সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
(শ্রী বসন্তকুমার মল্লিকের করকমলে)
দেশে দেশান্তরে
উদ্দীপ্ত যৌবনখানি অপচয় ক’রে
এসেছে মুমূর্ষু দিবা লুপ্তকীর্তি নর্তকীর প্রায়
অক্ষম জরার লজ্জা লুকাতে হেথায়,
জগতের এ-অখ্যাত কোণে॥
মোর মনে
হয়তো বা শান্তি নেই তাই।
তাই বুঝি বোধ হয় নিতান্ত বৃথাই
অন্ধকার বন্ধ ঘরে শ্বাস টেনে বাঁচা কোনও মতে;
উন্মার্গ হয়েছে নদী, বর্জিত এ-শ্মশানসৈকতের
নির্বিকার ঊষরতা শুধু;
যতদূর দৃষ্টি যায় করে ধূ ধূ
ভ্রাম্যমাণ পিঞ্জরের দুর্লঙ্ঘ্য প্রসার
নিঃসঙ্গ, নির্বাক, নিরাকার।
মনে হয়
শুনি যেন অহোরাত্র প্রতিধ্বনিময়
আত্মাপুরুষের কান্না নীরবের ফাটলে ফাটলে;
কি জানি কে বলে—
“খোলো, খোলো অলক্ষ্য দুয়ার,
হয়ে গেছে পার,
সহনীয়তার সীমা পার হয়ে গেছে বহুক্ষণ;
অস্থাবর মুক্তির লগন
সূর্যাস্তের স্বর্ণসম ভস্ম হবে চোখের নিমেষে।”
তাই মোর দার্শনিক বন্ধু যবে এসে
জ্ঞানসুগম্ভীর কণ্ঠে আরম্ভিল তত্ত্ববিশ্লেষণ,
হল না তো তখনও বচন
অভ্যস্ত সখ্যের সেতু মোদের বিজন ব্যবধানে।।
সে কহিল—“মরুগ্রস্ত, ক্ষুব্ধ প্রেতস্থানে
হানি তীক্ষ্ণ মর্মক্ষত উর্বরতা আনে হলধর।
অমৃতের পুত্র মোরা; জন্ম-জন্মান্তর,
নন্দনের প্রতিশ্রুতি বুকে,
অভুঞ্জিত ভূমিসম প’ড়ে আছে মোদের সম্মুখে।
আজিকার ক্লেশ,
এ-বিরোধ, বিসংবাদ, এই নিরুদ্দেশ,
এ-সকলই পরীক্ষা কেবল।
উন্মথি সুখের স্মৃতি সর্বনাশা যেই হলাহল
সৃষ্টি করে সুরাসুরে জীবনের প্রতি সন্ধিক্ষণে,
ত্রিভুবনে
সে-বিষের জ্বালা হতে নেই নেই কাহারও নিস্তার;
তারই পুরস্কার
অমোঘ সাযুজ্য, ঐক্য মৃত্যুঞ্জয় নীলকণ্ঠ-সাথে।
হয়তো বা হাতে হাতে
দক্ষিণান্ত হয় না মোদের;
জীবনের প্রসর্পণ হয়তো বা পথে বিকল্পের।
কিন্তু যার পরমায়ু অমেয়, অক্ষয়,
দুর্গ্রহের উপদ্রব তার কাছে নগণ্য কি নয়?
একাধিক শতাব্দীর বৈফল্য, নৈরাশ,
শাশ্বতের তুলনায় তাহা যেন সংক্ষিপ্ত নিঃশ্বাস
দ্রুতগামী সোপানারোহীর।
ভ্রমান্ধ যে, সে কেবল আতুর, অধীর,
অনন্তের প্রকৃতিরে কোনও মতে বুঝিতে না পেরে
পথকষ্টে মৃতপ্রায় কেন্দ্র খুঁজে ফেরে।
শুধু আস্থা আর সহিষ্ণুতা,
সৃষ্টির রহস্য মাত্র এই দুটি সনাতন কথা॥”
আরও কত ব’লে গেল সে যে।
মোর জীর্ণ সংস্কারের ছিন্ন তারে বেজে
সে-তর্কের অনুনাদ মুখরিল নিষ্ক্রিয় মস্তকে।
কিন্তু মোর স্মৃতিসিক্ত চোখে
ঘনীভূত প্রদোষের বিদেশী নীলিমা
এ-বাঙ্ময় প্রকোষ্ঠের ক্ষুদ্র চতুঃসীমা
অনায়াসে দিল লুপ্ত ক’রে।
শরীর রহিল হেথা, সপ্ত সিন্ধু পলকে সন্তরে’
আত্মা বেগবান
অচেনা নগরীচূড়ে সংগোপন করিল প্রয়াণ॥
যুগান্তে একদা-সেথা আমরা দু-জনে
কল্পনার স্তূপ দিয়ে গড়েছিনু প্রসন্ন গগনে
অসম্ভব দুরাশার উদ্ধত পাহাড়;
দুরারোহ নিরালায় তার
আকাশকুসুম তুলে পেতেছিনু ভাবী ফুলশেজ।
সে-দুর্ধর্ষ বিশ্বাসের নাক্ষত্রিক তেজ
নির্বাণ চন্দ্রের মতো মৃত্যুহিম আজিকে বিতরে;
বিশ্বব্যাপ্ত অভাবের অতল বিবরে
অন্তরিত সে-সম্ভ্রান্ত বিরহের দৃপ্ত সহিষ্ণুতা;
সে-দীপ্র বেদনা অনাহূতা
লাগে নাই আত্ম-পর কারও উপকারে;
শুধু আপনারে
করেছি একেলা, নিঃস্ব অপ্রতর পরিখার মাঝে।।
সেদিনও যে নিরুপাধি সাঁঝে
এমনই চৈনিক নীল রেখেছিল ঘিরি
অন্তরঙ্গ ঘটাটোপে অবিচল সে-মানসগিরি।
তাই জানি, ও-দিব্য বরণ
নহে শাশ্বতের কান্তি; ও যে প্রাবরণ
নিরাশ্বাস, নিরর্থ শূন্যের।
হে বন্ধু, তাইতে তব তত্ত্বদর্শনের
পরিক্ষিপ্ত যুক্তিজাল বাঁধিবারে পারে না আমায়।
যদিও বা ক্লান্ত বুদ্ধি মাঝে মাঝে তর্কে দেয় সায়,
তবু মোর উপজ্ঞা গভীর
জানে স্থির
অনন্ত, অমৃত তব মায়া, মিথ্যা মায়া।
সম্ভবত তার চেয়ে সত্য এই অতীতের ছায়া।।
১৪ জুন ১৯৩২
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন