বিশ্বরূপ মজুমদার
নিঃশব্দে ফুলিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে রহমত। ফুলিয়াকে নিয়ে গ্রাম থেকে পালিয়ে শহরে এসেছিল সে। হিন্দু মেয়ের সঙ্গে প্রেম। জানতে পারলে কুপিয়ে খুন হতে হত দু’জনকেই। কিন্তু ফুলিয়াকে ছাড়া বাঁচবে না সে। এখন শহরে একটা কনস্ট্রাকশন সাইটে মজদুরের কাজ করে দু’জনই। সাইটেই কিছু ছোট ছোট খুপরি ঘর। তাতেই ওদের সংসার। বিয়েটা করা হয়নি। কিন্তু স্বামী স্ত্রী’র মতোই থাকে। এখানে দু’জনকে আসল নামে কেউ চেনে না। এখানে সবাই জানে মোহন আর রাধা স্বামী-স্ত্রী। রহমত নিশ্চিত ছিল এখানে কেউ ওদের খুঁজে পাবে না।
ওদের গ্রামের লোকেরা ওদের সত্যিই খুঁজে পায়নি। কী করে পাবে? শহরে এসে ওদের খুঁজে বের করতে আসবে না কেউ। কিন্তু এক বিপদের খপ্পর থেকে বেরিয়ে আরেক বিপদে পড়েছে এখন তারা। কনস্ট্রাকশন সাইটে কিছু লোকাল দাদাদের আড্ডা লেগে থাকে। ওদের চোখে ফুলিয়ার জন্যে খুব নোংরা ভাষা। গা শিরশির করে উঠেছে রহমতের। এখানে বেশিদিন কাজ করা যাবে না। অন্য কোনও জায়গায় কাজ খুঁজতে হবে। খুঁজছিলও সে। কিন্তু…
ফুলিয়া কী নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। ওর ঘুম ভাঙার অপেক্ষা করছে রহমত। ঘুম ভাঙলেই পালাতে হবে। ফুলিয়ার নিরাপত্তার জন্য সে সবকিছু করতে পারে।
* * * * *
ভোর হওয়ার আগেই ফুলিয়ার ঘুম ভাঙল যেরকম প্রতিদিন ভেঙে যায়। কিন্তু প্রতিদিনের মতো পাশে রহমতকে পেল না সে। রাতে বাংলা খেয়ে কোথাও উলটে থাকার ছেলে তো সে নয়। তাহলে কি আগে উঠে কোথাও বেরিয়েছে? বাইরে ঠিক তখনই একটা চিৎকার শুনে চমকে উঠল ফুলিয়া। কাশি ভাইয়ের গলা। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলতেই সামনে তিনটে ছিন্ন ভিন্ন শরীর দেখে গা গুলিয়ে উঠল ফুলিয়ার। বমি করে অজ্ঞান হয়ে গেল সে।
প্রোমোটারের ছেলে শিবনাথ আর তাই দুই বখাটে বন্ধুর লাশগুলো ওরকম ছেঁড়া কাটা অবস্থায় কারা ফেলে গেল তা পুলিশ তদন্ত শুরু করল। যে নৃশংসভাবে লাশগুলো কুপিয়ে কাটা হয়েছে নিশ্চয়ই কোনও ভাড়াটে খুনীর কাজ। যদিও পুলিশের অনুমান, এটা একটা পলিটিক্যাল খুন। কনস্ট্রাকশন সাইটও আপাতত বন্ধ। এদিকে ফুলিয়া রহমতকে খুঁজে না-পেয়ে অথৈ সাগরে পড়ল যেন।
* * * * *
প্ল্যাটফর্মে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে ফুলিয়া। কালকে বস্তিতে থাকার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। সারাদিন রহমতের অপেক্ষা করে কেটে গেল। সারাদিন পাগলের মতো খুঁজে এখন ক্লান্ত ফুলিয়া। আজকের রাতটা স্টেশনেই কাটিয়ে দিতে হবে কোনও রকমে।
ঘুমোচ্ছে ফুলিয়া। রহমতের জন্যে চিন্তায় তার দু’চোখের পাতা এক হচ্ছিল না। কিন্তু এখন সারাদিনের ক্লান্তি তার শরীরকে অবশ করে দিয়েছে। ঘুমোলে আরও সুন্দর লাগে ফুলিয়াকে। রহমত মুগ্ধ হয়ে দেখছে। দেখছে আর পাহারা দিচ্ছে ফুলিয়াকে। রহমতকে ফুলিয়া আর খুঁজে পাবে না। ওই কনস্ট্রাকশন সাইটেই পুঁতে রাখা আছে তার দেহ। প্রতিবাদ করতে গিয়েছিল সে ফুলিয়ার নামে নোংরা কথা শুনে। কিন্তু ওদের তিনজনের সঙ্গে পেরে ওঠেনি। রহমতকে জ্যান্ত পুঁতে দিয়েছিল ওরা মাথা থেঁতলে। কিন্তু রহমত ফুলিয়াকে বাঁচাতে পেরেছে। সেদিন রাতে যখন ফুলিয়ার ওপর চড়াও হয়েছিল ওরা, ফুলিয়ার মনে নেই কিছুই। ও তো ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু রহমত জেগেছিল ফুলিয়ার শরীরে। শুকনো রক্ত আর নাড়িভুঁড়ি লাগানো কাস্তেটা এখনও ফুলিয়ার পুঁটলির মধ্যেই সযত্নে মোড়ানো আছে। যতদিন না ফুলিয়া নিরাপদ একটা ঠাঁই খুঁজে পাচ্ছে, কিংবা হয়তো তারও পরে, রহমত এভাবেই ঘুমন্ত ফুলিয়ার পাহারা দিয়ে যাবে। কী সুন্দর লাগছে ফুলিয়াকে।
***
প্রীতম গুহ
১৯৮৯ সালে নিউ ব্যারাকপুরে জন্ম, বর্তমানে কলকাতার রাজারহাটে বসবাস। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ গল্পের বইয়ের প্রতি ঝোঁক এবং নিজের মনে অনেক গল্পের আঁকিবুঁকি কাটা। সেই থেকে শুরু। পরবর্তীকালে পেশা হিসেবে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বেছে নিলেও, বেঁচে থাকার রসদ হিসেবে বই পড়া এবং নিজে লিখতে থাকার নেশাটা রয়েই যায়। ফেসবুক এবং অন্যান্য অনলাইন ফোরামে হঠাৎই কিছু লেখা পোস্ট করে বুঝতে পারেন মানুষ তাঁর গল্পগুলো পড়ে আনন্দ পাচ্ছেন। তাই কর্মব্যস্ত দিনগুলোর মধ্যেও চেষ্টা থাকে কিছুক্ষণ কল্পনার জগতে বিচরণ করে মানুষকে আনন্দের রসদ পৌঁছে দেওয়ার।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন