কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৯

সৈকত মুখোপাধ্যায়

ম্যানেজারের বাংলোয় ডিনার-টেবিলকে ঘিরে সাজিয়ে রাখা চেয়ারগুলোয় আমরা চারজন বসে আছি। আমি, বুধোদা, সুধাবিন্দু বসাক আর অর্ণব বসু। আমাদের প্রত্যেকের সামনে ব্যাভেরিয়ার মিটারটাইখ কোম্পানির শ্বেতশুভ্র প্লেট। দেখে মনে হতে পারে, এখনো প্লেটগুলোয় খাবার সার্ভ করা হয়নি, কিন্তু আসলে তা নয়। আমরা ব্রেকফাস্টটা এমনই চেটেপুটে খেয়েছি যে, ওরকম মনে হচ্ছে। একে তো সেই ভোরবেলা থেকে দৌড়োদৌড়ি করে প্রত্যেকেরই খিদে পেয়েছিল প্রচন্ড। উপরন্তু একটু আগে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ওয়ারলেস সেটে মেসেজ এসেছে, মিস্টার জোসেফের কোনো চোটটাই খুব একটা গভীর নয়। ওনার আপাতত কোনো বিপদ নেই। উপরন্তু ডাম্পির মনের ভেতরে জমে থাকা ভয়ের মেঘ কেটে গেছিল বলেই কিনা কে জানে, আজকে ওর বানানো এগ-স্ক্র্যামবল আর হ্যাম স্যান্ডউইচের টেস্ট হয়েছিল একেবারে বিন্দাস।

এইমাত্র আমাদের কফি সার্ভ করে ডাম্পিভাই নিজেও একটা কাপ হাতে নিয়ে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। বুঝতে পারছি, বুধোদার মুখে নেকড়ে-মানুষ রহস্যের ভেতরের কথা শুনবার আগ্রহটা আমাদের থেকে ওর কম নয়।

আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বুধোদা বোধহয় বুঝতে পারল, আর অপেক্ষা করানো ঠিক নয়। তাই কফির কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলতে শুরু করল—

মিস্টার বসাক, আপনি আমাদের উত্তরপাড়ার বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় রুবিককে বলেছিলেন কুকড়াঝোরাকে নিয়ে নানা রকমের ভুতুড়ে গল্প চালু আছে। ব্যাপারটাকে খুব একটা পাত্তা দিইনি। ভুতুড়ে গল্প এক জিনিস আর নিজের চোখে ভূত দেখা আরেক।

তাই যখন প্রথমদিনই ডাম্পি আমাদের জানাল এই বাগানে নেকড়ে-মানুষ ঘোরাঘুরি করছে তখন একটা বড় ধাক্কা খেলাম।

ডাম্পির মুখে একশো-পনেরো বছর আগে সুবেশ তির্কের ভয়ঙ্কর মৃত্যুর কথা শুনলাম। শুনলাম নেকড়ে-মানুষের কবলে গ্যাবন উইলিয়াম, তার পাহারাদার আর তার কুকুরের মৃত্যুর ঘটনাও।

আমাদের ভাগ্য ভালো, প্রায় একশো-পনেরো বছর পরেও ঘটনাগুলোর ডিটেইলস হারিয়ে যায়নি। কোথাও কোনো লিখিত নথি নেই। এক পুরুষের কাছ থেকে তার পরের পুরুষ শুনেছে। তার কাছ থেকে তার পরের পুরুষ। তবু সেই সময়ে ঠিক যা হয়েছিল, তাই-ই আমরা আজও জানতে পারছি। এই হচ্ছে ফোকলোরের মজা। যাই হোক, এরকমই একটা ডিটেইলস শুনে প্রথম আমার মনে হল হয়তো পুরোটাই গাঁজাখুরি গল্প নয়। নেকড়ে-মানুষের অলৌকিক গল্পের মধ্যে কোথাও হয়তো একটা বাস্তব ব্যাখ্যা থাকতে পারে।

সেই ডিটেইলসটা কী জানেন? নেকড়ে-মানুষ উইলিয়াম সাহেবের কুকুরটার মাংস ছিঁড়ে খেয়েছিল, কিন্তু উইলিয়াম সাহেবের গা থেকে এক টুকরো মাংসও খায়নি। তাকে শুধু মেরেই খান্ত হয়েছিল।

একসেলেন্ট!—মন্তব্যটা করলেন অর্ণববাবু। তাকিয়ে দেখলাম উনি হাসি হাসি মুখে ঘাড় নাড়ছেন। আবার বললেন, রিয়েলি একসেলেন্ট!

সুধাবিন্দুবাবু বললেন, দিস ইজ আনফেয়ার অর্ণব। তুমি আর মিস্টার মজুমদার এর মধ্যে কী সূত্র খুঁজে পেলে জানি না, কিন্তু আমি আর রুবিক তো পুরো অন্ধকারে।

অর্ণবববাবু বললেন, লেট মি এক্সপ্লেইন। যে কোনো জন্তুরই কিছু স্বাভাবিক শিকার থাকে, যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘Natural prey’। যে সব লেপার্ড মানুষের ঘরবাড়ির আশেপাশে ঘোরাফেরা করে, তাদের ‘ন্যাচারাল প্রে’ কুকুর। কিন্তু মানুষ তার ‘ন্যাচারাল প্রে’ নয়। করবেট সাহেবের লেখাগুলো পড়লে বুঝবে, কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতি না পড়লে চিতাবাঘ কখনো খাওয়ার জন্যে মানুষ মারে না। অন্য কারণে মারতে পারে।

বুধোদা বলল, ঠিক তাই। তখনই আমার প্রথম মনে হয়েছিল চিতাবাঘের কথা। এর থেকেই আরো একটা চিন্তা মাথায় এল। একশো-পনেরো বছর আগে চারিদিকে নিশ্চয় জঙ্গল আরো বেশি ছিল। এই সব এলাকায় বুনোশুয়োর, খরগোশ, হরিণের মতন শিকার দুর্লভ ছিল না। তবু সেই চিতাটাকে চা-বাগানে ঢুকে কুকুরটাকে মারতে হল কেন?

এর একটাই উত্তর— চিতাটা এই চা-বাগানেই ঘাঁটি গেঁড়েছিল আর এই চা-বাগান ছেড়ে, আরো প্রিসাইজলি বলতে গেলে ওই চার্চের চৌহদ্দি ছেড়ে দূরে কোথাও যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

চিতার মতন এমন একটা জন্তু, যে এমনিতে কয়েক স্কোয়ার-মাইল এরিয়া নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, সে কখন এরকম ছোট জায়গায় বন্দী হয়ে পড়ে? এনি গেস?

বুধোদা আমার আর সুধাবিন্দুবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।

অর্ণববাবু দেখলাম আবার সেইরকম অ্যাপ্রিসিয়েসনের হাসি হাসছেন, কিন্তু আমাদের শুকনো মুখে মাথা নাড়তেই হল।

বুধোদাই উত্তরটা দিয়ে দিল। বলল, যখন সে সবে মা হয়। যখন তার লুকিয়ে রাখা আস্তানায় ছোট ছোট বাচ্চা থাকে।

মাই গড! সুধাবিন্দুবাবু প্রায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তার মানে সেই চিতাটা এই চা বাগানে এসে বাচ্চা দিয়েছিল? দাঁড়ান দাঁড়ান! এখন বুঝতে পারছি উইলিয়াম সাহেবকেই বা কেন জন্তুটা ওরকম ফেরোসাসলি অ্যাটাক করেছিল। উইলিয়াম সাহেব তার কুকুরকে খুঁজতে খুঁজতে নিশ্চয় ওর ডেরার খুব কাছাকাছি পৌঁছিয়ে গিয়েছিলেন। হয়তো চিতার বাচ্চাগুলো ওনার সামনে পড়ে গিয়েছিল আর…।

এগজ্যাক্টলি! সুধাবিন্দুবাবুর মুখের কথা শেষ হবার আগেই অর্ণববাবু সায় দিলেন। পিওর অ্যানিমাল ইনস্টিঙকট। এমনিতে লেপার্ড মানুষ দেখলে দূরে সরে যায়। কিন্তু সঙ্গে বাচ্চা থাকলে সে কিছুতেই পালাবে না। সে অ্যাটাক করবে। একশো-পনেরো বছর আগে এই চা-বাগানে ঠিক তাই হয়েছিল। মিস্টার মজুমদারের ডিডাকশনে কোনো ভুল নেই।

বুধোদা কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রেখে বলল, ওই উনিশশো সাল নাগাদ ইওরোপের লোকের মনে ওয়ারউলফের ভয়টা আজকের থেকে অনেক বেশি গভীর ছিল। সুবেশ তির্কে কে উইলিয়াম সাহেব একরকম খুনই করেছিলেন। এইরকম সব ক্ষেত্রেই তো প্রতিশোধ নেবার জন্যে ওয়ারউলফের জন্ম হয়। কুকড়াঝোরা টি-এস্টেটের হাতে গোনা কয়েকজন ইওরোপিয়ান কর্মচারী ভাবল, এখানেও বোধহয় তাই হয়েছে। তারাই রটিয়ে দিল, সুবেশ তির্কে ওয়ারউলফ হয়ে গেছে।

একটা কথা জিগ্যেস করব?—আমি আর না পেরে বলে উঠলাম।

বল। বুধোদা বলল।

জঙ্গলে এত জায়গা থাকতে চিতাবাঘটা ওই চার্চের জমিতে বাচ্চা দিতে এসেছিল কেন?

এটাও ন্যাচারাল ইনস্টিঙকট। চিতাবাঘ তো বেড়ালজাতীয় প্রাণী। বেড়ালের বাচ্চাকে যেমন হুলোয় মেরে ফেলে, তেমনই চিতার বাচ্চাকেও পুরুষ চিতা মেরে ফেলে। তাই মা-চিতা অনেক সময়েই জঙ্গল থেকে দূরে কোনো নিরিবিলি জায়গায় বাচ্চা দেয়। জঙ্গলে ফেরে বাচ্চারা কিছুটা বড় হয়ে গেলে তারপর।

বুঝলাম। তারপর বল।

তখনকার নেকড়ে-মানুষের আসল রূপ ডাম্পির গল্প শুনতে শুনতেই আন্দাজ করেছিলাম। ভাবছিলাম, এখনকার নেকড়ে-মানুষটি কে? এমন কপাল, তার পরিচয় পাবার জন্যেও বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। সেদিনই ভোর রাতে আমাদের এই বাংলোর পেছনের দরজায় নেকড়ে-মানুষ হানা দিল।

আমি বুধোদার বলার ভঙ্গিতে হাসি চাপতে পারলাম না। বললাম, বুধোদা, আসলে তো টুইনস কে নিয়ে কুইন এসেছিলেন, একটু আগে যিনি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে গেলেন?

বিলকুল। বলল বুধোদা। বাচ্চাগুলোকে আজ যেমন দেখলাম, তাতে মনে হল, ওদেরও মায়ের দুধ ছেড়ে মাংস খাবার বয়স হয়ে গেছে। তাই তো অর্ণববাবু?

অর্ণববাবু বললেন, হ্যাঁ, মাস চারেকের বাচ্চা।

তাহলেই ভাব? নিজের প্লাস দুটো বাচ্চার খাবার। কুইন জোটাবে কোত্থেকে? তাই ঠ্যাঙে দড়ি-বাঁধা দেশি মুরগির গন্ধে তিনি আমাদের কিচেনে হানা দিয়েছিলেন। আর তার পাগ-মার্ক দেখে আমাদের রুবিকবাবুর একেবারে প্যান্টে…।

চুপ চুপ চুপ! আমি টেবিল ডিঙিয়ে বুধোদার ঘাড়ে গিয়ে পড়লাম।

আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আর কিছু বলছি না। বুধোদা হাত তুলে আমাকে ঠেকাল। তারপর বলল, চুপ করে শোন। আসল রহস্য এরপরেই শুরু হচ্ছে। সেটা হচ্ছে মিস্টার জোসেফ সুবিমল তির্কের মিথ্যে গুজব ছড়ানোর রহস্য।

মিস্টার জোসেফ যে রক্তের টানে এই কুকড়াঝোরায় ফিরে এসেছেন সে কথা মিথ্যে নয়। মিস্টার জোসেফ যে সেই টানেই পুরোনো গির্জা নিজের হাতে সাফ করেছেন তাও মিথ্যে নয়। এমনকী সেই টানেই যে তিনি হেনরি সুবেশ তির্কের সমাধির সামনে প্রত্যেকদিন গিয়ে দাঁড়াতেন সে কথাটাকেও মিথ্যে ভাবার কোনও কারণ নেই। ওনারই খালি পায়ের ছাপ আমরা কাল সুবেশ তির্কের কবরের সামনে দেখেছি। তিনি উদার, তিনি মহৎ। তিনি এই চা-বাগানের গরিব ছেলেমেয়েদের নিজের পয়সায় লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার ব্রত নিয়েছেন। তাহলে তিনি কেন চিতাবাঘকে নেকড়ে-মানুষ বলে প্রচার করছেন?

অর্ণববাবু বললেন, একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। কাল সুধাবিন্দুর মুখ থেকে ডরোথি টি-গার্ডেনে বাচ্চা হারানোর কথা শুনেই ওখানে লোক পাঠিয়েছিলাম। অল বোগাস। ওখানে এরকম কোনো ইনসিডেন্ট হয়নি। ওটাও মাস্টারসাবের বানানো গল্প।

বুধোদা বলল, সেরকমই আন্দাজ করেছিলাম। যাই হোক, মাস্টারসাবের মোটিভটা বুঝবার জন্যে পেছনদিক থেকে ভাবতে শুরু করলাম। তাহলে কি তিনি কোনো কারণে এই চা-বাগানের মানুষজনকে ওই চার্চের দিকে যেতে দিতে চাইছিলেন না?

কিন্তু কেন? ওখানে কি তিনি এমন কোনো সম্পদের সন্ধান পেয়েছেন যা অন্য কারুর চোখে পড়ে গেলে তার ক্ষতি হবে? যদি তাই হয়, তাহলে দুটো প্রশ্ন। কী সেই গুপ্তধন? আর সেই গুপ্তধন তিনি ওখানে ফেলে রেখেছেন কেন?

কাল দিনের বেলায় চার্চে গিয়ে এর কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না। পেলাম শুধু পুরনো চার্চের প্যারিস-রেজিস্টার। সেখানে বলা আছে হেনরি সুবেশ তির্কের মৃতদেহের সঙ্গে তার সমস্ত পার্থিব সম্পত্তি কবর দেওয়া হল। কী এমন পার্থিব সম্পত্তি থাকতে পারে একজন চা-বাগানের কুলির কাছে? বুঝতে পারছিলাম না।

কাল রাতের বেলায় কবরখানায় হানা দিয়েও কোনো লাভ হল না। নতুন কোনো তথ্য পেলাম না। শুধু চিতাবাঘিনী যে একেবারে সুবেশ তির্কের কবরের মধ্যেই বাচ্চা দিয়েছে এইটুকু সিওর হলাম। লাভের মধ্যে রুবিকের আরেকটু হলে চিতাবাঘের বাচ্চার কান্না শুনে আর সেই কান্না শুনে ছুটে আসা চিতা-মায়ের সিল্যুয়েট দেখে হার্ট-অ্যাটাক হয়ে যাচ্ছিল।

বুধোদাআআ! আমি আবার ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম। এবার সুধাবিন্দুবাবুই আমার হাত ধরে বসালেন। বললেন, রুবিক, তুমি সত্যিই খুব সাহসি ছেলে। আমি মিস্টার মজুমদারের কাছে সব শুনেছি। ওই পরিবেশে অমন দৃশ্য দেখলে তোমার বয়সি অনেক ছেলেই সত্যিকারেই অজ্ঞান হয়ে যেত।

বুধোদা বলল, সত্যিই তাই। আমিও ভয় পেয়েছিলাম। তবে সেটা লেপার্ড-অ্যাটাকের ভয়। যাই হোক, যা বলছিলাম। তারপর আজ সকালেই রুবিকের পকেট থেকে গড়িয়ে পড়ল টি-গার্ডেন টোকেন। সে গল্প তো আপনাদের কাছে ইতিমধ্যেই করেছি।

ওই টোকেনটা দেখেই মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। মনে হল, কি বোকা আমি! এতবছর ধরে অ্যান্টিক নিয়ে চর্চা করছি, আর এই সামান্য ব্যাপারটা মাথায় এল না যে, হেনরি সুবেশ তির্কের পার্থিব সম্পত্তির মধ্যে তার জমানো টি-গার্ডেন টোকেনগুলো থাকতে পারে? সেদিন যা ছিল এক চা-বাগানের কুলির সামান্য সঞ্চয়, যে সঞ্চয় নিয়ে সে পাড়ি দিতে গিয়েছিল ডুয়ার্স থেকে নিজের দেশে, সেই টোকেনগুলোই তো আজ অমূল্য অ্যান্টিক।

আমার মনে হয়, চার্চে ঘোরাঘুরি করার সময় প্যারিস রেজিস্টারটা কোনোভাবে মিস্টার জোসেফের চোখে পড়ে যায়। যে কথা আমার মাথায় আসেনি, চা-বাগানের ছেলে হওয়ার জন্যে সে কথা মিস্টার জোসেফের সঙ্গে সঙ্গেই মাথায় এসেছিল। তারপর তিনি বাজারদর যাচাই করার জন্যে সুবেশ তির্কের কবরের ইঁট আলগা করে ভিতর থেকে কোনোরকমে এক-দুটো টোকেন বার করেছিলেন আর সেরকম একটা টোকেনই খেলা করতে করতে কোনোরকমে গাপ্পির হাতে পড়ে যায়। সেখান থেকে চলে আসে রুবিকের পকেটে।

কিন্তু এমনই তাঁর কপাল, ঠিক সেই সময়েই একশো-পনেরো বছর আগে যা ঘটেছিল তারই রিপিট-টেলিকাস্ট শুরু হল। মা-চিতা বাচ্চা দেওয়ার জন্যে ওই কবরটাকেই আবার বেছে নিল আর তার ফলে অন্তত চারমাসের জন্যে ওই কবরের দিকে যাওয়াই তাঁর বন্ধ হয়ে গেল।

অপেক্ষা করতে তার অসুবিধে ছিল না, যদি না ইতিমধ্যে বাগান বিক্রির তোড়জোড় শুরু হয়ে যেত। এর মধ্যে বাগানের লোকেদের ওদিকে আসা-যাওয়া আটকানোর জন্যে মিস্টার জোসেফ সেই নেকড়ের মিথকেই আবার অস্ত্র করলেন। তাতে কাজ হল। ডাম্পি এবং তার সহকর্মীরা ওই টিলাকে এড়িয়ে যেতে শুরু করল। কিন্তু উটকো আপদের মতন ঠিক তখনই আমি আর রুবিক এসে পৌঁছলাম।

কাল সকালে আমরা চার্চ থেকে ফিরে আসার পরে কোনও এক সময়ে মিস্টার জোসেফ নিশ্চয় আবার ওখানে ফিরে গিয়েছিলেন। দেখেছিলেন, প্যারিস রেজিস্টার হাওয়া এবং সঙ্গে-সঙ্গেই বুঝতে পেরেছিলেন আর সময় নেই। মরিয়া হয়ে মিস্টার জোসেফ আজ সকালে আক্ষরিক অর্থে বাঘের গুহায় পা দিলেন।

উনি যদি আর একটা দিন সময় পেতেন তাহলে একেবারে বিনা বাধায় ওগুলো হস্তগত করতে পারতেন। কারণ, একটু আগে আমরা নিজেদের চোখেই দেখলাম বনের পশু বনে ফিরে গেল। বাচ্চারা বড় হয়ে গেছে, মা-চিতার আর এখানে থাকবার দরকার নেই। তবে একেই বোধহয় বলে ভাগ্য। সেই সময়টা মিস্টার জোসেফ পেলেন না।

আমাদের মাঝখানে টেবিলের ওপর একটা রুমালের মধ্যে রাখা ছিল প্রায় পঞ্চাশটা বিভিন্ন ডিনোমিনেশনের টি-গার্ডেন টোকেন। সুবেশ তির্কের সঞ্চয়। আমাদের সবার চোখ ঘুরে গেল ছোট ছোট মেটালের চাকতি দিয়ে তৈরি ওই স্তূপটার দিকে। অনেকক্ষণ কেউই কোনো কথা বলতে পারলাম না। তারপর বুধোদাই সবার আগে নিস্তব্ধতা ভেঙে বলল, মিস্টার বসাক, একটা রিকোয়েস্ট আছে।

বলুন মিস্টার মজুমদার।

আপনার টি-গার্ডেনের ভেতর থেকে এই টোকেনগুলো পাওয়া গেছে। এখনকার বাজারে এর দাম খুব কম করে হলেও পনেরো লক্ষ টাকা। এই টাকাটা আপনার মতন একজন ব্যবসায়ীর পক্ষে কিছুই নয়, কিন্তু মিস্টার জোসেফের কাছে অনেক। আমার অনুরোধ এগুলো বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে তা আপনি মিস্টার জোসেফের হাতেই তুলে দিন।

সুধাবিন্দুবাবু অবাক চোখে বুধোদার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

বুধোদা আবার যখন কথা বলল তখন দেখলাম ওর গলাটা একটু ভারী শোনাচ্ছে। বুধোদা বলে চলল—মিস্টার জোসেফ জান বাজি রেখে এগুলোকে উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন, নিজের জন্যে নয়। এই বাগানের ছোট-ছোট ছেলে-মেয়েগুলোর জন্যে। গত কুড়ি বছরে উনি নিজের সমস্ত সঞ্চয় শেষ করে ফেলেছিলেন ওদের পড়াশোনা শেখানোর কাজে। আর কোথাও থেকে পয়সা জোগাড় করতে না পেরেই উনি এই মৃতের সঞ্চয়ে হাত দিয়েছিলেন। হয়তো ধর্ম কিম্বা সমাজের চোখে এটা খুবই ঘৃণিত কাজ, কিন্তু মানবিকতার দিক থেকে যদি দেখি?

অর্ণববাবু বললেন, একটু ইন্টারফেয়ার করছি। সুধা, তুমি আর একটা ব্যাপার ভেবে দ্যাখ। একজন গরিব কুলির জমানো টাকা একশো-পনেরো বছর বাদে সেই চা-বাগানেরই লেবারদের ছেলেমেয়ের পড়াশোনার কাজে লাগবে, তাও আবার তার নিজেরই বংশধরের হাত দিয়ে—এর চেয়ে জাস্টিফায়েড আর কী হতে পারে? আমার মনে হয় সুবেশ তির্কের আত্মা যদি কোথাও থেকে থাকে, সে-ও এটাই চাইবে।

সুধাবিন্দুবাবু বললেন, এগ্রিড। তোমাদের কথা মেনে নিলাম। শুধু সুবেশ তির্কের আত্মা কেন, দীনদরিদ্রের প্রভূ যীশাস ক্রাইস্টও নিশ্চয় এতে খুশি হবেন।

ডাম্পিভাই জানলার কাছ থেকে এগিয়ে এসে বুকে ক্রশ এঁকে বলল ‘আমেন’।

সকল অধ্যায়

১. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ১
২. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ২
৩. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ৩
৪. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ৪
৫. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ৫
৬. অ্যান্টিক আতঙ্ক – ৬
৭. অ্যান্টিক আতঙ্ক – উপসংহার
৮. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ১
৯. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ২
১০. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৩
১১. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৪
১২. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৫
১৩. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৬
১৪. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৭
১৫. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৮
১৬. কুকড়াঝোরার নেকড়েমানুষ – ৯
১৭. খুনি ম্যাজিক – ১
১৮. খুনি ম্যাজিক – ২
১৯. খুনি ম্যাজিক – ৩
২০. খুনি ম্যাজিক – ৪
২১. খুনি ম্যাজিক – ৫
২২. খুনি ম্যাজিক – ৬
২৩. খুনি ম্যাজিক – ৭
২৪. খুনি ম্যাজিক – ৮
২৫. খুনি ম্যাজিক – ৯

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন