মুখোশ – শঙ্কর চ্যাটার্জী

বিশ্বরূপ মজুমদার

আমি ভূতের সাজ সেজে কোনও ছবি আপলোড করি না। এর পেছনে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আমার আছে। জানি না আপনারা বিশ্বাস করবেন কি না।

তখনও ভৌতিক গল্প তেমন ভাবে লেখা শুরু করিনি। সেই সময়, ‘অলৌকিক’ বলে একটা ভৌতিক গ্রুপ ছিল। এখন আর নেই। ওদের গ্রুপের একটা অনুষ্ঠানে বলা হয়েছিল, ভূতের সাজে নিজের ছবি পোস্ট করুন। বেশ মজা লেগেছিল। ঠিক করলাম, বেশ ভয়ঙ্কর সাজ সেজে ছবি দেব। অনেকেই লাইক কমেন্ট করবে।

কিন্তু সাজার উপকরণ কোথায় পাব? বাড়িতেও কাউকে বলতে পারছি না। কী বলব? আমি ভূত সাজব? পাগল ভাববে। যা করতে হবে লুকিয়ে চুরিয়ে। প্রথম কাজ একটা মুখোশ সংগ্রহ করা। যা আমাকে ভূতের রূপ দিতে সাহায্য করবে। মনে পড়ে গেল অবিনাশদা’র কথা। নাটকে মুখোশ সাপ্লাই করত। সোজা চলে গেলাম ওর বাড়ি।

আমার কথা শুনে বলল, “তুমি ওপরের চিলেকোঠার ঘরে চলে যাও। বিভিন্ন রকম মুখোশ পেয়ে যাবে।”

চিলেকোঠার ঘরে ঢুকে তাজ্জব বনে গেলাম। ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর ভূতের মুখোশ! বেছে বেছে হাড় হিম করা একটা মুখোশ নিলাম। এরপর বাজারের দোকান থেকে কিছু পরচুলা কিনলাম। বাড়িতে এসে ওগুলো লুকিয়ে রাখলাম। না হলে, স্ত্রী ছেলে মেয়েদের কাছে বেইজ্জত হয়ে যাব। যা করতে হবে রাত্রে।

রাত্রে সবাই শুয়ে পড়লে, চুপিসাড়ে বাথরুমে ঢুকলাম। প্যানের পিছন থেকে মুখোশ আর কালো পরচুলা বার করলাম। মোবাইলটা আয়নার নীচের তাকে রেখে সাজতে শুরু করলাম। মনের মধ্যে সুপ্ত উত্তেজনা। ফেসবুকে এই ছবি দেখে অনেকেই আঁতকে উঠবে। এর সঙ্গে আমার লেখা ভূতের গল্পেরও চাহিদা বেড়ে যাবে।

সেজে গুজে আয়নার দিকে তাকাতেই নিজের বুকটাই ভয়ে কেঁপে উঠল! আয়নার মধ্যে ওটা কে? আমি! কী বীভৎস লাগছে। যেন নরকের কালো গহ্বর থেকে উঠে আসা এক ভয়াল প্রেতাত্মা। এত জীবন্ত ভাবা যায় না। আমার মন বলছে… ওটা আমি নই। কথাটা মনে হতেই ভয়টা দশ গুণ বেড়ে গেল। আগে ভাগে ছবি তুলে ফেলি। তাড়াতাড়ি কাঁপা হাতে ফোন তুলে ক্যামেরাটা অন করতে গিয়ে হৃৎপিণ্ডটা আচমকা থেমে গেল। মেনুর মধ্যে ক্যামেরা লেখা ছবিটা নেই! চোখের ভুল নয়তো? মুখোশের চোখের ফুটো দিয়ে ভালো করে দেখেও খুঁজে পেলাম না।

এই সময় মুখোশের ভেতর থেকে একটা দুর্গন্ধ নাকে এসে লাগল। এতক্ষণ গন্ধটা ছিল না। পুরনো মুখোশ, অনেকদিন পড়ে থাকার জন্যে বোধহয় দুর্গন্ধ ছাড়ছে। গন্ধটা ক্রমশ পচা চামড়ার গন্ধে রূপান্তরিত হল। আমার মনে তখন এক অশুভ সংকেত খেলা করছে। ভৌতিক গল্প লেখার সুবাদে এটুকু জানতাম… বিদেহী আত্মার উপস্থিতি হলে এইরকম পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ভয়টা পাকে পাকে আমায় জড়াতে শুরু করেছে। বাথরুমের স্বল্প আলোয় আয়নার ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা ‘আমি’-টাকে, চিনতে পারছি না। এর মাঝে বাথরুমের আলোটা বার দুয়েক দপ্ দপ্ করে উঠল। অশরীরী আসার আর এক ইঙ্গিত! শরীরের স্নায়ুগুলো ধীরে ধীরে অবশ হয়ে যাচ্ছে। মুখ দিয়ে কোনও আওয়াজ বার করতে পারছি না।

দেহের সব শক্তি একত্র করে ডান হাত দিয়ে মুখোশটা খুলতে যেতেই… আবার বিষম খেলাম! কোথায় মুখোশ? ডান হাতের আঙ্গুলগুলো সরাসরি আমার মুখটাকে স্পর্শ করল। বোবাদের মতো একটা অস্ফুস্ট গোঙানি মুখ থেকে শুধু বেরোল। বাঁ হাতের মুঠোয় ধরা মোবাইলটা, পাঁচ আঙুলের শাসন ডিঙিয়ে বাথরুমের মেঝেতে পড়ে গেল। আমি পাগলের মতো দু’হাত দিয়ে মুঠো করে কালো পরচুলাটা টানলাম। এত জোরে টেনেছি যে, এক গোছা চুল হাতে উঠে এল। মাথায় জ্বলুনি অনুভব করলাম। ভয়ার্ত চোখে দেখছি, ওগুলো পরচুলা নয়। সত্যিকারের আমার মাথার চুল! এ কী করে সম্ভব? তাহলে মুখোশ, পরচুলাগুলো গেল কোথায়? আর আমিই বা এই কয়েক মিনিটে মুখোশে পরিণত হলাম কী করে? আতঙ্কে হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে উঠে এসেছে। বুকের ধুকপুকুনি নিজের কানে শুনতে পাচ্ছি। আমার মস্তিস্ক এবার আমাকে বিপদ সংকেত দিল। এই মুহূর্তে এরকম ভীতিপ্রদ স্থান ত্যাগ করার জন্যে।

আয়না থেকে চোখ সরিয়ে বাথরুমের দরজার ছিটকিনিতে হাত দেবার সঙ্গে সঙ্গে চোখে অন্ধকার দেখলাম। দরজা কোথায়? আমার চোখের সামনে শুধু নিরেট দেওয়াল। আমি যেন গোলক ধাঁধায় আটকে গেছি। যেমন মাকড়সার জালে আটকে পড়া ছোট্ট পোকা! শরীরের রক্ত চলাচল যেন এবার বন্ধ হয়ে যাবে। হার্ট ফেল করার অনুভূতি উপলব্ধি করতে পারছি। শেষবারের মতো, প্রাণপণে আর্তনাদ করার চেষ্টা করলাম। যদি এই মহা বিপদ থেকে কেউ আমাকে বাঁচাতে পারে।

সেইসময় বাথরুমের দরজা নাড়ার শব্দ আমার কানে এসে ঢুকল। কেউ বাইরে থেকে দরজা ঠেলছে। আশ্চর্যজনকভাবে চোখের সামনে বাথরুমের দরজাটা ভেসে উঠল। শব্দের সঙ্গে স্ত্রী’র উৎকণ্ঠার গলা পেলাম – “দরজা খোলো, কী হয়েছে তোমার?”

দরজা খোলার এক সেকেন্ড আগে, আয়নায় চোখ পড়ল। হতবাক হয়ে গেলাম। আয়নার ভেতর আমার প্রতিবিম্ব। কোথায় সেই ভয়ঙ্কর মুখ? শঙ্কর চ্যাটার্জী পরিষ্কার দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু মুখটা শুধু চক খড়ির মতো সাদা। বাথরুমের প্যানের পিছন থেকে উঁকি মারছে সেই বীভৎস মুখোশটা! তাহলে সব কি আমার কল্পনা?

ভয়টা এখনও সম্পূর্ণরূপে মন থেকে উধাও হয়নি। জানি, দরজা খুললে আমার মুখ দেখলে স্ত্রী বুঝে যাবে আমি ভয় পেয়েছি। ভাঙা গলায় ওকে বললাম, “কিছু হয়নি। তুমি শুয়ে পড়ো।”

“আগে দরজা খোলো। কখন থেকে বাথরুমে রয়েছ। এখন রাত বারোটা বাজছে।”

তার মানে, আমি বাথরুমে এক ঘণ্টার বেশি আছি। দরজা খুললাম। ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল।

“কী করছিলে এতক্ষণ বাথরুমে? কখন থেকে ডাকছি। ছেলেমেয়েরা বোধহয় উঠে পড়েছে।” — বানিয়ে কী বলব মাথায় আসছে না। তারপর বললাম, “একটা গল্পের প্লট চিন্তা করছিলাম।”

মেয়ে বলল, “তোমার ফোনটা বাথরুমের তাকে পড়ে আছে।” ফোনটা নিয়ে ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। চোখ বুজে ভাবতে লাগলাম, কিছুটা আগে হয়ে যাওয়া ঘটনার কথাটা। ঘুম চোখ থেকে উড়েছে। বুদ্ধি দিয়ে কোনও উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। জেগে জেগে স্বপ্ন দেখলাম? না কি কিছু সময়ের জন্যে ভৌতিক মুখোশটা আমাকে নিয়ে অদৃশ্য জগতে চলে গিয়েছিল? ফোনটা তো অক্ষত আছে! তাহলে কি জেগে স্বপ্ন দেখলাম? সারারাত ঘুম এল না। চোখ বুজলেই ওই বীভৎস মুখোশের ছবি ভেসে উঠছে।

সকালে উঠে বাথরুমে এলাম। অবিনাশদা’র কাছ থেকে নিয়ে আসা মুখোশ ফেরত দিতে হবে। মুখোশ নিতে গিয়ে দেখি পরচুলাটা নেই। এদিক সেদিক তাকিয়ে খুঁজে পেলাম না। মুখ ধুয়ে আয়নায় চুল আঁচড়াতে গিয়ে থমকে গেলাম। চিরুনিটা চুলে বসছে না। সভয়ে দেখি চুলগুলো মোটা মোটা পরচুলার মতো হয়ে গেছে! সারা মুখে ভয়ের রেশ ছড়িয়ে পড়ল। বুঝতে পারছি আমি কোনও অদৃশ্য আত্মার কবলে পড়েছি।

বিদ্যুৎ চমকের মতো মাথায় পীর বাবার মাজারে রফিকের নামটা ভেসে এল। ও ছাড়া এই বিপদ থেকে আমায় কেউ বাঁচাতে পারবে না। বাড়ির সকলের কান বাঁচিয়ে ফোন মেলালাম ওকে। সব কথা খুলে বললাম ওকে। সব শুনে বলল, ‘কিছু অতৃপ্ত আত্মা যে কোনও অব্যবহৃত পুরনো জিনিসের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশের চেষ্টা করে। ওরা কালো ঝুলের আকারে ওখানে লুকিয়ে থাকে। তাই যে কোনও পুরনো জিনিস ব্যবহার করার আগে পরিষ্কার করে নিতে হয়। এখানেও তাই ঘটেছে। ভয় পেলে, ওরা বেশি আনন্দ পায়। তখন দেহের গভীরে জাঁকিয়ে বসে। এক কাজ করুন, গঙ্গায় গিয়ে মুখোশটা ভাসিয়ে দিন। আর গুনে গুনে তিনটে ডুব দিয়ে পিছনের দিকে না তাকিয়ে জল থেকে উঠে আসবেন। বাকি কাজ আমার ওপর ছেড়ে দিন। দেখবেন, সব ঠিক হয়ে গেছে।’

সত্যি সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। চিরুনি দিয়ে পরিষ্কার চুল আঁচড়ালাম। কোনও অস্বাভাবিক মোটা চুলের খোঁজ পেলাম না।

রফিকের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে নাক কান মুলেছি। আর কোনওদিন অন্তত ভূত সাজছি না।

***

শঙ্কর চ্যাটার্জী

জন্ম বালি, হাওড়া। তবে বতর্মানে হুগলীর চুঁচুড়া নিবাসী। সোশ্যাল মিডিয়ায় মূলত ভৌতিক ও অলৌকিক গল্পকার হিসেবে শুরুটা করলেও পরবর্তীতে ওঁর কলমে ফুটে উঠেছে সামাজিক জীবনের পটভূমিকা। ২০১৮ সালে ওঁর প্রথম বই “কুহেলী” প্রকাশিত হয়। সাম্প্রতিকতম সৃষ্টি “সেরা পনেরো” ওঁর রচিত একাদশতম বই। এছাড়াও বহু সংকলনে ওঁর লেখা প্রকাশিত ও সমাদৃত হয়েছে।

সকল অধ্যায়

১. নোলা – স্নেহা আদক
২. তাপ্পর… – ডঃ সাম্য মণ্ডল
৩. কালচক্র – দেবলীনা বিশ্বাস
৪. রসের খোঁজে – অঙ্কন মুখোপাধ্যায়
৫. রক্তপিপাসু – মোনালিসা সাহা দে
৬. ফেরা – দেবদুলাল কুণ্ডু
৭. ঘড়ি – কেয়া চ্যাটার্জী
৮. স্বর্গাদপি – অলোকেশ ভট্টাচার্য্য
৯. আলিঙ্গন – রিয়া মিত্র
১০. খেলাঘর – প্রীতম গুহ
১১. সেই রাতে – নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী
১২. ছবি – মধুমিতা মুখার্জী
১৩. মুখোশ – শঙ্কর চ্যাটার্জী
১৪. ঋণশোধ – সৌমী গুপ্ত
১৫. সহযাত্রী – উস্রি দে
১৬. রিসর্টে এক রাত – অমিতাভ সাহা
১৭. জীবন্ত কথা – মহুয়া সমাদ্দার
১৮. অন্ধকারের জীব – রিয়া ভট্টাচার্য
১৯. রক্তে রাঙা রুদ্রাক্ষ – মঞ্জিলা চক্রবর্তী
২০. ভিত্তিহীন – মৃণাল নন্দী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন