ভিত্তিহীন – মৃণাল নন্দী

বিশ্বরূপ মজুমদার

হন্তদন্ত হয়ে বাইকটা গ্যারাজে রেখে বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই রান্নাঘর থেকে মায়ের গলার আওয়াজ ভেসে এল টুংটাং বাসনের শব্দ ছাপিয়ে, “ফিরলি খোকা?”

—“হ্যাঁ।”

—“এত রাত পর্যন্ত বাড়ির বাইরে কী করিস বল তো? সেই কখন বেরিয়েছিস সন্ধেয়! এতক্ষণ না-খেয়ে থাকলে পেটে পিত্তি পড়ে আলসার টালসার বাধাবি যে! পাশের ফ্ল্যাটের রমাকান্তের অবস্থা দ্যাখ। তোর মতোই বয়স। কিন্তু তিন সপ্তাহই মাসে শয্যাশায়ী থাকে পেটের রোগে। যা তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে আগে খেতে বোস।”

তমাল কোনও উত্তর দিল না। এসময় মায়ের কথার উত্তর দিয়ে কোনও লাভও নেই। চুপচাপ হাত পা ধুয়ে জামাকাপড় বদলে খাবার টেবিলে ভালো ছেলের মতো বসে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ। তমাল তাই সটান নিজের রুমে গিয়ে অ্যাটাচড বাথরুমে ঢুকে পড়ল। কিন্তু সেখান থেকে পরিষ্কার হয়ে বেরিয়েই একটু চমকে গেল। মা তমালের বিছানার ওপর গুটিসুটি মেরে বসে আছে। কী হল আবার! এই মাত্রই তো রান্নাঘর থেকে ভাষণ দিচ্ছিল।

তমাল খেয়াল করল তার রুমের দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ। কোনও কিছুর ভয়ে মায়ের মুখ কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে, আর থরথর করে কাঁপছে বিছানার ওপর বসে। মায়ের নজর বন্ধ দরজার ওপর স্থির হয়ে আছে।

বেশ অস্বাভাবিক ব্যাপার। মাকে তো আগে কখনও এরকম ভয় পেতে দেখেনি। তাহলে মাত্র এক মিনিটের মধ্যে কী এমন হল যে মা রান্নাঘর থেকে কাজকর্ম ছেড়ে তার রুমে চলে এল? তমাল জিজ্ঞেস করল, “কী হল?”

সঙ্গে সঙ্গে রমাদেবী তমালের দিকে ফিরে মুখে আঙুল চাপা দিয়ে ফিস ফিস করে বলে উঠলেন, “চুপ, একদম চুপ।”

তমাল তাড়াতাড়ি গিয়ে মায়ের পাশে বসল। তারপর চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

রমাদেবী কেমন উদভ্রান্তের মতো তাকালেন তার দিকে, তারপর দরজার দিকে তাকিয়ে যেন কিছু মনে পড়ে গিয়ে আবার চমকে উঠলেন। কাঁপা কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বলে উঠলেন, “ওই, ওই, ওখানে।”

তমালও সেদিকে দেখল, কিন্তু দরজা তো বন্ধ। তাই ওপারের কিছুই দৃষ্টিগোচর হল না। তাহলে কি আরশোলা, টিকটিকি বা ইঁদুর-বাদুড় ধরনের কিছু ঢুকেছে রান্নাঘরে? কিন্তু মায়ের তো এসব কিছুতেই তেমন ভীতি কখনও ছিল না। তাহলে এত আতঙ্কিত হওয়ার কারণ কী?

কিছুটা ধৈর্য হারিয়েই বলে উঠল সে, “কী আছে ওখানে?”

রমাদেবী ভয়ার্ত কণ্ঠে উত্তর দিলেন, “জানি না।”

উত্তরটা শুনে বিরক্তিতে তমালের পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে উঠল এবার। “কী শুরু করেছ কী?” বেশ জোর গলাতেই কথাটা বলে দরজাটা খুলতে উঠে গেল সে।

“খুলিস না খোকা, খুলিস না।” রমাদেবী প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন।

“আরে ছাড়ো তো, যত্তসব।” বলে তমাল গিয়ে দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিল।

কিন্তু বাইরে সব স্বাভাবিক। কোথাও ভয় পাবার মতো কিছুই নেই। মায়ের দিকে ফিরল তমাল। মা বাচ্চাদের মতো হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে কাঁপছে ভয়ের চোটে থরথর করে। তমাল নিজের রুম থেকে বেরিয়ে ছোট্ট প্যাসেজটা পেরিয়ে ডাইনিং রুমে এল। সবই তো ঠিকঠাক। রান্নাঘর থেকে খুব হালকা একটা শোঁ শোঁ আওয়াজ আসছে, কিছু একটা উনুনে গরম হচ্ছে। মা তো রান্নাঘরেই ছিল। তাহলে কি ওখানেই কিছু হয়েছে?

সত্যিই কিছু কি ঢুকেছে বাইরে থেকে? মানে সাপখোপ কিম্বা বেজি, অন্য কোনও প্রাণী, যা দেখে মা এত ভয় পেয়ে গেছে! কিন্তু তাই বলে এতটাই আতঙ্কিত হয়ে পড়বে যে মুখ দিয়ে ঠিকঠাক গলায় কথাই বেরোবে না? হুমম, ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে!

তমাল পা টিপে টিপে নিঃশব্দে রান্নাঘরের দিকে এগোল। তার আগে অবশ্য দেওয়ালে ঝোলানো তার স্বর্গবাসী দাদুর শখের ওয়াকিং স্টিকটা সে হাতে তুলে নিয়েছে। মা যা ভয় পেয়েছে, বলা যায় না, হয়তো সত্যিই বিপজ্জনক কিছু হতে পারে। তাই আগে থেকেই যতটা সম্ভব নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখাই ভালো।

কিন্তু রান্নাঘরের দরজায় উঁকি মেরেই সে যা দেখল, তাতে তার চোখ যেন অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। তার হাত থেকে লাঠিটা মেঝেতে পড়েই গেল সশব্দে। মা একমনে শসা আর টম্যাটো কাটছিলেন সেখানে, স্যালাড বানানোর জন্য। দরজার দিকে পেছন ফিরেছিলেন তিনি, শব্দে চমকে উঠে তমালের দিকে ফিরে তাকালেন। দু’জনেই হতবাক। তমালকে তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে রমাদেবী বলে উঠলেন, “কী হল রে?” তারপর মেঝেতে পড়ে থাকা লাঠিটার দিকে একবার তাকিয়ে মজার স্বরে বলে উঠলেন, “লাঠি নিয়ে তুই আবার কি করছিলি এখানে? দ্যাখ আবার, আমাকে মারধর করার ইচ্ছে নেই তো? সম্পত্তি-টম্পত্তি যদি চাস তাহলে বলে ফ্যাল বাবা, এখনই উইল করে দিচ্ছি।” বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলেন।

এবার তমালের সংবিৎ ফিরল, সে লজ্জা পেয়ে গেল একটু, “আরে না না, তেমন কিছু নয়। আমি ভাবলাম রান্নাঘরে কিছু আছে। তুমিই তো ভয় দেখাচ্ছিলে। কিন্তু এখানে তুমি এলে কীভাবে? এইমাত্র তো আমার রুমে ছিলে।”

এবার রমাদেবীর অবাক হবার পালা। “আমি? তোর রুমে? কী ভুলভাল বকছিস? আমি তো আধঘণ্টার মতো হল রান্নাঘর থেকে বেরোইনি।”

—“অ্যাঁ! কিন্তু তা কী করে হয়? এই তো তুমি ছিলে আমার ঘরে। ভয়ে কাঁপছিলে।”

—“কী? আমি ভয়ে কাঁপছিলাম?” রমাদেবী অবাক হয়ে একটু চিন্তা করলেন, তারপর একটু রাগত স্বরে বলে উঠলেন, “ও, বুঝেছি। তুই আবার ছাইপাঁশ গিলে এসেছিস বন্ধুদের সঙ্গে। এমনিতেই তোর হ্যালুসিনেশনের ধাত আছে। ছোটবেলা থেকেই মাঝে মাঝে কী সব উল্টোপাল্টা জিনিস দেখিস। তারপর আবার ওসব পেটে পড়লে নেশার ঘোরে কী না কী দেখবি তার কোনও ঠিক নেই। ভয় লাগে কখনও কিছু দুর্ঘটনা আবার না বাধিয়ে বসিস এসবের চোটে।”

—“না মা। বিশ্বাস করো। কিচ্ছু খাইনি। এই তোমার দিব্যি। সত্যিই তুমি আমার ঘরে ছিলে।”

এবার রমাদেবী বিরক্ত হলেন, “কী যা তা বকছিস খোকা? আচ্ছা চল তো। যদি তোর কথাই ঠিক হয়, তবে দেখি আমার ডুপ্লিকেটটা এখন সেখানে কী করছে! আর যদি কাউকে না পাই তাহলে তোর একদিন কী আমার!”

বলেই রমাদেবী হনহনিয়ে তমালের ঘরের দিকে হাঁটা দিলেন, পেছন পেছন তমাল। কিন্তু গিয়ে দেখলেন ঘর পুরো ফাঁকা। বাথরুমও চেক করা হল। সেখানেও কেউ নেই। কোমরে হাত দিয়ে রাগী রাগী মুখে রমাদেবী তমালের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। মুখে নুন পড়া জোঁকের মতো কিছুটা গুটিয়ে গেল তমাল, “আমি কিন্তু সত্যিই দেখেছি মা। আর কিছু উল্টোপাল্টাও খাইনি আমি, যার ঘোরে এসব দেখব। এই দ্যাখো, কোনও গন্ধ পাচ্ছ?” বলে মুখটা একটু হাঁ করে এগিয়ে দিল মায়ের দিকে।

কথাটা ঠিক। সত্যিই কোনও গন্ধ পেলেন না রমাদেবী। আর তাই হঠাৎ করেই তার চিন্তা যেন বেড়ে গেল আরও কয়েক গুণ। চিন্তা এখন দুশ্চিন্তার রূপ নিচ্ছে। গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন তিনি, “তাহলে কি তুই আরও বড় কোনও নেশা শুরু করেছিস? ড্রাগস জাতীয় কিছু?”

এবার তমাল হেসে উঠল জোরে, “আচ্ছা মা, তুমি আমাকে কী ভাবো বলো তো? আমাকে ছোট থেকেই তো মানুষ করছ। কখনও কী মনে হয়েছে যে আমি এতটাই হতাশাগ্রস্ত, যে এসব ফালতু নেশার মধ্যে ডুবে যাব? আর কেনই বা এরকম করতে যাব? এরকম ঘটার কি কোনও কারণ আছে আমার লাইফে? আমি তোমাদের ছেলে মা। এ হাইলি এনার্জেটিক ম্যান, জাস্ট লাইক ইউ অ্যান্ড বাবা। তাই এসব কল্পনাতেও এনো না।”

রমাদেবীর কপালে চিন্তার ভাজ কিছুটা কমল বটে, কিন্তু পুরোটা এখনও বিলীন হয়নি। “হুমম। সে তো বুঝলুম। কিন্তু এসব ভুলভাল যে দেখছিস, তাও তো ভালো লক্ষণ নয়। ছোটবেলা থেকেই তুই ভূত-প্রেত, অলৌকিক এসব ব্যাপার নিয়ে খুব মাতামাতি করতিস। মাঝে মাঝে বলতিসও যে তুই উদ্ভট সব জিনিস দেখতে পাস। আমরা বুঝতাম যে এগুলো সবই ছিল আসলে তোর শিশুমনের কল্পনা। কিন্তু এত বড় হয়েও যদি এ ধরনের ভূত দেখার মতো ব্যাপার থেকে যায়, তাহলে তো তা চিন্তার ব্যাপার।”

“ভূত!” তমাল দেখল বিষয়টা ভয়ঙ্করতর রূপ ধারণ করছে ধীরে ধীরে। তাই ব্যাপারটাকে হালকা করার জন্য বলে উঠল, “আচ্ছা ছাড়ো তো এসব। আমারই হয়তো মনের ভুল ছিল। চলো এবার খেতে বসা যাক। খিদেয় পেট চুঁই চুঁই করছে।”

রমাদেবী চোখ পাকালেন, “করবেই তো! কতক্ষণ না খেয়ে আছিস বল তো? আয় চলে আয়।” বলতে বলতে দরজার দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছেন, ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা। আর সঙ্গে সঙ্গে দু’জনেরই শিরদাঁড়া বেয়ে যেন আতঙ্কের এক শীতল তরঙ্গ বয়ে গেল একই সঙ্গে।

রান্নাঘরের দিক থেকে রমাদেবীর গলাতেই কেউ ডাক দিচ্ছে, “কই রে খোকা খাবি আয়। আর কত দেরি করবি?”

রমাদেবী থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর ধীরে ধীরে পিছিয়ে এলেন কয়েক পা। দু’জনেই নির্বাক হয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক পলক। আবার সেই আওয়াজ ভেসে এল, “কই রে! আয়।”

রমাদেবী আর কালবিলম্ব না করে প্রায় ছুটে গিয়ে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। তার চোখে প্রবল আতঙ্ক।

তমালেরও কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। কী যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। ভয়ও লাগতে শুরু করেছে। কিন্তু এই বয়সে মনের মধ্যে ভয় উঁকি দিতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই ভয়কে জয় করার একটা প্রবল ইচ্ছেও অনেকসময় উপস্থিত হয়। তমালেরও তাই হল। সে বাইরে যেতে উদ্যত হল। কিন্তু রমাদেবী দরজা আগলে দাঁড়ালেন। “যাস না তমাল। কিছু একটা অলক্ষুণে এ বাড়িতে ঢুকেছে। তাই এসব হচ্ছে।” ফিস ফিস করে বলে উঠলেন তিনি। তার মুখে এখন প্রবল ভয়ের ছাপ, কিছুক্ষণ আগে এই ঘরেই বিছানার ওপর বসে থাকা প্রথম রমাদেবীর মতো।

কিন্তু তমালের মধ্যে ভয় কেটে গিয়ে অকস্মাৎ কোথা থেকে যেন অসীম সাহসের জন্ম হয়েছে, যা তাকে বাইরে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে প্রবলভাবে। তবে এটাও বেশ বুঝতে পারছে সে যে মাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত না করতে পারলে সে বাইরে যেতে পারবে না। আর তা নাহলে এ রহস্যও ভেদ হবে না। তাই মায়ের দু’হাত ধরে সে ধীরে ধীরে বিছানায় এনে বসাল। মা ফিসফিস করে বারণ করেই চলেছে, “যাস না খোকা, বাইরে যাস না।”

বাইরে থেকে এই মূহূর্তে কোনও গলার শব্দ না এলেও খাবার টেবিলের ওপর থালা বাটি চামচ ইত্যাদি সাজানোর আওয়াজ আসছে। রাতের খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে মনে হয়। তমালের একটা খটকা লাগছে। তবে আপাতত সে শান্ত করার জন্য মাকে বোঝাল, “চিন্তা নেই মা। কিচ্ছু হবে না। সবই মনের ভুল।”

রমাদেবী যেন খুব হতাশ হয়েই উত্তর দিলেন, “আমিও তো তাই ভাবছিলাম। সব তোর মনের ভুল। কিন্তু এখন তো দেখছি সবই সত্যি।”

একটা ব্যাপার তমালের বেশ আজব লাগছে। তার মা বিছানার ওপর গুটিসুটি মেরে বসে আছেন। আর তমাল তার পাশেই পা ঝুলিয়ে বসে আছে। তাদের বসার জায়গা আর ধরন, সব যেন আগেরবারের মতোই। অর্থাৎ প্রথমবার তমাল যখন বাথরুম থেকে বেরিয়ে তার মাকে দেখতে পেয়েছিল, সবকিছু যেন প্রায় সেরকমই। প্রায়? না কি একেবারেই একরকম? তাহলে কি সবকিছুরই আবার একইভাবে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে? বারবার?

কিন্তু চিন্তামগ্ন তমালের চিন্তাজাল ছিন্ন হল আবার বাইরের সেই ডাকে, “আয় রে খোকা। আর কতক্ষণ?”

তমাল আর থাকতে পারল না। এই রহস্য তাকে ভেদ করতেই হবে। সে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। রমাদেবী তাকে কাতর অনুনয়ের সুরে বলে উঠলেন, “যাস না খোকা, তোকে আমি বার বার নিষেধ করছি।”

কিন্তু কে শোনে কার কথা? তমাল কোনও বারণ না শুনেই গটগট করে ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু তারপর দরজা খুলে যেই না ঘরের বাইরে পা রেখেছে, তখনই ঘটল আরেক দুর্ঘটনা। হঠাৎ লোডশেডিং। সারা বাড়ি মুহূর্তের মধ্যে ডুবে গেল নিটোল নিশ্ছিদ্র এবং অনভ্যস্ত অন্ধকারে।

কী হল এটা! লোডশেডিং তো প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে ইদানীং। আর যদি হয়ও, তাহলে এই মোক্ষম সময়েই পাওয়ার কাট হল কীভাবে? পুরোটাই কি কাকতালীয়? না কি অন্যকিছু! তমালের মনের ভেতর কেমন যেন একটা কু ডাকল কেউ। আর পেছনে, ঘরের ভেতর থেকে আবার ডেকে উঠলেন রমাদেবী, “বাইরে যাস না বাবা। ভেতরে চলে আয়।”

কিন্তু তা অগ্রাহ্য করেই তমাল পা রাখল বাইরের প্যাসেজে। তারপর পা টিপে টিপে সেখান থেকে ড্রয়িং কাম ডাইনিং রুমে। সেখানে পৌঁছেই বুঝল কেউ একজন আছে সেখানে। কেউ একজন, যে তার মায়ের গলা নকল করতে পারে হুবহু। কিন্তু তার উদ্দেশ্যটা বোঝা যাচ্ছে না। শুধু কি ভয় পাওয়ানো? না কি অন্য কিছু? গলাটা একটু পরিষ্কার করে নিয়ে তমাল বলে উঠল, “কে? কে আছে এখানে?”

কিন্তু কোনও উত্তর পাওয়া গেল না। তবে কিছু একটা অন্ধকারে নড়াচড়া করছে। তমাল পরিস্থিতি খুব একটা ভালো বুঝল না। এসময় হাতে কিছু একটা থাকা দরকার। সে খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগল রান্নাঘরের দরজার দিকে, যেখানে তার দাদুর লাঠিটা পড়ে থাকার কথা। কিন্তু সে খুব একটা নিশ্চিত নয় যে সেটা এখনও সেখানে আছে, না কি এখানে যিনি আছেন, তিনি আগেই সেটা অন্য কোথাও সরিয়ে রেখেছেন। তবুও ধীরে ধীরে একটা সুযোগ নেওয়ার জন্য সে এগিয়ে যেতে লাগল।

হঠাৎ আবার ঘরের অন্যদিক থেকে কিছু একটা নাড়াচাড়া করার খুটখাট আওয়াজ শোনা গেল, তার সঙ্গে ভেসে এল রমাদেবীর বিরক্তিভরা গলার স্বর, “ধুর বাবা। পাওয়ার কাট এর আর সময় পেল না! একেবারে মোক্ষম সময়ে? কী সব কাকতালীয় ব্যাপার রে বাবা!”

তমাল চমকে উঠল। এই শব্দগুলোই তো সে ভাবছিল একটু আগে — মোক্ষম সময়, কাকতালীয়, পাওয়ার কাট। একেবারে তার মাথা থেকে শব্দগুলো টেনে বের করে কেউ যেন তার মায়ের গলায় বলছে। মোক্ষম সময় বলতে সে কি বোঝাতে চাইছে? তাহলে কি এটা অলৌকিক কোনও অস্তিত্ব? না কি পুরোটাই তার কল্পনা?

“ধুস! দেশলাই আর মোমবাতিটাও যে কোথায় রেখেছি! আসল সময়েই খুঁজে পাওয়া যায় না।” কিছুক্ষণ খুটখাট আওয়াজের পর আবার কণ্ঠস্বরটা ভেসে এল। “এই তো মোমবাতিটা পেয়েছি। দাঁড়া এবার দেশলাইটা খুঁজি। আচ্ছা, তুই কি লাঠিটা খুজে পেলি তমাল? ওই তো, একেবারে কাছেই পৌঁছে গেছিস, বাঁ-দিকে আর মাত্র এক পা গেলেই ওটা পড়ে আছে।”

শোনামাত্র তমালের প্রবল সাহস যেন হঠাৎ করেই কর্পূরের মতো উবে গেল। পা দুটো যেন কেউ অদৃশ্য কোনও আঠা দিয়ে আটকে দিল মেঝের সঙ্গে।

“তুই একটু নিচু হয়ে হাত বাড়িয়েই নিতে পারিস ওটা। আর না এগোলেও চলবে। তবে নিয়ে কি লাভ হবে কিছু?”

তমাল কোনও রকমে বলে উঠল, “কি-কিন্তু তু-তুমি কি করে বুঝলে যে আমি লা-লা-লাঠিটা নিতে যাচ্ছি?”

হঠাৎ রমাদেবীর কণ্ঠ খিলখিলিয়ে হেসে উঠল, বেশ অস্বাভাবিক ভাবে। তারপর সেরকম অস্বাভাবিক স্বরেই পরের কথাগুলো ভেসে এল, “আমরা তো অন্ধকারেও পরিষ্কার দেখতে পাই রে। কোনও অসুবিধে হয় না। মোমবাতি তো জ্বালাতে চাইছিলাম তোর সুবিধের জন্য।”

কথা শেষ হওয়া মাত্রই নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে মূহূর্তের জন্য যেন সেই মূর্তিটার চোখের জায়গা দুটো জ্বলে উঠল, বন্য জন্তুর চোখ যেমন অন্ধকারের মধ্যে জ্বলজ্বল করে ওঠে। তমালের মেরুদণ্ডে যেন অসংখ্য আলপিন ফুটল একসঙ্গে। কোনও ভুল নেই, এটা তার কল্পনা হতে পারে না। খুবই কম সময়ের জন্য হলেও সে স্পষ্ট দেখেছে সেই জ্বলন্ত আগুনের মতো চোখ দুটো।

কিন্তু নাটক শেষ হয়নি তখনও, কিছুটা বাকি ছিল। ওদিক থেকে আবার স্বরটা ভেসে এল, “এই তো পেয়েছি। দাঁড়া, জ্বালাই মোমবাতিটা।” সঙ্গে সঙ্গেই ফস্‌ করে একটা আওয়াজ হল আর একটা দেশলাই জ্বলে উঠল। আর ঠিক সেই সময়ই কোথা থেকে যেন একঝলক ঠান্ডা দমকা বাতাস এসে সেটাকে সঙ্গে সঙ্গে নিভিয়েও দিল। কিন্তু তাতেই তমাল যা দেখল, তাতে তার নিজের চোখকেই বিশ্বাস হল না। সে স্পষ্ট দেখল, দেশলাই কাঠিটা শূন্যে ভাসছে, কেউ সেটাকে ধরে নেই। ডাইনিংয়ে সে ছাড়া আসলে আর কেউই নেই।

তমাল আর এক মূহূর্তও সেখানে সময় নষ্ট করল না। তার মন আর শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে কোনও রকমে দৌড় লাগাল নিজের ঘরের দিকে, যেখানে সম্ভবত তার আসল মা তার জন্য অপেক্ষা করছে। সম্ভবতই, কারণ এই মুহূর্তে কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে, কোনটা আসল আর কোনটা নকল, সবই তার কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। সে অন্ধকারের মধ্যেই হোঁচট খেতে খেতে কোনওভাবে নিজের রুমে পৌঁছে দরজাটা লক করে হাঁপাতে লাগল। এই বদ্ধ ঘরে, ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেও এখন তার নিজেকে কিছুটা নিরাপদ মনে হচ্ছে। যদিও আদৌ তা কতটা ঠিক সে ব্যাপারে নিজেও সে নিশ্চিত নয়।

একটু সামলে নিয়ে সে রমাদেবীকে বলে উঠল, “তুমি ঠিকই বলেছিলে মা। ওটা অন্য কিছু, ওটা তুমি নও। খুব, খুব ভয়ানক কিছু।”

কিন্তু কোনও উত্তর পাওয়া গেল না।

“মা।”

এবারও কোনও সাড়াশব্দ নেই।

“মা। তুমি আছো তো?” বলে এবার তমাল অন্ধকারের মধ্যে নিজের বিছানা হাতড়াতে লাগল। এ কী! বিছানা তো ফাঁকা। তাহলে মা গেল কোথায়? মা-ও কি তাহলে রুম ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে। কী সর্বনাশ! তমালের নিজেকে কেমন যেন উদভ্রান্ত লাগল।

আর তখনই, তাকে আবার চমকে দিয়ে রমাদেবীর গলার আওয়াজ শোনা গেল, ফিসফিস স্বরে, “চিন্তা নেই খোকা। আমি আছি।”

তমাল জিজ্ঞেস করল, “কোথায় তুমি?”

—“এই তো এখানে।”

আওয়াজটা আসছে বিছানার তলা থেকে। তমাল উঁকি মারল। সেখানে আঁধার আরও জমাট। তবে রমাদেবীর নিঃশ্বাসের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। উনি যে জড়সড় হয়ে সেখানে কোনও রকমে বসে আছেন তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।

“কী রে, একেবারে প্রথম থেকেই বলছিলাম না, বাইরে যাস না, যাস না। এখন নিজের চোখেই দেখলি তো!”

—“হ্যাঁ মা, ঠিকই বলেছিলে।”

—“আর যাস না। আয় চলে আয় আমার কাছে।”

—“হ্যাঁ মা। আর যাব না তোমাকে ছেড়ে। তোমাকেও কোথাও যেতে দেব না।”

তমালও কোনও রকমে নিচু হয়ে নিজেকে ঢুকিয়ে দিল খাটের তলায়। এখন তার বেশ ভালো লাগছে। রমাদেবী বলে উঠলেন, “তোর মনে পড়ে তমাল? তুই যখন ছোট ছিলি, আমরা কত লুকোচুরি খেলতাম! তুই, আমি আর তোর বাবা।”

—“হ্যাঁ। খুব মনে পড়ে। খুব মজা হত। তুমি আর আমি একসঙ্গে এদিক ওদিক লুকিয়ে পড়তাম। আর বাবা সারা বাড়ি আমাদের খুঁজে বেড়াত।”

—“হ্যাঁ। ভাব আমরা এখনও সেই লুকোচুরি খেলছি। দ্যাখ ভয় কেটে যাবে।”

তমাল হাত বাড়িয়ে মাকে স্পর্শ করল। রমাদেবীও তমালের হাত ধরলেন। একটা পায়ের আওয়াজ এই ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে। বেশ ভারী পায়ের আওয়াজ। থপ থপ থপ থপ। এক পা এক পা করে এসে আওয়াজটা এই ঘরের সামনে থামল। তারপর দরজা নক করার শব্দ। আর দরজার ওপার থেকে আবার রমাদেবীর গলা, “কী হল রে খোকা? খাবি না নাকি? কখন থেকে খাবার বেড়ে বসে আছি?”

মা ও ছেলে দু’জনে দু’জনের হাত শক্ত করে ধরল।

দরজায় ধাক্কা আরও জোরালো হচ্ছে।

“কী রে? দরজা খোল।”

তমাল ফিসফিস করে ভীত স্বরে মাকে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু এই খেলাতে তো বাবা নেই। আমাদের খুঁজতে যে আসছে সে তো অন্য কেউ। আমি নিজের চোখে তাকে দেখেছি। খুবই ভয়ানক সে।”

মা নিজেও প্রবল আতঙ্কিত। কিন্তু তার মধ্যেও ছেলেকে ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করলেন, “না না, আছে, বাবা আছে। ভাব ওই ভয়ঙ্কর কিছুটা আর কেউ নয়, তোর বাবা। ভাবতে থাক, চিন্তা কর, দেখবি তাই হয়ে যাবে। ভাব ভাব।”

দরজায় ধাক্কা আরও জোরালো হচ্ছে। আর গলার আওয়াজটাও যেন আরও মোটা হচ্ছে। “দরজা খোল। খোল বলছি।” কেমন যেন পুরুষ আর মহিলার গলার মেশানো স্বর হয়ে উঠছে সেটা।

রমাদেবী প্রায় তমালের কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলে উঠলেন, “হাল ছাড়িস না খোকা। ভাব। আমরা যা দেখি, যা শুনি, সবই আসলে আমাদের মনের খেলা। আমাদের চেতনা আমাদের যা অনুভব করায়, আমরা তাই অনুভব করি, আমাদের মাথার মধ্যে। তাই না? আর তোর কল্পনাশক্তি ছোটবেলা থেকেই অসাধারণ। আমি তার প্রমাণও পেয়েছি কয়েকবার। তুই অনেক কিছুই ভাবতিস, অনেক চরিত্র কল্পনা করতিস, যাদের মধ্যে কিছু আমিও দেখতে পেয়েছি বেশ কয়েকবার। কখনও ছায়া ছায়া, কখনও আসলের মতো, ঠিক যেন সত্যি মানুষ। কিন্তু তোর বাবা এসব ব্যাপার স্যাপার পছন্দ করত না একেবারেই। তাই কাউকে বলিনি ভয়ে। তোকেও না। কেউ বিশ্বাসও করত না বললে। কিন্তু তুই চেষ্টা কর। পারবি দ্যাখ। এসবই তোর কল্পনা। তুই যা ভাববি তাই সত্যি হবে শেষ পর্যন্ত। দেখিস।”

“কী শুরু করেছিস কী? বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু।” বাইরের গলার স্বরটা ক্রমশ যেন পুরুষ কণ্ঠে পরিবর্তিত হয়ে উঠছে।

“ভাবতে থাক খোকা, ভাবতে থাক।” মায়ের হাতটা তমালের হাতের ওপর আরও জোরে চেপে বসেছে। তমাল চোখ বন্ধ করে প্রাণপণে ভাবার চেষ্টা করছে। হ্যাঁ, হচ্ছে। গলার স্বরটা বদলাতে বদলাতে এখন পুরোপুরি পুরুষ কণ্ঠে পরিণত হয়ে উঠেছে।

“খোল। দরজা খোল বলছি।” কোনও সন্দেহ নেই। দরজার ওপার থেকে যে গলাটা ভেসে আসছে তা এখন একটা পুরুষ কণ্ঠ। আর তা তার বাবার। দরজার ওপর ধাক্কাটা আরও জোরদার হচ্ছে। ধুম ধুম ধুম ধুম। মনে হচ্ছে যেন দরজা ভেঙে পড়বে।

তমালের প্রচণ্ড মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। চারিদিকের এত আওয়াজ আর সে নিতে পারছে না। প্রত্যেকটা আওয়াজই ক্রমাগত আরও জোরালো হয়ে মস্তিষ্কে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। “দরজা খোল!”, “ভাবতে থাক।”, “ধুম ধুম ধুম!”, “খোল দরজা!”, “ধুম ধুম ধুম!”, “চিন্তা করতে থাক।”, “ধুম ধুম ধুম ধুম!”, “খোল বলছি”, “ভাব ভাব!”, “ধুম ধুম ধুম ধুম ধুম ধুম ধুম!”

তমাল জ্ঞান হারাল।

ছোট্ট একটা ঘর। তার মধ্যে ছোট্ট বিছানা একটা । ঘরটা যেন দুলছে। দুটো গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে খুব আস্তে আস্তে। একটা কথোপকথন। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে কথাগুলো। দু’জন মানুষ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। আলোচনাটা তাকে নিয়েই। কিন্তু ঘরটা শুধু দুলছেই না, এগিয়েও চলেছে মনে হচ্ছে। তমাল খুব কষ্টে চোখদুটো খুলল অর্ধেক।

ওহ! এটা একটা অ্যাম্বুলেন্স। সে শুয়ে আছে বেডে। তার পাশে দু’জন বসে কথা বলছেন। তাদের একজন তমালের বাবা। আরেকজন যে ডাক্তারবাবু, তা তার পোশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

ডাক্তারবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা, তাহলে এরকম মাঝেমধ্যেই হয়?”

—“হ্যাঁ। অল্পবিস্তর। তবে এবারের মতো এতটা বাড়াবাড়ি আগে হয়নি।”

—“আগে কীরকম হত?”

—“আগে? এই ধরুন, মাঝে মাঝে নিজের মনেই কথা বলে উঠত। মানে ঠিক যেন ওর মা’র সঙ্গে জমিয়ে গল্প করছে ও – এরকম একটা কল্পনা।”

—“ওর মা কতদিন হল মারা গেছেন?”

—“তা প্রায় একবছরের ওপর হয়ে গেছে। তারপর থেকেই এরকম শুরু হয়েছে। তবে আজকের মতো এতটা বাড়াবাড়ি আগে হয়নি। একেবারে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘর অন্ধকার করে খাটের নীচে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল! তাও আবার আমাকে ভয় পেয়ে! ভাবুন একবার। আমি কতক্ষণ ধরে ডাকছিলাম, দরজাতেও টোকা দিচ্ছিলাম খেতে আসার জন্য। কিন্তু কোনও উত্তর পাওয়া যাচ্ছিল না। অথচ ঘরের মধ্যে ও কিন্তু কারও সঙ্গে, মানে নিজের মা’র সঙ্গেই যেন কথা বলছিল। শেষে অনেক কষ্টে লাথিঘুষি কষিয়ে কোনওভাবে দরজাটা ভাঙলাম। নেহাত ভেতরের ঘরের দরজা বলে তেমন শক্তপোক্ত ভাবে বানানো হয়নি। নাহলে যে কী হত!”

—“চিন্তা নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে।” ডাক্তারবাবু আশ্বাস দিলেন, “আসলে ও ওর কল্পনার অলীক জগৎ নিয়ে থাকতেই বেশি ভালোবাসে। এরকম অনেক কেসই আছে। অনেকেই সুস্থ হয়ে নর্ম্যাল লাইফে ফিরে এসেছে আবার।”

—“ওর মায়েরও এরকম কিছুটা ছিল, জানেন? যদিও এতটা বেশি নয়। কিন্তু সেজন্যই তমালও ওর মায়ের কাছে এটা নিয়ে কিছুটা প্রশ্রয় পেত। তাই ওর মাকেই ও বেশি ভালোবাসত। আমি ওর কাছে কখনোই খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ছিলাম না। এমনকী এখনও না। ওর মায়ের অভাব পূরণ করার জন্য গত একবছর ধরে কত কীই না করেছি। কিন্তু ছবিটা বিশেষ বদলায়নি। মারা যাওয়ার এতদিন পরেও ওর মা-ই ওর কাছে সব।”

—“ভাববেন না। ঠিকঠাক চিকিৎসা হলেই দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। ওর কল্পনাটাকে আসলে ও বাস্তব ভাবে। ভাবতে ভালোবাসে, ভেবে আনন্দ পায়। কিন্তু আসলে যে তা কল্পনা, তা বুঝতে শুরু করলেই ও বাস্তব আর কল্পনার মধ্যে পার্থক্যটা ধরতে পারবে। বাস্তবের অনেক কিছু যে ওর কল্পনার থেকেও ইন্টারেস্টিং, তা বুঝতে শুরু করলেই ও ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠবে। ট্রিটমেন্ট শুরু হোক, তাহলেই ইম্প্রুভমেন্ট দেখতে পাবেন।” ডাক্তারবাবু আবারও আশ্বস্ত করলেন।

নতুন এক চিন্তার জন্ম হচ্ছে তমালের মস্তিষ্কে। আবার তার মনে সঞ্চার হচ্ছে প্রবল উত্তেজনার। তাহলে তার মধ্যে সত্যিই কি সেই অলৌকিক ক্ষমতা আছে, যেমনটা তার মা বলছিলেন? না কি তা জন্ম নিচ্ছে সবে? সে কোথায় যেন পড়েছিল যে কিছুকিছু মানুষের কল্পনাশক্তি এতই তীব্র হয় যে শুধু তারা নয়, তাদের আশেপাশের লোকজনও তাদের কল্পনাকে চাক্ষুষ দেখতে পায়। সত্যিই হবে হয়তো। নাহলে ডাক্তারবাবু তার বাবার সঙ্গে কথা বলছেন কীভাবে? বাস্তবে তো তা সম্ভব নয়। কারণ একটা পথ দুর্ঘটনায় তমালের বাবা ও মা মারা গেছেন একইসঙ্গে। ঘটনাটা ঘটেছিল গত বছর। তাই এই কথোপকথন অলৌকিক কোনও শক্তির প্রভাবে ছাড়া অসম্ভব।

না কি সত্যিই আবার তার বাবা-মা ফিরে ফিরে আসছেন বারবার, তমালের জন্য, তমালেরই টানে? কে তমালের বেশি কাছের মানুষ হয়ে উঠতে পারবেন, তার একটা প্রতিযোগিতা এখনও হয়তো তাদের মধ্যে চলছে, যেমন হত আগেও। কোন তত্ত্বটা বেশি যুক্তিগ্রাহ্য কে জানে!

তমালের চিন্তা জট পাকাচ্ছে। আবার সে জ্ঞান হারাচ্ছে। অর্ধজাগ্রত অবস্থা থেকে অন্ধকার অচৈতন্যের জগতে তলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

***

মৃণাল নন্দী

জন্মসূত্রে বাঁকুড়ার মানুষ, কর্মসূত্রে আপাতত কলকাতার বাসিন্দা। ইচ্ছে থাকলেও পড়াশোনার চাপে ও কেরিয়ার গড়ার লক্ষ্যে খুব বেশি লেখালেখি করতে পারেননি। তবে সময় পেলে যথাসম্ভব লেখার চেষ্টা করেন। মূলত অলৌকিক, কল্পবিজ্ঞান, রোমাঞ্চ ও সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার লিখতেই বেশি পছন্দ করেন, আর ভালোবাসেন রম্যরচনা লিখতে। ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কয়েকটি গল্প ও রচনা।

অধ্যায় ২০ / ২০

সকল অধ্যায়

১. নোলা – স্নেহা আদক
২. তাপ্পর… – ডঃ সাম্য মণ্ডল
৩. কালচক্র – দেবলীনা বিশ্বাস
৪. রসের খোঁজে – অঙ্কন মুখোপাধ্যায়
৫. রক্তপিপাসু – মোনালিসা সাহা দে
৬. ফেরা – দেবদুলাল কুণ্ডু
৭. ঘড়ি – কেয়া চ্যাটার্জী
৮. স্বর্গাদপি – অলোকেশ ভট্টাচার্য্য
৯. আলিঙ্গন – রিয়া মিত্র
১০. খেলাঘর – প্রীতম গুহ
১১. সেই রাতে – নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী
১২. ছবি – মধুমিতা মুখার্জী
১৩. মুখোশ – শঙ্কর চ্যাটার্জী
১৪. ঋণশোধ – সৌমী গুপ্ত
১৫. সহযাত্রী – উস্রি দে
১৬. রিসর্টে এক রাত – অমিতাভ সাহা
১৭. জীবন্ত কথা – মহুয়া সমাদ্দার
১৮. অন্ধকারের জীব – রিয়া ভট্টাচার্য
১৯. রক্তে রাঙা রুদ্রাক্ষ – মঞ্জিলা চক্রবর্তী
২০. ভিত্তিহীন – মৃণাল নন্দী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন