পটমঞ্জরী – ১৪

অভীক সরকার

সেতুরক্ষী আর কারাকর্তা দ্রুত পায়ে হেঁটে আসছিলেন অলিন্দপথ ধরে। কারাকর্তা প্রথম যে সৈন্যটিকে পেলেন তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘সব ঠিক আছে প্রহরী?’

সৈন্যটি বিনীতভাবে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ প্রভু, কোথাও কোনও গোলযোগ নেই।’

কারাকর্তা ফিরে তাকালেন সেতুরক্ষীর দিকে। তারপর বললেন, ‘দেখলে তো, সব ঠিকই আছে।’

সেতুরক্ষী বিনীতস্বরে বলল, ‘যখন এতটাই এসেছি প্রভু, নতুন বন্দির সঙ্গে একবার দেখা করে গেলে হতো না?’

‘আচ্ছা, চলো দেখেই আসা যাক।’

.

সংকীর্ণ গুহাপথ দিয়ে ক্রমাগত সরীসৃপের মতো এগিয়ে যাচ্ছিলেন দুজন। নিবিড় অন্ধকার। আদি নেই, অন্ত নেই, ঊর্ধ্ব নেই, অধঃ নেই। শুধু আছে মুক্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া।

দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দে বহুদিনের বদ্ধ গুহাপথের কটু বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল। কতকাল এই গুহাপথ উন্মুক্ত করা হয়নি কে জানে। প্রথমদিকে তো নিঃশ্বাস নেওয়াই যাচ্ছিল না। তবে বাতাস একটু একটু করে সহনীয় হয়ে উঠছিল, এটাই যা আশার কথা।

গুহাপথটি সমতল নয়, একটু একটু করে উপরদিকে উঠেছে। কিছুটা যাওয়ার পর পরই একটি করে বাঁক। তার মধ্য দিয়ে শরীর নিয়ে যাওয়া এক দুরূহ কর্ম। পদ্মসম্ভব কিছুটা চেষ্টা করে তাও পারছিলেন। কষ্ট হচ্ছিল বৃদ্ধা সঙ্গিনীর। কিন্তু স্বাধীন হওয়ার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা তাঁকে দিয়ে সেই অসম্ভব কর্মটিও করিয়ে নিচ্ছিল।

বেশ কিছুটা যাওয়ার পর গুহাপথটি সামান্য প্রশস্ত হল। এবার পথটি মোটামুটি সরল। দুজনে আরও দ্রুতবেগে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন।

একটি প্রশস্ত স্থান পাওয়া গেল। সেখানে মাথা উঁচু করে বসা যায়। দুজনে সেখানে বসে পরিশ্রান্ত পশুর মতো হাঁপাতে লাগলেন। দুজনেরই গলা শুকিয়ে কাঠ। হাত এবং পায়ের বিভিন্ন অংশে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে।

পদ্মসম্ভব অন্ধকারের মধ্যেই চাতালের বিপরীত দিকের গুহামুখে হাত বুলিয়ে বুঝেছেন যে সামনের পথটি আরও প্রশস্ত।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর দুজনে আবার অগ্রসর হলেন অন্যদিকের গুহাপথ বেয়ে। এবার গুহাপথে বয়ে আসা নির্মল বাতাসের আভাস তাঁদের ক্রমে উজ্জীবিত করতে থাকল। দুজনে এবার তাঁদের শরীরের অন্তিম শক্তিটুকুর সাহায্য এগিয়ে যেতে থাকলেন অন্য প্রান্তের দিকে।

.

অলিন্দের মধ্যপথে এসে সেতুরক্ষীটি থেমে গেলেন। নত হয়ে মেঝে থেকে কিছু গুঁড়ো হাতে তুলে নিলেন। তারপর নিজের মনেই নিজেকে প্রশ্ন করলেন, ‘এগুলো এখানে কেন? অলিন্দটি কি রোজ পরিষ্কার করা হয় না?’

কারাকর্তা ঈষৎ উষ্ণ হয়ে বললেন ‘তুমি কি এবার এই কারাগৃহের কর্মপরিচালন নিয়েও মাথা ঘামাবে?’

সেতুরক্ষীটি তৎক্ষণাৎ বললেন, ‘আমি তা বলতে চাইনি প্রভু।’

তিনজনে সামনে এগিয়ে গেলেন। প্রথম বাঁকের মুখ পর্যন্ত পৌঁছে সতর্ক হলেন কারাকর্তা। এখানে একজন প্রহরীর প্রহরারত থাকার কথা। অথচ কেউ নেই!

কারাকর্তা সন্তর্পণে ডাকলেন, ‘প্রহরী।’

কোনও উত্তর নেই।

তিনজনে নিজেদের তরবারি কোষমুক্ত করলেন। তারপর ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে লাগলেন সামনের দিকে।

.

ক্রমেই প্রশস্ত হয়ে উঠছিল গুহাপথ। দুজনে চার হাত পায়ে দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছিলেন সামনের দিকে। বাতাস আরও নির্মল হয়ে উঠছিল। একটু পরেই গুহাপথটি ডানদিকে বেঁকে গেছে। দুজনে সেই বাঁকটি ঘুরতেই দেখলেন একটু দূরে পথের শেষ। একটি বৃত্তাকার লৌহদ্বার তার মুখটি অবরুদ্ধ করে আছে।

দুজনে লৌহদ্বারের সামনে জড়োসড়ো হয়ে বসলেন। দুজনের দেহ ঘামে প্লাবিত।

মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় নারীটির চোখ জ্বলজ্বল করছিল। পদ্মসম্ভব ধীরে, অতি ধীরে মরিচা-ধরা লৌহদ্বার বাইরের দিকে খোলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সেটি বিন্দুমাত্র স্থানচ্যুত হল না। শক্তিপ্রয়োগের পরিমাণ বাড়াতে থাকলেন পদ্মসম্ভব। কিন্তু সেই অনড় লৌহদ্বারটি বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না। দুবার সজোরে পদাঘাত করলেন তিনি৷ তাতেও কোনও ফললাভ হল না।

প্রচণ্ড ক্রোধে শেষবারের মতো শরীরে সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করতে যাবেন পদ্মসম্ভব, এমন সময় তাঁর সঙ্গিনী তাঁর কাঁধ স্পর্শ করে থামতে বললেন। একটু এগিয়ে এসে দ্বারটির চারিদিক হাত বুলিয়ে ভালোভাবে পরীক্ষা করে পরিধির প্রান্ত থেকে একটি কীলক খুলে নিলেন।

দ্বারটি ভিতরদিকে খুলে এল।

পদ্মসম্ভব খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন। তারপর সশব্দে হা-হা করে হাসতে লাগলেন।

.

অলিন্দ ধরে উন্মাদের মতো ছুটে আসছিলেন তিনজন। কারাকর্তা মুখ্যদ্বারের কাছে পৌঁছেই চিৎকার করে উঠলেন, ‘দ্বাররক্ষী, বজ্রশিঙা বাজাও। মহারাজসচিবের কাছে সঙ্কটবার্তা পাঠাও। প্রত্যেক প্রহরীকে সমবেত করো।’

প্রহরীরা হতবাক হয়ে গেল। কারাকর্তা শীতল মস্তিষ্কের মানুষ, আজ পর্যন্ত কেউ তাঁকে এত উত্তেজিত হতে দেখেনি। জনৈক প্রহরীপ্রধান ইতস্তত করে প্রশ্ন করলেন, ‘কী হয়েছে প্রভু?’

‘অদ্যাবধি যা হয়নি, তাই হয়েছে। আজ সন্ধ্যাকালে যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্দিটিকে আমাদের হাতে সমর্পণ করা হয়েছিল, তিনি পালিয়েছেন। তার সঙ্গে পালিয়েছেন ধর্মচন্দ্রের মহিষী কাঞ্চনাদেবীও।’

প্রহরীদল স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে। সংবাদটি তাদের বিশ্বাস হচ্ছিল না। এও কি সম্ভব? এই নরক থেকে পালানো শুধু অসম্ভব নয়, অবাস্তবও বটে।

কারাকর্তা কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘শুধু তাই নয়; শ্রীধর, ভদ্রসেন, কীর্তিপতি—তিন প্রহরী নিহত। তাদের দেহ পাওয়া গেছে শূন্য কারাকক্ষের মধ্যে। আমি জানি না এরপর কী হবে!’

.

পদ্মসম্ভব গুহাগহ্বরটি থেকে মাথা বাড়িয়ে এদিক ওদিক দেখলেন। এদিকে রক্ষীদের আসার প্রশ্নই ওঠে না। তাই সতর্কতার কোনও প্রয়োজন নেই।

তাঁর মাথার ঠিক ওপরে লালিম্ববনের পর্বতের শীর্ষদেশ। পর্বতগাত্রটি মসৃণ, পাথুরে এবং উল্লম্ব। কিছু নীচে বয়ে চলেছে মেঘান্দ’র খরস্রোতা শাখানদী। এতদূর থেকেও তার ফেনিল গর্জন শোনা যাচ্ছে। কোনও অবলম্বন ছাড়া এই পর্বতগাত্র বেয়ে নদীতীরে পৌঁছনো প্রায় অসম্ভব।

তিনি কটিদেশ থেকে পুনরায় সেই চর্মপট্টিটি বার করলেন। বেরিয়ে এল দুটি ক্ষুদ্র পাথর। তারপর নিজের পরিধেয় বস্ত্রের শুষ্কতম অংশ ছিঁড়ে তার ওপর অতি যত্নে পাথরদুটি ঘষতে লাগলেন। গুহাদ্বার রইল তাঁর পিঠের দিকে, যাতে বাতাস এসে বিঘ্ন না ঘটায়।

পাথরদুটিতে বোধহয় দাহ্যচূর্ণ সম্পৃক্ত ছিল। সামান্য পরিশ্রমেই শুষ্ক বস্ত্রখণ্ডটি জ্বলে উঠল। পদ্মসম্ভব অতি সাবধানে সেটি বাড়িয়ে ধরলেন বাইরের দিকে।

নদীর ওপারে কয়েকজন এই সংকেতের জন্যই অপেক্ষা করছিল। মুহূর্তের মধ্যে সেদিক থেকে একটি ক্ষুদ্র নৌকা এপারের উদ্দেশে রওনা দিল। একইসঙ্গে লালিম্ববনের শীর্ষদেশে সচল হয়ে উঠল কয়েকটি ছায়ামূর্তি।

একটু পরেই পদ্মসম্ভবের ঠিক সামনে একটি শনের রজ্জু এসে পড়ল। লালিম্ববনের শীর্ষদেশ থেকে কেউ যেন সেটি ঝুলিয়ে দিয়েছে।

পদ্মসম্ভব সঙ্গিনীকে বললেন, ‘আমার পিঠে চড়ে কাঁধ আর গলা জড়িয়ে বসুন মা।’

সঙ্গিনী ইতস্তত করতে লাগলেন। পদ্মসম্ভব বিনীতভাবে বললেন, ‘দেবী, আপনি রাজমাতা, আমার মাতৃসমা। এই অধম সন্তানের কাছে সংকোচ করবেন না মা। মনে করুন আমিই আপনার সেই মৃত সন্তান আনন্দচন্দ্র, আপনাকে এই নরক থেকে উদ্ধার করতে এসেছি।’

নারীটির দুই চোখে ধক করে আগুন জ্বলে উঠল। হ্যাঁ, প্রতিশোধ নিতে হবে তাঁকে। স্বামী আর সন্তান হত্যার প্রতিশোধ।

তিনি পদ্মসম্ভবের পিঠে চড়ে বসলেন। পদ্মসম্ভব দুই হাতে আর পায়ে রজ্জুটি জড়িয়ে নিলেন তারপর ধীরে ধীরে নীচের দিকে নামতে থাকলেন।

.

ক্রুদ্ধ এবং আহত বাঘের মতো ফুঁসছিলেন প্রকাশচন্দ্র। আজ অবধি তাঁকে কখনও এত ক্রোধান্বিত হতে দেখা যায়নি। শত জটিল সমস্যা, উদ্বেগজনক পরিস্থিতি, বিক্ষোভ সংবাদ—এসবের মধ্যেও তাঁর স্থৈর্য অচঞ্চল ছিল। তিনি সিদ্ধান্ত নিতেন শান্ত ভঙ্গিতে, আজ অবধি তাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্ত নির্ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

কিন্তু আজ তাঁর পদচালনা অস্থির। আচরণ উন্মত্ত। বাক্য রূঢ় এবং অসংযত। প্রকাশচন্দ্র, বঙ্গের অবিসংবাদী শাসক প্রকাশচন্দ্রের প্রতিটি বাক্যে, পদক্ষেপে, আচরণে ফুটে উঠছিল বুদ্ধিহীনতার লক্ষণ।

বঙ্গদেশের রানি রাজসিংহাসনে আসীন। বজ্রযোগিনীর মন্দিরের বিস্ফোরণের আঘাত থেকে সদ্য নিরাময় হয়ে উঠেছেন তিনি। প্রসাধন সত্বেও তাঁর অনিন্দ্যসুন্দর মুখমণ্ডলে এখনও কিছু ক্ষতচিহ্ন। মুখখানিও আষাঢ়ের মেঘের মতো থমথমে।

চারজন রাজন্য কঠিন মুখ করে বসেছিলেন। সভার মধ্যে কম্পিতদেহে দাঁড়িয়েছিলেন কারাকর্তা আর সেতুরক্ষীটি।

‘কী করে সম্ভব হল মাধব?’ ক্রুদ্ধকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন প্রকাশচন্দ্র।

‘প্রভু, এ ত্রুটি সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত…’ আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করছিলেন কারাকর্তা।

‘আমি কোনও মিথ্যা স্তোকবাক্য শুনতে চাইনি মাধব,’ ধমকে উঠলেন প্রকাশচন্দ্র, ‘ওরা পালাল কীভাবে, সেইটি জানতে চেয়েছি।’

কারাকর্তার দিকে তাকিয়েছিল কয়েক জোড়া কঠিন নিষ্করুণ চোখ। সেই দেখে তাঁর দাঁতে ঠকঠকানি লেগে যাচ্ছিল। সেই অবসরে মুখ খুললেন সেতুরক্ষীটি, ‘মহামান্য মহারাজসচিব! কাঞ্চনাদেবী এবং কুমার পদ্মসম্ভব যে কারাকক্ষগর্ভে ছিলেন সেখান থেকে অনতিদূরে, অলিন্দের মধ্যে একটি বৃত্তাকার গুপ্তপথ আবিষ্কৃত হয়েছে। আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি যে সেই পথেই দুজনে পলায়ন করেছেন।’

‘গুপ্তপথ?’ ভ্রুকুঞ্চন করলেন প্রকাশচন্দ্র, ‘কোন গুপ্তপথ?’

‘প্রভু, আমরা আবিষ্কার করেছি কারাকক্ষগামী অলিন্দের নিম্নদেশে একটি বিশেষ গুপ্তগুহা আছে। সেটির মুখ একটি বিশেষভাবে প্রস্তুত বৃত্তাকার প্রস্তর দ্বারা নির্মিত। আমরা নিঃসন্দেহ যে এই দুই বন্দি ওই পথেই পলায়ন করেছেন।’

‘এই বন্দিশালা আমার সৃষ্টি। এখানে কোনও গুপ্তপথ থাকার তো কথা নয়।’ প্রকাশচন্দ্রের স্বর প্রস্তরকঠিন। তাঁর মাথার মধ্যে সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। তাঁরই নির্দেশে নির্মিত কারাগারে এই গুপ্তগুহার অস্তিত্ব তিনি নিজেও জানতেন না? এ কী করে সম্ভব?

সবাই নিশ্চুপ। সেই অবসরে তিক্ত কাঠিন্যের সঙ্গে প্রকাশচন্দ্র বললেন, ‘আমার বেতনভুক রক্ষীর দল যে পথের সন্ধান পেল না, তার সন্ধান ওরা পেল কী করে? এত অর্থব্যয় করে, এত সযত্নে তোমাদের পুষছি কেন মাধব? এর থেকে তো কয়েকটি জংলি কুকুর পুষলেই বরং ভালো হতো।’

কারাকর্তা মাথা নীচু করে রইলেন।

অগ্নিগর্ভ নৈঃশব্দের পর প্রকাশচন্দ্র বললেন, ‘কারাকক্ষের প্রহরা এড়িয়ে ওঁরা সেই গুপ্তপথ অবধি পৌঁছল কী করে?’

কারাকর্তা কম্পিতস্বরে বলতে লাগলেন, ‘প্রভু, ঘটনাটি এতই আকস্মিক আর অসম্ভব যে এখনও এর পারম্পর্য বুঝে উঠতে পারিনি।’

প্রকাশচন্দ্র কিছুক্ষণ অগ্নিবর্ষী চোখে কারাকর্তার দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর সেতুরক্ষীকে প্রশ্ন করলেন, ‘আর তুমি, সেতুপ্রহরী! তোমার কী মত? তুমিই তো শুনলাম সর্বপ্রথম বিপদসংকেত দিয়েছিলে।’

সেতুরক্ষী বলে ওঠে, ‘প্রভু, কুমার পদ্মসম্ভবকে বন্দি করে আনার কিছু পরেই জনৈক রক্ষী তাঁর কাছে রাজপ্রাসাদ থেকে অন্নপাত্র নিয়ে আসে। আমি প্রাথমিক দেহপরীক্ষার সময় লক্ষ করেছিলাম যে রক্ষীটির দক্ষিণ মণিবন্ধে একটি প্রশস্ত চর্মপট্ট বাঁধা আছে। আমার প্রশ্নের উত্তরে সে জানায় যে, সেটি দেবী অট্টহাসের ব্রতধারণপট্ট। আমিও সেই নিয়ে প্রশ্ন করিনি।

সেই রক্ষী চলে যাওয়ার সময় নিয়ম অনুসারে তার দ্বিতীয়বার দেহপরীক্ষা হয়। তখন তাকে আমি যেতে দিই। কিন্তু তার অব্যবহিত পর দৈবগতিকে আমার মনে পড়ে যে, বেরোবার সময় রক্ষীটির মণিবন্ধে সেই চর্মনির্মিত ব্রতপট্টটি ছিল না। আমার সন্দেহ হয়। তৎক্ষণাৎ আমি কারাকর্তাকে সেই বিষয়ে সতর্ক করি…’

হাত তুললেন প্রকাশচন্দ্র, ‘বুঝেছি, আর অধিক বিস্তারের প্রয়োজন নেই৷ কিন্তু বন্দি দুজন যে পথে পালাল, সেই গুপ্তপথটির সন্ধান তোমরা পেলে কী করে?’

ইতস্তত করল সেতুরক্ষী, ‘প্রভু, আমি বন্দিদের সন্ধানে যাওয়ার পথেই লক্ষ করেছিলাম যে অলিন্দের মাটিতে কিছু সূক্ষ্ম প্রস্তরচূর্ণ বিক্ষিপ্ত আছে, যেরকম চূর্ণ কোনও প্রস্তরখণ্ডকে দেওয়ালে বদ্ধ করার কাজে ব্যবহৃত হয়৷ সেই সূত্রে অনুসন্ধান করতে করতে বৃত্তাকার গুপ্তদ্বারটির সন্ধান পাই প্রভু।’

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন প্রকাশচন্দ্র৷ তাঁর মনের মধ্যে একটা কুটিল সন্দেহ দানা বেঁধে উঠছিল। তাহলে কি তাঁর অজ্ঞাতেই…

‘কে সেই রক্ষী যে অন্নপাত্র নিয়ে গেছিল?’

‘প্রভু, অনেক অনুসন্ধানের পর জেনেছি, তার নাম মল্ল সিংহোদর। সদ্য মগধ থেকে ভাগ্যান্বেষণে এই দেশে এসেছে। তার পূর্বে সে নালন্দা মহাবিহারের দ্বাররক্ষী ছিল। এই ঘটনার পর থেকেই সে উধাও, তার কোনও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।’

প্রকাশচন্দ্রের পায়ের কাছে একটি নীচু ত্রিপদী রাখা ছিল। তার ওপর একটি অরিষ্টপূর্ণ রৌপ্যনির্মিত কলস, আর একটি স্বর্ণনির্মিত পানপাত্র। প্রকাশচন্দ্র সেই ত্রিপদীতে সজোরে পদাঘাত করলেন। ঝনঝন শব্দে কলসটি সভার একদিকে নিক্ষিপ্ত হল। মদিরা নির্গত হয়ে দুর্মূল্য গালিচা ভিজিয়ে দিতে লাগল। পানপাত্রটি উড়ে এসে কারাকর্তার কপালে আঘাত করল। তিনি শুধু ক্ষতস্থান একহাতে চেপে ধরলেন, মুখ থেকে একটি শব্দও নির্গত হল না৷ শুধু উষ্ণ রক্তধারা নেমে এল তাঁর আঙুলের ফাঁক দিয়ে।

প্রকাশচন্দ্র আদেশ দিলেন, ‘রক্ষীদল, এই অপদার্থ কারাকর্তাকে এই মুহূর্তে কুমীরের মুখে নিক্ষেপ করো। রাজকর্মে অবহেলার অর্থ রাজদ্রোহ। এ যেন রাজদ্রোহীর উপযুক্ত শাস্তিই পায়। লক্ষ রেখো, এর শরীরের একটি অংশও যেন দাহকার্যের জন্য অবশিষ্ট না থাকে।’

কারাকর্তার হাহাকারে সভার বাতাস আকুল হয়ে উঠল। উপস্থিত রাজন্য বা সামন্তদের কারও ভ্রুকুঞ্চন হল না। সেতুরক্ষীটির হাত-পা ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। হতভাগ্য কারাকর্তা কাঁদতে কাঁদতে রানির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে লাগলেন৷ রাজ্ঞী এদিকে তাকালেন না।

উপস্থিত রাজসেবকরক্ষীরা হতভাগ্য কারাকর্তাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার পর প্রকাশচন্দ্র বললেন, ‘আর তুমি, সেতুরক্ষী, তোমার নাম কী?’

‘আমার নাম রঙ্গলাল, প্রভু।’

‘তুমি মল্ল সিংহোদরের মুখ দেখলে চিনতে পারবে?’

‘অবশ্যই পারব প্রভু। আমি কারও মুখ একবার দেখলে ভুলি না।’

প্রকাশচন্দ্র তাঁর ব্যক্তিগত দেহরক্ষীকে আদেশ দিলেন, ‘সমগ্র কর্মান্তবাসকে প্রহরা চতুর্গুণ করো। আমি নির্দিষ্টভাবে জানতে চাই এই রাজদ্রোহের পিছনে কারা আছে৷ ঘোষণা করে দাও, যে বা যারা বজ্রযোগিনী মন্দিরের সামনে ঘটে যাওয়া অন্তর্ঘাতের সঙ্গে জড়িত কারো সন্ধান দিতে পারবে, তারা এক কলসী রৌপ্যদ্রহ্ম পারিতোষিক পাবে।

আর এই রঙ্গলালের সঙ্গে চৌষট্টিজন বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রাজসেবক দেওয়া হোক। শোনো রঙ্গলাল, যদি এই মল্ল সিংহোদর, কাঞ্চনাদেবী বা কুমার পদ্মসম্ভব—এদের সন্ধান দিতে পারো, একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম উপহার হিসেবে পাবে। মনে থাকবে?’

রঙ্গলাল সায় দিতেই একজন রক্ষী এসে তাকে বাইরে নিয়ে গেল।

সভাস্থলে আবার অস্বাভাবিক নীরবতা নেমে এল।

কিছু পর প্রকাশচন্দ্র বললেন, ‘জিতসেন, আজ থেকে গূঢ়পুরুষবাহিনীর প্রধানের দায়িত্বও আপনিই নির্বাহ করুন। বঙ্গদেশের বিভিন্ন প্রদেশে নিযুক্ত গুপ্তচরদের মধ্যে যারা দক্ষতম তাদের ডেকে পাঠান। তাদের কর্মান্তবাসকের সর্বত্র নিয়োজিত করুন। আমি জানি, বিদ্রোহীরা আশেপাশেই কোথাও লুকিয়ে আছে। তাদের সেই গর্ত থেকে টেনে বার করে আনতে হবে। তারপর তাদের এমন শাস্তি দেব যা দেখে ঈশ্বরও ভয়ে কেঁপে উঠবেন।’

প্রধানমন্ত্রী অমিতাভভট্ট ইতস্ততস্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘শান্তঘোষ আর আনন্দগুপ্ত’র হত্যাকারীদের সন্ধান দেওয়ার জন্য কি অন্য কোনও পারিতোষিক ঘোষণা করা হবে মহামান্য রাজসচিব?’

কিছুক্ষণ অমিতাভভট্ট’র দিকে চেয়ে রইলেন প্রকাশচন্দ্র। মানুষটি অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং রাজসেবায় নিবেদিতপ্রাণ হলে কী হবে, কূটবুদ্ধিতে নিতান্ত শিশু।

প্রকাশচন্দ্র বললেন, ‘না আর্য। প্রথমত, আমরা জানি এই কাজ কাদের। একই কাজের জন্য দুবার পারিতোষিক ঘোষণা অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। দ্বিতীয়ত, শান্তঘোষ এবং আনন্দগুপ্ত’র হত্যার সংবাদ এখনও জনারণ্যে প্রকাশ করা হয়নি। তাই পারিতোষিক ঘোষণার প্রশ্নই ওঠে না।’

অগ্নিমিত্র অনুচ্চ স্বরে যোগ করলেন, ‘আমরা কৌশলে রটনা করেছি যে ওঁরা দুজন কোনও এক বিশেষ এবং গোপন রাজকার্যে বিদেশযাত্রা করেছেন।’

শান্তস্বরে প্রকাশচন্দ্র বললেন, ‘আপনাদের মতই শান্তঘোষ এবং আনন্দগুপ্ত ছিলেন বঙ্গদেশের শাসনক্ষমতার অচ্ছেদ্য অংশ। বিদ্রোহীরা তাঁদের হত্যা করেছে, এই সংবাদ প্রচার হলে জনসাধারণের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি পাবে। আমরা সেটি হতে দিতে পারি না।’

আচার্য বিশুদ্ধকীর্তি বললেন, ‘তাছাড়া আরও একটি কারণ আছে।’

অন্য রাজন্যরা আচার্য’র দিকে ফিরে চাইলেন। তিনি কঠিনস্বরে বললেন, ‘আমাদের মধ্যে একজন বিশ্বাসঘাতক আছে। তার পরিচয় উদঘাটিত না হওয়া পর্যন্ত এই সংবাদ জনারণ্যে প্রচার করা ঠিক হবে না।’

সভার মধ্যে থমথমে নৈঃশব্দ্য নেমে এল। অগ্নিমিত্র ইতস্ততভাবে বললেন, ‘এরকম অনুমানের কারণ কি আচার্য?’

বিশুদ্ধকীর্তি ওষ্ঠপ্রান্ত সামান্য বিকৃত হল, ‘ঘটনাপ্রবাহের পারম্পর্য বিচার করলেই এ কথার সত্যতা প্রতীয়মান হবে। সেই রাত্রের অভিযানের কথা আমরা সপ্তরাজন্য এবং স্বয়ং মহারানি ছাড়া আর কেউ জানতেন না। সমগ্র অভিজানটির জন্য সর্বোচ্চ পর্যায়ের গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়েছিল। কারণ আমরা চেয়েছিলাম—একই সঙ্গে সব কজন কুচক্রীকে বন্দি করতে।

‘তা সত্বেও তাঁরা যে তাঁদের উদ্দেশ্যপালনে শুধু ব্যর্থ হয়েছিলেন তা নয়, এই দুই মহারথী নির্মমভাবে নিহত হন। রাজসেবকসৈন্যদল প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বাহিনীপ্রধান গিরিকিশোরের মৃতদেহ এমন নৃশংসভাবে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে যে তার দিকে তাকানো যায় না।

এই বঙ্গদেশের বুকে দাঁড়িয়ে কেউ এমন শাসকবিরোধী অন্তর্ঘাত ঘটাতে পারে, এ আমরা এতদিন স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি। কিন্তু তাইই ঘটেছে। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম এ হয়তো আমাদের গুপ্তচরদের আত্মতুষ্টির ফল।

‘কিন্তু সেইরাত্রের অভিযানের ক্ষেত্রে তো সমস্তরকম সতর্কতা নেওয়া হয়েছিল। তা সত্বেও এই ঘটনা সম্ভব হল কী করে?

‘যে কয়েকজন রাজসেবক বেঁচে ফিরে এসেছে, তাদের কাছ থেকে জানা গেছে যে শান্তঘোষ এবং আনন্দগুপ্ত যখন রাজসেবকবাহিনী নিয়ে শত্রুদের প্রায় অধিকৃত করে ফেলেছেন, ঠিক তখনই তাঁদের ওপর অতর্কিতে প্রতিআক্রমণ নেমে আসে। বলা বাহুল্য, ওঁরা এর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। নইলে অত সহজে দুই মহারথী এবং অমন দুর্ধর্ষ, দুর্বধ্য রাজসেবকদের নির্মূল করা অসম্ভব।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই আপাত অসম্ভব ঘটনা সম্ভব হল কী করে? এর একটিই উত্তর। এই প্রতিআক্রমণ একমাত্র তখনই সম্ভব, যখন এই অভিযানের সংবাদ আগেই শত্রুদের কাছে যদি যায় পৌঁছে৷

অর্থাৎ আমাদের মধ্যেই এমন কেউ আছেন, যিনি আমাদের সমস্ত আলোচনা শত্রুপক্ষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন।’

প্রত্যেকে পাথরের মতো বসে রইলেন। আচার্য বিশুদ্ধকীর্তির শেষ বাক্যটি যেন অনুচ্চারে সন্দেহের জাল বুনে দিচ্ছিল সবার মনে। আর তার সঙ্গে সবার মনের মধ্যে চারিয়ে যাচ্ছিল ভয়, মহাভয়।

প্রকাশচন্দ্র বললেন, ‘আমি নিশ্চিত যে, আমাদের মধ্যেই কেউ একজন সেই বিশ্বাসঘাতক। তবুও আপনাদের আশ্বস্ত করছি যে, যতক্ষণ না অপরাধী ধরা পড়ছে বা নিজের অপরাধ স্বীকার করছে, ততক্ষণ আপনারা প্রত্যেকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে।

কালই আমি আর রানি বিশেষ যজ্ঞসাধনায় বসব। আমি আমার সমস্ত সাধনপ্রকরণ দিয়ে চেষ্টা করব সমস্ত মিথ্যাজাল ছিন্ন করতে। মা বজ্রযোগিনী আমাদের সহায় হোন।’

একটা শিরশিরে ভয় প্রত্যেকের শিরদাঁড়া বেয়ে ব্রহ্মরন্ধ্রের দিকে উঠে আসতে লাগল। উত্তপ্ত পারদের মতো, শান্ত আগ্নেয় লাভার মতো, শীতল মৃত্যুর মতো সেই ভয়।

প্রকাশচন্দ্র বললেন, ‘আর্য অগ্নিমিত্র, আমার ধারণা চূড়ান্ত সংঘর্ষের সময় উপস্থিত। শত্রুরা যে কোনও মুহূর্তে চূড়ান্ত এবং প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে পারে। এখন কর্মান্তবাসকের সৈন্যশিবিরে কত সৈন্য উপস্থিত?’

‘পঞ্চসহস্রের কিছু অধিক, মহারাজসচিব।’

‘সে কী! আমাদের সৈন্যসংখ্যা তো বিশসহস্রাধিক!’

‘অন্যান্য সৈন্যরা আপাতত বঙ্গদেশের বিভিন্ন সামন্তপ্রদেশে রাজদ্রোহদমনে ব্যস্ত মহারাজসচিব।’

পরের প্রশ্ন এল রাজ্ঞীর থেকে। ‘আশ্চর্য! রাজ্যের সৈন্যবাহিনীর তিন চতুর্থাংশ বিভিন্ন সামন্তরাজ্যে রাজদ্রোহনির্বাপণে সন্নিবিষ্ট, আর সেই সংবাদ আমাকে বা মহারাজসচিবকে কেউ জানায়নি?’

অগ্নিমিত্র সামান্য অপ্রতিভ হলেন, ‘প্রয়াত শান্তঘোষ স্বয়ং এই বিষয়ে অবগত ছিলেন মহারানি। বিগত বেশ কয়েক পক্ষকাল যাবৎ আমরা সংবাদ পাচ্ছিলাম যে, বঙ্গদেশের বিভিন্ন সামন্তপ্রদেশে বিদ্রোহের উদ্রেক ঘটছে। কোথাও সামন্তসৈন্যরা দ্রোহী হয়েছে, কোথাও বা কৃষক এবং অন্যান্য কৃষ্যমানকেরা৷ অনুগত সামন্তরা ক্রমাগত সাহায্য প্রার্থনা করে বার্তা প্রেরণ করছিলেন। তাই তাঁদের সাহায্যার্থে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করা হয়েছে।’

রাজ্ঞীর মুখমণ্ডলে প্রশ্নচিহ্নের উদয় হল, ‘তার মানে প্রকৃতপক্ষে কর্মান্তবাসক এখন অরক্ষিত, তাই তো?’

‘অরক্ষিত বলা ভুল হবে মহারানি। কর্মান্তবাসকের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্ব অনেকাংশেই রাজসেবক বাহিনী নির্বাহ করে। তবে সৈন্যদলের একটি বৃহদাংশ এই মুহূর্তে অন্যত্র নিয়োজিত, এ কথা সত্য।’

প্রকাশচন্দ্র বললেন, ‘আর যেসব অঞ্চলে সামন্তশাসন অপেক্ষাকৃত নিরুপদ্রব এবং আয়ত্তাধীন, তাঁদের সৈন্যবাহিনী?’

অগ্নিমিত্র অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, ‘সেইসব সামন্তদের সৈন্যবাহিনীও ওই একই কর্মে নিয়োজিত হয়েছে, রাজসচিব।’

প্রকাশচন্দ্রের মুখমণ্ডল আরও গম্ভীর হয়ে উঠল। প্রশ্ন করলেন, ‘আর্য অগ্নিমিত্র, যে যে সামন্তপ্রদেশে সৈন্যদল প্রেরণ করা হয়েছে তাদের নাম বলুন।’

অগ্নিমিত্র পাঁচটি সামন্তপ্রদেশের নাম বললেন।

প্রকাশচন্দ্র প্রশ্ন করলেন, ‘এগারোটি সামন্তপ্রদেশের মধ্যে পাঁচটিতে এতই বিদ্রোহের উন্মেষ ঘটছে যে দেশের রাজধানী অরক্ষিত রেখে সেখানে সৈন্যসন্নিবেশ করতে হয়েছে? এমনকী অন্য ছ’টি সামন্তপ্রদেশ থেকেও? কে নিয়েছে এত বড় সিদ্ধান্ত?’

অগ্নিমিত্র বিব্রত হলেন, ‘এই সিদ্ধান্ত একান্তই শান্তঘোষের ছিল, মাননীয় রাজসচিব।’

প্রকাশচন্দ্র খানিকক্ষণ স্থির চোখে চেয়ে রইলেন অগ্নিমিত্রর দিকে। তারপর শান্ত এবং ধীরস্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘এই ঘটনা কবে ঘটেছে?’

‘আমরা মাসাধিককাল থেকে এই মর্মে সংবাদ পাচ্ছিলাম, মাননীয় মহারাজসচিব। অবশেষে শরতের প্রারম্ভে উপায়ান্তর না দেখে আমরা সৈন্যপ্রেরণ করতে বাধ্য হই।’

রাজ্ঞী প্রশ্ন করলেন, ‘আর্য জিতসেন, এই পাঁচটি সামন্তপ্রদেশে নিশ্চয়ই আমাদের গুপ্তচরেরা রয়েছে। তাদের কাছ থেকে কী বার্তা এসেছে?’

জিতসেন বললেন, ‘তারাও একই বার্তা প্রেরণ করেছে মহারানি। সর্বত্র পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি ঘটেছে। অধিকাংশ স্থানেই সামন্তসৈন্যদল বিদ্রোহী হয়েছে। সামন্তবর্গ এবং তাঁদের অধীনস্থ রাজপদাধিকারীরা প্রাণভয়ে ভীত। বিদ্রোহী সৈন্যদল প্রতিটি সামন্তপ্রদেশের প্রান্তবর্তী অঞ্চলগুলি তো অধিকার করেইছে, অনেক ক্ষেত্রে রাজধানীর দিকেও অগ্রসর হয়েছে। তার সঙ্গে বিদ্রোহী হয়েছে কৃষক এবং অন্যান্য কৃষ্যমানকেরা। তারা কর দিতে অস্বীকার করছে। অন্তত তিনটি সামন্তপ্রদেশে রাজকোষ লুণ্ঠিত হয়েছে। অবশেষে উপায়ান্তর না দেখে আর্য শান্তঘোষ এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন।’

প্রকাশচন্দ্রের মুখমণ্ডল অবিকৃত রইল। তিনি বললেন, ‘আশা করি আর্য শান্তঘোষ সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন। তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্য একটি বিষয়ে জ্ঞাত হতে চাই আর্য জিতসেন।’

‘আদেশ করুন প্রভু।’

‘আপনারা তো জানেন যে প্রতিটি সামন্তপ্রদেশের রাজপদোপজীবিদের মধ্যে এক বা দুজন এমন গুপ্তপুরুষ আছেন যাঁরা গোপনে আমাদের সহায়তা করেন। তাঁদের থেকে কি এই বিদ্রোহবিষয়ে কোনও সংবাদ পেয়েছেন?’

জিতসেন বললেন, ‘আমরা গণনা করে দেখেছি যে ওই পাঁচটি প্রদেশে ঠিক ছ’জন রাজপুরুষ আছেন যাঁরা কর্মান্তবাসক থেকে নিয়মিত গুপ্ত অর্থ পেয়ে থাকেন। তাঁদের পাঁচজনের কাছ থেকে পাওয়া বার্তায় আমরা একই সংবাদ প্রাপ্ত হয়েছি। আমরা নিঃসন্দেহ যে এই বিদ্রোহসংবাদ সম্পূর্ণ সত্য।’

‘ষষ্ঠজন কে?’

‘বিক্রমপুরাধিপতি ধর্মসেনের কোষাধ্যক্ষ চণ্ডকীর্তি।’

প্রকাশচন্দ্র কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে রইলেন। আচার্য বিশুদ্ধকীর্তি প্রশ্ন করলেন, ‘একটি কথা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না আর্য প্রকাশচন্দ্র। যে পথে কুমার পদ্মসম্ভব এবং কাঞ্চনাদেবী পালিয়েছেন, তার সন্ধান ওঁরা পেলেন কী করে?’

প্রকাশচন্দ্র আত্মগতভাবে বললেন, ‘এর একটিই উত্তর সম্ভব আচার্যদেব। আর সেক্ষেত্রে বুঝতে হবে ষড়যন্ত্রের মূল অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে। আমি যা ভেবেছিলাম তার থেকেও অনেক বেশি গভীরে। এবং সেক্ষেত্রে প্রতিটি অস্বাভাবিক ঘটনা আমাদের বার বার যাচাই করে দেখতে হবে, তার স্বপক্ষে যতই সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকুন না কেন।

‘আর্য অগ্নিমিত্র, স্থানিক সমিতি বা আমাদের গুপ্তভৃতকদের থেকে যে গোপন পত্রগুলি এসেছে, সেগুলি আমি এখনই একবার পরীক্ষা করে দেখতে চাই।’

অগ্নিমিত্র বললেন, ‘সেগুলি আমার সঙ্গেই আছে, আপনি এখনই পরীক্ষা করতে পারেন।’

অগ্নিমিত্র’র ইঙ্গিতে একজন রক্ষী কয়েকটি তালিপত্র এনে দিল প্রকাশচন্দ্রের সামনে। তিনি এক এক করে পড়তে লাগলেন।

কিছুক্ষণ পর প্রকাশচন্দ্র যখন মুখ তুললেন তখন তাঁর মুখ থমথম করছে। তিনি উত্তেজিত স্বরে বললেন, ‘জিতসেন, আপনি এখনই সমস্ত সৈন্যদের কর্মান্তবাসকে ফিরে আসার আদেশ দিন। আর চণ্ডকীর্তির সন্ধানে এক্ষুনি চর প্রেরণ করুন। আমার আশঙ্কা যদি সত্য হয়, ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটতে চলেছে।’

আচার্য বিশুদ্ধকীর্তি প্রশ্ন করলেন, ‘কী ঘটতে চলেছে মহারাজসচিব? কোন অমঙ্গলের আশঙ্কা করছেন আপনি?’

‘আমার ধারণা আমাদের স্থানিক সমিতির প্রধান বা গুপ্তসচিবরা বন্দি। এই পত্রগুলি হয় তাদের ভয়প্রদর্শন করে লেখানো হয়েছে, অথবা পত্রগুলি নকল।’

জিতসেন বিস্মিতস্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘কেন এমন ভাবছেন প্রভু?’

‘পত্রগুলি আপনি যদি পরীক্ষা করতেন, তাহলে লক্ষ করতেন যে তালিপত্রগুলি এক, তাদের আকার এক, পত্রের ভাষা প্রায় এক, ঘটনাপ্রবাহের বিবরণ একেবারে একইরকম৷ বিভিন্ন সামন্তপ্রদেশ থেকে আসা প্রতিটি পত্রের মধ্যে এত সাদৃশ্য হতে পারে!’

সকলে আবার নিশ্চুপ। প্রকাশচন্দ্র অমিতাভভট্টের দিকে ঘুরলেন, ‘আর্য অমিতাভভট্ট, আপনাকে একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজের ভার দিতে চাই। এর জন্য আপনার থেকে উপযুক্ত আর কেউ নেই।’

অমিতাভভট্ট সাগ্রহে বললেন, ‘কী কাজ মহারাজসচিব?’

‘আপনাকে একবার হরিকেল যেতে হবে আর্য। সেখানে আমার এক প্রাচীন মিত্র ইশ্বরচিন্তায় বার্ধক্যাতিপাত করছেন। তাঁকে এখানে নিয়ে আসতে হবে।’

‘আপনার মিত্র? হরিকেলে?’ বিস্মিত হলেন অমিতাভভট্ট, ‘কে তিনি?’

‘আর্য চারুদত্ত।’

.

মানুষটি দ্রুত হাঁটছিল অন্ধকারের মধ্যে। দুর্ভেদ্য অরণ্য। এর মধ্য দিয়ে দ্রুত চলাফেরা করা অত্যন্ত অসুবিধাজনক। পদে পদে পা জড়িয়ে ধরে নাম না জানা লতা। কোথাও বা গভীর গহ্বর, কোথাও বিষাক্ত লতার ঘন ঝোপ।

আর বন্য জন্তুর তো কথাই নেই। বন্য বরাহ, হিংস্র সারমেয়, শৃগাল, বন্য মহিষ ইত্যাদিতে পূর্ণ এই অরণ্য। আর বিষধর সাপ! রাজগোক্ষুরো থেকে শুরু করে কালাচ, শাঁখামুটি, কেউটিয়া কী নেই অরণ্যে?

মানুষটি তবুও তার যাত্রা থামাল না। তাকে যে করেই হোক পৌঁছতে হবে অরণ্যের অন্য প্রান্তে। কারণ তার পিছনে ধেয়ে আসছে পৃথিবীর হিংস্রতম প্রাণী।

মানুষ।

একটি অপেক্ষাকৃত উন্মুক্ত স্থানে এসে গভীর নিঃশ্বাস নিল মানুষটি। দেহ ঘর্মাক্ত। দেহের বিভিন্ন স্থানে বৃক্ষশাখার আঘাতে সৃষ্ট ক্ষত থেকে রক্তপাত হচ্ছে। কিন্তু সেদিকে তার মন নেই। তার মন পড়ে আছে ফেলে আসা পথের দিকে। কারও পদশব্দ শোনা যাচ্ছে না তো? ধর্মসেনের গুপ্তঘাতকরা তার সন্ধান পেয়ে গেল না তো?

অনেকক্ষণ মনোযোগ সহকারে কান পেতে রাখার পর নিশ্চিন্ত হল মানুষটি। একবার আকাশের দিকে তাকাল সে। নক্ষত্র অবস্থান দেখে দিকনির্ণয় করতে হবে তাকে। কাল দ্বিপ্রহরের মধ্যেই যেনতেন প্রকারেণ কর্মান্তবাসকে পৌঁছনো আবশ্যক। নইলে মহা অনর্থ ঘটে যাবে।

কিন্তু এক পা এগোতেই মানুষটি অনুভব করল যে তার সমস্ত শরীর তীব্র ব্যথার কশাঘাতে জর্জরিত। দেহের প্রতিটি অংশ যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করছে৷ মাথা ভার, পা দুটি আর চলতে চাইছে না। অবশ্য তার কারণও আছে।

দীর্ঘ দুই রাত্রি সে প্রায় অনাহারে রয়েছে। বন্য জন্তুর মতো ছুটে বেরিয়েছে বিক্রমপুরের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। আশ্রয় ভিক্ষা করেছে পরিচিত মিত্রজনেদের কাছে। কিন্তু না, ধর্মসেনের রুদ্রচক্ষুর সামনে কারও সাহস হয়নি তাকে আশ্রয় দেওয়ার৷

শেষে বহু পুরাতন পরিচিতির সূত্র ধরে জনৈক তস্কর তাকে আজ প্রভাতে এই অরণ্যের প্রান্তে ছেড়ে যায়। অবশ্যই কাঞ্চনমূল্যের বিনিময়ে। সেই থেকে সে এই অরণ্যপথে ক্রমাগত ছুটে চলেছে কর্মান্তবাসকের দিকে। যৎসামান্য ক্ষুন্নিবৃত্তি করেছে বনজ ফলে। অরণ্যের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে মেঘান্দ’র এক ক্ষুদ্র শাখা। তার জলে তৃষ্ণানিবারণ করেছে সে। আর ক্রমাগত কান পেতে বোঝার চেষ্টা করেছে, ধর্মসেনের ঘাতক রক্ষীরা তার সন্ধানে ছুটে আসছে না তো?

মাটিতে বসে পড়ল সে। শরীর আর দিচ্ছে না। চক্ষু বন্ধ করল।

মাসাধিককাল যাবৎ বিক্রমপুরের রাজন্যবৃত্তের মধ্যে সে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ করছিল। হঠাৎ করেই গুরুত্বপূর্ণ রাজকর্মচারীদের অন্য দায়িত্বে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। মহামাত্য এবং অন্যান্য কিছু বিশিষ্ট রাজপদাধিকারীদের অসময়ে রাজপ্রাসাদে আনাগোনা বেড়ে গেছিল। ইতিউতি কিছু অসন্তোষের সংবাদও আসতে শুরু করেছিল রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে।

কিন্তু তাতে সে বিশেষ আমল দেয়নি। অমন সহস্রাধিক অসন্তোষের স্ফুলিঙ্গ নিমেষে নির্বাপিত করার ক্ষমতা রাখে ধর্মসেন। শুধু মাত্র নিজের কর্তব্যপালন করে যাচ্ছিল। দিনগত পাপক্ষয়। সুযোগমতো বিশ্বস্ত পারাবত কামিনীর মাধ্যমে আর্য শান্তঘোষের কাছে সংবাদ প্রেরণ করতে হবে।

এদিকে পরিস্থিতি ক্রমাগত জটিল হয়ে উঠছিল। সে বুঝতে পারছিল যে, রাজপ্রাসাদের সর্বত্র একটা থমথমে অবিশ্বাসের আবহাওয়া চারিয়ে যাচ্ছে। ঠিক একমাস পূর্বে এক রাত্রির মধ্যে তার পরিচিত জগত সম্পূর্ণ পালটে গেল।

.

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন