সৈকত মুখোপাধ্যায়
ছাব্বিশে জানুয়ারি সকাল। জামশেদপুর স্টেশনের বাইরে বুধোদার অলিভ গ্রীন এস ইউ ভি পার্ক করে রাখা আছে। আমরা একটু বাদেই বাড়ির দিকে রওনা হব। তার আগে স্টেশনে ঢুকেছি সপ্তদ্বীপা রায়কে সী-অফ করতে। ওর মা-বাবা গতকাল দুপুরেই কলকাতা থেকে চলে এসেছিলেন। রাতটা ওনারা ছিলেন চান্ডিলের একটা হোটেলে, আমরা দুজনে রঘুদার বাড়িতে। তবে সন্ধেটা আমরা সবাই একসঙ্গে রঘুদার বাড়িতে চমৎকার আড্ডা মেরে কাটিয়েছিলাম। আমার জীবনের একটা স্মরণীয় সন্ধ্যা।
বুধোদা ভালো আছে। কাল রাত অবধি ওর গলা আর মুখের চামড়া একটু লাল হয়ে ছিল। রঘুদা একটা সিন্ধুগোলাপ না বসরাই সারস কিসের যেন রস লাগানোর ফলে আজ দেখছি পুরোপুরি সেরে গেছে।
মিস সায়গল কাল রাতের ফ্লাইটেই লন্ডন রওনা হয়ে গিয়েছেন। তার আগে, কাল সকালে, আমরা সবাই মিলে প্যারিমোহন সায়গলের সেই ভয়ঙ্কর ছবির অ্যালবাম আর যত কাচের পুতুল সব টুরা নদীর তীরে দাহ করে এসেছি। ও হ্যাঁ, অ্যালবামের বাইরে দুটো ছবি ছিল। দুটোই পূর্ণবয়স্ক মানুষের ছবি। একটা পঞ্চাশ বছরের পুরোনো ছবি, শিবানী রায়ের। অন্যটার উৎপত্তি হয়েছে এই সেদিন। সেটা ভিসুক পাহানের ছবি। সেই ছবিদুটোকেও আমরা নদীর তীরে সৎকার করেছি। শিবানী রায় আর ভিসুক পাহানের কাচের মূর্তিদুটো তো আগেই তাদের আত্মীয় বন্ধুরা সৎকার করে ফেলেছেন।
‘সৎকার’ কথাটা বারবার ব্যবহার করছি একটাই কারণে। প্রতিটা ছবিই তো আসলে একটা মৃতদেহের অংশ, যেমন প্রতিটা কাচের পুতুলও মৃতদেহের অংশ। আর মৃতদেহের সৎকারই করা যায়, অন্য কিছু নয়।
প্যারিমোহন সায়গলের আবিষ্কৃত ওই আশ্চর্য লোহার প্ল্যাটফর্মের ওপর ওজন চাপলেই চালু হয়ে যায় বিদ্যুতের সার্কিট। যদি সেই ওজন জীবন্ত কোনো প্রাণীর হয় তাহলে সেই প্রাণীর আর নড়াচড়া করার ক্ষমতা থাকে না। ইতিমধ্যে স্বচ্ছ পাথরের স্ল্যাব তাকে পিষে ফেলতে থাকে আর লেন্সের মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে পড়া অদ্ভুত আলো তার শরীরের সমস্ত রঙিন পিগমেন্টকে নিংড়ে নিয়ে জড়ো করে লোহার বিছানার ওপরে পেতে রাখা মসৃণ চামড়ার চাদরের ওপরে। পড়ে থাকে কাচের মতন বিবর্ণ কঠিন শরীরটুকু, যাকে গতকাল অবধি আমরা সবাই কাচ ভেবেছি।
উন্মাদ বৈজ্ঞানিক কেন যে অমন ভয়ঙ্কর যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন তা বলতে পারব না। তবে ওই আবিষ্কারের ফলে প্রতিটি জীবন্ত প্রাণীর শরীর থেকে তৈরি হত দুটো জিনিস। একটা রঙিন ছবি আর একটা কাচের মূর্তি।
গতকাল ভোরে, স্টুডিও-ঘর থেকে বেরিয়ে, আমি, বুধোদা, রঘুদা, সপ্তদ্বীপা আর মিস সায়গল—সবাই মিলে মিস সায়গলের ড্রইং-রুমে বসেছিলাম। মিস সায়গল কাঁদছিলেন। দীপা ওনাকে দু-হাতে জড়িয়ে রেখেছিল।
উনি কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, আমি তোকে অনেক কষ্ট দিলাম দীপা। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি শুধু চেয়েছিলাম এই কমবয়সি ছেলেগুলো যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই অভিশপ্ত বাংলো ছেড়ে চলে যায়। আর কিছু না। তুই যতই ওদের সঙ্গে কথা বলতিস, যতই ওদের কাছে খুলে বলতিস তোর নিজের দিদিমার কথা কিংবা কাচের পুতুলের কথা, ততই ওদের রহস্যভেদের রোখ চেপে যেত।
তবু দ্যাখ, আটকাতে তো পারলাম না। যা ভাবছিলাম ঠিক তাই হল।
বুধোদা একবার শুধু জিগ্যেস করেছিল, স্টুডিও-ঘরের ভেতরের ওই মেশিন কেমন করে কাজ করে তা আপনি জানতেন না, তাই না?
আজকের আগে সত্যিই জানতাম না, মিস্টার মজুমদার। বিশ্বাস করুন। পঞ্চাশ বছর আগে লোহুরঙে আমি মহা আতঙ্কে দিন কাটাতাম। প্রথমে আমার প্রিয় কুকুর জিজো ওই ঘরে ঢুকে মরে গেল। তারপর আমার একমাত্র সঙ্গী শিবানীদিদি। কেন যে শিবানীদিদি ওই ঘরে ঢুকেছিল, কে জানে। যাই হোক, এই দুটো মৃত্যু আমাকে পাথর করে দিয়েছিল। তাই গ্রামবাসীরা যখন আমাকে ডাইনি বলে মারতে উঠল তখন সেটা আমার পক্ষে শাপে বর হল। আমি লোহুরঙের নরক থেকে মুক্তি পেলাম।
রঘুদা অনেকক্ষণ ধরে হাতের ওপর থুতনি রেখে কী যেন ভাবছিল। ও এবার বলল, মেশিনের পুরো ওজনটাই ওঠা-নামা করত হাইড্রলিক প্রেসের সাহায্যে। এক একটা মৃত্যু মানে মেঝের নীচের জলের ট্যাঙ্ক থেকে সমস্ত জল বেরিয়ে টানেলের মধ্যে দিয়ে টিলা-র গায়ে ছড়িয়ে যাওয়া। তাই মৃত্যু মানেই ওই ধসের জমি ভিজে লাল হয়ে ওঠা। রক্তের মতন লাল। ওঃ, কী ভয়ঙ্কর!
বুধোদা বলল, আমারও তাই মনে হয়। ওই হাইড্রলিক প্রেস আসলে ছিল মিস সায়গলের দাদু জানকীনাথের লেদার ফিল্টার বানানোর মেশিনের ড্রাইভ। পুরো প্ল্যাটফর্মটাই তাই। এককালে ওর ওপরে চামড়ার শিট রেখে, তাকে চাপ দিয়ে, সাধারণ ফিল্টারই বানানো হত। পরে প্যারিমোহন সায়গল ওটাকে নিজের মতন করে মৃত্যুযন্ত্রে বদলে নেন।
গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস সিটি বাজিয়ে নড়ে উঠতেই আমি অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এলাম।
আমরা তিনজনেই দীপাদের জানলার কাছ থেকে একটু সরে দাঁড়ালাম। আঙ্কল আর আন্টি আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে হাত নাড়লেন। আঙ্কল গলা তুলে বললেন, আমাদের বাড়ি আসবেন কিন্তু মিস্টার মজুমদার। আন্টি বললেন, রুবিক, তুমিও এসো। ভুলো না যেন।
আমি দীপাকে লক্ষ করছিলাম। ওর মুখে সেই চেনা হাসিটা নেই। ভীষণ গম্ভীরমুখে উল্টোদিকে তাকিয়ে বসেছিল। হঠাৎ আমার একটা জরুরি কথা মনে পড়ে গেল। আমি চটপট ব্যাগ থেকে ক্ষণিকা বইটা বার করে জানলার কাছে এগিয়ে গেলাম। বললাম, দেখেছ, আর একটু হলেই ভুলে যাচ্ছিলাম। তোমার বইটা যে আমার কাছে থেকে যাচ্ছিল।
দীপা খুব ক্যাজুয়ালি হাত বাড়িয়ে বইটা নিয়ে দু-একটা পাতা উলটিয়েই ওটা ওর ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখল। ও আমার দিকে তাকাল না। হাতও নাড়ল না। কিন্তু একটা চাপা হাসি একমুহূর্তের জন্যে ওর ঠোঁটে খেলা করে গেল।
গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস স্পিড তুলে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। আমি আর বুধোদাও স্টেশন থেকে বেরিয়ে রঘুদাকে টা-টা করে হাইওয়ে ধরলাম। এইসব ফাঁকা জায়গায় বুধোদা আমার হাতে স্টিয়ারিং ছেড়ে দেয়। আমিই চালাচ্ছিলাম। বুধোদা পাশে বসেছিল।
বড় জোর মিনিট পাঁচেক চালাবার পরেই আমার সেলফোনে পিড়িং করে সেই মেসেজটা ঢুকল, যেটার জন্যে এতক্ষণ ওয়েট করছিলাম।
‘এই নাকি উত্তরপাড়া গভমেন্ট স্কুলের ফার্স্ট বয়! বইয়ের পাতার মধ্যে মোবাইল-নাম্বার পাঠানো হয়েছে? বিচ্ছু!’
বুধোদা আড়চোখে আমার দিকে তাকাল। বলল, রুবিক, গাড়িটা সাইড করে দাঁড় করা। আমাকে ড্রাইভ করতে দে। লোহুরঙের ডাইনি-বাংলোয় ছবি হওয়ার হাত থেকে সদ্য বেঁচে ফিরলাম। এখন আর অন্যমনস্ক ড্রাইভারের হাতে মরতে একটুও ইচ্ছে করছে না।
***
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন