সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
মিলের ধোঁওয়ার ঢাকা শরতের নীল নভস্তল,
নগরের আবর্জনা জাহ্নবীর পুণ্য স্রোতে ঘুরে।
ছুটি-পাওয়া মসিজীবী দল বেঁধে করে কোলাহল,
পরিক্ষিপ্ত পরচর্চা বিষায়িছে বিমুক্ত বায়ুরে।।
তুমি আর আমি দোঁহে ব’সে আছি স্টীমারের কোণে
অপ্রতিভ, অপাক্তেয়, অনাহূত অতিথির মতো।
জানি না কী ভাব জাগে তব মৌন চিত্তের গহনে;
ভিড়ের সংসর্গ মোরে করে সদা নৈঃসঙ্গ্যব্ৰিত।।
তাই ধায় স্মৃতি মোর অতীতের নিরিন্দ্রিয় লোকে,
ছায়াতরীবিমন্বিত, মরুমুখী প্রেতনদীপানে,
নির্বাক বৈদেহী এক মেঘাচ্ছন্ন চন্দ্রের আলোকে
সাযুজ্যের মূলমন্ত্রে দীক্ষা দিল আমারে যেখানে।।
সে-নিগম সাধনায় হয়তো বা ঘটেছিল ত্রুটি;
মিলে নাই মোক্ষ, শুধু ছিঁড়ে গেছে জীবনের ডোর।
সেই থেকে বেঁচে আছি মরণের গৈবী পায়ে লুটি;
আমারে ডরায় লোকে, জনসংঘ বিভীষিকা মোর।।
তবু বিশ্বমানবের একমাত্র সত্য ব’লে জানি;
অতিমর্ত্য তারই স্বপ্ন, বিশ্বপতি কল্পপুত্র তার।
সভ্যতার রক্তলিপ্সা হয়ে গেছে আজ কানাকানি;
আদর্শের দৈববাণী প্রতিধ্বনি প্রবৃত্তিগুহার।
তাই মানুষের দিকে বারংবার মেলে দিই হাত;
আবশ্যিক বিসংবাদে বারংবার হই পণ্ডশ্রম।
জানি নেই অন্য গতি; তথাপি সে-আহ্নিক আঘাত
সঞ্চারে উৎসাহে দ্বিধা, নিরুৎসুব্ধ হয় উপক্রম।।
কিন্তু কেন নাহি জানি এ-কুৎসিত, বৈরী প্রতিবেশে
তোমার সান্নিধ্যে ব’লে নৈর্ব্যক্তিক আলাপের মাঝে
অকস্মাৎ মনে হয় পৌত্তলিক, রিক্ত নিরুদ্দেশে
আমার অজ্ঞাতবাস ফুরায়িল আজিকার সাঁঝে।।
অথচ বলিনি কিছু, বলিবার কিছুই যে নাই;
নাটকীয় মর্মবাণী করি নাই মোরা বিনিময়;
আকর্ষি কালের ব্যঙ্গ জানাইনি পণের বড়াই;
নয়নে নয়নে চাহি চারি চক্ষে জাগেনি বিস্ময়।
হয়তো বা তাই তুমি বহিরঙ্গ দৈন্য মম দেখে
অস্বীকার করিবে না মোর গুপ্ত মৌল আমিটিরে;
চিনিবে সে-চিরঞ্জীবে, মরণের অন্তরালে থেকে
যে নমিবে জন্মক্রমে যুগে যুগে নিত্য পৃথিবীরে॥
চিনিবে সে-আশুতোষে, এইমতো তূর্ণ সন্ধিক্ষণ
যার কাছে শ্রেয়ঙ্কর আত্মনিষ্ঠ অনন্তের চেয়ে,
ধন্য হয়ে যায় যার অফুরন্ত বিচ্ছিন্ন জীবন
বিরল অমৃত যোগে সদ্ভাবের প্রতিভাস পেয়ে।।
সম্ভবত এ-ও ভ্রান্তি, মায়াময় তুমিও বুঝি বা,
হয়তো যাহারে দেখো, সে-ও নয় ছায়ার অধিক;
তবু, যদি সত্য হও, মনে রেখো আজিকার দিবা
তোমারে করিল, বন্ধু, অন্তর্যামী প্রাণের প্রতীক।।
৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৩
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন