বিশ্বরূপ মজুমদার
মালপত্র নিয়ে সৌমভ যখন রণদীপ মিত্রের বাড়িতে ঢুকল তখন পৌষের সূর্য শেষের আলো ছুঁইয়ে দিয়ে ফিরে গেছে নিজের ডেরায়। সৌমভ বাড়ির পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখল রাস্তাটায় কোনওদিন হয়তো পিচ পড়েছিল। এখন আর পিচ নেই, শুধু কোথাও কোথাও একটু কালো কালো ছোপ রয়ে গেছে বর্ষার আকাশের মেঘের মতো। রাস্তাটা কেমন যেন নির্জন। দু’-একটা আলো পোস্টের গায়ে মিটমিট করে জ্বলছে বটে, কিন্তু কী এক অজ্ঞাত কারণে লাইটের গা থেকে আলো রাস্তায় গড়িয়ে পড়ার আগেই হাওয়ার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে যেন। তাই আলোটাও বড্ড ফ্যাকাশে।
বাড়িটার সামনে একটা মজা পুকুর। আর পেছনে একটা ফাঁকা প্লট। আশেপাশে কয়েকটা বাড়ি আছে। কিন্তু অনেকটা জায়গা ছেড়ে ছেড়ে। বড় রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা ভেতরে থাকায় গাড়ি খুব কম চলাচল করে বলেই মনে হচ্ছে সৌমভর। কারণ, এতটা সময়ে সে একটা গাড়িও যেতে দেখেনি।
বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা ফাঁকা। বাড়ির একপাশে একটা স্টেশনারি দোকান, দোকানের পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে। আর একপাশে একটা ঘর সঙ্গে অ্যাটাচড টয়লেট। তিনতলা বাড়িটাকে আলো আঁধারে কেমন যেন দৈত্যের মতো দেখতে লাগছে। বাড়ির মালিক রণদীপ মিত্র লোকটাও বাড়িটার মতোই কেমন যেন অদ্ভুত ধরনের। লাল লাল চোখদুটো দিয়ে এমনভাবে তাকায় যেন দৃষ্টি বুকের গভীরও দেখে নিতে পারে। খুব কম টাকায় ভাড়া পেয়েছে বলে সদ্য ব্যাঙ্কের চাকরিতে জয়েন করা সৌমভ বাড়িটাকে এক দেখাতেই পছন্দ করে নিয়েছে।
ঘরের ভেতর মালপত্র নিয়ে ঢুকে সৌমভ ঘরটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। ঘরের ভেতরে এক দেওয়ালে কিছু লিখে কাগজ চিপকানো ছিল। সেটা টেনে তোলায় কাগজের সাদা সাদা দাগ রয়েছে। কোথাও কোথাও দেওয়াল ফাটা। ঘরের রংটাও সেরকম কিছু বোঝা যাচ্ছে না। বহুদিন ঘরটাকে রং বা মেরামত কিছুই করা হয়নি। ঘরে ঢুকতেই কেমন একটা বোঁটকা গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা মারল। গন্ধটা ঠিক কীসের বুঝতে পারল না সৌমভ । কিন্তু গন্ধটাতে গা হাত পা কেমন যেন শিরশির করে উঠল। হয়তো অনেকদিন ঘরটা বন্ধ অবস্থায় পড়ে ছিল তাই এরকম গন্ধ। ঘরের একপাশে একটা কাচের পাল্লা রাখা রয়েছে। তাতে বড় বড় করে লেখা — পি সি ও। একটা পুরনো চৌকি, একটা প্লাস্টিকের পুরনো চেয়ার আর একটা পায়া-ভাঙা টেবিল। ঘরের মাঝখান দিয়ে একটা নোংরা দড়ি ঝুলছে। কেউ বোধহয় কখনও দড়িটা ঝুলিয়েছিল।
দিন পাঁচেক পরে সৌমভ রণদীপবাবুর দোতলার বেল বাজালে একটি বছর কুড়ির মেয়ে এসে দরজা খুলতেই সৌমভ জিজ্ঞেস করল – “রণদীপবাবু আছেন? আমি প্রথম মাসের ভাড়া দিতে এসেছি।”
মেয়েটি উত্তর দিল – “বাবা বাথরুমে আছেন। আমি বলে দেব আপনি এসেছিলেন।” — বলেই মেয়েটি ভেতরে ঢুকে গেল।
সাধারণত বাড়িতে কেউ এলে তাকে আমরা বসতে বলি বা দু’-একটা ভালো মন্দ কথা বলি। কিন্তু মেয়েটি সেসবের কোনওটাই করল না। বোধহয় সে কথাও গুনে গুনে খরচ করে। অন্তত সৌমভর তেমনটাই মনে হল।
মেয়েটির তাকানোর ভাব এবং কথা বলার ভঙ্গি দেখে সৌমভর মনে একটু সন্দেহ হল। মেয়েটি কি মানসিকভাবে একটু অসুস্থ? নাকি বিধ্বস্ত কোনও কারণে? ঠিক বোঝা গেল না। তা ওদের মেয়ে সুস্থই হোক বা অসুস্থ, তা নিয়ে সৌমভর কোনও মাথাব্যথা নেই। এই মেয়েটির সুর করে কান্নাই বোধহয় দু’-তিন দিন সৌমভ শুনতে পেয়েছে! এমনিতে তিনতলা বাড়িটা বেশ শান্ত, নিঃঝুম বাড়ি। সৌমভর এরকম বাড়িই ভীষণ পছন্দ। সারাদিন ধরে চেঁচামেচি, হইচই একদম ভালো লাগে না তার।
কিন্তু এই শান্ত বাড়িটাই মাঝে মাঝে অশান্ত হয়ে ওঠে রণদীপবাবুর স্ত্রী’র চিৎকারে। সৌমভ বুঝতে পারে মেয়েটিকে বোধহয় কোনও কারণে বকাবকি করেন ভদ্রমহিলা। কোনও কোনও সময় রণদীপবাবু হয়তো বলে ওঠেন – “আহ্ ছন্দা! ছাড়ো না! ওকে ওর মতো থাকতে দাও। সবসময় ওর পেছনে পড়ে আছো কেন?”
মাঝে মধ্যে রণদীপবাবুর স্ত্রীকে বিলাপ করতে শোনা যায়। কিন্তু কী কারণে এদের মধ্যে এত ঝামেলা ঠিক বুঝতে পারে না সৌমভ।
রাস্তায় বেরোলে সবাই কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। সেদিন রাস্তার শেষ বাড়িটার একজন বছর পঞ্চাশের ভদ্রলোক তো সরাসরি জিজ্ঞেস করেই ফেললেন – “মিত্তিরদের বাড়িতে উঠেছেন? বাব্বা! আপনার দম আছে মশাই।” কিন্তু এই প্রশ্নের তাৎপর্য হাজার জিজ্ঞাসার পরেও লোকটা বলেনি। শুধু বললেন – “ক’দিন থাকুন, আপনিও বুঝতে পারবেন।”
বাড়িটার আগাপাশতলা পুরোটাই অদ্ভুত। অন্ধকারে কেমন যেন একটা গা ছমছমে অনুভূতি হয়। এই বাড়িতে একটা গোপন কিছু রয়েছে যেটা হয়তো বাড়িওয়ালা জানেন। কিন্তু সেটা প্রকাশ করছেন না।
* * * * *
সেদিন ঠিক সাড়ে সাতটায় ঘুম ভাঙ্গল সৌমভর। শীতকালে এরকম সময়েই ওঠে সে। ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজ না পড়লে মনটা বড্ড খচখচ করে। তাই খবরের কাগজের খোঁজে বাইরে বেরোতেই দেখল রণদীপবাবু সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। — “গুড মর্নিং, রণদীপবাবু। এত সকালে কোথায় চললেন?” — সৌমভ বলল।
কিন্তু মুখটা গম্ভীর করে সৌমভর পাশ দিয়ে নেমে চলে গেল রণদীপবাবু। তার মুখ-চোখের এমন ভাব যেন সে সৌমভকে দেখেনইনি কিংবা তার কথা শুনতেই পাননি। অদ্ভুত ব্যাপার!
দিন সাতেক পর এক রাতে এগারোটা নাগাদ লাইট অফ করে শুয়ে পড়ল সৌমভ। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। কীসের যেন একটা আওয়াজ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। প্রথমে ঘুমের চোখে অতটা বুঝতে পারল না সে। তারপরেই সে বুঝতে পারল একটা ফোন বিকট আওয়াজে রিং হচ্ছে। সত্যিই অদ্ভুত ব্যাপার! সৌমভ প্রথমে ভাবল ওর নিজের মোবাইল ফোনের রিংটোন বোধহয় কোনওভাবে চেঞ্জ হয়ে গেছে। কিন্তু ফোনে হাত দিয়ে বুঝল চার্জের অভাবে তার ফোন সুইচড অফ হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু শোয়ার আগেই তো ফোনে সে দেখেছে সেভেন্টি ফাইভ পারসেন্ট চার্জ রয়েছে!
একে ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘর। তার উপরে আবার এরকমভাবে ফোন বেজে চলা। শীতের রাতে এমনিতেই শব্দের প্রাবল্য বেশি হয়। চারদিকে নিস্তব্ধতার কারণে আওয়াজ আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ছে।
হ্যাঁ, আওয়াজটা এখানেই হচ্ছে এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এ-ঘরে ল্যান্ড ফোন এল কোথা থেকে? কই এই ক’দিন সারাদিনে একবারও তো কোনও ফোন দেখেনি সৌমভ! বুঝতে পেরেছে। বুঝতে পেরেছে। এখন মনে হচ্ছে গতকাল রাতেও এরকম কোনও আওয়াজ হয়েছিল। কিন্তু গভীর ঘুম ছিল বলে ধরতে পারেনি। ভেবেছিল স্বপ্ন। — ‘তবে কি পাশের ঘরে কোনও ফোন আছে? পাশে তো রণদীপবাবুদের স্টেশনারি দোকান রয়েছে। হতেও পারে।’ —মনে মনে ভাবল সৌমভ ।
তখনই কে যেন ফোনটা রিসিভ করল। একটি মহিলা কণ্ঠস্বর ওপাশ থেকে বলল – ‘বিষ্ণু, এই বিষ্ণু। ফোনটা এতক্ষণ ধরে বাজছিল! এত দেরি করলে কেন ফোন ধরতে? আর এই ক’দিন ফোন ধরোনি কেন?’
౼ ‘আজ রাখো। একটু সমস্যা হয়েছে বুঝলে। ঘরে নতুন লোক এসেছে। একটু বুঝে-শুনে চলতে হবে। পরে তোমাকে জানাচ্ছি সব। রাখছি এখন।’
౼ ‘বিষ্ণু…!’
ক্রেডেলে ফোন নামিয়ে রাখার স্পষ্ট আওয়াজ হল। যদিও মনে হচ্ছে আওয়াজটা এই ঘর থেকেই আসছে। কিন্তু না, নিশ্চয়ই পাশের দোকানঘরেই ফোনে কথা হচ্ছিল এই সময়টুকুতে। মাঝে শুধু একটা দেওয়াল বলে বোধহয় এরকম মনে হচ্ছে। কাল একবার রণদীপবাবুকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে হবে।
* * * * *
কাল রাতে ঠিকমতো ঘুমটা হয়নি সৌমভর। সকাল থেকে দু’বার বাইরে উঁকি দিয়ে দেখেছে দোকান খুলেছে কিনা। সাড়ে আটটা নাগাদ শাটার তোলার আওয়াজ এল। সঙ্গে সঙ্গেই সৌমভ বাইরে বেরিয়ে এসে রণদীপবাবুকে উদ্দেশ করে বলল – “আপনাদের দোকানে রাতে লোক থাকে বুঝি? ভেতর দিক থেকে ওপরে ওঠার ব্যবস্থা আছে নিশ্চয়ই?”
রণদীপবাবু একটু অবাক হয়ে সৌমভর দিকে চেয়ে বললেন – “কেন বলুন তো?”
౼ “না মানে গত রাতে আপনার দোকানের ল্যান্ডফোনে ফোন এসেছিল। যে ছেলেটি থাকে সে ফোন রিসিভ করে কথা বলল। আমার ঘুমে অসুবিধা হবে বলে বেশি কথা বলেনি বোধহয়। ওনাকে বলে দেবেন ফোনের শব্দে আমার তেমন কোনও ডিস্টার্বেন্স হয় না।
౼ “কিন্তু, আমার দোকানে রাতে তো কেউ থাকে না! আর তাছাড়া, নীচে তো কোনও ফোন নেই এখন! আগে তোমার ঘরে পাবলিক টেলিফোন বুথ করেছিলাম। চলতও বেশ। কিন্তু এখন মোবাইল রয়েছে সবার কাছেই। কে আর বুথে আসবে ফোন করতে! তাই আমার দোকানটাকে একটু ছোট করে বুথের দোকান ভেঙে তোমাদের ভাড়ার ঘর বানিয়ে নিলাম।”
আরও কীসব যেন বলে চলেছেন রণদীপবাবু। কিন্তু আর কিছুই তার কানে ঢুকছে না। — ‘আমি স্পষ্ট শুনেছি ফোন বাজতে, কথা বলতে! এটা কীভাবে সম্ভব! রণদীপবাবুর মুখ দেখে পরিষ্কার বুঝতে পারছি কিছু একটা লুকোচ্ছেন উনি। কিন্তু কী লুকাতে চাইছেন? কেনই বা চাইছেন?’ — সৌমভ মনে মনে ভাবল।
* * * * *
সকাল থেকেই আজ ভীষণ মন খারাপ করছে মলির অর্থাৎ মল্লিকার, রণদীপ মিত্রের একমাত্র মেয়ের। নীচে একটা ছেলে ভাড়া এসেছে। তাই বিষ্ণু বিশেষ একটা কথা বলতে চাইছে না।
“আজ একটু কথা বলতেই হবে ওর সঙ্গে। আর পারছি না সহ্য করতে। এই কথাটুকুই তো শুধু আছে! তাছাড়া আর কি আছে আমার জীবনে! কিচ্ছু নেই। কিচ্ছু নেই। যখন ও বেঁচে ছিল তখন রাতের পর রাত আমার এই তিনতলার ঘর থেকে একতলার দোকানের ফোন বুথের ফোনে ওর সঙ্গে কথা চালিয়েছি। যখন রাত হয়ে উঠত নিশুতি, লোকজন সব যেত ঘুমিয়ে, চাঁদ হাসত মাঝ আকাশে — তখন শুরু হত দু’জনের প্রেমালাপ। সেইসব কথা আজও যেন জীবন্ত হয়ে আছে। গভীর রাতে ওর সঙ্গে ফোনে কথা বলা আমার কাছে নেশার মতো। এই নেশা ছাড়া আমি বাঁচবই না। দু’বছর হয়ে গেল বিষ্ণু চলে গেছে আমাকে ছেড়ে। কী ভীষণ ইচ্ছে করে ওকে একটু ছুঁতে! ইচ্ছে করে দু’চোখ ভরে ওকে একটু দেখতে। কিন্তু সে’সব পারি কোথায় আর! সন্ধের পর থেকে ও আমার কাছাকাছি থাকে বুঝতে পারি। কিন্তু কেমন ধোঁয়ার মতো অস্পষ্ট ওর অস্তিত্ব। ছুঁতে গেলেই মিলিয়ে যায়। যন্ত্রণা হয়। বড্ড যন্ত্রণা হয়। মাঝেমাঝেই আমার নিজেকে পাগল পাগল মনে হয়। ওর সঙ্গে একটু কথা না বলে আর থাকতে পারি না। বাবা মা তো কেউই বুঝতে পারে না আমার যন্ত্রণা। ওরা ভাবে বিষ্ণুকে ছেড়ে আমি বোধহয় ভালোই আছি। বেশ খাচ্ছি-দাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি! ভেতরে ভেতরে নিশ্চয়ই দাদার সঙ্গে যোগসাজশ করে আমার জন্য ছেলেও দেখছে। কিন্তু ওরা কেউ বুঝতে পারছে না যেদিন অন্য কোনও ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে, সেদিনই আমি সারাটা জীবনের জন্য আমার বিষ্ণুর কাছে চলে যাব।” — বিড়বিড় করে বলছে মল্লিকা।
* * * * *
রাতে আজ আর বাইরে বেরোতে ইচ্ছে করেনি সৌমভর। আজ ব্যাঙ্কে একটা অডিট ছিল। অফিস থেকে বেরতে বেরতেই সাতটা বেজে গেছে। ঘরে ফেরার সময় একটা দোকান থেকে রুটি তড়কা নিয়ে এসেছে সে। ন’টা নাগাদ খেয়ে একটা বই পড়তে পড়তে সে কখন ঘুমিয়ে পড়ল নিজেই বুঝতে পারল না। ঘুম ভাঙল মাঝ রাত্তিরে। চোখ বুজে সে শুনতে পেল আবারও রিং হচ্ছে ফোনে। এবং তারপরেই কথাবার্তা শুরু হয়ে গেল।
এপাশ থেকে একটি পুরুষ কণ্ঠ ‘হ্যালো’ — বলার সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশ থেকে মহিলা কণ্ঠ বলে উঠল – ‘বিষ্ণু।’
কণ্ঠে কী তীব্র আর্তি! কী ভীষণ একাকিত্বের যন্ত্রণা!
౼ “মলি, তুমি এরকম করছ কেন? এই তো আমি আছি। তোমার খুব কাছেই আছি।”
౼ “না। তুমি নেই। তুমি নেই। তুমি কোত্থাও নেই। আমার বিষ্ণু হারিয়ে গেছে!”
౼ “আমি আছি মলি। আমি তোমার সঙ্গেই আছি। আমার মলিকে ছেড়ে আমি যেতে পারি বলো?”
౼ “কিন্তু আমি যে তোমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতে চাই। তোমার ঠোঁটে চুমু খেতে চাই। তোমাকে দু’চোখ ভরে দেখতে চাই!”
౼ “সে তো আমিও চাই গো। হয়তো পারতামও সারাটা জীবন। যদি না তোমার বাবা আর দাদা ওভাবে আমাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিত।”
౼ “আমার বাবাকে, দাদাকে কোনওদিনও আমি ক্ষমা করতে পারব না বিষ্ণু। কোনওদিনও না। দাদার কথা না হয় বাদই দিলাম। ও তো চিরকালই গুন্ডামি করে জীবন কাটিয়েছে। ও তোমাকে খুন করার আগে আরও অনেক খুন করেছে। পুলিশ ওকে কখনও ধরতে পারেনি। কিন্তু আমি ভাবি আমার বাবার কথা। তুমি তো কোনও অন্যায় করোনি। বরং বাবার টেলিফোন বুথকে তুমি নিজের বুক দিয়ে আগলে রাখতে। তোমার মতো একটা নিষ্পাপ প্রাণকে মারতে বলার পরে বাবার একবারের জন্যও খারাপ লাগেনি!”
౼ “আসলে আমি যে তোমার যোগ্য ছিলাম না গো! তোমার বাবার কত টাকা পয়সা!”
౼ “ওসব কথা বাদ দাও। বিষ্ণু। অ্যাই বিষ্ণু। আমিও তোমার কাছে চলে যাই! আর না কোরো না গো। আমি যে তোমাকে ছেড়ে আর থাকতে পারছি না!”
౼ “না মলি। সে সময় এখনও আসেনি। তবে আমার একটা অনুরোধ আছে তোমার কাছে।”
౼ “কী? কী অনুরোধ?”
౼ “তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করে নিয়ো না মলি। সেটা আমি মরে গিয়েও সহ্য করতে পারব না।”
౼ “তুমি আমাকে এই চিনলে? অন্য কোনও ছেলেকে বিয়ে করব আমি? রাখলাম ফোন।”
౼ “না। না। আমি এমনিই বলছিলাম…”
ফোনটা কেটে গেল। এপাশের পুরুষ কণ্ঠ রিসিভার ক্রেডেলে নামিয়ে রাখল। সৌমভ স্তম্ভিত হয়ে পড়ল বিস্ময়ে। কথাবার্তা শুরু হওয়ার পরপরই ও বেশ আতঙ্কগ্ৰস্ত হয়ে পড়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। রীতিমতো রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছিল কথোপকথন চলাকালীন। কিন্তু সবটুকু জানার পরেই মনটা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল সহানুভূতি আর বেদনায়। এখন বুঝতে পারছে কেন রণদীপবাবু এত কম টাকায় ঘর ভাড়া দিয়েছেন। তার মানে এ-ঘরে যা কিছু ঘটছে তার সবটাই জানেন উনি। এখন সৌমভ পরিষ্কার বুঝতে পারছে কী লুকাতে চাইছিলেন রণদীপবাবু।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই সারা ঘর ভালো করে দেখল সৌমভ। রণদীপবাবুদের একটা ট্রাঙ্ক রয়েছে টেবিলের নীচে। হ্যাঁ। টেলিফোনের আওয়াজটা এই দিক থেকেই আসে বলে মনে হচ্ছিল সৌমভর। ট্রাঙ্কে একটা তালা লাগানো। অনেকদিন ব্যবহার নেই বলে বোধহয় তাতে জং ধরে গেছে। তালাটাকে ধরে একটু টানাটানি করতেই সেটা খুলে গেল।
ধীরে ধীরে ট্রাঙ্কের ঢাকনা খুলল সৌমভ। মুখ খোলার সময়ে ক্যাঁচ করে একটা আওয়াজ হল। বেরিয়ে এল কিছু অব্যবহৃত জিনিসপত্র — যেমন কয়েকটা পেন, দুটো মোটা মোটা খাতা, একটা পুরনো ছাতা, দুই সেট ছেলেদের জামাপ্যান্ট। বাক্সের একদম নীচে একটা টেলিফোন রাখা। এটা বোধহয় সেই বিষ্ণুর ট্রাঙ্ক ছিল। খাতাদুটো খুলে দেখল খাতার একপাশে দিন তারিখ আর অন্য পাশে মিনিট এবং টাকার হিসেব উল্লেখ করা রয়েছে। সৌমভ মনে মনে ভাবল – ‘ছেলেটা বোধহয় ফোনের দোকানের হিসেব রাখত সব।’ একটা পাতায় কী যেন লিখে কাটা হয়েছে। সৌমভ একটু ভালো করে দেখে বুঝলো লেখা আছে ‘আই লাভ ইউ মলি’।
রাস্তায় বেরিয়ে সৌমভ দেখল উল্টোদিকের বাড়ির একজন বৃদ্ধ রাস্তার পাশে চেয়ারে বসে রোদ্দুর পোহাচ্ছেন। সৌমভ কাছে এসে প্রথমে এটা সেটা বলার পরে আসল কথায় এল। বলল – “আচ্ছা কাকু, বিষ্ণু কে?”
বৃদ্ধ প্রথমে ঠিক মনে করতে পারলেন না। তারপর মাথা চুলকে বললেন – “ওহ্। তুমি এই ফোনের দোকানের ছেলেটার কথা বলছ! হ্যাঁ বিষ্ণুই তো নাম ছিল বোধহয়! অমায়িক ছেলে ছিল। অন্য কাজের ছেলেদের মতো মালিককে ঠকাত না। খুব সৎ ছেলে ছিল।”
౼ “ছিল বলছেন কেন কাকু?”
౼ “ছিল বলছি কারণ এখন আর দেখি না তাই।”
౼ “ও কি কাজ ছেড়ে দিয়েছে কাকু?”
౼ “কাজ ছেড়েছে কিনা বলতে পারি না। তবে হঠাৎ করেই একদিন সকালে আবিষ্কার করলাম ছেলেটি দোকানে নেই। রাতেও দোকানে দেখেছিলাম। বোধহয় ভালো কাজ পেয়ে চলে গেছে।”
‘বিষ্ণুকে আর খুঁজে পাবেন কী করে! ওকে তো মেরে ফেলেছে রণদীপ আর ওর ছেলে মিলে।’ — সৌমভ মনে মনে ভাবল। তারপর আবার সে বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করল – “আর রণদীপবাবুর কয় ছেলে মেয়ে, কাকু?”
౼ “কেন? তুমি জানো না? এক ছেলে আর এক মেয়ে।”
౼ “ছেলে? কিন্তু আমি তো কোনও ছেলেকে দেখিনি!”
౼ “ওকে দিনের আলোতে কেউই আর দেখতে পায় না সেভাবে। মস্তানি করে বেড়ায় এখানে ওখানে!”
౼ “মস্তান!”
౼ “কেন তুমি মন্টু গুন্ডার নাম শোনোনি?”
౼ “কই, না তো!”
౼ “মন্টু গুন্ডাই তো রণদীপের ছেলে। তবে রণদীপের মেয়েটা খুব ভালো। আমরা ‘মলি’ নামেই ডাকি। ভালো নাম বোধ হয় মল্লিকা। কোনওদিনই কিছু শুনিনি ওর মেয়ে আর বউয়ের নামে। তা তোমার হঠাৎ এত খোঁজের কী দরকার বাপু?”
౼ “না, এমনিই কৌতূহল।”
রাতে হোটেল থেকে ফিরে দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে খাটে বসল। একমনে ভাবতে লাগল মলি আর বিঞ্চুর কথা।
‘কী করা উচিত আমার? পুলিশে জানিয়ে রণদীপবাবুদের শাস্তির ব্যবস্থা করা? কিন্তু পুলিশকে প্রমাণ দেওয়ার মতো কিছুই নেই আমার হাতে। তাছাড়া যারা বিষ্ণুকে সরিয়ে দিতে পেরেছে তারা কি আমায় বাঁচিয়ে রাখবে! তাছাড়া যে যাওয়ার সে তো চলেই গেছে। তাকে তো ফেরানো যাবে না!” — মনে মনে বলল সৌমভ।
একটু বাদেই ফোনটা সজোরে বেজে উঠল। আজ সৌমভর মনে হচ্ছে এই ফোনটুকুই সত্যি। বাকি সব মিথ্যে। ফাঁকি। এই ফোনের এপাশে একটা মন আজও মৃত্যুর পরেও জেগে ওঠে ভালোবাসার টানে। জেগে ওঠে জীবন। আজ তার খুব মনে হচ্ছে আসলে শুধু জীবনই ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখে না। কখনও কখনও ভালোবাসাও জীবনকে বাঁচিয়ে রাখে। এমনকী মৃত্যুর পরেও।
***
মহুয়া সমাদ্দার
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক, রবীন্দ্র ভারতী থেকে মাস্টার্স এবং চাকরি করাকালীন বি.এড ডিগ্রি লাভ। বর্তমানে কলকাতা নিবাসী একটি সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষিকা। সেই ছোট্ট বেলা থেকে কবিতা লিখলেও বছর দুয়েক ধরে গল্প, উপন্যাস, গান, নাটক, ফিচার সবেতেই সিদ্ধহস্ত। “এই সময় দৈনিক”, “শুকতারা”, “কৃত্তিবাস”, “কিশোর ভারতী”, “সাহিত্য এখন” সহ বহু নামী পত্র-পত্রিকায় লেখিকার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন