সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
অন্ধকারে নাহি মিলে দিশা।
দীর্ঘায়িত নিশা
বয়ঃস্ফীত বারাঙ্গনাপারা
দুর্গম তীর্থের পথে হয়ে সঙ্গীহারা
ঘুমায়ে পড়েছে যেন আতিথেয় অজানার পাশে
দুর্মর অভ্যাসে।
কেশকীটে ভরা তার মাথা
লুটায় আমার কাঁধে, পরনের শতচ্ছিদ্র কাঁথা
বিষায় জীবনবায়ু সংকীর্ণ কুটীরে,
তাহার বিক্ষিপ্ত বাহু ধরিয়াছে মোর কণ্ঠ ঘিরে,
ক্ষণে ক্ষণে
অজ্ঞাত দুঃস্বপ্ন তার সন্ত্রস্ত কম্পনে
সঞ্চারিত হয় মোর জাতিস্মর অবচেতনায়।।
অতন্দ্রিত চক্ষু কিছু দেখিতে না পায়;
শুধু মোর সংকুচিত কায়া
অনুভব করে যেন নামহীন কাহাদের ছায়া
শিয়রে সংহৃত হয়ে উঠে;-
কোন্ জাদুঘর হতে দলে দলে পাশে এসে জুটে
অবলুপ্ত পশুদের ভূত
কুৎসিত, অদ্ভুত।
অমূর্ত আকাঙ্ক্ষা হানি, নিরাকার লজ্জা অসন্তোষ,
অসিদ্ধ দুরাশা দম্ভ, নিষ্ফল আক্রোশ
কানাকানি করে অন্তরালে।
রন্ধ্রহীন বিস্মৃতির প্রতন পাতালে
অতিক্রান্ত বিলাসের, অস্থাবর প্রমোদের শব
অনুর্বর সাম্প্রতেরে করিবারে চায় পরাভব
যোগায়ে জীয়ানরস অপুষ্পক বীজে॥
অয়ি মনসিজে,
কোথা তুমি কোথা আজ এই স্থূল শরীরী নিশীথে?
তোমার অতল, কালো, অতনু আঁখিতে
তারকার হিমদীপ্ত ভ’রে
তাকাও আমার মুখে। অনাত্মীয় অসিত অম্বরে
এলাও অস্পৃশ্য কেশ সূক্ষ্ম, নিরুপম,
স্বপ্নস্বচ্ছ বরাভয়ে আত্মত্যাগী বেরেনিকে-সম।
হেমন্ত হাওয়ার নিমন্ত্রণে
অনঙ্গ আত্মারে মোর ডাক দাও নীহারশয়নে
দুস্তর নাস্তির পরপারে;
দাঁড়ায়ে যে-নির্বাণের নির্লিপ্ত কিনারে
নিরুদ্বেগ নচিকেতা দেখেছিল অধোমুখে চাহি
সম্ভোগরাত্রির শেষে ফেনিল সাগরে অবগাহি
কষিতকাঞ্চনকান্তি নগ্ন বসুন্ধরা
তারই প্রলোভনতরে সাজায়িছে যৌবনপসরা
রূপে, রসে, বর্ণে, গন্ধে, কামাতুর রামার সমান
হে বৈদেহী, করো মোরে সেখানে আহ্বান।।
পণ্ডশ্রম, নাহি মিলে সাড়া।
শূন্যতার কারা।
অগোচর অবরোধে ঘিরে মোর আর্ত মিনতিরে;
যতই পলাতে চাই অভেদ্য তিমিরে
মাথা ঠুকে রক্তপঙ্কে পড়ি,
অগ্রজের মৃতদেহ যায় গড়াগড়ি
ক্রিমিভোগ্য দুর্গন্ধে যেখানে,
চরে যেথা ক্ষয়স্তূপে ভোজ্যের সন্ধানে
ক্লেদপুষ্ট সরীসৃপ, স্বেদস্রাবী বক্র বিষধর,
পঙ্কিল মণ্ডূক আর মূষিক তস্কর
বজ্রনখ পেচক, বাদুড়।।
বমনবিধুর
আমার অনাত্ম্য দেহ পড়ে আছে মৃন্ময় নরকে।
মৌন নিরালোকে
ভুঞ্জে তারে খুশিমতো গৃধ্ন নিশাচর।
দুস্তর, দুস্তর, জানি, শাস্তি মোর দুঃসহ, দুস্তর।
মনে হয় তাই
আত্মরক্ষা হাস্যকর, সুসংকল্প মৌখিক বড়াই,
জীবনের সার কথা পিশাচের উপজীব্য হওয়া,
নির্বিকারে, নির্বিবাদে সওয়া
শবের সংসর্গ আর শিবার সদ্ভাব।
মানসীর দিব্য আবির্ভাব,
সে শুধু সম্ভব স্বপ্নে, জাগরণে আমরা একাকী;
তাহার বিখ্যাত রাখি,
সে নহে মঙ্গলসূত্র, কেবল কুটিল নাগপাশ;
মলময় তাহার উচ্ছ্বাস
বোনে শুধু ঊর্ণাজাল অসতর্ক মাক্ষকার পথে।।
অমেয় জগতে
নিজস্ব নরক মোর বাঁধ ভেঙে ছড়ায়েছে আজ;
মানুষের মর্মে মর্মে করিছে বিরাজ সংক্রমিত মড়কের কীট;
শুকায়েছে কালস্রোত, কর্দমে মিলে না পাদপীঠ।
অতএব পরিত্রাণ নাই।
যন্ত্ৰণাই
জীবনে একান্ত সত্য, তারই নিরুদ্দেশে
আমাদের প্রাণযাত্রা সাঙ্গ হয় প্রত্যেক নিমেষে।।
ব্যাপ্ত মোর চতুর্দিকে অনন্ত অমার পটভূমি,
সবই সেথা বিভীষিকা, এমন-কি বিভীষিকা তুমি।।
৯ নভেম্বর ১৯৩৩
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন