সৈকত মুখোপাধ্যায়
‘বাড়িতে এল’ বলাটা অন্যায় হচ্ছে। বলা উচিত ‘বাড়িতে পদার্পণ করল’।
এমন বিশাল একটা গাড়িতে চেপে সুবিনয় এল, যেটা আমাদের গলিতে ঢুকতেই পারল না, গলির মুখে দাঁড়িয়ে রইল। সুবিনয়ের গায়ে লাল সিল্কের আলখাল্লা, গলায় মোটা সোনার চেন। দশ আঙুলে পনেরোটা আংটি। চারটি মস্তান ওকে চারদিক দিয়ে আগলে নিয়ে আমার বসার ঘর অবধি পৌঁছে দিয়ে গেল। তারপরেও তারা চলে গেল না। দরজার বাইরে শিকারি কুকুরের মতন খাপ পেতে বসে রইল। সুবিনয়ের যে এত সিকিউরিটির প্রয়োজনটা হয় কিসে সেটা তখন বুঝতে পারিনি। পরে বুঝেছি।
যাই হোক, আমার বন্ধুপুত্র একটা হাত কোনোরকমে কপালে ছুঁইয়ে আমাকে নমস্কার করল। তারপর কিছুক্ষণ একথা-সেকথার পর বলল, কাকাবাবু, ঘরদোরের চেহারা দেখে বুঝতে পারছি, কষ্টের মধ্যে আছেন। এক কাজ করুন, এই বাড়িটা আমাকে বিক্রি করে দিন। এরকম একটা দোতলা বাড়ি মেইনটেইন করারও তো খরচ আছে। যা দাম আপনাকে দেব তাতে আপনি খুব ভালো লোকালিটিতে একটা ফ্ল্যাট তো কিনতে পারবেনই, তারপরেও আপনার হাতে আরও অনেকগুলো টাকা থেকে যাবে।
স্বাভাবিকভাবেই যে-প্রশ্নটা মনে এল সেটাই ওকে করলাম। বললাম, সুবিনয়, তোমার যদি ছোটবেলার পাড়ায় ফিরে আসতেই মন চায় তাহলে তোমার নিজের পুরোনো বাড়িটাই আবার কিনে নিচ্ছ না কেন?
সুবিনয় একটু থতমত খেয়ে বলল, ওদের পুরোনো বাড়িটা বড্ড ছোট। তাছাড়া বাস্তুশাস্ত্র মতে আমার বাড়িটাই নাকি ওর তন্ত্র-সাধনার পক্ষে উপযুক্ত।
সত্যিকথাই বলছি মিস্টার মজুমদার, সুবিনয়ের প্রস্তাবটা আমার বেশ মনে ধরেছিল। সত্যিই, দাদুর আমলের বাড়িটার পেছনে আমার রেগুলার অনেক টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া অতবড় বাড়িটায় আমার স্ত্রীয়ের স্মৃতি জড়িয়ে একা-একা পড়ে থাকার একটা মানসিক কষ্টও যে রয়েছে, সেটাতো বোঝেন। তাই আমি ওর প্রস্তাবে প্রায় রাজিই হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তারপরেই ও যে কথাটা বলল, সেটা চমকে যাওয়ার মতন। ও বলল, কাকাবাবু, বাড়িটা কিন্তু আমি কিনবো সমস্ত পুরোনো ফার্নিচার আর অন্যান্য পুরোনো জিনিসপত্র সমেত। আপনি জামাকাপড়, গয়নাগাটি আর কাগজপত্র নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু আর কিছু না।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছি দেখে ও তাড়াহুড়ো করে বলল, তার জন্যে নিশ্চয় আমি আপনাকে আলাদা দাম দেব। যা বাজারদর তার থেকে বেশিই দেব। আপনি ঠকবেন না।
আমি ওকে বেশ কয়েকবার জিগ্যেস করলাম, এরকম অদ্ভুত ইচ্ছের কারণটা কী। এমন কী রয়েছে আমার সস্তা আর ভাঙাচোরা জিনিসপত্রের মধ্যে যাতে ও সেগুলো অত দাম দিয়ে কিনতে চাইছে? সুবিনয় স্পষ্ট কোনো উত্তর না দিয়ে আবার সেই বাস্তুশাস্ত্র আর হাবিজাবি নিয়ে পড়ল। বাড়িটাকে নাকি বদলানো চলবে না। ও বলল, উনিশে সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার শুভদিন আছে। সেদিনই ও বিক্রির কাগজে সই করাতে আসবে। আমাকে টাকাপয়সা দিয়ে বাড়ির দলিলটাও সেদিনই নিয়ে যাবে।
বুধোদা কিছুক্ষণ দুই-হাতের মধ্যে থুতনি রেখে কী যেন চিন্তা করল। তারপর বলল, আপনি আমাকে কী করতে বলছেন মিস্টার রক্ষিত?
প্রতাপবাবু একটু সঙ্কোচের সঙ্গে বললেন, যেটা করতে অনুরোধ করছি, সেটা আপনাকে বলা মানায় কিনা জানি না। কিন্তু আমার আর কোনো উপায় নেই। দেখুন, সুবিনয়ের কথাবার্তা শুনে আমার সন্দেহ হচ্ছে, আমার বাড়িতে এমন কিছু জিনিস রয়েছে যেটা খুব দামি। তা না হলে সুবিনয় অমন প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছে আসত না।
বুধোদা বলল, তা নাও হতে পারে। সত্যিই হয়তো এটা সুবিনয়বাবুর একটা খেয়াল। অযোগ্য লোকের হাতে হঠাৎ পয়সা এসে গেলে তাদের মাথায় এরকম নানান বদখেয়াল চাপে।
প্রতাপবাবু বললেন, কিন্তু বাস্তু-টাস্তু টাইপের কোনো কুসংস্কারের ব্যাপার হলে কি আর কাগজপত্র গয়নাগাটির মতন জিনিসগুলোকে ছাড় দিত? বলত, সবকিছুই রেখে যান।
বুধোদা একটু চিন্তা করে বলল, সেটা ঠিক।
আমি আর থাকতে না পেরে জিগ্যেস করলাম, আচ্ছা বুধোদা, একটা কথা বলো তো। যে জিনিসের কথা প্রতাপদাদু জানেন না, সে জিনিসের কথা সুবিনয়বাবু কেমন করে জানবেন?
বুধোদা বলল, এটার একটাই ব্যাখ্যা হয়। সুবিনয় মুস্তাফি জেনেছেন তার দাদু, মানে তারাপদ মুস্তাফির কাছ থেকে। দাদুর মুখের কথায় নয়, তার কোনো লেখা থেকে। হয়তো তারাপদ মুস্তাফির ডায়েরি খুঁজে পেয়েছেন। পেয়েছেন রিসেন্টলি, সেইজন্যেই কাজে নামতে এতদিন সময় লেগে গেল।
আমি বললাম, আরেকটা ব্যাপার আমার মাথায় ঢুকছে না। যদি সুবিনয়বাবু জেনেই থাকেন প্রতাপদাদুর বাড়িতে সেরকম দুর্মূল্য কোনো জিনিস রয়েছে, তাহলে সরাসরি সেটুকুই কিনতে চাইছেন না কেন? একটা জিনিসের জন্যে পুরো বাড়িটাই কিনতে চাওয়া একটু বাড়াবাড়ি নয়?
বুধোদা বলল, জিনিসটা যে ওনার হস্তগত হয়েছে, মুস্তাফিমশাই সেটা সারা দুনিয়াকে জানাতে চান না। আর তার প্রথম স্টেপ হচ্ছে স্বয়ং মালিক, মানে প্রতাপবাবুকেই জিনিসটার পরিচয় বুঝতে না দেওয়া। অ্যান্টিকের ব্যবসায় এটা খুব কমন প্র্যাকটিশ। একটা জিনিস অধিকার করে তারপর চুপচাপ বসে থাকা। জিনিসটার সম্বন্ধে মানুষের আগ্রহ বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁলে তখন সেটাকে বিক্রির জন্যে বার করা। পুরোনো পেইন্টিং-এর ক্ষেত্রে এটা প্রায়ই হয়। তুই জানিস ভ্যান গগের একটা পেইন্টিং রয়েছে। ভালো অবস্থাতেই রয়েছে। কিন্তু কার কাছে রয়েছে তুই অনেক চেষ্টা করেও জানতে পারবি না, যতক্ষণ না ওয়ান-ফাইন-মর্নিং ক্রিস্টি কিম্বা সদবীর নিলামখানায় সেই ছবিটা নিলামে উঠছে।
প্রতাপবাবু যেভাবে খুশি-খুশি মুখে ঘাড় নাড়ছিলেন, তাতে বুঝতে পারলাম, বুধোদার ব্যাখ্যাগুলো ওনার বেশ মনঃপুত হয়েছে।
বুধোদা হঠাৎ প্রতাপবাবুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, আপনার বাড়িতে সেরকম কোনো পুরোনো জিনিস রয়েছে কি, যার একটা অ্যান্টিক-ভ্যালু থাকতে পারে?
একশো বছরের পুরোনো বাড়ি। কিছু পুরোনো জিনিস তো থাকবেই। তবে সোনা হিরে আইভরির মতন কিছুই নেই। আমার পূর্বপুরুষেরাও অত্যন্ত সাধারণ লোক ছিলেন।
বুধোদা বলল, তা হোক। যা আছে আপনি এক-এক করে সেগুলোর নাম বলে যান, আমি শুনি। রুবিক, তুইও মন দিয়ে শোন।
প্রতাপবাবু একটু চোখ বুজে ভাবলেন। তারপর বললেন, কয়েকটা জিনিস রয়েছে যেগুলোকে বলা যায় আমার দাদুর স্মৃতিচিহ্ন—একটা ভাঙা এসরাজ আর একটা গড়গড়া। পকেটঘড়ি। ফাউন্টেন পেন। ঠাকুমার কিছু সোনার গয়না…কিন্তু না। সুবিনয় তো গয়না নিতে চায়নি। আচ্ছা যে-জিনিসগুলোর কথা বললাম, সেগুলোর কি কোনো অ্যান্টিক ভ্যালু রয়েছে মিস্টার মজুমদার?
রয়েছে, তবে খুবই সামান্য। ওর জন্যে সুবিনয় মুস্তাফি আপনার বাড়ি কিনতে চাইবে না।
বাবার কথা তো আপনাকে বললামই। যে মানুষটা মাত্র আঠাশ বছর বয়সে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন, আর ফিরতে পারেননি, সংসারে তার আর ক’টা জিনিস থাকবে? একটা খাট, আলনা, আর একটা কাঠের আলমারি। একটা ফিলিপস কোম্পানির রেডিয়ো রয়েছে, খোদ হল্যান্ডে তৈরি। এখনো দিব্যি গান শোনা যায়। এসব জিনিস আমি জ্ঞান হওয়া ইস্তক দেখছি।
আর কিছু?
প্রতাপবাবু একটু চিন্তা করে বললেন, ও হ্যাঁ। জার্মানি যাওয়ার সময় ম্যাজিক দেখানোর যে-সরঞ্জামগুলো বাবা নিয়ে যাননি, সেগুলো একটা বড় ট্রাঙ্কের মধ্যে রাখা আছে। মায়ের ভয়ঙ্কর আপত্তি ছিল ওগুলোতে হাত দেওয়ার ব্যাপারে। আসলে মায়ের ধারণা ছিল, বাবার অকালমৃত্যুর জন্যে দায়ী ওই ম্যাজিক। কাজেই আমাকে যথাসাধ্য ম্যাজিকের সঙ্গে যোগ রয়েছে এরকম সবকিছুর থেকে মা আড়াল করে রাখতেন। এমনকী তারাপদকাকাকেও বারণ করে দিয়েছিলেন বাবার ম্যাজিক নিয়ে কোনো কথা আমার সামনে যেন না বলেন। আমি মায়ের ইচ্ছে মেনে নিয়েছিলাম। কখনো ম্যাজিক দেখাইনি, তাই ওসব জিনিস ব্যবহারও করিনি। তবে বাক্সটায় কী-কী রয়েছে জানি। তাসের প্যাকেট, সিল্কের রুমাল, প্রমাণ-সাইজের লুডোর ছক্কা, ফেদার-ডাস্টার। কিছু পুরোনো রুপোর কয়েন রয়েছে। ম্যাজিক দেখাতেই কাজে লাগত নিশ্চয়।
বুধোদা বলল, শুনে তো মনে হচ্ছে না এগুলোর মধ্যেও কোনো অ্যান্টিক থাকতে পারে। আচ্ছা, আপনার বাবার লেখা কোনো ডায়েরি কিম্বা চিঠিপত্র আছে কি, যেগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোনো অজানা কনস্পিরেসির ওপর আলো ফেলতে পারে?
প্রতাপবাবু বললেন, কিছু চিঠির কথা তো আপনাকে আগেই বলেছিলাম। তবে প্রথমত চিঠিগুলো নিতান্তই ঘরোয়া—একজন স্ত্রীকে লেখা তার প্রবাসী স্বামীর চিঠি। আর দ্বিতীয়ত, সুবিনয় কিন্তু কাগজপত্র চায়নি। গয়নাগাটিও নয়। চিঠি বা ডায়েরি তো আমি নিয়েই যেতে পারি।
আর আপনার কেনা জিনিসপত্রের মধ্যে সেরকম কিছু…?
প্রতাপবাবু শুকনোমুখে বললেন, একজন সামান্য স্কুলমাস্টারের কেনা সস্তার টিভি, বেতের চেয়ার, কাচের ফুলদানি বা পাখির খাঁচার কী-ই বা অ্যান্টিক-ভ্যালু থাকতে পারে বলুন। না মিস্টার মজুমদার, আমি নিশ্চিত, ওগুলোর জন্যে সুবিনয় আমার বাড়িতে হানা দেয়নি।
বুধোদা সোফা ছেড়ে উঠে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ওখান থেকেই প্রতাপবাবুর উদ্দেশে বলল, সুবিনয় মুস্তাফি আপনার বাড়িতে এসেছিলেন পাঁচই সেপ্টেম্বর। উনি আবার আসবেন উনিশে সেপ্টেম্বর। মিস্টার রক্ষিত! সোম থেকে শনি আমার প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে কাটে। আমি যদি সামনের রবিবার মানে পনেরোই সেপ্টেম্বর বিকেলের দিকে একবার আপনার বাড়িতে যাই, আপত্তি আছে?
না-না, কী যে বলেন! আপত্তি থাকবে কেন? আপনি আমার উপকার করতেই আসছেন তো। আপনি আসবেন, একশোবার আসবেন। রুবিকভাইকেও সঙ্গে নিয়ে আসবেন। আমি সাধারণত বাড়ি থেকে বেরোই-টেরোই না। তবু কাছাকাছি এসে একটা ফোন করে দেবেন। আমার ঠিকানাটা…।
রুবিক, ওনার ঠিকানাটা তোর মোবাইলে সেভ করে রাখ। আর আমার গাড়িটা নিয়ে ওনাকে একটু উত্তরপাড়া স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আয়।
আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। বুধোদা পেছন থেকে প্রতাপবাবুকে ডেকে বলল, মিস্টার রক্ষিত, আপনি একা থাকেন। যদি দেখেন সুবিনয় মুস্তাফির চ্যালাচামুন্ডারা আপনার কোনো অসুবিধে সৃষ্টি করছে তাহলে আমাকে একবার ফোন করবেন। বড়বাজার থানার ওসি সুজন সরকারের সঙ্গে আমার খুব ভালো আলাপ রয়েছে। আমি ওদের থামানোর ব্যবস্থা করব।
হঠাৎ করেই প্রতাপদাদু এতক্ষণের ‘আপনি-আজ্ঞে’ ভুলে বুধোদার হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন, বেঁচে থাকো বাবা। আমি বুঝতে পারছি, তুমি যা করছ এই অসহায় বৃদ্ধের মুখ চেয়েই করছ। না-হলে তোমার কী দায় পড়েছিল বলো। বেঁচে থাকো।
উনি চশমা খুলে পাঞ্জাবির খুঁটে চোখ মুছছিলেন। বুধোদা শান্তগলায় বলল, দায় একটা আছে বইকি মিস্টার রক্ষিত। একজন বিস্মৃত শিল্পীর প্রতি, একজন বড় মাপের মানুষের প্রতি উত্তরসূরীর দায়। সামনের রবিবার আমি তো শুধু আপনার বাড়িই যাচ্ছি না। যাচ্ছি প্রিন্স রাজনের বাড়ি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন