সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
নাথু-সংকটে হাঁকে তিব্বতী হাওয়া।
প্রাকৃত তিমিরে মগ্ন চুমলহরি।
ছঙ্গু-সায়রে কার বহিত্র বাওয়া
অপর্ণ বনে দিয়েছে রহস ভরি।।
সুহৃদ আগুন নিবে গেছে গৃহকোণে
শ্রান্ত সাথীরা স্বপনে আপনহারা;
আমি শুধু ব’সে তুষারিত বাতায়নে
প্রহরে প্রহরে গুণি খসে কত তারা।।
অঙ্গ তুহিন, তপ্ত আর্মার মাথা,
ক্লান্ত, তথাপি নিদ্রা আসে না ডাকে;
বাণীহীন কোন্ অনাদি বিষাদগাথা
গুঞ্জরে বিস্মরণের ফাঁকে ফাঁকে।।
হিমানীবিজন এই দুর্গম দেশে,
মনে হয় যেন, কে আমার অনুগামী;
হয়তো বা আমি ভুলে গেছি আজ কে সে,
কিন্তু ভোলেনি তারে অন্তর্যামী।।
বিগত জনমে, এই পর্বতশিরে,
এমনই নীরব প্রাগিতিহাসিক রাতে
শিকার সমাপি এসেছিনু ঘরে ফিরে
মৃগের বদলে তাহারে কি ল’য়ে সাথে?
মিনতি আমার প্রথমে ধরেনি কানে;
কুটিল ভ্রুকুটি মোছেনি ললাটে ত্বরা;
তার পরে কেন—তা কেবল সেই জানে-
অযাচিতে হল সহসা স্বয়ংবরা।।
চ্যুত বল্কলে নিবে গেল দীপখানি;
বাহিরের হিম মুকুরিল দ্রব চোখে;
হঠাৎ তাহার লঘু, ভাস্বর পাণি
খুঁজিল আমারে প্রাক্তন নিরালোকে।।
আবার কি তার আদিম নিমন্ত্রণী
আহ্বানে মোরে অমৃতের অভিসারে?
কাঁদে সেদিনের প্রণব প্ৰতিধ্বনি
প্রতন গিরির গহ্বরকারাগারে?
পুরাণপুরুষ ছাড়া পাবে নিমেষে কি?
মাটির মানুষ মিলিবে মাটির সনে।
বিদগ্ধ প্রাণী, এ কি মরীচিকা দেখি?
ফিরিব প্রভাতে পরিচিত পরিজনে।।
মৌল আকৃতি মরমেই যাবে ম’রে।
জনশূন্যতা সদা মোরে ঘিরে রবে।
সামান্যাদের সোহাগ খরিদ ক’রে
চিরন্তনীর অভাব মিটাতে হবে।।
বর্বর বায়ু চিরায়ু অচলচূড়ে
মুছে দিবে মোর অশুচি পায়ের রেখা।
মার্জিতরুচি জনপদে, বহু দূরে,
ভিড়ে মিশে আমি ভেসে যাব একা একা।।
৮ ফেব্রুআরি ১৯৩৩
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন