রসের খোঁজে – অঙ্কন মুখোপাধ্যায়

বিশ্বরূপ মজুমদার

উত্তরের জানালার পাশেই নবনীর বিছানা। অন্ধকার শীতের রাতে নিজের বিছানায় বেশ আরাম করেই ঘুমিয়ে ছিল নবনী। বহুদিন পর গ্ৰামের বাড়িতে ফিরেছে। দূরসম্পর্কের এক কাকার পরিবার ছাড়া নবনীদের বাড়ির বাকি সবাই গ্ৰামের পাট উঠিয়ে কলকাতায় পাকাপাকি নিজেদের ব্যবস্থা করে নিয়েছে। তবে ছুটিছাটাতে বছরে একবার দু’বার ওরা বেড়াতে আসে গ্ৰামে। নবনীও তেমনি অনেকদিন পর গ্ৰামের বাড়িতে এসেছে আজ বিকেলের ট্রেনে। এই ঘরটা ওর ভাগের। একা মানুষ, আর ক’দিনের জন্যই বা আসা, তাই অসুবিধা হয় না কোনও। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরেই জানালার বাইরে থেকে আসা খস্ খস্ শব্দটা ওর ঘুমের বারোটা বাজাচ্ছে। শেষে একসময় উঠেই পড়ল বিছানা ছেড়ে নবনী। ঘড়ি দেখল, প্রায় শেষ রাত।

‘এই শেষ রাতে বাগানে কে কী করছে! চোর-টোর এল নাকি?’

তারপর মাথার কাছের জানালার পাল্লা খুলে বাইরে তাকিয়েই সামান্য ভয় পেয়ে গেল নবনী। জানালার পরে কিছুটা জমি, তারপর তাল, নারকেল, খেজুরের সারি। সেগুলোর একটার নীচে একটা লিকলিকে কালো ছায়ার মতো লোককে দেখতে পেল ও। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে হাঁক পাড়ল একটা, “কে, কে ওখানে?”

—“আমি পাঁচু।”

—“এত রাতের ঠান্ডায় কী করছ বাগানে?”

—“আজ্ঞে, রস পাড়তে এসেছি।”

—“রস!”

—“হ্যাঁ কর্তা, খেজুর গাছের রস, হাঁড়ি বেঁধে গেছি আগে, এখন পাড়তে এসেছি…”

—“তা, না-বলে যে রস পাড়ছ, জানো না এ বাগান আমাদের?”

—“আজ্ঞে বলা আছে আপনার কাকারে, আপনি তো এখানে থাকেন না, তাই সবকিছু জানেন না কর্তা।”

নবনী মনে মনে ভাবল, তাই হবে নিশ্চয়ই। তারপর কী মনে হতে মোটা চাদরটা গায়ে জড়িয়ে মোবাইলে টর্চ জ্বেলে ঘর থেকে বেরিয়ে বাগানে গিয়ে দাঁড়াল নবনী। পাঁচু নামের লোকটা ততক্ষণে মিলিয়ে গেছে কোথায় যেন! নবনী চারিদিকে তাকিয়েও ওকে দেখতে না পেয়ে ডাক দিল একটা, “পাঁচু? গেলে কোথায়?”

“এই যে কর্তা, আমি এখানে।” নবনী চমকে তাকাল সামনের খেজুর গাছটার উপর। দেখল সেই কালো ছায়ার মতো লোকটা গাছের উপর থেকে সাড়া দিচ্ছে, “এখানে, এখানে। দাঁড়ান আপনাকে টাটকা রস খাওয়াব।”

এরপর নিমেষের মধ্যে গাছ থেকে নীচে নেমে এসে হাঁড়ি থেকে একটা ছোট ঘটিতে কিছুটা রস ঢেলে এগিয়ে দিল নবনীর দিকে, এক গাল হেসে বলল, “নিন ঢক করে খেয়ে নিন, একেবারে টাটকা। খাঁটি সোয়াদ।”

সেই ছোটবেলায় একবার ও খেয়েছিল খেজুর রস, বেশ মাদকতা থাকে একটা। লোভটা সামলাতে পারল না নবনী। মাটির ঘটিটা থেকে কিছুটা খেজুর রস গলায় গেলে চোখ বুজল ও। আঃ, বেশ স্বাদ!

অনেক বেলায় কাকার ডাকে ঘুমটা ভাঙল ওর। নবনী চেয়ে দেখল বাগানের খেজুর গাছের নীচে বসে আছে! “কী রে এখানে কী করছিস?” কাকার গলায় উদ্বেগ।

—“ওই খেজুর রস… পাঁচু বলে লোকটা দিল…”

সবটা খুলে বলতেই কাকা ভীষণ অবাক হয়ে গেল। গাছের উপর তাকিয়ে বলল, “বলিস কী! পাঁচু তোকে খেজুর রস খাইয়ে গেছে!”

—“হ্যাঁ, ওই নামটাই তো বলল লোকটা।”

—“এই গাছটা দেখেছিস কতটা লম্বা।”

নবনী কাকার কথা শুনে উপরের দিকে তাকাল। কাকা আবার বলল, “ওই উপর থেকে পাঁচু গতবছর পড়ে গেছিল ভোর রাতে খেজুর রস পাড়তে উঠে। গাছে উঠতে ওর মতো জুড়ি নেই এ গ্ৰামে। তবু কেন যে পড়ে যায় ও, সেটাই রহস্য। মাথাটা ফেটে রক্তারক্তি কাণ্ড একেবারে। বাঁচানো যায়নি বেচারাকে।”

নবনী কী বলবে বুঝতে পারল না। কাকার পিছু পিছু ফিরে গেল বাড়ির ভিতর। দু’দিনের জন্য এসেছে, আবার পরশু কলকাতায় ফিরে যাবে। ভেবেছিল, বেশি ভেবে লাভ নেই কোনও। কিন্তু আজ রাতেও সেই খস্ খস্ শব্দটা আবার শুরু হতেই ঘুমটা ভেঙে গেছে নবনীর। ভয়ে ভয়ে লেপের আড়াল থেকে জানালাটা একটু ফাঁক করতেই লোকটাকে দেখা গেল! যেন নবনীর জানালা খোলার জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করেছিল‌‌। একটু হেসে শীতল কণ্ঠে লোকটা বলল, “কী কর্তা, খাবেন নাকি খেজুর রস?” এই বলে নীচে দাঁড়িয়েই লোক তার লম্বা হাতদুটো অজগরের মতো বাড়িয়ে দিতে শুরু করল খেজুর গাছটার উপর দিকে, রসের হাঁড়ির খোঁজে!

***

অঙ্কন মুখোপাধ্যায়

ছোট থেকেই কিছু অগোছালো কবিতা দিয়ে লেখালিখি শুরু। পরে সেই অগোছালো ভাবনাগুলো গল্প, কবিতা, উপন্যাস হিসেবে প্রকাশিত হয় “আনন্দমেলা”, “কিশোর ভারতী” প্রভৃতি আরও বেশ কিছু পত্র-পত্রিকায়। নিজের মনকে তৃপ্তি দিতেই মূলত কলম ধরা।

সকল অধ্যায়

১. নোলা – স্নেহা আদক
২. তাপ্পর… – ডঃ সাম্য মণ্ডল
৩. কালচক্র – দেবলীনা বিশ্বাস
৪. রসের খোঁজে – অঙ্কন মুখোপাধ্যায়
৫. রক্তপিপাসু – মোনালিসা সাহা দে
৬. ফেরা – দেবদুলাল কুণ্ডু
৭. ঘড়ি – কেয়া চ্যাটার্জী
৮. স্বর্গাদপি – অলোকেশ ভট্টাচার্য্য
৯. আলিঙ্গন – রিয়া মিত্র
১০. খেলাঘর – প্রীতম গুহ
১১. সেই রাতে – নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী
১২. ছবি – মধুমিতা মুখার্জী
১৩. মুখোশ – শঙ্কর চ্যাটার্জী
১৪. ঋণশোধ – সৌমী গুপ্ত
১৫. সহযাত্রী – উস্রি দে
১৬. রিসর্টে এক রাত – অমিতাভ সাহা
১৭. জীবন্ত কথা – মহুয়া সমাদ্দার
১৮. অন্ধকারের জীব – রিয়া ভট্টাচার্য
১৯. রক্তে রাঙা রুদ্রাক্ষ – মঞ্জিলা চক্রবর্তী
২০. ভিত্তিহীন – মৃণাল নন্দী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন