অ্যান্টিক আতঙ্ক – ১

সৈকত মুখোপাধ্যায়

এক

এইটা পড়—বুধোদা ওর কম্পিউটারের সামনের চেয়ারটাতে বসেই ব্যাঙ-বাজির কায়দায় একটা বেশ মোটাসোটা A4 সাইজের খাম আমার দিকে ছুঁড়ে দিল আর আমিও সেটাকে তৎক্ষণাৎ ক্যাচ লুফে নিলাম।

বুধোদার সঙ্গে এমনিতে আজকাল দেখাসাক্ষাৎ একটু কমই হয়। ওর অ্যান্টিকের ব্যবসা ‘মহারাজা কালেকশনস’ এই কয়েক বছরের মধ্যেই বেশ ফুলে ফেঁপে উঠেছে, তাই ওকে দুষ্প্রাপ্য সব জিনিসের খোঁজে সারা ভারতে দৌড়ে বেড়াতে হয়। এদিকে ইলেভেনে ওঠার পর থেকে আমারও পড়ার চাপ খুব বেড়ে গেছে; হেমকুঞ্জে আর আগের মতন প্রতিদিন যাওয়া হয় না। তবে বুধোদা মাঝে-মাঝেই আমাকে ফোন করে। বিশেষ করে অ্যান্টিক কালেকশন করতে গিয়ে অদ্ভুত কোনো অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়লে।

ওর ওই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার গল্পগুলোই আমার প্রতিদিনের ভিটামিন। বাকি জীবনটা তো শুধু ইন্টিগ্রাল আর ডিফারেনশিয়াল, অরগ্যানিক আর ইনঅরগ্যানিক। জ্বালিয়ে দিল, সত্যি।

গতকাল রাতে ফোন করে অবশ্য বুধোদা সেরকম কোনো অভিজ্ঞতার গল্প বলেনি। শুধু বলেছিল, শোন রুবিক! তোর রঘুদা কয়েকটা ডকুমেন্টস পাঠিয়েছে। বেশ ইন্টারেস্টিং। যদি দেখতে চাস তো আসতে পারিস।

বুধোদার কথা শুনে বোধহয় পাভলভ রিঅ্যাকশনেই আমার মাথার চুলগুলো সব খাড়া হয়ে গেল। আসলে বুধোদার বন্ধু এই রঘুদা, মানে চান্ডিলের রঘুনাথ দ্বিবেদীর একটা চিঠির সূত্র ধরেই আমরা কিছুদিন আগে মাদলপাহাড়ের বামনসন্ন্যাসীর কাছে পৌঁছিয়ে গিয়েছিলাম।

সেবার যদি অন্য গ্রহের যন্ত্রদানব গুঙ্গাদানোর বুকের ব্যাটারি মোক্ষম সময়ে শেষ না হয়ে যেত তাহলে মাদলপাহাড়ের একটা গুহায় এতদিনে আমার আর বুধোদার কঙ্কাল পড়ে থাকত। তাই মনে মনে ভাবলাম, আবার রঘুদা? আবার ডকুমেন্টস? তার মানে কি আবার একটা কেলেঙ্কারিয়াস গোছের কিছু হতে যাচ্ছে? মনের উত্তেজনা মনেই চেপে রেখে বুধোদাকে বললাম, কাল তো নেতাজীর জন্মদিন, আমার স্কুল ছুটি। সকালেই দেখা করছি তাহলে?

হ্যাঁ, আসিস। মা বলছিল মাছের কচুরি বানাবে। সাড়ে-আটটার আগে এলে পেয়ে যাবি। এই বলে বুধোদা ফোন রেখে দিয়েছিল।

বলা বাহুল্য, আজ ঠিক সময়েই চলে এসেছি এবং বুধোদার ঘরের পেল্লায় পালঙ্কের ওপর বসে, কোলের ওপর থালা নিয়ে, জ্যাঠাইমার বানানো সেই অনবদ্য মাছের কচুরি খান আষ্টেক শেষ করেছি। বুধোদা ডেস্কটপের সামনে বসেই খাওয়া সারল এবং হাতের তেল মাথায় আর দাড়িতে মুছে নিয়ে আবার ঝুঁকে পড়ল মনিটরের ওপর। এইরকমই ওর স্বভাব। যখন যেটা করে একেবারে হান্ড্রেড পার্সেন্ট মন দিয়ে করে। তবে ট্র্যাকসুট পরে আছে দেখে বুঝতে পারছিলাম ভোরের দিকে মর্নিং-ওয়াকটা সেরে এসেছে। ফিটনেসের ব্যাপারে বুধোদা ভয়ঙ্কর খুঁতখুঁতে। মানে, ওখানেও হান্ড্রেড পার্সেন্ট।

আমার মন চাইছিল তখনই বুধোদাকে বলি, কই, রঘুদা কীসব পাঠিয়েছে বলছিলে, সেগুলো দাও! কিন্তু তার আগে কালো-সাদা মার্বেল টাইলসে মোড়া বিশাল বারান্দার বেসিনে হাত ধুতে যেতে হল আর সেখানে গিয়েই একটু দেরি হয়ে গেল। উত্তরপাড়ার বনেদী মজুমদার-ফ্যামিলির বসতবাড়ি, একশো-আঠেরো বছরের পুরোনো এই হেমকুঞ্জের পূবের বারান্দার ঠিক নীচ দিয়েই বয়ে চলেছে গঙ্গা। কোনাকুনি উল্টোপাড়ে দক্ষিণেশ্বরের মন্দির আর তার একটু পেছনে নদীর ওপরে একটা বিশাল রুপোলি বিছের মতন আড়াআড়ি শুয়ে রয়েছে বিবেকানন্দ সেতু। বিখ্যাত সরোদিয়া মানস ব্যানার্জি প্রতিদিনের মতন ওনার পোষা লোটন পায়রাগুলোকে বাড়ির ছাদ থেকে আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। জানুয়ারির এই সকালের উজ্জ্বল রোদে সবকিছুই যেন ক্যালেন্ডারের ছবি। মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে এইসব না দেখে ঘরে ফিরতেই পারলাম না।

ঘরে ঢুকতেই বুধোদা খামটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিল। খামের ওপরে স্টেপলার দিয়ে আটকানো রিসিট-টা দেখে বুঝলাম ওটা গতকালই ক্যুরিয়ারে বুধোদার কাছে পৌঁছেছে। মুখটা খোলাই ছিল। আমি সাবধানে ভেতরের কাগজগুলো খাটের ওপরে ঢেলে এক এক করে দেখতে শুরু করলাম। মোট পাঁচটা কাগজ। তার মধ্যে চারটে রঙিন ছবি আর বাকি কাগজটার দু-পিঠে রঘুদার কালো-পিঁপড়ের মতন গুড়িগুড়ি হাতের লেখায় ঠাসা একটা চিঠি।

স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে ছবিগুলোর দিকেই আমার চোখ চলে গেল। দেখে মনে হল কোনো বইয়ের পাতা থেকে স্ক্যান কিংবা কালার-জেরক্স করে প্রিন্ট নেওয়া হয়েছে। চারটে ছবিই কোনো না কোনো ছোট প্রাণীর। একটা ইঁদুর, একটা বড় গঙ্গাফড়িং, একটা কাঠবেড়ালি আর একটা দোয়েলপাখি। নিখুঁত ফোটোগ্রাফ। গায়ের রোঁয়া, খোলস ইত্যাদি দেখে মনে হচ্ছিল নখ দিয়ে খুঁটলে উঠে আসবে। ছবিগুলোর মধ্যে একটা ত্রিমাত্রিকতার আভাস পাচ্ছিলাম। কিন্তু কোনো ছবিটারই রং তেমন উজ্জ্বল নয়।

সেইজন্যেই মনে হচ্ছিল ফোটোগুলো পুরোনো। পুরোনো ফোটোগ্রাফ কি অ্যান্টিকের মধ্যে পড়ে? কে জানে? সাদাকালো ফোটো হলে তবু কথা ছিল। কিন্তু এগুলো তো কালারড ফোটো আর তার ইতিহাস তো খুব বেশিদিনের নয়। অবশ্য বোধিসত্ত্ব মজুমদারের যে পুরোনো জিনিস নিয়েই কারবার সেটা তার বন্ধু রঘুনাথ দ্বিবেদী ভালো করেই জানে। অ্যান্টিকের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলে সে এসব ছবি পাঠাবেই বা কেন?

আমি ছবিগুলোর দিক থেকে চোখ তুলে বুধোদার দিকে তাকালাম। দেখলাম ও এর মধ্যেই ডেস্কটপে একটা পুরোনো রাশিয়ান না ইরানি ঝাড়লণ্ঠনের ইমেজের মধ্যে ডুবে গেছে। আমি তাও ডাক দিলাম— বুধোদা!

কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বুধোদা বলল—বল!

ফোটোগুলো কি অনেক পুরোনো?

রঘুর চিঠিটা পড় না! সব বুঝতে পারবি।—ঝাড়লণ্ঠনের ছবিটা জুম করতে করতে বুধোদা জবাব দিল।

পড়লাম। তবে সেই চিঠিতে কী লেখা ছিল সেটা বলার আগে রঘুদার পরিচয়টা একটু দিয়ে রাখা দরকার।

অ্যান্টিকের খোঁজ পাবার জন্যে বুধোদাকে বহু লোকের ওপর নির্ভর করতে হয়। তারা কেউ মাইনে করা ইনফর্মার আবার কেউ ওর বন্ধু, যারা ওর এই ব্যবসার খবর রাখেন। এরকমই একজন বন্ধু হল রঘুনাথ দ্বিবেদী। রঘুনাথ দ্বিবেদীর বয়েস বুধোদার কাছাকাছি। বাড়ি ঝাড়খণ্ডের টাটানগর থেকে একটু দূরে চান্ডিল বলে একটা শহরে। বছর পাঁচেক আগে চাঁইবাসার এক অভ্রখনির মালিকের বাড়ি থেকে একটা উনিশ শতকের জার্মান টেবল-ক্লক সংগ্রহ করতে গিয়ে ওর সঙ্গে বুধোদার আলাপ হয়। তারপর গত পাঁচবছরে জঙ্গলমহলের পড়তি জমিদারবাড়ি থেকে রঘুদার কালেক্ট করে আনা ভালো ভালো শ্বেতপাথরের মূর্তি, পুরোনো গ্রামাফোন রেকর্ড, অয়েল-পেইন্টিং এমনকী ভিন্টেজ মোটরকার অবধি মহারাজা কালেকশনসের শো-রুম থেকে বিক্রি হয়ে গেছে।

রঘুদার ব্যবসা কিন্তু অ্যান্টিক সংগ্রহ নয়, কবিরাজি। চান্ডিলের দ্বিবেদী পরিবার খুব নামকরা কবিরাজ পরিবার। রঘুদাও তার পূর্বপুরুষদের সেই পেশা নিয়েই ব্যস্ত। তবে ওই পেশার কারণেই তাকে রাজবাড়ি থেকে গরিবের কুঁড়েঘর অবধি সর্বত্র যেতে হয়, আর এরকম যাতায়াতের ফলেই সে নানান আশ্চর্য জিনিসের খোঁজ পেয়ে যায়। খোঁজ পেলে সে নিজে কিছু করে না, বুধোদাকে জানায়। তার কারণ, আসল আর নকল, চোরাই আর জেনুইন, অত শত নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় কিংবা ইচ্ছে কোনোটাই ওর নেই। ও কাজটা করে স্রেফ বুধোদার সঙ্গে বন্ধুত্বের খাতিরে।

সেই যেবার মাদলপাহাড়ের রহস্যের পেছনে ছুটেছিলাম সেইবারেই রঘুদার সঙ্গে কয়েকটা রোমাঞ্চকর দিনরাত্রি কাটিয়েছিলাম আর তার মধ্যেই আমাদের সম্পর্কটা দাদা-ভাইয়ের মতন হয়ে গিয়েছিল। আমি ওকে তুমি করেই কথা বলি, ও আমাকে তুই। বুধোদার মতন ও আমার আরেকটা দাদা।

এবার রঘুদার চিঠির বক্তব্যে ঢুকে পড়ি। রঘুদা লিখেছে—

প্রিয় বোধিসত্ত্ব,

তুমি যেমন শুধু পেশার কারণেই অ্যান্টিক খুঁজে বেড়াও না—অ্যান্টিক যেমন তোমার নেশা—আমিও তেমনি শুধু কবিরাজি গাছ-গাছালির খোঁজে দলমাপাহাড়ের বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়াই না। বন আমার নেশা। বনের জন্তু, বনের পাখি আর গাছপালা—এরা আমাকে সেই কিশোর- বয়স থেকেই কী যেন এক মায়ায় বেঁধে ফেলেছে।

কিন্তু জঙ্গলে তো শুধুই পশুপাখি আর গাছপালা থাকে না। দলমাপাহাড়ের প্রাচীন-অরণ্যের মাঝে-মাঝে, অরণ্যের মতনই প্রাচীন কিছু মানুষের বসতিও রয়েছে। পাঠান, মোগলরা ভারতে আসার অনেক আগে, এমনকী সিন্ধুনদী পার হয়ে আর্যরা এই উপমহাদেশে পা রাখারও আগে থেকে ওই গ্রাম আর গ্রামের মানুষগুলো এইভাবেই জঙ্গলের মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে ছিল। ওরা ভারতের আদিবাসী।

 গত সপ্তাহে…তারিখটা ছিল সতেরোই জানুয়ারি…ওরকমই একটা গ্রামে রুগি দেখতে গিয়েছিলাম। চান্ডিল থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূরে গভীর জঙ্গলে ঘেরা সেই গ্রামটার নাম লোহুরং—মানে রক্তের রং। সার্থক নাম। কেন, সেটা একটু পরে বলছি। ভীষণ সাদামাটা সেই গ্রামটা থেকে জমাট আতঙ্ক নিয়ে ফিরে এলাম। মন থেকে কিছুতেই সেই আতঙ্কটা মুছে ফেলতে পারছি না, তাই তোমাকে এই চিঠি। কী হয়েছিল বলি।

সেদিন তিরিশ কিলোমিটার জঙ্গল ভেঙে, নিজে জিপ চালিয়ে, বিনা-পয়সায় রুগি দেখতে গিয়েছিলাম। কেন জানো? ওই সতেরোই জানুয়ারি সকালে বাজার করতে গিয়ে দেখি বাসস্ট্যান্ডের সামনের ফুটপাথে বসে একজন আদিবাসী যুবক শিশুর মতন কাঁদছে। তার বয়স বড়জোর পঁচিশ বছর হবে। সুঠাম সুন্দর স্বাস্থ্য। কোমরে একটা ধুতি অর্ধেক করে জড়ানো। গলায় রঙিন পুঁতির মালা। কানে বাঘনখের মাকড়ি আর পিঠে ধনুক। দৃশ্যটা চান্ডিলের মতন বড় শহরে এতই বেমানান যে ছেলেটাকে ঘিরে ততক্ষণে বেশ ভিড় জমে গিয়েছিল। আমি সেই ভিড় ঠেলে ছেলেটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

হয়তো ভিড়ের মধ্যে অনেকেরই তাকে সাহায্য করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু ওর ভাষা কেউ বুঝতে পারছিল না। আমি কিন্তু বুঝতে পারলাম। গত কুড়িবছর ধরে পায়ে হেঁটে দলমা পাহাড় চষে ফেলার ফলে আমি এখানকার আদিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত এগারোটা উপভাষা বুঝতে পারি।

ছেলেটার কান্নার মধ্যে জড়ানো কথাগুলো একটু মন দিয়ে শুনে চমকে উঠলাম। ও আমার নাম বলছিল। আর যা বলছিল তা শুনে একইসঙ্গে আমার চোখে জল চলে এল আর মাথার মধ্যে জ্বলে উঠল আগুন। ভাঁজ করা বাজারের থলি বগলেই রইল; আমি ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে একটা রিকশায় উঠে চলে এলাম সোজা নিজের বাড়িতে। প্রথমে ওকে কিছু জলখাবার খাওয়ালাম, কারণ, দেখেই বোঝা যাচ্ছিল বেচারা খিদেয়, তেষ্টায় আর ক্লান্তিতে নড়তে পারছে না। তারপর ওর মুখ থেকে ওর দুঃখের কাহিনি শুনলাম।

ওর নাম শঙ্কু পাহান।

ভারতের একটা ছোট্ট আদিবাসী সম্প্রদায়ের নাম বীরহোর। তার জীবিত সদস্যের সংখ্যা সাকুল্যে হাজার দশেক হবে। শঙ্কু ওই বীরহোর গোষ্ঠীর মানুষ। ওরা এখনো চাষবাস কিংবা পশুপালন জানে না। আদিম মানবদের মতন ওরাও বনের জীবজন্তু শিকার করে আর ফলমূল কুড়িয়ে খেয়ে বেঁচে থাকে।

পঁচিশ-বছর বয়সের মধ্যে সেদিনই শঙ্কু প্রথম লোহুরঙের বাইরে বেরিয়েছিল। সেদিনই প্রথম বাসে উঠেছিল। অশেষ হেনস্থার মধ্যে দিয়ে কোনোরকমে চান্ডিলে পৌঁছিয়ে তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে কাঁদতে বসেছিল। ও চান্ডিলে এসেছিল বৈদ্যরাজ রঘুনাথ দ্বিবেদীর খোঁজে। তার কারণ, ওর মেয়ে টুসাই মরে যাচ্ছে। চারবছরের মেয়ে টুসাই গত তিনদিন ধরে পেটের যন্ত্রণায় ছটফট করছে আর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে তার গা। আমিই যে রঘুনাথ দ্বিবেদী সেটা জানার পর শঙ্কু আমার হাঁটুদুটো জড়িয়ে ধরে আবার কাঁদতে শুরু করল।

অন্য গ্রামের সাঁওতাল কিংবা মুন্ডা অধিবাসীদের কাছ থেকে শঙ্কু পাহান আমার নাম শুনেছিল। তারা অনেকেই আমাকে দেবতা মানে। কিন্তু বীরহোররা চিকিৎসার জন্যে ওদের নিজেদের গোষ্ঠীর গুণিন ছাড়া কারুর ওপরে ভরসা করে না। আমি যে এতদিন ধরে এত আদিবাসী গ্রামে গিয়ে চিকিৎসা করেছি, সেদিন অবধি কোনো বীরহোর গ্রাম থেকে কিন্তু ডাক পাইনি। তাহলে এমন কী হল যে, শঙ্কু পাহান মেয়ের উপযুক্ত চিকিৎসকের খোঁজে একেবারে চান্ডিলের মতন অজানা অচেনা শহরে চলে এল?

সেই কথাটাই শঙ্কুকে জিগ্যেস করলাম। শঙ্কু যা উত্তর দিল তা শুনে রহস্য পরিষ্কার হল। শঙ্কু বলল, ওদের গ্রামের গুণিন ভিসুক পাহান স্পষ্ট বলে দিয়েছেন যে, টুসাইকে লোহুরঙের ডাইনি বাণ মেরেছে। তার এমন ক্ষমতা নেই যে টুসাইকে বাঁচায়। কাজেই তখন শঙ্কুর শেষ ভরসা বলতে আমি।

আমার ওপরে ওর ভরসা দেখেই যে চোখে জল চলে এসেছিল সেটা নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলতে হবে না। কিন্তু মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল ওই ডাইনির কথা শুনে। আমাদের এদিকে, বিশেষ করে আদিবাসীদের মধ্যে, ডাইনের কুসংস্কার একটা অভিশাপ। নিজেদের যা কিছু অকর্মণ্যতা, যা কিছু অক্ষমতা, সবকিছুর দায় ডাইনির অভিশাপের ওপর চাপিয়ে দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকাটাই এদের ট্র্যাডিশন।

এতে দু-দিক দিয়ে ক্ষতি হয়। এক তো নিরীহ বুড়োবুড়িদের ডাইনি অপবাদ দিয়ে, তাদের ওপর গ্রামের বাকি লোকজন অকথ্য অত্যাচার শুরু করে। অনেক সময় ঢিলিয়ে কিংবা আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলে। সেইসব ডাইনি হত্যার খবর নিশ্চয়ই তোমাদের ওদিকের খবরের কাগজেও মাঝেমধ্যে দেখতে পাও। আর দুই, ডাইনগিরিতে বিশ্বাসের ফলে বিজ্ঞানকে এরা গ্রামের ত্রিসীমানায় ঢুকতে দেয় না। খুঁজতে চায় না কোনো অসুখ কিংবা দুর্ঘটনার পেছনে নিতান্তই প্রাকৃতিক কোনো ব্যাখ্যা রয়েছে কিনা।

তাই শঙ্কু পাহান সেদিন যেটা করেছিল সেটা ছিল একটা বিপ্লব। ও ডাইনির তত্ত্বে বিশ্বাস না রেখে চান্ডিল শহরে আমার কাছে চলে এসেছিল। আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার সামনে সেদিন ও একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল। আমি যদি সেদিন লোহুরঙে না যেতাম, তাহলে নিজের কাছেই নিজে সারাজীবন অপরাধী হয়ে থাকতাম।

সেইজন্যেই আর দেরি না করে শঙ্কুকে আমার পাশের সিটে বসিয়ে লোহুরঙের দিকে রওনা হয়ে গেলাম। শঙ্কুর মেয়ের অসুখের ব্যাপারটা এমন কিছু জটিল ছিল না। মারাত্মক একটা ইনফেকশন হয়েছিল ঠিকই কিন্তু তার ওষুধও আমার কাছে ছিল। সূর্য ডোবার আগেই মেয়েটাকে আটআনা সুস্থ করে তুলতে পারলাম। বাকি আটআনার জন্যে রাতটাও ওখানে থাকতে হল আর তারমধ্যেই ঘটে গেল এক বীভৎস ঘটনা। সেই ঘটনার কথা পরে বলছি। তবে তার আগে সঙ্গের ছবি চারটে দেখো।

দেখে হয়তো ভাবছ এগুলো ফোটোগ্রাফ। কিন্তু তা নয়। এগুলো হাতে আঁকা ছবি। ক্যানভাসের ওপরে সম্ভবত অয়েল পেন্ট দিয়ে আঁকা, কারণ, হাত দিয়ে ছুঁলে ক্যানভাসের ওপর উঁচু হয়ে জমাট বেঁধে থাকা রঙের ব্যাপারটা দিব্যি টের পাওয়া যায়। কোনো ফোটোগ্রাফিক-পেপারের ওপরে রং অমন উঁচু হয়ে জমাট বেঁধে থাকে না। কপিগুলোতে তুমি হয়তো সেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবে না, তবে নিজের চোখে দেখলেই বুঝবে। তাছাড়া এগুলো পঞ্চাশ বছরের পুরোনো ছবি। ছবির নীচে আর্টিস্টের নামের আদ্যাক্ষর আর তারিখ সেই কথাই বলছে।

তোমার কাছেই আমি জোসেফ ডালটন হুকারের ‘হিমালয়ান জার্নাল’ বইটা দেখেছি। তাছাড়া অ্যালান অক্টাভিয়াস হিউমের ‘গেম বার্ডস অফ ইন্ডিয়া’। দুটো বইতেই অজস্র পাখি, ফুল, প্রজাপতির হাতে আঁকা ছবি রয়েছে। ওগুলো মোটামুটি দেড়শো বছর আগে আঁকা। যখন কালারড ফোটোগ্রাফির চল হয়নি তখন সারা পৃথিবীতেই উদ্ভিদ আর প্রাণীবিদ্যার বই-ই বলো আর বৈজ্ঞানিকদের নিজস্ব ক্যাটালগই বলো, সব জায়গাতেই স্পেসিমেনের হাতে-আঁকা ছবিই থাকত। কিন্তু এই ছবিগুলোর মতন এমন আশ্চর্য ছবি, যা দেখলে ফোটো বলে ভুল হয়, তেমন কোথাওই দেখিনি। তুমি কি দেখেছ বোধিসত্ত্ব? কে এই নাম না জানা শিল্পী যিনি পঞ্চাশ বছর আগে এমন নিখুঁত রঙিন লাইফ স্টাডি করেছিলেন?

একটু আগে গুণিন ভিসুক পাহানের কথা লিখলাম না? সেই-ই মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে এই ছবিগুলো আমার হাতে তুলে দিয়েছিল। ছবিগুলো ও কোথা থেকে পেয়েছিল জানো? লোহুরঙের ডাইনিবাংলো থেকে। সত্যিই ওখানে পাহাড়ের চূড়ায় ডাইনি-বাংলো রয়েছে। সেখানে ডাইনি থাকে। ভিসুক পাহান বলেছিল না, শঙ্কুর মেয়েকে ডাইনিতে বাণ মেরেছে। এই সেই ডাইনি। তাহলে কি ছবিগুলোর সঙ্গে উইচ-ক্র্যাফটের কোনো সম্পর্ক রয়েছে?

জানি না এই লেখা পড়ে তুমি হাসছ কিনা। কিন্তু একটা ব্যাপার খেয়াল করে দ্যাখো। ছবিগুলো সবই কিন্তু মৃত প্রাণীর। চোখ বন্ধ করে হাত-পা গুটিয়ে ওরা পড়ে আছে। বিজ্ঞানের বইয়ে এভাবে ছবি আঁকা হয় না। মৃতপ্রাণীকে সামনে রেখেও যদি শিল্পী ছবি আঁকেন, তিনি চেষ্টা করেন সেগুলোকে যথাসম্ভব জীবন্ত করে আঁকতে। যেমন হিউমের বইতেই যদি এই দোয়েলপাখিটার ছবি থাকতো, তাহলে নির্ঘাত সেই পাখি কোনো গাছের ডালে বসে গলা তুলে গান গাইত। এমন পালক ছেতরে শুয়ে থাকতো না।

মৃত্যুর গন্ধ ওই বাংলোর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে। মৃত্যুর গল্পও বলতে পারো। ভিসুক পাহানের মুখে পঞ্চাশবছর ধরে চলে আসা সেইসব গল্পের কয়েকটা আমি শুনেছিলাম। তখনো জানতাম না ওর নিজের আয়ু শেষ হয়ে এসেছে। ডাইনি ওকেও মারবে।

জঙ্গলের অন্ধকার থেকে চান্ডিল শহরের আলোয় ফিরে আসবার পরে হয়তো সেসব গল্পকে গল্প বলেই উড়িয়ে দিতাম। আমরা শহুরে শিক্ষিত মানুষেরা তাই তো দিই; যা-কিছু আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে তাকেই বলে দিই গাঁজাখুরি গল্প। কিন্তু আর তা পারব না। কারণ, নিজের চোখেই দেখে এলাম ডাইনির শেষ শিকার। দেখে এলাম ভিসুক পাহানের লাশ।

তুমি একবারটি এসো বোধিসত্ত্ব। রুবিককে সঙ্গে নিয়েই এসো। এতদিন তো শুধু জড়বস্তু নিয়েই নাড়াচাড়া করলে। সেসব জিনিসকে হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করা যায়, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। এবার ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না এমন একটা অ্যান্টিক আতঙ্কের চেহারা দেখেই যাও না! যে আতঙ্ক পঞ্চাশ-বছর ধরে আদিবাসী গ্রাম লোহুরঙের ওপরে কালো মেঘের মতন ঝুলে রয়েছে।

এই কথাগুলো লিখতে লিখতেই দেখতে পাচ্ছি তোমার আর রুবিকের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি। তোমরা মনে মনে বলছ, রঘুনাথ দ্বিবেদী তিলকে তাল করার বিদ্যেটা ভালোই আয়ত্ব করেছে। নইলে এক আদিবাসী গুণিনের মৃত্যুর সঙ্গে শুধুমুধু ডাইনিবিদ্যাকে জড়াচ্ছে কেন?

কী জানি, সত্যিই তিলকে তাল করছি কিনা। কিন্তু যতবার নিজের ঘরে বসে সেই মৃতদেহটার কথা ভাবছি ততবারই মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাব।

আচ্ছা বোধিসত্ত্ব, তুমি এমন কোনো মৃতদেহ দেখেছ, কিংবা এমন কোনো মৃতদেহর কথা শুনেছ, যা কাচের মতন স্বচ্ছ?

নাঃ, আর লিখতে পারছি না। বুঝতে পারছি লেখাটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। শেষ করছি। যদি আসো তাহলে বাকি কথা নিজের মুখেই বলব। ইতি…

অধ্যায় ১ / ২৫

সকল অধ্যায়

১. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ১
২. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ২
৩. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ৩
৪. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ৪
৫. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ৫
৬. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ৬
৭. অ্যান্টিক আতঙ্ক – উপসংহার
৮. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ১
৯. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ২
১০. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৩
১১. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৪
১২. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৫
১৩. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৬
১৪. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৭
১৫. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৮
১৬. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৯
১৭. খুনি ম্যাজিক – ১
১৮. খুনি ম্যাজিক – ২
১৯. খুনি ম্যাজিক – ৩
২০. খুনি ম্যাজিক – ৪
২১. খুনি ম্যাজিক – ৫
২২. খুনি ম্যাজিক – ৬
২৩. খুনি ম্যাজিক – ৭
২৪. খুনি ম্যাজিক – ৮
২৫. খুনি ম্যাজিক – ৯

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন