সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
আমার মৃত্যুর দিনে কৌতূহলী প্রশ্ন করে যদি—
সাধিলাম কী সুকৃতি, হব যার প্রসাদে অমর?
মেনে নিও মুক্ত কণ্ঠে, নেই মোর পাপের অবধি;
সারা ইতিহাস খুঁজে মিলিবে না হেন স্বার্থপর।।
অজস্র ঐশ্বর্য মোরে অর্পিয়াছে সমুদার বিধি;
ভুঞ্জেছি নিঙ্কুণ্ঠ মনে সে-সকলই প্রাপ্য ভেবে আমি।
পেয়েছি অমিত সুধা আমন্থিয়া কালের বারিধি;
করেছি তা আত্মসাৎ, শুধু বিষ কণ্ঠে গেছে থামি।।
দেখেছি এ-মরচক্ষে নটরাজ মহাশূন্যে নাচে;
শুনেছি পার্থিব কানে সে-নক্ষত্রনূপুরের ধ্বনি।
তথাপি আমার বীণা বাজায়েছে বেসুর পিশাচে;
অধরার অনুনাদে সাড়া কভু দেয়নি ধমনী॥
ফাল্গুন অঙ্গনে মোর ছড়ায়েছে অশোক পলাশ।
দক্ষিণের বাতায়নে কৃষ্ণচূড়া হেনেছে বৈশাখ।
জাগায়ে মেদুর মেঘে চপলার চকিত বিলাস
বিকচ কদম্বকুরে আষাঢ় দিয়েছে মোরে ডাক।।
শেফালীরঞ্জিত হস্তে নবান্নের নৈবেদ্য এনেছে
অতিক্রমি কাশবন সিতাম্বর শ্যামল আশ্বিন।
কাননে ছড়ায়ে সোনা উদাসী অঘ্রান চ’লে গেছে।
পৌষের পাথেয় দিতে সর্বহারা হয়েছে বিপিন।।
তথাপি অভাব মোর মিটে নাই মুহূর্তের তরে;
অপব্যয়ী প্রকৃতির অরক্ষিত দানসত্র হতে
অপহরি মহাবিত্ত আনিয়াছি বৎসরে বৎসরে
অন্তর্ভৌম কোষাগারে মরুলুপ্ত সুড়ঙ্গের পথে।।
সে-উদার দৃষ্টান্তেও হয় নাই কার্পণ্য লজ্জিত,
সন্দেহের অবকাশ পায় নাই গৃধুতা আমার।
ফিরেছি ধনীর দ্বারে অপলাপী চীবরে সজ্জিত,
বলেছি নাটকী স্বরে, বিশ্বে শুধু সত্য অবিচার।।
অন্তরঙ্গ সখাসম ফুলধনু আমার ইঙ্গিতে
ফুটায়েছে পারিজাত হিমরুক্ষ তুঙ্গ তপোবনে;
স্বয়ংবরা শৈলসুতা এসেছে কৌমার্য নিবেদিতে;
টুটেছে দুঃস্বপ্ন মোর ব্রহ্মাণ্ডের মঙ্গলাচরণে।।
তবু মোর নীল কণ্ঠে উঠে নাই কামোদ ঝংকারি;
অনভ্যস্ত রসনায় উৎসরিত হয়নি দীপক।
মোর প্রিয়সম্ভাষণে বিরহের আশঙ্কা সঞ্চারি,
অন্তরের দ্বার জুড়ে হেসেছে অশ্লীল বিদূষক।।
গোপন বৈভব আমি ব্যক্ত কভু করিনি প্রিয়ারে;
বুঝি নাই বিনিময়, বিনা বরে কুড়ায়েছি পূজা;
অভিব্যাপ্ত ক্ষুধা মম অবরোধে ঘিরেছে তাহারে;
পরিতৃপ্তি বিতরিতে পারেনি স্বয়ং দশভুজা।।
নিমেষ না যেতে তাই ফুরায়েছে প্রথম আবেশ।
উন্মীলিত বিলোচন জ্বলিয়াছে বিপ্রলব্ধ লোভে,
অচিরাৎ সে-আগুন কামেরে করেছে ভস্মশেষ;
অপর্ণা সেজেছে চণ্ডী আত্মহিতে মোর উপদ্রবে।।
কেবলই চেয়েছি আমি, ক্ষতি কভু ছোঁয়নি আমারে;
কোনওদিন বজ্রাঘাতে সর্বস্বান্ত করেনি উর্বশী;
মোর তারাদীপাবলী মূলাধার অমার ফুৎকারে
কখনও যায়নি নিবে, ধ্বংসমূক হয়নি ক্রন্দসী।।
শিখিনি কদাচ আমি কাম্য যার নিশ্চিন্ত অমরা,
অনির্বাণ কুম্ভীপাকে হতে হয় তাহারে নিখাদ।
শুধুই জঞ্জালে তাই ভরিয়াছি প্রাণের পসরা;
গায়ত্রী জপেছি, কিন্তু শোনা গেছে নিরর্থ নিনাদ।।
আমার মৃত্যুর দিনে তাই যদি অলস জিজ্ঞাসু
মাগে শবপরিচিতি, বিনা ভাষ্যে বোলো তারে, সখা,–
জগতের কোনও কাজে লাগেনি এ-অখ্যাত গতাসু,
যায়নি অনাথ ক’রে কোনও মৌন হৃদয়-অলকা।।
২৩ জুন ১৯৩৩
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন