সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
কাল রাতে
এ-সংকীর্ণ সংসারের নির্বোধ সংঘাতে
চীর্ণ, দীর্ণ হৃদয় আমার
মৃত্যুর ঘনান্ধকারে খুঁজেছিল নির্বাণ উদার
কণ্টকিত শয়নীয়ে শুয়ে।
তার পরে কি জানি কখন গেল ছুঁয়ে
স্বপ্নবহ মলয় আমাকে;
অনিদ্রার ফাঁকে
কখন পশিল চিত্তে মন্দারের অক্ষয় পরাগ;
ঊষর বিরাগ
কখন বিকৃত হল সর্বশেষ প্রপঞ্চের ফুলে॥
মনে হল জীবনের পঙ্কলিপ্সু মূলে
অভাব লেগেছে অকস্মাৎ;
মরণের বজ্রাঘাত
পরবশ শরীরের অন্ধকূপ হানি,
উপেক্ষি সত্তার মর্মবাণী
স্বয়ম্ভর চৈতন্যেরে উড়ায়ে করেছে উচ্ছৃঙ্খল।
কী আনন্দ! অমিতির অখণ্ড মণ্ডল
নিরুপাখ্য কী আনন্দে ভরা!
এ-চির স্রস্তরা
সন্তপ্ত হবে না কভু সঙ্গিনীর শ্লিষ্ট সহবাসে।
বিতরি উন্মাত্র সিদ্ধি পাশব উল্লাসে
বৃংহিত গণেশ হেথা মিটাবে না জনতার তৃষা।
নিরঞ্জন, নিত্য মহানিশা
হারাবে না পবিত্রতা নৈমিত্তিক ক্রিমির প্ররোহে।
গৃধ্রের কলহে
শূন্যের নির্গুণ শান্তি টুটিবে না কখনও কিছুতে।।
আচম্বিতে প্রতর্কের পিশাচী বিদ্যুতে
উদ্ভাসিল স্বপ্নলোক; সহস্রাক্ষ জিজ্ঞাসায় বেজে
শতচ্ছিদ্র রহস্যের স্বচ্ছ ঘটাটোপ
ঘুচে গেল মুহূর্তেকে; অন্তিম দুরাশা পেল লোপ।
কোথা সে-অনন্ত অমা? রাগরিক্ত সন্ধিলগ্ন এ যে,
অনিশ্চিত প্রত্যাশার মির্মিরে চঞ্চল,
উন্মুখর বিনির্মোক আত্মার মর্মরে।
পলে পলে, প্রহরে প্রহরে
পশে এ-অশেষ রন্ধ্রে অশরীরী মানুষের দল
শটিত স্পৃহার কণা কুড়ায়ে যতনে
অনুপূর্ব পিপীলিকাবৎ।
উৎক্ষিপ্ত বায়ুর দৌত্যে ভেসে আসে হেথা ক্ষণে ক্ষণে
যুগপৎ
অট্টহাসি, দীর্ঘশ্বাস, অশ্রুর শীকর।
গতাসুর অভিশাপ হেথা হতে বর্ষে নিরন্তর
নক্ষত্রের ঋষ্টিরূপে জীব্রঘন ধরিত্রীর শিরে।।
এই অরাজক রাষ্ট্রে ধর্মরাজ ফিরে
জনশ্রুত স্বৈরিতার অপ্রচল প্রকীর্তি আস্ফালি
জরাগ্রস্ত অধিকর্মাসম।
করতালি
নিষ্ঠুর, নির্মম,
বাজে তার চতুর্দিকে। অজর, অমর আত্মা যত
বৃদ্ধ শার্দূলের পাছে তরঙ্কুর মতো
ব্যক্ত ব্যর্থতারে তার ব্যঙ্গ করে বাচাল চিৎকারে।
বহু ব্যবহারে
ক্ষয়িষ্ণু আজিকে তার তৃণ;
ভয়াল মৃগয়া তাই শব্দভেদী সায়কে দারুণ
সঞ্চারে না আর
আকস্মিক দুর্দৈবের সম্ভ্রান্ত সংহার
নিশ্চিন্ত অন্ধের বক্ষে, তরুণের নিঃশঙ্ক প্রমোদে।
শ্ৰান্ত পদে
আবর্জনাবাহকের প্রায়
অখ্যাত দিনের শেষে অলক্ষ্যে সে আসে আর যায়
প্রাণের উদ্বৃত্ত ক্লেদ আহরিতে চুপে
জনাকীর্ণ পথপার্শ্ব হতে।।
মৃত্যুর সৈকতে
মহত্ত্ব কল্পনামাত্র। বল্মীকের সাম্যময় স্তূপে
নির্লিপ্তি, নির্বাণ, শান্তি কেবলই স্বপন।
প্রেতগণ
জটলা পাকায় হেথা বৈতরণীতীরে;
জন্মান্তরের খেয়া ঘাটে ভিড়ে;
পরপারে কপিসেনা করে সেতুবন্ধের সূচনা।।
রব না, রব না
লুব্ধ, ক্ষুব্ধ বামনের এ-সমষ্টিবাদে।
তোমার প্রমাদে,
হে বসুধা, আবার ফিরায়ে লও মোরে।
হয়তো সেখানে আজও স্বতন্ত্রতা মিলে মাঝে মাঝে;
নগণ্যের অভীপ্সারে প্রতিহত ক’রে
এখনও দিগন্তে সেথা পরিচ্ছিন্ন হিমাদ্রি বিরাজে,
এখনও নিঃসঙ্গ অন্ধকার
সপ্তর্ষির আশীর্বাদে ধন্য হয় সেথা বারংবার;
আজও থাকি থাকি
দিগ্বিজয়ী শঙ্খে সিন্ধু তুরঙ্গমী সেনানীরে ডাকি
মানুষের প্রগল্ভতা ডুবায় চকিতে অভ্রংলিহ পরাক্রমে;
আজও ভ্রমে
বর্বর সিমূম সেথা সাহারা-গোবিতে;
সুমেরুর দুরাক্রম্য কূটে
রূপের শাশ্বত হাসি আজও ফুটে উঠে
অতিক্রমি সংকটের অহৈতুক ঘাত-প্রতিঘাত।
আজও তব অরণ্যে নির্বাত
নিভৃতে বিহরে যেথা নির্নিগড় শিবি,
সেথা মোরে স্থান দাও, হে পৃথিবী, পৃথুল পৃথিবী।।
২১ জুন ১৯৩১
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন