বিশ্বরূপ মজুমদার
রাতের আকাশে যেন কেউ আলকাতরা ঢেলে দিয়েছে বেশ করে। মাথার উপরে অনেক উঁচুতে তাকিয়ে দেখলে জ্বলজ্বলে তারাগুলো নিকষ কালো অন্ধকারে জোনাকির মতো মনে হয় অন্যদিন — আজ তাদেরও কোনও চিহ্নমাত্র নেই। একনাগাড়ে ঝিঁঝিঁ পোকার কলরব। দু’-একটা ব্যাঙ কর্কশ গলায় নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে বাঁশবাগানের পাশ থেকে। ভেটি জেঠু হাতের থলিটা বেশ করে সাইকেলের হ্যান্ডেলে পেঁচিয়ে রাখলেন। অন্ধকারে রাস্তাঘাট ভালো করে ঠাহর করা যায় না। পুজোটা শেষ হতে বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গেল। একেই অমাবস্যা, তার উপর দোসর হয়েছে পরিপূর্ণ গুমর কালো মেঘ। এত মেঘ বলেই বোধহয় বিদ্যুৎ চমকালেই আকাশটা কেমন গোলাপি রঙে ছেয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন আবির মাখিয়ে দিয়েছে কেউ। মাঝে মাঝে সাদা চুলের বুড়ির মাথার সাদা কেশাগ্র গোটা আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। কুসুম ডিঙ্গী গ্রামের পথটা এখনও লাল মাটির। মানে এখনও পর্যন্ত কালো পিচের ছোঁয়া পড়ার সৌভাগ্য হয়নি। রাজকীয় মান্ধাতা আমলেই পড়ে আছে। দুই ধারে জমির আঁচল। মাঝে লাল মেঠো রাস্তা খানাখন্দে ভরা আর উঁচু-নিচু বাধাপ্রাপ্ত বাম্পার। ভেটি জেঠু প্রায়ই পুজো করে বেশ রাত করে বাড়ি ফেরেন এই রাস্তা ধরেই। কাকপক্ষীর টিকিটি পাওয়া যায় না দিনে দুপুরেই। রাত হলে তো ধুধু প্রান্তর শূন্য আকাশ নিয়ে ঘুমিয়ে থাকে।
বাসস্ট্যান্ড থেকে দু’কোশ হেঁটে তবে গিয়ে গ্রাম। আজ পুজো ছিল পাশের গ্রামে। ভেটি জেঠু গিয়েছিলেন সেই ভরদুপুরে। পুজোর পরে হৈমন্তী ঠান্ডা কিছুটা পড়লেও দুপুরে এতখানি রাস্তা সাইকেল চালিয়ে যেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল — কারণ অন্যদিনের তুলনায় আজ গরম বেশ খানিকটা বেশিই ছিল। তা ছাড়া বয়স তো কম হয়নি। ষাট পেরিয়ে সত্তরের ঘরে পা বাড়িয়েছেন তিনি। তবু বড় কালীপুজো, ভিটে পুজো, খুঁটিপুজো এসব কাজে তাঁর নাম সর্বাগ্রে। ভেটি জেঠুরও অবশ্য এসব কাজে না নেই। আমজনতার ভেটি জেঠুর সেই ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গে পৈতে পরে পুজোয় হাতেখড়ি। সেই থেকে পূজা-অর্চনা তার মজ্জাগত। তবে আজ বেশ ধকল গিয়েছে। সঙ্গের হেল্পারটি আজ ডুব মেরে ছিল। এ লাইনেও কম ফাঁকিবাজ তিনি এ জীবনে দেখেননি! সারাটা দিন উপোস করে, যজ্ঞ করে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। এখনও মিনিট কুড়ির পথ। পা দুটো বেশ বিদ্রোহ জানাচ্ছে মাঝে মাঝে। একটা চোঁয়া ঢেকুর উঠল। এঃ একেবারে অম্বল হয়ে গেছে। সারাদিন খালি পেটে থেকে সন্দেশটা আর সহ্য হয়নি। দুদ্দাড় করে বেশ কয়েকবার মেঘ ডাকলো সুযোগ বুঝে বেশ বীরদর্পে। ভেটি জেঠু এবার তাকালেন আকাশের দিকে। সাদা চুলের বুড়ি যেন এলোকেশী, অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। ভাবতে ভাবতে দু’-এক ফোঁটা পেরিয়ে বেশ মুষলধারে নেমে এল বৃষ্টির ধারা। এদিক ওদিক তাকিয়ে গগনদের পোড়ো বাড়ির বারান্দায় সাইকেলটা হেলান দিয়ে রেখে মাথায় কিঞ্চিৎ দুব্বো ঘাসের মতো চুল কাঁধের গামছা দিয়ে মুছে এসে দাঁড়ালেন। ভূতের ভয় তিনি কোনওদিন পান না। ভয়ে যদি একটু আধটু হৃৎপিণ্ড দ্রুতগতিতে পালস রেট বাড়িয়ে দৌড়তে থাকে তবে তা চোর-ডাকাত দুষ্ট লোক এবং সাপের উপদ্রবে। হাতের টর্চ লাইটটা জ্বালিয়ে দেখলেন চারিদিক। এ জায়গাটা একদম জঙ্গলে ভর্তি, আগাছা লতাপাতায় ভরপুর তেমনি নির্জন। কেন যে গগনরা এই বাড়িটা বিক্রির ব্যবস্থা করছে না কে জানে। অবশ্য কেই বা গ্রামের বাইরে জনমানবহীন জায়গায় এই বাড়িটা কিনতে চাইবে! তালা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে বহু বছর। কলকাতায় আস্তানা গড়ার পর গগনরা আসে না তেমন। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বৃষ্টির বেগটা চিন্তাটা আরও বাড়িয়ে তুলল। বাড়ি ফিরতে বেশ কিছুটা দেরি হয়ে যাবে। শরীরটা দিচ্ছে না। ক্লান্তিতে চোখ দুটো বুজে আসছে। থলির মধ্যে বিশেষ যা প্রসাদ আছে যদি বৃষ্টি না কমে মুখে দিয়ে পেটের রাক্ষসটাকে শান্ত করে একটু জিরিয়ে নেওয়া যাবে। এদিকে কতক্ষণে আকাশটা শান্ত হবে কে জানে।
একটা মান্ধাতা আমলের শ্যাওলাধরা ছোট্ট বেদীর উপর ভেটি জেঠু বসে পড়লেন। পাশে থলিটা রাখলেন। কিছুটা বলির কাঁচা মাংসও আছে। বসে পড়ে শরীরটা আরামে ঝিমিয়ে গেল। এমন সময় ধপ করে কিছু পড়ার আওয়াজে চমকে উঠলেন তিনি। হাতের টর্চটা খুঁজে পেতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল। জলের সঙ্গে হওয়ার ঝাপটায় গাছের মাথাগুলো একেবারে নুয়ে পড়েছে। তাকিয়ে দেখলেন একটা বড় হুলো বেড়াল গুটিগুটি পায়ে পাশে এসে বসেছে। অন্ধকার রাতে চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। ভেটি জেঠু একটু বিরক্ত হলেন। বৃষ্টি হবার আর সময় পেল না। এতক্ষণে বাড়ি পৌঁছে যাবার কথা। থলি থেকে মিষ্টির প্যাকেটটা বের করেছেন ঠিক তখনই হনহন করে হেঁটে আসতে দেখলেন সামনে একজনকে। ভেটি জেঠু গলা উঁচিয়ে বললেন, “কে ওখানে?”
ছায়ামূর্তি এগিয়ে এল সামনে, “এজ্ঞে কর্তা আমি!”
౼ “আমি কে হে?”
౼ “আমি তারক কত্তা! চিনতে পারলেন না?”
౼ “আমাদের তারু! তা কবে ফিরলে? এতদিন আটকে পড়েছিলে বুঝি?”
౼ “এই তো ফিরছি কত্তা। বৃষ্টিতে আটকে গেলুম তারপর দেখলুম আপনি এখানে বসে আছেন।”
౼ “এমন ঘুটঘুটে আঁধারে দেখলে কেমন করে, তোমার চোখের জ্যোতি তো বেশ ভালোই বলতে হবে তারু!”
౼ “আজ্ঞে কত্তা তা ভালোই আছে এখনও। আপনি কোথাও গিয়েছিলেন কত্তা?”
ভেটি জেঠু নিজের ছোটখাট শরীর নিয়ে হেলেদুলে বাবু হয়ে বসলেন বেদীর উপর, “গিয়েছিলাম হীরাপুরে, একটা পুজো ছিল, ফিরতে গিয়ে এই বৃষ্টি! কী জ্বালায় পড়লুম দ্যাখো দেখি!”
౼ “সেই তো কত্তা, আমিও আসতে পারলাম না, কতদিন পর বাড়ি আসছি সব গণ্ডগোল হয়ে গেল!”
౼ “বৃষ্টি থামলেই বেরিয়ে পড়ব! চিন্তা করো না, তা তোমার কাজবাজ ঠিকঠাক চলছে তো?”
তারক একটু সামনে এগিয়ে এল, “হ্যাঁ কত্তা কাজ চলছিল ঠিকঠাক। তারপর তাড়াহুড়োতে এই অশান্তি। ফিরতে দেরি হল ট্রেন নেই তেমন।”
বিড়ালটা তারকের পাশ দিয়ে জোরে কর্কশ কণ্ঠে আর্তনাদ করে দৌড় লাগাল।
౼ “তুমি কিছু খাবে তারু? প্রসাদ আছে আমার সঙ্গে — এতটা রাস্তা এসেছ!” ভেটি জেঠু একটু নরম সুরে বললেন।
౼ “না কত্তা খেতে পারব না, গলায় খুব ব্যথা!” একটু থেমে তারক বলল, “এজ্ঞে কর্তা বৃষ্টি ধরে এসেছে, এই বেলা নেমে পড়ুন দেরি হয়ে যাবে।”
ভেটি জেঠুও সম্মতি জানালেন। তারক হাঁটতে লাগল। ভেটি জেঠুও সাইকেলটা পাশে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। এখনও কিছুটা পথ। এই নির্জন রাস্তায় তারককে একা ছাড়তে মন চাইল না।
রাস্তার বাঁকটা পেরোতেই তারক ভেটি জেঠুর হাতটা চেপে ধরল। এত ঠান্ডা বরফের মতো হাতের ছোঁয়ায় ভেটি জেঠু একটু চমকে উঠলেন, “কিছু বলবে তারু?”
౼ “এজ্ঞে কত্তা আপনি আমার কাছে দুশো টাকা পেতেন — এইটা রাখতে হবে কত্তা।”
ভেটি জেঠু অন্ধকারে দেখলেন তারকের দাঁতগুলো ঝিলিক মারছে অন্ধকারে, চোখ দুটো চকচকে। একটু বেশিই রোগা লাগছে দেখতে। মাথাটা কাত করে আছে তখন থেকেই। ভেটি জেঠুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। এই গরিব মানুষগুলো দরকারে অদরকারে দু’-একশো টাকা নেয় তিনিও মনে রাখেন না তেমন। তারমধ্যে এই তারক ছেলেটা ঘরের একমাত্র উপার্জনক্ষম। বাইরে থাকে। মাঝে মাঝে আসে। দারিদ্র্যতায় জরাজীর্ণ। টাকাটা নিতে মন সায় দেয় না। ভেটি জেঠু বললেন, “থাক না তারু। পরে দিও। আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি?”
౼ “এজ্ঞে কত্তা আর সময় হবে কিনা। পরে দেওয়া হবে না হয়তো। ঋণ নিয়ে মরা ঠিক নয় কত্তা।”
౼ “বালাই ষাট, এ আবার কেমন কথা, আচ্ছা দাও! এসো বাড়ির দিকে তারু!”
তারক একটু হাসল। ঘাড়টা প্রথম থেকে কাত করা। সোজা করছে না কেন কে জানে! তারক আস্তে আস্তে বলল, “কত্তা পরশু আমার বাড়ি একটা কাজ আছে করে দিয়েন। টাকা পয়সা বিশেষ দিতে পারব না আগে থাকতে কয়ে দিলাম।”
— “কীসের কাজ তারু? পুজো? নিশ্চয়ই করে দেব খন। পরশু কিছু পুজো আছে? জানি না তো! পাঁজিতে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না তো?”
— “সে কত্তা পরে জানিয়ে দেব। এখন চলি। ছেলেটাকে দেখবেন কত্তা। আপনারা মাথার উপর আছেন চিন্তা নেই, এখন চলি ওদিকে।”
ভেটি জেঠু আবার সাইকেলে উঠলেন। ছেলেটা কীসব বলে গেল। মাথামুণ্ডু নেই। এতটা এসেছে ক্লান্তিতে ভুলভাল বকছে। দুশো টাকা কোঁচায় বেঁধে রাখলেন।
মিনিট আটেক পর নিজের পাড়ায় ঢুকতেই চণ্ডীমণ্ডপের সামনে বেশ জটলা দেখে থমকে গেলেন তিনি। রাত প্রায় আড়াইটা হবে। এমন সময় এত ভিড় কেন। ভেটি জেঠু এগিয়ে গেলেন। তারপর সামনে কানাইকে দেখে বললেন, “কী হয়েছে রে কানু এত ভিড় কীসের?”
౼ “আপনি কিছু শোনেননি ভেটি জেঠু?”
౼ “না তো, কী হয়েছে? কারওর কোনও বিপদ হল নাকি?” আতঙ্কিত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।
কানাই তারপর কেটে কেটে বলল, “আর বলেন কেন, ও পাড়ার তারক আছে না! আজ সন্ধেবেলা চলন্ত ট্রেন থেকে স্টেশনে নামতে গিয়ে তলায় পড়ে মারা গেছে। একেবারে ঘাড়ের উপর দিয়ে গেছে জেঠু! ঘাড় থেকে গলা হাঁ হয়ে গেছে!”
౼ “কে? কার কথা বললে? তারু? আজ সন্ধ্যায়! কী বলছ কানু! এই তো কিছুক্ষণ আগে…”
কথাটা শেষ করতে পারলেন না ভেটি জেঠু হাঁফাতে লাগলেন। গোটা শরীর যেন থর থর করে কাঁপছে। এত ঘাম কখনও আগে হয়নি। রক্ত যেন হুলস্থুলু যুদ্ধ করছে শরীরের ভেতর। পেটের ভেতরটা গুলিয়ে আসছে। মাথাটা একেবারে অকেজো। কোনও মতে কোমরে হাত দিয়ে দেখলেন দুশো টাকা কোঁচায় তখনও কড়কড় করছে। কানাই তখনও বলে চলেছে, “কেমন বেআক্কেলে ছেলে ভাবুন! নামার সময় অত তাড়াহুড়ো করে কেউ? দিলি তো প্রাণটা বেঘোরে অকালে। এখন পোস্টমর্টেম হবে। ডেডবডি আসবে ঝামেলা কম? পরিবারটা একেবারে জলে ভেসে যাবে!”
ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন বলে উঠল, “অপঘাতে মৃত্যু হলে তো তিন দিনে কাজ তাই না ভেটি জেঠু!”
শেষ চমকটা বোধহয় আর নিতে পারলেন না তিনি। তিন দিন মানে তো পরশু। পরশু দিন! কোন কাজের কথা যেন বলছিল রাস্তায় তারু। গলায় ব্যথা, ঘাড় কাত করা, ঋণশোধ, সব কেমন গুলিয়ে গেল! ভেটি জেঠু চোখদুটো বন্ধ করলেন, তারপর সব অন্ধকার!
***
সৌমী গুপ্ত
কলকাতা নিবাসী। লেখালেখি শুরু ছোটবেলা থেকেই। স্কুলে নিয়মিত বাৎসরিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হত। সাম্প্রতিক “ঘোড়াড্ডিম”, “অভিষিক্তা”, “বর্ষালিপি”, “একুশ শতক”, “কালি কলম মনন”, “উত্তরণ”, “সুখবর” সহ বেশ কিছু মুদ্রিত সংখ্যা ও ওয়েব পোর্টালে গল্প এবং কবিতা প্রকাশিত। লেখা ও বই পড়াই একমাত্র নেশা।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন