সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
মেঘার্ত পাণ্ডুর শশী; শঙ্কাকুল শ্রাবণশর্বরী;
নির্নিগড় বিভীষিকা বিচরিছে গগনে গগনে;
ব্যোমের পরিধি-’পরে ভ্রমিতেছে, শুনি, ক্ষণে ক্ষণে
জাগর নক্ষত্রদল, বৃত্তবদ্ধ কালের প্রহরী।।
অতীত বৃষ্টির বিন্দু পুষ্পের কৃপণ মুষ্টি হতে
ঝরে শ্লথ পত্র-’পরে থেকে থেকে আপনা-আপনি;
নিদ্রাতুর নীরবতা আচম্বিতে চমকি অমনই
রহস্যের ঘটাটোপ কীর্ণ করে প্রপন্ন জগতে।।
নিস্পন্দ নিরিক্ত কুঞ্জ; পরিত্যাক্ত অচ্ছোদ সরসী;
হৃতস্পর্ধা বনস্পতি পুঞ্জীভূত আতঙ্কে গম্ভীর;
সম্ভ্রান্ত বিহঙ্গবৃন্দ অপ্রতিভ, অবনতশির,
প্রহরের জপমালা আবর্তিছে স্তব্ধ শাখে বসি।।
মুখর কলহালাপ, কুহরণ, কূজন, কাকলী
কখন হয়েছে মূক; মণিকণ্ঠী, চন্দনা, ভারতী,
দোয়েল, পাপিয়া, শ্যামা, কলবিঙ্ক, কঞ্জল, কপোতী
দুর্দান্ত দুঃস্বপ্নে কাঁপে আশ্রয়ের দুয়ার আগলি ॥
বউ-কথা-কও কোথা দুরারোহ, তমিস্র তমালে
সভয়ে সংবরি আছে উচ্ছৃঙ্খল দ্বিস্বরা দীপক।।
সুদূর পারস্যে বুঝি বিরহী বুলবুল পলাতক
ফুটাতে সংরক্ত রাগ সোহাগিনী গোলাপের গালে।।
ডাহুকী, সারসী, ক্রৌঞ্চ, চক্রবাক, কাদম্ব, কুলাল
নির্বিঘ্ন তিব্বতপানে নিরুদ্দেশ আসন্ন দুর্দিনে।
চক্রধর চর্মচটী লুক্কায়িত দুশ্চর বিপিনে
প্রেতসঞ্চরিত কক্ষে চিত্রার্পিত সারিকা বাচাল।
সংগীতের দিগ্বিজয়ে লব্ধকীর্তি শকুন্ত কুলীন,
কাংস্যক্রেংকারিত শিখী, বাগ্মী শুক, অনুলাপী পিক
আলোড়িত কলরবে মন্থিছে না সুপ্তিশান্ত দিক।
উদ্বিগ্ন, নির্বাত, খিন্ন রুদ্ধস্রোত কালের পুলিন।।
শূন্যগর্ভ নভস্তল অকস্মাৎ অনুনাদে ভরি
তরঙ্গিল সারা বিশ্বে, হে কুক্কুট, তোমার মাভৈ;
আশার অলকানন্দা বহায়িলে, অশুচি বিজয়ী;
বাঙ্ময় উদ্ধার এল, প্রেতমুক্ত হল বিভাবরী।।
সে-জয়গাথায় মাতি মোর শঙ্কাস্তম্ভিত রুধির
দ্রুত-বিলম্বিত নৃত্য আরম্ভিল চমকিত হৃদে;
অহৈতুক কৃতজ্ঞতা গুঞ্জরিল, বাণী দে, বাণী দে;
রোমাঞ্চিত ধন্যতায় মুগ্ধ হল উদ্দীপ্ত শরীর।।
দেখেছি, পতিত, তব অতিমর্ত্য বিরাট মূরতি
অসংস্কৃত অন্ত্যজের চমৎকৃত, তীব্র পরিচয়ে।
রুচিগ্রস্ত সিদ্ধ কবি শুদ্ধ থাক আভিজাত্য ল’য়ে;
তুমি ধরো, হে অস্পৃশ্য, অখ্যাতের সহজ প্রণতি।।
৭ ভাদ্র ১৩৩৫
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন