বিশ্বরূপ মজুমদার
একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেনটা নড়ে উঠতেই হাতঘড়িতে সময়টা মিলিয়ে নিলেন শোভনসুন্দর। কাঁটায় কাঁটায় চারটে পঞ্চাশ। এক্কেবারে অন টাইম ডিপারচার দিল্লিগামী রাজধানী এক্সপ্রেসের। ফার্স্ট ক্লাস ক্যুপে নিজেকে একা আবিষ্কার করে মনটা আনন্দে নেচে উঠল। অবশ্য মাঝে কোনও স্টেশন থেকে কারোর রিজার্ভেশন থাকতেও পারে। সে যাক, আপাতত তো আরামে বসা যাবে! এই বা কম কী! জানালার কাচের মধ্যে দিয়ে শীতের পড়ন্ত বেলার ম্লান আলো আরও ম্লান দেখাচ্ছে। কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েছেন শোভনসুন্দর। হঠাৎ দরজায় আওয়াজ হতেই ঘুরে তাকালেন। একজন মাঝবয়সি ভদ্রলোক, প্যান্ট-শার্ট পরা, কাঁধে একটা চামড়ার ব্যাগ, ওর দিকে সস্মিত মুখে তাকিয়ে আছেন। এ আবার কোত্থেকে উদয় হল রে বাবা! ভাবতে না ভাবতেই এগিয়ে এলেন ভদ্রলোক – “বসতে পারি?”
౼ “অ্যাঁ… হ্যাঁ হ্যাঁ, বসুন!”
বসেই ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন – “কদ্দুর… দিল্লি?”
౼ “হ্যাঁ, আপনি?”
౼ “আমিও” বলেই একটু মুচকি হাসলেন ভদ্রলোক। শোভনসুন্দর মনে মনে বিড়বিড় করলেন ‘সে তো বুঝতেই পারছি। পুরো জার্নিটাই…।’ যা হোক, মনের ভাব চেপে রেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে একটু যাচাই করতে চেয়ে বললেন – “ও, তা আপনার সিট বুঝি…”
౼ “হ্যাঁ, এইখানেই। এটাই তো 1A-র ‘B’ ক্যুপ, তাই না?”
౼ “ঠিক তাই।” একটা নিঃশ্বাস লুকোলেন শোভনসুন্দর। “তা আপনাকে তো এতক্ষণ…”
শোভনসুন্দরকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ভদ্রলোক হেসে উঠলেন।
౼ “আর বলবেন না, ভুল করে 2A তে উঠে পড়েছিলাম। দেখি, ওখানে তো কোনও সিট খালি নেই! তারপর ভুলটা বুঝতে পেরেই…”
౼ “ও” শোভনের গলায় হালকা হতাশার ছোঁয়া।
౼ “আপনার লাগেজ তো কিছু…”
౼ “নাঃ, ওসব আমি বিশেষ ক্যারি করি না। এই একটা ঝোলাই যথেষ্ট।”
শোভনসুন্দর আর কথা বাড়ালেন না। ক্যাটারিং থেকে দুটি ছেলে এসে টেবিল সাজিয়ে বিকেলের স্ন্যাক্স ও টি পরিবেশন করে গেল। তারিয়ে তারিয়ে খাবারটা খেলেন শোভনসুন্দর। বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন বেশ আগে। খিদেও পেয়েছিল। হঠাৎ খেয়াল হল ভাদ্রলোক তো সিটে নেই। গেলেন কোথায়! ভাবতে ভাবতেই ক্যুপের দরজায় দেখা গেল ওঁকে। উনি তো কিছু নিলেন না! খাবেন না বোধহয়। সন্ধে নেমে গেছে বাইরে। জানালা দিয়ে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না এখন। রিডিং ল্যাম্প জ্বালিয়ে একটা ডায়েরি বার করলেন শোভনসুন্দর। সম্পাদক যে ওঁকে কী গেরোয় ফেলেছেন! লেখালেখি করেন, বাজারে বেশ নামও আছে ওঁর। যে মাসিক পত্রিকায় নিয়মিত লেখা বেরোয়, তারা এবারের সংখ্যাটি বিশেষ ভৌতিক সংখ্যা করতে চাইছেন। ফলে নিয়মিত লেখকদের প্রত্যেককেই এবারে ভূতের গল্প কন্ট্রিবিউট করতে হবে। কোনও মানে হয়! একে তো শোভনের ভূত-প্রেতে বিশ্বাস নেই একেবারেই। ওই বিষয়ের লেখাগুলোও খুব ট্র্যাশ মনে হয়। আর সেই তাকেই কিনা লিখতে হবে ভূত নিয়ে! পেনটা হাতে নিয়ে ভাবনায় ডুব দিলেন শোভনসুন্দর।
౼ “আপনার পেনটা তো ভারি সুন্দর!”
চমকে তাকালেন শোভন। পেনটা সত্যিই দারুণ! গতবছর ছোট শ্যালক জার্মানি থেকে ফিরে গিফট করেছিল।
౼ “আপনি কি লেখালেখি করেন?”
౼ “একটু আধটু। আচ্ছা, যা বিশ্বাস করি না মন থেকে, তাই নিয়ে কি কোনও লেখা তৈরি করা যায়, বলুন তো?”
౼ “কী বিশ্বাস করেন না, না জেনে কী করে বলি বলুন?”
౼ “এই ভূত-প্রেত আর কী! যত সব বোগাস! এবারে পত্রিকার বিশেষ ভৌতিক সংখ্যা প্রকাশিত হবে। সুতরাং সম্পাদকের হুকুম…”
౼ “তাহলে তো খুব মুশকিল! অবিশ্বাস থাকলে সেই বিষয় নিয়ে কিছু লেখা খুবই কঠিন!”
౼ “আচ্ছা, আপনার কোনও অভিজ্ঞতা আছে নাকি, এ ব্যাপারে?”
౼ “আমার!” হাসলেন ভদ্রলোক। “তা একবার একটা ঘটনা ঘটেছিল আমার জীবনে, সেটা ভৌতিক নাকি আধিভৌতিক না পুরোপুরি কল্পনা, তা বলতে পারব না।”
౼ “বেশ তো, সেটাই শেয়ার করুন না, যদি কোনও প্লট পেয়ে যাই…” আগ্রহ নিয়ে বললেন শোভনসুন্দর।
౼ “বেশ, তাহলে শুনুন।” ভদ্রলোক শুরু করলেন – “অনেকদিন আগের কথা। রাজধানী ধরেই দিল্লি যাচ্ছিলাম জরুরি কাজে। ফার্স্ট ক্লাস ক্যুপ, আমি একা। মনে মনে বেশ খুশিই ছিলাম। ডিনার সেরে বড় আলোটা নিভিয়ে রিডিং ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে একটা ডিটেকটিভ গল্প পড়ছি, আগাথা ক্রিস্টির। আমার আবার ট্রেনে সচরাচর ঘুম আসে না। তো রাত তখন অনেক হবে, আমার দু’চোখের পাতা বুজে আসছে দেখে আমি লাইটটা অফ করে চাদরটা টেনে নিলাম। কতক্ষণ কেটে গেছে জানি না, আচমকা আমার ঘুমটা ভেঙে গেল, একটা অস্বস্তিতে। মনে হচ্ছে ক্যুপে আমি একা নই, আরও কেউ আছে! অথচ আমি নিজের হাতে ক্যুপের দরজা বন্ধ করেছি! আশ্চর্য! ভয়ডর আমার কোনও কালেই নেই তেমন। কিন্তু সেই রাতে আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসতে লাগল কী এক অজানা ভয়ে! হাত বাড়িয়ে লাইটের সুইচটা যে টিপব, সেই শক্তিটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছি। কারোর নিঃশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। একবার যেন কপালে একটা হিমশীতল হাতের ছোঁয়া পেলাম। শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। অনেক কষ্টে মনে জোর এনে একসময় সুইচটা টিপে দিলাম। আলোয় ঝলমল করে উঠল ক্যুপটা। কেউ কোথাও নেই! আমি পুরো ক্যুপের ওপর নীচ সব জায়গায় ছানবিন করলাম, কিন্তু কি বলব মশাই, কারোর টিকিও দেখতে পেলাম না।”
౼ “তারপর!” রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করলেন শোভনসুন্দর।
౼ “তারপর আর কী! সারারাত আলো জ্বেলে বসে রইলাম, যতক্ষণ না ভোর হয়!”
౼ “আর কিছু…?”
౼ “নাঃ, আর কিছু দেখিনি বা অনুভবও করিনি।”
ভদ্রলোক উঠলেন, টয়লেটে যাবেন। একটু পরে ডিনার সার্ভ করে গেল। এবারেও ভদ্রলোক কিছু নিলেন না। জিজ্ঞেস করাতে বললেন রানিং ট্রেনে উনি বিশেষ কিছু খান না, পেটে অসুবিধে হয়। সঙ্গে বিস্কুট আছে, তাই খেয়ে জল খেয়ে নেবেন।
খাওয়াদাওয়া সেরে তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়লেন শোভনসুন্দর। যাক, একটা প্লট তো মোটামুটি পাওয়া গেল। গল্পটা দাঁড়িয়ে যাবে মনে হয়। ভদ্রলোকও ততক্ষণে বিছানা পেতে শুয়ে পড়েছেন। রাতে ট্রেনের ঝাঁকুনিতে দু’-একবার ঘুম চটকে গিয়েছিল শোভনসুন্দরের। আবছা আলোয় আধো ঘুমে মনে হয়েছে ক্যুপের মধ্যে যেন কেউ হেঁটে বেড়াচ্ছে। গা-টা একটু ছমছম করে উঠলেও পরমুহূর্তে মনে হয়েছে শোয়ার আগে ওই গল্পটা শুনেছেন। তাই ঘুম চোখে ওইসব…। পাত্তা না দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন শোভনসুন্দর। সকালে ঘুম ভাঙল বেড টি’র দৌলতে। টয়লেটে গিয়ে ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে এসে বসে চা ঢালতে গিয়ে মনে হল ওর সহযাত্রীটিকে তো দেখা যাচ্ছে না। গেলেন কোথায় ভদ্রলোক! মনে পড়ল গতকালই উনি বলছিলেন ট্রেনে একটানা বসে বা শুয়ে থাকতে ওর শারীরিক কষ্ট হয়। ওইজন্যই ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কাটেন, যাতে করিডোরে হাঁটাহাঁটি করতে পারেন। আবার ফ্লাইটে চড়তে ওর খুব ভয়! সত্যি, কত যে বিচিত্র মানুষ! মনে মনে ভাবেন শোভনসুন্দর। আর ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে যায়। এইরকম ভাবেই তো মিলে যায় তার লেখার উপাদান। ঘড়ি দেখলেন, ট্রেন ঠিক টাইমে রান করছে। দিল্লি পৌঁছতে আর বেশি দেরি নেই। কিন্তু, এখনও তো ভদ্রলোকের কোনও পাত্তা নেই! “স্যার” – একটা শিট এগিয়ে দিল ক্যাটারিং-এর ছেলেটি কমেন্ট লেখার জন্য। সুইপার ছেলেটিও এসে দাঁড়িয়েছে। এইসময়ই সবাইকে বকশিস দিতে হয়। পার্স থেকে টাকা বের করতে করতে শোভনসুন্দর বললেন – “আমার থেকে তো নিচ্ছ, ঠিক আছে। কিন্তু আর একজন গেলেন কোথায়?”
౼ “কার কথা বলছেন, স্যার?”
౼ “কেন, আমার সঙ্গে যিনি ছিলেন এই ক্যুপে?”
౼ “আপনার ক্যুপে তো আপনি ছাড়া আর কেউ ছিলেন না, স্যার!”
౼ “মানে? কী ভুলভাল বকছ? ওই তো ওর বার্থে চাদরটা এখনও কুঁচকে আছে, তাকিয়ে দ্যাখো!”
౼ “স্যার, ওখানে কোনও চাদরই পাতা নেই, আপনি ভুল করছেন, রাতে ঘুমটা বোধহয় ঠিকমতো হয়নি আপনার।”
বকশিস নিয়ে ছেলেগুলো চলে গেছে। স্থানুর মতো সিটে বসে আছেন শোভনসুন্দর। কে ওই লোকটা? যাকে শুধু উনিই দেখতে পেলেন, কথা বললেন, অন্য কেউ জানতেই পারল না!
আর কী আশ্চর্য! এখন মনে পড়ছে, কাল থেকে যতবার ওরা খাবার দিতে, ঝাড়ু দিতে এসেছিল, ওই ভদ্রলোক সেই সময়টাতে ক্যুপে ছিলেন না! তাই তো। তাহলে! কে ও? ট্রেন নিউ দিল্লি জংশনে ঢোকার মুখে। জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে গিয়ে ডায়েরিটা সাইড টেবিল থেকে তুলতেই তার নীচে চাপা দেওয়া এক তাড়া কাগজ বেরিয়ে পড়ল। কী এটা? এ তো একটা পাণ্ডুলিপি মনে হচ্ছে। বহু পুরনো। পাতাগুলো বিবর্ণ হয়ে গেছে। যদিও হাতের লেখাটা এখনও স্পষ্ট! পাণ্ডুলিপির ওপরে একটা চিরকুট আটকানো, তাতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা —
‘ঘাবড়ে গেলেন নাকি? ওহো, আপনি তো আবার ওসবে বিশ্বাসই করেন না! যাক, আপনি লেখক মানুষ, পাণ্ডুলিপিটার প্রতি সুবিচার করবেন আশা করি। রাজধানীর এই ক্যুপেতেই একদিন লেখাটির জন্ম, আর সেই দিনই লেখকের…। বহুদিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি জানেন, তেমন মানুষই পাই না যে লেখালেখির মর্যাদা দেবে! অবশেষে, আপনাকে পেলাম। দেখবেন, যেন লেখাটা প্রকাশিত হয়, লেখক যেই হোন না কেন!’
পাণ্ডুলিপিটির দিকে চেয়ে স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন শোভনসুন্দর।
***
উস্রি দে
পেশায় ভারতসঞ্চার নিগম লিমিটেড-এর ফাইন্যান্স এক্সিকিউটিভ ছিলেন। নেশায় সাহিত্যচর্চা। ছোটবেলা থেকেই এ বিষয়ে আগ্রহ। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির শুরু। বাংলাদেশে ভারতীয় হাই কমিশনের থেকে প্রকাশিত ‘ভারতবিচিত্রা’ ও অন্যান্য লিটল ম্যাগাজিনে লেখা প্রকাশ পেয়েছে। পরবর্তীতে ‘দেশ’ পত্রিকায় কবিতা ও আনন্দবাজারের ‘রবিবাসরীয়’তে ছোটগল্প প্রকাশ পায়। বর্তমানে কিছু ওয়েবজিন-এ লেখা নিয়মিত প্রকাশ পাচ্ছে – যেমন ‘পরবাস’ (আমেরিকার নিউজার্সি থেকে প্রকাশিত), ‘সাময়িকী’ (নরওয়ে থেকে প্রকাশিত), ইত্যাদি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন