁদের মধ্যে দূরত্ব কমে আসছে। কমে আসছে মৃত্যু এবং জীবনের মধ্যে দূরত্ব। তীক্ষ্ণধার বল্লমটি একবার চেপে ধরলেন দেদ্দদেবী। কীভাবে, ঠিক কীভাবে এই মত্ত মাতঙ্গকে প্রতিহত করা যায়!
প্রায় ঘাড়ের কাছে এসে গেছে বজ্রঘণ্টা। তাঁর রক্তাভ মদস্রাবী চোখ দেখে বুকে ভয় জাগে। ঠিক এই সময় কীসের প্রেরণায় বজ্রঘণ্টার দিকে দৌড়চ্ছেন তিনি।
বপ্যট দাঁতে দাঁত চিপে একটি অশ্রাব্য শব্দ উচ্চারণ করলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে কোনওপ্রকার অনুশাসন ভঙ্গ করা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ৷ আর এই উন্মাদ তরুণী…
শুধু উন্মাদ তরুণী? চোখের কোণ দিয়ে তিনি দেখলেন—হাতে একটি দড়ির ফাঁস ঘোরাতে ঘোরাতে বজ্রঘণ্টার দিকে দৌড়ে আসছেন পদ্মসম্ভবও।
আশ্চর্য হলেন বপ্যট। না, পদ্মসম্ভবের এই দুঃসাহস দেখে নয়। আশ্চর্য হলেন দড়িটি দেখে৷ কামরূপের উত্তরাঞ্চলের গহীন জঙ্গলে এক ধরনের ঘাস পাওয়া যায়৷ সেই ঘাস শুকিয়ে তৈরি হয় এই দড়ি। এই দিয়ে অতি বৃহৎ বাণিজ্যতরী অবধি বাঁধা যায়, এতই শক্ত এর বাঁধন।
কই, এর কথা তো পদ্মসম্ভব ঘুণাক্ষরেও বলেননি তাঁদের।
পদ্মসম্ভবের দিকে তাকিয়ে রইলেন বপ্যট৷ তিনি বুঝতে পারলেন, আরও একজনও তাকিয়ে আছেন এই উত্তেজক ঘটনার দিকে। লোকেশ্বর মৎস্যেন্দ্রনাথ।
অতিকায় হস্তিটির আগ্রাসন স্তব্ধ হল। সে বা তার মাহুত, কেউই ভাবতেই পারেনি যে আক্রান্ত মানুষেরা এত আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারেন। তবে এ বিভ্রান্তি সাময়িক। উচ্চ বৃংহণে আকাশ বাতাস মুখরিত করে ফের ধাবিত হল বজ্রঘণ্টা। নিপুণ রণহস্তীটি ততক্ষণে যুদ্ধের স্বাদ পেয়ে গেছে৷
তবে বেশীক্ষণ নয়। ততক্ষণে অব্যর্থ নিশানায় পদ্মসম্ভবের দড়ির ফাঁসটি এঁটে বসেছে উদ্ধত হস্তিশুণ্ড আর হস্তিদন্তের মাঝে। তারপর এক প্রবল টান!
কয়েক মুহূর্তের জন্য উপস্থিত প্রত্যেকে যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল এই অসম সংগ্রাম দেখে। একদিকে বঙ্গবাহিনীর সর্বশ্রেষ্ঠ রণদুর্মদ রণহস্তী বজ্রঘণ্টা, অন্যদিকে এক সামান্য মানুষ।
তবে উপস্থিত জনসাধারণ আরও স্তম্ভিত হল পরের ঘটনাপ্রবাহ দেখে।
এই আকস্মিক আক্রমণ বোধহয় বজ্রঘণ্টা আশঙ্কা করেনি। তাই সে নিজের ভারসাম্য রক্ষার্থে সামনের দুই পা একবার তুলেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। আর তার প্রবল শুণ্ডচালনে পদ্মসম্ভবের হাতে ধরা দড়িটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
তবে সেই মুহূর্তেই দ্রুত ধাবমান দেদ্দদেবী প্রথম লাফে বজ্রঘণ্টার দন্তাগ্রে এসে পড়লেন, এবং লাফিয়ে উঠলেন তার মাথা লক্ষ্য করে।
উপস্থিত জনতা স্তম্ভিত হয়ে দেখল এক আশ্চর্য দৃশ্য। একটি দেহ উড়ে যাচ্ছে বজ্রঘণ্টার মাথার দিকে। তার পা দুটি ভাঁজ করা। আর উত্থিত দুই হাতে শক্তমুঠিতে ধরা আছে একটি খর্বকায় তীক্ষ্ণধার ভল্ল। সূর্যের আলোয় ভল্লাগ্রটি একবার ঝিকিয়ে উঠল। তারপরেই সেটি আমূল বিদ্ধ হল বজ্রঘণ্টার মাথার ঠিক পিছনে, কাঁধ আর কানের মধ্যবর্তী নরম অংশটায়।
যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল সেই মহামাতঙ্গ। তারপর এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল সে। তার পিঠ থেকে ছিটকে পড়ে গেল মাহুত। ততক্ষণে দেদ্দদেবী নেমে দাঁড়িয়েছেন একপাশে। তাঁর দিকে দৌড়ে আসছেন পদ্মসম্ভব আর জয়াপীড়।
প্রবলবেগে নিজের মাথা নাড়াল বজ্রঘণ্টা। ঝেড়ে ফেলতে চাইল ঘাড়ে বিঁধে থাকা অস্ত্রটাকে। তারপর তার সামনের পা দুটি একবার তুলেই প্রবল বেগে নামিয়ে আনল মাটিতে পড়ে থাকা মাহুতের বুকে। একরাশ রক্ত ছিটকে উঠল চারিপাশে। প্রবল আক্রোশে দেহটাকে উপর্যুপরি আঘাত করল এই আহত ক্রুদ্ধ মত্তমাতঙ্গ। হতভাগ্য মাহুতের শরীরটা মুহূর্তের মধ্যে রক্তমাংসের দলায় পরিণত হল। তারপর সেই শরীরটাকে শুঁড়ে তুলে দূরে ছুঁড়ে দিল সে। তারপর যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদে চারিদিক মথিত করে সে দৌড়তে লাগল লালিম্ববন পাহাড়ের দিকে।
বিস্ফারিত চোখে সমগ্র দৃশ্যটি দেখলেন প্রকাশচন্দ্র। তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি, এই সামান্য ক’জন বিদ্রোহীকে পরাস্ত করতে গিয়ে তাঁকে তাঁর শ্রেষ্ঠতম রণহস্তীটি হারাতে হবে।
তিনি উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, ‘কালকূট সেনা, বন্দি করো ওই বিশ্বাসঘাতকদের। ওদের প্রত্যেকের মুণ্ড আমার চাই। আর বন্দি করো ওই দুই নারীকে। ওরা তোমাদের লুণ্ঠিত বস্তু, ওদের শরীর আজ তোমাদের ভোগ্য হোক।’
শিক্ষিত কালকূটসেনার প্রথম অংশ একই ছন্দে নিষ্কাশিত করল অসি। আর একই সঙ্গে তাদের প্রত্যেকের বামহাতে উঠে এল খর্বকায় কুঠার। সামান্য নীচু হল তারা, একইসঙ্গে। তারপর সঙ্ঘবদ্ধ শিয়ালের মতো তারা ছুটে চলল সামনের দিকে।
.
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন