সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
বায়ুকোণের বাতায়নে ব’সে
তাকিয়ে আছি দিগন্তরে উদাস চক্ষু মেলে।
শূন্য মনে
ঘুরে বেড়ায় আকুল হয়ে ক্ষণিক খুশির খামখেয়ালী ছবি
শরৎসাঁঝের নকশাবহুল খণ্ডমেঘের মতো।
পিছলে পড়া খোলা কেতাবখানার
কয়েক পাতা দুমড়ে গিয়ে উলটো-পালটা চটিজুতোর পায়ে
হচ্ছে ধুলোয় মাখামাখি;
সামর্থ্য নেই কুড়িয়ে নিয়ে ঝাড়ার।
মাঝে মাঝে ভিতর-বাড়ি থেকে
যাচ্ছে শোনা ধমক-ধামক, গৃহস্থালির আওয়াজ ছোট-খাট।
ক্ষণে ক্ষণে উজান হাওয়া বেয়ে
বখেলোয়াড় ছেলের দলের বিজয়কোলাহল
আসছে ভেসে পোড়ো মাঠের থেকে।
সামনের ওই খাপরা-ছাওয়া বস্তিখানার চালে
ধোঁওয়ার কারিকুরি
বেখাপ্পা ঠিক তেমনিতর
যেমন, ধরো, তাপ্পি-দেওয়া ফোতোবাবুর কাঁধে
নিলেম থেকে দাঁওয়ে কেনা ঘরোওয়ানার আসল জামিওয়ার
শান্তি, নিভাঁজ শান্তি চতুর্দিকে।
অহর্নিশি-অসন্তুষ্ট শহরখানা যেন
প্রাণধারণের নিছক সুখে হাহুতাশে হঠাৎ উদাসীন।
সন্ধ্যাপরীর জাদুর ছোঁওয়াচ লেগে
এমন-কি সব আধি, ব্যাধি কিছু ক্ষণের জন্যে ঝিময় আজ।।
জানি জানি মুহূর্তেকেই জাগবে কলিকাতা;
চলবে চাকার ঘড়ঘড়ানি, পথে পথে জ্বলবে গ্যাসের আলো,
দোকান-পাটে আবার শুরু হবে
দর-করা আর চেঁচামেচি, গলি-ঘুঁজির ধারে
খড়ি-মাখা বেশ্যারা ফের কাষ্ঠ হেসে থাকবে পেতে ওৎ
ছাত্র, মাতাল, মজুর, কুলির আশায়,
ভিক্ষা মেগে মেগে
ফিরবে আবার ঠক, জুয়াচোর, কানা, খোঁড়া, কুষ্ঠরোগীর দল।।
নিমেষ পরে
আমার মনেও অধৈর্য ফের আসবে ফিরে, জানি,
আরোগ্যহীন রোগের বিষে ছটফটিয়ে উঠবে আবার দেহ,
এই নিরালা স্বপ্নমগন ঘর
লাগবে অন্ধকূপের সমান, ঘরকরনার খুঁটিনাটি
জগদ্দলের মতো
বসবে চেপে বুকের উপর, মনে হবে শ্বাসচলাচল দায়।
মৃত্যুকে ফের অচল ভেবে, জানি,
দেব আবার তাড়া, তাগিদ, ত্রাহি-স্বরে করব ডাকাডাকি।।
কিন্তু তবু এই গোধূলিবেলায়,
বহুরূপী রঙের খেলা চোখের আগায় চলছে যত ক্ষণ,
সাঁচ্চা কেবল হালকা হাওয়া বক্ষে পুঁজি করা,
নেহাৎ মেকী দুর্ভাবনাগুলো।
রাত্রে যেমন উধাও নদীর স্রোতে
আঁধার-ছাওয়া নাওয়ের বাতি হেথায় হোথায় ঝকমকিয়ে উঠে
নিরুদ্দেশে হয় পলকে লোপ,
তেমনি ফাঁকি কান্না, হাসি, সাধ্য ও সাধ, আকাঙ্ক্ষা, নৈরাশ,
চাওয়া, পাওয়া, সিদ্ধি, প্রবঞ্চনা।।
সত্য কেবল বাঁচা, কেবল বাঁচা,
সত্য কেবল পশুর মতো মনের বালাই ঝেড়ে ফেলা বাঁচা,
বাঁচা, কেবল বাঁচা।।
৪ জুলাই ১৯৩২
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন