বিশ্বরূপ মজুমদার
(১)
বিষণ্ণ কবিতার মতো শেষ হতে চলেছে পাতাঝরার মরসুম। আর কিছুদিন পরেই, ন্যাড়া গাছের ডালে এসে বসবে মরশুমি পাখিদের দল। ছোট্ট এই শহরটায় তেমন জনবাহুল্য নেই, তাই এখনও এখানে সবুজ টিকে আছে। কংক্রিটের ধূসর আস্তাবলে হারিয়ে যায়নি মজা পুকুরের মদিরতা।
রোজ বিকেলে পশ্চিমের বারান্দায় সূর্যাস্ত দেখতে আসে চৈতি৷ খড়খড়ির চাদর তুলে চেয়ে থাকে বিষণ্ণ আকাশের দিকে। সিঁদুরে আবিরে রেঙে যখন একটু একটু করে হারিয়ে যায় নিটোল থালার মতো সূর্যখানা, পাখিদের ডানায় চেপে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে কালো অন্ধকার… চৈতি ফিরে আসে নিজের একলা ঘরে।
থাকার বলতে এক কামরার এই ঘরখানাই। এছাড়া অনন্তর স্মৃতি বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই চৈতির কাছে৷ কোনও এক ধূসর বিকেলে ঠাঁইছাড়া হয়ে সে এসে জুটেছিল এই আঙিনায়, আর ফিরে যায়নি৷ যাওয়ার তেমন উপায়ও ছিল না অবশ্য৷
অনন্তকে ছাড়বার সিদ্ধান্তটা ছিল চৈতিরই। যেভাবেই হোক তাকে এক গলাবন্ধ সম্পর্ক থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিল সে।
সন্তানহীনতা একজন নারীর সামাজিক জীবনে যে কত বড় প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিতে পারে হয়তো নিজের জীবন দিয়ে অনুভব না করলে বুঝত না চৈতি। প্রথমে পরিবার, তারপরে আত্মীয়স্বজন… সবশেষে অনন্ত, অপরাধবোধের এক অন্তহীন খাদে নিত্য তলিয়ে যাচ্ছিল চৈতি। না, কোনও রকম শারীরিক সমস্যা নেই তার, কিন্তু সন্তানসুখ থেকে চিরবঞ্চিত সে। নিজের ভালোবাসার মানুষের চোখে নিজের জন্য ঘৃণা আর তিতিক্ষা দেখতে দেখতে শেষমেশ সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলেছিল চৈতি। ডিভোর্সের পরে মা-বাবার ঘরে ফেরেনি সে, ছোট্ট বেসরকারি স্কুলের চাকরিটা কোনওক্রমে মাথা উঁচু করে চলতে শিখিয়ে দিয়েছিল। এই ঘরে একাকিত্ব রয়েছে, কিন্তু শান্তির অভাব নেই।
এই ঘরটা অনন্তর দূরসম্পর্কের বিধবা পিসির। তিনি মারা যাওয়ার পরে ধুলোবালি মেখে বন্ধই পড়ে ছিল ঘরখানা। ডিভোর্সের সময়ে অনন্তর কাছে একপ্রকার জোর করেই ঘরটা চেয়ে নিয়েছিল চৈতি। নিভৃতবাসের জন্য এমন ঘর আদর্শ।
পাড়ার সকলে বলে ঘরখানা ভূতে পাওয়া। যখন বন্ধ অবস্থায় পড়ে ছিল, নিত্য শোনা যেত নানারকম শব্দ। কখনও কখনও সন্ধ্যার অন্ধকারে জানলার ধার ঘেঁষে চট করে সরে যেত কোনও কালো ছায়া। পাড়ার লোকে বেশ এড়িয়েই চলে এক কামরার ছোট্ট বাড়িটাকে। পশ্চিম দিক ঘেঁষা বিশাল বাঁওড়, সেইসঙ্গে উত্তরে ফাঁকা মাঠ বাড়িটাকে যেন আরও আলাদা করে ফেলেছে সকলের থেকে। সীমানা-প্রাচীর কোনও কালেই ছিল না বাড়িটার, চৈতি আসার পরে লোক ডেকে কিছু কাঁটাতার বসিয়েছে উত্তরদিক বরাবর, এছাড়া আর কিছু করার অর্থনৈতিক সামর্থ্য নেই তার।
বারান্দার এক কোণেই পর্দাঘেরা চৈতির একটুকরো রান্নাঘর। পর্দা বলতে পুরনো শাড়ি সেলাই করে বানানো আবরণ মাত্র, তার রং ও জৌলুস উধাও হয়েছে কবে। গ্যাসস্টোভটা পুরানো হয়ে গিয়েছে, আজকাল জ্বালাতে গেলে কেমন অদ্ভুত শব্দ হয়। ঠিক যেন বাতাসের কান্নার মতো, অথবা মুমূর্ষু রোগীর বাতাসের জন্য হাহাকার!
বারান্দার খড়খড়ি এখন নামানো, সূর্য ওঠার আগে আর তাদের খোলার সম্ভাবনা নেই। সন্ধ্যার পরে উত্তরদিকের মাঠের দিকে চাইতে বড্ড গা ছমছম করে চৈতির। ভূতের ভয় তার ছিল না কোনও কালে, কিন্তু মানুষ যে ভূতের চেয়ে ভয়ঙ্কর!
স্টোভে চায়ের জল বসিয়ে ছোট্ট সেলফ হাতড়ায় চৈতি। গুঁড়ো দুধ শেষ হয়ে গিয়েছে গতকালই, আজ আনব আনব করেও আনতে পারেনি সে। অগত্যা লাল চা-ই সম্বল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। মাঝেমধ্যে বড্ড একঘেয়ে লাগে এই একলা জীবন। স্মৃতিযাপনের জন্যও একখানা মুখ অন্তত থাকা জরুরি।
চায়ে চুমুক দিয়ে বিছানায় বসে বই খোলে চৈতি, পরের দিনে ক্লাসে পড়ানোর বিষয়গুলি ঝালিয়ে নেয়। আকাশটা কেমন যেন গুম মেরে রয়েছে আজ সন্ধ্যা থেকেই। মাঝে মাঝে বইছে জোলো বাতাস। মাটির সোঁদা গন্ধে মনটা কেমন যেন ফুরফুরে হয়ে উঠছে চৈতির। ইচ্ছে করছে উঁচুগলায় গান গাইতে৷ ঘরে একমাত্র আলো দানকারী একশো ওয়াটের বাল্বটা এইমাত্র কেঁপে কেঁপে নিভে গেল। চারিদিকে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার।
শোঁ শোঁ শব্দে ঝড় শুরু হয়েছে বাইরে, খড়খড়ির চাদর সশব্দে কেঁপে উঠছে বারবার। দেওয়ালে ভর দিয়ে মোমবাতি খুঁজছে চৈতি। কাছেই কোথাও জোরালো শব্দে আছড়ে পড়ল বাজ। চৈতির হাতের তালুতে শক্ত করে ধরা পেন্সিল টর্চখানা কাঁপছে। দূর থেকে ভেসে আসছে কোনও শিশুর কান্নার শব্দ। একটু একটু করে তা এগিয়ে আসছে এই এক কামরার ঘরখানার দিকে। পশ্চিমের বাঁওড়ের ধার ঘেঁষেই এগিয়ে আসছে শব্দটা। নাকি বাঁওড় থেকেই উঠে আসছে কেউ!
(২)
খট খট শব্দ হয় পুরনো কাঠের দরজায়।
“পোস্টম্যান!” শব্দে খরখরে গলায় হাঁক পাড়ে লোকটা।
কাঠের দরজা অল্প ফাঁক করে মুখ বাড়ায় চৈতি। তার এলোমেলো চুল ও রক্তজবার মতো লাল চোখদুটো অমন দশাসই লোকটার অন্তরাত্মাও কাঁপিয়ে দেয়।
“একটা মানি অর্ডার আছে আপনার নামে। সই করে নিয়ে নিন৷”
কোনওক্রমে নিজের কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক করে বলে লোকটা।
“প্রয়োজন নেই। যার টাকা তাকেই ফিরিয়ে দাও গে। আমাদের মায়ে পোয়ে চলে যাচ্ছে ঠিকই, কারও দয়ার প্রয়োজন নেই৷”
কড়া গলায় কথাগুলো বলে মুখের ওপরে দরজা বন্ধ করে দেয় চৈতি।
হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে লোকটা। গতমাসেও মানি অর্ডার নিয়ে এসেছিল সে। চৈতির বাবা প্রতিমাসেই কিছু টাকা পাঠান তাকে, প্রতিবারই বিনা বাক্যব্যয়ে সই করে টাকা নিয়ে নেয় সে। এবার হলটা কী!
ভাবতে ভাবতে বাড়ি থেকে রাস্তায় নেমে আসে লোকটা। চৈতি দিদিমণিকে সে ভালো করেই চেনে। একটু কড়া ধাঁচের হলেও তার মতো শান্ত মানুষ পাওয়া শক্ত। চিরকালই বড্ড কম কথা বলে, পাড়ার কারও সঙ্গেই তার বাকবিতণ্ডা নেই। সেই চৈতি দিদিমণির আজকের রূপ কেমন যেন হতভম্ব করে দেয় তাকে৷ কেমন কর্কশ গলায় বললেন কথাগুলো! আর চোখ-মুখের অমন অবস্থাই বা হল কীভাবে! যেন মনে হয় কতকাল ঘুমোননি!
অন্যমনস্কভাবে চলতে চলতে পাড়ার পানবিড়ির দোকানের সামনে দাঁড়ায় লোকটা। দোকানি শিবুকে একটা সিগারেট দিতে বলে নিচুগলায় শুধোয়, “ভূতবাড়ির দিদিমণির হল কী! বাচ্চাটাচ্চা দত্তক নিলেন নাকি! গলার স্বরই বদলে গেছে!”
দোকানদার শিবু ঠোঁট ওলটায়, “জানিনে বাপু, তিনদিন ধরে তেনাকে তো স্কুলে যেতেও দেখছিনে। সারাদিন ঘরের ভেতর আটক থেকে কী যে করেন জানিনে। তবে বাঁজা মহিলাকে বাচ্চা দেবে কেডা! কী যে বলো!”
দোকানি অন্য খদ্দেরকে জিনিস দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দোকান থেকে পায়ে পায়ে বেরিয়ে আসে লোকটা। পেছন ফিরে একবার একতলা বাড়িটাকে দেখে নেয় ভালো করে। এই বাড়ি সম্পর্কে কারও মুখেই ভালো কথা শোনা যায় না। সে শুনেছে, আগে যে বুড়ি এই বাড়িতে থাকত সেও মারা গিয়েছে ভূতের হাতেই। মরার সময় কী বীভৎস অবস্থা হয়েছিল বেচারির চোখ-মুখের! ভাবলেও এখনও গায়ে কাঁটা দেয় লোকটার। এই দিদিমণির বড্ড সাহস! সকলে বারণ করার পরেও থেকে গিয়েছিলেন। খারাপ কিছু হল না তো!
ভাবতে ভাবতে পথ হাঁটে লোকটা। চৈত্রের খরখরে রোদ চোখে লেগে চোখ জ্বালা করে তার। বাঁওড় থেকে একটা অদ্ভুত পচা গন্ধ উঠে আসছে। ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। একতলা ছোট্ট বাড়িটা যেন ধূসর কুয়াশায় ঢেকে হারিয়ে যাচ্ছে লোকটার সামনে থেকে। বাড়িটা থেকে ভেসে আসছে একটি বাচ্চার তীক্ষ্ণ চিৎকার। হাড় হিম করা সেই চিৎকার ভরদুপুরেও স্নায়ু বেয়ে হিমজলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে।
(৩)
“জেদ করিসনে বাবা! একটু খেয়ে নে! আমার সোনা মানিক… মায়ের কথা শুনতে হয় বাছা!”
অন্ধকার ঘরে কারও উদ্দেশে কাকুতি মিনতি করছে চৈতি। বারবার হাতজোড় করে তাকে বলছে শান্ত হতে। কিন্তু তার থামার কোনও লক্ষণ নেই। অন্ধকারের ভেতরে গুমরে ওঠা নরকের আঁচে যেন ফুটে চলেছে সে, তার মর্মন্তুদ আর্তনাদ কাঁপিয়ে দিচ্ছে প্রতিটা পুরনো ইঁট। চৈতির কানের ভেতরটা ঝিনঝিন করছে, যেন রক্ত বেরিয়ে আসতে চাইছে প্রাণপণে। প্রায় তিনদিন হল কিচ্ছু খায়নি চৈতি, পেটের ভেতরটা যেন অসাড় হয়ে রয়েছে তার। তেতো স্বাদ উঠে আসছে গলা বেয়ে।
“অমন করিসনে বাবা! মাকে ক্ষমা করে দে এবারের মতো! আর কখনও কেউ আসবে না এ বাড়িতে। আমি সব্বাইকে মানা করে দেব। তুই শুধু রেগে যাসনে বাছা। মায়ের কথা শোন, একটু খেয়ে নে!”
হাতে মাখানো ভাতের দলা নিয়ে অন্ধকারের উদ্দেশ্যে অনুরোধ জানায় চৈতি। মেঝেতে সশব্দে মাথা ঠোকে। অন্ধকার ঘরের কোণে অদ্ভুত আলোড়ন বোঝা যায়। কী যেন একটা হামাগুড়ি দিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে আসে। চৈতি মাথা তোলার আগেই ‘ওফফ’ শব্দে কাতরে ওঠে সে। ভাতের দলামাখানো তার আঙুলগুলো ভাতের সঙ্গেই চালান হয়েছে অন্ধকারের গর্ভে, ক্ষতস্থান বেয়ে দরদরিয়ে ঝরছে রক্ত! লম্বা জিভ দিয়ে মেঝেতে পড়া রক্ত চেটে খায় অন্ধকারের জীব, তারপর ধারালো দাঁত বের করে খিলখিলিয়ে হাসে। কোনও অবোধ শিশুর মতোই স্নিগ্ধ সেই হাসি। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে যন্ত্রণার আর্তনাদ রোধ করতে করতে সেই হাসির দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির শব্দ করে চৈতি। ঘোলাটে অন্ধকারে তার রক্তাক্ত হাত থরথর করে কাঁপে।
তিনদিন আগের সেই ঝড়ের সন্ধ্যায় শিশুর কান্নার শব্দ শুনে দরজা খুলে দিয়েছিল সে৷ বাঁওড়ের পচা কাদা মেখে উঠে আসা ছোট্ট বিকলাঙ্গ শরীরটা লালচে গভীর চোখ মেলে তাকিয়েছিল তার দিকে, আধোস্বরে ডেকেছিল ‘মা’! তারপরে আর কিচ্ছু মনে নেই চৈতির।
তার চোখের সামনে থেকে মুছে গিয়েছে তার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ, স্বজনবর্গের কারও মুখ আর তার মনে নেই। তার শুধু মনে আছে একটা ছোট্ট জীব ঘাঁটি গেড়ে বসে রয়েছে তার ঘরে। ধীরে ধীরে শুষে নিচ্ছে তার জীবনীশক্তি। আস্তে আস্তে পুষ্ট হচ্ছে সে, হামাগুড়ি দিয়ে চলে বেড়াচ্ছে ঘরময়। খিলখিল শব্দে হাসছে, কখনও বা তীক্ষ্ণস্বরে কেঁদে উঠছে। মানুষ পছন্দ করে না সে, ক্ষিপ্ত হয়, ছুটে গিয়ে ছিঁড়ে নিতে চায় তাদের গলার নলি। অতিকষ্টে তখন তাকে নিরস্ত করে চৈতি। তার শরীরের এখানে ওখানে মাংস কামড়ে তুলে নিয়েছে সে, তবুও চৈতি অপত্যস্নেহে হাত বুলোয় তার কেশহীন মাথায়। রক্তজবার মতো লাল চোখে উথলে ওঠে স্নেহ। শত হলেও শিশু তো! ‘মা’ বলে যখন ডাকে তখন যে প্রাণটা ভরে ওঠে তার! ছিন্ন আঙুলের ডগাটা আরেকটু চিপে রক্ত বের করে বলে,
“খা বাবা! খেয়ে তাড়াতাড়ি সুস্থ হ দিকি!”
(৪)
“বাঁওড়ের ভূত ফিরে আইছে খুড়ো! ওই ভূতের বাড়িতে এখন রয়েছে সে! কাল রাতের বেলা বড় বাইরে পাওয়ায় একাই উঠে বাইরে আসি। তখনই বাড়িটার ছাদে দেখতে পাই। ওই মহিলা… ওই দিদিমণি ওরে ফিরায়ে আনছে খুড়ো! পাড়ার লোকেদের আর ছাড়বে নে সে!”
সকালবেলা গনশার চায়ের দোকানে আড্ডারত প্রবীণদের কাছে হাউমাউ করে কেঁদে পড়ে শিবু পানওয়ালা।
“বলিস কী শিবু! বাঁওড়ের ভূত তো সেই কবেকার কথা! তার পরিবার পাড়া ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে আর তো দেখা যায়নি তাকে!”
হাতে ধরা খবরের কাগজ দিয়ে বাতাস খেতে খেতে বললেন এক বৃদ্ধ।
“খুড়ো বিশ্বাস করেন, মিছে কতা কইছিনে। সত্যই কাল রাতে দেখেছি তাকে, ওই দিদিমণির কোলে। মোর চোখ এতো খারাপ নয় যে ভুল দেখব!”
হাঁফাতে হাঁফাতে বলে শিবু।
“আচ্ছা বেশ, চল দিদিমণির বাড়ি। সবাই মিলে যাই। যতদূর জানি, বাঁওড়ের ভূত যাকে ধরে তার আচার আচরণে বড়রকমের পরিবর্তন হয়। সেরকম হলে সনাতন ওঝাকে একটা খবর দিতে হবে।”
চায়ের দোকান ছেড়ে উঠে আসেন প্রবীণদের দল, সকলে মিলে এগিয়ে যান ছোট্ট একতলা বাড়িটার দিকে। কিছুটা এগোতেই অদ্ভুত পচা গন্ধে দমবন্ধ হয়ে আসে তাঁদের।
“বলেছিলাম খুড়ো! শিবু পানওয়ালা মিছে কথা কয়নে। দিদিমণি আজকাল স্কুলে যান না, বাজার করতেও বেরোন না। হলটা কী তবে!”
প্রবীণদের দলটা পায়ে পায়ে বাড়িটির দিকে এগোয়। বেশিদূর এগোতে হয় না, চৈতির তীব্র আর্তনাদ সকলকে অবশ করে ফেলে বাইরেই। দরজার কড়া নাড়তে ভুলে যান তাঁরা। শুনতে পান চৈতির করুণ কণ্ঠস্বর, “কাউকে কিছু করিসনে বাবা… ওনারা চলে যাবেন… মায়ের কথা শোন… জেদ করিসনে…”
কথা শেষ হওয়ার আগেই আবার তীক্ষ্ণস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে চৈতি। প্রবীণদের দলটা তড়িঘড়ি বাড়ির সামনে থেকে সরে আসে। মুখ কালো হয়ে গিয়েছে সকলের। মনে পড়ে যাচ্ছে কুড়ি বছর আগের সেই ঝড়বৃষ্টির রাত।
নিজের চারবছরের বিকলাঙ্গ পুত্রসন্তানকে বাঁওড়ের জলে চুবিয়ে মেরেছিলেন তার মা, নিত্য সাংসারিক অশান্তি ও অনুযোগের বহর পাগল করে দিয়েছিল তাঁকে। ভোরের দিকে বাঁওড়ের জলে ভেসে উঠেছিল বাচ্চাটির নিথর দেহ। পুলিশ তার মাকে ধরে নিয়ে যায় এবং কিছুদিন পরে তার পরিবারও পাড়া ছেড়ে চলে যায়। যতদিন তার পরিবার পাড়া ছেড়ে যায়নি সেই রাতগুলির কথা মনে করলে এখনও ভয়ে কেঁপে ওঠেন প্রবীণ মানুষগুলো।
প্রতিরাতে শিশুর কান্না ও রাস্তাজুড়ে তার ঘষে ঘষে এগিয়ে যাওয়ার শব্দে তটস্থ হয়ে থাকতেন সকলে। পাড়ার মুখরা বাগদী বউ বেঘোরে প্রাণ দিল তার কবলে পড়ে। সনাতন ওঝা অনেক কষ্টে মন্ত্র পড়ে বাঁওড়ের জলেই বেঁধে দিয়েছিল তাকে। শান্তস্বরে বলে গিয়েছিল, “সাবধান বাবুরা, এবারের মতো বেঁধে দি গেলাম, পরেরবার কিন্তু পারব না। বাঁওড়ের জলে ভুলেও নামবেন না কেউ।”
তবে কি কেউ নেমেছিল বাঁওড়ে!
উত্তর পাওয়া গেল সেদিন সন্ধ্যাবেলায়। পাড়ার ছেলের দল খেলতে খেলতে বল ফেলে দেয় বাঁওড়ে। পাড়ার অকুতোভয় ছোঁড়া গোপাল সেই বল আনতে নেমেছিল জলে। দিন সাতেক আগের কথা এটি।
“সনাতনকে ডেকে বাড়ির চারধার বন্ধন করে দিই বুঝলে! এমনিতেই ওই ভূতের বাড়িতে কেউ যায় না। বন্ধন করে বাইরে থেকে তালা দিয়ে দিলে আর সমস্যায় পড়তে হবে না কাউকে৷”
নিচু স্বরে বলেন এক প্রবীণ ব্যক্তি।
“কিন্তু দিদিমণি! উনি তো এখনও সেই ভূতের সঙ্গে আছেন, ওনাকে বাঁচাবার ব্যবস্থা করবেন নে খুড়ো!”
হতবাক হয়ে জানতে চায় পানওয়ালা শিবু।
“ও কি আর বেঁচে আছে নাকি! বাগদী বউকে ওই বাঁওড়ের ভূত কী করে খেয়েছিল মনে নেই! একেও হয়ত সেভাবেই সাবাড় করে ফেলেছে। ঘরছাড়া বাঁজা মেয়েমানুষ, কেউ খুঁজতে আসবে না ওকে। পাড়ার সকলকে বাঁচানোটা বেশি জরুরি এখন।”
প্রবীণদের কথায় সায় দেয় সকলে। দু’জন লোক তখনই সাইকেল নিয়ে রওনা হয়ে যায় সনাতন ওঝার খোঁজে।
(৫)
মধ্যরাতের ঘোর কাটিয়ে তখনও জেগে ওঠেনি ছায়াশরীরের দল, ঝাপসা কুয়াশার আস্তরণে ঢেকে রয়েছে মফস্বলের উদাসীন আকাশ।
তীব্র চিৎকারে ধড়ফড় করে উঠে বসে চৈতি। ঘরের ভেতরটা ভরে গিয়েছে ধোঁয়ায়, বাইরে কেউ ধুনি জ্বালিয়েছে হয়তো। ঘরের অন্ধকারতম কোণ থেকে তীক্ষ্ণস্বরে ভেসে আসছে অমানুষিক চিৎকার, কিছু বুঝে ওঠার আগেই চৈতি অনুভব করে তার সারা শরীর জ্বলছে৷
শরীরের এদিকে ওদিকে কামড়ের ক্ষত… কিছু পুরানো, কিছু টাটকা, যেন কেউ সদ্যই কামড় দিয়ে ছিঁড়ে নিয়েছে দেহতন্তু। রক্তক্ষরণে দুর্বল শরীর নিয়ে চৈতি চ্যাঁচায়।
“তোমরা চলে যাও, আমাদের মেরো না… আমরা বেঁচে আছি…”
প্রতিটা শব্দ বড় কষ্ট করে উচ্চারণ করে সে, ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে আসে তার।
বাইরের মানুষগুলো তার কথা শুনতে পেয়েছে কি পায়নি ঠিক বোঝা যায় না। ঘরের চারকোণে চারটি কাঁচা লোহার খিল পুঁতে দেয় সনাতন ওঝা, নাকিসুরে মন্ত্র পড়তে পড়তে কালচে গুঁড়ো ছড়িয়ে দেয় মাটিতে। চৈতির মনে হয় যেন কেউ আগুন লাগিয়েছে তার শরীরে, এক বেপরোয়া বাতাস যেন বন্ধ ঘরের ভেতরে ঢুকে তাকে আছড়ে ফেলে মেঝেতে। কোনওক্রমে শরীর ঘষতে ঘষতে দরজার দিকে এগোয় সে, প্রাণপণে ধাক্কা দেয় নিথর দরজায়, “দরজা খোলো… আমায় বেরোতে দাও… আমি বেঁচে আছি…”
ঘরের বাইরের লোকগুলো ধীরে ধীরে চলে যায়, চৈতির গলার স্বর নিস্তব্ধ অন্ধকারে মাথা খুঁড়ে মরে, কেউ সাড়া দেয় না।
একমাস পরে…
“ম্যাডাম পোস্টম্যান! আপনার মানি অর্ডার এসেছে!”
কালো সুতো দিয়ে আগাপাশতলা বন্ধন করা দরজার বাইরে থেকে হাঁক পাড়ে লোকটা। তাকে সকলে বলেছিল বাড়িতে কেউ নেই, কিন্তু এইতো সে শুনতে পাচ্ছে চৈতির গলার স্বর, সুর করে গাইছে সে…
“সোনা ঘুমাল, পাড়া জুড়াল বর্গি এল দেশে… বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কীসে!”
ক্ষিপ্রহাতে দরজার কড়ায় আটকে রাখা কালো সুতোগুলো ছেঁড়ে লোকটা। এই পাড়ার মানুষগুলো অন্ধবিশ্বাসী, অনেক আগে থেকেই ভূতের বাড়ি বলে ডেকে দিয়েছিল বাড়িটাকে।
সুতো ছেঁড়ার সঙ্গে সঙ্গেই থেমে যায় গান। কিছু একটা যেন ঘষতে ঘষতে এগিয়ে আসে দরজার সামনে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক শীর্ণকায় শিশুর কালো হাত অল্প খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে হাত বাড়ায়।
ভেতরে চৈতি খিলখিলিয়ে হাসে।
***
রিয়া ভট্টাচার্য
জন্ম পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার খড়গপুর শহরে। প্রথম ছাপার অক্ষরে আত্মপ্রকাশ সিসৃক্ষা প্রকাশনীর ‘প্রিজম’ গল্প সংকলনে। একক বইয়ের সংখ্যা আপাতত ছয়টি। রয়েছে গল্পগ্রন্থ – ‘স্মৃতিমেদুর গল্পগুলো’, ‘অশনি সংকেত’, ‘প্রেতছায়া’, ‘অরিহন্ত্রী’ এবং কাব্যগ্রন্থ ‘বিরহিয়া বারিষনামা’ ও ‘অনুভবের সালতামামি’। এছাড়াও ‘আরবান লেজেন্ডস’ (পলান্ন প্রকাশনী), ‘ভয়ঙ্কর বিশ’ (পালক পাবলিশার্স), ‘কাব্যফেরী’ (অক্ষরসংলাপ প্রকাশন), ‘শ্রমণা কাব্যসংকলন’ (রা প্রকাশন) ইত্যাদি সংকলনে কাজ করেছেন তিনি। লিখেছেন “নবকল্লোল”, “ভবিষ্যৎ ম্যাগাজিন”, “আজকের অনন্যা”, “যুগসাগ্নিক”, “ভিস” ইত্যাদি পত্র-পত্রিকায়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন