নোলা – স্নেহা আদক

বিশ্বরূপ মজুমদার

সন্ধের মুখে স্টেশনের বাজারে সস্তায় ইলিশ পেলেন সুবোধবাবু। ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে সেই দুপুর থেকে। একজোড়া ইলিশ হাতে ঝুলিয়ে আসছেন পুকুর পাড় দিয়ে, পিছন থেকে মেয়েলি গলায় কে যেন জিজ্ঞেস করল, “ইলিশ কত করে নিল?”

এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন সুবোধবাবু। পিছনে তাকানো উচিত হবে কি না ভাবতে লাগলেন, তখনই আবার মেয়েলি গলায় কেউ বলে উঠল, “কী হলটা কী? অমন দাঁড়িয়ে রইলে কেন?”

ব্যস, দরদর করে ঘামতে শুরু করলেন সুবোধবাবু। পায়ের গতি বাড়িয়ে একপ্রকার ছুটতে শুরু করলেন। দূর থেকে একটা গোলমালের আওয়াজ আসছে। ‘নিশ্চয়ই কোনও ভূতুড়ে কাণ্ড ঘটেছে। আর বাইরে থাকা যাবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ঢুকতে হবে।’ — ভেবে প্রাণপণে ছুটতে শুরু করলেন। কিন্তু বয়স বেড়েছে। পায়ের জোর নেই বেশি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে ঢুকলেন রান্নাঘরে। মাছটা রেখে দিয়ে ঘরে একটু শান্ত হয়ে বসলেন।

ভূতের ভয়টা অনেকটা কমে গেছে এতক্ষণে। দরজা জানলা লাগিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লেন।

ক’দিন আগেই স্ত্রী মারা গেছে। তার আগে দু’জনে শুয়ে গল্প করতেন এইভাবে, আজ সেই বিছানাটা তাকে ছাড়া কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এতগুলো বছর একসঙ্গে থাকার পর কি আর ভালো লাগে? ছেলে বউমার ওপর নিজেকে বোঝা মনে হয়। ওরাও যেন ওঁকে ঝেড়ে ফেলতে পারলে বাঁচে।

হঠাৎ করে ঘরের আলো পাখা বন্ধ হয়ে যায়। ফুরিয়ে যাওয়া ভয়টা আবার নতুন করে ফিরে আসে সুবোধবাবুর মনে। জড়সড় হয়ে বিছানায় শুয়ে ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলেন তিনি।

হঠাৎ তার মনে হল ঘরে কেউ হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। গোটা ঘরে নূপুরের আওয়াজ হতে লাগল।

“কে… কে ওখানে?”, কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করেন সুবোধবাবু। নূপুরের আওয়াজটা থেমে গেল। কোথা থেকে একটা দমকা হাওয়া এসে জানলাটা খুলে দিল। সুবোধবাবুর গায়ের চাদরটা উড়ে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও একটা অদৃশ্য মূর্তির গায়ের সঙ্গে লেপটে গেল, আবার হাওয়ার তোড়ের সঙ্গেই সেটা ঘরের এক কোণে গিয়ে পড়ল।

এবার সুবোধবাবু প্রমাদ গুনলেন। আরেকটু হলেই ভিরমি খাচ্ছিলেন।

হঠাৎ একটা খোনা গলা বলে উঠল, “মরে গিয়ে ভীমরতি ধরল নাকি তোমার?”

হঠাৎ করে সব কিছু কেমন যেন ঘেঁটে গেল সুবোধবাবুর।

“আ মোলো যা! দু’দিন আগেই তো পটল তুলেছ। এ কেমন মিনসে রে বাবা!”

“মালতী?”, অন্ধকারের মধ্যে ধীরে ধীরে ভেসে ওঠা গিন্নির অবয়বটার দিকে হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইলেন সুবোধবাবু, “তু… তু… তুমি?”

— “হ্যাঁ, আমি! এত অবাক হচ্ছ কেন? মরে গিয়েও কি ভোলার রোগটা গেল না?”

— “আমি মরে গেছি?”

— “তা নয়তো কি? সকলের সামনে ভরা বাজারে ইলিশ মাছটা যে তুলে নিয়ে চলে এলে, ওখানে লোকজন তো সব ভয়েই উলটে গেল, ওদিকে বউমাও রান্নাঘরে ইলিশ মাছ দেখে অবাক হয়ে গেছে।”

— “বলো কী!”

— “মরে গিয়েও কি তোমার নোলা গেল না গো?”

এতক্ষণে সুবোধবাবুর মনে পড়ে, গিন্নির চলে যাওয়ার শোকে তিনি ক’দিন আগে এই ঘরেই হার্ট ফেল করে মারা গেছেন।

***

স্নেহা আদক

বর্তমানে নার্সিং স্টুডেন্ট হলেও বছরখানেক আগে ভালোবেসে লেখালিখি শুরু করেন। মূলত রহস্য আর ভৌতিক গল্প লিখতে ভালোবাসেন। ভবিষ্যতে লেখালেখি নিয়ে আরও এগোনোর পরিকল্পনা রয়েছে। বিভিন্ন গল্প সংকলন, অডিও স্টোরির পাশাপাশি ‘গল্পকুটির’, ‘বইসই’ ইত্যাদি অনলাইন পোর্টালের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।

অধ্যায় ১ / ২০

সকল অধ্যায়

১. নোলা – স্নেহা আদক
২. তাপ্পর… – ডঃ সাম্য মণ্ডল
৩. কালচক্র – দেবলীনা বিশ্বাস
৪. রসের খোঁজে – অঙ্কন মুখোপাধ্যায়
৫. রক্তপিপাসু – মোনালিসা সাহা দে
৬. ফেরা – দেবদুলাল কুণ্ডু
৭. ঘড়ি – কেয়া চ্যাটার্জী
৮. স্বর্গাদপি – অলোকেশ ভট্টাচার্য্য
৯. আলিঙ্গন – রিয়া মিত্র
১০. খেলাঘর – প্রীতম গুহ
১১. সেই রাতে – নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী
১২. ছবি – মধুমিতা মুখার্জী
১৩. মুখোশ – শঙ্কর চ্যাটার্জী
১৪. ঋণশোধ – সৌমী গুপ্ত
১৫. সহযাত্রী – উস্রি দে
১৬. রিসর্টে এক রাত – অমিতাভ সাহা
১৭. জীবন্ত কথা – মহুয়া সমাদ্দার
১৮. অন্ধকারের জীব – রিয়া ভট্টাচার্য
১৯. রক্তে রাঙা রুদ্রাক্ষ – মঞ্জিলা চক্রবর্তী
২০. ভিত্তিহীন – মৃণাল নন্দী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন