বিশ্বরূপ মজুমদার
রাতের শেষ ট্রেনটা কিছুক্ষণ আগেই আমার সামনে থেকে বেরিয়ে গেল। ছোট স্টেশন, তাতে আবার ইদানীংকালে কিছু গুজব রটেছে। পুরুলিয়ার বেগুনকোদর স্টেশন। কারা যেন গুজব ছড়িয়েছে, এখানে ভূতের উপদ্রব। এমনিতেই এখানে যাত্রী সংখ্যা কম। এখন এমন অবস্থা হয়েছে, দিনমানে গার্ডও সিগন্যাল দিতে রাজি হচ্ছে না। এই ফেসবুক আর স্মার্ট ফোনের যুগেও মানুষ যে এত ভূতের ভয় পেতে পারে, ভুক্তভোগী না হলে বিশ্বাস করা কঠিন। আমার মতো গ্রামের সাধারণ মানুষ, যার আবার ভাড়ার গাড়ির ব্যবসা, তার এতে হয়েছে সমূহ ক্ষতি। বেগুনকোদর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে চিপকপুর, সেখানেই আমার গ্রাম। একমাত্র লোকাল ট্রেন যাওয়া এই বেগুনকোদর স্টেশনে যদি আর ট্রেন না থামে, আমার মতো মেঠো মানুষদের বড় সমস্যা হবে। ভূত নিয়ে বিলাসিতা করা আমাদের মতো খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে চলে না।
রাতে বিরেতে গাড়ি নিয়ে ছুটে বেড়াই দুটো পয়সার জন্য। গ্রামদেশে সাতটার পরই দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় আর রাত ন’টা মানে এখানে একেবারে নিশুতি রাত। আমি রাত বারোটার সময়ও রুগী আনতে বেগুনকোদর স্টেশন দিয়ে এসেছি, গেছি। একদিনও কোনও অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েনি। তাই ট্যুরিস্টরা এসে যখন জানতে চায়, ‘এখানে ভূত আছে?’ আমার তখন ভারি বিরক্তি লাগে।
আমার একটা ফোন আছে। ফোন না রাখলে, আমাদের গাড়ি ভাড়ার কাজ চলে না। যত ভাড়ার খবর, সবই তো ফোনেই পাই। এ আবার স্মার্ট ফোন। আমি এর খুব ভালো ব্যবহার জানি না। ফোনে আমার শহরের পরিচিত কয়েকজন আবার নেট কানেকশানও করে দিয়েছে। এখন তো হোয়াটসঅ্যাপের যুগ। ওরা মাঝে মাঝে আমাকে ছবি পাঠিয়ে বলে, ‘সুভাষ একটু দেখে নিস।’ তখন ফোনটা খুলে একটু দেখি আর নাড়িচাড়ি।
পুরুলিয়ার সব থেকে সুন্দর জিনিস হল গিয়ে পলাশ ফুল। গরমের শুরুতে ফুল ফুটে যেন চারিদিকে আগুন লেগে যায়। গাছগুলো তখন যেন একেবারে জ্যান্ত হয়ে ওঠে। আপনারা ভাববেন, এ আবার কীরকম কথা! গাছ তো জ্যান্তই হয়। তাদের আমি বলব, ফুল ফোটার সময় একবার জ্যোৎস্না রাতে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাবেন। সমস্ত প্রকৃতি তখন যেন একেবারে জীবন্ত হয়ে ওঠে। গাছের পাতায় জোছনার আলো পিছলে যায়। এক আশ্চর্য জগৎ সামনে এসে দাঁড়ায়। কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলে, হাসে। এ অনুভূতি ভৌতিক নাকি জানি না। তবে এ অনুভূতি আমার অনেকবার হয়েছে। সত্যি বলছি, তখন আমার মতো ডাকাবুকো মানুষেরও গা কেমন ছমছম করে উঠেছে। বন্ধুরা অনেকে ঠাট্টা করেছে, শুনে। আমি তাই এই অনুভূতি নিজের মধ্যেই রেখেছি। মনের একান্ত গভীর অনুভূতি সকলকে বলার নয়।
রাত হয়েছে খানিকটা। একটা ভাড়া নিয়ে মুরি স্টেশন থেকে ফিরছিলাম। সময়টা চৈত্র মাস। অজস্র পলাশ ফুটে আছে, চারিদিকে। মুরি স্টেশনটা পড়ে ঝাড়খণ্ডের সীমানায়। পুরুলিয়ার শেষ প্রান্তে। চিপকপুর থেকে বেশি একটা দূর নয়। ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গেছে। ওখানকার সন্ন্যাসী লজে আমার পুরনো বন্ধুরা গল্পে গল্পে দেরি করিয়ে দিল। বেশি রাস্তা নয় বলে, আমিও গা করিনি। ফেরার পথে জঙ্গল পড়ে। একা গাড়ি নিয়ে চলেছি। এখানে মাঝে মাঝে হাতি বের হয়, তাই গাড়ি চালাচ্ছি বেশ জোরেই। জোছনা রাত। তার উপর, পলাশ ফুলের সময় চলছে। অপূর্ব সুন্দর পরিবেশ। চারিদিক যেন অস্বাভাবিক স্বচ্ছ আর সাদা হয়ে আছে। মাঝে মাঝে এক একটা পলাশগাছ ফুলের ভারে যেন নুয়ে পড়েছে। প্রকৃতিতে আজ যেন কীসের এক উৎসব শুরু হয়েছে। এমন সময় আমার ফোনটা বেজে উঠল। ওপ্রান্তে একজন পুরুষ কণ্ঠ বলে উঠলেন, ‘সুভাষবাবু! বড় বিপদে পড়েছি। মেয়েটা জ্বরে অচৈতন্য হয়ে পড়েছে। আমি কলকাতা থেকে পুরুলিয়া এসেছিলাম। ওকে এখনই একবার হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কাছাকাছি কোটশিলা হাসপাতাল আছে শুনেছি। আপনি তো কাছাকাছিই থাকেন। যদি একটু গাড়িটা নিয়ে আসেন। আমি সন্ন্যাসী লজে উঠেছি। সকালে ওখান থেকে বেরিয়ে, এদিক সেদিক করে, মেয়ে ভূত দেখবে বলে জোর করায়, ওকে নিয়ে বেগুনকোদর স্টেশনে এসেছিলাম। এখন আমরা ওখানেই আছি। এদিকে এখানে তো মাথার উপর একটা ছাদও নেই, যে একটু বসে বিশ্রাম করব! ফাঁকা মাঠের উপর স্টেশন। কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে কিছুই চোখে পড়ছে না। আমার ভাড়া গাড়ির চালক, আপনার নাম বলল, আর এই নম্বরটা দিয়ে, সেই বিকেলে কোথায় যেন চলে গেছে। এখনও আসেনি। এদিকে অন্ধকারে অসুস্থ মেয়ে নিয়ে আমি পড়েছি মহা ঝামেলায়।’
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ‘আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি এখনই পৌঁছাচ্ছি।’ ফোনটা কেটে যেতে স্ক্রীনে একটা ছবি ফুটে উঠল। একটা বাচ্চা মেয়ের ছবি। সুন্দর ফুটফুটে মুখ। ফোনে কী করে যেন হঠাৎ নেট কানেকশান চালু হয়ে গেছে। আমি এসব বুঝি না। ভিডিও কল না কীসব যেন বলে। তবে কল লিস্টে দেখলাম কোনও নম্বরই ওঠেনি। যাক বাবা, এ আবার কী ব্যাপার! বাড়িতে আমারও এই বয়সের মেয়ে আছে। ও এইসব ভালো বোঝে। একবার ওকে ফোনটা দেখিয়ে নিতে হবে।
হুড়মুড় করে গাড়ি চালিয়ে স্টেশনে এসে দেখি, কেউ কোথাও নেই। আমি কলকাতার মানুষদের কাছে এমন ব্যবহার আগেও পেয়েছি। হয়তো বিপদে পড়ে ডেকেছে, এর মধ্যে অন্য গাড়ির ব্যবস্থা হঠাৎ হয়ে গেছে। ব্যস, কিছু না জানিয়ে সোজা হাওয়া। এরাও হয়তো তাই করেছে। আমি প্ল্যাটফর্মের চারদিকে একবার চোখ বুলালাম। অন্ধকারে একটা লাল টিমটিমে আলো জ্বেলে টিকিটবাবু বসে আছেন। আর আধঘণ্টা পরে গুমটি বন্ধ করে দেবেন। মাঠের মধ্যে একটা রেললাইন আর একটা নামের বোর্ড নিয়ে স্টেশন। ঘড়িতে প্রায় আটটা। সামনে দিয়ে রাতের শেষ লোকাল ট্রেনটা বেরিয়ে গেল। আমি গাড়ি থেকে নেমে চারিদিকে চোখ চালালাম। কই কোথাও কেউ নেই তো!
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে মাঠের মধ্যে এগোতেই, কার একটা অস্পষ্ট গলা শুনতে পেলাম।
“সুভাষবাবু! দাঁড়ান! আমরা এখানে।”
অন্ধকারে ভালো করে দেখতে পেলাম না। তবে একজন ভদ্রলোক অন্ধকারে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। জোছনা রাত। আমার একটা দৃশ্য দেখে চমক লাগল। মাঠের মধ্যে চাদর জড়িয়ে মেয়েটা শোয়ানো আছে। ভারি সুন্দর সেই মুখ, যা আমার ফোনে একঝলক ভেসে উঠেছিল। বললাম, “গাড়িতে উঠে আসুন। ওর জ্বর খুব বুঝি? ওকে একেবারে মাটিতে শুইয়ে রেখেছেন—!”
ভদ্রলোক পাঁজাকোলা করে মেয়েকে তুলে নিলেন গাড়িতে। নিজেও পিছনে বসলেন। মাথায় একটা টুপি পরায়, তার মুখ স্পষ্ট দেখতে পেলাম না। কোটশিলা হাসপাতাল বেশি দূরে নয়। গাড়ি চালু করলাম। ভদ্রলোক বললেন, “আমি বিষ্ণু হালদার। থাকি কলকাতার বরানগরে। ও আমার মেয়ে পাখি। আমার একমাত্র মেয়ে। ওর মা মারা গেছে খুব ছোটবেলায়। প্রতিবার ছুটিতে আমরা দু’জন বেড়িয়ে পড়ি। এবারে আমরা পুরুলিয়া এসেছি। আপনি তো এখানকার লোক, কাল রাতে এখানকার সন্ন্যাসী লজে একজন খুন হয়েছে তা শুনেছেন?”
“হ্যাঁ আজকেই একটা কাজে ওখানে এসে সব শুনলাম। যিনি খুন হয়েছেন, আপনাদের ওখানকার, মানে কলকাতার লোক। অনেক পয়সাওয়ালা লোক ছিলেন শুনেছি। হোটেলের সবচেয়ে দামি এ.সি ঘরটা অনেকদিন ধরে বুক করে রেখেছিলেন। নামটা শোনা হয়নি।”
“আমিও নামটা শুনিনি। শুনলাম বডি পাওয়া যায়নি। শুধু ঘরের বেড কভারে রক্ত লেগেছিল প্রচুর।”
“শুনেছি পুলিশ এসে হোটেলের কর্মচারীদের ধরে নিয়ে গেছে, জেরা করার জন্য। আচ্ছা আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?” আমি প্রশ্নটা করে পেছন ঘুরে তাকালাম।
“কী করে বলব বলুন? কে কেমন মানুষ, কে জানে!”
“হয়তো লোকটার কোনও অসাধু ব্যবসা ছিল। তাই ওর শত্রুরা এসে ঘরে ঢুকে মেরে দিয়ে গেছে।”
“আর লাশ? লাশ কী হল তাহলে? এত তাড়াতাড়ি দু’-দুটো লাশ গায়েব করা তো সহজ নয়, যদি হোটেলেরও কেউ জড়িত না থাকে।”
“দুটো?”
“হ্যাঁ, দুটো। আমার আর আমার মেয়ের বডি। দুটোই তো হল, তাহলে। তাই না! মেয়েটাকেও ওরা ছাড়ল না জানেন!”
কী বলে কী লোকটা? পাগল নাকি? হাসপাতাল আর হয়তো দুশো মিটারও নয়। সামনে হ্যালোজেনের মৃদু আলো দেখা যাচ্ছে। আমি চকিতে পেছনে ফিরে তাকালাম, আর তখনই একটা তীব্র কটু গন্ধটা পেলাম। অল্প আলোয় দেখলাম, সমস্ত গায়ে পচা গলা শাকপাতার আবর্জনা মাখা, দুটো নিস্প্রাণ শক্ত হয়ে যাওয়া মৃতদেহ সোজা হয়ে আমার গাড়ির পিছনের সিটে বসে আছে। সমস্ত শিরদাঁড়া বেয়ে এক প্রবল ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল আমার। জ্ঞান হারানোর আগে, তবুও শুনতে পেলাম কয়েকটা মাত্র কথা। সেই কয়েকটি কথা জানার ফলেই পুলিশের কাছেও পরে বিষয়টা পরিষ্কার হয়েছিল। লোকটা বললেন, “কাল রাতে খুব কাছ থেকে গুলি করার পর, প্রথমে আমাদের দেহ দুটো হোটেলের সবুজ সার করার পাথরের ট্যাঙ্কে ফেলা হয়েছিল। আপনি গাড়ির ডিকিটা একেবারও খেয়াল করেননি, দেখছি। আজ সন্ধ্যায়, হোটেলের সবুজ সার করার সেই বিশাল ট্যাঙ্ক থেকে পুলিশের ভয়ে আমাদের বডি দুটো আপনার গাড়িতে তুলে দিয়েছিল, হোটেলের কর্মচারীরা। অবশ্য ওরা খুব ভালো করে প্যাকিং করেছিল, যাতে কোনও গন্ধ না পাওয়া যায়। তবে, সেই প্যাকিং খুলে আমরা এখন বাইরে এসেছি। স্রেফ সামান্য কিছু টাকার লোভে আমরা কিন্তু খুন হইনি। এর পিছনে অনেক লম্বা হাত আছে। আমি একজন সিবিআই অফিসার। ঝাড়খণ্ড ও মুরি অঞ্চলে নিষিদ্ধ মাদক, হাসিস পাচারের চক্রটা আমি একাই ধরে ফেলেছিলাম, এখানে হঠাৎ বেড়াতে এসে। আর তাই, তাই…।
***
নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী
বেথুন কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ছাত্রী নন্দিতা বুদ্ধ ও বৌদ্ধ যুগের উপর আগ্রহ থেকে প্রাথমিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিভাগে পালিভাষা শিখতে শুরু করেন। বর্তমানে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগে গবেষণারত। প্রকাশিত বই “জীবক” এবং গল্পগ্রন্থ “কাকুলাস হারসুটাস”।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন