সৈকত মুখোপাধ্যায়
থ্যাঙ্কইউ রুবিক। বুধোদা ওর জিম-ব্যাগের মধ্যে হাতকড়াটা ঢুকিয়ে নিয়ে বলল, চল!
এখন! কোথায়?
বড়বাজার থানা। একটুও নষ্ট করার মতন সময় নেই। আরে, ঘাবড়াচ্ছিস কেন? কাকিমাকে আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি, তোকে নিয়ে বেরোচ্ছি। ফিরতে রাত হবে।
তারপর ঠিক সাতমিনিটের মধ্যে বুধোদা ওর গাড়িটাকে বিবেকানন্দ ব্রিজের ওপরে উঠিয়ে ফেলল। ব্রিজ পেরোতে-পেরোতে বুধোদা পাশ ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, প্রতাপবাবুর বাড়িতে হ্যারি হুডিনির হাতকড়া থাকার মানে কী জানিস? হুডিনির আরও সরঞ্জাম থাকার সম্ভাবনা। আর তার মানে কী জানিস?
আমি বললাম, অ্যান্টিক।
‘অ্যান্টিক’ তো অবশ্যই। কিন্তু তার থেকে বেশি আরও কিছু। আরও অনেক কিছু। এই বলে সেই যে বুধোদা মুখে কুলুপ আঁটল, আর কিছুতেই ওর মুখ খোলাতে পারলাম না।
মুখ খুলল একেবারে বড়বাজার থানার ওসির ঘরে ঢুকে। সুজনদা একটু গাঁইগুঁই করছিলেন। বুধোদাকে বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন, সিল ভেঙে আবার প্রতাপ রক্ষিতের ঘরে ঢোকার মধ্যে প্রচুর অফিসিয়াল হুজ্জুতি আছে। কিন্তু বুধোদা নাছোড়বান্দা। একবার…আর মাত্র একবার ওকে ঘরটা দেখতে দিতেই হবে। ও নিশ্চিত, ভূতুড়ে খুনির রহস্য এবারে ও ঠিক বার করে ফেলতে পারবে। কিছুটা বাধ্য হয়েই সুজনদা বগলে ফাইল নিয়ে আমাদের সঙ্গে গাড়িতে উঠে বসলেন।
প্রতাপদাদুর বাড়ির দরজায় লাগানো পুলিশের তালা খোলা হল। একতলার যে-ঘরটায় উনি খুন হয়েছিলেন, সেই ঘরের দরজার সিলও ভাঙা হল। আলো জ্বেলে আমরা সেই ঘরে ঢুকলাম। ভেবেছিলাম, বুধোদা আবার সবকিছু তন্ন তন্ন করে দেখবে। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে ও সটান সেই কাঠের বড় আলমারিটার পাল্লা দুটো খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল। তারপর আমাদের আরও অবাক করে দিয়ে পাল্লাদুটো ভেতর থেকে ভেজিয়ে দিল।
সুজনদা অসন্তুষ্ট গলায় ডাকলেন—বোধিসত্ত্বদা…এই বোধিসত্ত্বদা! এসব কী করছ? মাথাখারাপ হয়ে গেল নাকি তোমার?
শুধু ডাক দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না বড়বাজার থানার ওসি। সটান গিয়ে পাল্লাদুটো টেনে খুলে ফেললেন এবং যেন মুখের ওপরে একটা ধাক্কা খেয়ে সঙ্গে-সঙ্গেই দু-পা পিছিয়ে এলেন। আলমারির ভেতরে বুধোদা ছিল না। আলমারি ফাঁকা। আমিও যারপরনাই অবাক হয়েছিলাম। তবে বেশিক্ষণ আমাদের ওই অবস্থায় না রেখে বুধোদা বেরিয়ে এলো আলমারির পেছনদিক দিয়ে। একগাল হেসে বলল, আয়! দেখে যা।
দেখলাম। সাধারণ কাঠের আলমারির পেছনে লুকোনো একটা আংটা, যেটায় টান দিলেই একটা তক্তা সরে গিয়ে পেছনে একটা চোরাকুঠুরি বেরিয়ে পড়ছে। ছোটখাটো চেহারার একজন মানুষ সেখানে কোনোরকমে গুঁড়িশুঁড়ি মেরে বসে থাকতে পারে। সেই চোরাকুঠুরির পেছনের দেয়ালেও একইরকমের একটা আংটা—যেটার সাহায্যে আরেকটা কাঠের টুকরো সরিয়ে বুধোদা একটু আগে বেরিয়ে এসেছিল।
এরপর বুধোদা যেটা দেখাল সেটার জন্যে ওর সেলফোনের ফ্ল্যাশলাইটটা জ্বালতে হল। ফ্ল্যাশের জোরালো আলোয় আমি আর সুজনদা দেখলাম, পাল্লার ভেতরদিকে কাঠের গায়ে খোদাই করা আছে দুটো রোমান অক্ষর—এইচ এইচ।
এই হল ব্যাপার। বিজয়ীর হাসি হেসে বলল বুধোদা।
কী হল ব্যাপার? আমি বললাম।
কী ব্যাপার বোধিসত্ত্বদা? সুজনদা জিগ্যেস করলেন।
বুধোদা ঘরের এককোণে রাখা সোফাসেটটার ওপরে গা এলিয়ে দিয়ে বলল, আয় এখানে বোস। সুজন, তুমিও বোসো। তবে তার আগে তোমার হাবিলদারকে একটু হাঁক দিয়ে বলে দাও, নাখোদা মসজিদের কোনার চায়ের দোকানটা থেকে কেটলিতে করে মালাইদার চা নিয়ে আসতে, আর মাটির ভাঁড়। টেনশনে গলাটা শুকিয়ে গিয়েছে।
হবে না টেনশন? খালি ভাবছি, এই বয়সে কি ভূতপ্রেত কিম্বা বাণ-মারায় বিশ্বাস করতে হবে? এই ছিল কপালে? ভাগ্যিস রুবিক হ্যান্ডকাফটার ওপরে হ্যারি হুডিনির নামের ইনিশিয়াল দেখতে পেল। নাহলে এখনো অন্ধকারেই হাতড়ে মরতাম।
ওইটি দেখার সঙ্গে-সঙ্গেই বুঝতে পারলাম, জার্মানি থেকে তারাপদ মুস্তাফি প্রিন্স রাজনের কিছু স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে এসেছিলেন। কেমন স্মৃতিচিহ্ন? যুদ্ধের পরের সেই ভয়ঙ্কর আকালের দিনেও কেন অত খরচ করে জার্মানি থেকে তিনি সেগুলোকে নিয়ে এসেছিলেন?
এর একটাই উত্তর হয়। জিনিসগুলো শুধুই প্রিন্স রাজনের স্মৃতিচিহ্ন ছিল না। সেগুলোর গায়ে লেগেছিল আরেক প্রতিভার স্পর্শ। হ্যারি হুডিনির।
এর আগে প্রতাপবাবুই কথায়-কথায় আমাদের বলেছিলেন, মার্টিন জিগলার প্রিয়রঞ্জনবাবুকে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছিলেন যে, তিনি নিজের সংগ্রহের অনেক ম্যাজিকের সরঞ্জাম বিনাপয়সায় প্রিয়রঞ্জনকে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন।
হ্যান্ডকাফটা যে স্বয়ং হুডিনির সেটা বুঝতে পারামাত্রই মনে হল, তাহলে কি মার্টিন জিগলারের ‘নিজের সংগ্রহ’ মানে তার প্রিয় বন্ধু হুডিনির এরকম আরও কিছু স্মৃতিচিহ্ন আছে? তিনি কি বুঝতে পেরেছিলেন এত বছর আগলে রাখার পরে এবার সেগুলো কোনো যোগ্য মানুষকে দিয়ে দেওয়া উচিত, কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তাঁর নিজের বেঁচে থাকাটাই অনিশ্চিত। এমন একজনের হাতে ওগুলো তুলে দেওয়া উচিত, যে সেগুলোকে হুডিনির মতন দক্ষতাতেই ব্যবহার করতে পারবে। নিশ্চয় তাই।
কেবল ব্যবহার করতে নয়, তিনি প্রিন্স রাজনকে হুডিনির ম্যাজিকের কিছু সরঞ্জাম বরাবরের মতন দিয়ে দিয়েছিলেন; গিফট করেছিলেন প্রিন্স রাজনকে। প্রিয়রঞ্জনের সহচর তারাপদ মুস্তাফি জানতেন কোন সরঞ্জামগুলো হুডিনির নিজের উদ্ভাবিত সরঞ্জাম। তিনি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সেগুলোকে ভারতে ফিরিয়ে আনলেন। তুলে দিলেন প্রিয়রঞ্জন রক্ষিতের বিধবা পত্নীর হাতে।
তখন প্রিয়রঞ্জনবাবুর একমাত্র সন্তানের বয়স দুই। সে এসবের কিছুই জানল না। প্রতাপবাবুর কাছেই শুনেছি যে ওনার মা ম্যাজিকের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে এরকম কোনো জিনিসে ওনাকে হাত ছোঁয়াতে দিতেন না। তার ভয় ছিল পাছে প্রতাপবাবুকেও ম্যাজিকের নেশা পেয়ে বসে। কাজেই প্রতাপবাবুর কোনোদিনই জানা হয়নি যে, তার ঘরের মধ্যেই রয়ে গেছে কিছু দুর্লভ অ্যান্টিক—হুডিনির ম্যাজিকের প্রপস।
জানতে পারলেন সুবিনয় মুস্তাফি। কেমন করে সেটা আন্দাজ করতে পারি। হয়তো দাদুর কোনো পুরোনো ডায়েরি কিম্বা নোটস তার হাতে পড়ে গিয়েছিল। শুধু যে এমন কিছু দামি জিনিস তাহের আলি লেনের বাড়িটায় পড়ে আছে এটুকুই তিনি জানেননি, প্রতিটি জিনিসের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনাও নিশ্চয় তিনি সেই নোটস কিম্বা ডায়েরি থেকে পেয়েছিলেন। তার মধ্যে একটা জিনিসের বর্ণনা তাকে লোভে পাগল করে তুলল। সেটা হচ্ছে একটা কাঠের আলমারি।
বুঝলে সুজন, হুডিনির এই ম্যাজিকটার কথা তুমি অনেক ম্যাজিকের বইয়ে কিম্বা পত্রপত্রিকায় এখনো দেখতে পাবে। দর্শকদের চোখের সামনে হুডিনিকে একটা কাঠের আলমারির মধ্যে পুরে আলমারির দরজায় তালা দিয়ে দেওয়া হল। আলমারিটা তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করেছেন সবাই। চাবিও রইল দর্শকদের কাছেই। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই দেখা গেল আলমারির গায়ের তালা যেমনকার তেমনই রয়েছে কিন্তু হুডিনি দর্শক-আসনের মাঝের রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছেন স্টেজের দিকে।
নেহাত আমার কাছে আমেরিকার মধ্যে সেরা ম্যাজিকের সরঞ্জাম যারা বানায় সেই গ্যামাজ কোম্পানির পুরোনো কিছু ক্যাটালগ ছিল। তাই আমি এই আলমারিটা থেকে বেরোনোর গোপন রাস্তা বার করতে পারলাম। নাহলে কারুর সাধ্য নেই খোদ হুডিনির নিজের ডিজাইনে তৈরি করা এই আলমারির গোপন চেম্বার খুঁজে বার করে।
সুবিনয় মুস্তাফিও খুঁজে পেয়েছিলেন। হয়তো তারাপদ মুস্তাফির ডায়েরিতে ওই কায়দাটার কথাও লেখা ছিল, সেইজন্যেই পেয়েছিলেন। তাছাড়া ‘ম্যাজিক’ এই আর্টটা তো তার অচেনা নয়। খুঁজে পেয়েছিলেন বলেই প্রতাপবাবুর মাথায় ফুলদানির বাড়ি মারার পরের মুহূর্তেই যখন দরজায় রুবিকের হাতের চাপে কলিং-বেল বেজে উঠল তখন তিনি উপায় না দেখে ওই আলমারির মধ্যে ঢুকে পড়লেন।
তারপর যা হল সেটা আমার আন্দাজ। তবে মনে হয় তোমরা ইনভেস্টিগেট করলে দেখবে আন্দাজে ভুল নেই। ওই আলমারির মধ্যে বসেই সুবিনয় মুস্তাফি মোবাইলের মেসেজে তার চ্যালাচামুন্ডাদের নির্দেশ দেন, যেভাবেই হোক বাইরে একটা গোলমাল বাঁধিয়ে ঘরে ঢুকে পড়তে। তার চ্যালারা একটা বাচ্চা ছেলেকে ঠেলা দিয়ে ফরেনসিকের গাড়ির সামনে ফেলে দিয়ে নিখুঁতভাবে গোলমালটা বাঁধিয়ে দেয়। আমরা যে-কয়েক সেকেন্ড ওই ‘মব’-এর মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম, তার মধ্যেই সুবিনয় মুস্তাফি আলমারি থেকে বেরিয়ে এই ঘর ছেড়ে পালান।
সুজনদা বুধোদার কথা শুনতে শুনতে উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। শুনলাম তিনি ফোনে থানার সেকেন্ড-অফিসারকে একটা টিম রেডি করতে বলছেন। গন্তব্য হাতিবাগান। আমরা প্রতাপবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। দরজাটা আবার সিল করতে করতে সুজনদা জিগ্যেস করলেন, বোধিসত্ত্বদা, স্কাউন্ড্রেলটা প্রতাপ রক্ষিতকে খুন করল কেন?
বুধোদা বলল, সুবিনয়বাবু ওই আলমারিটাকে মরিয়ার মতন চেয়েছিলেন— অ্যান্টিক হিসেবে নয়—ওনার জোচ্চুরির ব্যবসার মূলধন হিসেবে। ভাবতে পারছ, ওনার প্ল্যানচেটের আসরের মিডিয়ামকে যদি ওই আলমারির মধ্যে বন্ধ করে রাখা হয় আর সেখান থেকে সূক্ষ্ম-দেহে বেরিয়ে এসে যদি সে প্রশ্নের উত্তর লিখে দিয়ে যায়, তাহলে কেমন মারকাটারি বিজনেস হবে? অতি উৎসাহেই হয়তো সুবিনয় মুস্তাফি খেয়াল করেননি যে, তিনি যখন আলমারির লুকোনো চেম্বারটা খুলে দেখছেন তখনই বাইরে থেকে ঘরে ঢুকে পড়েছেন প্রতাপ রক্ষিত। ফোনে চিৎকার করে আমাদের বলতে শুরু করেছেন সব কথা।
মরিয়া সুবিনয়বাবু প্রথমে ঘরের দরজা বন্ধ করে ওনাকে আটকানোর চেষ্টা করেন। তারপরে ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে ওনাকে মেরে ফেলেন। নিশ্চয় দলিলটা তার আগেই সই করানো হয়ে গিয়েছিল। কাজেই এরপর প্রতাপবাবু খুন হলেও তার অসুবিধে ছিল না। অসুবিধে হল শুধু আমরা দু-মিনিটের মধ্যে এখানে পৌঁছে যাওয়ায়।
সুজনদা জিপে উঠতে উঠতে বললেন, চিন্তা কোরো না বোধিসত্ত্বদা। ওই লুকোনো চেম্বারের ফরেনসিক এগজামিনেশনে নিশ্চয় সুবিনয় মুস্তাফির কিছু না কিছু চিহ্ন আমরা পাবই। তারপরে ওর জবানবন্দি নেওয়ার সুযোগ তো রইলই। সুবিনয় মুস্তাফির হাতে এবার যে হাতকড়াটা পরাব, সেটা ও খুলতে পারবে না। কারণ ও হুডিনি নয়…শিল্পী নয়। ও একটা খুনি। ওর ম্যাজিক ‘খুনি ম্যাজিক’।
সমাপ্ত
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন