সুধীন্দ্রনাথ দত্ত
আপনারে অহরহ খুঁজি।
কিন্তু যার স্পর্শ পাই, নিগূঢ় বিশ্রাম্ভালাপ বুঝি,
অন্বিষ্ট সে নয়।
সে শুধু কামসর্বস্ব বাচাল হৃদয়
বহুরূপী, বহুভাষী, বহুব্যবসায়ী,
যার সনে আত্মীয়তা নাই
স্বচ্ছন্দ দেহের কিংবা স্বতন্ত্র বুদ্ধির;
যে-অধীর
পৃথ্বীর পৃথুল কোলে শান্ত হয়ে থাকিতে পারে না;
বারে বারে যার স্বপ্নসেনা
অলীক স্বর্গের দ্বারে হানা দিতে ছুটে
শূন্যের পরিখা ঘেরা ব্রহ্মাণ্ডের সন্তপ্ত সম্পুটে
যেথা তার প্রতিনিধি, ক্রূর ভগবান,
পাসরি সম্রাট্নিষ্ঠা অগোচর সামন্ত-সমান,
অনাদি নীরবে ব’সে, মনের গোপনে
চক্রান্তের ঊর্ণাজাল বোনে।
আমি যারে চাই
তার মাঝে ভেদ নাই, দ্বন্দ্ব নাই, দেশ-কাল নাই;
মননে ও মনীষায়, দেহে ও বুদ্ধিতে
একান্ত সে; বিংসবাদী উপাদান শিল্পের শুদ্ধিতে
যেমন নিষ্ফল, সেও তেমনই সংগত—
সংকল্পপ্রহত
বাদ্যভাণ্ড মগ্ন ঐকতানে;
দেবযানে
উদ্গাতা জ্যোতিষ্ক যেন বৃত্তির নিজস্বে পূর্ণ করে
অসম্পৃক্ত অয়নাংশ; তরায় বন্দরে
নিশাক্রান্ত তরণীরে নিরুদ্দিষ্ট তার আশীর্বাদ;
ব্যক্তিনিরপেক্ষ তার প্রচুর প্রসাদ
রূপসীর অহংকারে, কূরূপার কৌস্তুতে স্বরাট্;
রটায় সে-হতবাক্ ভাট,
নবজাতকের বার্তা উৎকর্ণ জগতে।।
আমারে যে ডাকে মুক্ত পথে
দীক্ষা দিতে, মোক্ষে নয়, স্বায়ত্তশাসনে,
তার অপেরণে
অপচারী দ্রষ্টাই প্রকট;
শাঠ্যের প্রেরণা তারে যোগায় না শঠ;
মজে না সে প্রশংসায়, পায় না লোকাপবাদে ভয়;
স্থিতধী সঞ্জয়
ডরায় না ব্যাধি, মৃত্যু, জরা,
চিতার স্ফুলিঙ্গযোগে জীবনের দীপপরম্পরা
জ্বালায় সে নির্বিষাদ নির্বাণের আগে।।
অক্ষয় মনুষ্যবট নির্বিকার যে-প্রাণপরাগে
বিকশিত আশুক্লান্ত নির্বিশেষ ফলে,
সে-অনাম চিরসত্তা খুঁজি আমি নিজের অতলে।।
১২ অক্টোবর ১৯৩৩
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন