বর্ষ পঞ্চক – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

পঞ্চ বর্ষ অতিক্রান্ত। মরুপথ ধূলায় আকুলি
অচিরাৎ অন্তর্হিত জীবনের শ্রেষ্ঠ বর্ষগুলি
দৃষ্টির দিগন্তপারে, অনিশ্চিত বেদনার মাঝে,
সমাপ্ত পূরবী যেথা নির্বিকার অনুনাদে বাজে,
সম্বল হারায় স্মৃতি অসংহত প্রদোষান্ধকারে।
একদা যে-পঞ্চবর্ষ অধুনার সূচীমুখ দ্বারে
অঙ্গাঙ্গি ঐক্যের ব্যূহ বেঁধেছিল, ভবিতব্য যাতে
যাযাবরবৃত্তি ভুলে ক্ষণমাত্র শিবির না পাতে
দুর্গের ধ্বংসাবশেষে, প্রত্যক্ষের পরীণাহ মেপে
যাদের সংসারযাত্রা, ভূমিকম্প প্রতি পদক্ষেপে,
জুড়েছিল অসম্পূর্ণ শতাব্দীর প্রশস্ত সোপান;
সে-স্থাবর পঞ্চবর্ষ, তারাও কি শূন্যে ধাবমান?
অবিচ্ছিন্ন, অবিরাম, অচঞ্চল তাদের প্রগতি,
আপাতনিশ্চলা যেন হিমনদী অন্তর্বেগবতী,
আচম্বিতে একদিন প্রলয়ের বিক্ষুব্ধ সম্পাতে
করে আত্মপ্রকটন। আজি নব বসন্তপ্রভাতে
চেয়ে দেখি অকস্মাৎ তাহাদের স্থবির প্রয়াণ
মোর স্তব্ধ যৌবনেরে দিয়ে গেছে বিনষ্টির দান
ধ্বংসের কালিমাক্লিষ্ট, নগ্ন, নিঃস্ব বৈধব্যে গোপন

ভেবেছিনু নাহি ত্বরা; তোদের সাদর সম্ভাষণ
শুনিলে চলিবে পরে। ভেবেছিনু তোরা বর্তমান,
রক্ষণশীলের শত্রু, জয়দৃপ্ত, চির-আয়ুষ্মান,
নহিস ক্ষণের পান্থ; তোদের ও-অচল গৌরব
ফুরালে পাতিব সখ্য। অতএব ভাবিনি সেদিন
লগ্ননিষ্ঠ গড্ডলিকা, জিতশ্রম, স্বাচ্ছন্দ্যবিহীন,
গমনসর্বস্ব তোরা; অনন্তের পটে যেন আঁকা
অসীমের আজ্ঞাবহ, মুক্তপক্ষ, উদ্বাস্তু বলাকা
তোরা ক্ষিতিনিরপেক্ষ। বুঝি নাই সেইদিন মনে
জীবনের মায়াপুরে নিরুদ্ধ স্ফটিক বার্তায়নে
সবাষ্প রঙীন শ্বাস তোরাও যে ব্যাহত কালের,
নিমেষে বিলুপ্ত হবি; অচুম্বিত কুমারীগালের
সন্ত্রস্ত লজ্জার রাগ প্রথম প্রগল্‌ভ নিমন্ত্রণে,
তোরাও বিলীন হবি সম্ভোগের সার্থক লগনে
পাণ্ডু, শ্লথ তর্পণের নিরুপায়, নির্বীর্য ধিক্কারে
অকস্মাৎ। নিষ্করুণ মধ্যাহ্নের প্রখর প্রহারে
তোদের সন্তাপশুভ্র হৃদয়ের মুকুরফলকে
যে-ইন্দ্রধনুর কান্তি বিচ্ছুরিত বিচিত্র ঝলকে,
কে জানিত সেইদিন হবে তার আশু পরিণাম
উন্মাদিনী বৈশাখীর প্রলয়দ, নবঘনশ্যাম,
তড়িতাড়িত মেঘে। কে জানিত পাঁচটি বৎসর
কালগ্রাসী বিধাতার অলক্ষিত তুচ্ছ অবসর
প্রহরীপীড়িত আঁখি একবার পালটি লব
কে জানিত সেইদিন ভোগাসক্ত বিরহ আমার
বিলাসী অশ্রুর ধারা মুছিতে পাবে না অবকাশ;
করিতে নারিবে সাঙ্গ দীর্ণ, দীর্ঘ একটি উচ্ছ্বাস
মুহূর্তেক অবহেলি ঊর্ধ্বশ্বাস মিলন-উল্লোল।

আজি পুন প্রত্যাগত বসন্তের পুলকহিল্লোল
সগর্বে প্রচার করে চেতনের মজ্জায় মজ্জায়
নব প্রতীক্ষার বার্তা; মাঙ্গলিক নূতন লজ্জায়
হোথা ওই স্তব্ধশোক, ভ্রান্তমতি, উলঙ্গ বল্লরী
আস্বচ্ছ কপিশ বস্ত্র রিক্ত বক্ষে টানিছে শিহরি
আগন্তুক জ্যোতিষ্কের মুগ্ধ, স্থির, তপ্ত আঁখিপাতে;
সংহতির চির-অরি যৌবনের দুর্বার সংঘাতে
বিজড় প্রান্তর ওই অকস্মাৎ হয়েছে জাগ্রত
প্রাণের পরম স্পন্দে, অভিশপ্তা অহল্যার মতো,
তরুণের পদস্পর্শে উজ্জীবিত শিলাস্তূপে আজি
অঙ্কুরিছে আচম্বিতে হর্ষোত্থিত নব রোমরাজি;
কিছু না ভ্রূক্ষেপ ক’রে আত্মম্ভরি যুগের সারথি
অজ্ঞানগোচরগতি চ’লে গেছে যে-পথে সম্প্রতি
ঘর্ঘরিত রথচক্রে এঁকে দিয়ে গভীর লাঞ্ছন,
সে-পথের মর্মক্ষত ফাল্গুনের লঘু বরিষণ
সস্নেহে দিয়েছে ধুয়ে। ভুলিবার এসেছে সময়।
প্রাচীন দৌর্বল্য মোর, কম্প, লজ্জা, ক্ষয়, পরাজয়
হারায়ে আশ্রয় যাক ঝরকে ঝরকে লুটে টুটে
সর্বভুক রজনীর ব্যয়কুণ্ঠ রহস্যসম্পুটে,
বিস্মৃতির গুহাগর্ভে।

পশ্চিমের শ্মশান-অঙ্গনে
যে-চিতা নির্বাণমুখ অনাঙ্গিক পঞ্চভূতসনে
মূর্ত পঞ্চ বৎসরেরে একাকার করিয়া বিষাদে
স্তিমিত অরুণ তেজে আপাতত জ্বলে ভস্মাচ্ছাদে,
সৃজনবেদনাস্ফীত, পীত তার উর্বর জরায়ু
আবার কি জন্ম দিবে ক্ষণস্থায়ী অথচ চিরায়ু
অক্ষয় ফিনিক্স-সম অভিনব বৎসরপঞ্চকে?
তাহারাও আসিবে কি বিজয়ের শূন্য প্রপঞ্চকে
অর্গলিত দুর্গ মম অবরোধ করিতে আবার?
সংকীর্ণ আকাশ মোর উদ্‌ভাসি সদর্পে পুনর্বার
তাহাদের বৈজয়ন্তী আস্ফালিবে বহুবর্ণচ্ছটা?
আসিবে কি পুনরায় স্বার্থসিদ্ধি, কুহকী কুলটা,
মিসরসম্রাজ্ঞীসম বিলাসের অপাঙ্গ ইঙ্গিতে
ভাঙিতে উদীর্ণ ব্রত; তনিমার সলীল ভঙ্গিতে
আত্মদানবিনিময়ে করিবে কি স্মিত অঙ্গীকার
সে-তপ্তকাঞ্চন দেহে নিমেষের মত্ত অধিকার?
মনোজ্ঞ মৃত্যুরে পুন ল’য়ে তারা আসিবে কি সাথে,
স্নিগ্ধ, শান্ত, শ্যাম কান্তি, বাঁশের বাঁশরী বাঁকা হাতে,
করুণ তরল হাস্যে নির্বাণের নিঃশঙ্ক আশ্বাস?
পথাশ্লিষ্ট-শূন্য-আঁখি, ক্ষিপ্ৰ-পদ, সঘন-নিঃশ্বাস,
আসিবে দুরন্ত প্রেম, টংকারিত কুসুমকার্মুকে
অলক্ষ্যসন্ধানী শর সংস্থাপিয়া চপল কৌতুকে
হানিতে নিখিলব্যাপী দুরারোগ্য, দুর্বিচার ক্ষত?

এ-জিষ্ণু সেনার পাছে, জানি জানি, আজিকার মতো
ভ্রমিবে কবন্ধযূথ, অন্ধকার, ত্রস্ত বিভীষিকা,
নৈর্ব্যক্তিক হাহাকার, ভ্রান্তিসার, শূন্য মরীচিকা,
মড়ক কঙ্কালশেষ, বিকলাঙ্গ গতানুশোচনা,
অক্ষম ক্রোধের দাহ, নিষ্কারণ অতৃপ্তিযন্ত্রণা,
ক্ষুব্ধ আত্মধিক্কারের ধূমাঙ্কিত, খিন্ন তুষানল।
পলক ফেলার আগে সে-নবীন বিজেতার দল
পঞ্চ বৎসরের শেষে বিনাবাক্যে হরে অন্তর্ধান
আসন্ন আঁধারে পুন। দুর্নিবার তাদের প্রয়াণ
সময়ে হবে না লক্ষ্য। সেদিনেও অশ্রুনত চোখে
অচপল ব’সে রব অবলুপ্ত অতীতের শোকে
উপেক্ষিয়া সুলগন। তার পরে কেটে গেলে বেলা
হঠাৎ পড়িবে মনে করিয়াছি পুন অবহেলা
দ্বারাগত অতিথিরে। আর বার শিরে কর হানি
অসম্পূর্ণ অভ্যর্থনা, অসমাপ্ত পরিচয়খানি
বেদনাবিলাসী বক্ষে বর্মসম ধরিব গৌরবে।
পুন মোর বন্ধ দ্বারে বসন্তের বৈতালিক যবে
উচ্চারিবে আবাহনী, নিবৃত্তির আত্মপরসাদে
রুদ্ধ ক’রে রব শ্রুতি। সেদিনেও অন্ধ মরমাদে
ব্যর্থতারে শ্রেষ্ঠ ব’লে মনে মনে করিব নিশ্চয়;
ভাবালু সংগীতে পুন পরাস্তের দুর্জ্জেয় বিজয়
চাহিব ঘোষিতে মর্ত্যে; স্বেচ্ছাপঙ্গু ঘৃণ্য নিরাশারে
অসংকোচে দিব নতি; নিশ্চেষ্ট বাচাল অহংকারে
কৃতীর পবিত্রাসনে করিব ক্লীবের অভিষেক;
রত্নগর্ভা-প্রতি হানি বিষতিক্ত বিদ্রূপ শতেক
ভাবিব মহৎ বুঝি নিরিন্দ্রিয়া বন্ধ্যার সংযম;
ভবিষ্যের মৈত্রীবাহী অধুনা-দূতের সমাগম
হেলায় নিষ্ফল ক’রে সহ্যশীল অদৃষ্টের ’পরে
অর্পিব সমস্ত দোষ, রুদ্র যবে রুষ্ট মূর্তি ধ’রে
হানিবে নিষ্ঠুর বজ্র।

এই ভাবে কেটে যাবে কাল।
জরান্ধ, নির্ণয়হারা নিয়তির বাহুর আড়াল,
নির্বল, নির্ভরশীল, নিরুপায় দুলালের মতো,
আমারে বেষ্টন করি দূরে দূরে রাখিবে নিয়ত
পতন ও অভ্যুদয়ে যেই পন্থা হয়েছে বন্ধুর,
সে-পথের প্রান্ত হতে। গৃহকোণে ব্যর্থশ্রমাতুর,
ক্ষতির সহিত ক্ষতি, অপচয়সনে অপচয়
যোগ দিতে দিতে মোর সুদীর্ঘ জীবন হবে ব্যয়
অখ্যাতির অবচ্ছায়ে। ঘটিবে না কোনওখানে ত্রুটি
বিদ্রোহের ঝঞ্ঝাবাতে বিজ্ঞতার সতর্ক দেউটি।
হবে না নির্বাণ কভু নপুংসের নির্বিঘ্ন ভুবনে
যে-অতীত চুপে চুপে আয়ুটুকু কাটায়ে ভুবনে
অকীর্তির অন্তরালে অবশেষে মুভিছে বিশ্রাম,
নগণ্য দুষ্কৃতি যার, অবজ্ঞেয়, নশ্বর দুর্নাম
ঐতিহ্যের স্মৃতিস্তম্ভে কোনও কালে নাহি হবে লেখা
গভীর অক্ষরে, তারই নিভৃত পদের ভৃগুরেখা
শুধু মোর হৃদয়ের ক্রমশুষ্ক ফলকে গোপন
হয়ে রবে সদাপূজ্য, হয়ে রবে চির চিরন্তন।।

১২ ফাল্গুন ১৩৩৪

সকল অধ্যায়

১. উটপাখী – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
২. সন্ধান – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
৩. সৃষ্টিরহস্য – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
৪. প্রত্যাখ্যান – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
৫. জাদুঘর – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
৬. বর্ষ পঞ্চক – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
৭. বর্ষশেষ – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
৮. প্ৰতৰ্ক – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
৯. কাল – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
১০. অকৃতজ্ঞ – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
১১. লঘিমা – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
১২. বিরাম – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
১৩. প্রশ্ন – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
১৪. প্রতীক – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
১৫. জাতিস্মর – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
১৬. নরক – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
১৭. কুক্কুট – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
১৮. ভাগ্যগণনা – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
১৯. মৃত্যু – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
২০. সিনেমায় – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
২১. সমাপ্তি – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
২২. পরাবর্ত – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
২৩. বাক্য – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
২৪. প্ৰাৰ্থনা – সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন