বিশ্বরূপ মজুমদার
“কই রে মিঠাই, ডিংকাই… কোথায় গেলি রে দিদিভাইরা?” হামান-দিস্তেয় পান ছাঁচা শেষ হলে সরযূবালা হাঁক পাড়লেন।
কথায় বলে মেয়েরা নাকি কুড়িতেই বুড়ি। তা চার কুড়ি বয়স পেরনো সরযূবালাকে নিঃসন্দেহে বুড়ি বলা চললেও, থুরথুরে বলাটা ঠিক হবে না। আগেকার নির্ভেজাল খাদ্যের গুণেই হোক, অথবা বুনিয়াদি কাঠামোটা বেশ পোক্ত থাকার জন্যেই হোক; সরযূবালা এখনও দিব্যি টনটনে আছেন। খালি চোখে সুর করে পাঁচালি পড়েন। নিজের হাতে গোয়াল-ঘরে প্রিয় গাই লক্ষ্মীকে জাবনা দিয়ে আসেন। হাটবারে বাড়ির রোয়াকে বসে পথচলতি মানুষজনের সঙ্গে গল্পগাছা করেন। রোগব্যাধি যেটুকু আছে তা উল্লেখ করার মতো নয়।
একটি দু’টি প্রভুভক্ত দন্তযুগল ছাড়া অবশ্য সবগুলিই একে একে সঙ্গ ছেড়ে গেছে। গালে পান ফেলে সুখ পান না। তাই এই হামান-দিস্তের প্রয়োজন।
যমজ দুটি নাতনি ভরদুপুরে ঠাকুমার ঘরে ঠং ঠং আওয়াজ শুনেই দৌড়ে চলে আসে। “ঠাম্মা, গল্প বলো… গল্প বলো…”। সরযূবালা বিরক্ত হন না, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন ওদের কচি মুখের অকৃত্রিম বিস্ময়ের বহিঃপ্রকাশ। তাছাড়া ওঁর গপ্পের স্টক অফুরন্ত। একই গল্পকে পাঁচরকম ভাবে বললেও ধরতে পারা মুশকিল!
সরযূবালাকে একবারের বেশি ডাকতে হল না। মিঠাই, ডিংকাই উড়ে এসে ঠাম্মার কোলে মাথা গুঁজে দিল। বারান্দায় একটা শীতলপাটি বিছিয়ে সরযূবালা পা ছড়িয়ে গুছিয়ে বসেছেন। নাতনিদের মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে বললেন, “আজ তবে কীসের গল্প?”
রোজ এই পর্বে এসে কিঞ্চিৎ মনোমালিন্য হয় দুই বোনের। এমনিতে গলায় গলায় ভাব কিন্তু গল্পের পছন্দ আলাদা। একজনের পছন্দ রূপকথা, তো অপরজনের অদ্ভুতুড়ে। আজ অবশ্য দু’জনেই একবাক্যে বলল, “ভূতের…।” আষাঢ়ের ঝিম করে আসা কালো মেঘ, শ্যাওলা ভেজা সোঁদা গন্ধ আর আজকের ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে অবশ্য ভূতের গল্পই একমাত্র পছন্দ হতে পারে।
—“আজ তবে একটা দুষ্টু মেছো ভূতের গল্প বলি, কেমন।”
—“মেছো ভূত, মানে যে মাছ খেতে ভালোবাসে। তাই না ঠাম্মা?” ডিংকাই জানতে চায়।
—“ভালোবাসে মানে, মাছের জন্য পাগল একেবারে। সবসময় নোলা একেবারে ছুঁকছুঁক করছে। কিন্তু নিজের তো মাছ ধরার মুরোদ নেই। তাই চুরিচামারি করেই দিন কাটাতে হয়।”
—“ভূতেরাও বুঝি চুরি করে!” মিঠাইয়ের মুখ হাঁ।
—“করেই তো দিদি। না করলে খাবে কী! একদিন কী হয়েছে শোন না। এক জেলে হাটবারে শহরে গিয়েছিল মাছ বেচতে। তা সেদিন তেমন বিক্রিবাটা হয়নি। সারাদিনের শেষে যখন গাঁয়ের পথ ধরল জেলে, তখনও তার চুবড়ি ভর্তি মাছ। অনেকটা পথ হেঁটে ফিরতে ফিরতে বেলা গড়িয়ে কাবার। গাঁয়ে ঢুকতে একটা বিশাল বড় বাঁশবন পেরোতে হয়। আজ সেখানেই কিনা ঝুপ করে সন্ধে নামল। আর যেখানে সন্ধে হয়, সেখানেই ভূতের ভয়…।”
—“তাপ্পর, তাপ্পর…”, দুই বোনের বিস্ফারিত চোখেই সমান কৌতূহল।
গল্পের নাটকীয় মোড়কে এসে, সাসপেন্স জিইয়ে রাখার জন্য সরযূবালা মুহূর্তকাল বিরাম নিলেন। পাশে রাখা পেতলের ঘটিটা থেকে আলগোছে দু’-ঢোঁক জল ঢাললেন গলায়। তারপর খানিকটা ছাঁচা-পান মুখে দিলেন।
—“তোরা জানিস সেই বাঁশবনে কে থাকত?”
—“মেছো ভূত!!” দুহিতাগণ সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল।
সরযূবালা তাঁর ভৌতিক গল্পের পরবর্তী পর্বে যাবেন, এমন সময় নীচ থেকে হাঁকডাক শোনা গেল। “ঠানদি, ও ঠানদি। বাড়িতে আছো নাকি?”
সদরের আগল খোলাই ছিল। দিগম্বর ডাক্তার বাড়ির অন্দরে পা দিলেন। বহুদিন ধরেই এই গ্রামে রুরাল প্র্যাকটিস করে আসছেন। পুরনো পরিচিত তাই মাঝেমধ্যে নিজেই এসে সরযূবালাকে দেখে যান। কলতলায় মালতী বাসন মাজছিল। ওকে দেখে শুধোলেন, “কি রে, দিদি আছেন ওপরে?”
“কোথায় আর যাবে। দেখো গে গালে পান ঠুসে বসে আছে হয়তো বারান্দায়।” ছাই দিয়ে একটা তেলচিটে কড়াই ঘষতে ঘষতে ব্যাজার মুখে জবাব দিল মালতী। দোতলার দিকেই পা বাড়ালেন দিগম্বর।
“আর ডাক্তার বদ্যি দিয়ে কী হবে! বুড়ির এবার ঘাটে যাওয়ার সময় হয়েছে।” কড়ায় জল ঢালতে ঢালতে নিজের মনেই গজগজ করতে থাকে মালতী। “মাথাটা তো কবেই গিয়েছে… কোন কালে পুকুরে নাইতে গিয়ে দুই নাতনি ডুবে মরল তা আর খেয়ালই থাকে না বুড়ির! এখনও ভরদুপুরে তেঁনাদের গপ্পো শোনাবার জন্য ডাকাডাকি করেন! যত্তসব অমানুষ্যি কাণ্ডকারখানা মাইরি! মরণ…।’
পুরনো আমলের কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দিগম্বর ডাক্তার যখন দোতলার শেষ ধাপে পা রাখছেন, বারান্দা থেকে তখন অনেকগুলি অসমবয়সী মানুষের প্রাণোচ্ছল হাসির আওয়াজ শোনা গেল।
***
ডঃ সাম্য মণ্ডল
পেশায় চিকিৎসক, ভালোবাসায় লেখক। বর্তমানে হাওড়া জেলার সরকারি স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। পেশার পাশাপাশি মৌলিক লেখনীর সঙ্গে সংযোগ দীর্ঘদিনের। বিভিন্ন পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের সঙ্গে ‘প্রতিলিপি’, ‘পাণ্ডুলিপি’, ‘গল্পকুটির’ ইত্যাদি অনলাইন পোর্টালগুলিতেও নিয়মিত লেখালেখি করেন। ২০১৯ সালের কলকাতা বইমেলায়, “১৯ থেকে উনত্রিশ” নামে লেখকের একটি প্রেমের গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন