কালচক্র – দেবলীনা বিশ্বাস

বিশ্বরূপ মজুমদার

ক’দিন ধরেই আমার মাথার ঠিক নেই। ভালো ঘুম হচ্ছে না রাতে। শুলেই রোজ একই স্বপ্ন… দেখছি আমার চোখের সামনে রাত্রির অন্ধকার চিরে একটা কুঁড়েঘর দাউদাউ করে জ্বলছে। একজন জমিদার গোছের লোক, পরনে জরির কাজ করা ধুতি-পাঞ্জাবি, হাতে ছড়ি, পায়ে নাগরা জুতো… নিষ্ঠুর মুখে আঙুল তুলে ক’জন লাঠিয়াল সেপাইকে নির্দেশ দিচ্ছে… আর একজন অর্ধনগ্ন অসহায় মানুষকে বেদম প্রহার করা হচ্ছে। তার স্ত্রীকে বেআব্রু করার জন্য ঝোপের ধারে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে লাঠিয়ালরা… মহিলাটি তারস্বরে চিৎকার করছে, কাঁদছে… তার কোলে একটা দুধের শিশু… জমিদারের নির্দেশে ওই শিশুটিকে মা’র কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে… মাটিতে আছাড় মেরে… উহ্ মাগো! এখানেই আমার ঘুমটা ভেঙে যায় বারবার। নিজের ঘুমন্ত সন্তানের গায়ে হাত বুলিয়ে দি আতঙ্কে। এসব কী দেখি আমি? ওই নিপীড়িত লোকটা কি কোনও কৃষক? ওই জমিদার মার্কা লোকটার প্রজা? এগুলো কত সালের ঘটনা? আর এগুলো দেখলেই একটা অদ্ভুত অপরাধবোধে ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যাই কেন? আমার মেয়েটা বড্ড বাবা ন্যাওটা, কিন্তু আমার এই মানসিক অশান্তির প্রভাব ওর ওপরেও পড়েছে যেন। আজকাল আমার থেকে দূরে দূরে থাকে, কিছু জিজ্ঞেস করলে বিরক্ত হয়… আপন মনে খেলতে খেলতে হঠাৎ কেঁদে ওঠে। কী হচ্ছে এসব?

আজ রাত্রিবেলাও যথারীতি ওই একই স্বপ্নে ভয় পেয়ে উঠে বসলাম। কিন্তু পাশে হাত বাড়িয়ে দেখলাম, মেয়ে নেই! ভয় পেয়ে গেলাম। স্ত্রীকে নাম ধরে, ধাক্কা মেরে ডাকলাম কতবার। কোনও সাড়া নেই। কালঘুমে ধরেছে যেন। আমি পাগলের মতো মেয়ের নাম ধরে সারা বাড়ি ছুটে বেড়ালাম। হঠাৎ মনে পড়ল… চিলেকোঠা! চিলেকোঠায় উঠে দরজা খুলতেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। দেখলাম আমার ছোট্ট মেয়েটা পা ছড়িয়ে বসে আছে মেঝেয়। শরীরের অর্ধেকটা কেমন স্বচ্ছ, ধোঁয়া-ধোঁয়া হয়ে গেছে… সেই দেহ ভেদ করে জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়ছে মেঝেয়! চোখের মণি দুটো তার পুতুলের মতো স্থির… এ-এ আমার মেয়ে হতেই পারে না! আমার ঠোঁট কেঁপে উঠল, কিন্তু একটাও শব্দ বেরোল না। আমার মেয়ের ছায়ামূর্তি অবিকল আমার স্বপ্নে দেখা সেই মার খাওয়া লোকটার গলা করে বলে উঠল, “ভেবেছিলি পার পেয়ে যাবি? পাবি না, পাবি না… আমি তোর অতীত!”

দেখতে দেখতে পুরো দেহটাই কর্পূরের মতো উবে গেল আমার চোখের সামনে।

সবাই জানল আমার মেয়েটা হারিয়ে গেছে, কিন্তু আমি সেই রাতে কী দেখেছি কাউকে বলতে পারলাম না। আমারও স্মৃতি ফিরছে আস্তে আস্তে, প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে এক গভীর মৃত্যুভয় ও অবসাদ।

ঠিক তিনদিনের মাথায় আমার স্ত্রী আত্মহত্যা করল। তারপর থেকে আমি তাঁকে প্রায়ই দেখতে পাই… সিঁড়িতে, শোবার ঘরে, বারান্দায়। সে ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আর আমার স্বপ্নের সেই সর্বহারা মহিলাটির কণ্ঠস্বরে চিৎকার করে বলে, “এ জন্মেও আমার সন্তানটাকে কেড়ে নিতে হল? শয়তান! তুই পার পাবি না, কোথাও পালাতে পারবি না… যেখানেই যাবি আমায় দেখতে পাবি… আমিই তোর বর্তমান!”

আমি এখন পাগলের মতো একা একা ঘুরে বেড়াই গোটা বাড়িতে। চোখের তলায় কালি, স্নান করি না, ঘুমোই না। কেউ ডাকতে এলে সাড়া দিই না। না, আমি পালাচ্ছি না। আমি জানি আমি যে পাপ করেছি তার কোনও ক্ষমা নেই। আমি অপেক্ষা করছি শুধু। এভাবেই একদিন অপ্রকৃতিস্থের মতো টলতে টলতে সিঁড়ি বেয়ে দোতলা ছাড়িয়ে আরও ওপরের দিকে উঠতে লাগলাম। কে যেন আমাকে চালিয়ে নিয়ে এল সেই চিলেকোঠার ঘরের দরজার সামনে। দরজা খুলতেই দেখলাম, সিলিং থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে হুবহু আমার মতোই দেখতে একটা লোক… আমার প্রতিকৃতি। সে আমার দিকে অলৌকিক দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর অল্প হেসে অবিকল স্বপ্নে দেখা সেই জমিদারের কণ্ঠস্বরে বলে উঠল, “দেখছ কী? আমি তোমার ভবিষ্যৎ।”

***

দেবলীনা বিশ্বাস

জন্ম কলকাতায়। হুগলি জেলার রিষড়ায় বেড়ে ওঠা। স্কুলজীবন কেটেছে মাখলার দেবীশ্বরী বিদ্যায়তনে। অঙ্কে অনার্সসহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্ৰি লাভ। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে চাকুরিরতা। লেখালেখির হাতেখড়ি মায়ের কাছে। অবসর সময়ের শখ বলতে গল্পের বই, সিনেমা, অভিনয় ও ভ্রমণ।

সকল অধ্যায়

১. নোলা – স্নেহা আদক
২. তাপ্পর… – ডঃ সাম্য মণ্ডল
৩. কালচক্র – দেবলীনা বিশ্বাস
৪. রসের খোঁজে – অঙ্কন মুখোপাধ্যায়
৫. রক্তপিপাসু – মোনালিসা সাহা দে
৬. ফেরা – দেবদুলাল কুণ্ডু
৭. ঘড়ি – কেয়া চ্যাটার্জী
৮. স্বর্গাদপি – অলোকেশ ভট্টাচার্য্য
৯. আলিঙ্গন – রিয়া মিত্র
১০. খেলাঘর – প্রীতম গুহ
১১. সেই রাতে – নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী
১২. ছবি – মধুমিতা মুখার্জী
১৩. মুখোশ – শঙ্কর চ্যাটার্জী
১৪. ঋণশোধ – সৌমী গুপ্ত
১৫. সহযাত্রী – উস্রি দে
১৬. রিসর্টে এক রাত – অমিতাভ সাহা
১৭. জীবন্ত কথা – মহুয়া সমাদ্দার
১৮. অন্ধকারের জীব – রিয়া ভট্টাচার্য
১৯. রক্তে রাঙা রুদ্রাক্ষ – মঞ্জিলা চক্রবর্তী
২০. ভিত্তিহীন – মৃণাল নন্দী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন