সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
শুনিলাম জ্যোতিষীর কাছে
শনির দশার মোর পঞ্চ বর্ষ আরও বাকি আছে;
তার পর
বিংশতি বৎসর
অকৃপণ বৃহস্পতি গূঢ় আশীর্বাদে
উদ্বাস্তু আত্মারে মোর রাজকীয় মর্মরপ্রাসাদে
সুপ্রতিষ্ঠ করিবে নিশ্চয়;
মোর ব্যর্থ যৌবনের ক্ষিপ্ত অপচয়
হিরণ্ময় শস্যের আকারে
সে-দিন ফিরিবে নাকি অক্ষয় ভাণ্ডারে;
বিলাসের কামধেনু দুয়ে,
রচি সে-ফেনিল দুগ্ধে শুভ্র শয্যা, তার ’পরে শুয়ে
নিশ্চিন্ত ঘুমের আগে যদ্যপি তখন
দৈবাৎ স্মরণ করি আজিকার উদ্ভ্রান্ত জীবন,
তবে মনে হবে
আমার অজ্ঞাতসারে কখন নীরবে
সুনিদ্রা এসেছে পাশে দুঃস্বপ্নের ছদ্মবেশ পরি—
যেন কোনও রঙ্গিনা নাগরী
রূঢ়তার ভানে
অন্তরঙ্গ সোহাগ বাখানে।।
হেথা এসে
গণক গুটাল পুঁথি; আমি ম্লান হেসে
বিদায় নিলাম তারে যথোচিত দক্ষিণান্ত ক’রে।
কিন্তু মোর গভীর অন্তরে
জাগিল না প্রসন্ন প্ৰত্যাশা;
শুধু পেল ভাষা
অন্তর্ভৌম যে-আশঙ্কা এতদিন উৎসবের ক্ষণে
সঞ্চার করেছে মোর জাগ্রত চেতনে
অহেতু বিষাদ আর অকারণ উদ্বেগ, কম্পন
বুঝিলাম আচম্বিতে উদ্দীপ্ত যৌবন
ক্ষীয়মাণ সলিতায় অতঃপর পাবে না আশ্রয়।
বুঝিলাম মোর শত্রু নয়
দুহৃদ মানুষ কিংবা কুটিল দেবতা,
শত্রু নয় নিষ্ফলতা, শত্রু নয় আবশ্যিক ব্যথা;
শত্রু শুধু নিরপেক্ষ কাল,
মহাকাল,
ভয়াল, বিশাল।।
বুঝিলাম আজ যাহা আছে,
সে-দিনও সে-সবই রবে;— দুরারোহ গাছে
থাকিবে মন্দার ফুটে, কুহরিবে নন্দনের পাখী,
সর্বাঙ্গে পরাগ মাখি
প্রজাপতি শাখে শাখে বিতরিবে প্রাণ।
শুধু মোর দৃষ্টি, শ্রুতি, ঘ্রাণ
সে-ডাকে দিবে না সাড়া।
সুন্দরের প্রহত নাকাড়া
সে-দিনও ধ্বনিত হবে কামনার চিরন্তন রনে,
জিগ্মীষার রুদ্র নিমন্ত্রণে
হৃদয়কন্দর মোর অনুনাদে ভ’রে যাবে, জানি;
কিন্তু যে-অসভ্য প্রাণী
আজি সেথা বাস করে, সংস্কারের গুণে
সজীব ইন্ধন ঢালে যজ্ঞের আগুনে,
জয়যাত্রা আর তার সাধ্যে কুলাবে না।
তাই সে পাবে না
মর্মান্তিক অস্ত্রাঘাত নিষ্কবচ বুকে।
দেখিবে না তাই সে সম্মুখে
সংরক্ষিত সভ্যতার জ্বালামুখ প্রাকারমণ্ডল।
কালস্রোতে ভেসে আসা পল, অনুপল
নির্গমের দুয়ারে তাহার
জঞ্জালের অবরোধ করিবে সেদিন স্তূপাকার;
তার অন্তরালে
রুদ্ধশ্বাস বীর্য তার নিস্পন্দ কঙ্কালে
পরিণত হবে ত্বরা, প্রস্তরিত হবে অবশেষে।।
সে-দিনেও ঊর্ধ্ব নিরুদ্দেশে
তাকাবে তোমার আঁখি; সংকুচিত পায়ের তলায়
হতাশী লুটায়ে রবে; শ্লেষের শলায়
দীর্ণ, দগ্ধ হয়ে
ত্যজিবে বিদ্রোহ সে-ও; বিচ্ছিন্ন হৃদয়ে
ভাগ্যনির্ভরতা লেপে বিষায়িত প্রদাহ জুড়াবে;
বাঁধা পড়ে অনন্ত অভাবে
ভাবিবে জীবন মায়া, সত্য শুধু দুর্বার মরণ,
বস্তুবিশ্ব ক্ষণস্থায়ী, শূন্য সনাতন।
কিন্তু আমি রব না সেখানে;
রানীরে দুর্জেয় জেনে বাঁদীর সন্ধানে
ফিরিব অভীপ্সা ভুলে সমীকর আঁধারের নীচে।
তাই আর মোর পিছে পিছে
ভ্রমিবে না নিঃসঙ্গতা দিনান্তের ছায়ার সমান।।
রবে বর্তমান
সে-দিনেও আজিকার মতোই জগতে
বুভুক্ষা, লাঞ্ছনা, ঈর্ষা; পথে পথে
কণ্টকিত পরাজয় করিবে দমন
মানুষের অসাধ্যসাধন।
শুধু আমি দুঃখভীরু হব উঞ্ছজীবী
উদার পৃথিবী
শস্যসঞ্চয়নশেষে ফেলে যাবে সমভূমি-’পরে
জরাগ্রস্ত পশুদের তরে
যে-কটা উচ্ছিষ্ট কর্ণা, তার ভাগ পেয়ে,
শূন্যে চেয়ে
বিধিরে জানাব কৃতজ্ঞতা।
সে-দিন ছোঁবে না মোরে তাই আর ব্যথা ও ব্যর্থতা।।
বুঝিলাম বেলা চ’লে যায়,
দিগন্তের পটে আঁকা অস্থিসার হিম চন্দ্রমায়
সূর্যের অপরিহার্য তেজ
রচে শেষ শেজ;
মৃগতৃষ্ণিকার প্রেত অলৌকিক মরীচিকারূপে
স্বর্গান্বেষী সোপানের ধ্বংসধূলিস্তূপে
কালের তাণ্ডবলীলা ঢেকে দেয় মায়ার প্রচ্ছদে,
প্রতি পদে
সিদ্ধির স্বয়ম্ভূ নেশা আমাদের মুগ্ধ চোখে ভ’রে
গুহারে শিখর ব’লে প্রতিপন্ন করে,
গুরু ব’লে লঘুরে চালায়।
বুঝিলাম মৃত্তিকার তলায় তলায়
যত দিন রক্ত বহে, যত দিন তার মর্ম হতে
ক্ষয়ের অক্ষয় বীজ মঞ্জরিয়া উঠে দুষ্ট ক্ষতে,
সৃষ্টির কুৎসিত স্ফীতি রূপরেখা-’পরে
যত দিন ব্যক্ত হয়, তত দিন ধ’রে
অনশ্বর জড়বিশ্বে জেগে থাকে মানুষী চেতন।।
বৈকল্য এমনই ধ্রুব, এতই কি দুঃসাধ্য মরণ?
২৭ নভেম্বর ১৯৩৩
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন