সৈকত মুখোপাধ্যায়
বুধোদার ওইরকম ডোন্ট-পরোয়া হাবভাব দেখে একটু সাহস পেলাম। তাছাড়া স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার বাংলোটার মধ্যে বসে থাকতে থাকতে মনটা কেমন যেন ডিপ্রেসড হয়ে গিয়েছিল। এই রোদ ঝলমলে পাখি-ডাকা সকালে রাস্তায় বেরিয়ে সেটা অনেকটাই কেটে গেল। চার্চের রাস্তার চড়াই ধরে কিছুটা উঠতেই বাঁদিকে দেখতে পেলাম অনেক দূরে নীল আকাশের গায়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা-রেঞ্জ ঝলমল করছে।
প্রায় পাঁচশো-ফিট মতন চড়াই ভাঙার পরে রাস্তার দুপাশের পাইনবন একটু হালকা হয়ে এল। তার জায়গায় শুরু হল ঘাসজমি। ফুট চারেক উঁচু একটা পাঁচিল সেই জমিকে ঘিরে রেখেছিল। বুধোদা বলল, চার্চের এলাকা শুরু হল, বুঝলি।
পাঁচিলটা বেশি উঁচু নয়, তার ওপরে অনেক জায়গাতেই ভেঙে পড়েছে। তাই চলতে-চলতেই আমরা কম্পাউন্ডের ভেতরটা দেখতে পাচ্ছিলাম। যা দেখছিলাম, তাতে মনটা বেশ দমে যাচ্ছিল। পাহাড়ের ঢালে এদিকে-ওদিকে বেশ কয়েকটা একতলা বাড়ি। হয়তো এক সময় চার্চের যাজক এবং কর্মচারীদের বসবাসের জন্যেই সেগুলো বানানো হয়েছিল। কিন্তু এখন তার কোনোটাই আর আস্ত নেই। কাচভাঙা জানলাগুলোর ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছিল এই দিনের বেলাতেও বাড়িগুলোর মধ্যে অন্ধকার জমাট বেঁধে রয়েছে। দেয়ালে বড় বড় গাছ গজিয়ে গেছে। ছাদের টালিও খসে পড়েছে বেশিরভাগ জায়গায়। আর এই সব কিছুর ওপরে ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় কয়েকটা ওক-গাছ। তাদের ডালে অসংখ্য বাদুড় মাথা নীচু করে ঝুলে আছে।
বুধোদা নিজের মনেই মন্তব্য করল, সন্ধের পর জায়গাটার চেহারা কেমন হবে ভাবতে পারছিস?
আর ঠিক দুটো বাঁক পেরোনোর পরেই গির্জাটাকে দেখতে পেলাম। টিলার একদম চূড়ায় অনেকটা সমতল জমির ওপরে গির্জাটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমাদের বাঁ-পাশে পাঁচিলের গায়ে একটা মরচে পড়া লোহার গেট দেখতে পেলাম। গেট পেরিয়েই পাহাড়ের গা দিয়ে পাথরের সিঁড়ি উঠে গেছে। বেশি নয়, তিরিশ চল্লিশটা ধাপ হবে। সেই সিঁড়ি ধরে আমরা পৌঁছে গেলাম গির্জার বারান্দায়।
বড় বড় থামওলা বারান্দাটায় দাঁড়িয়ে চারপাশের একটা অদ্ভুত সুন্দর প্যানোরামিক ভিউ পাচ্ছিলাম। উঁচু-নীচু পাহাড় ঢেউয়ের মতন চলে গেছে দূরের স্নো-রেঞ্জ অবধি। আমাদের পায়ের নীচে কুকড়াঝোরা টি-এস্টেটের প্রায় জনশূন্য বস্তি আর কারখানা। ম্যানেজারের বাংলোটা দাঁড়িয়ে রয়েছে একেবারে উত্তর প্রান্তে। তার পরেই শুরু হয়েছে জঙ্গল। দক্ষিণদিকে তাকালে ছোট ছোট গ্রাম আর নতুন চা-বাগানগুলোকে দেখা যাচ্ছে, যেগুলো আমরা আসবার পথে পেরিয়ে এসেছিলাম। ওরই মধ্যে কোনো একটা হয়তো ডরোথি টি-গার্ডেন, যেখান থেকে নেকড়ে-মানুষ বাচ্চা তুলে নিয়ে গেছে।
বারান্দা ছেড়ে চার্চের ভেতরে ঢুকবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াতেই বুকটা ছাঁৎ করে উঠল।
দরজার দু-দিকের পাল্লায় দুটো হাত রেখে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। মানুষটা খুব রোগা আর তেমনই লম্বা। গায়ের রং কুচকুচে কালো। মাথায় কাকের বাসার মতন এলোমেলো চুল, তার পুরোটাই ধবধবে সাদা। গায়ে একটা পুরোনো রং-চটা খাঁকি রঙের সোয়েটার আর ঝলঝলে ফুলপ্যান্ট। উনি এক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
বুধোদাই প্রথম সামলে উঠল। ভদ্রলোকের দিকে দু-পা এগিয়ে গিয়ে বলল, আমার নাম বোধিসত্ত্ব মজুমদার। আমরা মিস্টার সুধাবিন্দু বসাকের একটা কাজ নিয়ে এখানে এসেছি।
ভদ্রলোকের মুখে একটা আলতো হাসি ফুটে উঠল। তিনি আমাদের দিকে দু-পা এগিয়ে এলেন। আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম, ওনার বয়সের ভার, ওনার স্যাবি জামাকাপড় সবকিছু ভেদ করে একটা জিনিস ফুটে বেরোচ্ছিল, যেটাকে বোধহয় এককথায় বলে আভিজাত্য। ভীষণ মায়া মাখানো ওনার চোখের দৃষ্টি, আর তেমনই সুন্দর ওনার হাসি।
নমস্কার। আমি জোসেফ। জোসেফ সুবিমল। নামটা কি আপনাদের কানে একটু অদ্ভুত ঠেকছে? আসলে আমার দাদু কুলি হিসেবে এই বাগানে কাজ করতে এসে খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। সেই থেকে আমাদের সবারই নামের প্রথমে একটা খৃস্টান নাম জুড়ে যায়। এখানকার লোকে অবশ্য আমার ফার্স্ট-নেম, মিডল-নেম, সার-নেম—সবই ভুলে মেরে দিয়েছে।
তারপরেই ভদ্রলোক বেশ ধাক্কা দেওয়ার মতন একটা কথা বললেন। বললেন,আপনাদের কাজটা কী? এই কপালপোড়া কুকড়াঝোরার সৎকার?
মানে? বুধোদার ভুরুদুটো দেখলাম কুঁচকে গেছে।
মানে বুঝলেন না? বাগানটা তো পাঁচবছর আগেই মরে গেছে। এখন তার শরীরের যেখানে যা পুরনো গয়নাগাটি রয়েছে সেগুলোকে খুলে নিতে হবে না? তারপরে তো তাকে কবর দেওয়া যাবে।
মিস্টার জোসেফের কথাগুলোর অর্থ বেশ তেঁতো, কিন্তু সেগুলো উনি বললেন মিষ্টি হাসিটা মুখে নিয়েই আর সেইজন্যেই খুব একটা রাগ করতে পারলাম না। বুধোদাও দেখলাম হেসে ফেলল। বলল, মোক্ষম ধরেছেন। গয়না খুলতেই এসেছি বটে। তবে আমরা খুলে না নিলে জিনিসগুলো যে নষ্ট হবে, এটা তো মানেন?
মিস্টার জোসেফ মুখে কিছু না বলে হাসতে হাসতে ওপর-নীচে ঘাড় নাড়লেন।
বুধোদা বলল, আমরা কী কাজে এসেছি, সেটা আপনি কেমন করে জানলেন?
কেন? ডাম্পির কাছ থেকে। ও-ই আমাকে ক’দিন আগে বলেছিল, মাস্টারসাব, কলকাতা থেকে দুজন অফসার আসছেন। বাংলার পুরানা সামানের তালাশ নেবেন।
আরেঃ! ওনার কথা শুনে আমরা দুজনেই চমকে উঠলাম। বুধোদা বলল, আপনিই মাস্টারসাব? এখানকার গরীব ছেলেমেয়েগুলোকে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন? প্রণাম আপনাকে।
আমরা দুজনেই হাতজোড় করে ওনাকে নমস্কার করলাম। উনি ভারি সঙ্কুচিত মুখে বললেন, না না। আমার পড়ানোর যোগ্যতা কোথায়? ওই যতদিন ওরা ছোট থাকে ততদিন একটু অঙ্ক, ইংরিজি, ইতিহাস, ভূগোল এইসব শেখাবার চেষ্টা করি আর কি।
জিগ্যেস করলাম, আপনি কতদিন ধরে এই কাজ করছেন?
উনি বললেন, ছিলাম আর্মির অফিসার। রিটায়ার করার পর কুকড়াঝোরায় চলে এলাম। সে প্রায় বিশবছর আগের কথা। তখন থেকেই এই বাগানের ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছি।
বুধোদা বলল— একটা কথা জিগ্যেস করি, কিছু মনে করবেন না যেন। কুকড়াঝোরায় ফিরে এলেন কেন? শহরে তো অনেক আরামে থাকতে পারতেন।
জোসেফ সুবিমল উত্তর দিলেন, নাড়ির টান। এখানেই তো আমি জন্মেছিলাম। অবশ্য দশ বছর বয়স হতে না হতেই আমার বাবা আমাকে কার্সিয়ঙের বোর্ডিং-স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তা না হলে হয়তো চা গাছ লাগিয়ে আর চায়ের পেটি বয়েই জীবন কাটত, যেমন ভাবে আমার বাপ দাদুর জীবন কেটেছিল। রিটায়ারমেন্টের পরে মনে হল, কুকড়াঝোরার এখনকার ছেলেমেয়েগুলোকে তো অন্তত একটু অন্যভাবে তৈরি করা যায়।
পেরেছেন?
পেরেছি।—বুক ফুলিয়ে বললেন মিস্টার জোসেফ সুবিমল। গত কুড়ি বছরে অনেকগুলো ছেলেমেয়েকে আমার ওই কুলিবস্তির ঘরে বসে প্রাইমারি এডুকেশন দিয়েছি। তারপর হায়ার-এডুকেশনের জন্যে নিজের খরচায় তাদের পাঠিয়েছি দার্জিলিং, কালিম্পং, শিলিগুড়ি, এমনকি আপনাদের কলকাতাতেও। আমার ছাত্রদের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার আছে, ডাক্তার আছে। টিচারও রয়েছে অন্তত পাঁচজন।
আমি আর বুধোদা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। একজন এক্স আর্মি-অফিসারের সঙ্গে জোসেফ সুবিমলের পোশাক-আশাকের মলিনতা ঠিক মেলাতে পারছিলাম না। এখন কারণটা বুঝতে পারলাম। পেনশনের সব টাকা এবং সম্ভবত জমানো টাকা-পয়সা সবই উনি খরচ করেছেন এখানকার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর কাজে। ওনাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে ইচ্ছে করছিল।
মিস্টার জোসেফ বললেন, চলুন, ভেতরে চলুন। এই গির্জায় অবশ্য আপনার মনের মতন কিছুই পাবেন না। একে তো এটা তৈরি হয়েছিল কুলিদের উপাসনা করার জায়গা হিসেবে। তার ওপর যেটুকু যা ফার্নিচার-টার্নিচার ছিল, সব নতুন গির্জা তৈরি হবার পর সেখানেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ফাঁকা বাড়িটা সাপ আর শেয়ালের রাজত্ব হয়ে পড়েছিল একশো বছর। আমি এখানে ফিরবার পর নিজের হাতে সাফসুতরো করতে শুরু করেছি, সেইজন্যেই আপনারা আজ ভেতরে পা রাখতে পারছেন।
ভেতরে ঢুকে দেখলাম, সত্যিই তাই। প্রেয়ার-হলের ভেতরে কয়েকটা পুরনো কাঠের ফার্নিচার ছাড়া আর কিছুই নেই। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করার পর মিস্টার জোসেফ বললেন, চলুন, বাইরে যাই।
হ্যাঁ, চলুন। আমি আর বুধোদা মিস্টার জোসেফের পেছন পেছন বাইরে বেরিয়ে এলাম। বুধোদা হঠাৎ বলল, এইরে, ক্যামেরা-ব্যাগটা ভেতরে ফেলে এসেছি। রুবিক, তোরা একটু দাঁড়া। আমি চট করে ব্যাগটা নিয়ে আসি।
আমি আর মিস্টার জোসেফ দাঁড়িয়ে রইলাম। বুধোদা ক্যামেরা-ব্যাগ নিয়ে ফিরে এল।
মিস্টার জোসেফ বললেন, একটু দাঁড়ান। এই দরজাটায় তালা লাগিয়ে দিই। তারপরে আপনাদের সঙ্গেই আমি ফিরব।
আপনি এখন কোথায় যাবেন? বুধোদা ওনাকে জিগ্যেস করল।
আমি? আমি তো আমার ঘরে ফিরব। কটা বাজে বলুন তো? নটা বেজে গিয়েছে, তাইনা? তাহলে তো আমার স্টুডেন্টদের আসার সময় হয়ে গেছে।
মিস্টার জোসেফ চার্চের দরজায় তালা লাগিয়ে ফিরে এলেন। বললেন, চলুন।
আমরা তিনজন একসঙ্গেই চার্চের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম।
ঘাসজমির ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, যে প্রশ্নটা অনেকক্ষণ থেকেই আমার মাথায় ঘুরছিল, সেই প্রশ্নটাই বুধোদা ওনাকে করে বসল। মিস্টার জোসেফ, এই পরিত্যক্ত চার্চে আপনি কী করতে আসেন?
মিস্টার জোসেফ অদ্ভুত দৃষ্টিতে বুধোদার দিকে তাকালেন। বললেন, জেরা করছেন?
বুধোদা হেসে বলল, জেরা করব কেন? আমি কি পুলিশ না ডিটেকটিভ? জাস্ট কৌতূহল। আপনার ইচ্ছে হলে উত্তর দেবেন, না হলে দেবেন না।
মিস্টার জোসেফ মাথা নিচু করলেন। মনে হল, বুধোদার সঙ্গে ওভাবে কথা বলার জন্যে উনি লজ্জিত। সত্যিই তাই। একটু বাদেই উনি বললেন, স্যরি মিস্টার মজুমদার। আসলে আমি কেন গির্জায় এসেছিলাম, কেন প্রতিদিন গির্জায় আসি, সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে যে প্রসঙ্গে ফিরে যেতে হয়, সেটা আমার কাছে খুব একটা সুখকর নয়।
বুধোদা কোনও কথা না বলে ওনার মুখের দিকে তাকাল। আমরা দুজনেই বুঝতে পারছিলাম, উনি আরো কিছু বলবেন। তবে যা বললেন তার জন্যে তৈরি ছিলাম না।
মিস্টার জোসেফ বললেন, প্রতিদিনের মতন আজও আমি এসেছিলাম আমার দাদুর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করতে। ওই কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আমি গত পনেরো দিনের প্রত্যেকটা দিন ‘অলমাইটি’র কাছে একটাই প্রার্থণা করে যাচ্ছি—প্রভু! আমার গ্র্যান্ডফাদারের আত্মাকে তুমি শয়তানের কবল থেকে ফিরিয়ে আন। তাঁকে মুক্তি দাও। একজন সরল আদিবাসীর আত্মা মৃত্যুর একশো পনেরো বছর পরেও নেকড়ে হয়ে দৌড়ে বেড়াবে, এটা মানা যায়? বলুন?
বুধোদা আর আমি দুজনেই চলা থামিয়ে মিস্টার জোসেফের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মিস্টার জোসেফও দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। ওনার সুন্দর মুখটা কোনো এক চাপা কষ্টে ভেঙেচুরে যাচ্ছিল। বুধোদা একটু বাদে খুব নিচু গলায় বলল, তার মানে আপনার পুরো নাম…।
জোসেফ সুবিমল তির্কে। দাদুর নাম হেনরি সুবেশ তির্কে। দাদুকে খুন করার পর অন্য লেবারদের চাপে আমার বাবাকে ওরা দেশ থেকে ডেকে এনে চাকরি দিয়েছিল। বাকিটা আপনি নিশ্চয়ই ডাম্পির মুখ থেকে শুনেছেন?
বুধোদা বলল, শুনেছি। কিন্তু বিশ্বাস করিনি। মনে হয়েছে আজগুবি গল্প।
আজগুবি গল্প নয় মিস্টার মজুমদার। সত্যিই গ্যাবন উইলিয়াম কিম্বা তার পাহারাদারকে একটা নেকড়েবাঘই মেরেছিল। উইলিয়াম সাহেবের কুকুরকেও নিশ্চয়ই সেই প্রেত-নেকড়েই তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এসব তো বাগানের সবাই জানে। অল দিজ আর রেকর্ডেড। আপনি মিস্টার বসাক কে জিগ্যেস করলেও জানতে পারবেন।
বুধোদা বলল, বেশ। মানলাম, মৃত্যুর পরে আপনার দাদু প্রেত-নেকড়ে হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু গত একশো-পনেরো বছরে তাকে তো আর দেখা যায়নি। তার মানে তাঁর আত্মার সৎগতি হয়ে গিয়েছে।
নো নো নো নো নো! পাগলের মতন সাদা চুলে ভরা মাথাটা দুদিকে ঝাঁকাতে শুরু করলেন মিস্টার জোসেফ সুবিমল তির্কে। আই হ্যাভ সিন হিম…আই হ্যাভ সিন দ্যাট বিস্ট। ইট ওয়জ ওনলি আ ফোর্টনাইট এগো।
মানে! আপনি পনেরোদিন আগে সেই প্রেত-নেকড়েকে দেখেছেন! বুধোদা বলল।
হ্যাঁ, দেখেছি। কাল রাতেও দেখেছি, ওনার কবর থেকে বেরিয়ে এসে সেই বিশাল কালো জন্তুটা বিদ্যুতের মতন ছুটে গেল ডরোথি চা-বাগানের দিকে। তারপর কী হয়েছে শুনেছেন নিশ্চয়?
চারিদিকে আলো। গাছে গাছে পাখি ডাকছে। তবু আমার শিরদাড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। মনে পড়ল, গতরাতে বাংলোর পেছনের দরজায় সেই আঁচড়ের শব্দ। সেই থাবার ছাপ। কুকড়াঝোরার প্রেত-নেকড়ে কি সত্যিই তাহলে ফিরে এসেছে? কেন? এতবছর বাদে আবার কেন তার ঘুম ভাঙল?
যেন আমার মনের প্রশ্ন বুঝতে পেরেই মিস্টার জোসেফ বললেন, হি ইজ একসাইটেড ফর সাম রিজনস। আমি মোট তিনবার সেই ছায়াশ্বাপদকে দেখেছি। প্রত্যেকবারই মনে হয়েছে সে যেন কি এক অস্থিরতায় ছটফট করে বেড়াচ্ছে। মিস্টার মজুমদার, আপনি কি জানেন, কুকড়াঝোরার চা-বাগানের নতুন মালিকেরা এই চার্চের জমি নিয়ে কী করবে? হয়তো এই সব ভেঙেপড়া ঘরবাড়ির জায়গায় নতুন ঘরবাড়ি উঠবে। নতুন রাস্তা হবে, গাড়ি ছুটবে। ঘুমিয়েপড়া প্রেত-নেকড়ে কি বুঝতে পেরেছে, এক ভয়ঙ্কর অশান্তির দিন আসছে? সেইজন্যেই কি সে বিচলিত?
কথা বলতে বলতে আমরা চার্চের বাউন্ডারি-ওয়ালের গায়ে বসানো সেই মরচেধরা লোহার গেটটার সামনে চলে এসেছিলাম। গেটের বাইরেই রাস্তা, আর রাস্তার উলটোদিকেই আরেকটা পাঁচিলঘেরা জমি। ওটা যে কিসের জমি সেটা কাউকে বলে দিতে হয় না। পুরো জায়গাটা জুড়েই সবুজ ঘাসের ওপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে সারি সারি পাথরের ক্রশ। ওটা কবরখানা।
বুধোদা রাস্তা পেরিয়ে ওই জমিটায় ঢুকবার মুখে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর বলল, মিস্টার জোসেফ, আমার একটা অনুরোধ আছে। একবার আপনার দাদুর কবরের কাছে আমাদের নিয়ে চলুন।
কেন?
এমনিই। শুধু একবার কবরটাকে দেখব। বিশ্বাস করুন, আপনার বিশ্বাসের অসম্মান করব না। দূর থেকে একবার দেখেই চলে আসব।
না, সম্ভব নয়।
যে মানুষ কিছুক্ষণ আগেই অমন হাসিমুখে কথা বলছিলেন, সেই মুখই যে মুহূর্তের মধ্যে এমন কঠিন হয়ে যেতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না।
মিস্টার জোসেফ! এবার বুধোদার মুখও কঠিন। আপনি জানেন আমরা এই বাগানের মালিকের গেস্ট। ইচ্ছে করলে এই কম্পাউন্ডের মধ্যে যে কোনও জায়গায় আমরা যেতে পারি। তার জন্যে আপনার পারমিশন লাগবে না।
বুধোদার কথা শুনেই মিস্টার জোসেফ এগিয়ে এসে ওর হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বললেন, পারেন, নিশ্চয়ই পারেন। কিন্তু প্রভু যীশুর দোহাই, যাবেন না। তাতে আপনাদেরই ক্ষতি হবে।
কিসের ক্ষতি, মিস্টার জোসেফ? এই দিনের বেলায়, পরিষ্কার মাঠের মধ্যে…এখানে কি সেই প্রেত-নেকড়ে উঠে আসবে? এটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের কল্পনা হয়ে যাচ্ছে না?
মিস্টার জোসেফ বললেন, একটু বুঝবার চেষ্টা করুন। হয়তো আমি ওনার বংশধর বলেই আমাকে উনি সহ্য করেন, কিন্তু আপনারা এসেছেন বাগান বিক্রির কাজে হেল্প করতে। আপনাদের উনি ছেড়ে দেবেন না। দ্যাট বিস্ট উইল অ্যাটাক ইউ…অ্যাটাক ইউ ফর সিওর।
উনি ভয়ার্ত চোখে চার্চের দিকে তাকালেন। ওনার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে আমিও ওইদিকে তাকালাম। অজস্র আলোর মধ্যেও চার্চের বারান্দা, জানলা, ঘণ্টাঘর আর চুড়োর ঘড়ির গর্তে চাপ-চাপ অন্ধকার জমাট বেঁধে রয়েছে। মনে হচ্ছিল, ওই অন্ধকারের আড়াল থেকে একজোড়া সবুজ চোখ আমাদের লক্ষ্য করছে। বুধোদাও দাঁড়িয়ে পড়েছিল। আমার মতনই ও একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল চার্চের দিকে।
একটু পরে বুধোদা বলল, চলুন তাহলে। কী আর করা যাবে? আমাকে বলল, চল রুবিক। মাস্টারসাব যখন আমাদের ওনার দাদুর কবর দেখতে দেবেন না, তখন ওনার ইসকুলটাই দেখে আসি।
বুধোদার এই কথায় ওদের দুজনের মধ্যে যে টেনশনটা তৈরি হয়েছিল, সেটা কেটে গেল। মিস্টার জোসেফ একগাল হেসে বললেন, তাই চলুন। আপনি দেখবেন, বারোটা ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, খেতে না পাওয়া চেহারা, চুলে তেল নেই, জামার বোতাম অর্ধেক ছেঁড়া। তবু ওদের চোখগুলো কি ব্রাইট। সত্যি মিস্টার মজুমদার, এই লাস্ট ব্যাচটাকে অন্তত ক্লাস টেন অবধি হস্টেলে রেখে পড়ানোর খরচা যদি কোথাও থেকে পেতাম, তাহলে আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারতাম।
বুধোদা বলল, মিস্টার বসাকদের বললেন না কেন, ওদের জন্যে কিছু ব্যবস্থা করতে?
বলেছিলাম। ওনারা রাজি হননি। স্বাভাবিক। কুকড়াঝোরা তো আর লাভের ব্যবসা নয়। এখানে কেন এইসব ওয়েলফেয়ারের কাজে ওনারা পয়সা নষ্ট করবেন?
ফেরবার সময় উতরাইয়ে নামছিলাম, তাই দশ মিনিটের মধ্যে কুলিবস্তির কাছে পৌঁছে গেলাম। আট-ন বছরের কয়েকটা ছেলেমেয়ে মিস্টার জোসেফের কোয়ার্টারের বন্ধ-দরজার সামনে ভীড় জমিয়ে একটা টালি-র টুকরো ছুঁড়ে ছুঁড়ে চু-কিতকিতের মতন কী একটা খেলা খেলছিল। আমাদের দেখেই ওরা শান্ত হয়ে একদিকে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর একসঙ্গে সুর করে বলল, নমস্তে মাস্টারজী, নমস্তে আঙ্কল, নমস্তে ভাইয়া।
এত মিষ্টি লাগল বাচ্চাগুলোর এই সুরেলা সম্ভাষণ যে, কী বলব! মিস্টার জোসেফ ঘরের দরজার তালা খোলা মাত্র ওরা লাইন দিয়ে ঘরে ঢুকে মেঝের ওপর বসে পড়ল। মিস্টার জোসেফ একটা বছর তিনেকের বাচ্চাকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, ইনি কে জানেন? ইনি হলেন মিস্টার গাপ্পি মাহাতো। ডাম্পি মাহাতোর ছেলে। এ ব্যাটা পড়াশোনা করে না, কিন্তু সারাদিন আমার ঘরেই পড়ে থাকে। খুব গুন্ডা, ঘরদোর পুরো তছনছ করে দেয়। খুব ইনটেলিজেন্ট কিন্তু। বাবু, একটু আঙ্কলদের ব্যা ব্যা ব্ল্যাকশীপটা শুনিয়ে দাও তো।
ডাম্পি মাহাতোর ছেলে গাপ্পি সঙ্গে সঙ্গে আধো আধো উচ্চারণে আমাদের ব্যা ব্যা ব্ল্যাকশীপ শুনিয়ে দিল। এত লাভলি বাচ্চাটা, আমি মাস্টারসাবের কাছ থেকে ওকে নিজের কোলে নিয়ে নিলাম। তারপর বললাম, বাবার কাছে যাবি?
গাপ্পি এত বড় করে ঘাড় হেলাল। বাবার কাছে যাওয়ার নামে কোন বাচ্চাই বা আপত্তি করে? ডাম্পিভাইয়ে বউও আমাদের সঙ্গে আলাপ করার জন্যে পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। সেও বলল, নিয়ে যান তো দাদা। সকাল থেকে এত জ্বালাচ্ছে, আমাকে ঘরের কোনও কাজ করতে দিচ্ছে না। ওকে ওর বাবার কাছেই দিয়ে দিন।
বুধোদা বলল, তুই তাহলে বাংলোয় ফিরে যা রুবিক। আমি একটু কম্পাউন্ডের বাইরে বেরিয়ে দেখি, মোবাইলের সিগনাল পাওয়া যায় কিনা। মিস্টার বসাকের সঙ্গে কয়েকটা ব্যাপারে কথা বলা দরকার।
আমি গাপ্পিকে কোলে নিয়ে বাংলোর দিকে রওনা হলাম। গাপ্পি বেশ আমার কোলে চেপে চলছিল। পাখি, বাঁদর, মেঘ, পাহাড় যা দেখাচ্ছিলাম তাই বড় বড় চোখ করে দেখছিল আর নিজের মনে বকবক করছিল। কিন্তু একটু বাদেই ছটফট করতে শুরু করল। বললাম, কী হল রে?
লাগছে।
লাগছে! কোথায়?
গাপ্পি নিজের কোমরের দিকটা দ্যাখাল। সত্যিই কি যেন একটা শক্ত মতন জিনিস আমার বুকেও বিঁধছিল। ওকে কোল থেকে নামিয়ে ওর হাফপ্যান্টের পকেটের মধ্যে হাত চালিয়ে দিলাম। দেখলাম একটা গোল মেটালের চাকতি। দেখে মনে হল পেতলের তৈরি। ওপরের কিনারা বরাবর ইংরিজিতে ‘কুকড়াঝোরা টি-গার্ডেন’ কথাটা লেখা রয়েছে। মাঝখানে একটা ফুটো। দেখে মনে হল ডাম্পিভাইয়ের ইউনিফর্মের বুকে লাগিয়ে রাখার ব্যাজ। বিচ্ছু ছেলেটা বাবার ব্যাজ পকেটে পুরে নিয়ে চলে এসেছে। ওইটাই ওর কোমরে বিঁধছিল।
আমি চাকতিটা নিজের প্যান্টের পকেটে রেখে আবার ওকে কোলে তুলে নিলাম। বাংলোয় ফিরে এটা ডাম্পিভাইকে দিয়ে দেব।
বাকি রাস্তাটা গাপ্পি বেশ সুন্দর চলে এল। আর কোনো ঝামেলা করল না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন