সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
পারায়ে প্রিয়ার দ্বার দেখিলাম ঊর্ধ্বমুখে চাহি—
শীর্ণকায় শুক্ল শশী অগাধ তিমিরে অবগাহি,
ফিরে গেছে বহুক্ষণ আপনার অখ্যাত আবাসে
অতিক্রমি চক্রবাল; গুপ্তগতি কালস্রোতে ভাসে
বেপমান তারাদল বেগজাত বুদ্বুদের প্রায়;
মাঝে মাঝে মজ্জমান মুহূর্তের বিক্ষোভ জানায়
আবর্তিত নীহারিকা; নিরুদ্দেশ কোন্ লোক হতে
কাহার সোনার তরী অজানার অদৃশ্য সৈকতে
নিঃশব্দে গিয়েছে চ’লে প্রস্ফুরিত ছায়াপথ এঁকে
রজতক্ষেপণীস্পর্শে; ধরণীরে সুখসুপ্ত দেখে
যেন কোন্ চিরচোর অরক্ষিত মহাবিত্ত তার
হয়েছে অন্দরে প’শে; নিদারুণ সেই দস্যুতার
সাক্ষী নেই জনপ্রাণী, শুধু ওই বৃদ্ধ বনস্পতি
মুহুর্মুহুঃ জটা নেড়ে ব্যক্ত করে কী নিষ্ঠুর ক্ষতি
দুর্মর শৈশবসখা বিকলাঙ্গ বায়ুর নিকটে॥
জানি না প্রাকৃত ভাষা, তাই যবে মোর কৰ্ণপটে
ক্ষণে ক্ষণে হানা দেয় অন্তরঙ্গ সেই গুঞ্জরণ,
মিলে না বুদ্ধির সাড়া, শুধু মোর নিগূঢ় চেতন
ভরে ওঠে অকস্মাৎ নিরুপাধি কিসের বিলাপে;
জাতিস্মর জৈব কণা মর্মে মর্মে থরথর কাঁপে
অব্যক্তির যন্ত্রণায়; শোকাবহ কোন্ ইতিহাস
উন্মথিত করি তোলে কবেকার রুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস
দুষ্প্রবেশ বিস্মৃতির প্রতিধ্বনি প্রহত গহ্বরে।।
আচম্বিতে চিত্ত মোর কী অমর্ত্য সংক্রামে শিহরে—
মনে হয় স্বার্থপর, অকিঞ্চন, উঞ্ছজীবী আমি,
আমার ইতর লোভে অমৃতবঞ্চিত অন্তর্যামী
বুভুক্ষায় মরে আজ; মনে হয় এ-ক্ষুধার পাশে
তুচ্ছ মোর চাওয়া-পাওয়া; বিচঞ্চল অসীম আকাশে
বিকীর্ণ যে-সর্বনাশ, তার মাঝে হারায় হঠাৎ
মোর উল্লাসের অর্থ; মূল্যহীন হয় অচিরাৎ
যে-দান অনতিপূর্বে সুদক্ষিণ প্রেয়সীর কাছে
পেয়েছি তপস্যাবলে; ভয় পাই নেহারিতে পাছে;
মনে হয় চাহি যদি দীপান্বিত বাতায়নপানে,
তারে দেখিব না সেথা, নিরখিব নির্বোধ নয়ানে
ক্ষণপ্রাণ প্রজাপতি ম্রিয়মাণ প্রদীপেরে ঘিরে
ঘুরে যেন মর্ত্যনাচে।।
নাস্তিগর্ভ প্রাক্তন তিমিরে
আমার স্বতন্ত্র সত্তা হতে থাকে ক্রমাগত ক্ষয়;
ফুরায় ইন্দ্রিয়বোধ; মূক হয় বাচাল হৃদয়;
শুধু শ্রুতি জেগে রহে। মহামৌনে শুনি অকস্মাৎ
বিনষ্ট বিশ্বের প্রান্তে কোথা যেন কালের প্রপাত
উল্বণ রভসে নামে অনন্তের উদ্র অতলে।
কণিকাও নহি আমি; চরাচর লুপ্ত সে-কল্লোলে।।
১৫ জুলাই ১৯৩৩
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন