সৈকত মুখোপাধ্যায়
আমি আর বুধোদা দুজনেই বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠলাম। দৌড়লাম সামনের দরজাটার দিকে। ওই দরজাটাই ডাম্পিভাই প্রাণপণে পেটাচ্ছিল। যেতে যেতেই একবার ডাইনিং-হলের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ছ’টা বাজতে তখনো দশমিনিট বাকি আছে। তার মানে ভালো করে সকাল হতে এখনো প্রায় দু-ঘন্টা দেরি। এই বিদঘুটে সময়ে এমন কোন ঘটনা ঘটল যার জন্যে ডাম্পিভাইকে তার কোয়ার্টার থেকে ছুটে আসতে হল?
বুধোদা দরজাটা খুলতেই ডাম্পি মাহাতো প্রায় হুমড়ি খেয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে এল। ওর জামাকাপড়ে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ।
প্রথমে ভেবেছিলাম ও নিজেই কোনোভাবে মারাত্মক চোট পেয়েছে, কিন্তু ওর কথাতেই ভুল ভাঙল। ডাম্পি অসহায়ের মতন বুধোদার হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বলল, মজুমদারসাব, মাস্টারসাবকে বাঁচান। নেকড়ে-মানুষ ওকে বহোত বুরা তারিকাসে জখম করেছে। এত খুন বেরোচ্ছে, এত খুন বেরোচ্ছে, যে কী বলব?
বুধোদার ব্যাগে সব সময়েই একটা ফার্স্ট-এইড-কিট থাকে, কারণ, ওই ব্যাগ নিয়ে ও যেমন অ্যান্টিক খুঁজতে বেরোয়, তেমনি আবার বিপজ্জনক সব পাহাড়ে জঙ্গলে ট্রেকিং করতেও বেরোয়। সেটা ওর দ্বিতীয় নেশা। তৃতীয় নেশা বার্ড-ওয়াচিং।
যাই হোক, সেই কিট টা হাতে নিয়ে বুধোদা দৌড়ল ডাম্পির কোয়ার্টারের দিকে। পেছন পেছন আমি আর ডাম্পি। যেতে যেতেই ডাম্পির মুখে যেটুকু শুনলাম, তাতে বুঝতে পারলাম, একটু আগে তার কোয়ার্টারের দরজায় নক করেছিলেন মিস্টার জোসেফ। দরজা খুলতেই রক্তাক্ত মিস্টার জোসেফ মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়ে জ্ঞান হারান। জ্ঞান হারানোর আগে তিনি শুধু বলতে পেরেছিলেন, প্রভূ যীশু আমার লোভের শাস্তি দিলেন ডাম্পি। আমাকে মিথ্যে কথা বলার শাস্তি দিলেন।
আমরা যখন পৌঁছলাম তখনও মিস্টার জোসেফ চিৎ হয়ে ঘরের মেঝের ওপরে পড়ে আছেন। দেখে শিউরে উঠলাম—ওনার বাঁদিকের গালটায় দুটো বড় গর্ত, যেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে নেমেছে বুকে। ওগুলো যে কোনো শ্বাপদের শ্বদন্তের দাগ তা আর বলে দিতে হয় না। তাছাড়া পেট থেকে থাই অবধি জামাপ্যান্ট ফালা ফালা হয়ে ছিঁড়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে চামড়ার ওপরে একসারি রক্তরেখা।
বুধোদা হাঁটু মুড়ে ওনার পাশে বসে পড়ল। ফার্স এইড কিটটা খুলতে খুলতে আপনমনেই মন্তব্য করল—কপাল ভালো, কামড়টা গলায় বসাতে পারেনি। তাহলে আর কিছু করার থাকত না।
কে কামড় বসাতে পারেনি? নেকড়ে-মানুষ? জানি, এখন এই প্রশ্ন করা যাবে না।
বুধোদা একটা লোশন ঢেলে মিস্টার জোসেফের ক্ষতস্থানগুলো ধুইয়ে দিয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধতে শুরু করেছিল। একটা অ্যান্টি-টিটেনাস ইঞ্জেকশনও দিল। কিন্তু তারপর অসহায়ের মতন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, রুবিক, এ ফার্স্ট এইডের কাজ নয় রে। এনাকে ইমিডিয়েটলি কোনও বড় হাসপাতালে ট্র্যান্সফার করতে হবে। কিন্তু সে তো সেই শিলিগুড়িতে। ডাম্পি, ওনাকে শিলিগুড়ি নিয়ে যাব কেমন করে? গাড়ি কোথায়?
পিছন দিক থেকে কেউ বললেন, ও দায়িত্বটা আমার ওপর ছেড়ে দিন মিস্টার মজুমদার।
মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম দরজার সামনে সুধাবিন্দু বসাক দাঁড়িয়ে আছেন। বুধোদা অবাক গলায় বলল, আপনি যে বললেন দুপুরের ফ্লাইটে আসবেন।
সুধাবিন্দুবাবু উত্তর দিলেন, ফোনে আপনার সব কথা শুনে অতক্ষণ ওয়েট করতে পারলাম না। ইনকাম ট্যাক্সের কাজটা গতকাল সকাল এগারোটার মধ্যে মিটে গেল। তখনই তৎকালে শতাব্দীর টিকিট কেটে রওনা হয়ে গেলাম। রাত সাড়ে দশটায় পৌঁছলাম এন.জে.পি। অত রাতে তো আর গাড়ি পাবো না, তাই রাতটা কোনোরকমে শিলিগুড়ির একটা হোটেলে কাটিয়ে, ভোর না হতেই চলে এসেছি। এসেছি অবশ্য ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের গাড়িতে। এই অর্ণব, ভেতরে এস।
লম্বা দোহারা চেহারার এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। এতক্ষণ উনি ঘরের ভিতরের দৃশ্য দেখতে পান নি। এবার সুধাবিন্দুবাবুর ডাকে সাড়া দিয়ে ঘরের মধ্যে পা দিয়েই ‘ওহ’ বলে একটা আওয়াজ করে উঠলেন। বোঝাই যায় সেটা মিস্টার জোসেফের অবস্থা দেখে ওনার ইনস্ট্যান্ট রিঅ্যাকশন। সুধাবিন্দুবাবু বললেন, মিস্টার মজুমদার, ইনি আমার ঘনিষ্ট বন্ধু অর্ণব বসু। এখানকার ডি.এফ.ও.। ওর সঙ্গে ফরেস্টের লোকজন রয়েছে। আপনি যা যা ইকুইপমেন্টস আনতে বলেছিলেন সব নিয়ে এসেছি।
অর্ণব বসু বললেন, সুধা, আমি বলি কি, একটা গাড়ি আর আমার দুজন লোক দিয়ে এই ভদ্রলোককে আগে নর্থবেঙ্গল মেডিকাল কলেজে অ্যাডমিশন করিয়ে দিই। ওখানকার সুপারের সঙ্গে আমার ভালোই আলাপ আছে। ফোনে বলে দিচ্ছি। সেরা চিকিৎসাটাই হবে। কিন্তু আর দেরি হলে এনার ক্ষতি হতে পারে।
বুধোদার মুখ দেখে বুঝতে পারলাম, অর্ণববাবুর কথাটা ওর পছন্দ হয়েছে। পরের পনেরো মিনিটের মধ্যে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের একটা এস. ইউ. ভি. মিস্টার জোসেফকে নিয়ে জলপাইগুড়ি রওনা হয়ে গেল আর অন্য দুটো গাড়ি কুলিবস্তির সামনে থেকে ধীরগতিতে এগিয়ে চলল চার্চের রাস্তায়। বেশ কিছুটা চড়াই ভেঙে ওঠার পর, ঠিক যখন দূরে গির্জার চুড়োটা দেখা গেল, তখনই সামনের গাড়িটা থেমে গেল। অর্ণববাবু হাত দেখিয়ে আমাদের গাড়িটাকেও থামালেন। এরপরেই শুরু হল আমাদের ফুট-মার্চ।
আমরা বলতে আমি আর বুধোদা তো আছিই। সঙ্গে আছেন সুধাবিন্দুবাবু আর অর্ণববাবু। আর রয়েছে ডাম্পিভাই। তা বাদে চারজন ফরেস্ট গার্ড। অবাক হয়ে দেখলাম, তাদের একজনের হাতে একটা বন্দুক আর বাকি তিনজন কাঁধে করে একটা নাইলনের জাল বয়ে নিয়ে চলেছে। বুধোদা অর্ণববাবুকে জিগ্যেস করল,বন্দুকটা কি ঘুমপাড়ানি গুলি ছুঁড়বার জন্যে?
অর্নববাবু বললেন, নিশ্চয়। তাও যদি প্রয়োজন হয়, তবেই।
একটু বাদে অর্ণববাবু বললেন, মিস্টার মজুমদার আপনিই লিড করুন। আপনিই সবথেকে ভালো জানেন কোথায় যেতে হবে। সুধাবিন্দুবাবুও সেই কথায় সায় দিলেন। আমি আর বুধোদা এগিয়ে গেলাম, অন্যরা আমাদের ফলো করতে শুরু করল।
বুধোদা আমাদের কবরখানার গেটের সামনে নিয়ে এসে পিছন ফিরে তাকাল। ডাম্পি তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে পকেট থেকে চাবি বার করে গেটের তালাটা খুলে দিল ঠিকই, কিন্তু তারপরেই প্রায় দৌড়েই অনেকটা দূরে গিয়ে দাঁড়াল। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, এই মুহূর্তে ওর কবরখানার ভিতরে ঢুকবার একটুও ইচ্ছে নেই।
বুধোদা আমাদের দলটাকে হেনরি সুবেশের কবরটার কাছে নিয়ে এল। আমি ভাবছিলাম, বোধহয় আট ঘন্টাও কাটেনি, আমি আর বুধোদা ঠিক এই জায়গাটায় দাঁড়িয়েছিলাম। রাতের সেই পরিবেশ এখন আর নেই। কিন্তু অন্য অনেক কিছুই এক অবস্থায় রয়েছে। আমাদের হাতের ইশারায় একটু দূরে দাঁড়াতে বলে অর্ণববাবু আর সেই বন্দুকধারী ফরেস্ট-গার্ড সেইরকমই একটা জিনিস ভালো করে দেখবার জন্যে এগিয়ে গেলেন। থাবার ছাপ।
অর্ণববাবু হাঁটু মুড়ে বসে কিছুক্ষণ ছাপগুলোকে দেখলেন। তারপর বুধোদার দিকে ফিরে হাসিমুখে বললেন, ইউ আর রাইট, মিস্টার মজুমদার। লেপার্ড। অ্যান্ড সি দেয়ার। পাগ-মার্ক অফ হার কাবস। অর্ণববাবু মাটির যেদিকে দেখালেন সেদিকে তাকিয়ে দেখি বেড়ালের থাবার মতন ছোট্ট ছোট্ট আরো কয়েকটা থাবার ছাপ।
অ্যান্ড দেয়ার দে গো। এবার অর্নববাবু আঙুল তুলে দেখালেন কবরখানার পিছনদিকে, যেখান থেকে টিলার ঢালু গা প্রায় দুহাজার ফিট নীচে একটা জঙ্গলে ঢাকা খাদে গিয়ে মিশেছে।
সেই ঢালু পাহাড় বেয়ে নেমে যাচ্ছে একটা চিতাবাঘ। তার চলা-ফেরার মধ্যে কোনো তাড়াহুড়ো নেই। সকালের নরম আলোয় তার হলুদ রেশমি চামড়া সোনার মতন ঝলমল করছে। আর সেই মা-চিতাবাঘের পেছন পেছন নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করতে করতে, কখনো আবার মায়ের লেজটাকে নিয়ে খেলা করতে করতে দৌড়চ্ছে দুটো বাচ্চা।
আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম সবার চোখে খুশি। সবার চোখে মুগ্ধতা। এমনকি ডাম্পিও কখন যেন আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। সেও হাসছিল।
খোলা ঘাসজমিটা পেরিয়ে চিতাবাঘটা আর তার বাচ্চাদুটো প্রায় জঙ্গলের কিনারায় পৌঁছে গিয়েছিল। জঙ্গলে ঢুকে পড়বার আগে মা বাঘটা হঠাৎ কী মনে করে একবার রাজকীয় ভঙ্গিতে ঘাড় ফিরিয়ে আমাদের দিকে তাকাল। বাচ্চা দুটোও ঘুরে দাঁড়াল আমাদের দিকে মুখ করে। যেন ওরা তিনজনেই বিদায় জানাল কুকড়াঝোরাকে। তারপর ঢুকে গেল ঘন জঙ্গলের মধ্যে।
অর্নববাবু বললেন, চলুন মিস্টার মজুমদার, চল সুধাবিন্দু। আমাদের এখানে আর কাজ নেই। আগামী এক-বছরের মধ্যে অন্তত ও আর এখানে ফিরে আসবে না।
সুধাবিন্দুবাবু তাকালেন বুধোদার দিকে। জিগ্যেস করলেন, মিস্টার মজুমদার? আপনি গুপ্তধনের কথা কী যেন বলছিলেন?
হ্যাঁ, সেই কাজটুকুই বাকি। একটু দাঁড়ান। ডাম্পি, তোমাকে যা আনতে বলেছিলাম এনেছ।
ডাম্পি মুখে কিছু না বলে ওর কাঁধের ঝোলা থেকে একটা ছোট শাবল বার করে দ্যাখাল। বুধোদা বলল, ভেরি গুড। কাজে লেগে যাও তাহলে।
ডাম্পি বুকের ওপর ক্রশ এঁকে হেনরি সুবেশের কবরের ইঁটের গাঁথনির ফাঁকে শাবল চালাল। পুরনো ঝুরঝুরে গাঁথনি শাবলের দু-তিন কোপেই অনেকটা ভেঙে পড়ল। ভেতরে দিব্যি বড়সড় একটা ঘরের মতন জায়গা। বোঁটকা গন্ধ, কিছু হাড়গোড়। আমাদের ম্যাডাম চিতার সংসার পাতার চিহ্ন।
যা দেখবার ভয়ে সিঁটিয়ে ছিলাম সেরকম কিছুই চোখে পড়ল না। না কফিনের কাঠ, না মানুষের কঙ্কাল। একশো-পনেরো বছর বিরাট লম্বা সময়। তার মধ্যে সব কিছুই মাটিতে মিশে গেছে।
ডাম্পি এবার হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। একটা ছোট বেলচা বার করে আস্তে আস্তে কবরের মধ্যে জমে থাকা ধুলো সরাতে শুরু করল। বুধোদা ওর পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল। হঠাৎই বুধোদা চেঁচিয়ে উঠল—ওই তো!
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন